গুরুভায়ুর মন্দিরে বিগ্রহের প্রত্যুষ শৃঙ্গার বাকি এখনও। পশ্চিম দিকের পাহাড়টা জুড়ে যে ছোপ ছোপ ছায়া ঘেরা অন্ধকার তৈরী হয়েছে, তার গায়ে কেমন একটা ধ্বনিবিহীন নিঃসঙ্গতা লেগে আছে। গোটা ‘ভূলোক বৈকুন্ঠম’ জুড়ে এখন একটা প্রাচীন সুগন্ধের হালকা স্রোত বয়ে চলেছে। মন্দির লাগোয়া হাতিশাল থেকে ভেসে আসছে হাতির পায়ের শিকলের ধ্বনি কিংবা গলার ঘন্টির শব্দ। বহু যুগ ধরে এই হাতিশালে পুরুষ দাঁতাল হাতি দান করে আসছেন বহু পুণ্যার্থী, হয়তো সেই পৌরাণিক রাজা জনমেজয় এর সময়কাল থেকেই। হাতিকে গুরুভায়ুরাপ্পনের অবতার রূপ ধরা হয়। তাই মানুষ নিজের পোষা হাতি একসময় দান করে দিয়ে যেতেন এই মন্দিরে। পরে হাতির সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়তে থাকায় এই হাতিশালটি খোলা হয়। এই গুরুভায়ু মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা ‘মেলসান্থি’ ভেঙ্কটরাঘবনের খুব নিকট অনুশিষ্য, এই মন্দিরের প্রধান দেবতা উন্নিকাননের সেবাইতদের একজন মাধবন, পাশের পাহাড়ের রেবতী ঝর্ণায় স্নান সেরে মূল গর্ভগৃহে যাবার আগে, নিজের বাবা বা আচনের ঘরে ঢুকে দেখলো শতায়ু ভেঙ্কটরাঘবন শেষ বায়ু ত্যাগ করেছেন। দীর্ঘস্থায়ী অসুখের বেড়াজালে আটকে পড়ে একটা বিনিদ্র, ক্লান্ত, বিষন্ন বেঁচে থাকাকে অতিক্রম করে পরমাত্মায় বিলীন হয়েছেন এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। নিমীলিত চোখ, ভারী লোলচর্ম্ম মুখটা জুড়ে এখন কেবল উদাসীন প্রশান্তি! শেষ দিকে পুরোই বিছানা নিয়েছিলেন ভেঙ্কটরাঘবন। দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে শ্রী বিগ্রহের নিত্য পূজার পাশাপাশি প্রায় কয়েকশো অনাথ শিশুর লালন পালনের ভার তিনি নিয়েছিলেন। এই মন্দিরেরই এক প্রান্তে গড়ে তুলেছিলেন অনাথালয়। তারা আজ অনেকেই এই মন্দিরেই প্রভু গুরুভায়ুরাপ্পানের সেবায় নিযুক্ত।
মাধবনের মনে পরে যায় তার আচান এর শেষ ইচ্ছের কথা। কিছুদিন আগেই হাতিশালার ‘দাইমা’ পেল্লিভরণের মৃত্যু হয়েছে। ভেঙ্কটরাঘবনের মত সেও শতবর্ষ পার করেছিল কয়েকমাস আগে, ‘এত্তুকাল পোঙ্গল’ এর ঠিক পরের সপ্তাহে। পেরিয়ার বা কোডানাদ থেকে গুরুভায়ুর হাতিশালে কোন অনাথ হস্তিশাবক এলে প্রথমে তার কাছেই দেওয়া হত। শেষ দিকে নিজের ভারী শরীরটা নিয়ে আর একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো না হাতিটি। লম্বা শুঁড়খানা তার এলিয়ে পরে মাটিতে মিশে যেতে চাইত। কাছে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে হাতিটির চোখে করুণ মায়া আর বৃদ্ধ কায়ার মাঝে নিঃশব্দে বয়ে চলা নিজের অন্তঃসলিলা জীবনকে ঘিরে অমোঘ স্মৃতিমেদুরতা দেখেছে মাধবন। ঠিক যেমনটা ও দেখেছে ওর আচানের চোখেও। অনেকগুলো রংবদলের ভোরবেলা পেরিয়ে সূর্যাস্তের পাড়ে এসে দাঁড়ালে হয়তো একটা চিরহরিৎ বৃক্ষকে ঠিক এমনটাই দেখায়! ভেঙ্কটরাঘবনের শেষ ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পরে তাকে আর হাতিটিকে যেন পাশাপাশি সমাধিস্থ করা হয়। যাতে জন্মান্তরে ফিরে এসে তারা যেন আবার দুজনেই বালকৃষ্ণার সেবায় লাগতে পারেন। হয়তো সেদিন রুদ্রতীর্থমে আবার দুটি পদ্ম ফুটবে রূপান্তরের উল্লাসে!
ভেঙ্কটরাঘবান এবং পেল্লিভরণ দুজনেই শতায়ু পার করেছিলেন প্রায় একই সাথে। দুজনেরই জন্ম হয়তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আশেপাশের সময়ে। আর কিছুদিন বাঁচলে তারা দুজনেই হয়তো আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হতে পারতেন!
ছোট থেকে নিজের বাবার অধীনে চতুর্বেদ ও অন্যান্য নীতি শাস্ত্র শিক্ষা করেছে মাধবন। তবু কবিতা ছিল ওর প্রাণ! হয়তো এ নিয়ে আচানের সাথে ওর মতানৈক্যও ছিল। তবু আজ বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় ঠিক স্মরণসভা শুরুর মুহূর্তে মাধবনের মুখে কোন শ্লোক এল না বরং আশাবরী রামধনু রঙে ভেসে এল একটা কবিতা, এক ইরানী কবির লেখা কবিতা। কিছুদিন আগে বোমার আঘাতে যার কবিতার খাতাটা তার সোনালী শরীরের মতোই থেঁতলে গিয়েছিল!
“তুমি আর আমি একদিন
শেষ হয়ে যাব কোথাও,
কোন খানে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর কবিতা
চুপ হয়ে যাবে।”
মাধবনের মনে হলো কবিতাটা বলতে বলতে, একটি ইরানী মেয়ে তার পুরুষ বন্ধুটিকে অপেক্ষায় রেখে, আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে মেঘের কোলে নিজের বাবার কবরে এক গোছা লাল গোলাপ রেখে এলো। ঈশ্বর প্রেমে ও অপ্রেমে সমান্তরাল ও অফুরন্ত! তার কাছে তো সবই ক্রিয়া! ভূলোক বৈকুন্ঠে তখন ম ম করছে বৃষ্টিভেজা বারুদের গন্ধ!