উন এস্টাটে ইটালিয়ানা - দ্বিতীয় পর্ব

লিখেছেন:রাজর্ষি ঘোষ

পর্ব ২ঃ অল রোডস্‌ লিড ট্যু রোম 

 

শেষমেশ জুন মাসের এক বৃষ্টি ভেজা পড়ন্ত বিকেলে আমাদের বিদেশ যাত্রার সূচনাটা হয়েই গেল। সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ছিল ভার। তার উপর সারা শহর জুড়ে প্রথম বর্ষার পিটপিটে ধারাপাত। সেসব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে নির্দিষ্ট সময়ের ঘন্টা তিনেক আগেই আমরা এয়ারপোর্টের তিন নম্বর গেটের সামনে এসে হাজির। আগেই বলেছি, কলকাতা থেকে আমাদের প্রথম গন্তব্য হবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর রাজধানী শহর আবু ধাবি, আর সেখান থেকে রোম। মাঝে ঘন্টা দুই লে-ওভার পাব। যদিও এটা আমার প্রথম বিদেশযাত্রা নয়, এইবারই প্রথম পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়া। সামনের আড়াইটা সপ্তাহ সময় নিয়ে তাই আমাদের অজস্র পরিকল্পনা, আর নানারকম চিন্তাভাবনা। তবে এইক্ষেত্রে আমাদের দুই বাবার যেহেতু এটাই প্রথম বড় মাপের বিদেশ ভ্রমণ, স্বাভাবিকভাবেই তারা আমার বা বৃষ্টির তুলনায় অনেক বেশি উত্তেজিত; বরং বলা উচিত তারা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। তাদের সামাল দিতেই আমরা প্রতি পদক্ষেপে হোঁচট খাচ্ছি। এখন এই যে ঘটনা পরম্পরা, এর সূত্রপাত কিন্তু ভিসা অ্যাপ্লিকেশনের সময় থেকেই। অর্থাৎ তাদের প্রথম উদ্বেগ, ভিসা অফিস আমাদের আদৌ ইটালি যাত্রার ছাড়পত্র দেবে কিনা সেই নিয়ে। একদল পর্যটককে তাদের বিদেশ ভ্রমণের ছাড়পত্র না দেওয়ার ঠিক কী কারণ থাকতে পারে যদিও আমার তা আজও অজানা, তবে আমাদের এই দুই কুখ্যাত মাফিয়া বসের সমস্ত দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনার অবসান ঘটিয়ে একদিন পাসপোর্টে সেনজেন ভিসার ছাপ পড়ে গেল। আর তারপর থেকে তো নানারকম তোড়জোড়; শেষে মালপত্র বাঁধা ছাঁধার পরিকল্পনাতে পৌঁছে তাদের এই উদ্বেগের মাত্রার দ্বিতীয় পর্যায়ে উত্তরণ ঘটল। ইটালির কোন শহরে কোন দিন কত ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে তার চুলচেরা হিসেব, কিংবা ইউরোপ যাচ্ছি তো ব্যাগ ভরে উলেন নেব না কেন - এসব হাবিজাবি অজস্র তথ্য নিয়ে এক প্রস্থ জেরা ও ঝগড়াঝাঁটি আগেই হয়ে গেছিল। এখন শেষ মুহূর্তে এসে তার সাথে যোগ হয়েছে, আমরা ওখানে পৌঁছে খাব কী, সেই নিয়ে দুশ্চিন্তা। এখানে বলে রাখা ভাল, বাপির অভিপ্রায়, (আর তার দেখাদেখি বাবারও) আমরা - অর্থাৎ আমি ও আমার স্ত্রী বাইরে রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া সারলেও, নিজেরা স্বপাকে মিতাহার গ্রহণ করা। বলা তো যায় না, বাইরে কখন কি ছাই-পাঁশ খাইয়ে দেবে। তার থেকে বরং ঘরে রান্না করে খাওয়াই ভালো। এ প্রসঙ্গেও আর এক প্রস্থ অশান্তি হয়ে যাওয়ার পর, আমার বাবা লুকিয়ে অন্তত গোটা সপ্তাহ চালিয়ে দেওয়ার মত ইনস্ট্যান্ট নুডল প্যাক করে নিয়ে যাচ্ছে। বাবার ধারণা আমি তার ব্যাগ পত্তরের গোপন অন্দরমহল সম্পর্কে বিন্দু মাত্র ওয়াকিবহাল নই। তবে এরই সাথে অন্যান্য জিনিসপত্র যেমন - চাল, ডাল, নুন, তেল, বা মশলাপাতি ইত্যাদি নেওয়ারও বোধহয় ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমার সহধর্মিণী সেসব বাজেয়াপ্ত করে বলেছে, ইটালিতে ওসব পর্যাপ্ত পরিমাণেই পাওয়া যায়। সে আশ্বাসে তারা বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হয়েছে কিনা একমাত্র শিবই বলতে পারেন। অতএব যাত্রাশুরুর আগে চোরা আশঙ্কা একটা ছিলই, যে আমাদের যা ব্যাগ-পত্তর নেওয়ার মাথা পিছু লিমিট, অর্থাৎ মোট তিরিশ কেজি - তার থেকে একটু বেশিই মাল পত্র আমরা ক্যারি করছি কিনা। কার্য ক্ষেত্রে দেখা গেল, আমাদের মালপত্রের ওজন বেশি তো হয়ই নি, বরং একটু কমের দিকে। 

 

কলকাতা এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল সেকশনে, যেটি ডিপার্চারের রাস্তা দিয়ে ঢুকলে মূল টার্মিনালের একেবারে শেষের দিকে, সেখানে এটিহাদের কাউন্টারের মালপত্র জমা দিয়ে দেখলাম আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। কাউন্টার থেকে আমাদের হাতে একসাথে দুটো করে বোর্ডিং পাশ ধরিয়ে দেওয়া হল। প্রথমটা অবশ্যই কলকাতা থেকে আবু ধাবির, আর দ্বিতীয়টা আবু ধাবি থেকে রোমের। আমাদের যেহেতু কানেক্টেড ফ্লাইট এবং একই ক্যারিয়ার - এটিহাদ, আবু ধাবিতে নেমে আমাদের আর নতুন করে বোর্ডিং পাশ বা মালপত্র সংগ্রহ করতে হবে না। খাশা ব্যবস্থা। আমাদের চোখের সামনেই, কাউন্টারের পেছনের অটোমেটিক কনভেয়ার বেল্টে আমাদের পাঁচ পাঁচটা দামড়া স্যুটকেস রোমের উদ্দেশ্যে ধীরেসুস্থে রওনা হয়ে গেল। আমরাও বোর্ডিং কাউন্টার ছেড়ে ইমিগ্রেশন গেটের দিকে এগোচ্ছি, এমন সময় আমার মুঠোফোনে কুটুশ শব্দে বার্তালাপ ভেসে এল। অভ্যাসবশত মোবাইল খুলে মেসেজ চেক করতে গিয়ে দেখি বিরাট বড় দুঃসংবাদ। রোমে আমাদের এয়ারবিনবির যিনি মালিক, সেই সত্তরোর্দ্ধ ফেডেরিকো জিয়ারডিনা জানালেন, সেদিনই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে তার স্লিপ ডিস্ক হয়েছে। তার অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল এবং এখন তিনি হসপিটালে ভর্তি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ফেডেরিকো পেশায় চিত্রশিল্পী, আর্টের কনোস্যর, রোমে তার নিজস্ব দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যেগুলো তিনি এয়ারবিএনবির মাধ্যমে ট্যুরিস্টদের ভাড়া দেন। ভদ্রলোকের সাথে আগেই বেশ আলাপ জমে গেছিল; এবং কথা প্রসঙ্গে এও বুঝেছিলাম যে তাকে রোম শহরের এনসাইক্লোপিডিয়া বললেও অত্যুক্তি হবে না। চাইলে হয়তো তিনি নিজেও ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করতে পারতেন। আমার রোম শহরের আইটেনারি সাজানোর ক্ষেত্রে, বা বিভিন্ন জায়গার অনলাইনে টিকিট জোগাড় করার ব্যাপারে ফেডেরিকো তার সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়ে আমাকে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও ভ্রমণ সংক্রান্ত নানাবিধ খুঁটিনাটি, যেমন রোম শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা, যেমন কাছাকাছি স্টেশন কোথায়, মেট্রো কখন ছাড়ে, বাস বা ট্রামের সার্ভিস কিরকম, তার টিকিট কোথায় পাওয়া যায়, কাছাকাছি রেস্তোরাঁ বা গ্রসারি স্টোর কোথায় - এসব নিয়েও আমাদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। কথা ছিল ফেডেরিকো নিজেই গাড়ির ব্যবস্থা করে আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসবেন। আমরাও এই সলিউশ্যনে বেশ খুশি ও নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ফেডেরিকো জানালেন এই অবস্থাতেও আমাদের এয়ারপোর্ট পিকআপের বিকল্প ব্যবস্থা তিনি করে ফেলেছেন। তার ঠিক করে দেওয়া ড্রাইভার আমাদের জন্য সকাল দশটায় রোম এয়ারপোর্টের এক্সিট গেটের বাইরে অপেক্ষা করবে। ড্রাইভারের ফোন নাম্বার যথা সময়ে তিনি আমাকে হোয়াটস্‌অ্যাপ করে পাঠিয়ে দেবেন। প্রসঙ্গত, এক্ষেত্রে আমাদের একটু অসুবিধেই হল। আমরা রোম পৌঁছাবো স্থানীয় সময় সকাল সাতটায়। কিন্তু যেহেতু আমাদের ড্রাইভার পিক-আপ করতে আসবে সকাল দশটায়, আমাদের প্রায় তিন ঘন্টার মত সময় এয়ারপোর্টের ভেতরই জিরিয়ে নিতে হবে। সম্ভব হলে ব্রেকফাস্টের জরুরি পর্বটাও মিটিয়ে ফেলতে হবে এখানেই। 

