বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং আমাদের ঐতিহ্য

লিখেছেন:অরিজিত চট্টোপাধ্যায়

১. 

একুশ শতকের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময় কেটে গেলেও বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে ভারতবর্ষের বন্যপ্রাণ ও তার সংরক্ষণ সংক্রান্ত ধারণার খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ নাগরিকেরা বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে নিজেদের লিবারাল প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও, তাদের মধ্যে পরিবেশ, বন্যপ্রাণ ও তার সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিস্তারিত পর্যালোচনার যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যায়। খুব সোজা ভাষায় বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলে বলতে হয় এখনও বেশীরভাগ মানুষের কাছে বন্যপ্রাণ বলতে চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে ওঠে বাঘ, সিংহ, হাতি বা কুমির জাতীয় বড়সড় জমকালো প্রাণীদের কথা, আর সংরক্ষণ বললেই মাথায় আসে এইসব প্রাণীদের মানুষের নাগাল থেকে দূরে নিজেদের পছন্দের বিচরণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্যের মধ্যে নির্দিষ্ট নজরদারিতে আবদ্ধ রাখা। কারণ এটাই সার্বজনীন বিশ্বাস। বন্য জীবজন্তুর সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে মানুষ, আর যদি বন্যপ্রাণকে বাঁচাতে হয় তাহলে এদেরকে শহর বা গ্রাম অর্থাৎ মানুষের সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে সংরক্ষণের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই আজ থেকে  প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে একের পর এক জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, টাইগার রিজার্ভ ইত্যাদি গড়ে ওঠে। 

বিষদে বলতে গেলে এই সংরক্ষিত এলাকাগুলো আর কিছুই নয় এগুলো হল একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা অরণ্য, জলাশয়, মরুভূমি বা অন্য যে কোনো ইকোসিস্টেম হতে পারে, শুধু পরিবেশগত দিক থেকে অর্থাৎ ইকোলজিকালি তার কোন না কোন গুরুত্ব থাকতে হবে। এখানে বসবাসকারী প্রাণী ও তাদের পছন্দের থাকার জায়গাকে টিকিয়ে রাখাই এই জাতীয় সংরক্ষণ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য। সেই কারণেই নির্দিষ্ট হুকুমনামা ছাড়া এই সব অংশে মানুষের অনুপ্রবেশ এবং সেখানকার যেকোনরকম সামগ্রীর ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই এলাকাগুলিতে সাধারণভাবে সেই সব প্রাণীদেরই অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় যাদের সংখ্যা পৃথিবীতে কমে গেছে, বিলুপ্তপ্রায় বা অদূর ভবিষ্যতে যাদের চিরতরে হারিয়ে যাবার কোন আশঙ্কা রয়েছে। যেমন বাঘের সংখ্যা সত্তরের দশকের পর থেকে হু-হু করে কমতে থাকায় কানহা, বান্ধবগড় বা তাডোবার মত জঙ্গলকে জাতীয় উদ্যানে পরিবর্তিত করা হয়, যেখানে বাঘের সংরক্ষণই মূল উপজীব্য; তবে শুধু বিপন্ন প্রাণীদেরই নয় তার সাথে কিছু কিছু ইকোলজিকালি গুরুত্বপূর্ণ হ্যাবিটাটকেও এই সংরক্ষণ পদ্ধতির আওতায় আনা হয়েছে, যেমন - ভরতপুরের মত গাছে ঢাকা জলাভূমি বা গাল্ফ অফ মান্নারের কোরাল রিফ ইত্যাদি। 

তবে একটু গভীরে তলিয়ে দেখলেই এই পদ্ধতির ফাঁফোকরগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভারতের মোট স্থলভাগের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ এই সরকার নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষিত অঞ্চলের মধ্যে পরে। আর সারাদেশের ৮৭০ টা সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে মাত্র ২৫ টার আয়তন ১০০০ বর্গ কিমি বা তার বেশি, যেখানে আফ্রিকায় কেবলমাত্র তানজানিয়ার সেলাস গেম রিসার্ভের আয়তনই ৪০,০০০ বর্গ কিমি. (এনভিস সেন্টার অন ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড প্রোটেকটেড এরিয়া ২০১৯)। সুতরাং বলাই বাহুল্য বন্যপ্রাণের জন্য নির্দিষ্ট এই অংশ ভারতের মত প্রকাণ্ড জৈববৈচিত্র্য পূর্ণ দেশে (ভারত পৃথিবীর একটি মেগা ডাইভারসিটি দেশ) সংরক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই নগণ্য। 

২. 

