উন এস্টাটে ইটালিয়ানা - তৃতীয় পর্ব

লিখেছেন:রাজর্ষি ঘোষ

 

সপ্তদশ শতকের গোড়ার কথা। সময়টা ১৬০৯ সাল, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের ঘটনা। রোম শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যাসিলিকা - সান্তা মারিয়া ম্যাজিওরের একটি মার্বেল রিলিফ বানানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ভাস্কর পিয়েত্রো বার্নিনি। কাজের অনুরোধ এসেছিল স্বয়ং পোপের কাছ থেকে। পিয়েত্রোর নিজের জন্ম ফ্লোরেন্সে হলেও কর্মসূত্রে তিনি তখন থাকতেন ইটালির দক্ষিণে নেপলস্‌ শহরে। এহেন, পোপের অনুরোধ উপেক্ষা না করতে পেরে পিয়েত্রো কার্যত তার গোটা পরিবার সমেত নেপলস্‌ ছেড়ে চলে আসেন রোম শহরে, সেও প্রায় বছর তিনেক হয়ে গেল। রোমে পিয়েত্রোকে কাজের সহায়তা করছে তারই শিক্ষানবিশ সন্তান, নাম তার জিয়ান লোরেঞ্জো। তার বয়স তখন সবেমাত্র এগারো। তবে পিয়েত্রোর সাকুল্যে মোট তেরোটি সন্তানের মধ্যে তার এই ষষ্ঠ সন্তানের হাতের কাজে যেন জাদু আছে। এই অল্প বয়সেই সে বানিয়ে ফেলেছে অত্যন্ত নান্দনিক কিছু শিল্পকর্ম। রোমের উপকন্ঠে কার্ডিনাল সিপিওনে বোরগেজের সুবিশাল বাগান বাড়িতে কিছু মূর্তি গড়ার কাজ করতে এসেছিলেন পিয়েত্রো। কার্ডিনাল সিপিওনের এই বাগান-বাড়িতে বিভিন্ন ইটালিয়ান মাস্টারের শিল্পকর্মের বিশাল সমাহার। সিপিওনে নিজেও ভীষণ রকমের শিল্প রসিক। সেখানে গিয়ে অবধি কার্ডিনালের নেকনজর পড়েছে এই অল্প বয়সী ছেলেটির উপর। তিনি খেয়াল করেছেন বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটি কেমন সুনিপুণ হাতে অপূর্ব সব ভাস্কর্য নির্মাণ করে চলেছে। রোমের ক্ষমতার অলিন্দে সিপিওনে ততদিনে বেশ সুপরিচিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত এক নাম। সেই সিপিওনে চিঠি লিখলেন তার ততোধিক বিখ্যাত কাকাকে; যিনি আর কেউ না, স্বয়ং পোপ পঞ্চম পল। প্রিয় ভাইপোর চিঠি পড়ে পোপ আশ্চর্য্য চকিত। চিঠিতে সিপিওনে লিখেছেন এক অমিত প্রতিভাধর বালকের কথা। কিন্তু এও কি সম্ভব? অতএব পোপের ডাক আসল পিয়েত্রো ও তার সন্তানের কাছে; পোপ নিজের চোখে পরখ করে নিতে চান জুনিয়র বার্নিনির কারিগরি দক্ষতা। ভ্যাটিকানের ভর্তি সভাঘর। সভায় উপস্থিত পোপ এবং তার বিশ্বস্ত বন্ধুরা অবাক চোখে দেখছেন, তাদের সামনেই সেন্ট পলের এক স্কেচ কিভাবে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে ভাস্কর্য হিসেবে। আর ভাস্কর নেহাতই এক শিশু। এক সময় পোপ আর থাকতে না পেরে বলেই বসলেন, আরে, এই ছেলে তো তার সময়ের মাইকেল অ্যাঞ্জেলো হয়ে উঠবে দেখছি। পোপ পঞ্চম পলের এই ভবিষ্যৎবাণী সার্থক হয়েছিল। বর্তমান রোম ও তার অপূর্ব শিল্প সম্ভারের অধিকাংশই রূপ পেয়েছে এই জিয়ান লোরেঞ্জো বার্নিনির হাতে। ভ্যাটিকানের প্রাণকেন্দ্রে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার অন্যতম স্থপতি বার্নিনি। আবার এই ব্যাসিলিকা সংলগ্ন সুবিশাল সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের বর্তমান রূপও দিয়েছেন তিনিই। রোমের প্রসিদ্ধ পিয়াজ্জা নভোনার বিখ্যাত ফোয়ারাটিও বার্নিনির হাতেই নির্মিত হয়েছে। পরবর্তিতে বার্নিনির অন্যতম প্রধান প্যাট্রন পোপ অষ্টম আর্বান তার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, তুমি তৈরিই হয়েছ রোম শহরের জন্য, আর রোম তোমার জন্য। বস্তুত রোম আর বার্নিনি যেন এক কথায় সমার্থক, একে অন্যের সাথে মিলে মিশে গেছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, প্রায় চারশো বছর আগের এক ভাস্করের হাতের নকশায় রোম এখনো এত জীবন্ত, এত প্রাণোচ্ছল। ১৬৮০ সালে একাশি বছরের বৃদ্ধ বয়সে বার্নিনির মৃত্যু হয়। বার্নিনি তার সুদীর্ঘ জীবনে খুব অল্প সময়ের জন্যই রোম শহরের বাইরে, অন্য কোথাও গিয়ে থিতু হতে পেরেছেন; যদিও তিনি ডাক পেয়েছেন অজস্র। একবারই মাত্র ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইসের একান্ত অনুরোধে বার্নিনি প্যারিসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু, প্যারিসের বৈভব তাকে সেভাবে টানতে পারে নি। বলা চলে, বার্নিনিও কোনোদিন প্যারিসকে রোমের মত করে ভালবাসতে পারেন নি। তাই মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যেই প্যারিসের পাট চুকিয়ে বার্নিনি ফিরে এসেছিলেন তার স্বপ্নের শহর রোমে। 

চতুর্দশ লুইসের মূর্তির প্রোটোটাইপ - বার্নিনি

এখানে বার্নিনিকে নিয়ে আমাদের এই গৌরচন্দ্রিকার একটা বিশেষ কারণ আছে। রোম শহরে পৌঁছে আমাদের প্রথম গন্তব্য হবে ভিলা বোরগেজে। সেই ভিলা বোরগেজে, যেখানে বার্নিনির প্রতিভার প্রথম বিকাশ হয়েছিল। সিপিওনে বোরগেজের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধই হোক, কী অন্য কোন কারণে বার্নিনি বহুদিন বোরগেজে ভিলার সাথে স্থপতি ও ভাস্কর হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এখানেই যুবক বার্নিনি তার প্রসিদ্ধ ব্যারোক স্টাইলে অসাধারণ কিছু ভাস্কর্য রচনা করেছেন। তৎকালীন রোমের বিশাল শিল্পকলার সমাহারের মধ্যেও এই ভাস্কর্যগুলো এক অভূতপর্ব শৈল্পিক বিল্পব ডেকে এনেছিল। তবে শুধু বার্নিনিই নয়, ভিলা বোরগেজে সমৃদ্ধ হয়েছে আরো বিভিন্ন ভাস্কর ও চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্মে। তার মধ্যে যেমন আছেন ইতালীয় রেনেসাঁর স্বর্ণযুগের বিখ্যাত শিল্পী রাফায়েল, তেমনি আছেন ব্যারোক চিত্রকল্পের জনক কারাভাজিও। এই কারাভাজিও-ও এক অদ্ভুত চরিত্র। কারাভাজিওর জন্ম ১৫৭১ সালে, মিলান শহরে; অর্থাৎ বার্নিনির জন্মের প্রায় তিরিশ বছর আগে। পেশায় চিত্রকর কারাভাজিও কুখ্যাত ছিলেন তার ভয়ঙ্কর মেজাজ আর রাক্ষুসে রাগের কারণে। বস্তুত রেগে গেলে তার মাথার ঠিক থাকত না। শুধুমাত্র ১৫৯০ সাল থেকে ১৬০৬, এই ষোলো বছরের মধ্যেই তরুণ কারাভাজিওর নামে সর্বসমক্ষে ঘটা অসংখ্য হাতাহাতি আর মারামারির নালিশ নথিবদ্ধ হয়েছিল মিলান, জেনোয়া, ভেনিস, ও রোম সহ ইটালির বিভিন্ন শহরে। তার বিরুদ্ধে বিবিধ মামলা দায়ের হয় এবং তাকে বেশ কয়েকবার জেলেও যেতে হয়েছিল। তবে এর মধ্যে সবথেকে মারাত্মক যে অভিযোগ ওঠে, তা হল ম্যানস্লটার অর্থাৎ খুনের। ১৬০৬ সালের ২৯শে মে, রোম শহরে রানুচিও তোমাসোনি নামে এক যুবকের মৃত্যু হয় কারাভাজিওর হাতে। তোমাসোনি ও কারাভাজিওর মধ্যে কোনোদিনই তেমন সদ্ভাব ছিল না। তোমাসোনি ছিলেন এক প্রো-স্প্যানিশ প্রবল প্রতিপত্তিশালী পরিবারের সন্তান, বিত্তবান, যদিও সামাজিক মর্যাদায় আমরা যাদের বলি গ্যাংস্টার বা গুন্ডা। অন্যদিকে কারাভাজিও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হলেও ভাগ্যের ফেরে তুলনামূলক ভাবে গরীব, এবং তখন সবে খ্যাতির মুখ দেখেছেন। প্রসঙ্গত, ১৫৭৭ সালে মিলানের প্লেগে কারাভাজিওর বাবা আর দাদুর একই দিনে মৃত্যু হয়েছিল, এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে তার পাঁচ সন্তানকে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে পালন করতে গিয়ে ঘটনার সাত বছর পর কারাভাজিওর মাও মারা গেছিলেন প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায়। উপরন্তু সেই সময় কারাভাজিওর মূল প্যাট্রন ছিলেন রোমের ফরাসি অ্যাম্বাসাডর। বিভিন্ন ছবিতে কারাভাজিওর মডেল, প্রখ্যাত ইতালিয় কোর্টেসান (বেশ্যা) ফিলিডে মেলানদ্রনিকে নিয়ে তোমাসোনি ও কারাভাজিওর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। তোমাসোনি ছিলেন ঘটনাচক্রে মেলানদ্রনির দালাল বা পিম্প। ১৬০৬ সালের ওই ঘটনাবহুল দিনে তোমাসোনি ও কারাভাজিও নিজেদের মধ্যে তলোয়ারের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন, যার পরিণতি হয় মারাত্মক। কারাভাজিও তোমাসোনির কাসট্রেশনের চেষ্টা করেন, এবং সেই অভিঘাতে তোমাসোনির মৃত্যু হয়। তোমাসোনি ও কারাভাজিওর এই ডুয়েল এবং তার পরিণতিতে তোমাসোনির মৃত্যু - সেটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, সেই নিয়ে অনেক বিবাদ রয়েছে। কিন্তু তৎকালীন রোমের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্প্যানিশ ও ফ্রেঞ্চ দুই বিবাদমান গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ কোন্দলের মাশুল গুণতে হয় কারাভাজিওকে। তোমাসোনির অতি ক্ষমতাশালী পরিবার প্রতিশোধের সঙ্কল্প নেয়। এমনকি কারাভাজিওর প্রভাবশালী প্যাট্রনরাও তাকে তার এই বিপদের হাত থেকে আর রক্ষা করতে পারেন নি। কারাভাজিওর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়, শিরচ্ছেদের মাধ্যমে। আজকের দিনের সাইট অ্যান্ড শ্যুটের মতোই নির্দেশ জারি হয়, কেউ যদি কারাভাজিওকে চিনতে পারেন, তাহলে যেন তিনি তৎক্ষণাৎ কালবিলম্ব না করে তার মুন্ডচ্ছেদ করেন। পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠায় কারাভাজিও রোম ছেড়ে নেপলস্‌ শহরে পালিয়ে যান। 