 

কলকাতায় ইমিগ্রেশনের কিউ যে খুব একটা বড় তা যেমন নয়, আবার তেমন ছোটও নয়। বিশাল একটা হলঘরের মত জায়গার একপাশে সাজানো অনেকগুলো কাউন্টার, তার গায়ে লাগোয়া আমাদের মেট্রোরেলের মত অটোমেটিক গেট। মেঝেতে টানা একটা লম্বা হলুদ লাইনের মাধ্যমে যাত্রীদের থেকে কাউন্টারগুলোকে আলাদা রাখা হয়েছে। একই লাইন দিয়ে হলঘরে ঢুকলেও ভেতরে প্রত্যেক কাউন্টারের জন্য আলাদা আলাদা লাইন। সিকিউরিটি প্রয়োজনমত সবাইকে ডেকে নিয়ে আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সবকিছুই চলছে ঘড়ি ধরে, নিয়ম মেনে। কাউন্টারে বসা ইমিগ্রেশান অফিসার প্রত্যেককেই কিছু না কিছু প্রশ্ন করছেন; তাদের বিদেশযাত্রা সংক্রান্ত সাধারণ প্রশ্ন, যেমন - কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, বা কবে ফিরবেন ইত্যাদি। প্রসঙ্গত বলে রাখি সাধারণ প্রশ্ন বলে ভাববেন না যেন, এই কথোপকথন একেবারে অনাবশ্যক। অনেক সময় তাবড় দুষ্কৃতীও এই সমস্ত প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতে গিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে বিপদে পড়ে যায়। কাউন্টারেরই পাশে রাখা একটি ক্যামেরার দিকে যাত্রীদের অল্প কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকাতে হচ্ছে। সেখানেই ইমেজ স্ক্যানের মাধ্যমে তাদের যাবতীয় তথ্য জমা হয়ে যাচ্ছে অফিসারের সামনে বসানো ডেক্সটপ কম্পিউটারে। অফিসার সেসব তথ্য এবং ডকুমেন্ট মিলিয়ে দেখে নিয়ে তবেই যাত্রীদের সিকিউরিটি চেকে যাওয়ার ছাড়পত্র দিচ্ছেন। ইমিগ্রেশনে পৌঁছে প্রথমেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আমাদের আলাদা আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। তার মধ্যে আমি আর বাবা এক লাইনে। বৃষ্টি আর বাপি দুজন দুটো আলাদা লাইনে। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের সমস্ত ডকুমেন্ট চেক করে নিলে, ইঙ্গিতে তাকে বুঝিয়ে দিলাম বাবার একটু কানের সমস্যা আছে, ঠিকমতো শুনতে পান না। অফিসার তার হাতের ইশারায় আমাকে সাথে থাকতে বলে বাবাকে নিয়মমাফিক অল্প কিছু প্রশ্ন করলেন, আর তারপর ক্যামেরা স্ক্যান। সব মিলিয়ে পরপর আমাদের দুজনের ভেরিফিকশন হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। সমস্ত ফর্মালিটি মেটার পর আমরা দুজন ইমিগ্রেশনের অটোমেটিক গেট পেরিয়ে বাকিদের জন্য অপেক্ষায়। এদিকে বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি আর বাপির কিন্তু তখনো কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, বৃষ্টি আমার আগেই নিজের কাউন্টারে পৌঁছেছে। সেখানে ওর অন্তত এতক্ষণ সময় লাগার কোনো কারণ নেই। বরং আমার বেশ কিছুক্ষণ আগেই ওর ভেরিফিকেশন শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কী হল? এবার আমার উদ্বেগের পালা শুরু। গেটের পেছন থেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে ওদের কাউন্টারে কী হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করলাম; সঙ্গত কারণেই তাতে খুব একটা সফল হলাম না। তবে তার একটু পরেই গেট পেরিয়ে জিভ কাটতে কাটতে বাপি হাজির, সাথে বৃষ্টি ল্যাংবোট। কাউন্টারের অফিসার বাপিকে তার ম্যান্ডাটরি চেকের সময় প্রশ্ন করেছেন, হোয়াট ইজ ইয়োর ফাইনাল ডেস্টিনেশন; এদিকে বাপি তার নিজের দুশ্চিন্তায় শুনেছে অফিসার তাকে বলছেন, আপনার তো মশাই যাওয়া হবে না। হাতে ভ্যালিড টিকিট আর ভিসা নিয়ে ইটালি কেন যাওয়া হবে না বুঝতে না পেরে বাপি খানিক ভেবলে থ। আর অফিসারও বিস্ময়চকিত। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি গিয়ে বাপিকে এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। এত সব কান্ডের পর, আমাদের সিকিউরিটি চেক সম্পূর্ণ নিরামিষ। ব্যাগ পত্তর নামিয়ে রেখে, আমাদের দুটো বড় বড় ক্যামেরা বের করে ট্রেতে চাপিয়ে, বেল্ট খুলে রেখে আমরা একে একে সিকিউরিটির ঝামেলা মেটালাম। নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু আগেই আমাদের ফ্লাইট আবু ধাবির উদ্দেশ্যে তার ডানা মেলল। 

 

প্লেনে আমার ঘুম হয় খুব কম। বাকি সহযাত্রীদের দেখলাম অনেকেই এই সুযোগে এক চোট ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের এই ফ্লাইটে অধিকাংশই ট্রানজিটের প্যাসেঞ্জার। আবু ধাবি পৌঁছে তারা দিগ্‌বিদিকের ফ্লাইট ধরবেন। অধিকাংশেরই গন্তব্য ইউরোপের বিভিন্ন শহর। মাঝে কিছুক্ষণের লে ওভার। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর এই শহর এখন গোটা বিশ্বের এক জনপ্রিয় ট্রানজিট স্টপ। ইউরোপ ও এশিয়ার বড় শহরগুলোর মাঝামাঝি অবস্থানের কারণে আবু ধাবি এয়ারপোর্টের এত জনপ্রিয়তা। এছাড়াও রয়েছে আমিরশাহীর বিখ্যাত সব পাঁচতারা হোটেল, লাক্সারি শপিং মল, সাথে পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী সমুদ্র সৈকত কিংবা আরব মরুভূমির নরম বালিয়াড়ির হাতছানি। যত দিন যাচ্ছে আবু ধাবি এয়ারপোর্টে তাই যাত্রী সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে; আর সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কলেবরও। একটানা প্রায় পাঁচ ঘন্টা জার্নির পর আমরা আবু ধাবি এসে পৌঁছলাম স্থানীয় সময় রাত পৌনে একটায়। ফ্লাইটে সামান্য কিছু খেতে দিয়েছিল। ফ্রুট স্যালাড, পাঁউরুটি, জুস, আর চকলেটের তৈরি একটা ডেজার্ট; চা নয়তো কফি; সাথে অ্যালকোহলের মধ্যে ওয়াইন। আমরা কেউই রাতে সেরকম ভারী কিছু ডিনার করে বেরোই নি। দিনভর হুড়োহুড়ির মধ্যে তার কোনো অবকাশও ছিল না। তবে ফ্লাইটের ওই যৎসামান্য খাওয়া দাওয়ার পর আবু ধাবি পৌঁছেও কেউ কিছু খেতে রাজি হল না। বরং আমরা এরোব্রিজ ধরে নেমে সরাসরি সিকিউরিটি চেকের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবারে আর আমাদের ইমিগ্রেশনের মুখোমুখি হতে হবে না। সুতরাং সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত। আবু ধাবি এয়ারপোর্টে যেটা নজর কাড়ল তা হল এই বিমানপোত যেন এক আন্তর্জাতিক মুক্তাঞ্চল। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত কি বিভিন্ন দেশ, জাতি ও এথনিসিটির লোক সারা এয়ারপোর্ট জুড়ে থৈ থৈ করছে। সিকিউরিটি আর এয়ারপোর্টের নিজস্ব স্টাফ বাদ দিলে এই জন-অরণ্যে আরব দেশের নিজস্ব অধিবাসীদের খুঁজে পাওয়াই আদৌ মুশকিল হবে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্দেশ্যে মুহুর্মুহু বিমান ওঠা নামা করছে। তার কোনটা চলেছে ফ্রাঙ্কফুর্ট, কোনটা নিউ ইয়র্ক, কোনটা প্যারিস কি ব্রিসবেন, আবার কোনটা টোকিও। গোটা এয়ারপোর্ট জুড়ে চুড়ান্ত ব্যস্ততা। বিশাল চেহারার আরব তরুণ ও সুন্দরী আরব তরুণী আমাদের সিকিউরিটি চেক অবধি পথ দেখিয়ে দিলেন। এখানে আর কলকাতা এয়ারপোর্টের মত খানা তল্লাশি হল না। শুধু একটি স্বল্প পরিসরের সিকিউরিটি গেটের মধ্য দিয়ে আমাদের পাশ করিয়ে দেওয়া হল। এই গেটের মাধ্যমেই বডি স্ক্যান করে আমাদের যাত্রার পরবর্তী পর্যায়ের জন্য ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমাদের ছেলেদের ক্ষেত্রে বডি চেক নির্বিঘ্নে কাটলেও গোল বাধল বৃষ্টির অলঙ্কারে। ভারতীয় নারীর অঙ্গ-বিভূষণে আরব দেশের সিকিউরিটির যে যৎকিঞ্চিৎ আপত্তি আছে, তা পরিস্ফুট হল। বৃষ্টিকে তার লোহা বাঁধানো হাতের বালা খুলে ব্যাখ্যা করতে হল সেটা কী জিনিস। আর তারপরেই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি মিলল।  

