শান্তির জন্য জল

লিখেছেন:সায়ন্তী কর

২০২৪ বিশ্ব জল দিবসের এর থিম বা মূল বিষয়বস্তু হল "শান্তির জন্য জল"। জল জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হলেও, এই জল নিয়ে সারাবিশ্ব জুড়ে রয়েছে অনেকরকম সমস্যা। বিশ্ব জলদিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো সারা বিশ্বব্যপী মানুষ এবং বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা ও প্রশাসনকে জল সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিয়ে সমাধানের পথ দেখানো ও তারই সাথে কিছু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টালমাটাল পরিসরে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রায়শই বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা, এবং তার থেকে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সেখানে জল সহযোগিতা এবং শান্তি উভয়ের জন্যেই একটি অনন্য অনুঘটকের ভুমিকা নিতে পারে। 

এখানে উল্লেখ্য, পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ জলের ওপর ভরসা করেই সমস্ত জীবকুল বেঁচে আছে। খাবার জল থেকে শুরু করে, রান্না, কৃষিকাজ, কলকারখানা চালানো পর্যন্ত এর ব্যবহার সর্বস্তরে। বাস্তুতন্ত্র এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য জলকে রক্ষা করা তাই খুবই প্রয়োজন। সর্বস্তরে জলের সমান ভাবে বণ্টন শুধু জীবনযাত্রার মানকেই রক্ষা করে না, বজায় রাখে শান্তি এবং উৎসাহ দেয় স্থিতিশীলতাকে। 

তবে এহেন গুরুত্বপূর্ণ এক প্রাকৃতিক সম্পদকে নিয়ে সমস্যাও রয়েছে অনেকখানি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পেয় জলের বিতরণ অসমান, আর ঠিক সেখানেই বিঘ্নিত হয়েছে বিশ্ব-শান্তি। কোথাও যেমন রয়েছে বিপুল জলের প্রকৃতিগত সমাহার, তেমনি আবার কোথাও রয়েছে তার অনেকখানি ঘাটতি, যার ফলে তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। শুধু তাই নয়, এই জলই আবার যখন দূষিত হয়, যখন মানুষ পর্যাপ্ত জল পায়না তার নিয়মিত কাজের জন্য, তখনই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে, এবং দেশগুলির মধ্যেও উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

বস্তুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র বিশ্বেই জলের ঘাটতি ক্রমবর্ধমান। জলকে তাই সর্বস্তরে সমান ভাবে পৌঁছানো এবং এর সঠিক গুনমান বজায় রাখা এখন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসাবে স্বীকৃত।

স্বাভাবিক ভাবেই, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পানীয়জল, এবং এই বর্ধিত জনসংখ্যার ভরণপোষণের জন্য কৃষিকার্য, কলকারখানা, ও শিল্প পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে জলের চাহিদাও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বর্ধিত চাহিদা প্রায়শই উপলব্ধ সরবরাহকে ছাড়িয়ে যায়, ফলে অভাব এবং তীব্র জলসঙ্কট দেখা দেয়। দ্রুত নগরায়ান এই সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তোলে। পরিবেশগত অবনতি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জলের গুনমান ও প্রাপ্যতাও হ্রাস পায়। দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জলের ব্যবহার নদী, হ্রদ এবং মহাসাগরের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে, অগণিত প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বিপন্ন করে।

জলবায়ু পরিবর্তন এরই সাথে জটিলতার আরেকটি স্তর যোগ করে। বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন করে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলিকে তীব্র করে, এবং জলের চাপকে বাড়িয়ে তোলে। বর্তমান পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুতর সমস্যা। এর প্রভাব বাড়ার সাথে সাথে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটি যথেষ্ট সঙ্কটে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) জলের প্রাপ্যতা, গুণমান এবং বিতরণের ওপর প্রভাব ফেলায়, এটা বিশ্বব্যাপী জল সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ত্বরান্বিত করছে হিমবাহের গলনকে, পরিবর্তন হচ্ছে রেনফল প্যাটার্নের, আর যার ফলস্বরূপ মিষ্টি জলের সরবরাহ বিপন্ন হতে থাকছে; যার ওপর নির্ভর করে থাকে কোটি কোটি মানুষ।

জাতিসংঘের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে, একটি দেশের চারজনের মধ্যে অন্তত একজন মিষ্টি জলের দীর্ঘস্থায়ী বা পুনরাবৃত্ত ঘাটতি দ্বারা প্রভাবিত হবে। যেসব অঞ্চলে জলের সম্পদ সীমিত, সেখানে প্রবেশাধিকার নিয়েও উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই মানবিক সঙ্কটকে বাড়িয়ে তুলতে পারে আরো বেশি করে।

ইতিহাস আন্তঃসীমান্ত জল চুক্তি এবং উদ্যোগের উদাহরণ দিয়ে পরিপূর্ণ, যা ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাকে অস্বীকার করেছে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়াকে করেছে উৎসাহিত । 