নেপলস্‌ শহর ছিল রোমের জুরিসডিকশনের বাইরে। স্বভাবতই রোমের কোর্টের রায় সেখানে খাটে না। নতুন এই শহরে প্রভাবশালী কোলোনা পরিবারের সদস্যা কস্টানজা কোলোনা ফোরজা কারাভাজিওর আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠেন। এই কস্টানজা কোলোনা ফোরজার প্রয়াত স্বামীর অধীনেই কারাভাজিওর বাবা দীর্ঘদিন মিলান শহরে কাজ করেছিলেন। সুতরাং দুই পরিবারের ইতিপূর্বেই ঘনিষ্ঠতা ছিল। কোলোনা পরিবারের আপেক্ষিক সুরক্ষা ও আশ্রয়ে থেকে অচিরেই কারাভাজিও রোমের মত নেপলসেও তার প্রভাব বিস্তার করেন। তবে এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রওনা হয়ে যান মালটার উদ্দেশ্যে। কস্টানজা কোলোনা ফোরজার এক সন্তান, ফ্যাবরিজিও ফোরজা কোলোনা ছিলেন মালটার নাইট। তিনিই কারাভাজিওকে মালটার নাইটদের গ্র্যান্ড মাস্টার উইগনাকোর্টের দরবারে এনে হাজির করেন। কারাভাজিও আশা করেছিলেন উইগনাকোর্টের আনুগত্য তাকে অবিলম্বে রোমান কোর্টের ক্ষমা এনে দেবে। কারাভাজিওর প্রতিভায় মুগ্ধ উইগনাকোর্ট কারাভাজিওকে সরাসরি তার নাইটদের দলে সামিল করে নেন এবং তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাইটদের অর্ডারের চিত্রকর হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু মালটা শহরেও শেষ পর্যন্ত তার অবস্থান খুব একটা সুখের হয় নি। কারাভাজিও তার সেই কুখ্যাত স্বভাবের কারণে পুরোনো সেই বিপদের পুনরায় সম্মুখীন হলেন। ১৬০৮ সালে কারাভাজিওর ফের জেল হয়। এবারে কারাভাজিও এক অভিজাত নাইটের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। পরিণামে তাকে নাইটদের অর্ডার থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং কারাভাজিও পালিয়ে আসেন ইটালির আরো দক্ষিণে - সিসিলির দ্বীপরাষ্ট্রে। সেখানে কারাভাজিওর শৈশব বয়সের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রথম জীবনে তার বিভিন্ন ছবির মডেল হিসেবে সুপরিচিত - মারিও মিনিতি, তাকে নিজের আশ্রয় দেন। এমন নয় যে সিসিলিতে তার খুব কাজের অভাব হচ্ছিল, কিন্তু ক্রমাগত বিভিন্ন বিপদের আশঙ্কায় কারাভাজিওর মানসিক স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়ে এবং নয় মাসের মধ্যেই কারাভাজিও সিসিলি ছেড়ে নেপলস শহরে কোলোনা পরিবারের আশ্রয়ে ফিরে আসেন। ১৬০৫ সালে রোমের ক্ষমতার পালাবদলে নতুন পোপ নিযুক্ত হয়েছিলেন পঞ্চম পল। ভবিষ্যতে এই পঞ্চম পলই বার্নিনির প্রতিভা অন্বেষণ করবেন। এবং এক্ষেত্রেও পোপ পঞ্চম পলের প্রিয় ভাইপো সেই সিপিওনে বোরগেজে ছিলেন কারাভাজিওর একান্ত সমর্থক ও গুণমুগ্ধ ভক্ত। পোপের নিজস্ব কর্মকাণ্ডে সিপিওনের প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। চাইলেই সিপিওনে কারাভাজিওকে তার কাঙ্ক্ষিত ক্ষমা এনে দিতে পারতেন। এই শেষ সুযোগ কাজে লাগাতে কারাভাজিও সিপিওনের সাথে যোগাযোগ করেন এবং উপহার স্বরূপ বেশ কিছু চিত্র তার হাতে তুলে দেন। খবর আসে কারাভাজিওর ক্ষমা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। ১৬১০ সালের জুলাই মাস। পোপের প্রদেয় ক্ষমার চিঠি সংগ্রহ করার লক্ষ্যে কারাভাজিও নেপলস ছেড়ে নদীপথে রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। সে যাত্রায় তার সাথে ছিল কার্ডিনাল সিপিওনের জন্য আরো বেশ কিছু ছবি এবং উপহার। এর পর ঠিক কী হয় তা আজও রহস্যে ঘেরা। তবে রোমে এসে পৌঁছানোর আগেই (এবং রয়াল পারডন তার হাতে আসার আগে) সন্দেহজনক পরিস্থিতে কারাভাজিওর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র আটত্রিশ বছর। কারোর মতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপে বা অন্য কোনো সংক্রমণে কারাভাজিও মারা যান; কারো মতে সিফিলিস, কারোর মতে কেমিক্যাল রঙ থেকে লেড পয়জনিং, আবার কেউ কেউ মনে করেন তোমাসিনির পরিবারই প্রতিশোধস্পৃহায় তাকে কোনো উপায়ে খুন করেছিল। তবে যে কোনো কারণেই হোক না কেন, ইটালি হারায় তার এক অসীম প্রতিভাধর চিত্রকরকে, যিনি তার জীবদ্দশায় রোমান চিত্রশিল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন। তার চিত্রশিল্পের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে রুবেন, রেমব্রান্ট, বার্নিনি সহ আরো বিভিন্ন শিল্পীর শিল্পকর্মে। 

***** 

ইমিগ্রেশনের লাইনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, মোবাইলের সমস্যা, গাড়ি পেতে দেরি হওয়া এবং সর্বোপরি এয়ারপোর্টে জঙ্গি হানার আশঙ্কা - সব মিলিয়ে ঘরে ঢুকে আমাদের শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। ফেডেরিকোর সাজানো গোছানো পরিপাটি গৃহকোণ ছেড়ে যে অন্য কোনো জায়গার উদ্দেশ্যে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করব - মনে হচ্ছিল কী দরকার। এই যে আশ্রয়, এবং এই আরামটুকু - এটুকুই তো আমার চাওয়া। এখানে আমার শোওয়ার ঘর সংলগ্ন দক্ষিণের খোলা বারান্দা, - কেন জানি না ইচ্ছে করছিল হাতে একটা বই, ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ আর টিভিতে ফেলিনির কোনো পুরনো সিনেমা চালিয়ে বসে পড়তে। রোমের উপকন্ঠে কানডিনস্কি হাউস - যেন স্বপ্নের মত; আমার সব পেয়েছির ঠিকানা। অন্যদিকে, বোরগেজে গ্যালারিতে আমাদের বুকিং ছিল ঠিক সাড়ে বারোটার সময়। এতখানি লম্বা জার্নি করে এসে যে এত তাড়াতাড়ি গ্যালারি দেখতে বেরিয়ে যাব, এরকমটা প্ল্যান করার একটা কারণ ছিল।  এয়ারবিএনবির নিয়মানুযায়ী তো বেলা তিনটের আগে আমাদের এই ফ্ল্যাটের অ্যাকসেস পাওয়ারই কথা নয়। আমাদের আগের অতিথিরা নেহাতই সকাল সকাল ফ্ল্যাট ছেড়ে দেওয়ায় ফেডেরিকো আমাদের জন্য এই ব্যবস্থাটুকু করে রেখেছিলেন। তাই আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, ফ্ল্যাটে এসে মালপত্র জমা রেখে আমরা আবার শহর ঘুরতে বেরিয়ে যাব। ফিরব সেই দুপুর তিনটের পর, চেকইনের সময়। 