 

সিকিউরিটি চেক থেকে আমাদের পরবর্তী ফ্লাইটের প্রস্থানের যে গেট তা প্রায় পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। আর এই পুরো পথটাই একরকম ট্র্যাপ। পথের দু ধারে সুসজ্জিত সব দোকান। পারফিউম, বই, চকোলেট থেকে আরব দেশের বিখ্যাত সব ড্রাই ফ্রুটস। এক এক জায়গায় ঢেলে ছড়িয়ে অসম্ভব সস্তা দামে বিত্রি হচ্ছে পেস্তা কাজু আমন্ড কিশমিশ কি খেজুরের ঢাউশ ঢাউশ সব প্যাকেট। নামী দামী সুগন্ধীর গন্ধে চারপাশ মম করছে। বড় বড় ডিউটি ফ্রি শপে বিক্রি হচ্ছে দেশ বিদেশের বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পানীয়ের বোতল, টি-শার্ট, মেমেন্টো, ইলেকট্রনিক্স বিভিন্ন উপকরণ। সেসবের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে আমরা একতলায় ফ্লাইটের গেটের সামনে এসে হাজির হলাম। এখানেও হাতে কিছুটা সময় ছিল। বাকিদের সিটে বসিয়ে রেখে এগোলাম কাছাকাছির মধ্যে থাকা ডিউটি ফ্রি শপগুলো ঘুরে দেখতে। সেলস্‌ম্যানের হাঁকডাক আর সুগন্ধীর ম্যান্ডাটরি চেক পয়েন্ট পেরিয়ে ড্রাই ফ্রুটসের স্টলে গিয়ে হাজিরা দিলাম। বই আর চকোলেটের স্টলেও বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। বস্তুত, এইভাবে উইন্ডো শপিং করে এয়ারপোর্টে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। চারপাশে কত মানুষের ভিড়। এই জনস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে কী অদ্ভুত এক বিভোরতায় নিজেকে বারবার হারিয়ে ফেলেছি। কোথায় আমার দেশ, কোথায় আমার দেশের ক্ষুদ্র আর নিম্নমুখী রাজনীতি, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, বিরোধ আর অমানবিকতা। আন্তর্জাতিক বিমানপোতগুলি সেখানে এক প্রকার খোলা জানলা। মুক্ত হাওয়ার প্রথম ঝলক। সারা পৃথিবীর মানুষ তোমার চারপাশ দিয়ে স্রোতের মত বয়ে চলেছে। বিচিত্র তাদের ভাষা, পরিধান; বিচিত্র তাদের চেহারা, পেশা কিংবা পরিচয়। জাতপাতের রাজনীতি ও বিভেদের উর্দ্ধে উঠে এখানে তুমি শুধুই মানুষ, আক্ষরিক অর্থেই গ্লোবাল সিটিজেন। 

 

আমরা যেখানে বসেছিলাম, সেটা একটা আলাদা হলঘরের মত জায়গা; তার নির্দিষ্ট এন্ট্রি গেটের উপরের সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে লেখা - ডেস্টিনেশন রোম। খানিক পড়ে আমাদের বোর্ডিং পাশ চেক করে নিয়ে, বাসে চড়িয়ে রওনা করিয়ে দেওয়া হল রোমের ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে। এবং অদ্ভুত ভাবে এখানেও আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। আমি, বাবা আর বৃষ্টি এক বাসে, আর বাপি তার পরের বাসে। অনেক অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও আমাদের এক বাসে চড়তে দেওয়া হল না। আসলে কলকাতা এয়ারপোর্টের ওই ঘটনার পর থেকে আমি আর চাইছিলাম না কেউ আলাদা হোক। কিন্তু সেই বিধি বাম। যাই হোক, আমাদের বাসই আগে এসে পৌঁছাল প্লেনের সামনে। নিজেদের মালপত্র গুছিয়ে রেখে আমারা সিটে এসে বসলাম। প্রসঙ্গত, আমাদের বোর্ডিং হয়ে যাওয়ার আরো মিনিট পনেরো পর বাপিদের বাস এসে পৌঁছায় এবং অন্যান্য যাত্রীদের সাথে বাপিকেও ঢুকে আসতে দেখে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। তার অল্পক্ষণের মধ্যেই বোর্ডিং সম্পূর্ণ হয়েছে বলে প্লেনে ঘোষণা করে দেওয়া হল। 

 

