পর্ব ৪ঃ যে শহর কখনো ঘুমোয় না
বোরগেজে গ্যালারি দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর তিনটে বেজে গেছিল। ততক্ষণ কোনো খাবারই জোটে নি। তার উপর রোমে প্রথমদিন; শহরের রাস্তাঘাটও তেমন সড়গড় হয় নি আমাদের। কানডিনস্কি হাউসের গায়ে লাগানো রেস্তোরাঁটিই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেখানে ঢুকতে গিয়েই জোর ধাক্কা। সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত, কাঁচা-পাকা দাঁড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক, চেহারায় তিনি সাক্ষাৎ ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু - দুদিনের চুরুট টানা বিমর্ষ মুখে এবং কিঞ্চিৎ খ্যান খ্যানে গলায় - ভাঙা ভাঙা ইটালিয়ান মিশ্রিত ইংরেজি বচনে বলে উঠলেন, কিচেন ইজ ক্লোজড। কাছাকাছি কোথায় খাবার পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করায় ভদ্রলোক শূন্য দৃষ্টিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ইউ মে ট্রাই দ্য রেস্টুরেন্টস ডাউন দ্য লেন। ভদ্রলোকের কাঁধ ঝাঁকানি দেখে অনুমান করা গেল, সেই রেস্টুরেন্ট এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে। অতএব সময় নষ্ট না করে আমরা আবার রাস্তায় নেমে পড়লাম। মিশন বোরগেজের পর এইবারে, মিশন রেস্টুরেন্ট। এখানে বলে রাখি, পরবর্তী দুদিন আমরা যখনই ওই রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি, সবসময় কিচেন ক্লোজডই পেয়েছি। কানডিনস্কি হাউসের গায়ে লাগোয়া সি-ফুড রেস্টুরেন্টটি যে কখন খোলে আর কখনই বা হঠাৎ সিয়েস্তা ব্রেক নিয়ে তার ঝাঁপ ফেলে দেয়, তা রোমে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের কাছে রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। বস্তুত, ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম্ - বচনটিকে সত্যি প্রমাণিত করে দূর থেকে, আবার কখনো ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকেও পর্কের ফ্যাট আর বাটারে ভাজা স্যামন মাছের গন্ধটুকু এসে জুটেছে কপালে, কিন্তু রোমে থাকার তিনদিনের একদিনও আমরা সেই রেস্তোরার ভাজা মাছের দর্শন পাই নি।
আমাদের ফ্ল্যাটের মোড় থেকে একটা বড় রাস্তা - বাস স্টপ, ওষুধের দোকান ইত্যাদি পেরিয়ে হুই দিকে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। ওই দিকেই কোথাও - পিয়াজ্জা সান জিওভানি দি ডিডো। সেখানে বাজার বসে, স্ট্রিট ফুডও নাকি পাওয়া যায়। এদিকের রাস্তাঘাটে মানুষজন কম হলেও মাঝে মধ্যেই দেখি দু একটা গাড়ি বেশ হুশ হুশ করে ছুটে চলেছে। থেকে থেকে এক আধটা সাজানো দোকান। সেখানে খাবার বাদ দিয়ে বিছানা পত্র, বাহারি ল্যাম্পশেড, জুয়েলারি মায় নেলপালিশ পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে তো আর আমাদের পেট ভরবে না। প্রায় দুই ব্লক একটানা হেঁটে যাওয়ার পর একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দর্শন পাওয়া গেল। দোকানের মাথায় চিনা ভাষায় কিছু একটা লেখা। সামনের বারান্দায় দু একটি ছেলে অলস দুপুরে বসে আড্ডা মারছে। আমার স্ত্রী উৎসাহের চোটে আমাদের ছাড়িয়ে খানিক এগিয়ে গিয়ে দুঃসংবাদটা শোনালে। এই চাইনিজ রেস্টুরেন্টটিও ঝাঁপ ফেলে বসে আছে। কী যে মুশকিল। রোমের প্রথম দিনই কি আমাদের অনশন করতে হবে নাকি? তবে, এইবারে এই ছেলেগুলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটু আশার আলো দেখা গেল। সামনে এগোলেই নাকি আরো একটি রেস্টুরেন্টের সন্ধান পাওয়া যাবে। আর সেটি বন্ধ থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। কাছেই দুটি গ্রসারি স্টোর বেশ রাত অবধি খোলা থাকে। খিদের চোটে এবং আসন্ন কেল্লাফতে হওয়ার আশায় আমাদের সবারই হাঁটার স্পিড বেড়ে গেছিল। এদিকে আমার আবার নতুন জুতো পরে পায়ে ততক্ষণে বেজায় ব্যাথা। খানিক ল্যাংচাচ্ছিও। উপরন্তু সারাদিন হাঁটাহাঁটি হয়েছে। কলকাতায় থাকতেই বাবা ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছিল যে, কদিন একটু নতুন জুতো পরে হাঁটাচলা করার অভ্যাস করে নাও, নইলে ফোস্কা পড়ে যাবে। আমিই তখন আমল দিই নি। এখন বাকিরা হাঁটতে চলতে কমপ্লেন করলেও, প্রেস্টিজের চোটে আর নিজের পায়ের ব্যথাটা স্বীকার করতে পারছিলাম না। বাকিদের তাই সামান্য রিলিফ দিতে একজায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে রাস্তা ধরে সামান্য এগোতেই দেখি বাঁহাতে সেই কাঙ্খিত রেস্টুরেন্ট এবং শুধু তাই নয়, তার ভেতরে ঢোকার দরজাটিও হাট করে খোলা। কী যে শান্তি! খোঁড়া পা নিয়ে ফেরত না গিয়ে বরং বাকিদেরই ফোন করে ডেকে নিলাম। তবে এবার রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই আমাদের সকলের চক্ষু ছানাবড়া। এ কী কাণ্ড! ঠিক দেখছি তো?
রেস্টুরেন্টের নাম আল-মদিনা। তার সামনের কাঁচের কাউন্টারে থরে থরে সাজানো সিঙাড়া, ঢাকাই পরোটা, চপ, চমচম, সন্দেশ, মায় রসগোল্লা পর্যন্ত। আমার বাঁদিকের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ডানদিকে হাওড়া ব্রিজ, আর সোজাসুজি কাউন্টারের মাথার উপর ঢাকার কোন জ্যাম জমাট ব্যস্ত রাস্তা। কাউন্টারের ওপারে এক ভদ্রমহিলা কৌতূহলী চোখে আমার হাঁ করা মুখ অবলোকন করছিলেন। এবারে তিনি শুদ্ধ বাংলায় ডেকে নিয়ে বললেন, ভেতরে এসে বসুন। সুদূর রোমে এসে বাঙালি রেস্টুরেন্টের খাওয়া জুটবে এ আমার কষ্ট-কল্পনারও বাইরে। তবে, কী কাণ্ড - এদের রান্নাঘরও নাকি তখন বন্ধ হওয়ার মুখে। অন্য লোক হলে হয়তো ফিরিয়েই দিত, হঠাৎ করে স্বভাষী মানুষের দেখা পাওয়ায় এরা ভারি খুশি হয়েছে। কী পাওয়া যাবে জিজ্ঞেস করায় জানা গেল, এখন শুধু দুটি ডিশই অ্যাভেলেবল্। খিচুড়ি এবং বিরিয়ানি। খিচুড়িও আবার এখানে প্রকারভেদে দুই রকম - চিকেন এবং মাটন। ভেজ খিচুড়ি নাকি হয় না। কুক বেরিয়ে এসে বললে, দাদারা চাইলে একটু মাংসের ঝোল আর স্যালাডের বন্দোবস্তও হতে পারে। আমাদের আর চাই কী? সাথে সাথে এক প্লেট খিচুড়ি, দুটো বিরিয়ানি আর দুই প্লেট মুরগির মাংস অর্ডার করে দেওয়া হল। টেবিলে চলে এল সারাদিনের ক্লান্তির পর একটু গা জিরিয়ে নেবার জন্য ঠান্ডা কোক জিরো। সারা জীবনে কলকাতার কোনো রেস্তোরাঁয় বসে বাংলাদেশী ভুনি খিচুড়ি বা ঢাকাই বিরিয়ানি খাবার সৌভাগ্য আমার হয় নি। সেই জিনিস প্রথম চেখে দেখলাম রোম শহরে এসে। আর সেকি বিরিয়ানি! কানা উঁচু এক বিরাট থালায় বেড়াল ডিঙোবে না এমন পরিমাণ ভাত, তার সাথে অন্তত পাঁচ - ছয় পিস বোনলেস মাংসের টুকরো। খিচুড়িও যে সার্ভ করা হল, তার পরিমাণও বিরিয়ানির প্রায় সমান। তবে নামে আলাদা হলেও বহিরঙ্গে সেই খিচুড়ি আর বিরিয়ানির বিশেষ পার্থক্য কিছু নেই, অন্তত আমাদের সাদা চোখে তা ধরা পড়ে নি। পরে চেখে দেখেছি স্বাদেরও তেমন কোন হেরফের নেই - খিচুড়িতে ওই সামান্য ডাল থাকা বা না থাকায় কিছু যায় আসে না - রান্নাটা মূলত একই। এতদূর পড়ে যারা এতক্ষণে হৈচৈ করছেন কিংবা প্রবল আপত্তি জানাচ্ছেন, তাদের বলে রাখি, অথেন্টিক ভুনি খিচুড়ি আর ঢাকাই বিরিয়ানি যে একই রকম খেতে হবে এ ধারণা আমি কস্মিনকালেও করব না। সেইটুকু আক্কেল আমার আছে। যাই হোক, আমাদের তো আলুসেদ্ধ ভাত হলেও চলত, সেখানে এতশত অপ্রত্যাশিত আয়োজন। দুপুরের খাওয়া বেশ জমে গেল। আর হ্যাঁ, শেষ পাতে রসগোল্লাও কিন্তু নেওয়া হয়েছিল। তবে সে রসগোল্লা কেমন খেতে ছিল সংক্ষেপে তা যদি বর্ণনা করি তাহলে বলতে হবে যে, ও বস্তু ছুঁড়ে মারলে মানুষ খুন পর্যন্ত করা যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, বাবা এবং বাপি আমাদের কোয়ালিটি কনসার্ন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে সেই মুহূর্তেই আল-মদিনার পার্মানেন্ট কাস্টমারের খাতায় নিজেদের নাম তুলে ফেললে। রোম শহরে এসে পিজ্জা পাস্তা না খেয়ে নাকি বাঙালি মাছ ভাত খাব। যত্তসব। গজগজ করলেও আমার কথার কেউ কোন পাত্তা দিলে না।
ইচ্ছে ছিল বিকেলে শহরটা একটু পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখার। এখানের পিয়াজ্জাগুলো ভারি সুন্দর সাজায়। আবার টিবারের ধারের রাস্তাটাও ভারি সুন্দর। কিন্তু সবার হাবভাবে বুঝলাম যে, আমি যতই বাইরে যাওয়ার বাই তুলি না কেন, সংসদে সে প্রস্তাব অবিলম্বে খারিজ হয়ে যাবে। গরমকাল চলছে রোম শহরে। রোমের রেগুলেশন বলছে চাইলেও হিটিং সিস্টেম এখন অফ। এসিও উনিশ থেকে তেইশ ডিগ্রির বেশী ওঠা নামা করবে না। আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটে যথেষ্ট গরম। বাড়ি ফিরেই সবাই পটাপট বিছানার আশ্রয় খুঁজে নিল। অগত্যা আমিও হাতে একটা বই নিয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা নিজেও টেরও পাই নি। বাইরের উত্তেজনা থাকলেও ওভারনাইট জার্নির ধকল তো একটা থাকবেই। সেটা আর অস্বীকার করি কী করে?
