(২৯ শে জুলাই আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস। বিলুপ্তপ্রায় এবং পরিবেশগত দিক থেকে মহা মূল্যবান এই প্রজাতিটি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় এই দিনটি। এই দিনটিকে স্মরণে রেখেই এই প্রবন্ধ)
আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস - রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্কের পোস্টার (ছবিঋণ - https://ranthambhorenationalpark.in/)
‘টাইগার’ শব্দবন্ধটি গ্রীক শব্দ ‘টাইগ্রিস' থেকে এসেছে। বাঘ নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তাই চলুন প্রথমেই বাঘ নিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
বর্তমানে মাত্র ১৩টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। এই ১৩টি বাঘ সমৃদ্ধ দেশকে বলা হয় Tiger Range Country (TRC)। দেশগুলো হচ্ছে, ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাও পি.ডি.আর. এবং রাশিয়া।
বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতিমধ্যে বালিনিজ, জাভানিজ ও কাম্পিয়ান টাইগার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঘের পাঁচটি উপ-প্রজাতি বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার কোনোরকমে টিকে আছে।
বিড়াল প্রজাতির মধ্যে বাঘ সবচেয়ে বড় প্রাণী। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন গ্রুপ (ডাব্লিউ.ডাব্লিউ.এফ) এর তথ্য অনুযায়ী একটি বাঘের ওজন ৩০০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এরা বাঁচে ২৬ বছর পর্যন্ত। বাঘের মাথা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৮০ সে.মি.। এখানে শুধুমাত্র ল্যাজের মাপ ১০০ সে.মি.। উচ্চতা হয় ১১০ সে.মি।
বাঘের মস্তিষ্ক বেশ বড় হয় যার ওজন ৩০০ গ্রামের মত এবং বাঘের স্মৃতিশক্তি অনেক ভালো। বাঘের স্বল্প-মেয়াদী স্মরণশক্তি মানুষের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি। ৩০০ কেজি ওজনের একটা বাঘ ৫ মিটার পর্যন্ত (প্রায় ১৫ফুট) লম্বা লাফ দিতে পারে। পেছনের পাগুলি তার সামনের পাগুলির চেয়ে লম্বা হওয়ার ফলে তারা অনেক বেশি দূরত্বে লাফ দিতে সক্ষম হয়। বাঘ ঘন্টায় প্রায় ৬০-৬৫ কি.মি. বেগে দৌঁড়াতে পারে।
বাঘের লালায় প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক থাকে। বাঘ তার দেহের ক্ষত সারাতে ক্ষতস্থানে লালা লাগায়।
বাঘের গর্ভকালীন সময় ১০৪-১০৬ দিন। এরা এক সাথে ২ থেকে ৫ টি বাচ্চা জন্ম দেয়। পুরুষ বাচ্চা ৪-৫ বছর ও মেয়ে বাচ্চা ৩-৪ বছরে বয়োপ্রাপ্ত হয়। জন্মের সময় বাঘের বাচ্চাগুলো পুরোপুরি অন্ধ থাকে। জন্মের দেড়-দুই সপ্তাহ পরে এদের চোখ ফোটে। এই বাচ্চাদের অর্ধেকই যৌবন পর্যন্ত বাঁচে না। বাঘের বাচ্চারা ৬ মাসে স্বাবলম্বী হয়। এর আগে তাদের দেখাশোনা পুরোটাই মা বাঘ করে। পুরুষ বাঘ (পিতা) কোন দায়িত্ব পালন করে না। উল্টে অনেক সময় নিজের বাচ্চাকেও খেয়ে ফেলে। বিখ্যাত বাঘ শিকারি জিম করবেট বলেছেন, “বাচ্চারা মায়ের সাথে ১৮ মাস পর্যন্ত থাকে।" যখন তারা নিজেরা চলাফেরা শিখে যায়, তখন তারা তাদের মাকে ছেড়ে চলে যায় এবং নিজেদের মতো করে একটা এলাকা বেছে নিয়ে বসবাস করা শুরু করে। বাঘ সাধারণত নিশাচর প্রাণী। পুরুষ বাঘ বাঘিনী এবং শাবকদের ছাড়াই নিঃসঙ্গভাবে চলাফেরা করে। তবে পুরুষ বাঘ শিকার ধরে স্ত্রী বাঘ এবং শাবকদের আগে খেতে দেয়। বাঘের কপালের নিদর্শনটি চীনা প্রতীকের সাথে হুবহু মিলে যায় অর্থ রাজা, এজন্য বাঘ চীনা সংস্কৃতিতে রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেছে।
বাঘের জিহ্বা ভর্তি পিছনের দিকে মুখ করা অনেক ধারালো প্যাপিলা থাকে। যেগুলো যেকোন শিকার থেকে লোম, চামড়া বা পালক ছাড়িয়ে খেতে সাহায্য করে। এগুলো এতটাই অমসৃণ হয় যে তারা খুব সহজেই যেকোনো হাড়ে লেগে থাকা মাংস চেটে তুলে আনতে পারে। বাঘের ডোরাকাটা দাগ শুধু তার লোমে না, চামড়ায়ও থাকে। মানুষের যেমন স্বতন্ত্র ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকে, সেরকম দুটি বাঘের চামড়ার স্ট্রাইপের প্যাটার্ন কখনো এক হয় না। যার ফলে বাঘেরা খুব সহজেই একে অপরকে শনাক্ত করতে পারে। বিড়ালের মত প্যাডেড পা (নিঃশব্দে চলাফেরার জন্য), প্রায় ৩ ইঞ্চি লম্বা একেকটা ধারালো ক্যানাইন দাঁত, ১০ সে.