কলকাতা থেকে আবু ধাবি - আমাদের ফ্লাইটটি ছিল আকারে ছোট। মধ্যিখানের যে গলিপথ, অর্থাৎ আইলের এপাশ আর ওপাশ মিলিয়ে মোট ছ’টি করে সিট। আমাদের দেশের অন্তর্দেশীয় বিভিন্ন রুটে সাধারণত এই ধরণের বিমানেরই ব্যবহার হয়। কিন্তু আবু ধাবি থেকে রোমের যে ফ্লাইট, তা বৃহদাকৃতির বোয়িং ৭৭৭ ওয়াইড বডি। এখানে প্রত্যেক রো’য়ে মোট ন’জন করে বসতে পারে, দুটো করে আইল। তবে শুধু যে এই বিমান প্রস্থে চওড়া তাইই নয়, আকারে আয়তনেও তা যথেষ্টই দীর্ঘ। প্লেনের ককপিট থেকে লেজ পর্যন্ত মোট তিনটি আলাদা সেকশন রয়েছে এই বিমানে। প্রথম সেকশনটি বিজনেস ক্লাস, আর তার পরের তুলনামূলক বড় সেকশন দুটি ইকোনমি। সব মিলিয়ে গোটা চল্লিশেক রো তো হবেই, অর্থাৎ প্রায় তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো লোকের বসার ব্যবস্থা। নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই আমাদের বিমান রোমের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাত্রার শুরুতে সুন্দরী বিমানসেবিকা এসে আমাদের স্বাগত জানালেন; চিরাচরিত সিকিউরিটি ব্যবস্থার প্রদর্শনও সম্পন্ন হল। এখানে বলে রাখি, ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের আগের বিমানের সাথে এই বিমানের বেশ কিছু তারতম্য আমার চোখে পড়েছে। এখানে প্রত্যেক সিটে সাজিয়ে রাখা আছে একটি করে গায়ে দেওয়ার চাদর, ছোট একটা বালিশ (কুশনের মত) এবং অবশ্যই হেডফোন, যাতে অন্যকে ডিস্টার্ব না করে সামনের সিটের গায়ে লাগানো টিভিতে পছন্দমত সিনেমা বা গান চালিয়ে দেখা যায়। এই টিভির ব্যাপারটা আগের ফ্লাইটেও ছিল, তবে এখানে চয়েস অনেক বেশি। বিভিন্ন ভাষার সিনেমা যেমন - চাইনিজ কি আরবিক, হিন্দি, কি ইংরাজি, আর তার সাথে নানারকম গানের অ্যালবাম, এমনকি ভিডিও গেমসেরও বন্দোবস্ত রয়েছে। তবে যেটা একেবারেই অনন্য তা হল, প্লেনের উইংসয়ে লাগানো কিছু ক্যামেরার মাধ্যমে এই টিভিতে বাইরের দৃশ্যের সরাসরি সম্প্রচার হয়। ফলে যাদের উইন্ডো সিট নয়, বিশেষত যাদের মাঝের রো’য়ে বসার ব্যবস্থা, তারাও কিন্তু নিজের সিটে বসে সরাসরি বাইরের দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে। এছাড়াও প্লেনের গতিপথের অন্যান্য সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য, যেমন প্লেনের বর্তমান অবস্থান, কি ম্যাপ, ভূপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা, এমন কি বাইরের তাপমাত্রা, সবই এই টিভিতে উপস্থিত। আমাদের পরপর দুটি রো’তে জানলার ধারে দুটি করে সিট রিজার্ভ করা ছিল। যাতে বাইরের দৃশ্যের কোনো মিস্‌ না হয়, তার জন্য আগের থেকেই এই ব্যবস্থা। আমাদের বিমান এবার রানওয়ে ছেড়ে আকাশের সীমানা ছুঁতেই দেখলাম, আরব দেশের এই শহর জুড়ে কত আলোর মেলা; তারা একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে আসছে দূরের পারস্য উপসাগর। দুবাইয়ের মত আবু ধাবিও তার বিভিন্ন বহুতল ও তাদের আকাশচুম্বী উচ্চতার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু না নামার সময়, না বিমান ওঠার সময় কখনই ভাল করে আবু ধাবির সেই বিখ্যাত আকাশ সীমানা দেখতে পাওয়া গেল না। আমরা শুধু চেয়ে দেখলাম সমুদ্রের তীর ধরে সরলরেখায় আলোর সীমানা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সামনে পড়ে রইল শুধুই ধু ধু অন্ধকার এবং মধ্যরাত্রির সমুদ্রের গহনে আন্দোলিত অল্প কিছু আলোর বিন্দু। 

 

আবু ধাবি থেকে রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যা ফিউমাচিনো এয়ারপোর্ট নামেও খ্যাত, এই যে আকাশপথ, তা অতিক্রম করতে আমাদের সময় লাগবে প্রায় ছ’ঘন্টা। আমাদের বিমান আমিরশাহির সীমানা ছাড়াতেই সর্বপ্রথম আমাদের রাতের খাবার পরিবেশন করে দেওয়া হল। এবার আর আগের যাত্রাপথের মত টুকিটাকি কোনো পদ নয়, বরং স্যালাড, মাংস ও সবজি সহযোগে সম্পূর্ণ ডিনার; আর তার সাথে ব্রেডরোল, ডেজার্ট এবং গরম গরম কফি বা চা; সুরারসিকদের জন্য অ্যালকোহল। প্লাস্টিকের কানা উঁচু গ্লাসে পরিবেশন করা হল রেড অথবা হোয়াইট ওয়াইন, যার যেরকম পছন্দ। বিমানসেবিকারা ওয়াইনের বড় বোতল বের করে তার থেকে সুরা পরিবেশন করলেন। তবে যারা এ রসে বঞ্চিত, যেমন এক্ষেত্রে আমার বাবা, দেখলাম তাদের জন্যও নানারকম ফলের রস ও অন্যান্য বিবিধ ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং তাদেরও আর এ যাত্রাপথে গলা সুখা রাখার প্রয়োজন পড়ল না। এহেন ভুরিভোজের পর যখন আমরা খাদ্য আর পানীয়ের যুগপৎ অভিঘাতে হা-ক্লান্ত, কেবিনের আলো ক্রমশ ঢিমে করে দেওয়া হল। অর্থাৎ ইঙ্গিতে বলা হল, এবার তোমাদের ঘুমানোর সময়। আমরাও নির্দেশমত নিদ্রাদেবীর শরণাপন্ন হলাম। এমনকি হলিউডি সিনেমার মারকাটারি অ্যাকশন দৃশ্যও এবার আর আমাকে জাগিয়ে রাখতে পারল না। তবে আধো ঘুম আধো জাগরণে কী অদ্ভুত এক খেয়াল আমায় পেয়ে বসল। কী আশ্চর্য্য! আমাদের পায়ের নীচে পড়ে রইল কতই অচেনা অদেখা সব দেশ। কোনোদিন কি তাদের নাগাল পাব? আমাদের বিমান আমিরশাহীর ঠিকানা পেরিয়ে প্রথমে সৌদি আরব, আর তারপর লোহিত সাগরের পার ঘেঁষে উড়ে চলল। বুড়ি ছোঁয়া হয়ে মাঝে দেখা দিল ইজরায়েল, ধূ ধূ বালিয়াড়ি পিরামিডের দেশ মিশর ও তারপর ভূমধ্যসাগর। এই ভূমধ্যসাগরের পথ বেয়েই আমরা উড়ে যাব আমাদের পরের ঠিকানায়, যেখানে সব পথ এসে মেশে, সেই সুদূর ইটালির প্রাচীন রাজধানী শহর রোমে। 

 

*****

 

জানলার কাঁচ বেয়ে ভোরের সূর্যের আলতো আলো আমাদের ঘুম ভাঙালো। জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, দূরের আকাশ সীমানায় যেন একটা অস্পষ্ট পাহাড়ের রেখা। নাকি মেঘ? সামনের টিভি ইঙ্গিত দিচ্ছে রোম আর বেশি দূরের পথ নয়। আমাদের বিমান রাত্রিকালীন উচতা থেকে অনেকটাই নীচে নেমে এসেছে। ইন্টারকমে পাইলটের ঘোষণা শোনা গেল আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রোমে অবতরণ করব। বিমানসেবক ও সেবিকারা দ্রুতলয়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করলেন। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্য এবার একটু কফির দরকার পড়ল। পালা করে ইংরাজি, ইটালিয়ান ও আরবি ভাষায় অ্যানাউন্সমেন্ট শুরু হল, যে এবার আপনারা সিটবেল্ট বেঁধে নিন। আর এত কিছুর মধ্যেই আমাদের বিমান কোন ফাঁকে যেন হুড়মুড়িয়ে এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁল। বোতাম টিপে মোবাইল অন করতেই কিমাশ্চর্যম্‌, মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে এসে সারা রাতের একগাদা মেসেজ টুং টাং শব্দে তাদের আগমন বার্তা জানাল। ভারত পেরিয়ে আরব মরুভূমির দেশে এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে, তাও না হয় কষ্টকল্পনা ছিল, কিন্তু বিশুদ্ধ ইটালিয়ান ভাষায় এয়ারটেল যে আমাদের রোমে স্বাগত জানাবে, এমন প্রত্যাশা একেবারেই করি নি। তবে বাকিদের কারোর ফোনেই কোনো নেটওয়ার্ক নেই। একমাত্র আমার ফোনই দেখলাম সচল রয়েছে। সেটাও কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। কলকাতা থেকে সবার ফোনেই ম্যাট্রিক্স কোম্পানির সিমকার্ড ভরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ম্যাট্রিক্সের সাথে চুক্তি ছিল ইটালিতে ঢোকার আগেই তাদের সিমগুলি সচল হয়ে যাবে। সে মর্মে তাদের সাথে যাবতীয় কথাবার্তা পাকা করে এসেছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল অত পয়সা দিয়ে কেনা সিমগুলির একটিও তখনো অ্যাক্টিভেট হয় নি। সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার নিজের ফোনে যদি এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক না থাকত আমরা পড়তাম মহা বিপদে। সব থেকে বড় কথা, এখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে ছয়। এদিকে ফেডেরিকোর মেসেজ অনুযায়ী দশটার সময় আমাদের সারথি তার গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টের গেটের বাইরে অপেক্ষায় থাকবে। কিন্তু এত বড় একটা এয়ারপোর্টের এক্সিট তো আর নিশ্চয়ই একটা নয়। আর পার্কিংও নিশ্চয়ই রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সুতরাং, মোবাইলের নেটওয়ার্ক না থাকলে এ বিশাল বিমানপোতে কোথায় ড্রাইভার, কোন দিকে সে অপেক্ষায় রয়েছে; তার সাথে যোগাযোগ করা এক কথায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর আমরা নিজেরাও যদি কোনো কারণে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি সেক্ষেত্রে একে অপরের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় থাকবে না।  