ঘুম ভাঙল খুচখাচ খুটখাট টুংটাং ইত্যাদি নানারকমের আওয়াজে। সময় তখন রাত আটটা। অর্থাৎ, বেশ অনেকক্ষণই টানা ঘুম হয়েছে। চোখ কচলে বাইরের হলে গিয়ে দেখি ধুন্ধুমার অবস্থা। এক মক্কেল, বাথরুমে গিয়ে দাঁত মাজছেন। আর অন্যজন ইনডাকশনে কেটলি বসিয়ে গরম চায়ের মৌতাত নিচ্ছেন। সামনে আধখোলা মেরি বিস্কুটের প্যাকেট। আমাদের দেখতে পেয়েই তারা বেশ তাগাদা দিয়ে বলে উঠলে, - আমরা কি রোমে এসে আলসে হয়ে গেলাম? নইলে এতক্ষণ ধরে ঘুমোচ্ছি কেন? খাওয়া দাওয়া সাড়তে হবে। সবার আগে ব্রেকফাস্ট জোগাড় করতে হবে। আর তাছাড়া না একটু পরেই আমাদের কলেসিয়াম দেখতে বেরিয়ে পড়ার কথা? যাচ্চলে! এ আবার কী নতুন ঝামেলা! প্রাথমিক হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠে ব্যাপারটা বুঝতে নিতে আমাদের একটু সময় লাগল। আর তারপরেই আসল ঘটনাটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেরা একচোট হেসে নিলাম। আমারই ভুল। বাবাদের আগে থাকতে বলে রাখা হয় নি। বাইরে যে তখনো ঝকঝক করছে সূর্যের আলো। আর তাই দেখে আমাদের দুই বাবা ভেবেছে, রাত কাবার করে তারা একেবারে পরের দিন ঘুম থেকে উঠল। আর তাই সেদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নিজেদের প্রস্তুতি নেওয়াও শুরু করে দিয়েছে। দাঁত মাজা ইতিমধ্যেই কমপ্লিট। চাও তৈরি। স্নানের জন্য গরম জলও প্রস্তুত। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদের ক্ষান্ত দেওয়ানো গেল। কিন্তু কী মুশকিল, কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না যে এখনো পরের দিন হয় নি। বলে রাখি, রোম শহরে গরম কালে সুর্য অস্ত যায় রাত ন’টারও পরে। মানে দিনের আলো থাকে প্রায় পনেরো ঘন্টা। আগে থেকে না জানা থাকলে আমাদের মত ট্রপিকাল বা সাব-ট্রপিকাল কান্ট্রির লোকেদের হকচকিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, ততক্ষণে আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেছে। বিকেলের বেড়ানোটা তো নাকচ হয়েছে। তাই এবারে প্রস্তাব রাখলাম যে, প্রস্তুতি যখন নিয়েই ফেলেছ, তাহলে আর ঘরে বসে না থেকে রাতের রোম শহরটা একটু ঘুরে ফিরে দেখা যাক।
ঘর ছেড়ে আমরা আবার যখন বেরোলাম, তখন রাত ন’টা বেজে গেছে। বাইরে তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। পশ্চিমের আকাশ অস্তগামী সূর্যের আভায় লালে লাল। পুব আকাশে একটা বিদঘুটে ম্যাজেন্টা রঙের ছায়া পড়েছে। একটা দুটো করে স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠছে রোমের রাজপথে। আমার বাবা নিতান্তই অখুশি - নিজের মত বিড়বিড় করে চলেছে, যে এত রাতে নাকি কোথাও কোনোদিন বেড়াতে যায় নি। আর আমার বাপির মতে, রাস্তায় এখন কিলবিল করছে পকেটমার, ছিনতাইবাজ আর ইটালির সব কুখ্যাত পাসপোর্ট চোরের দল। আজকেই নাকি আমাদের পাসপোর্ট সব ফেলে রেখে বাড়ির পথ ধরতে হবে। সেসব ওজর - আপত্তি আমরা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে রওনা হয়ে গেলাম ট্রেভি ফাউন্টেনের উদ্দেশ্যে।
*****
যীশু খ্রীষ্টের জন্মেরও বেশ কিছু বছর আগের কথা। রোমে তখন পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধ চলছে। ৪৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রোমান সেনেটের আভ্যন্তরীণ চক্রান্তে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর রোমান রিপাবলিকের আনাচে কানাচে জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। এই বিদ্রোহীদের শান্ত করতে এবং স্থায়ীভাবে রোমের মসনদ দখলের অভিপ্রায়ে মার্ক অ্যান্টনি, এবং মার্কাস লেপিডাসের মতোই লড়াইয়ে সামিল হলেন জুলিয়াস সিজারের ভাইপো তথা দত্তক পুত্র অক্টাভিয়ান সিজার। মার্কাস আগরিপা ছিলেন এই অক্টাভিয়ান সিজারেরই অন্যতম আস্থাভাজন, অভিন্নহৃদয় বন্ধু এবং তার সেনাপ্রধান। আগরিপা পরে অক্টাভিয়ান সিজারের কন্যা জুলিয়ার সাথে প্রণয় বন্ধনেও আবদ্ধ হবেন। প্রথম জীবনে জুলিয়াস সিজারের অধীনে এবং পরবর্তীকালে অক্টাভিয়ান সিজারের অন্যতম প্রধান সেনাপতি হিসেবে আগরিপা বহু যুদ্ধে শক্তিশালী রোমান সৈন্যদলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর অনতি পর ৩৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দী এবং সিসিলির তৎকালীন প্রধান সেক্সটাস পম্পেইয়ের বিরুদ্ধে আগরিপার যুদ্ধযাত্রা ও জয়লাভ; এছাড়াও আনুমানিক ৩৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধে রোমের সিংহাসনের অন্যতম প্রধান দাবীদার মার্ক অ্যান্টনি ও তার প্রণয়প্রার্থী মিশর সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার (জুলিয়াস সিজারের স্ত্রী) সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে তার যুদ্ধজয়। তবে আগরিপা শুধুমাত্র একজন দক্ষ ও অকুতোভয় সেনানায়কই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে একজন লেখক (বিশেষত, ভৌগোলিক বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল অতুলনীয়) এবং স্থপতি। মার্ক অ্যান্টনির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অক্টাভিয়ান নিজেকে রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র প্রথম সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন অগাস্টাস সিজার। অগাস্টাস সিজারের আনুকূল্যে আগরিপা অচিরেই হয়ে ওঠেন রোমান সাম্রাজ্যের ডি ফ্যাক্টো নাম্বার টু। বস্তুত কিছু ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা ছিল প্রায় সিজারেরই সমতুল্য। আগরিপা প্রশাসক হিসেবে তার জীবৎকালে অসংখ্য প্রাসাদ, বাগান, অ্যাকুয়াডাক্ট এবং রোমান জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বিবিধ পাবলিক বিল্ডিং তৈরি করান। এর মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভবন হল রোমের সর্বসাধারণের জন্য তৈরি করা বাথ হাউস বা স্নানাগার।
প্রাচীন রোমান সভ্যতার নাগরিকদের মধ্যে স্নানের ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ ছিল না। তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল স্নানের জন্য প্রয়োজনীয় যে পরিশ্রুত জল, তার অপ্রতুলতা। আর তাছাড়া প্রাচীন রোমান ধর্ম অনুযায়ী স্নানের কাজটিকেও খুব একটা পবিত্র রিচ্যুয়াল হিসেবে গণ্য করা হত না; সুতরাং তৎকালীন রোমান অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল। আগরিপা এই নাগরিক ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটান। আগরিপার নবনির্মিত স্নানাগারে, পাবলিক পুলগুলিতে নাগরিক স্নানের জন্য বিভিন্ন উষ্ণতার পরিশ্রুত জলের ব্যবস্থা করা হয়, যেমন - গরম কিংবা নাতিশীতোষ্ণ, এবং সাধারণ তাপমাত্রা কিংবা ঠান্ডা। তাছাড়াও এই বিশাল বিল্ডিং কমপ্লেক্সের মধ্যে ছিল রোমান অ্যাথলিটদের নিত্য ব্যবহারের জন্য সনা, জিমনাসিয়াম, রানিং ট্র্যাক, এবং সাধারণ নাগরিকের ব্যবহারযোগ্য উন্মুক্ত পাঠাগার ও রেস্তরাঁ। আজ থেকে প্রায় দেড় থেকে দু হাজার বছর আগের একটি পাবলিক বিল্ডিংয়ে এই অত্যাধুনিক ফেসিলিটিগুলির ব্যবস্থা যে ঠিক কিভাবে করা হয়েছিল, তা ভাবলেও আশ্চর্যচকিত হতে হয়। আগরিপা যতদিন জীবিত ছিলেন, তার এই স্নানাগারে প্রবেশের জন্য অল্প কিছু অর্থমূল্যের প্রয়োজন হত। তবে আগরিপার মৃত্যুর পর তারই ইচ্ছে অনুযায়ী এই স্নানাগারকে সম্পূর্ণ নিঃশুল্ক করে দেওয়া হয়। পরবর্তী কালে বিভিন্ন রোমান সম্রাট আগরিপার বানানো এই স্নানঘরকে আরো প্রসারিত করেন এবং এই ভবনটি ক্রমশ রোমান সভ্যতার এক অন্যতম প্রতীক হয়ে ওঠে। এখন পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই যে বিশাল স্নানাগার, তার যে এই বিপুল ব্যবস্থাপনা - এসব পরিচালনা করার জন্য যে বিপুল পরিমাণ পরিশ্রুত জলের প্রয়োজন, তার যোগান হত কিভাবে? আর এখানেই আমাদের নজর পড়বে অ্যাকোয়া ভারগো নামক অ্যাকুয়াডাক্টটির উপর, যার ইতিহাসের সাথে ট্রেভি ফাউন্টেন সরাসরি যুক্ত।