এখানে বলে রাখা দরকার এত নিয়ম কানুন চাপিয়েও সবসময় যে এই সব বিপন্ন প্রাণী বা তাদের স্বাভাবিক হ্যাবিটাটগুলোর নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। গুজরাটের গির অভয়ারণ্য থেকে মাত্র ছয় কিমি দূরে প্রায়  প্রায় চারশো হেক্টরের বেশি জায়গা জুড়ে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের সব রকম অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারি তরফ থেকে। কাগজে কলমে দেখান হয়েছে এই অঞ্চলটি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে পরে না তাই এটা সিংহের বিচরণক্ষেত্রও নয়। তবে বহু বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে গির অঞ্চলে যত সিংহ আছে তার প্রায় এক চতুর্থাংশই মানুষ নির্ধারিত সংরক্ষিত এলাকার বাইরে ঘুরে বেড়ায় (দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২০১৮)। 

এছাড়া ‘ডাউন টু আর্থ’ গোষ্ঠী ২০১৭ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে (স্টেট অফ ইন্ডিয়া’স এনভাইরনমেন্ট ২০১৭ ইন ফিগারস) জানায় ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সারা দেশে ওয়াইল্ডলাইফ সংক্রান্ত ক্রাইমের বৃদ্ধি ঘটেছে প্রায় ৫২%। এই তিন বছরে মোট ৩০,৩৮২ টি বেআইনি বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত চোরাচালান এবং চোরাশিকারের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে এবং কেবলমাত্র ২০১৬ সালে চোরাশিকারিদের হাতে ৫০ টির বেশী বাঘের মৃত্যু হয়েছে যা গত এক দশকে সর্বাধিক। বজ্র আঁটুনির ফসকা গেরো মনে হয় একেই বলে। সরকারি রাজকোষের এক বিশাল অংশ এবং এক বিপুল কর্মীসংখ্যা দেশের এই মাত্র পাঁচ শতাংশ অংশের জন্যে নির্দিষ্ট করেও বন্যপ্রাণীদের জন্য যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যা এই তথাকথিত সংরক্ষণ ব্যবস্থার সামগ্রিক ফলাফলের ওপর এক বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

যেকোনো বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সবসময় বাঁধাধরা প্রেক্ষিত থাকেনা, যা স্থান-কাল-পাত্র-সংস্কৃতি প্রভৃতির সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। তাই নির্দিষ্ট করে দেওয়া বিধিনিষেধ কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজে দিলেও বৃহৎ প্রেক্ষিতে তার প্রভাবের রূপান্তর লক্ষণীয়। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ তার থেকে আলাদা কিছু নয়। আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার বাস্তবায়নের সময় তাই কয়েনের এক পিঠের দিকে চূড়ান্ত মনোনিবেশ করতে গিয়ে, অন্য পিঠের অবস্থা আসলে কি, সেটা অজান্তেই আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। 

৩.