 

 

রোমের সীমানায় 

 

একরাশ দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা সঙ্গী করে প্লেন থেকে নেমে টার্মিনালে ঢুকলাম। এবারেও আমাদের বাসে চাপিয়ে টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হল। বিমান থেকে অবতরণের সময় বিমানসেবক আর সেবিকারা আমাদের শেষবারের মত বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বাসে এসে উঠলাম। ফিউমাচিনো এয়ারপোর্ট ইউরোপের অন্যতম বড় এবং ব্যস্ত একটি এয়ারপোর্ট, যার পোশাকি নাম - লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফিউমাচিনো এয়ারপোর্ট। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি - রেনেসাঁ ইটালির এই বিশ্ববরেণ্য পন্ডিত এবং চিত্রশিল্পীর নামে রোম এয়ারপোর্টের নামকরণ করা হয়েছে। অনেকেরই মতে মোনালিসা, ভিট্রুভিয়ান ম্যান বা দ্য লাস্ট সাপারের মত শিল্পকর্মের জনক দ্য ভিঞ্চি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম চিত্রকর। তবে দ্য ভিঞ্চির অধিকাংশ শিল্পকলাই ছড়িয়ে আছে ফ্লোরেন্স বা মিলানের মত ইটালির বিভিন্ন শহরে। রোমকে বরং সেদিক দিয়ে বার্নিনির ক্যানভাস বলে ধরা যেতে পারে। আমাদের চারপাশে এখন সহযাত্রীদের ভিড়, কত দেশের কত মানুষ। পোশাক আশাকে বোঝাই যায় এদের অধিকাংশই ট্যুরিস্ট। গরমের ছুটিতে ইউরোপে কিছুদিন সময় কাটাতে এসেছেন। দীর্ঘাঙ্গী যুবতীটি তার যুবক বন্ধুর সাথে এক কোণে আলিঙ্গনে বদ্ধ। চোখে রঙিন চশমা পরা এক শিশুকে ট্রলির উপর বসিয়ে তার বাবা-মা ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন। দুই বিশালাকায় আফ্রিকান মহিলা, নিগ্রো, মাথায় ঘন কাজ করে বিনুনি বাঁধা, নিজেদের মধ্যে তারা গল্পে মশগুল। তবে দুচোখ ভরে চারদিকের এইসব দৃশ্য, মানুষজন দেখব কি, আমার চোখ তখন আটকে কেবল মোবাইলের পর্দায়। অন্যদের বিরক্তি উৎপাদন করে বারবার কল করছি সেই ম্যাট্রিক্সের হেল্প লাইন নম্বরে। নিশ্চয়ই চড়চড় করে রোমিংও কাটছে। দিল্লির বাসিন্দা যে এরিয়া ম্যানেজার আমার সিমের ব্যবস্থা করেছিলেন তার সাথেও এরই মধ্যে কথা হল। সব কিছু মিলিয়ে দেখে তিনিও হতভম্ব, জানালেন যে এ ঘটনা সত্যিই রীতিমতো আস্বাভাবিক। এদিকে তাদের টেকনিকাল টিমের লোকেরাও বারংবার ফোন করছে এবং এটা ওটা টিপে দেখে আমাদের সিম কার্ডগুলি অ্যাক্টিভেট হচ্ছে কিনা তাদের জানাতে বলছে। কিন্তু যেভাবে যাই করা হোক না কেন, সেই মুহূর্তে আমাদের পরিস্থিতির কোনো ভাবেই কোনো সুরাহা হল না। 

 

বিমান থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল কোন কনভেয়ার বেল্টে আমাদের মালপত্র আসবে। সেইমতো দিকনির্দেশ মেনে আমরা ফিউমাচিনো এয়ারপোর্টের ভুলভুলাইয়ায় পা রাখলাম। তবে মালপত্র সংগ্রহ করার আগে আমাদের এখনো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি। আর সেটা হল ইমিগ্রেশন থেকে চেক আউট। এখানে বলে রাখি, কলকাতা বা দিল্লির মত এয়ারপোর্ট থেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে ঢোকার যে প্রসেস - সেটা ঠিক যতটা চটজলদি হয়, রোম বা ফ্রাঙ্কফুর্টের মত ইউরোপের বিভিন্ন এয়ারপোর্ট থেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে বেরোনোর প্রসেসটা ঠিক ততটাই সময়সাপেক্ষ। ইউরোপের দেশগুলোতে ইমিগ্রেশনের লাইন কতটা লম্বা হতে পারে তার সম্যক একটা ধারণা আমার আগে থেকেই ছিল। বছর পাঁচেক আগে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমায় হতে হয়েছে। কিন্তু এবারের এই গ্রীষ্মকালীন ফিউমাচিনো এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হল তা ছিল আমার কষ্ট কল্পনারও বাইরে। প্রায় এক কি দুই কিলোমিটার লম্বা বেশ কিছু প্যাঁচালো লাইন, শুরুর মুহূর্তে সংখ্যায় বোধ হয় গোটা চারেক কি পাঁচেক, সাপের মত তারা এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক এলাকা জুড়ে। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সে লাইনের মুড়ো কোথায় আর ল্যাজা কোথায় অনুমান করা এক রকমের অসম্ভব ব্যাপার। একের পর এক গায়ে লাগোয়া হলঘর - তার কোথাও কোনো তিলধারণের জায়গা নেই। কালো কি ধলা, লম্বা কি বেঁটে, হিস্পানিক কি এশিয়ান, গোটা পৃথিবীর সমস্ত মনুষ্যষ্যজাতি বুঝি ভিড় করেছে এই একই হলঘরে, আর সে ঘরের ভেতর দিয়ে আমাদের লাইন এগোচ্ছে শামুকের চেয়েও শ্লথ গতিতে। প্রকৃত অর্থেই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে বিমানপোতের এসি ততক্ষণে পুরোপুরি বিকল। লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই দরদর করে ঘেমে চলেছি। এতক্ষণ প্লেনের সিটে বসে থাকার কারণে অল্প সল্প কোমরের অস্বস্তি তো ছিলই, এবার তার সাথে যোগ হল পায়ের চিনচিনে ব্যথা। এয়ারপোর্ট জুড়ে তখন প্রায় হাওড়া স্টেশনের মত দৃশ্য। ব্যাগপত্র মাটিতে বিছিয়ে বসে লোকজন সুযোগ মত অল্প একটু জিড়িয়ে নিচ্ছে। কেউ আবার এরই ফাঁকে পকেট থেকে বের করে এনেছে হাতপাখা, পিলারের গায়ে অলস (নাকি হতাশ?) হয়ে হেলে দাঁড়িয়ে সামান্য হাওয়া খেয়ে নিচ্ছে। মোবাইল কানে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কথা বলেই চলেছে কেউ, আবার কেউ ব্যস্ত নেট সার্ফিংয়ে। বাচ্চারা অধৈর্য্য হয়ে কান্নাকাটি করছে। তাদের বাবা-মারাও উদ্বিগ্ন, বিরক্ত এবং উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছে মক্কা আর কতদূর। আগ্রহীদের জন্য জানিয়ে রাখি, ইমিগ্রেশনের এই লাইনগুলির মধ্যেও আবার বিশেষ বিভাজন রয়েছে। এখানে বেশ কিছু লাইন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জন্য সংরক্ষিত, আর কিছু লাইন সংরক্ষিত ইউ কে (যুক্তরাজ্য) এবং ইউ এস এ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই এই লাইনগুলির গতি আমাদের তুলনায় সামান্য বেশি, আর ভিড়ও তুলনামূলকভাবে কম। তবে ভিড়ের কথা বলতে গেলে, তা সব থেকে বেশি আমাদের এই লাইনেই। এখানে জড়ো হয়েছে ইউরোপ আমেরিকার তাবড় দেশগুলি বাদ দিয়ে রেস্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। না আমাদের জন্য সংরক্ষণের সুবিধা নেই ঠিকই, কিন্তু পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দেখা যাবে ইউরোপের ট্যুরিজম বিজনেসের মূল প্রফিট কিন্তু আসে এই রেস্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডের থেকেই, যে লাইনে ভারতীয়, চিনা ও জাপানি পর্যটকেরাই ভিড় করে থাকে, হয়ত তারা বেড়াতে ভালোবাসে বলেই। 

 