যারা অ্যাকুয়াডাক্ট শব্দটির সাথে খুব একটা পরিচিত নন, তাদের অবগতির জন্য বলি এটি একটি নাগরিক জল সরবরাহের ব্যবস্থা। রোমান সভ্যতার একেবারে গোড়ার সময় থেকেই জল সরবরাহের এই পদ্ধতিটি গোটা ইউরোপ জুড়ে প্রচলিত ছিল। এই ব্যবস্থায় মিষ্টি জলের কোনো উৎস, যেমন কোনো প্রপাত, ঝরণা বা বড় হ্রদ থেকে পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে পেয় জল সরবরাহ করা হত শহরের বিভিন্ন অংশে। যেখানে পাহাড়ের ন্যাচারাল স্লোপ বা খাত পাওয়া যেত না, সেখানে তৈরি করা হত জল বইবার উপযুক্ত কোনো সুড়ঙ্গ কিংবা দুধার উঁচু একটি ব্রিজের মত স্ট্রাকচার - যার উপরের নালার মাধ্যমে শহরের দিকে জল গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ সালে রোম শহরের অনতি দূরে কয়েকজন তৃষ্ণার্ত রোমান সৈনিক হঠাৎ করেই এমনই একটি বিশুদ্ধ জলের উৎসের সন্ধান পেয়ে যান। প্রসঙ্গত, রোমে তখন জলকষ্ট তীব্র আকার ধারণ করেছে। উপরন্তু দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানে আগরিপার সেই সৈন্যদল তখন হা-ক্লান্ত এবং পানীয় জলের অভাবে তাদের অনেকেই তখন মৃত্যুপথযাত্রী। রোম ফেরতা এই সৈন্যদলের সামনে প্রায় দেবদূতের মত উপস্থিত হয় একটি অল্পবয়সী মেয়ে। সে তাদেরকে এই ঝরণার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। ফলে প্রাণ বেঁচেছিল আগরিপা ও তার সেই সৈন্যদলের। আগরিপা পরে রোম থেকে ফিরে এসে মেয়েটির অনেক সুলুক সন্ধান করলেও তার আর কোন খোঁজ মেলে নি। তার নামও জানা যায় নি। পরবর্তী সময়ে এই ঝরণাটি থেকেই রোম শহরে তার স্নানাগার পর্যন্ত আগরিপা একটি অ্যাকুয়াডাক্টের নির্মাণ করান। এই অ্যাকুয়াডাক্টটি তার স্নানাগার সমেত শহরের অন্যান্য বেশ কিছু অংশেও সরাসরি জল সরবরাহ করত। বস্তুত এই অ্যাকুয়াডাক্ট নির্মাণের মাধ্যমে রোম শহরের জলের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয়ে যায়। এক সময়ে যে শহরে জলের জন্য হাহাকার পড়ে গেছিল, সেই শহরেই জল হয়ে ওঠে উদ্বৃত্ত। রোমের অদূরে এত গুরুত্বপূর্ণ এই সন্ধানে নাম-না-জানা অপরিচিত ও অল্পবয়সী মেয়েটির ভূমিকার কথা মাথায় রেখে আগরিপা তার নব নির্মিত অ্যাকুয়াডাক্টটির নাম দেন অ্যাকুয়া ভারগো। ভারগো অর্থাৎ ভারজিন বা কুমারী। রোমের সেই স্বর্ণযুগে এই অ্যাকুয়া ভারগোর দিন প্রতি প্রায় লক্ষ কিউবিক মিটার জল সরবরাহের ক্ষমতা ছিল।
রোমান অ্যাকুয়াডাক্ট (রেখাচিত্র)
আগরিপার স্নানাগার খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় চারশো বছর ধরে একটানা ব্যবহার হয়েছিল। ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি, মূলত অস্ট্রোগথদের আক্রমণের মুখে পড়ে অ্যাকুয়া ভারগো ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; আর আগরিপার স্নানাগারও ক্রমশ ব্যবহারের অভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে থাকে। আজ রোম শহরে তার তেমন কোনো অস্তিত্বই আর অবশিষ্ট নেই। যদিও আগরিপার স্নানাগারের আড়ালে অ্যাকুয়া ভারগো কিন্তু থেকেই যায়। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার জল পরিবহণের ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেলেও অ্যাকুয়াডাক্টটির ব্যবহার কখনই সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হয়ে যায় নি। শেষ পর্যন্ত, খ্রিষ্টিয় অষ্টম শতকে এসে পোপ প্রথম আদ্রিয়ান এই অ্যাকুয়া ভারগোর সংস্কার করান। এতে নতুন করে রোম শহরের বিভিন্ন অংশে জল সরবরাহের ব্যবস্থা হয়। পুনরায় ১৪৫৩ সালে এসে, অর্থাৎ এই ঘটনারও প্রায় সাতশো বছর পর পোপ পঞ্চম নিকোলাস অ্যাকুয়াডাক্টটির সম্পুর্ণ সংস্কারের কাজে হাত দেন। প্রায় নতুন ভাবে গড়ে তোলা অ্যাকুয়াডাক্টটির তিনি নাম পরিবর্তন করে রাখেন, অ্যাকুয়া ভেরজিনে। তবে ততদিনে যেহেতু আগরিপার স্নানাগার সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তাই এইবার আর সেই স্নানাগার নয়, অ্যাকুয়াডাক্টটির পথচলা শেষ হয় সেই ভবনেরই অদূরে রোম শহরের বিখ্যাত ফোয়ারা ট্রেভি ফাউন্টেনে এসে।
তিনটি রাস্তার সংযোগস্থলে তৈরি বলে ফোয়ারাটির নাম ট্রেভি, আদতে ট্রে ভি। রোমান ভাষায় ট্রে শব্দের অর্থ হল তিন, আর ভি শব্দের অর্থ হল রাস্তা (এখানে বহুলিঙ্গে ব্যবহৃত)। অবশ্য ট্রেভি ফাউন্টেন তৈরির আগে এখানে অন্য একটি মিষ্টি জলের ফোয়ারা ছিল। সেটিও সম্ভবত আগরিপার আমলেই নির্মিত। তবে তার পুরনো চেহারা কেমন ছিল এখন আর তা জানার কোনো উপায় নেই। ১৬২৯ সালে বার্নিনির পৃষ্ঠপোষক সেই পোপ অষ্টম আর্বানের মনে হয়েছিল এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্য হিসেবে পুরনো এই ফোয়ারাটি একেবারেই মানানসই নয়। অষ্টম আর্বান বার্নিনিকে নির্দেশ দেন ফোয়ারটিকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই মর্মে এই নতুন ফোয়ারার জন্য নকশা বানানোর কাজও শুরু হয়। যদিও ১৬৪৪ সালে পোপ অষ্টম আর্বানের মৃত্যুর কারণে বার্নিনি ফোয়ারাটির সংস্কারের কাজ শেষ পর্যন্ত শুরু করে উঠতে পারেন নি।
ভিয়া পোলি থেকে ট্রেভি ফাউন্টেন
সপ্তদশ - অষ্টাদশ শতকে রোমের বিভিন্ন নির্মাণের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। বার্নিনির পরের শতকে, ১৭৩০ সালে পোপ দ্বাদশ ক্লেমেন্ট এরকমই এক প্রতিযোগিতার আহ্বান করেন। উদ্দেশ্য ছিল পোপ অষ্টম আর্বানের স্বপ্নের পুনরুদ্ধার, অর্থাৎ ট্রেভি ফাউন্টেনের নবনির্মাণ। এই প্রতিযোগিতার দুই প্রধান প্রতিযোগী ছিলেন সেই সময়ের দুই বিখ্যাত শিল্পী - নিকোলা সালভি এবং অ্যালেস্যান্দ্রো গ্যালিলেই। উল্লেখ্য, এই প্রতিযোগিতায় সালভির হার হয়। কিন্তু, সালভি ছিলেন রোমের নাগরিক এবং গ্যালিলেই ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রোমের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ইটালীয় নবজাগরণের শহর ফ্লোরেন্সের বাসিন্দা। প্রতিযোগিতায় সালভির এই হার রোমের সাধারণ জনগণ একেবারেই মেনে নিতে পারেননি, রোমে শুরু হয় প্রবল বিক্ষোভ। শেষ পর্যন্ত, জনগণের এই প্রবল চাপের মুখে মাথা নত করে পোপ বাধ্য হন ট্রেভি ফাউন্টেনের রূপকার হিসেবে সালভিকেই মেনে নিতে। ১৭৩২ সালে সালভির নকশা অনুযায়ী ট্রেভি ফাউন্টেনের নির্মাণ কাজ শুরুও হয়। কিন্তু সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৭৫১ সালে সালভির মৃত্যু হয়েছিল। সালভি তার স্বপ্নের পরিসমাপ্তি দেখে যেতে পারেন নি। সালভির মৃত্যুর পর - রোমের চার প্রখ্যাত ভাস্কর - পিয়েত্রো ব্রাচি, ফিলিপ্পো ডেল্যা ভ্যাল্যে, জোভানি গ্রস্যি, এবং আন্দ্রেয়া বেরগোন্ডিকে ফোয়ারাটির অলঙ্করণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্থপতি জুসেপ্পে পানিনি সালভির জায়গায় ট্রেভি ফাউন্টেনের আর্কিটেক্ট নিযুক্ত হন। শেষ পর্যন্ত পানিনিরই তত্বাবধানে ১৭৬২ সালে ট্রেভি ফাউন্টেনের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। আর সেই কারণে ট্রেভি ফাউন্টেনকে কোনো একক শিল্পীর নির্মাণকাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না। বার্নিনি থেকে সালভি হয়ে পানিনি, বহু শিল্পীর যোগদান রয়েছে এই ফোয়ারার বর্তমান রূপটির পিছনে।