মানুষের চিন্তার বিস্তার অধিকাংশ সময়য়েই জটিলতা বর্জিত হওয়ায় বন্যপ্রাণ, অরণ্য বা লোকালয়ের মত খুব সাধারণ কিছু শব্দ কিছু গতানুগতিক ছবিই চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে। যেমন জঙ্গল বললেই প্রথমেই মাথায় আসে গাছে ঘেরা বিস্তীর্ণ বনভূমি, সবুজের ছড়াছড়ি যেখানে। আর লোকালয় অর্থাৎ গ্রাম, শহর বা শহরতলি বললেই মনে হয় এগুলো হল কেবলমাত্র মানুষের জীবনযাপনের জন্য তৈরি এক কৃত্রিম পরিবেশ। একইভাবে বন্যপ্রাণী বললেই মনে হয় বাঘ, হাতি, হরিণ, ময়ূর, সাপ এই রকম আকর্ষক কিছু প্রাণীর কথা, জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্যের মত সংরক্ষিত জঙ্গলেই যাদের মূলত দেখা মেলে আর লোকালয়ের মধ্যে জীবজন্তুর কথা বললে মাথায় আসে কেবলমাত্র কুকুর-বিড়াল, গরু-ছাগল, হাস-মুরগির মত গৃহপালিত বা গবাদি পশুর কথা। কিন্তু এই অতি-সরলীকৃত ধারণা একদমই গ্রামাঞ্চল বা শহরের বাস্তব ছবিটা তুলে ধরে না। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে বনে জঙ্গলে আবাস হলেই যে তাকে বন্যপ্রাণ বলতে হবে তা কিন্তু নয়। বন্যপ্রাণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গেলে তাদের কথাই বলতে হয় যাদের জন্ম বা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে মানুষের কোন হাত নেই, লাখ লাখ বছর বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মেই যাদের সৃষ্টি। তাই বন্যপ্রাণের আওতায় সুবিশাল বটগাছ থেকে শুরু করে ছোট চারা ঘাস, বা হাতি থেকে শুরু করে প্রায় আণুবীক্ষণিক পিঁপড়ে যেকোনো কিছুই থাকতে পারে কারণ তাদের উৎপত্তি বা বিকাশ একদমই প্রাকৃতিক। আর তাদের পছন্দের বাসভূমি যে শুধু সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না তা বলাই বাহুল্য। তবে ঘাস, ঝোপ বা পোকামাকড় সংজ্ঞার দিক থেকে বন্যপ্রাণ হিসেবে পরিগণিত হলেও জরুরী সংরক্ষণের নিরিখে দেখতে গেলে আকারে বড় ও সংখ্যায় কম এমন প্রাণীদেরই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়।

চাষবাস ও গবাদি পশু প্রতিপালন খাদ্যের মূল যোগান দিলেও মানুষ তাদের দৈনিক বারোমাসের চাহিদার এক বিশাল অংশ আজও এই  লোকালয়ের মধ্যে সহজলভ্য বিভিন্ন বুনো সামগ্রী (যেমন বহু শাক, বিভিন্ন গাছের ফল-পাতা-ডালপালা, দেশি মাছ, গেঁড়ি-গুগলি, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি) থেকেই সংগ্রহ করে। তা সে খাবার হিসেবে হোক বা জ্বালানি কিম্বা ঔষধি হিসেবে। এছাড়াও এমন অনেক বন্যপ্রাণী, যেমন শিয়াল, খ্যাঁকশিয়াল, ভাম, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, গিরগিটি, ব্যাঙ, বিভিন্ন পাখি ইত্যাদি যাদের মানুষের কাছে হয়ত সেভাবে সরাসরি কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই, তারাও বহাল তবিয়তে লোকালয়ের মধ্যে টিকে রয়েছে। এমনকি ইঁদুর, ছুঁচোর মত ক্ষতিকারক প্রাণীদের প্রাচুর্যও এখানে নেহাত কম নয়। একটা পরিসংখ্যানে চোখ বোলালে দেখা যাবে কেবল দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ এবং উভচর মিলিয়ে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা প্রায় একশোর বেশী এবং এদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভারতীয় বন্যপ্রাণ রক্ষা আইনের সর্বোচ্চ দুটি ধারায়, যে ধারায় বাঘ, সিংহ, হরিণ, কুমীর ইত্যাদিরা সংরক্ষিত অর্থাৎ শিডিউল ১ (মেছো বিড়াল, প্যাঙ্গোলিন, গোসাপ, কচ্ছপ ইত্যাদি) ও শিডিউল ২ (শিয়াল, বনবিড়াল, ভাম, বেজি, কেউটে সাপ, গোখরো সাপ, দাঁড়াশ সাপ ইত্যাদি) -এর অন্তর্গত। যাদের কোন রকমভাবে মারা, ক্ষতি করা বা কোন দেহাংশ ব্যাক্তিগত সংগ্রহে রাখা চূড়ান্ত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইন অমান্য করলে জেল বা জরিমানা এমন কি দুটোই হতে পারে। 

সুতরাং তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার সংরক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে লোকালয় কোনভাবেই অবজ্ঞার জায়গা নয়। কিছু সংরক্ষিত এলাকার ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে গিয়ে দেশের এক বিশাল অংশ অবহেলিত থেকে যাচ্ছে যেখানে বন্যপ্রাণের প্রাচুর্য নেহাত কম নয় এবং যারা সংরক্ষনের দিক থেকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনা ও তথ্যপঞ্জি খুব সহজাত কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে। যেখানে, সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ থেকে বহু দূরে সংরক্ষিত এলাকা নির্ধারিত করেও বন্যপ্রাণীদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে না, সেখানে কীভাবে তারাই গ্রামের মধ্যে কোনরকম কোন প্রচলিত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের সান্নিধ্যে অবলীলায় নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।       

৪. 