রোমের পর্যটন মানচিত্রে বোরগেজে গ্যালারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্রষ্টব্য হলেও এর বুকিং পাওয়া কিন্তু নেহাতই ভাগ্যের ব্যাপার। প্রতি ঘণ্টায় সাকুল্যে মোট চল্লিশ জনের বেশি এই গ্যালারিতে ঢুকতে পারে না। সুতরাং বলাই বাহুল্য, খুব সীমিত সংখ্যক পর্যটকই এই গ্যালারি দেখতে আসতে পারেন। এবং সরাসরি গ্যালারিতে পৌঁছে টিকিট কাটার চেষ্টা করলে সেই মুহূর্তে নিরাশ হওয়ার সম্ভাবনাই হয়তো প্রবল। প্রসঙ্গত, আমরা বোরগেজে গ্যালারির টিকিট কেটেছিলাম অনলাইনে, রোম যাত্রার অন্তত মাস দুয়েক আগে। এখন এতো সহজেই অনুমেয়, একবার স্লট মিস হলে এ যাত্রায় আর আমাদের এই গ্যালারি দেখার সুযোগ হবে না। প্রাথমিকভাবে তাই শরীর না চাইলেও ঘরে বসে জিরোনোর কোনো উপায় আমাদের ছিল না। সামান্য ফ্রেশ হয়ে নিয়ে এবং ম্যান্ডেটরি এক রাউন্ড চা পানের পর (কার্টেসি, বাবা আর বাপি) আমরা আবার জুতোয় পা গলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রোমের রাস্তায়। আর বেড়ানোর ক্ষেত্রে যা হয়, একবার ঘর ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালে, কোথায় ক্লান্তি, আর কোথায় কী, একেবারে সব কিছু উধাও হয়ে যায়। আগেই বলেছি, রোম শহরে আমাদের কলকাতার মতই নানারকম পরিবহণের ব্যবস্থা। ট্রাম থেকে ট্রেন, ট্যাক্সি থেকে উবের সব কিছুরই এখানে বন্দোবস্ত রয়েছে। আমাদের আবার ফ্ল্যাটের সামনেই বাসস্টপ। হু হু করে সেখানে লাল রঙের দুই কামরার বিশাল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাস ছুটে চলেছে রাজপথ ধরে। চাইলে এই বাসে করেও গ্যালারি ঘুরতে যাওয়া যেতে পারত। তবে রোমে যেহেতু আজ সবে আমাদের প্রথম দিন - সুতরাং, বেশি দৌড়-ঝাঁপ না করে চট করে একটা উবেরই বুক করে নিলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কালো মার্সিডিজে সওয়ার, আমরা রওনা হয়ে গেলাম রোমের উপকন্ঠে বোরগেজে গ্যালারির উদ্দেশ্যে। 

সপ্তদশ শতকের একেবারে প্রথমভাগে কার্ডিনাল সিপিওনে বোরগেজের নির্দেশে এবং রোমান আর্কিটেক্ট ফ্ল্যামিনিও পনজিওর নকশা মত বোরগেজে ভিলা যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন কিন্তু এই এলাকা ছিল রোম শহরের বাইরে। শহরের গোলযোগ থেকে বেশ কিছুটা দূরে, মূলত সাব-আরবান অঞ্চলে এই ভিলা তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন সিপিওনে। সেই সময় ভিলা সংলগ্ন বোরগেজে এস্টেটের মোট জমির পরিধিই ছিল প্রায় তিন মাইলের কাছাকাছি। আর এই সুবিশাল এলাকা সাজানো হয়েছিল বাগান, নানারকম ভাস্কর্য, ফোয়ারা, ও ছোট ছোট জলধারা দিয়ে। শুধু তাই নয়, বোরগেজে এস্টেটের এই বাগানে তখন পোষা হত দেশ বিদেশের বিচিত্র সব পশুপাখি - যেমন, ময়ূর, উটপাখি, হাঁস এবং সারস, ইত্যাদি। ষোড়শ শতকের শেষদিকে বোরগেজে পরিবার তাদের আদি বাসস্থান সিয়েনা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে রোম শহরে বসবাস করা শুরু করেন। ১৬০৫ সালে এই পরিবারেরই সদস্য ক্যামিলো বোরগেজে পোপ হিসেবে নিযুক্ত হন (পোপ পঞ্চম পল)। এবং আধুনিক পরিভাষায়, যাকে আমরা নেপোটিজম বলি, তারই মাধ্যমে তিনি তার প্রিয় ভাইপো সিপিওনে বোরগেজেকে কার্ডিনাল পদে অধিষ্ঠিত করেন। সিপিওনে কার্যত পোপের বকলমে ভ্যাটিকানের সরকার পরিচালনা করতেন, এবং তার এই ক্ষমতাবলেই (পাপাল ফি এবং ট্যাক্স কালেকশনের মাধ্যমে) তিনি প্রচুর ধন সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে রেনেসাঁ, ব্যারোক আর্ট এবং রোমান অ্যান্টিকের প্রতি সিপিওনের ঝোঁক ছিল প্রথম থেকেই। তিনি ছিলেন এইসব আর্টফর্মের একনিষ্ঠ সমঝদার, পৃষ্ঠপোষক ও সংগ্রাহক। সিপিওনে তার অর্জিত ধনরাশির বিপুল অংশ ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য ব্যয় করতে থাকেন। তার সংগ্রহের তালিকায় যুক্ত হয় বহু প্রাচীন শিল্পকর্ম। বস্তুত, বোরগেজে ভিলা - এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরির মূল উদ্দেশ্যই ছিল এক ছাদের তলায় তার সুবিশাল সংগ্রহকে নিয়ে আসা। মূলত তারই ব্যাক্তিগত উদ্যোগে টিশান, রাফায়েল, কারাভাজিও, এবং বার্নিনি সহ বিভিন্ন ইটালিয়ান মাস্টারের শিল্পকলার বিপুল সম্ভার জমা হতে থাকে বোরগেজে ভিলাতে। ১৬৩৩ সালে সিপিওনের মৃত্যুর পর থেকে এখন এই ২০২৪, প্রায় চারশো বছরের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে বোরগেজে গ্যালারি এবং সংলগ্ন বাগানের চরিত্রের কিন্তু বিবিধ পরিবর্তন হয়েছে। উপরন্তু, রোমের রাজনীতিতে একসময় যে বোরগেজে পরিবারের ক্ষমতা ছিল সর্বাত্মক, ধীরে ধীরে সেই পরিবারেও দুর্ভাগ্য নেমে আসে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সিপিওনের বিপুল সংগ্রহ ক্রমশ তার উত্তরসূরিদের হাতছাড়া হতে থাকে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে ওঠে যে ১৮০৮ সালে প্রিন্স ক্যামিলো বোরগেজে, বোরগেজে গ্যালারির বহু মূল্যবান চিত্র, স্থাপত্য এবং অ্যান্টিক পিস বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন তার বিখ্যাত (মতান্তরে কুখ্যাত) শ্যালক এবং ফ্রান্সের একনায়ক সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে। এই বিক্রিত শিল্পসম্ভারের মধ্যে ছিল মধ্যে ছিল টিশান, রাফায়েলের আঁকা বিভিন্ন ছবি এবং বোরগেজে গ্যালারির সবথেকে বিখ্যাত অ্যান্টিক, বোরগেজে গ্ল্যাডিয়েটর এবং বোরগেজে হারমাফ্রোডিটাস। নেপোলিয়নের আনুকূল্যে বিক্রি হয়ে যাওয়া এই সমস্ত অ্যান্টিক স্থান পায় প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে। আরো বড়সড় কোনো ক্ষতি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ১৯০২ সালে ইটালির সরকার সমস্ত শিল্পকলা সমেত বোরগেজে ভিলা ও সংলগ্ন বাগান ক্রয় করে নেন এবং পাবলিক গ্যালারি হিসেবে তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। বর্তমান দশকে দাঁড়িয়ে এই গ্যালারির সম্ভার আগের থেকে কিছু কমলেও এখনো এখানে যা সব মণিমুক্তো রয়েছে তা যেকোনো সাধারণ পর্যটকের চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। 

*****

ফিউমাচিনো এয়ারপোর্ট থেকে রোমে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে আসার পথে প্রথমবার টিবার নদীর দর্শন পেয়ে বেশ হতাশ হয়েছিলাম। তবে হতাশ হলেও এটা অস্বীকার করতে পারি না যে ইউরোপের দেশগুলোতে যেভাবে নদীর যত্ন নেওয়া হয় তা রীতিমত শিক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে, প্যাডার। প্যাডার হল জার্মানির সব থেকে ছোট নদী। সেখানে যখন ছিলাম, দেখেছি মাত্র চার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীপথের দুপার ধরে সাজানো বাগান, এবং পাবলিক পার্ক। কি সকাল কি বিকেল, যখনই সে রাস্তা ধরে পথ হেঁটেছি আবর্জনা তো দূরের কথা একটা শুকনো পাতাও অগোছালো ভাবে কোথাও পড়ে থাকতে দেখিনি। আর সেখানে টিবার তো ইটালি কিংবা ইউরোপের প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী। এবং হাজার হলেও রোম ইটালির সবথেকে বড় শহর। জনঘনত্বে বা মোট জনসংখ্যার নিরিখে তার সাথে জার্মানির ছোট্ট শহর প্যাডারবর্নের কোনো তুলনাই চলে না। অথচ তার পরেও রোমের টিবার নদী কী পরিচ্ছন্ন, কী দারুণ তার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা। বোরগেজে ভিলা যাওয়ার পথে যখন আমরা দ্বিতীয়বার এই নদী পার হলাম, তার দুপারের সংযোগরক্ষাকারী ব্রিজগুলির চেহারা ও পরিচ্ছন্নতা দেখে সত্যিই ভীষণ অবাক হয়েছি। রোমের মত এত বড় একটা মেট্রো শহরে থেকে সেখানকার সাধারণ নাগরিকরা এই ব্রিজ, এবং এই নদীপথকে কীভাবে এত পরিষ্কার, ঝকঝকে করে রাখেন তা আমার কল্পনারও অতীত। তাছাড়া এই শহরে কি কোনো গৃহহীন মানুষও নেই? 