ট্রেভি ফাউন্টেন যে পিয়াজ্জা বা স্কোয়ার জুড়ে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার অনেকটা অংশই আগে দখল করে ছিল প্যালাজ্জো পোলি। ট্রেভি ফাউন্টেনের নির্মাণের জন্য রোমের এই প্রাচীন প্রাসাদটির বেশ কিছু অংশ ধ্বংস করতে হয়। তবে নিকোলা সালভি খুব সুচতুর ভাবে এই প্রাসাদটিকে তার নির্মাণকাজের জন্য ব্যবহার করেছেন। সত্যি কথা বলতে, সালভির জায়গায় অন্য কোন স্থপতি থাকলে হয়ত আজ আর এই প্রাসাদটিকে রোমের মানচিত্রে খুঁজেই পাওয়া যেত না। সালভি প্রাসাদটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার বদলে বরং তার পেছনের দেওয়ালটিকেই ট্রেভি ফাউন্টেনের ব্যাকড্রপ বা পশ্চাৎদেশ হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। পাঠক ভেবে দেখুন কী আশ্চর্য্য এই পরিকল্পনা! অর্থাৎ এই নির্মাণকাজের জন্য সামনের ভবনটিও খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হল না, আবার ফাউন্টেনটির অলঙ্করণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত আস্ত একটি দেওয়ালও পাওয়া হয়ে গেল। বেশ সাপও মরল, আবার লাঠিও ভাঙল না গোছের ব্যাপার। বলাই বাহুল্য খরচের দিক থেকেও এই পরিকল্পনা যথেষ্টই সাশ্রয়কর। এই দেওয়ালের উপরেই সালভি এবং অন্যান্য শিল্পীরা নির্মাণ করলেন অসাধারণ দুটি রিলিফ এবং অনিন্দ্যসুন্দর কিছু স্ট্যাচু। প্রসঙ্গত, প্যালাজ্জো পোলির পেছনদিকে নবনির্মিত এই দ্বিতল ব্যাকড্রপের মধ্যভাগে রয়েছে একটি সুবিশাল আর্চ। কোরিন্থিয়ান শৈলীতে নির্মিত চারটি থাম এই আর্চটিকে ধারণ করে রেখেছে। ট্রেভি ফাউন্টেনের মূল যে নির্মাণ, অর্থাৎ গ্রীক দেবতা ওসিয়ানিয়াসের স্ট্যাচুটি এই আর্চের সামনেই স্থাপনা করা হয়েছে।
গ্রীক এবং রোমান মিথোলজি অনুযায়ী, ওসিয়ানিয়াস ছিলেন টাইটান ইউরেনাস ও দেবী গাইয়ার সন্তান এবং তিনিই ছিলেন আদি রোমান জনসাধারণের প্রধান নদীর দেবতা। বস্তুত এই বিপুলা পৃথিবীতে নাকি যে সমস্ত নদীর দেবতারা রয়েছেন, তারা সকলেই এই ওসিয়ানিয়াসেরই সন্তান। আবার একই সাথে তিনি ওসিয়ানিডস্ তথা ঝর্ণাদেরও পিতা এবং হিন্দু পুরাণের গঙ্গার মতই নিজেও একটি বিশালকায় নদী। তবে যেখানে গঙ্গার উপস্থিতি ভারতের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়, সেখানে প্রাচীন রোমের এই নদীটি কিন্তু আদতে কাল্পনিক (অন্তত এখনো এর কোন প্রামাণ্য অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি) যদিও রোমান উপকথা অনুযায়ী এই নদীটি নাকি সমস্ত পৃথিবী জুড়েই প্রবাহিত হচ্ছে। অনুমান করাই যায়, খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে যখন পরিশ্রুত জলের অপ্রতুলতা ছিল রোমানদের নিত্যসঙ্গী, সেই সময়ে তাদের আচার ও ধর্মবিশ্বাসে নদীর দেবতা ওসিয়ানিয়াসের প্রভাব কতটা ব্যাপক আকারে ডালপালা বিস্তার করেছিল। আগেই উল্লেখ করেছি, ট্রেভি ফাউন্টেন কোনো নির্মাণ-শিল্পীর একক দক্ষতার নিদর্শন নয়, বরং বহু শিল্পীর সম্মিলিত অবদানের প্রতিফলন। এদেরই মধ্যে একজন, স্থপতি পিয়েত্রো ব্রাচি ট্রেভি ফাউন্টেনর সেন্টারপিস হিসেবে রথারূঢ় ওসিয়ানিয়াসের একটি মূর্তির নির্মাণ করেন। প্রসঙ্গত, প্রাচীন রোম শহরে জলের সমস্যার সমাধান করেছিল আগরিপার নির্মিত অ্যাকুয়া ভারগো; আর তাই মিষ্টি জল, ঝর্ণা ও নদীর দেবতাকে তিনি এখানে রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বলে রাখা ভাল, ওসিয়ানিয়াস এখানে যে রথে আসীন, সেই রথ আসলে একটি ঝিনুকের খোল (শেল), এবং তার এই রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে দুটি বিশালাকায় হিপোক্যাম্পাস, বা সমুদ্রের ঘোড়া। সমুদ্রের ঘোড়া বলছি বলে পাঠক কিন্তু তাকে সিন্ধু-ঘোটক ভেবে ভুল করবেন না। গ্রীক মিথোলজির এই প্রাণীটি আদতে ঘোড়াই, অন্তত তার দেহের উপরিভাগ পর্যন্ত, (জলের উপর থেকে দেখলে তাকে একেবারে ঘোড়াই মনে হবে) যদিও জলের আড়ালে তার দেহের পেছনের অংশ আকারে প্রকারে একেবারে মাছের মত। একই সাথে এই ঘোড়ার আবার পক্ষীরাজের মত দুটি ডানাও রয়েছে, তবে তাদের আকশে ওড়ার কোন ক্ষমতা ছিল বলে কোথাও শুনিনি। এই হিপোক্যাম্পাসদুটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন দুজন ট্রাইটন। মিথোলজি অনুযায়ী ট্রাইটনেরা হলেন সমুদ্রের উপদেবতা, সমুদ্রের অসীম ক্ষমতাধর দেবতা পোসেইডনের (রোমান মিথোলজিতে, নেপচুন) তারা বীর সন্তান। গ্রীক উপকথায় হারকিউলিস এই ট্রাইটনের সাথেই যুদ্ধ করেছিলেন। এদের চেহারা রূপকথার সমুদ্র-মানুষের মত। অর্থাৎ ঊর্ধাঙ্গ মানুষের মত হলেও, সমুদ্র ঘোড়া হিপোক্যাম্পাসের মতই এদেরও দেহের নিম্নাংশ মাছের আকারের। এদের হাতে থাকে একটি করে শাঁখ বা শিঙা - যার থেকে সমুদ্রের মতই গম্ভীর গর্জন নির্গত হয়। ব্রাচির ট্রাইটনেরা, - একজন সমুদ্রের রুক্ষতা ও প্রখরতা এবং অন্যজন শান্ত সমুদ্রের প্রশান্তির ইঙ্গিত বহন করে।
ওসিয়ানিয়াসের স্ট্যাচু
ওসিয়ানিয়াসের স্ট্যাচু - মূল এই স্থাপত্য ব্যতিরেকেও ট্রেভির স্থপতিরা তার দ্বিতল ব্যাকড্রপের নীচের তলায় আরো দুটি মূর্তি আর উপরের তলায় মোট দুটি বাস-রিলিফের নির্মাণ করেছেন। ব্যারোক স্টাইলে নির্মিত এই রিলিফ দুটি অ্যাকুয়া ভারগোর (পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন হয়ে অ্যাকুয়া ভারজিনে-র) নির্মাণের গল্প বলে। সেই যে অল্পবয়সী মেয়েটি যুদ্ধক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত রোমান সৈন্যদলকে ঝর্ণার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল, প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাদের - সেদিনের সেই মুহূর্তের ঘটনাবলীই চিত্রিত হয়েছে ট্রেভি ফাউন্টেনের ডানদিকের রিলিফটিতে (শিল্পী - জোভানি গ্রস্যি)। আর ফাউন্টেনের বাঁদিকের রিলিফে চিত্রিত হয়েছে রোমান সেনাধ্যক্ষ আগরিপার নির্দেশে প্রাচীন অ্যাকুয়াডাক্টটির নির্মাণ দৃশ্য (শিল্পী - আন্দ্রেয়া বেরগোন্ডি)। নবনির্মিত ট্রেভি ফাউন্টেনের শিল্পীরা এভাবেই প্রাচীন অ্যাকুয়া ভারগো এবং তার স্থপতিদের স্মরণ করেছেন তাদের শিল্পকর্মে। ব্যাকড্রপের নীচের তলার মূর্তি দুটি আবার যথাক্রমে রোমের দুই দেবী অ্যাবানডেন্স (সমৃদ্ধির দেবী) এবং স্যালুব্রিটির (স্বাস্থ্য ও ফলের দেবী)। অ্যাবানডেন্স তার কলস থেকে জল ঢালছেন এবং স্যালুব্রিটির হাতের কাপ থেকে একটি সাপ জলপান করছে। বস্তুত, ওসিয়ানিয়াসের স্ট্যাচুটির মতই এই মূর্তিদুটিও ছিল তৎকালীন রোমান জনতার কাছে এক ধরণের স্ট্যাটাস সিম্বল। সাথে অন্য শহরগুলির বাসিন্দাদের কাছে খানিক দেখনদারিও বটে। শিল্প, ইতিহাস, রোমের আদি গৌরব - সব কিছু ছাপিয়ে অন্যান্য স্টেট ও শহরগুলিকে পাপাল স্টেটের একরকম বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা, যে দেখ - আমাদের কাছে এত জল রয়েছে যে তাই দিয়ে আমরা স্থাপত্যও নির্মাণ করতে পারি। পোপের বা পাপাল স্টেটের এই সিম্বল কিন্তু আক্ষরিক ভাবেই ট্রেভি ফাউন্টেনের গায়ে একেবারে সিলমোহরের মত বসানো রয়েছে। ফাউন্টেনের ব্যাকড্রপের মাথায় প্রায় মুকুটের মত সিম্বলটি পোপের বা ভ্যাটিকানের প্রতীক চিহ্ন যাকে ঘিরে রয়েছে আরো চারটি মূর্তি যার প্রতিটিই রোমের সমৃদ্ধির ইঙ্গিতবাহী। এর তলায় খোদাই করা রয়েছে ল্যাটিন ভাষায় লেখা কিছু ইনস্ক্রিপশন। পোপ দ্বাদশ ক্লেমেন্টের নির্দেশে ট্রেভি ফাউন্টেনের নির্মাণের শুরু, পোপ ত্রয়োদশ ক্লেমেন্টের নির্দেশে তার অলঙ্করণ ও পোপ চতুর্দশ বেনেডিক্টের আমলে এই নির্মাণকাজ শেষের ঘোষণা।
ট্রেভি ফাউন্টেনের মাথায় পাপাল সিম্বল