ভেবেছিলাম, ফিউমাচিনো এয়ারপোর্টে আমাদের বেশ কিছুটা সময় অলস ভাবে কাটবে। আর সে সুযোগে এখানেও এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি শপগুলোও একবার একটু ঢুঁ মেরে নেব। কিন্তু পুরো ইমিগ্রেশনের প্রসেসটা শেষ হতেই সাড়ে নটা বেজে গেল। পাক্কা আড়াই ঘন্টার অপেক্ষার পর আমরা পুরো বিধ্বস্ত অবস্থায় কাউন্টারে এসে পৌঁছলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার, এক বিশাল চেহারার আফ্রিকান বংশোদ্ভুত ভদ্রলোক, আমাদের সমস্ত কাগজপত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখলেন। তার প্রশ্নবাণের যথোপযুক্ত উত্তর দিয়ে আমরা যখন কনভেয়ার বেল্টের কাছে এসে উপস্থিত, তখন যথেষ্টই বেলা বয়ে গেছে। সাধারণত এয়ারপোর্টগুলোর কনভেয়ার বেল্টে মালপত্র এক দেড় ঘন্টার বেশি ঘোরানো হয় না। তবে এটা যে রোম এয়ারপোর্ট, আর ইউরোপের ইমিগ্রেশন লাইনে সময় লাগবে, এটাই তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। তা সত্ত্বেও আমাদের এতগুলো স্যুটকেসের কী হাল হবে সে নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা ছিলই। বেল্টে পৌঁছে দেখলাম আমাদের ফ্লাইটের বেশ কিছু মালপত্র তখনও সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই ঘূর্ণায়মান মালপত্রের ভিড়ে আমাদের পাঁচটা দামড়া দামড়া স্যুটকেসের কোনো সুলুক সন্ধান পাওয়া গেল না। শেষপর্যন্ত বাকিদের বেল্টের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি চারপাশটা ভালো করে খুঁজে দেখতে গেলাম। তখনই চোখে পড়ল বেল্টের অদূরেই বেশ কিছু স্যুটকেস অবিন্যস্তভাবে নীচে নামিয়ে রাখা আছে। প্যাসেঞ্জারদের দেরী দেখে এয়ারপোর্টেরই কোনো স্টাফ হয়তো সেগুলো সরিয়ে রেখেছেন। আমাদের প্রমাণ সাইজের মালপত্রগুলিও সেই গুচ্ছের মধ্যে শোভা পাচ্ছে। 

 

রাস্তার উলটোদিকে লিওনার্দো এক্সপ্রেসের বিশাল পার্কিং 

 

দ্রুত পায়ে মালপত্র সংগ্রহ করে আমরা এক্সিটের দিকে এগোলাম। এর মধ্যে ম্যাট্রিক্সের ইন্ডিয়া অফিসের সাথে আমাদের অজস্র বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তিন তিন ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেলেও আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান বেরোয় নি। এখনো আমাদের সিমগুলো সেই বিকল অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। সেগুলো পুরোপুরি ডিঅ্যাক্টিভেট থেকে গেলে আমাদের গোটা ট্যুরের কি হাল হবে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি, হঠাৎই এয়ারপোর্ট ছেড়ে বেরোনোর রাস্তায় চোখে পড়ে গেল, পথের ধারে লাল সাদা আলোয় উজ্জ্বল ভোডাফোন ইটালির এক বড়োসড়ো স্টল। স্টলের গায়ে জ্বল জ্বল করে ইংরেজিতে লেখা এখানে ইটালির সিম কার্ড বিক্রি করা হয়। আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। তক্ষুনি তক্ষুনি দুটো সিম কার্ড (একটা আমার নিজের জন্য আর অন্যটা বৃষ্টির জন্য) কিনে নেওয়া হল। ম্যাট্রিক্সের সিম পরে চলুক বা নাই চলুক এবার অন্তত আমাদের কাছে কিছু একটা ব্যাকআপ থাকবে। দোকানের সেলস্‌ম্যান আমাদের সামনেই মোবাইল ফোন খুলে সিম অ্যাক্টিভেট করে দিলেন। তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এসে আমরা আমাদের ড্রাইভারকে কল করলাম। ফেডেরিকো কাল গভীর রাতে আমাকে ড্রাইভারের নাম্বার মেসেজ করে রেখেছিলেন। ততক্ষণে অবশ্য দশ’টা বেজে গেছে। ফেডেরিকোর ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী আমাদের ড্রাইভারের এর মধ্যেই পিক আপ করতে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু বার বার ফোন করার পরেও তিনি আমাদের কল রিসিভ করলেন না। ইতিমধ্যে অবশ্য ফেডেরিকো নিজেও আমাদের ফোন আর মেসেজ করা শুরু করেছেন। অসুস্থতার কারণে এবার আমাদের সামনা সামনি আলাপ পরিচয়ের সম্ভাবনা না থাকলেও তার বাড়িতে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য তিনি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। ফেডেরিকো কীভাবে তার বাড়িতে ঢুকতে হবে তার ডিটেলড্‌ ইনস্‌ট্রাকশন আমাদের ফোনেই বুঝিয়ে দিলেন। এয়ারবিএনবির চ্যাটের মাধ্যমেও সেই নির্দেশ আমাদের হাতে এসে পৌঁছাল। কিন্তু, ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভারের কী হল? ফেডেরিকো নিজেও তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছেন। কিন্তু সাড়ে দশটা বেজে গেলেও এখনো তার ফোন সুইচড্‌ অফ। আমরা অবশ্য ততক্ষণে এয়ারপোর্টের এক্সিট গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে রোমের ব্যস্ত রাজপথ। ইউরোপ আর এখন কোনো অলীক স্বপ্ন-কল্পনা নয়। 

 

আমরা যেখানে বসে আমাদের ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করছি তা ফিউমাচিনো এয়ারপোর্টেরই দ্বিতীয় তলা। বিল্ডিংয়ের বাইরে সাজানো গোছানো সব ছোট ছোট বেঞ্চ, ফুলের টব, যাত্রীদের জন্য চৌকোমত বসার জায়গা। সেখানেই আমরা এখন আস্তানা গেঁড়েছি। আমাদের সামনের এক্সিট রোডে একের পর এক গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে; তাদের পিক-আপ সেরে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে চলে যাচ্ছে এয়ারপোর্ট ছেড়ে। দোতলা থেকে নীচে তাকালে রাস্তার ওপারেই দেখতে পাচ্ছি লিওনার্দো এক্সপ্রেসের বিশাল পার্কিং ও রেল স্টেশন। এই রেল স্টেশন থেকেই প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর একটি বিশেষ মেট্রো, লিওনার্দো এক্সপ্রেস ছাড়ে যা ফিউমাচিনো এয়ারপোর্টকে মূল রোম শহরের সাথে যুক্ত করেছে। ফিউমাচিনো এয়ারপোর্ট রোম শহরের নাগরিক কেন্দ্রগুলি থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখান থেকে রোম টার্মিনি, যা রোমের মূল রেল স্টেশন; মেট্রোর মাধ্যমে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে মোট বত্রিশ মিনিট। কিন্তু আমাদের যেতে হবে রোম টার্মিনি ছড়িয়েও আরো দূর, রোমের শহরতলি ট্রাস্টেভেরে এলাকায়। রোমের বিখ্যাত বা কুখ্যাত মিড-নাইট পার্টি জোন এবং সেখানকার শোরগোল থেকে দূরে এই সব অঞ্চলই রোমের মূল রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। এয়ারপোর্ট থেকে দূরত্বের কারণেই আমরা মেট্রো না নিয়ে নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা করেছি, যে গাড়ি এখন নিরুদ্দেশ। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর এবার আমাদের ড্রাইভার রবের্তো নিজেই ফোন করে জানালেন যে তিনি এয়ারপোর্টের পার্কিংয়ের ভেতর আটকা পড়ে আছেন। এতক্ষণ সিগনালের অভাবে কল করতে পারছিলেন না। কে বা কারা সেদিনই সকালে এয়ারপোর্ট অথোরিটিকে হুমকি দিয়ে জানিয়েছে যে ফিউমাচিনো এয়ারপোর্টের পার্কিংয়ের ভেতর কোথাও বোম রাখা রয়েছে। এখন সেখানে পুলিশ আর পুলিশ। সমস্ত গাড়িরই খানা তল্লাশি চলছে। আমাদের তো শুনেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এই তো কিছুদিন আগেই শুনেছি আইসিসের জঙ্গিরা ইটালির বেশ কিছু জায়গা আত্মঘাতী হামলার জন্য টার্গেট করেছিল। ইউরোপে পৌঁছেই কি তবে জঙ্গি হামলার মুখোমুখি হতে হবে নাকি? এসব খবর যে কারোর হৃদ্‌স্পন্দন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে আমাদের সারথি দেখলাম মোটেও সেভাবে উত্তেজিত নয়। কে জানে, হয়তো এসব থ্রেট এখানে হামেশাই আসে। আমাদের আশ্বস্ত করে তিনি বললেন, আপনারা আরো আধঘন্টা অপেক্ষা করুন। কিচ্ছু হবে না। গেটে সিকিউরিটির জন্য বেরোতে একটু দেরি হচ্ছে মাত্র। আমি পিক আপ করতে আসছি।  