উদাহরণস্বরূপ, নীল নদের অববাহিকায় অবস্থিত ১১টি নদীতীরস্থ দেশকে একত্রিত করে নীলনদের শেয়ার্ড ওয়াটার রিসোর্স  পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রাজনৈতিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এরা একসাথে কাজ করে এবং নীলনদের জল ভাগ করতে সাহায্য করে। একইভাবে, ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি, বিরোধের সময়কালের মধ্য দিয়ে টিকে আছে, যা বিশ্বব্যাপী জল-বণ্টন চুক্তির মডেল হিসেবে কাজ করে। 

অধিকন্তু, জল কূটনীতি শুধুমাত্র জলের অভাবের তাৎক্ষনিক চ্যালেঞ্জগুলিই নয়, দারিদ্র্য, অসমতা এবং পরিবেশগত অবক্ষয় সহ সংঘাতের অন্তর্নিহিত চালকগুলিকেও মোকাবিলা করার একটি পথ সরবরাহ করে। টেকসই জল ব্যবস্থাপনা অনুশীলন, জল সম্পদের ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার এবং জলের সম বিতরণ কাঠামো - দেশগুলোর সংঘাতের মূল কারণকে প্রশমিত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপন করতে পারে ।

জল উদ্বাস্তু অথবা শরণার্থী হল এমন মানুষের গোষ্ঠী, যারা জলের সমস্যার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জল শরণার্থীরা আমাদের বিশ্বের একটি ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং মানব সংঘাতের কারণে বিশুদ্ধ জলসম্পদের ক্রমবর্ধমান অভাব তাদের বাধ্য করে স্থানচ্যুত হতে। এই ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়গুলি বাস্তুচ্যুতি এবং কষ্টের সম্মুখীন হয়ে এমন এলাকায় আশ্রয় খোঁজে যেখানে জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট জল পাওয়া যায়। জল শরণার্থীদের দুর্দশা, জলের ঘাটতি এবং এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি, বাস্তুচ্যুতি, অস্থিতিশীলতা এবং মানুষের দুর্ভোগসহ মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে। নেচার কমিউনিকেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কিছু দেশ যারা অনেক শরণার্থীকে আতিথেয়তা দিয়ে চলেছে, তাদেরও নিজস্ব জল সরবরাহের উপর অতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন হতে হয়। এই জলউদ্বাস্তুদের দুর্দশা পৃথিবীর এক কোণে সীমাবদ্ধ নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ দেশগুলি থেকে সমুদ্র দখলের হুমকিতে আক্রান্ত আফ্রিকার শুষ্ক অঞ্চলগুলি দীর্ঘস্থায়ী জলের চাপের সম্মুখীন হচ্ছে, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে প্রভাব পরছে তাদের জীবিকা, সংস্কৃতিতে এবং আলোড়িত হচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। 

ক্রমবর্ধমান জল প্রতিযোগিতার মুখে, সম্মিলিত পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা সবসময়ই ছিল। স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs), বিশেষ করে লক্ষ্য ৬, যার উদ্দেশ্য সকলের জন্য জল, স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা - জল সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে ব্যাপকভাবে মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রুতির উপর জোর দেয়।

যেহেতু আমরা একটি ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে বিচরণ করি, সীমিত জল সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা, "শান্তির জন্য জল" ধারণাটিকে বিঘ্নিত করে এবং এটি সুরেলা ভবিষ্যতের জন্য একটি বাধ্যতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির সহায়ক নয়। দ্বন্দ্বের উপর সহযোগিতা, বিবাদের উপর সংলাপ, এবং কলহের উপর দায়িত্ববোধ। এই মূল্যবোধগুলিকে আলিঙ্গন করে, জাতিগুলি সেতু তৈরি করতে, অংশীদারিত্ব তৈরি করতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য আরও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে বিশ্বকে সুরক্ষিত করতে, জলের রূপান্তরকারী শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।

স্বাভাবিক ভাবেই, জনগণ এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূরণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সচেতনতা মূলক বার্তা যাতে খুব সহজে এবং তাড়াতাড়ি মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে এর বিষয়ভিত্তিক প্রচারকে আরো জোড়ালো করতে হবে। বিশুদ্ধ জলের প্রাপ্যতা প্রতিটা মানুষ এবং জীবকুলের প্রাথমিক অধিকার। জল যেমন শান্তি বিঘ্নিত করে আবার এই জলের-ই ক্ষমতা আছে মানুষকে একত্রিত করার। মোটকথা, জল শুধু জীবনের উৎস নয়; এটি সহযোগিতার জন্য একটি অনুঘটক, ঐক্যের প্রতীক এবং আমাদের আন্তঃসংযুক্ততার একটি অনুস্মারক। এই মূল্যবান সম্পদের মূল্যায়ন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও টেকসই ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি।

 

1 Comments
Leave a reply