মি. লম্বা নখর, সমস্ত ফেলাইনের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর থাবা ও দ্রুতগতি থাকা সত্ত্বেও বাঘের শিকার ধরার সফলতার রেট ১০%। অর্থাৎ প্রতি ১০ বারের চেষ্টায় বাঘ মাত্র ১ বার সফল হয়। তবে একটু বড় কিছু এক বার শিকার করতে পারলে ৫-৬ দিন আর শিকার করে না। বাঘ একবারে মোটামুটি ৪০ কেজির মত মাংস খায়। এরা সাধারণত মহিষ, হরিন, বন্য শূকর, বানর, বড় পাখি, বড় মাছ শিকার করে থাকে। এরা ২-৩ সপ্তাহ না খেয়ে থাকলে মারা যায়। বাঘ অন্যান্য প্রাণীর ডাক নকল করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বোকা বানিয়ে শিকার করে। সুন্দরবনের বাঘ মানুষও খায়।
সুন্দরবনের বাঘ (ছবিঋণ - https://www.sunderbannationalpark.in/)
বাঘের গর্জন ৩ কি.মি. দূর থেকেও শোনা যায়। এরা দূরবর্তী বাঘদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভয়ঙ্কর শব্দে গর্জন করে। কাছ থেকে বাঘের গর্জন শুনলে বধির হয়ে যাবারও সম্ভাবনা আছে।
বিড়াল পরিবারের মধ্যে একমাত্র বাইঘ জল খেতে ভালবাসে। এরা খুবই ভাল সাঁতারু, একটানা ৬ কি.মি. সাঁতারও কাটতে পারে। সাঁতার কাটার সময় শিকার ধরতেও এরা বেশ পটু। বাঘ রাতে স্পষ্ট দেখতে পেলেও দিনের বেলা মানুষের তুলনায় চোখে কম দেখে। এরা অন্ধকারে মানুষের চেয়ে ৬ গুণ বেশি পরিষ্কার দেখতে পায়। বাঘের পা এতটা শক্তিশালী যে এরা মারা যাওয়ার পরও কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বাঘ সচারচর সামনে দিয়ে আক্রমণ করে না। এজন্য সুন্দরবনের জেলে, বাউয়ালি, মৌয়ালিরা বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মাথার পেছনে মুখোশ পরে। বাঘের কানের পেছনের সাদা দাগটিকে ওসেলি বলে। কানের পিঠের এ সাদা দাগগুলি কখনও কখনও পিছন থেকে সম্ভাব্য আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়ার জন্য 'চোখ' হিসাবে কাজ করে বলে মনে করা হয়। আবার কখনো এই সাদা দাগগুলি বাঘের শাবকগুলিকে লম্বা ঘাসের মধ্যে তাদের মাকে অনুসরণ করতে সহায়তা করে।
এই বারে আসি বর্তমানে বাঘের পরিস্থিতির পরিসংখ্যানে:-
২০২২ সালের বাঘশুমারির হিসাবে যা বলছে, তাতে বিগত চার বছরে ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে দেশে বাঘের সংখ্যা। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে দেশের বাঘের সংখ্যা ২,২২৬ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৯৬৭। ভারতে ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। মাত্র ন’টি টাইগার রিজ়ার্ভ ফরেস্ট নিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্প। ৫০ বছরে ১৯টি রাজ্য মিলিয়ে এখন টাইগার রিজ়ার্ভের সংখ্যা মোট ৫৩। উনিশ শতকের শেষে ভারতে প্রায় ৪০ হাজারের মতো বাঘ ছিল। কিন্তু শিকার ও নির্বিচারে বাঘ মারার ফলে তা দ্রুত কমে। ২০০৬ সালে দেশে মাত্র ১৪১১টি বাঘ ছিল। গত ১৬ বছরে বাঘের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ বেড়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে বাঘের প্রয়োজন মত এত বনভূমি কোথায়? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাঘ নির্জনে থাকতে পছন্দ করে। অন্য বাঘকে তারা নিজের অঞ্চলে সহ্য করতে পারে না।
ভারতে জনসংখ্যার ঘনত্ব তো আছেই কিন্তু তবুও পরিকল্পিত ভাবে জমি ব্যবহার করা গেলে বনের আয়তন বাড়ানো যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রোজেক্ট টাইগারের জন্য এলাকা বাড়ানো। আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে চোরাশিকার, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
বাঘ আমাদের জাতীয় পশু, তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের জাতীয় পশু কে রক্ষা করা, বিশেষত, চোরা শিকারীদের থেকে রক্ষা করা।
আগামী দিনে যাতে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেদিকে সরকার ও দেশের নাগরিকদের আরো নজর দিতে হবে, আরো যত্নবান হতে হবে। অন্নদাশঙ্কর সেই কবেই লিখে গেছেন-
“বাঘের বংশ হচ্ছে ধ্বংস
বাঘের জন্যে ভাবি
বাঘকে হবে বাঁচাতে আজ
এই আমাদের দাবি।
বাঘের দেখা পাবো কি ?
বাঘের জন্য ভাবি
বাঘের শিকার চলবে না
এই আমাদের দাবি।”
- সঞ্চালিকা (টিভি ও রেডিও চ্যানেল ) ও বিজ্ঞান লেখিকা