বোরগেজে ভিলা 

আমাদের উবের আধঘন্টার মধ্যেই বোরগেজে ভিলার গেটের সামনে এনে হাজির করল। তারপরেও আমাদের পৌঁছতে বেশ কিছুটা দেরিই হয়ে গেছিল। হন্তদন্ত হয়ে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি আমাদের যিনি গাইড, বাগানের একপাশে তার গ্রুপ নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন। আমাদের আজকের গাইড অল্পবয়সী এক ইটালিয় তরুণী। তার নাম জ্যাক, পুরো নাম সম্ভবত জ্যাকেলিন। আর্কিওলজি এবং রোমের শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করে জ্যাক এই জীবিকা বেছে নিয়েছেন। জ্যাক একে একে আমাদের সাথে গ্রুপের বাকিদের আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিলেন। এক মধ্যবয়স্ক যুগল সুদূর আমেরিকা থেকে রোম ঘুরতে এসেছেন তাদের ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে। এক ইটালিয়ান নব-দম্পতি - খুব সম্ভবত এটা তাদের হানিমুন ট্যুর। এক ইউক্রেনিয় তরুণ, তিনি নিজেও পেশায় চিত্রকর, তার আর্মেনিয়ান গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছেন মূলত গবেষণার উৎসাহে। এই তরুণটির হাতে ধরা নোটবুক এবং একগুচ্ছ পেনসিল। ট্যুরের মাঝে সুযোগ মত কিছু স্কালপ্‌চার স্কেচ করে নেবেন। এবং পরিশেষে আমরা চারজন। সব মিলিয়ে জনা বারো লোক। জ্যাক আমাদের হাতে ট্যুরের ব্যাজ, ইয়ারফোন এবং সাথে একটি করে গাইডিং ডিভাইস ধরিয়ে দিলেন। গাইডেড ট্যুরের ক্ষেত্রে এই ধরণের যন্ত্রের ব্যবহার এই প্রথম দেখলাম। গাইড এখানে ব্লু-টুথ কানেক্টেড মাইক্রোফোনের সাহায্যে যা কথা বলবেন, এই যন্ত্র তাই ক্যাপচার করে ইয়ারফোনের সহায়তায় সরাসরি আমাদের কানে পাঠিয়ে দেবে, সে তিনি যত দূরেই দাঁড়িয়ে থাকুন না কেন। আবার কেউ কোনো কারণে গ্রুপ থেকে আলাদা হয়ে গেলেও এই যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে ফের দলে ডেকে নেওয়া যাবে। প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর্ব মিটলে জ্যাক আমাদের নিয়ে ভিলার দিকে অগ্রসর হলেন। 

রোমে আসার আগে আমি বোরগেজে ভিলা নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেই এসেছিলাম। তবে সেই পড়াশোনা ছিল মূলত এই ভিলার বিপুল পরিমাণ শিল্প সংগ্রহের বিষয়ে। জ্যাক এবার এই ভিলার পূর্নাঙ্গ ইতিহাসের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই ভিলার ঐতিহাসিক যা গুরুত্ব, তা আমি আগেও উল্লেখ করেছি। এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করব না। ভিলার চারপাশে ছবির মত সাজানো সবুজ বাগান। ছোট ছোট সাদা রঙের নুড়ি পাথর বিছানো পথ পেরিয়ে আমরা হাজির হলাম মূল ভবনের সামনে। এই পথের দুধারে এবং ভবনের সামনের খোলা চত্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্ট্যাচু। অধিকাংশই সিপিওনে বোরগেজের নিজস্ব সংগ্রহ। এদের বয়সের আলাদা করে কোথাও কোনো উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন রোমান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলি যে ঠিক কতটা প্রাচীন তা তাদের চেহারা থেকেই অনুমান করা যায়। কোথাও রোম সার্কাসের ক্লান্ত গ্ল্যাডিয়েটর, কিংবা রোমান জেনারেল মিনারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার পূর্ণ পোষাকে, আবার কোথাও নগ্ন নারীমূর্তি, প্রাচীন রোমান সভ্যতার প্রতীক সিংহ হাঁটু মুড়ে বসে। খুব ভুল যদি না হয়, এই মুর্তিগুলির কোনটিরই বয়স হাজার দুয়েকের কম হবে না। ভিলা বাদ রাখলেও বোরগেজে বাগানের এই মূর্তিগুলি নিজেরাও এক একটি দ্রষ্টব্য। তাদের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় সময় বুঝি থমকে গেছে এইখানে। অফ হোয়াইট রঙের মূল ভবনের সর্বমোট দুটি তলা এবং দুই পাশে দুই উইংস। দুই পাশ থেকে ভবনের ধার ঘেঁষে সিঁড়ি উঠে গেছে সদর দরজার দিকে। আমরা সিঁড়ি পেরিয়ে কোণার দিকের একটি ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। 

 

প্রাচীন রোমান অ্যান্টিকে সাজানো বোরগেজে গার্ডেন

যেখানে সারাদিনে এই ভিলায় মোট কজন পর্যটক প্রবেশ করতে পারবেন ইটালির গভর্নমেন্ট তারও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে সহজেই অনুমেয় এই গ্যালারির নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ঠিক কতটা আঁটোসাঁটো হতে পারে। স্ক্রিনিং শেষ করে নিজেদের সমস্ত মালপত্র বেসমেন্টে সিকিউরিটির কাছে জমা রেখে, হাতে শুধুমাত্র ক্যামেরা নিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকতে পারলাম। একতলার বড় ঘরটিতে প্রবেশ করামাত্রই যেন চমক লাগল। মেঝে থেকে ছাদ অবধি রঙিন ছবি আঁকা সুসজ্জিত ঘরটির মধ্যিখানে প্রায় দুই মানুষ উচ্চতার একটি বিশাল স্কাল্পচার। বার্নিনির জীবনের অন্যতম সেরা কাজ - রেপ অফ প্রসারপিনা। এই ভাস্কর্যটির সম্বন্ধে আগেও পড়েছি, কিন্তু এমন নিঁখুত কাজ চোখের সামনে কোথাও কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বোরগেজে গ্যালারিতে বার্নিনির অল্প বয়সে করা যে মোট চারটি অসাধারণ স্থাপত্য এখনো বিদ্যমান, তার মধ্যে প্রথমটিই হল এই রেপ অফ প্রসারপিনা। বার্নিনি এই মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন ১৬২১ সালে, যখন তার বয়স মাত্র তেইশ। প্রসারপিনার ঘটনাবলী রোমান মিথের অন্তর্গত। মিথ অনুযায়ী প্রসারপিনা (গ্রীক উপকথায় পারসিফোন) ছিলেন রোমান দেবতাদের রাজা জুপিটার এবং প্রাণ ও ফসলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সেরেসের কন্যা। পাতালের দেবতা প্লুটো (গ্রীক মিথোলজি অনুযায়ী, হেডিস অথবা ডিস) লেকের ধারে প্রসারপিনাকে ফুল কুড়োতে দেখে তার প্রেমে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে অপহরণ করে পাতালে নিয়ে যান। সেরেস অপহরণকালে শুধুমাত্র তার মেয়ের কান্নার আওয়াজটুকুই শুনতে পেয়েছিলেন, এবং তার মেয়েকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে ওঠেন। তার ক্ষোভে সূর্য অস্তমিত হয়, পৃথিবী ক্রমশ মরুভূমিতে পরিণত হতে থাকে এবং সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। দেবতাদের রাজা জুপিটার প্রমাদ গোনেন এবং মার্কারির মাধ্যমে প্লুটোকে নির্দেশ পাঠান যেন অবিলম্বে তার কন্যা প্রসারপিনাকে আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে প্রসারপিনা প্লুটোর হাত থেকে পাতালের কিছু খাবার (বেদানার দানা) গ্রহণ করে ফেলেছেন। দেবতাদের সভায় প্লুটো যুক্তি দেন যেহেতু প্রসারপিনা স্বেচ্ছায় মৃতদের এই খাবার গ্রহণ করেছেন তাই তাকে আইন অনুযায়ী জীবিতদের দুনিয়ায় পাকাপাকিভাবে আর ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত, প্লুটো ও জুপিটারের মধ্যে চুক্তি হয়, প্রসারপিনা ছয় মাস পৃথিবীতে তার মায়ের কাছে এসে থাকতে পারবেন। যদিও বাকি ছয় মাস তাকে পাতালে প্লুটোর সাথে এসে থাকতে হবে। আর তারপর থেকেই পৃথিবীতে ঋতুচক্রের সূত্রপাত হয়। প্রসারপিনার পৃথিবীতে ফেরার সাথে সাথে সেরেসের ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে বসন্ত ঋতুর সূত্রপাত, পল্লবিত হয় মুকুল, পৃথিবী সেজে ওঠে অপরূপ সাজে, তারপর গ্রীষ্মে ফসলের সমারোহ এবং শরৎ শেষ হয়ে ছয় মাস পরে প্রসারপিনার পাতালে প্রবেশের কালে পৃথিবী ক্রমশ হয়ে ওঠে অনুর্বর, নিষ্ফলা; সময় শুরু হয় রুক্ষ শীতের। 

 

 

 