 

রবের্তোর রথ এবং আমরা 

 

নেট ঘাটতে গিয়ে দেখলাম, রোম এয়ারপোর্টের বোমাতঙ্ক ইতিমধ্যেই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোয় ফলাও করে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আবারো রবের্তোর ফোন। তিনি এবারে পৌঁছে গেছেন। আমাদের জন্য এক্সিট গেটে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কোথায় কে। একটার পর একটা গাড়ি তো চোখের সামনে দিয়েই হুশ করে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। অনেক অনুসন্ধানের পরেও আমাদের গাড়ির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। বেগতিক দেখে এবার রবের্তো ফোন করে বললেন, আমাদের এবং আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গার ছবি হোয়াটস্‌ অ্যাপ করে তাকে পাঠাতে। সেলফি তোলা হল। রবের্তোর সাথে কথা বলে বোঝা গেল, আমরা রয়েছি ভুল গেটে। দোতলায় নয়, আমাদের আসতে হবে একতলায়। দুই তলাতেই গেটের নাম্বার এক, আর সেখানেই কনফিউশন। আবার আমাদের এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রবেশ করতে হল। এক্সিট গেটের কাছেই বড়সড়ো একটা কাঁচের দেওয়াল ঘেরা লিফট। সেই লিফট ধরে নীচে নামতেই দেখি নীল জিনস্‌ কালো টি-শার্ট পরিহিত সৌম্যদর্শন বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের জন্য একেবারে লিফটের দোরগোড়ায় অপেক্ষা করছেন। দেরি হবার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ভদ্রলোক একরকম আমাদের হাত থেকে মালপত্র ছিনিয়েই নিলেন। আমরা তার পেছন পেছন হাঁটা দিলাম বাইরের পার্কিংয়ে। মূল এয়ারপোর্ট থেকে পার্কিং বেশ খানিকটা দূর। ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকে লিওনার্দো এক্সপ্রেসের সেই পার্কিং, সেসবও অতিক্রম করে গলি, তস্য গলি পথে মিনিট পাঁচ হাঁটা রাস্তা। আমাদের কাছে সবই নতুন। হাঁ করে ট্রাফিক এবং ট্রাফিক জ্যামের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করছি। এখানে গাড়ি উলটো পথে চলে। আমাদের ড্রাইভার দ্রুত লয়ে আমাদের রাস্তা পার করিয়ে কাছের এক খোলা চত্ত্বরে গাড়ির সামনে এসে হাজির করলেন। সেখানে শয়ে শয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে আমাদের গাড়ির চেহারা দেখে আমরা তো হাঁ। বিশাল এক কালো কুচকুচে মার্সিডিজ ভ্যান। ভেতরে জনা দশেক লোক আরামে এঁটে যাবে এমনই তার চেহারা। বিশাল বিশাল কালো জানলা, উডেনের উপর লেদার ফিনিশ করা সিট, যাকে বলে লাক্সারিয়াস ইন্টেরিয়র। পুরো গাড়িই একেবারে অত্যাধুনিক, হাল ফ্যাশানের, তার চলন বলন পুরোপুরি টেকনোলজি নির্ভর। রিমোট নির্দেশে দরজা খুলে যায়। ভেতরে চক চক করছে ড্যাশ বোর্ড, মাউন্টেড ট্যাব। পেছনে বিশাল এক বুট, মালপত্র রাখার অঢেল জায়গা। সেখানে আমাদের এতগুলো স্যুটকেস রেখেও আরো জিনিসপত্র ঢোকানো যাবে এমন স্পেস রয়েছে। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গা এলিয়ে বসলাম। রবের্তো আমাদের সিটে বসিয়ে, গাড়ির টেম্পারেচার চেক করে নিয়ে রওনা দিয়ে দিলেন।  

 

*****

 

এবং রোম শহরে আমাদের যাত্রার শুভ সূচনা হল। এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা পথ আমাদের সাথে সাথে চলল লিওনার্দো এক্সপ্রেসের রেললাইন, আর তার পাশে পাশে সবুজে সবুজ জলপাইয়ের ক্ষেত। ক্রমে শুরু হল জনবসতি। টিবার নদী পেরিয়ে আমরা রোম শহরে এসে ঢুকলাম। হ্যাঁ সেই টিবার নদী। একদিন এই নদীপথ বেয়েই রোমান রণতরী বিশ্বজয়ের আকাঙ্খায় বেরিয়েছিল। তাদের আঘাতে একের পর এক ধ্বংস হয়েছে পৃথিবীর প্রাচীন সমস্ত জনপদ - কার্থেজ, কোরিন্থ, থিবিস, সিরাকাস, কিংবা জেরুজালেম। গড়ে উঠেছে সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্য। তবে যে নদী এত বিখ্যাত, যার স্রোত ইতিহাসের স্রোত হয়ে বয়ে গেছে, কল্পনায় তাকে ভেবেছি তার দুকূল উপচে পড়েছে ঢেউয়ে; কিন্তু বাস্তবে তাকে দেখে বেশ হতাশ হলাম। কোথায় ঢেউ, আর কোথায় কি। ছোট একফালি জলধারা শহরের বুক চিড়ে বেরিয়ে গেছে। কিছু বয়সে অত্যন্ত প্রবীণ, আর তারই সাথে কিছু অতি আধুনিক নবীন সেতু বন্ধন রচনা করেছে তার দুই পাড়ের। এ নদী প্রস্থে আমাদের গ্রাম বাংলার ছোট নদীগুলির থেকেও ছোট। আর এরই স্রোত বেয়ে ভেসেছিল কিনা রণতরী! তবে আমাদের এই অল্প সময়ের যাত্রাপথেই কত অজস্র পরিচিত ল্যান্ডমার্ক আমাকে বিস্ময় চকিত করেছে। এত দিন যা ছিল গল্পের বইয়ের পাতায় কিংবা সিনেমার দৃশ্যে এবারে তা বাস্তব হয়ে ধরা দিল। আমাদের ঘরে যাওয়ার রাস্তাতেই দেখলাম টিবার নদীর ব্রিজের ওপারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাসেল সান্ত্‌ অ্যাঞ্জেলোর বিশাল গোল টাওয়ার। ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত উপন্যাস অ্যাঞ্জেলস্‌ অ্যান্ড ডেমনস্‌ যারা পড়েছে তাদের কাছে রোমান সম্রাট হেড্রিয়ানের এই সমাধি মন্দির সুপরিচিত না হয়ে যায় না। রোমের বিখ্যাত কিছু পিয়াজ্জাও (বস্তুত টাউন সেন্টার বা নগরকেন্দ্র) পার করে চলে এলাম। তাদের শোভা এমনই যে চোখ ফেরানো যায় না। মনে হয় গাড়ি থামিয়ে আরো একটু সময় নিয়ে সেসব দেখতে পারলে ভালো হত। অপূর্ব সব স্ট্যাচু, স্থাপত্য, আর ফোয়ারায় সাজানো সমৃদ্ধ একেকটা নগরকেন্দ্র। তবে সেখানেই শেষ নয়, স্কাইলাইনে এবার দেখা দিল রোমের সব থেকে উঁচু এবং বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক, সেন্ট পিটার্স ক্যাথিড্রালের চুড়া। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর বানানো এই বিখ্যাত শিল্পকর্ম দূর থেকেই আমাদের মুগ্ধ করল। আমরা সেসব ছাড়িয়ে রওনা দিলাম শহরতলির পথে। 

 

রোমের রাজপথে - দ্বিতীয় ভিক্টর ইম্যানুয়েলের মনুমেন্ট 

 