ট্রেভি ফাউন্টেন ও তার বিচিত্র ইতিহাসের এই বিবরণ শেষ করব একটা ছোট্ট গল্প বলে। গল্পের দুই কুশীলব - ট্রেভির প্রধান স্থপতি নিকোলা সালভি ও রোমের এক অখ্যাত নাপিত। রোমের এই নাপিতের ট্রেভি ফাউন্টেনের পাশের গলিতেই ছোট্ট এক দোকান ছিল। সেই সময় যেসব পর্যটক এই ফোয়ারা দেখতে ভিড় করতেন তারাই অনেকে চুল কাটাতেন নাপিতের সেলুনে। কিন্তু নাপিত মশাইয়ের ফাউন্টেন তৈরির এই শোরগোল একদম পছন্দ হচ্ছিল না। তার অভিযোগ ছিল যে, ফাউন্টেন তৈরির গোলযোগে নাকি তার ব্যবসার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। আর সেজন্যই তিনি বিভিন্ন উপায়ে সালভিকে উত্যক্ত করতে লাগলেন। সালভি প্রথম দিকে তার এসব অভিযোগকে কোনো গুরুত্ব না দিলেও, পরে তার উত্যক্ত করার মাত্রা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাল যে তিনি এই নাপিতের উপর একেবারে খাপ্পা হয়ে গেলেন। কিন্তু আইন তো তার পথের বাধা। সালভি তাই কোনভাবেই এই নাপিতকে শায়েস্তা করতে পারছিলেন না। সুতরাং তাকে জব্দ করতে শেষ পর্যন্ত তিনি শিল্পেরই পথ ধরলেন। এ কথা তো আগেই বলেছি, সালভি ছিলেন তার পূর্বসুরী বার্নিনির মতই একজন ব্যারোক শিল্পী। আর ব্যারোক নির্মাণ কাজের অনেক গোপন আঙ্গিকও থাকে। সালভি তার ফাউন্টেনের পাশে সিসিলির বিখ্যাত এক কার্ডগেম স্কোপার ট্রাম্পকার্ড - অ্যাসো ডি কোপ অর্থাৎ এস অফ কাপের অনুকরণে একটি কলস বা কলসি নির্মাণ করলেন। আপাতদৃষ্টিতে তো শুধুই ফোয়ারার এক অলঙ্করণ। কিন্তু এই কলসটিই হয়ে উঠল নাপিতের জবাবে সালভির ট্রাম্পকার্ড। নির্মাণ কাজ শেষ হলে পর দেখা গেল এই এস অফ কাপ সেই নাপিতের সেলুনকে পুরোপুরি দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে দিয়েছে। পরিণতিতে তার সেই দোকান আর কোনদিনই ফাউন্টেনের সামনে দাঁড়ানো ওই থিকথিকে ভিড়ের দৃষ্টিগোচর হবে না। এভাবেই সালভি নাপিতের উপর নিজের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। আজ সেই নাপিত বিস্মৃতির কোন অতলে তলিয়ে গেছেন। ইতিহাস তার উপর সদয় হয় নি। কে জানে, হয়ত বা সেদিন নিজের ব্যবসাও তিনি হারিয়েছেন নিজের গোঁয়ার্তুমির কারণে। শেষ পর্যন্ত তার ঠিক কী পরিণতি হয়েছিল আজ আর তা জানা যায় না। তার সে দোকান বন্ধ হয়েছে কবেই, রয়ে গেছে সেই এস অফ কার্ড। আজও সালভির সেই বিখ্যাত ট্রাম্পকার্ড ট্রেভি ফাউন্টেনের একপাশে দেখতে পাওয়া যাবে।
*****
আগেই বলেছি, ট্রেভি ফাইন্টেন তিনটি প্রাচীন রাস্তার সংযোগস্থলে নির্মিত। ইঁট বাঁধানো এই রাস্তাগুলি এখন পেডেস্ট্রিয়ান জোন। ঐতিহাসিক স্থান বলেই হয়ত রোমের প্রশাসনের নির্দেশে এই অঞ্চলে যান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে ইতিহাসের দিক থেকে প্রাচীন হলেও রাস্তার দুপাশের দোকানগুলি কিন্তু যুগপৎ আধুনিক, সুসজ্জিত আর ঝাঁ-চকচকে। আমাদের উবের যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেল, অর্থাৎ ভিয়া পোলির ঠিক মুখটাতে - সেখান থেকে এই গলি বেয়ে এসে মাত্র এক মিনিটের হাঁটাপথ - ট্রেভি ফাউন্টেন। এই গলিপথ কিংবা পোলির প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ হয়তো অনুমানও করতে পারবে না যে আপাত-সাধারণ এই ভবনটির পেছনেই রয়েছে রোম শহরের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইকন। আমরা ভেবেছিলাম, যে রাত বাড়লে হয়তো শহরের রাস্তাঘাট সব শুনশান হয়ে যাবে, কিন্তু দেখলাম উলটে লোকের ঢল নেমেছে এই রাস্তায়। বস্তুত কাঁচের জানলার পেছনে উজ্জ্বল আলোয় সাজানো বিবিধ দোকান-পাট, পিজেরিয়া, নানারকমের রঙ বেরঙের ছাতা দেওয়া আউটডোর রেস্টুরেন্ট - ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের ডিস্ট্রাকশন পেরিয়ে এসে ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনে পৌঁছে আমাদের মনে হল, বুঝি একখানা ছোট-খাটো মেলাই বসেছে সেখানে। চারদিকে এমনই গিজগিজ করছে ভিড়। ফাউন্টেনের ধারের শান বাঁধানো উঁচু জায়গাটাতেই অন্তত শ’ খানেক লোক বসে। আরো লোক ভিড় করেছে রাস্তার উপর, সিঁড়ি এবং আশেপাশের দোকানগুলির সামনে।
ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনের ভিড়
রোমের আইকন, বিশালকায় এই ফোয়ারা প্রায় গোটা একটা স্কোয়ার জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। চারপাশের রাস্তা থেকে ফোয়ারার জলের আধারটি কিছুটা নীচে, কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে তার ধারে পৌঁছাতে হয়। এই সিঁড়িতেও লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ গিটার বাজিয়ে গান করছে, কেউ আবার রাতের খাবার খাচ্ছে, নয়তো ঈষৎ মাতলামি করছে ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবের সাথে। আমাদের সকালে দেখা বোরগেজে গ্যালারি যেখানে শিল্প-রসিকদের জায়গা, স্বভাবতই আপাত-গম্ভীর, অন্তত কেউ মুখে ডেকোরাম উল্লেখ না করলেও লোকজন তার স্থান মাহাত্য সম্বন্ধে ভীষণই সচেতন, সেখানে ট্রেভির এই ভিড় বয়সে অনেক তরুণ, উচ্ছ্বল, আধুনিক এবং শিক্। আর রাতের আলোকসজ্জায় ফোরায়াটিও অসম্ভব সুন্দর, ও মায়াময় - খানিক রোমান্টিকও বটে। এই রোমান্স বস্তুত রোম শহরের রোমান্স। তার ভালোবাসার আহ্বান। আমি দিনের আলোয় ট্রেভি দেখি নি, তবে অন্য পর্যটকদের অভিজ্ঞতায় শুনেছি যে রাতের আলোকসজ্জা এই ফোয়ারাকে আলাদাই এক ডাইমেনশন এনে দেয়। তবে মাদকতা যদি কিছু থেকেই থাকে তা এই ফোয়ারাটির মধ্যে ভরে রয়েছে - রয়েছে তার অনির্বচনীয় আর্কিটেকচারে। আমাদের সামনেই ব্রাচির নির্মিত ওসিয়ানিয়াসের প্রায় দুই মানুষ উচ্চতার সেই সাদা মার্বেলের স্ট্যাচু; রথারূঢ় সেই প্রাচীন দেবতার দু-পাশ থেকে পাথরের ধাপ গড়িয়ে স্রোতশীল জল ঝালরের মত নেমে এসেছে নীচে, মিশেছে ফাউন্টেনের পুলের জলে। ট্রেভির এই পুলটিও কিন্তু আয়তনে বিশাল। আজকালকার আলট্রা-মর্ডান যে কোন হোটেলের সুইমিং পুলও তার ভেতরে স্বচ্ছন্দেই ফিট করে যাবে। খ্রীষ্টপূর্ব সময়ে নির্মিত সেই অ্যাকুয়া ভারগো অ্যাকুয়াডাক্ট - তার কাঁচের মত স্বচ্ছ জল এই এত দিন পরেও পুলের মার্বেলের বেসিনে জমা হয়ে টলটল করছে। এই জল ছুঁয়ে দেখা মানে প্রায় দুই হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা। তার প্রথম পরশেই মোহিত হলাম, কী ঠান্ডা সে জল! এই বেসিনেরই পেছন দিকে সালভি ও অন্যান্য শিল্পীদের নির্মিত স্থাপত্যগুলির গা ঘেঁষে জলের গভীরে নিয়ন আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর তারই উদ্ভাসে পুলের জল এই এত রাতেও প্রাচীন কোন রত্ন কী অমূল্য কোন জহরতের রঙে সবুজাভ নীল, যার মোহময় সৌন্দর্য্য থেকে চোখ ফেরানোই মুশকিল। লোকচক্ষুর আড়ালে লাইট লাগানো হয়েছে ভাস্কর্যগুলিরও আনাচে কানাচে। ফলে এক অদ্ভুত আলোছায়া - মূর্তি, মোটিফ ও অলঙ্করণগুলিকে আরো বেশী বাঙ্ময় করে তুলেছে। মনে হচ্ছে ইতিহাস বুঝি কথা বলছে আমাদের সামনে।
ট্রেভি ফাউন্টেনের সামনে