বার্নিনির বোরগেজে সিরিজের স্কালপ্‌চার - রেপ অফ প্রসারপিনা 

শ্বেত কারারা মার্বেলে রচিত তার এই বিখ্যাত স্কালপ্‌চারে বার্নিনি বন্দী করেছেন রোমান উপকথার সেই মুহূর্তটিকে, যখন প্লুটো সেরসে কন্যা প্রসারপিনাকে তার কাঁধে উঠিয়ে ধরে পাতালে প্রবেশ করছেন। অপহরণরত প্লুটোর সুদৃঢ় বাহুবন্ধনে প্রসারপিনা এমনিতেই ত্রস্ত। দুর্বলের ক্ষমতাহীন এবং ক্ষীণ প্রতিরোধ ব্যর্থ হলে যে ব্যাকুলতা তাকে আচ্ছন্ন করে তাই যেন অশ্রুবিন্দুর মাধ্যমে সকরুণ হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে তার চোখেমুখে। অন্যদিকে প্লুটোর মুখে বিজয়ীর হাসি, তার শক্তিশালী দুহাত চেপে ধরেছে প্রসারপিনার কমনীয় দেহটিকে। তার শরীরের পেলব মাংসপেশি সঙ্কুচিত হচ্ছে প্লুটোর সেই খরস্পর্শে, আঙুলের ছাপ চেপে বসেছে তার উন্মুক্ত জঙ্ঘায়। আর এই প্রবল নাটকীয় মুহূর্তের দুই প্রধান কুশীলব - যথা, প্লুটো ও প্রসারপিনা, দুজনেই কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায় নিরাভরণ; যদিও প্রসারপিনার গা থেকে লজ্জা নিবারণের একখন্ড বস্ত্র খসে এসে পড়ছে প্লুটোর দেহে। প্লুটোর পায়ের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেরবেরোস, তিন মাথাওলা সেই ভীষণদর্শন কুকুর যা নাকি শত্রুদের আক্রমণের হাত থেকে পাতালের প্রবেশদ্বারকে সতত রক্ষা করে চলেছে। সত্যিই, কী আশ্চর্য এই মূর্তি! প্রাচীন রোমান উপকথার পুরো দৃশ্যকল্পটিকে কী অবিশ্বাস্য দক্ষতায় এখানে একফ্রেমে বেঁধে ফেলা হয়েছে। আর ততোধিক আশ্চর্যের হল এই ভাস্কর্যের অনন্য ডিটেলিং। বাহুর মাধ্যমে নগ্ন শরীরে বল প্রয়োগ করলে মানবদেহের যে অংশে যতটুকু টোল পড়ার কথা, যতটুকু দৃশ্যমান হওয়ার কথা হাতের শিরা কিংবা উপশিরা, আঙুলের ছাপ চেপে বসার কথা মানবদেহের যে গভীরতায়, নিখুঁত এবং নির্ভুল পরিমাপে তাই যেন উপস্থিত হয়েছে এই মূর্তিতে। এমনকি প্রসারপিনার অবিন্যস্ত কাপড়ের ভাঁজ এমনই যে দেখলে মনে হবে তা বুঝি এই মাটিতে খসে পড়ল। প্রসঙ্গত প্লুটো বা প্রসারপিনাকে দেবত্ব আরোপ করবেন না বলেই বার্নিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মানবশরীরের একাধিক ছোটোখাটো খুঁত রেখে গেছেন তাদের দেহে, যা আমাদের সাধারণ চোখে সেভাবে দৃশ্যগোচর নয়। যেমন জ্যাক আমাদের না দেখালে হয়ত খেয়ালও করতাম না প্লুটোর পিঠের ওই ছোট্ট তিলটুকু, যা কিনা তার নশ্বরতারই ইঙ্গিত বহন করে। বস্তুত, এই মূর্তিতে রোমান মিথোলজির সাথে বাস্তবতা এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে হঠাৎ করে দেখলে সেটিকে জীবন্ত বলে মনে হতে পারে। আমি আজ পর্যন্ত বহু মিউজিয়ামে বহু শিল্পকলার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু একথা হলফ করে বলতে পারি এর আগে এমন কোনো মূর্তি আমি দেখিনি যার চরিত্রায়ন এতটাই বাস্তবধর্মী। 

প্রাথমিক ভাবে বোরগেজে ভিলার নিজস্ব সংগ্রহের জন্য তৈরি করা হলেও রেপ অফ প্রসারপিনা মূর্তিটিকে কিন্তু নির্মাণের পর খুব বেশিদিন বোরগেজে গ্যালারিতে ধরে রাখা যায় নি। ১৬২৩ সালে মূর্তিটি নির্মাণের মাত্র দু’বছরের মাথায় সিপিওনে বোরগেজে এটিকে উপহার হিসেবে তুলে দেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কার্ডিনাল, লুডোভিকো লুডোভিসির হাতে। খুব সম্ভবত ১৬২১ সালের জানুয়ারি মাসে পোপ পঞ্চম পলের মৃত্যু হলে, তার পরবর্তী পোপের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থেই তাকে এই উপহার দেওয়া হয়েছিল। এই নতুন পোপ, পঞ্চদশ গ্রেগরি ছিলেন লুডোভিসি পরিবারের সদস্য এবং সম্পর্কে কার্ডিনাল লুডোভিকো লুডোভিসির কাকা। সিপিওনে তার কাকা পঞ্চম পলের প্রতি আনুগত্যের কারণে কোনোদিনই পোপ পঞ্চদশ গ্রেগরির সাথে খুব একটা মসৃণ বা কাছের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন নি। যদিও তাদের এই মতান্তর দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় নি। পঞ্চদশ গ্রেগরি মাত্র দুই বছরই পোপের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন। তার মৃত্যুর পর পোপ হন বার্নিনির বন্ধু এবং তার দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক মাফেও বারবেরিনি (পোপ অষ্টম আর্বান)। হস্তান্তরের পর বার্নিনির রেপ অফ প্রসারপিনা স্থান পেয়েছিল লুডোভিসি ভিলায়। পরবর্তীকালে আরো বিভিন্ন স্থান পরিবর্তনের পর শেষমেষ ১৯০৮ সালে ইটালির গভর্নমেন্ট মূর্তিটিকে কিনে নেয় এবং সেটিকে আবার বোরগেজে গ্যালারিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। প্রসঙ্গত, নির্মাণ পরবর্তী সময়ে মূর্তিটিকে বোরগেজে ভিলার একটি দেওয়ালের সামনে উঁচু পেডেস্টালের উপরে দাঁড় করানো হয়েছিল। এই পেডেস্টালে খোদাই করা ছিল মাফেও বারবেরিনির (পরবর্তীতে পোপ অষ্টম আর্বান) একটি বিখ্যাত কবিতার লাইন - (Oh you who are bending down to gather flowers, \ behold as I am abducted to the home of the cruel Dis)। কিন্তু পেডেস্টালটি পরে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ১৯১১ সালে আবার নতুন করে মূর্তিটির জন্য অন্য একটি পেডেস্টাল বানাতে হয়। বর্তমানে বোরগেজে ভিলায় মূর্তিটিকে এই নতুন পেডেস্টালের উপরেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। 

বার্নিনির তৈরি অসাধারণ এই ভাস্কর্যটির সামনে কিছুক্ষণ স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই মূর্তিটিই বোরগেজে ভিলার প্রথম ঘরটির সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশন। তবে শুধু রেপ অফ প্রসারপিনাই নয়, এই সুদৃশ্য ঘরটি আরো বিভিন্ন অলঙ্করণ ও মূর্তির দ্বারা সুসজ্জিত। যদিও তার মধ্যে কোনটিই বার্নিনির এই মাস্টারপিসটির মত ফ্যান ফলোয়িং পায় নি। বোরগেজে ভিলায় তার উপর ও নীচ দুটি তলা মিলিয়ে মোট কুড়িটির মত ঘর রয়েছে। এর মধ্যে নীচের তলার ঘরগুলো মূলত বার্নিনির তৈরি স্ট্যাচুগুলির কারণেই বিখ্যাত। সেখানে উপরের ঘরগুলি রেনেসাঁ আমলের বিভিন্ন ছবির কালেকশনের জন্য পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্যালারিতে ঢুকে তার প্রথম ঘর পেরিয়ে এসে আমরা এবার ঢুকলাম তার পাশের ঘরে; সেখানে আমাদের মোহিত করল, বার্নিনির তৈরি আরেকটি বিখ্যাত ভাস্কর্য, অ্যাপোলো অ্যান্ড ড্যাফনি। রেপ অফ প্রসারপিনার মতই এই মুর্তিটিকেও ঘরের ঠিক মাঝখানে প্লেস করা হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই দর্শকদের আকর্ষণ অন্য কোন দিকে বিক্ষিপ্ত না হয়। ১৬১৮ সাল নাগাদ সিপিওনে বোরগেজে, তরুণ বার্নিনিকে বোরগেজে ভিলার জন্য কিছু মূর্তি তৈরির বরাত দেন। এই সিরিজের দ্বিতীয় মূর্তিটি ছিল রেপ অফ প্রসারপিনা। তবে অ্যাপোলো অ্যান্ড ড্যাফনি তার এই সিরিজের শেষ এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বার্নিনি এই মূর্তিটির কাজ শেষ করেছিলেন ১৬২৫ সালে। রেপ অফ প্রসারপিনার কাজ শেষ হওয়ার অনতি পরেই এই মূর্তিটি নির্মাণের কাজ শুরু হলেও মাঝখানে অন্য একটি ভাস্কর্য ডেভিড নির্মাণে বার্নিনির মনোযোগের কারণে এই মূর্তিটি তৈরিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। অ্যাপোলো অ্যান্ড ড্যাফনি ব্যারোক আর্টের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক নিদর্শন। বলা হয়, গোটা ইউরোপে সপ্তদশ শতকে যে ব্যারোক মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল তার সূত্রপাত হয় এই মূর্তিটির থেকেই। বস্তুত, এই মূর্তিটির মাধ্যমেই বার্নিনি নিজেকে স্কালপ্‌চারের জগতে ব্যারোক ফর্মের জনক এবং তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আমরা ব্যারোক আর্ট নিয়ে একটু আলোচনা সেরে নিই। 

 

 

 