আপাতদৃষ্টিতে গ্রাম কিম্বা শহর, কেবল মানুষ অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হলেও এর আনাচে কানাচে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে বন্যপ্রাণীদের দেখা মেলে না। তবে তার মধ্যেও নির্দিষ্ট কিছু কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে এরা থাকতে বিশেষ ভাবে পছন্দ করে যেমন চাষের জমি, ঝোপজঙ্গল, বাঁশঝাড়, পুকুর এবং তার পাড়, আম-লিচু কাঁঠাল জাতীয় বাগান, পান বরজ, ভাগাড়, শ্মশান, কবরস্থান ইত্যাদি। এমনকি বাড়ির অব্যবহৃত পরিতক্ত্য অংশও এর বাইরে নয়। আর এখান থেকেই পরিষ্কার নিজেদের পছন্দের আবাসভূমির উপস্থিতিই বন্যপ্রাণীদের গ্রামের মধ্যে টিকে যাবার অন্যতম কারণ। কিন্তু তাও যে প্রশ্নের উত্তরটা অধরাই থেকেই যায় তা হল এইসব বুনো জীবজন্তুদের বেশ কিছু হিংস্র, বিষধর এবং ক্ষতিকারক হওয়া সত্ত্বেও গ্রাম ও শহরবাসীরা কেন তাদেরকে নিজেদের আশেপাশে এত দিন ধরে সহ্য করে চলেছে।

ইতিহাসের পাতায় যদি একটু উঁকি মারি তাহলেই চোখে পড়বে মানবজাতি ও প্রকৃতির মধ্যে এই সম্পর্ক আজকের নয়। বিবর্তনের সাথে সাথেই পরিবেশ ও মানুষ নিজেদেরকে অপরের সান্নিধ্যে মানিয়ে নিয়েছে এবং হাজার হাজার বছরের বংশানুক্রমিক ভাবে সঞ্চারিত অভিজ্ঞতা তাদেরকে শিখিয়েছে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকাটা কোন বিছিন্ন কাজের মধ্যে পড়েনা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে এত বছরের পরম্পরালব্ধ জ্ঞান, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি এবং পরিবেশবান্ধব অভ্যাসের, যাদের মেলবন্ধনই এইসব বন্যপ্রাণকে লোকালয়ের মধ্যেই নিরাপদে বাস করতে সাহায্য করেছে। এই পরম্পরালব্ধ জ্ঞান আর কিছুই নয়, এত হাজার বছর ধরে মানুষ যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করেছে তারই ভুল, ত্রুটি ও সংশোধনের মাধ্যমে অর্জিত তথ্যের এক বিপুল সংকলন। সদাপরিবর্তনশীল এই জ্ঞানভাণ্ডার স্থানীয় মানুষ একাকী বা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে ধীরে ধীরে সংগ্রহ করেছে যা তারপর বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত ও প্রসারিত হয়েছে এবং তার আধুনিকিকরণ ঘটেছে। ফলশ্রুতিতেই মানুষ প্রকৃতিকে নিজেদের প্রয়োজনমত বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত এবং ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম অঞ্চলের মাঝে তারা কখনই কোন অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দেয়নি, আর তাই বন্যপ্রাণের সান্নিধ্য লোকালয়ের মধ্যে বরাবরের জন্যই রয়ে গেছে। কৃষিজমি, জলাশয়, বাগান ইত্যাদি যেমন বন্যপ্রাণীদের লোকালয়ের মধ্যে দিয়েছে নিরাপদ বাসভূমি, তেমনি এর সাথে এসে মিলেছে মানুষের উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া নানারকম ধর্মীয় ও লৌকিক বিশ্বাস। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে এই বন্য জীবজন্তুদের লোকালয়ের মধ্যে টিকে থাকার পিছনে যার প্রভাব অনস্বীকার্য।   

৫. 

বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পর বেশ কিছুদিন এই আধুনিক সংরক্ষণ ব্যাবস্থার প্রভাব বাড়তে থাকলেও গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শুরু থেকে তা একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। সেই সময়কার বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার সাথে মানুষের পরম্পরালব্ধ জ্ঞানের গুরুত্ব নিয়ে সোচ্চার হন। তাঁরা বলেন তাৎক্ষনিক সুরাহার উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র আরোপিত কিছু নিয়মের ওপর নির্ভরশীল থেকে কয়েক হাজার বছরের অভিজ্ঞতার দ্বারা অর্জিত মানুষের বিপুল জ্ঞান ভাণ্ডারকে উপেক্ষা করা নিদারুণ ভুল ছাড়া আর কিছু হতে পারেনা। তাই যদি পরিবেশকে সুস্থিত এবং টেঁকসই করতে হয় তাহলে শুধু কিছু দেখতে আকর্ষণীয় প্রাণীদের বাঁচানোর চেষ্টা করলেই হবে না তার সাথে বিভিন্ন কম পরিচিত জীবজগতের সংরক্ষণেও একই ভূমিকা নিতে হবে। এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই সংরক্ষণ সংক্রান্ত গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির এক বদল লক্ষ্য করা যায় এবং যার ওপর কড়া শিলমোহর পরে ২০০২ সালে ভারতীয় জীববৈচিত্র্য আইন প্রণয়নের মাধ্যেম। যেখানে সরকারি তরফে প্রথম সেই সব তথাকথিত স্বল্পখ্যাত জীবগোষ্ঠীকেও একই রকম গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণের কথা বলা হয় যাদের শুধুমাত্র জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্যে নয় বরং লোকালয়ের মধ্যেও অবাধ বিচরণ। 

ভারতের বাস্তুতান্ত্রিক ইতিহাস এবং পরম্পরালব্ধ জ্ঞানের পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন এটাই স্পষ্ট করে মানবজাতির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের উপযুক্ত বাস্তবায়ন কার্যত অসম্ভব। এটা যদিও ঠিক যে বাঘ, সিংহ, গণ্ডার, বিভিন্ন প্রাইমেট জাতীয় প্রাণী, গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের মত বিলুপ্তপ্রায় পাখি, নোনা জলের কুমীর ইত্যাদি যারা আকারে বড়, সংখ্যায় কম, অবলুপ্তির ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে, হ্যাবিটাটের সামান্যতম পরিবর্তনে পরিবেশ থেকে চিরতরের জন্য যারা হারিয়ে যেতে পারে এবং চোরাবাজারে যাদের বিভিন্ন দেহাবশেষের চড়া দাম রয়েছে, তাদের সংরক্ষণের জন্যে নিশ্চিতভাবে জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্যের মত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের প্রয়োজন। কিন্তু তার মানে কখনই এটা নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল মানুষদের অধিকারকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা বা শুধু সংরক্ষিত এলাকার ওপর অতিরিক্ত নজর দিতে গিয়ে দেশের বাকি অংশের বন্যপ্রাণকে চূড়ান্ত অবহেলা করা। এত গৌরচন্দ্রিকা, ভণিতার, উপমার এবং বিশ্লেষণের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য একটাই, যে আজকে এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্য ইত্যাদি ছাড়া হয়ত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সম্ভব নয়। কোথাও কোথাও কোন বিশেষ প্রজাতির ওপর অতিরিক্ত নজরদারির প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায়না। কিন্তু আধুনিক এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার সাথে হাজার বছরের পুরনো অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানগুলোকে যদি সঙ্ঘবদ্ধভাবে ব্যবহার করা যায় এবং যারা বংশপরম্পরায় বিভিন্ন বন্যপ্রাণ ও তাদের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তাদেরকে যদি এই জীবজগত বাঁচানোর প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করানো যায়, তাহলেই তা সামগ্রিক ভাবে মানবজাতিসহ সারা সমস্ত পৃথিবীর জীবজগত সংরক্ষণের যথার্থ পদক্ষেপ হয়ে উঠবে।

 

0 Comments
Leave a reply