তবে ট্রেভি ফাউন্টেনের এই পুল কিন্তু খুব একটা গভীর নয়। অন্তত মানুষ ডুবে যাওয়ার মত গভীর নয় এই পুল। তার জলে নামলে খুব বেশী ওই কোমর কী বুক অবধি ডুবতে পারে। অ্যাঞ্জেলস্ অ্যান্ড ডেমনস্ সিনেমার সেই দৃশ্যটা মনে আছে? যেখানে ওই খুনে হ্যাসাসিন গল্পের নায়ক রবার্ট ল্যাঙ্গডনকে (টম হ্যাংকস্) ট্রেভি ফাউন্টেনের জলে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করছে? আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে বাস্তবে সেই প্রয়াস কতদূর সম্ভব হত। আর কিছু না হোক, এই ফোয়ারা ঘিরে যা সিকিউরিটি এবং এত রাতেও যে পরিমাণ সাধারণ পর্যটকের ভিড় - তাতে নেহাতই এ দৃশ্য কষ্ট কল্পনা। প্রসঙ্গত, ট্রেভি ফাউন্টেনের পুলে নামা কিন্তু আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই জল পেয়, অর্থাৎ লোকে পান করতে পারে - আর সে কারণেই এই জলের দূষণ খুব কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। আমাদের যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগেই, মে মাসের শেষের দিকে আলটিমা জেনারেজিয়নে নামে একটি ক্লাইমেট অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপ এই ফোয়ারার জলে কালো রং মিশিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেই নিয়ে সে সময় কম অশান্তি হয় নি। প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে একটি ঐতিহাসিক স্থানকে নোংরা করা, কিংবা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করা বোধহয় খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়। রোমের প্রশাসনকে অনেক খরচ ও পরিশ্রম করতে হয়েছিল ট্রেভি ফাউন্টেনকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। প্রসঙ্গত এই ফোয়ারার ডান পাশে একটি মুখ খোলা কলও রয়েছে, যা সরাসরি অ্যাকুয়া ভারগো থেকেই পানীয় জল সরবরাহ করে। যার ইচ্ছে সেখান থেকে আঁজলা ভরে জল খাও কী জলের বোতল ভরে নাও, তাতে কোন সমস্যা নেই। আমরা নিজেরাও সেই কল থেকেই জল সংগ্রহ করেছি। তবে আমাদের সামনেই যে দু-একজন অত্যুৎসাহী ট্যুরিস্টকে দেখলাম জলে নামার উদ্যোগ নিতে, পুলিশ কিন্তু সাথে সাথেই বাঁশি বাজিয়ে তাদের সে প্রচেষ্টা থেকে বিরত করেছে। আসলে পুরো জায়গাটাই এতটা ইনস্টাগ্রাম-ওর্দি যে কিছু লোক থাকবেই যারা জলে নেমে সেলফি বা ছবি তোলার চেষ্টা করবে। তবে এখন তো আর সেই সাদা-কালোর দিন নেই। ১৯৬০ সালে ফেডেরিকো ফেলিনির সিনেমা ‘লা ডলচে ভিটা’ (দ্য সুইট লাইফ) -র সেই বিখ্যাত দৃশ্যে আনিটা একবারি ও মারচেলো মাসত্রোয়য়ানিকে দেখা গেছিল ট্রেভি ফাউন্টেনের পুলে নেমে অভিনয় করতে। ‘লা ডলচে ভিটা’ ইটালির সর্বকালের সেরা সিনেমাগুলির মধ্যে একটি। আর স্বাভাবিক ভাবেই জনমানসে ফেলিনির সিনেমার সেই দৃশ্যের অভিঘাতও বেশ গভীর। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আর আনিটা একবারি হওয়ার চেষ্টা না করাই ভাল।
ট্রাইটন ও হিপোক্যাম্পাস
ট্রেভির সামনে বসে - দাঁড়িয়ে ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়েছি। সত্যি বলতে, এই ধরণের ভিড়ের মধ্যে এক ধরণের উন্মাদনা থাকে যা আপামর দর্শককে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এবং ক্রমশ সেই ভিড়ের অংশ করে তোলে। বেশ লাগছিল তার সে স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দিতে। তবে, ট্রেভির সঙ্গে যে এক রকমের সুপারস্টিশন বা ট্র্যাডিশন জড়িয়ে আছে, তার অংশ না হতে পারলে বুঝি কোনো ট্রেভি ভ্রমণই সম্পূর্ণ হবে না। আর এই ট্র্যাডিশনের সাথে রোম শহরের চুম্বকীয় আহ্বান ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। ফোয়ারাটির সামনে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ডান কাঁধের উপর দিয়ে বাঁহাতে তার জলে একটি পয়সা ছুঁড়ে দিলে নাকি বারংবার রোম শহরে ফিরে আসা যায়। আমি তো সে রোমের আহ্বান প্রথম দিনই পেয়ে গেছি। প্রথম দিনই রোম শহর তার সৌন্দর্য্যে, ইতিহাসে আমাকে মুগ্ধ করেছে। রোমে ফিরে আসার এত বড় সুযোগ আমিই বা ছেড়ে দিই কী করে? তবে সত্যি বলতে এত সব নিয়ম কানুন আমি তখন জানতাম না। আমি সরাসরিই জলে পয়সা ফেলেছি। এবং অধিকাংশ লোককেই দেখছিলাম সেভাবেই পয়সা ফেলতে। এখানে বলে রাখা ভাল, এই ট্র্যাডিশনের কারণে ট্রেভির জলে দিন প্রতি গড়ে প্রায় তিন হাজার ইউরো অর্থ জমা হয়, আর বছরে প্রায় দেড় মিলিয়ন। এই জমা পয়সার লোভে কত লোকেই ট্রেভির জলে নামতে চেয়ে পুলিশের তাড়া খেয়েছে। এখন পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, ট্রেভির বেসিনে যে এই এত টাকা পয়সা জমা হয় তার শেষ পরিণতি কী? রোমের প্রশাসন কিন্তু সময়ে সময়ে ট্রেভির বেসিন পরিষ্কার করায়। আর সেসময় ফোয়ারার জল থেকে সংগৃহীত সমস্ত অর্থই কিন্তু বিভিন্ন চ্যারিটি ও দুস্থদের সাহায্যার্থে ব্যবহৃত হয়।
সামনে থেকে ট্রেভি ফাউন্টেন
সেদিন আর আমাদের ঘরে ফিরে সব গুছিয়ে বসে ডিনার করা সম্ভব ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ট্রেভির আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্ট থেকেই আমাদের রাতের খাওয়া সেরে নেব। কিন্তু সময় ততক্ষণে প্রায় এগারোটা। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে গেছে। রোম শহর যদিও বা নিদ্রাহীন, সেখানের মানুষ-জন, বিশেষত ইয়াং জেনারেশন, সারারাত জেগে কাটালেও রেস্টুরেন্টগুলো কিন্তু এই সময় বন্ধ হয়ে যায়। কাছের আউটডোর রেস্টুরেন্টটাও দেখলাম ইতিমধ্যেই তাদের বাইরে পাতা রঙিন ছাতা ও চেয়ার-পত্র সব গুটিয়ে ফেলেছে। ট্রেভির উলটোদিকে ভিয়া পোলির জাংশনে একটি মাত্র পিজেরিয়া সেই রাতে খোলা ছিল (পরে জেনেছি দোকানটি পিজ্জা ও আইসক্রিম পার্লার হিসেবে বেশ বিখ্যাত)। তবে তার হাবেভাবে বুঝলাম সেটিও আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি খোঁজ নিয়ে দেখা গেল যে, তাদের স্টকে পিজ্জাও আর খুব বেশী অবশিষ্ট নেই - মেরেকেটে দু তিন পিস পড়ে আছে। পিজেরিয়ার মালিক নিজে আমাদের অনুরোধ করলেন, যাতে রেস্টুরেন্টে বসে না খেয়ে আমাদের রাতের খাবারটা আমরা ঘরের জন্য প্যাক করিয়ে নিয়ে যাই। তার সেই অনুরোধ মত পিজেরিয়ার শেষ দু-পিস নেপোলিটান পিজ্জা প্যাক করতে বলে আমরা আমাদের চার জনের জন্য আইসক্রিমের অর্ডার করলাম। কাঠের চুল্লীর গনগনে আঁচে পিজ্জা সেঁকে বেরোনোর আগেই সেই আইসক্রিম এসে হাজির হয়ে গেল। এখানে বলে রাখি শুধু রোম নয়, গোটা ইটালির ক্যুইজিনেই পিজ্জা বা পাস্তার মতই আইসক্রিমেরও একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ইটালির ভাষায় আইসক্রিমকে বলে জেলাটো। আকার এবং প্রকার ভেদে আমাদের দেশের আইসক্রিমের সাথে তার অনেক পার্থক্য। জেলাটোতে দুধ কম থাকে, আবার সাধারণ আইসক্রিমের তুলনায় তা হয় অনেক বেশী ঘন। আর তার স্বাদের প্রোফাইল - সেও বড়ই বিচিত্র। ইটালির যেকোনো আইসক্রিমের পার্লারে চোখ বুজে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ রকম বিভিন্ন স্বাদের জেলাটো কিনতে পাওয়া যায়। আর তার অর্ধেকেরও বেশি স্বাদ আমার অচেনা। যেমন, রোমে আসার আগেই আমরা লিমনচেলোর নাম শুনেছি। এই লিমনচেলো হল এক রকমের ইটালিয়ান লিকার বা মদ, যা আবার আমাদের দেশে আনঅ্যাভেলেবল - সচরাচর কিনতে পাওয়া যায় না। নেপলস্ সহ দক্ষিণ ইটালির ক্যাম্পানিয়া অঞ্চলে ডাবের সাইজের একরকমের লেবুর চাষ হয়। সেই লেবুর রস থেকেই এই মদ তৈরি, স্বাদে আর গন্ধে যা সত্যিই অতুলনীয়। এই দোকানে দেখলাম সেই লিমনচেলো ফ্লেভারেরও জেলাটো বিক্রি হচ্ছে। একেবারে কচি হলুদ, খানিকটা সর্ষে ফুল যে রঙের হয়, তারও একপোঁচ হালকা হলুদ রঙের এই আইসক্রিম। দেখে লোভ সম্বরণ করা গেল না। নীল রঙা পেটমোটা কাগজের বাটিতে, নানারকম অলঙ্করণে সাজিয়ে সেই আইসক্রিম আমাদের সার্ভ করা হল। দেখা গেল, তার যা পরিমাণ তা খেয়েই আমাদের ডিনার হয়ে যাবে, অন্য কিছুর আর দরকার পড়বে না। কী ভাগ্যিস পিজ্জাগুলো প্যাক করিয়ে নেওয়া হয়েছিল! এত রাতেও কিন্তু ট্রেভির সামনে জন সমাগমের কোন খামতি নেই। উলটে যেন উত্তরোত্তর লোকের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। মানুষেরও বুঝি ঘরে ফেরার কোন তাড়া নেই। প্রেমিক প্রেমিকারাও হয়ত নিজেদের বাহুডোরেই ট্রেভির সেই সিঁড়িতে বসে সময় কাটাবে, এক যদি না তাদের সে কাজের জন্য মাঝরাতে কোন ইটালিয়ান পুলিশের ধাতানি খেতে হয়। আসলে ট্রেভি ফাউন্টেনের যে রাত্রিকালীন মায়াময় রূপ, তা ওই অত রাতেও দেশ বিদেশের পর্যটকদের সেখানে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে আনে। তবে আমাদের সে-রাতের অ্যাডভেঞ্চার কিন্তু তখনো শেষ হয় নি। ট্রেভির ভিড়ের সাথে গা ভাসিয়ে তার লাগোয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম শেষ করে আমরা হাঁটা দিলাম আমাদের পরের ডেস্টিনেশনের উদ্দেশ্যে। স্প্যানিশ স্টেপস্।