বার্নিনির অ্যাপোলো ও ড্যাফনি 

রেনেসাঁ আমলের যে স্ট্যাচুগুলি সারা বিশ্বে পরিচিতি এবং খ্যাতি লাভ করেছে, সেগুলি মূলত কোন বিখ্যাত ঘটনাক্রমের শুরুর অথবা শেষের দৃশ্য বর্ণনা করে। মূর্তিগুলির চরিত্ররা সাধারণত এখানে শান্ত এবং সমাহিত। যেমন, ফ্লোরেন্স শহরে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড। ডেভিড এখানে প্রতীক্ষারত, আসন্ন যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতিতে স্থিরচিত্ত। তার পিঠে এলিয়ে রয়েছে সেই গুলতিটি যার মাধ্যমে তিনি এর পরে গোলিয়াথকে হত্যা করবেন। সেখানে, ব্যারোক আর্ট ঘটনার বহমানতাকে উদ্‌যাপন করে। ঘটনাক্রমের সবথেকে নাটকীয় মুহূর্তগুলিই এক্ষেত্রে শিল্পের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। স্বভাবতই, এই সব মূর্তির চরিত্ররা অনেক বেশি গতিশীল, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, ইন অ্যাকশন। বার্নিনির রেপ অফ প্রসারপিনাকেই যদি আমরা উদাহরণ হিসেবে নিই, আমরা দেখব বার্নিনি মূল ঘটনাক্রমের মধ্যে প্রসারপিনাকে অপহরণ করে প্লুটোর পাতাল প্রবেশের দৃশ্যটিকেই এখানে পাথরে খোদাই করেছেন। ঘটনাক্রমের মূল কুশীলব প্লুটো ও প্রসারপিনা দু’জনের কেউই কিন্তু এই মূর্তিতে স্থির নয় এবং ঘটনার বহমানতাকেই এই মূর্তিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। 

অ্যাপোলো ও ড্যাফনি - বার্নিনির এই মূর্তিটির দৃশ্যপটও প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মিথোলজির আশ্রয়ে নির্মিত। ধনুর্বিদ্যা এবং সূর্যের দেবতা অ্যাপোলো ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। গ্রীক ও রোমান পুরাণের বিভিন্ন উপকথায় তার দেহ সৌষ্ঠবের উল্লেখ রয়েছে। আশ্চর্যের কী, এই একবিংশ শতকেও পুরুষ দেহের সৌন্দর্য্যের বর্ণনায় তাদেরকে গ্রীক গড অ্যাপোলোর সাথে তুলনা করা হয়। আর সেকারণেই অ্যাপোলো হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত দাম্ভিক। একবার অ্যাপোলো প্রেমের দেবতা কিউপিডকে (এই কিউপিড ছিলেন সৌন্দর্য্য ও সমৃদ্ধির দেবী ভেনাসের সন্তান) ধনুর্বিদ্যায় তার পারদর্শিতার কারণে বালক বলে উপহাস করেন। অপমানিত ও ক্ষুব্ধ কিউপিড অ্যাপোলোকে উচিত শিক্ষা দিতে তাকে বিদ্ধ করেন তার প্রেমের সোনালি তীরে। ফলে, পৃথিবী ভ্রমণের সময় কোনো এক নদীর নিম্ফ (এক ধরণের উপদেবতা) ড্যাফনির মন ভোলানো সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে অ্যাপোলো তাকে তার হৃদয় দিয়ে বসেন। পরিস্থিতি জটিল করে তোলার উদ্দেশ্যে কিউপিড এবার তার সীসার তীরে বিদ্ধ করেন নদীকন্যা ড্যাফনিকে। ড্যাফনি অরণ্যভূমির ছায়া ছায়া অন্ধকার গাছের আড়ালে সুপুরুষ অ্যাপোলোকে ক্রমশ তার দিকে অগ্রসর হতে দেখে দ্রুত সেই স্থান পরিত্যাগ করে ছুটে পালিয়ে যান। প্রেমে আকুল অ্যাপোলো পলায়নরতা ড্যাফনিকে অনুসরণ করে দৌড়তে থাকেন এবং দৌড়তে দৌড়তেই বারংবার তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই এবং তিনি তার কোনো ক্ষতি করবেন না। কিন্তু শত প্রচেষ্টাতেও তার সে আবেদন বিফল হয়। বরং অ্যাপোলোর প্রেমে সাড়া না দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ড্যাফনি ক্রমশ তার থেকে আরো দূরে পালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তারপরেও অ্যাপোলোর পিছু ছাড়াতে না পেরে ড্যাফনি শেষপর্যন্ত তার পিতা সেই নদীর দেবতার কাছে আকুল হয়ে প্রার্থনা করেন, যেন তিনি এসে তাকে এই পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেন। ড্যাফনির পিছু ধাওয়া করে যখন অ্যাপোলো তাকে তার হাতের নাগালে প্রায় পেয়েই গিয়েছেন, এমন সময় নদীর দেবতার আশীর্বাদে ড্যাফনির শরীরে শুরু হয় মেটামরফোসিস। হতবাক অ্যাপোলোর চোখের সামনেই তার ভালোবাসা ড্যাফনি ক্রমশ একটি লরেল গাছে রূপান্তরিত হতে থাকেন। নদীকন্যা ড্যাফনির সোনালি চুল হয়ে ওঠে সেই লরেল গাছের কচি সবুজ পাতা, তার দুই হাত হয়ে ওঠে গাছের শাখা, আর তার কমনীয় শরীর ধীরে ধীরে গাছের বাকলের চেহারা নেয়। ড্যাফনিকে পেতে ব্যর্থ অ্যাপোলো তখন এই লরেল গাছটিকেই তার প্রেম ও সম্মান প্রদর্শন করেন, এবং লরেল গাছের পাতায় সাজান তার মুকুট ও গলার হার। এর পর থেকে লরেল গাছ হয়ে ওঠে গোটা রোমান সাম্রাজ্যে বিজয় ও সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক। প্রসঙ্গত, ইংরেজি লরিয়েট (বাংলায় যার অর্থ বিজয়ী) শব্দটিও এসেছে এই লরেল গাছ থেকেই। 

 

 

 

অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে অ্যাপোলো ও ড্যাফনি - ড্যাফনির মেটামরফোসিস 

আগেই উল্লেখ করেছি অ্যাপোলো অ্যান্ড ড্যাফনি ব্যারোক ভাস্কর্যের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বস্তুত ব্যারোক আর্টের একাধিক পার্সপেক্টিভ থাকে। অর্থাৎ একটি ব্যারোক স্কালপচারকে সেন্টার পয়েন্টে রেখে বিভিন্ন দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং প্রত্যেক পর্যবেক্ষণেই দর্শক এই মূর্তি থেকে কিছু না কিছু নতুন দৃশ্যকল্প খুঁজে পাবেন। আর এখানেই অ্যাপোলো অ্যান্ড ড্যাফনির সার্থকতা, বা বলা যেতে পারে ম্যাজিক। বার্নিনি অ্যাপোলো ও ড্যাফনির উপকথার যে মুহূর্তটিকে এখানে ভাস্কর্যের রূপ দিয়েছেন তা হল ড্যাফনির মেটামরফোসিসের প্রসেস, অর্থাৎ যে মুহূর্তে ড্যাফনি রূপান্তরিত হচ্ছেন উপকথার সেই লরেল গাছটিতে। অ্যাপোলো এখানে ড্যাফনিকে অনুসরণ করে প্রায় তাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন। খোলা হাওয়ায় উড়ছে তাদের দুজনেরই চুল। অ্যাপোলোর হাতও ড্যাফনির দিকেই প্রসারিত। কিন্তু, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরিবর্তন শুরু হয়েছে ড্যাফনির দেহে। যদি সামনের দিক থেকে এই মূর্তির দিকে তাকাই দেখা যাবে ভীত সন্ত্রস্ত ড্যাফনি কিভাবে অ্যাপোলোর হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আবার তার উলটো দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে কিভাবে ক্রমশ পল্লবিত হয়ে উঠেছে ড্যাফনির সমগ্র শরীর, তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ পরিবর্তিত হয়ে চেহারা নিয়েছে একটি আস্ত লরেল গাছের। বস্তুত এই দ্বিতীয় অবজার্ভেশন পয়েন্ট থেকে মানবশরীরের নিরিখে আস্ত মূর্তিটিতে ড্যাফনির দেহের সামান্য চিহ্নটুকুও যেন মুছে ফেলা হয়েছে। আর সেখানে তার জায়গা নিয়েছে একটি বৃক্ষ। মার্বেলের মূর্তিতে এই ডুয়ালিটি, অর্থাৎ এই পরিবর্তন ধরা যে কী দুঃসাধ্য এক কাজ তা বলে বোঝানো যাবে না। বার্নিনির রেপ অফ প্রসারপিনাকে যদি বর্ণনা করি মানবিক ও নিখুঁত হিসেবে, অ্যাপোলো ও ড্যাফনির ক্ষেত্রে এই বর্ণনা হবে মানবিক, নিখুঁত এবং ম্যাজিকাল। অনেকেরই হয়ত আপত্তি থাকবে আমার পরের অবজারভেশনে, তবে বোরগেজে গ্যালারিতে ঢোকা মাত্রই তার প্রথম ঘরে রেপ অফ প্রসারপিনার অবস্থান দর্শকের মনকে সজোরে এক ধাক্কা দেয়। আর হয়ত সেটাই এই মুর্তিটিকে পর্যটকদের কাছে এত জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে সত্যিই যদি শৈল্পিক দিক থেকে বিচার করা হয়, বার্নিনির বোরগেজে সিরিজের শ্রেষ্ঠ কাজ হল এই অ্যাপোলো ও ড্যাফনি। তার সাথে অন্য কোনো মূর্তিরই কোনো তুলনা চলে না। 