ভাঙা ইংরাজি এবং ইটালিয়ান মিশিয়ে রবের্তো গাইডের কাজটাও মোটামুটি করে দিচ্ছিলেন। একটা জিনিস দেখে বেশ অবাক লাগছিল। এখন আমরা যে অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলেছি সেখানে ইউরোপ বা এশিয়ার অন্যান্য বড় শহরের মত নতুন ঝাঁ চকচকে সব বাড়িঘর, কিংবা বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং বা বহুতল নেই বললেই চলে। হালকা হলুদ, লাল, গোলাপি কিংবা ধূসর বর্ণের পুরনো বাড়িগুলির অধিকাংশই দোতলা, খুব বেশি হলে তিনতলা। রাস্তা থেকেই তারা খুব একটা জায়গা না ছেড়ে খাড়া হয়ে উঠে গেছে। বাড়ির সামনে সামান্য যা ড্রাইভ-ওয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি। মূল দরজার উপর ছোট ছোট কারুকাজ। ভীষণ সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো ব্যালকনি, কাঁচের জানলা; রঙ বেরঙের বিবিধ ফুলের ভারে তারা রঙিন হয়ে আছে। রবের্তোর থেকেই জানতে পারলাম, রাজপথের দুধারে এই বাড়িগুলির কোনটিরই বয়স শ’তিনেকের কম নয়। মূল রোম শহরের বাড়িগুলি অধিকাংশই শতাব্দী প্রাচীন, এবং রোমের জনগণ ও সরকার দুইই বাড়িগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সমানভাবে উদ্যোগী। সব থেকে আশ্চর্য এই যে, বাড়িগুলির কোনোটিই বয়সের ভারে সেভাবে ঝুড়ঝুড়ে হয়ে যায় নি। অথচ আমাদের দেশে একশো দেড়শো বছরের পুরনো বাড়িগুলিই কেমন সংরক্ষণের অভাবে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। রোম শহরে এখনো খুব স্বাভাবিক ভাবেই লোকেরা এই সব পুরনো বাড়িতে বসবাস করে। বরং থাকার জন্য হাল ফ্যাশানের অত্যাধুনিক বাড়িঘর তাদের না-পসন্দ। 

 

মিনিট চল্লিশ কি পঞ্চাশ পথ চলার পর, একটা বড় রাস্তা থেকে আমাদের গাড়ি ডানদিকে শার্প টার্ন নিল। ছোট গলিপথ বেয়ে ঢাল ধরে খানিকটা নেমে এসে রবের্তো তার গাড়ি থামিয়ে দিলেন। এই গলিপথের নাম ভিয়া মারিয়া লোরেঞ্জো লঙ্গো। আমরা এসে পৌঁছেছি আমাদের গন্তব্যে, ফেডেরিকোর বাড়ির ঠিকানায়। তার বাড়ির নাম কানডিনস্কি হাউস, রুশ চিত্রশিল্পী কানডিনস্কির বিবিধ চিত্রকলায় সাজানো এই বাড়ি। ফেডেরিকো নিজেও নিশ্চয়ই তার কাজের ভক্ত। কানডিনস্কি হাউস অফ-হোয়াইট রঙের পুরনো ধাঁচের একটি চারতলা বাড়ি, সামনেই ছোট লোহার গেট। সেই গেটের পাশেই লাগানো ইন্টারকম। সেখানে আমাদের আগমনবার্তা ঘোষণা করা হলে অটোমেটিকালি লোহার দরজা চিচিং-ফাঁক হয়ে যাবে। তবে তা একবারের জন্যই। পরের বার থেকে অন্য ব্যবস্থা। এই বিল্ডিংয়ের গোটা তিনতলা আমরা সামনের তিনদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছি। আমাদের সামনেই রাস্তার একটা ব্যস্ত ইন্টারসেকশন, সেখানে হু হু করে ছুটে চলেছে বাস, ট্যাক্সি, আর প্রাইভেট গাড়ি। এই রাস্তা দিয়ে ট্রামও চলে, তবে এখন তা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে সাময়িক ভাবে বন্ধ। আমাদের ডানদিকে একটা পেট্রোল পাম্প, রাস্তা পেরিয়ে উলটো দিকে ওষুধের দোকান। আর আমাদের বাড়ির গা-ঘেঁষে বাঁদিকে একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ। রবের্তো গাড়ির বুট খুলে আমাদের মালপত্র সব নামিয়ে বিদায় নিলেন। আমরাও প্রয়োজনীয় খরচপত্র মিটিয়ে আমাদের স্যুটকেস তিনতলায় তোলার কাজে মনোনিবেশ করলাম। বাইরের লোহার গেট পেরিয়ে একটু এগোলেই সামনে সিঁড়ির দরজা। ডানহাতে। লিফট নেই। অবশ্য এত সমস্ত পুরনো বাড়িতে লিফটের আশা করাও সমীচিন নয়। ইন্টারকমের মাধ্যমে বাইরের গেটের সাথে সিঁড়ির দরজাও একসাথেই আনলক হয়ে গেছিল। আবারও তা লক হয়ে গেলেই চিত্তির। সুতরাং বাপি প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে, আর বাবা বাইরের দরজার সামনে। আমি ও আমার সহধর্মিনী এরই মধ্যে রাস্তার ঢাল বেয়ে এদিক ওদিক গড়িয়ে যাওয়া আমাদের সমস্ত ব্যাগ পত্র সংগ্রহ করে কোনোরকমে তাদের টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে ঢোকালাম। সিঁড়ির দরজার পাশেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার আর তার গা ঘেঁষে লাগানো কি-সেফ। তার কম্বিনেশন আমার জানা। সেখান থেকে চাবি সংগ্রহ করে, কি সেফের কম্বিনেশন পুনরায় ঘেঁটে দিয়ে এবারে একবারে তিনতলা। 

 

এই বাড়ির প্রত্যেকটি কোণা আমার এখনও মুখস্থ। আসলে সামনের তিনদিন এই ফ্ল্যাট আমাদের বাড়িঘর হয়ে উঠবে। ফেডেরিকো শিল্পী মানুষ। তার বাড়ির প্রতিটি অংশে শিল্পের ছোঁয়া। সুন্দর সুন্দর ছবি (অধিকাংশই কানডিনস্কির), ল্যান্ন্ডস্কেপে দেওয়াল ভরে আছে। বাইরের লিভিং রুমের একটা বড় অংশ জুড়ে নানারকম বইপত্র, ম্যাগাজিন; তার সাথে গানের সিডি ও ডিভিডির বিশাল আয়োজন। শোভা পাচ্ছে ফেলিনি, ভিত্তোরিয়ো দে সিকা, রোসেলিনি। বিভিন্ন আর্টফর্ম, যেমন নাটক, বা সিনেমা, ইটালিয়ান নিও-রিয়েলিজম সংক্রান্ত ইটালিয় ও ইংরেজি ভাষায় লেখা বিবিধ বই। অন্যপাশে কিচেন ও কাউন্টার; যার প্রত্যেকটি ড্রয়ার ও ক্যাবিনেট আমাদের জন্য ফেডেরিকো এর মধ্যেই গুছিয়ে রেখেছেন। নুন, চিনি, সস, চিলিফ্লেক্স বা অরিগ্যানো, (যারা বোঝার তারা এর মধ্যেই ইঙ্গিত বুঝে নিয়েছেন) এবং সাথে গুঁড়ো দুধ, চা-পাতা, কফি ও কোকো - ইত্যাদি এই কদিনে যা যা প্রয়োজন হতে পারে তার সবেরই বন্দোবস্ত রয়েছে। ঝকঝক করছে কাঁচের ও সেরামিকের বাসনপত্র, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, ইনডাকশন ও ওভেন। ছোট্টো একটা প্যাসেজের ওপারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুম; সেখানেই ওয়াশিং রুম, আর বিডেট - স্নান করার আলাদা জায়গা ভাগ করা। আর আছে বড় বড় দুটো বেডরুম, তার সর্ব অঙ্গে রুচির ছাপ। পুরনো কলকাতার মত খড়খড়ি দেওয়া বড় বড় তার জানলা। সাজানো বাঙ্কবেড। একপাশে নরম কাউচ। আর আমার এ কদিনের বিশ্রামের, ক্লান্তি নিরসনের প্রিয় জায়গা - বেডরুমের লাগোয়া কাঁচের দরজা পেরিয়ে ছোট্ট একটা রেলিং দেওয়া ব্যালকনি। সেখান থেকে দূরে তাকালেই নীল নীল মেঘ পাহাড়; আর রোমের ব্যস্ত রাজপথ সমস্ত মুগ্ধতায় ছড়িয়ে রয়েছে দিগন্ত জুড়ে। 

 

*****

ক্রমশ 

 

 

 

2 Comments
  • avatar
    নির্মাল্য কাকা

    29 July, 2024

    ইতালিতে নেমে সিম কার্ড কেনার সময় কি কি পেপার দেখতে চাইল?

  • avatar
    রাজর্ষি ঘোষ

    30 July, 2024

    একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হয়েছিল। আর পোজ দিয়ে দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছিল। আর ডকুমেন্ট বলতে পাসপোর্ট আর ভিসার কপি। খুব ভুল না হলে এক কপি আইটেনারি জমা নিয়েছিল। মজার ব্যাপার হল সিমটা এই আগের মাস অবধিও এক্টিভ ছিল। মাঝে মাঝেই ইটালিয়ান ভাষায় মেসেজ আসত।

Leave a reply