ট্রেভি ফাউন্টেনের পুল
*****
ট্রেভি ফাউন্টেন থেকে স্প্যানিশ স্টেপস্ খুব বেশী হলে দশ কী পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। আমরা ট্রেভিতে প্রবেশ করেছিলাম ভিয়া পোলি হয়ে। এবারে আমরা ধরলাম তার উল্টোদিকের ভিয়া ডেলা স্ট্যাম্পেরিয়া। সেখান থেকে বড় রাস্তার মোড় পেরিয়ে গুগলের দেখানো গলিপথে আমরা পা ফেললাম। বড় রাস্তা পেরোতেই শহরের চরিত্র বদলে গেল। রোম শহরের এই অঞ্চলটা খানিক রেসিডেনসিয়াল, আবার অন্যদিকে অল্পকিছু কমার্শিয়াল বিল্ডিংও রয়েছে। স্বভাবতই ট্রেভির থিকথিকে ভিড় এই রাস্তায় অনুপস্থিত। তবে কয়েকটি বার বা পানশালা এই এত রাতেও বেশ গমগম করছে। সেই রকমই একটি বারের সামনে দেখলাম কয়েকটি ছেলে মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে সিগারেট টানছে। আমাদের দিকে তারা একবার ফিরেও তাকাল না। অথচ কলকাতা হলেই এত রাতে এই রকম একটা রাস্তায় চলাচল করতে আমরা রীতিমত আতঙ্কিত থাকতাম। কিছু না হোক এদিক ওদিক থেকে উড়ে আসত কিছু অপ্রীতিকর আলপটকা মন্তব্য। আর সাথে মহিলা থাকলে তো কোন কথাই নেই। রোম কিন্তু সে দিক থেকে অনেক বেশি সচেতন। এরা পার্সোনাল স্পেসে বিশ্বাসী। সেই স্পেসের বাইরে তুমি যা খুশি কর, পার্টনারকে ধরে চুমু খাও - কেউ কোনো মন্তব্য করা তো দূরের কথা ফিরেও তাকাবে না। তবে সত্যি বলতে, মনে মনে একটু ঘাবড়েও ছিলাম। একে ওই রকমের নিশুত রাত। আমরা চারজন একরকম জটলা হয়েই পথ হাঁটছি। লোকজন বিশেষ নেই। জোছনার আলো ইলেকট্রিকের তারের সাথে মিশে পিছলে পড়ছে সাইড ওয়াকে। কোথাও কোনো কনস্ট্রাকশন। সেসব পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ট্রেভি মনে হচ্ছে পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে। আর স্প্যানিশ স্টেপস, সে যেন এসেও আসছে না। মাঝে মাঝে হাঁটা থামিয়ে দু একটা ছবি তুলছি খচ করে। মনে মনে ভাবছি গুগল এ কোথায় এনে ফেলল রে বাবা।
রাতের রোম
তবে গুগল খুব একটা দিক ভুল করে নি। যদিও সে আরেকবার প্রমাণ করে দিল গলিপথের ক্ষেত্রে তাকে খুব একটা ভরসা করা উচিত নয়। এই গুগলই একবার খাস কলকাতা শহরের এক সাব-আর্বে আমাকে পিচ রাস্তা ছেড়ে আবর্জনায় ভরা ডোবা পেরিয়ে উলটো দিকের বড় রাস্তায় যাওয়ার সুপরামর্শ দিয়েছিল। সেই আমি ঠেকেও শিখি না। যাই হোক, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা স্প্যানিশ স্টেপসের মাথার সেই বিখ্যাত চার্চ - ট্রিনিটা ডি মনটির সামনে এসে উপস্থিত হলাম। সেই চত্ত্বর তখন জনরহিত। আমাদের সাথে খুব বেশী হলে আর চার-পাঁচ জন পর্যটকই সেখানে উপস্থিত। তাদের মধ্যে আবার দুই অল্প-বয়সী কাপল, আলিঙ্গনরত - তারা ভেসপা (ইটালির স্কুটার) নিয়ে রাতের সফর করতে বেড়িয়েছে। চার্চের সামনে থেকে তাদের নড়ার খুব একটা ইচ্ছে বোধহয় নেই। সাদা রঙের এই প্রাচীন চার্চ এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। আজ রাতের মত তার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তার দুপাশে দুটি সুউচ্চ বেল-টাওয়ার। চার্চের সামনেই আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটি নিঃসঙ্গ ওবেলিক্স খাড়া পায়ে দাঁড়িয়ে। গভীর রাতের চাঁদের আলো সেই ওবেলিক্স ও চার্চের সফেদ স্ট্রাকচারে পড়ে যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জ্বলছে রাতের আলোকবাতি। এই চার্চের সামনে থেকেই ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়ার দিকে। অন্যদিকে রেলিং, খাদ। এই সিঁড়িগুলিই স্প্যানিশ স্টেপস। পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়ার স্প্যানিশ এমব্যাসির নামেই তার নামকরণ। যদিও এই সিঁড়ির আর্কিটেকচার কিন্তু পুরোদস্তুর ফ্রেঞ্চ, - ইটালিয়ান বা স্প্যানিশ নয়। এইখানে বলে রাখি, স্প্যানিশ স্টেপসে পৌঁছাতে আমি সামান্য একটু অফ-র্যুটের সাহায্য নিয়েছিলাম। আসলে রাত্রিবেলায় স্প্যানিশ স্টেপসের মোট একশ পয়ত্রিশটা খাড়া সিঁড়ি চড়ার রিস্ক আমি নিতে চাই নি। তার থেকে সিঁড়ি ধরে নীচে নামাটাই আমার কাছে অনেক বেশি সহজসাধ্য বলে মনে হয়েছিল। আর সে কারণেই চার্চের দিকের সামান্য এই দীর্ঘ পথটুকু ধরা।
স্প্যানিশ স্টেপস্-এর পথে
এই যে ট্রিনিটা ডি মনটি চার্চের কথা বললাম, এই চার্চটি প্রায় ছ’শো বছর পুরোনো একটি চার্চ। ১৪৯৪ সালে ফ্রান্সের রাজা অষ্টম চার্লস্ এই অঞ্চলে একটি জমি কেনেন এবং পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের কাছ থেকে এই জমিতে একটি মনাস্টেরি বানানোর অনুমতি জোগাড় করেন। এই মনাস্টেরিই হল ট্রিনিটা ডি মনটি। চার্চের সামনেই রয়েছে সেই উত্তুঙ্গ ওবেলিক্স, যার পোশাকি নাম ওবেলিস্কো স্যালুস্টিয়ানো। আগেই বলেছি, এই চার্চ ও ওবেলিক্সের সামনে থেকেই স্প্যানিশ স্টেপসের সূত্রপাত। সিঁড়িটির অপর প্রান্তে রয়েছে একটি ফোয়ারা, যার নাম ফন্টানা ডেলা বারকাচিয়া। প্রসঙ্গত, ওবেলিক্স রোমের প্রায় সমস্ত পিয়াজ্জাতেই দেখতে পাওয়া যায়। রোমান সৈন্যরা অনেক সময়ই প্রাচীন মিশরের সাথে যুদ্ধ শেষ হলে লুটপাটের সময়ে তাদের ওবেলিক্স ভেঙে নিয়ে আসতেন। তবে ট্রিনিটা ডি মনটির সামনের ওবেলিক্সটি আসল মিশরীয় ওবেলিক্সের একটি কপি। খ্রিষ্টিয় তৃতীয় শতকের শেষের দিকে রোমের সম্রাট অরেলিয়ান এই ওবেলিক্সটি নির্মাণ করেছিলেন রোমের উপকন্ঠে স্যালুস্টের বাগানের জন্য। এর গায়ের হিয়েরোগ্লিফিক্স রোমেরই পিয়াজ্জা ডেল পোপোলোর অন্য একটি ওবেলিক্স থেকে কপি করা হয়েছিল। ১৭৮৯ সালে ওবেলিক্সটিকে সরিয়ে নিয়ে এসে ট্রিনিটা ডি মনটির সামনে স্থাপনা করা হয়। এখন এই ওবেলিক্স স্প্যানিশ স্টেপসের আইকনিক দৃশ্যাবলির এক অন্যতম অংশ।
ট্রিনিটা ডি মনটি ও ওবেলিস্কো স্যালুস্টিয়ানো
ট্রিনিটা ডি মনটির সামনে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা স্প্যানিশ স্টেপসের রেলিং ধরে - ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামা শুরু করলাম। আমাদের সামনে রাতের রোম শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য। সারি সারি পুরোনো বাড়ি ঘর রাতের আলোয় উদ্ভাসিত। অনেক নীচে পিয়াজ্জার সামনে থেকে সোজাসুজি একফালি রাস্তা দূরে প্রায় অসীমে মিলিয়ে গেছে। এখান থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে সেখানে পর্যটক ও স্থানীয় মানুষ জনের ভিড়। অনেকেই আবার সিঁড়ির নীচের দিকের ধাপগুলিতে জমায়েত করে বসে। সময় যদিও তখন প্রায় মধ্যরাত। নীচের রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার চিহ্নমাত্র নেই। তবে তার কারণ সম্ভবত এই যে, ট্রেভি ফাউন্টেনের মত এই জায়গাটিও একটি পেডেস্ট্রিয়ান জোন। এখানে গাড়ি চলে না। প্রাচীন সিঁড়িটি চওড়া হলেও যথেষ্টই খাড়া। মাঝে মাঝেই বালুস্ট্রেডে ঘেরা র্যাম্প, যেখানে দাঁড়িয়ে রোম শহরের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। পরে জেনেছি এই সিঁড়িতে মোট এগারোটি র্যাম্প রয়েছে আর এই সিঁড়িটি গোটা ইউরোপের মধ্যে সর্বাধিক চওড়া। পিছন ফিরলে আমাদের মাথার উপরে ট্রিনিটা ডি মনটি আর তার সামনের ওবেলিক্স সিঁড়ির ঢালের মাথায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। রাতের অন্ধকারে মনে হচ্ছে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে তাদের দেহ থেকে। প্রসঙ্গত, স্প্যানিশ স্টেপস্ তৈরির অন্যতম কারণও হচ্ছে এই ফরাসি চার্চ এবং তার নীচের পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়া ও সেখানকার স্প্যানিশ দূতাবাসের মধ্যেকার এই ঢাল। খাড়াই এই ঢালের কারণে দর্শনার্থী ও চার্চের ফ্রিয়ারদের চার্চ ব্যবহারে অসুবিধে হচ্ছিল। সিঁড়িটি তৈরির আগে তাদের এই ঢাল অতিক্রম করেই চার্চে প্রবেশ করতে হত। সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা ও অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত হয় উন্মুক্ত এই ঢালের জায়গায় একটি সিঁড়ি নির্মাণ করা হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন এই নির্মাণ আটকে পড়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত ফরাসি রাজনীতিক এটিয়েন গ্যাফিঁয়ে তার উইলে এই সিঁড়ির নির্মাণের জন্য বিপুল সম্পত্তি বরাদ্দ রেখে যান। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সিঁড়ির মাথায় ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা চতুর্দশ লুইসের ঘোড়ায় চড়া (ইক্যুয়েস্ট্রিয়ান) একটি মূর্তির নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু পোপের শহরে বসবে ফ্রান্সের রাজার মূর্তি? স্বয়ং হোলি সি-র বিরোধিতা এবং গ্যাফিঁয়ে-র এই উইলের কিয়দংশ চেয়ে তার বিরুদ্ধে আবেদনের কারণে সিঁড়িটির নির্মাণকাজ আবার থমকে যায়। শেষ পর্যন্ত পোপ ত্রয়োদশ ইনোসেন্ট ফ্রান্সের রাজ পরিবারের সাথে একক সমঝোতায় আসেন। এই সমঝোতা অনুযায়ী চতুর্দশ লুইসের মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং সিঁড়ির গায়ে ফ্রান্সের রাজ পরিবারের প্রতীকচিহ্ন ফ্লর-ডি-লিস (লিলি ফুল) সাথেই স্থান পায় পোপ ত্রয়োদশ ইনোসেন্টের ঈগল সম্বলিত রাজচিহ্ন। ১৭২৩ থেকে ১৭২৫ সালের মধ্যে ফ্রানচেসকো দে স্যাংকটি ও অ্যালেসান্দ্রো স্পেচির নকশা অনুযায়ী স্প্যানিশ স্টেপসের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়।
স্প্যানিশ স্টেপস্ থেকে রাতের রোম শহর। স্টেপস্ থেকে নেমে বাঁদিকের বাড়িটি কীটস্ এর বাসস্থান
স্প্যানিশ স্টেপস্ একটি ব্যারোক মাস্টারপিস এবং বহুদিন ধরেই তা ইউরোপ ও আমেরিকার উবের-রিচ, সুন্দর-সুন্দরী তথা বোহেমিয়ানদের এক মিলনক্ষেত্র। তার সামনের রাস্তায় দোকানিরা বিবিধ বহুমূল্য বস্তুর দোকান ও ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেন। স্প্যানিশ স্টেপসের ধাপগুলিও বসন্তকালে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। রঙ বেরঙে ভরে যায় পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়া। স্প্যানিশ স্টেপসের এই বৈচিত্র্য এবং তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই বারে বারে আকৃষ্ট করেছে দেশ-বিদেশের আর্টিস্ট ও বিভিন্ন চিত্র-পরিচালককে। বিবিধ সিনেমার শুটিং হয়েছে স্প্যানিশ স্টেপসে। তবে এরই মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত সিনেমাটি বোধ হয় - রোমান হলিডে (১৯৫৩)। এই হলিউডি সিনেমাটির নির্দেশক ছিলেন আমেরিকান চিত্র পরিচালক উইলিয়াম ওয়াইলার। সিনেমাটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক কাল্ট ক্লাসিক, জনশ্রুতিতে সত্যজিৎ রায়ের অত্যন্ত পছন্দের সিনেমা। আর এই সিনেমারই একটি অতি-বিখ্যাত দৃশ্যে গ্রেগরি পেক ও নবাগতা অড্রে হেপবার্নকে দেখা গেছিল স্প্যানিশ স্টেপসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে। হেপবার্ন পরে এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য অস্কারও পেয়েছিলেন। তবে সেই সব সোনালি দিন বোধহয় আর ফিরে আসবে না। প্রসঙ্গত, রোমের প্রশাসনের নির্দেশ অনুযায়ী এখন স্প্যানিশ স্টেপসে জটলা করে বসে থাকা, খাওয়া-দাওয়া করা এবং কিংবা তার সিঁড়ির ধাপগুলি নোংরা করা আইনত নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালে শেষবার সংস্কারের পর (রোমান লাক্সারি ব্র্যান্ড বুগারি প্রায় দেড় মিলিয়ন ইউরো খরচ করে এই সংস্কার করিয়েছিল) এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই কাজ করতে গিয়ে কেউ ধরা পড়লে তাকে আড়াইশো ইউরো জরিমানাও গুণতে হতে পারে। তবে আমরা সিঁড়ির নীচে পৌঁছে দেখলাম যে সে বারণ শুধুমাত্র নামেই কার্যকর হয়েছে। এবং আমাদের ধারণা সত্যি করে ধাপগুলিতে পর্যটকেরা রীতিমত ভিড় করে রয়েছেন। অবশ্য আমাদের সেদিকে চোখ দেওয়ার বিশেষ সময় ছিল না। ঘড়ির কাঁটা বলছে রোমে আমাদের প্রথম দিন অতিবাহিত। এইবারে ঘরে ফেরার সময়।
পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়া থেকে স্প্যানিশ স্টেপস্
তবে ফিরব বললেই কী ফেরা যায়! ঘরে ফেরার আগে আরো কয়েকটি স্থাপত্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যেমন স্প্যানিশ স্টেপসের ঠিক উলটো দিকে, পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়ার একেবারে মধ্যিখানে রয়েছে একটি ছোট্ট ফোয়ারা, নাম তার ফন্টানা ডেলা বারকাচিয়া। বোরগেজে গ্যালারি ভ্রমণের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে রোম তথা ইটালির বিখ্যাত ভাস্কর জিয়ান লোরেঞ্জো বার্নিনির নাম উল্লেখ করেছিলাম। তার বাবা পিয়েত্রো বার্নিনিও কিন্তু ভাস্কর হিসেবে ছিলেন বেশ বিখ্যাত। ১৬২৩ সাল থেকে অ্যাকুয়া ভেরজিনের পোপ নিযুক্ত প্রধান স্থপতি ছিলেন বার্নিনির বাবা এই পিয়েত্রো বার্নিনি। আর এই পিয়েত্রো বার্নিনিই পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়ার মাঝখানে ডুবন্ত নৌকার আদলে তৈরি ফোয়ারাটিরও ভাস্কর। (অনেকে মনে করেন, এই ফোয়ারাটির নির্মাণে সিনিয়য়ার বার্নিনির সাথে জিয়ান লোরেঞ্জোরও কিছু অবদান রয়েছে।) কথিত আছে, একবার টিবার নদীর ভীষণ বন্যায় রোম শহরে একটি ছোট্ট নৌকো ভেসে এসেছিল। এই আধা-ডুবন্ত নৌকাটি পোপ অষ্টম আর্বানের মনে বিশেষ দাগ ফেলে যায়। তার সেই অনুপ্রেরণাতেই ১৬২৯ সালে নির্মিত হয় ফন্টানা ডেলা বারকাচিয়া। আবার স্প্যানিশ স্টেপসের গা ঘেঁষে ডানদিকে যে ক্রিম রঙের বাড়িটি, সেটি ছিল রোম শহরে ইংল্যান্ডের রোমান্টিক জেনারেশনের বিখ্যাত কবি জন কীটস্-এর বাসস্থান। এই বাড়িটিতেই দীর্ঘ রোগে ভুগে ১৮২১ সালে কীটসের মৃত্যু হয়েছিল। এখন এই বাড়িটি একটি মিউজিয়াম। কীটস্ ও তার প্রিয় বন্ধু পার্সি বিসি শেলির বিভিন্ন ম্যানুস্ক্রিপ্ট ও ব্যবহার্য জিনিস সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এই বাড়িটিতে।
ফন্টানা ডেলা বারকাচিয়া
বলা বাহুল্য, সেদিন স্প্যানিশ স্টেপস থেকে ঘরে ফিরতে বেশ ভালোই জব্দ হয়েছি। তবে, আমাদের অনুমান কিন্তু নির্ভুল ছিল। ট্রেভি ফাউন্টেনেরর মতই পিয়াজ্জা ডি স্প্যানিয়া (বস্তুত যেকোনো পিয়াজ্জাই) একটি পেডেস্ট্রিয়ান জোন। সেখান থেকে ডান হাতে আরো কিছুটা এগিয়ে গেলে - কলাম অফ দ্য ইম্যাকুলেট কনসেপশন; পিয়াজ্জার একেবারে শেষের কর্নারে তার অবস্থান। এখানেই মিনারের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন ভার্জিন মেরি। নীচে মিনারটিকে ঘিরে মোট চারটি ব্যারোক স্ট্যাচু - কিং ডেভিড, ইসাইয়া, এজেকিয়েল এবং মোজেস। লুইগি পোলেত্তির নির্মিত এই অপূর্ব ভাস্কর্য। আর মিনারটি তৈরি (কমিশন) করিয়েছিলেন দুই সিসিলির রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ - ১৮৫৭ সালে; নেপলস এবং রোমের মধ্যের ক্রমবর্ধমান বিরোধ মেটানো ছিল তার উদ্দেশ্য। স্প্যানিশ স্টেপস থেকে হাঁটাপথে এই মিনার মিনিট দুই কী তিনের রাস্তা। গাড়ি আসবে এইখানেই। কিন্তু গাড়ি পেলে তো। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে অন্তত গোটা তিনটে উবের আমাদের বুকিং ক্যানসেল করার পর (সাথে সাথে আমাদের হৃদ্স্পন্দনও বৃদ্ধি পাচ্ছিল) গাড়ি পাওয়া গেল। তবে ভাড়া পড়ল প্রায় তিন গুণ। সেই গাড়ি চড়ে কানডিনস্কি হাউসের সামনে আমরা যখন নামলাম, ঘড়ির কাঁটা রাত্রির প্রথম প্রহরের দিকে তার যাত্রা শুরু করেছে।
স্প্যানিশ স্টেপস্ থেকে
*****