বোরগেজে গ্যালারির নীচের তলার বিভিন্ন ঘরে এর বাইরেও কিন্তু বার্নিনির আরো অনেক কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল বার্নিনির বোরগেজে সিরিজের বাকি দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য, এক - ডেভিড এবং দ্বিতীয় - ইনিয়াস, অ্যানকাইসিস অ্যান্ড অ্যাসকানিয়াস। বার্নিনির ডেভিড কিন্তু তার পূর্বসুরী মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিডের থেকে অনেকটাই আলাদা। প্রকৃত ব্যারোক স্টাইলে নির্মিত এই মূর্তিটিতে ডেভিডকে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ অবস্থায় দেখি, যা তার আগের যুগের রেনেসাঁ স্ট্রাকচারে কখনোই দেখানো হয় নি। ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং বিভিন্ন ইহুদি স্ক্রিপচার থেকে ডেভিডের গল্প আমাদের অনেকেরই জানা। ডেভিড ছিলেন ইজরায়েলের এক রাখাল বালক। সেই সময় ফিলিস্তিনিদের আক্রমণে ইহুদিরা বিধ্বস্ত। ইহুদিদের রাজা সল পরাজয়ের দিন গুনছেন। ফিলিস্তিনি সৈন্যদলের যুদ্ধবাজ নেতা গোলিয়াথ, তার চেহারা দৈত্যাকার, যুদ্ধের শুরুতে ইহুদি সৈন্যদের একক যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানান। বাইবেল অনুযায়ী, এই গোলিয়াথের উচ্চতা ছিল নয় ফুটেরও বেশি, এবং তিনি বিভিন্ন ধরণের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। টানা চল্লিশ দিনের যুদ্ধে কোনো ইহুদি সৈন্য, এমনকি রাজা সলও গোলিয়াথের এই একক যুদ্ধের আমন্ত্রণে সাড়া দেন নি। এমন পরিস্থিতিতে ডেভিড, তখন তিনি নেহাতই এক বালক, গোলিয়াথের সাথে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসেন। বিভিন্ন অস্ত্রে সুসজ্জিত গোলিয়াথের বিপক্ষে বালক ডেভিডের একমাত্র অস্ত্র ছিল একটি গুলতি এবং সাথের ঝোলায় পাঁচটি নুড়ি পাথর। ডেভিডের ছোঁড়া গুলতির আঘাতে গোলিয়াথ মারাত্মক চোট পান। গুলতির থেকে পাথর এসে লাগে সরাসরি তার মাথার মধ্যিখানে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যথায় প্রায় অচৈতন্য গোলিয়াথের খাপ থেকে তার তরোয়াল বের করে এনে ডেভিড তার শিরচ্ছেদ করেন। ডেভিডের হাতে গোলিয়াথের কাটা মুন্ডু দেখে হতবাক ফিলিস্তিনি সৈন্যরা পিছিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। পরবর্তীকালে এই ডেভিডই সংযুক্ত ইজরায়েলের রাজা নির্বাচিত হবেন, ইহুদিদের পবিত্র আর্ক অফ্‌ দ্য কোভেনান্ট উদ্ধার করে নিয়ে আসবেন জেরুজালেম শহরে এবং তারই হাত ধরে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠবে। প্রসঙ্গত, বাইবেল অনুযায়ী যিশুখ্রিষ্ট ছিলেন এই ডেভিডেরই বংশধর। বার্নিনি প্রথাগত পথে না হেঁটে তার ডেভিডকে গড়েছেন যুদ্ধরত অবস্থায়, যখন তিনি তার হাতের হার্প (বাদ্যযন্ত্র) মাটিতে নামিয়ে রেখে গুলতি ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছেন। তার চোখে মুখে প্রতিফলিত হচ্ছে কঠিন একাগ্রতা; গুলতি ছোঁড়ার অভিঘাতে দেহ ধনুকের মত টানটান, দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে; চোখ স্থির নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। বার্নিনির বোরগেজে সিরিজের অপেক্ষাকৃত অধিক খ্যাতিমান মূর্তিগুলির তুলনায় এই মুর্তিটি উচ্চতায় একটু খাটো এবং তার মার্বেলেও সামান্য ত্রুটির আভাস রয়েছে। যদিও এটা অনস্বীকার্য যে, ডেভিডের এই রকম ব্যারোক সংস্করণ ইউরোপের শিল্প মানচিত্রে সত্যিই দুর্লভ। 

 

 

 

বার্নিনির ডেভিড 

খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, ডেভিড বাদ দিলে বার্নিনির বোরগেজে সিরিজের বাকি মূর্তিগুলির সবকটিই প্রাচীন গ্রীক ও রোমান উপকথার আশ্রয়ে নির্মিত। বার্নিনি যদিও জীবৎকালে ভ্যাটিকানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাদের নির্দেশে শহরজুড়ে তৈরি করেছেন অজস্র খ্রিশ্চান স্থাপত্য, তা সত্ত্বেও রোমান সভ্যতার প্রাচীন যে ইতিহাস, এবং পাগান কালচার - তাদের সম্পদ বিভিন্ন উপকথাগুলির উপর ছিল তার সার্বিক দুর্বলতা। এমনকি বোরগেজে সিরিজের প্রথম যে স্থাপত্য - ইনিয়াস, অ্যানকাইসিস এবং অ্যাসকানিয়াস - এই মূর্তিটিও প্রাচীন গ্রীক ও রোমান উপকথার থেকেই প্রভাবিত, এক্ষেত্রে ভার্জিলের ঈনিদ। বার্নিনি এই মূর্তিটি বানানোর কাজ শেষ করেছিলেন ১৬১৯ সালে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে; এবং সম্ভবত এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম বড় মাপের কাজ। অনেক বিশেষজ্ঞেরই ধারণা, এই মূর্তিটির নির্মাণে তার বাবা পিয়েত্রো বার্নিনি, বার্নিনিকে সহায়তা করেছিলেন। তবে এর পর থেকে বোরগেজে সিরিজের বাকি কাজগুলির সবকটিই বার্নিনির একেবারে নিজস্ব ক্রিয়েশন, সেখানে তার বাবার নির্মাণশৈলীর কোনোরকম কোনো প্রভাব পড়ে নি। স্থাপত্য নির্মাণের নিরিখে প্রথম হলেও, বোরগেজে ভিলার ক্রম অনুসারে আমরা এই মূর্তিটি দেখেছি সবার শেষে, এই সিরিজের বাকি মূর্তিগুলি দেখার পর। দেখেছি এবং মুগ্ধ হয়েছি। এই মূর্তিটি ট্রয়ের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের গল্প বলে। দেবী ভেনাসের সন্তান ইনিয়াস গ্রীকদের হাতে ট্রয়ের পতন হলে তার অশক্ত বৃদ্ধ পিতা অ্যানকাইসিস ও শিশু সন্তান অ্যাসকানিয়াসকে সাথে নিয়ে পালিয়ে আসেন সুদূর ইটালিতে। তাদের সঙ্গী হন ট্রয়ের সেই বাসিন্দারা যারা যুদ্ধ পরবর্তী ম্যাসাকারের সময়ে কোনরকমে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করতে পেরেছিলেন। হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি এই দুই মহাকাব্যের মতোই এক ঘটনাবহুল ও দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর দেশান্তরী মানুষগুলি শেষপর্যন্ত ইটালিতে পৌঁছে তাদের নতুন বাসস্থান তৈরিতে সমর্থ হয়। প্রসঙ্গত, ট্রোজানদের নেতা এই ইনিয়াসের হাতেই একদিন রোম শহরের পত্তন হবে এবং রোম হয়ে উঠবে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। বার্নিনি এখানে ইনিয়াসের দেশত্যাগের মুহূর্তটিকে ভাস্কর্যের চেহারা দিয়েছেন। ইনিয়াসের কাঁধে অশক্ত অ্যানাকাইসিস, অ্যানাকাইসিসের হাতে ধরা তার ট্রয়ের শেষ স্মৃতি - তাদের গৃহ দেবতার একটি মূর্তি। অন্যদিকে ইনিয়াসের পায়ের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে খেলনা হাতে তারই শিশু সন্তান অ্যাসকানিয়াস। বার্নিনির এই মূর্তি দিকে দিকে উদ্বাস্তু সমস্যার প্রতিভূ; ভিটে মাটি ছেড়ে যারা যুগে যুগে দেশান্তরী হয়েছে, তাদের কেউ খুঁজে পেয়েছে সাফল্য, আবার কেউ অচিরেই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায় ফুটনোট হয়ে, বার্নিনি যেন এখানে সেই তাদেরই দুর্দশার কাহিনী শুনিয়েছেন শ্বেতশুভ্র মার্বেলের স্কালপ্‌চারে। 

 

 

 

বার্নিনির ইনিয়াস, অ্যানকাইসিস এবং অ্যাসকানিয়াস

সিপিওনে বোরগেজের নির্দেশে নির্মিত বোরগেজে সিরিজের চারটি স্কালপ্‌চার সন্দেহাতীত ভাবে বার্নিনির জীবনের অন্যতম সেরা কাজ। কিন্তু এই কাজগুলি ছাড়াও বার্নিনির আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নির্মাণ বোরগেজে গ্যালারিতে সংরক্ষিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল বার্নিনির অসমাপ্ত মূর্তি - ট্রুথ আনভেলড্‌ বাই টাইম। বার্নিনি তার জীবনে মোট যে ক’জন পৃষ্ঠপোষক পেয়েছেন তাদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলেন পোপ অষ্টম আর্বান। অষ্টম আর্বানের পৃষ্ঠপোষকতায় বার্নিনি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার প্রধান আর্কিটেক্ট এবং পাপাল কোর্টের প্রধান শিল্পী হিসেবে নিযুক্ত হন। তবে ১৬৪৪ সালে অষ্টম আর্বানের মৃত্যু হলে নব-নিযুক্ত পোপ দশম ইনোসেন্ট দ্রুত বার্নিনিকে পাপাল কোর্ট থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে বার্নিনি যথেষ্ট পরিমাণ পাবলিক হিউমিলিয়েশনের সম্মুখীন হন। উপরন্তু, বার্নিনি অষ্টম আর্বানের নির্দেশে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার সামনে দুটি বেল টাওয়ার নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। সেই দুটি টাওয়ারেই ফাটল ধরা পড়ে। দশম ইনোসেন্টের নির্দেশে এই দুটি টাওয়ারকেই সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। যদিও বার্নিনি প্রথমেই অভিযোগ করেছিলেন তার পূর্বতন শিল্পীর হাতে তৈরি টাওয়ার দুটির ভিত বা ফাউন্ডেশন খুবই দুর্বল এবং তা টাওয়ার দুটির ভার বহন করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন মহলে সমালোচনায় বিদ্ধ বার্নিনি ট্রুথ আনভেলড বাই টাইম মূর্তিটির কাজ শুরু করেন ১৬৪৪ সালে। 

 

 

 

বার্নিনির ট্রুথ আনভেলড্‌ বাই টাইম 

বার্নিনির প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল তিনি সময়ের (ফাদার টাইম) একটি মূর্তি তৈরি করবেন যেটি কাপড়ের আড়াল থেকে একটি নগ্ন নারীদেহ, অর্থাৎ ট্রুথ বা সত্যকে উন্মোচন করবে। বার্নিনি নিশ্চিত ছিলেন যে একদিন সত্যিটা সামনে আসবেই এবং তিনি তার হৃত গৌরব ফিরে পাবেন। ১৬৫৫ সালে দশম ইনোসেন্ট এর মৃত্যুর পর বার্নিনি আবার ভ্যাটিকানের গুরুত্বপূর্ন প্রোজেক্টগুলির দায়িত্বে ফিরে আসেন এবং খুব দ্রুত তার পাবলিক ইমেজ পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৪৪ থেকে ১৬৫৫ এই সময়ের মধ্যে বার্নিনি শুধুমাত্র ট্রুথের মূর্তিটুকুর কাজই সমাপ্ত করতে পেরেছিলেন। মূর্তিটির বাকি কাজ অসমাপ্তই থেকে যায়। তারপরেও বিভিন্ন শিল্প সমালোচকদের মতে ট্রুথ আনভেলড বাই টাইম বার্নিনির জীবনের অন্যতম সেরা একটি সৃষ্টি। বস্তুত, আমার সাধারণ চোখে যা ধরা পড়েছে তাতেই মনে হয়েছে ট্রুথ অর্থাৎ নগ্ন নারীমূর্তিটির কাজ এখানে এতটাই নিখুঁত যে সে বুঝি যেকোনো মুহূর্তে চোখ মেলে তার পাথরের উপরে হেলে থাকা পজিশন ছেড়ে উঠে বসতে পারে। সাথে বিস্ময়ও জাগে, এই মূর্তিটির কাজ যদি সমাপ্ত হত না জানি কোন অপূর্ব ভাস্কর্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত এইখানে। 

বার্নিনির প্রথম স্কালপ্‌চার - দ্য গোট অ্যামালথিয়া উইথ দ্য ইনফ্যান্ট জুপিটার অ্যান্ড আ ফন

এর বাইরেও দেখলাম গ্যালারির দোতলায় ইতালিয় চিত্রকরদের বিভিন্ন ছবির পাশাপাশি বার্নিনির বেশ কিছু ছোট মাপের কাজও সেখানে সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার মধ্যে একটি (প্রস্থে মূর্তিটি দেড় কি দুই হাতের মত চওড়া), দ্য গোট অ্যামালথিয়া উইথ দ্য ইনফ্যান্ট জুপিটার অ্যান্ড আ ফন, সম্ভবত বালক বার্নিনির জীবনের প্রথম কাজ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বার্নিনি যখন এই মূর্তিটি নির্মাণ করেন তার বয়স তখন খুব বেশি হলে বড়জোর দশ কি বারো। আবারও সেই গ্রীক ও রোমান মিথোলজির গল্প অবলম্বনে (এখানে, দেবতাদের রাজা জুপিটারের জন্মবৃত্তান্ত) এই মূর্তিটি নির্মিত হয়েছে। তবে শিল্পসম্ভারের এই ঘরটিতে বার্নিনির অল্প বয়সের কাজ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার কিছু বেশি বয়সেরও কাজ। বার্নিনি যে অল্প কিছুদিন প্যারিসে ছিলেন, সেই সময় তিনি ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইসের জন্য একটি ঘোড়ায় চড়া (ইকিউয়েস্ট্রিয়ান) স্ট্যাচুর ডিজাইন করেছিলেন। পরে মূর্তিটি তৈরি করা হলেও সেটি যখন রোম থেকে প্যারিসে এসে পৌঁছায় চতুর্দশ লুইসের তা একেবারেই মনঃপুত হয় নি এবং তার নির্দেশেই মূর্তিটিকে রিমডেল করে অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। এখানে বার্নিনির বানানো সেই প্রথম মূর্তিটিরই একটি প্রোটোটাইপ সংরক্ষিত হয়েছে; এই প্রোটোটাইপটিও বার্নিনিরই বানানো। তবে এক নজরে দেখলেই বোঝা যায় সুদৃশ্য স্ট্যাচুটি আর যাই হোক একেবারেই বার্নিনির নিজস্ব ঘরানায় তৈরি নয়, তার উপর ফ্রেঞ্চ প্রভাব যথেষ্ট। আর ঘরানার কথাই যদি বলি, জ্যাক এখানে আরো একটি বাস্টের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কালো প্যানেলের উপর রক্ষিত সাদা মার্বেলে সিপিওনে বোরগেজের আবক্ষ মূর্তি - তার মৃত্যুর পর বার্নিনির শ্রদ্ধার্ঘ্য। বার্নিনি কিন্তু তার প্রথম প্যাট্রনকে কোনদিনই ভুলতে পারেন নি। এই ভাস্কর্যটি তার সেই প্রণতির মূর্তমান প্রতীক, তার প্রথম পৃষ্ঠপোষকের প্রতি তার শেষ সম্মান। 

বার্নিনির তৈরি কার্ডিনাল সিপিওনে বোরগেজের আবক্ষ মূর্তি 

বোরগেজে গ্যালারি সম্বন্ধে কিছু লিখতে গেলে বার্নিনিকে উহ্য রেখে সে লেখা বোধহয় কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে শুধুই বার্নিনি নয়, বোরগেজে গ্যালারিতে অন্যান্য আরো অনেক শিল্পীর ভাস্কর্যই সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, গ্যালারির ভাস্কর্যের মোট কালেকশনের অধিকাংশই কিন্তু অ্যান্টিক পিস, গ্রীক বা রোমান ধ্বংসস্তূপ থেকে সংগৃহীত প্রাচীন মূর্তি ও ভাস্কর্য, যার কিছু আমরা ইতিমধ্যেই ভিলায় ঢোকার সময় বোরগেজে গার্ডেনে দেখেছি। আবার কিছু হল অরিজিনাল পিসগুলির অনুকরণে তৈরি করা অন্য কোনো ভাস্করের মূর্তি। এইসব মূর্তির মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত যে মূর্তিটি, বোরগেজে হারমাফ্রোডিটাস সেটিকে নেপোলিয়ান প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে উঠিয়ে নিয়ে গেছিলেন। তবে তার একটি কপি এখনো বোরগেজে গ্যালারিতে বিদ্যমান। লুভ্যরের কপিটি অবশ্য একটু আলাদা, তার অন্যরকম একটি গুরুত্বও আছে। এই কপিটিতে হারমাফ্রোডিটাসের নিচের মার্বেলের বিছানাটি বার্নিনি নিজের উদ্যোগে তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং বার্নিনির অন্যান্য কাজের মত এই বিছানাটিও এতটাই রিয়েলিস্টিক যে দেখে মনে হয় হারমাফ্রোডিটাস সত্যিই বুঝি এই বিছানার উপর শুয়ে রয়েছেন। বোরগেজে পরিবারের ইজিপ্ট থেকে সংগৃহীত বেশ কিছু নমুনাও গ্যালারির নীচের তলার একটি বিশেষ ঘরে সাজিয়ে রাখা আছে। এর মধ্যে আছে যেমন কিছু মূর্তি (স্ফিংস্‌, বা মিশরীয় দেবতাদের), আবার তেমনি আছে বেশ কিছু প্রাচীন মোজাইক। বোরগেজে এস্টেট থেকে সংগৃহীত গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধের মোজাইকগুলি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তবে মোজাইকগুলি মেঝেতে বসানো থাকায় এবং সংলগ্ন এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণ মার্কিং না থাকায় এদের মধ্যে কোনগুলি গুরুত্বপূর্ণ, আর কোনগুলি নয় তা বোঝা বেশ দুষ্কর। প্রাচীন আর একটি মূর্তির কপিও এখানে বেশ নজরকাড়া। শায়িত লিডাকে আক্রমণ করছে একটি রাজকীয় চেহারার রাজহাঁস। আবার এই মূর্তিটির উল্টোদিকেই রয়েছে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে অথবা উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে বানানো আন্তোনিও কানোভার বিখ্যাত মূর্তি ভেনাস ভিট্রিক্স। এই অর্ধনগ্ন মূর্তিটি রোমের দেবী ভেনাসকে রিপ্রেসেন্ট করলেও আসলে এটি ক্যামিলো বোরগেজের স্ত্রী, নেপোলিয়ান বোনাপার্টের বোন পাওলিন বোনাপার্টের চেহারার আদলে রচিত। 

পাওলিন বোনাপার্টের আদলে নির্মিত আন্তোনিও কানোভার ভেনাস ভিট্রিক্স

বোরগেজে গ্যালারির প্রতিটি ঘরই অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। আর তার এই নান্দনিকতা শুধুমাত্র সংগৃহীত ভাস্কর্য বা চিত্রের সৌন্দর্য্যে অথবা তাদের যুগপৎ ঐতিহাসিক গুরুত্বে সীমাবদ্ধ নয়। এই গ্যালারির প্রতিটি ঘরই উপর থেকে নীচ পর্যন্ত অলঙ্কৃত, অলঙ্করণ ছড়িয়ে আছে ঘরের সমস্ত দেওয়ালে এবং কোণে। এমনকি মেঝে এবং ছাদও কিন্তু বাদ যায় নি। ফ্রেসকো পদ্ধতি অবলম্বন করে লাল, নীল, কিংবা সোনালি, ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের - যীশুর জীবন নির্ভর এবং কিছু ক্ষেত্রে রোমান উপকথা নির্ভর ছবি আঁকা রয়েছে গ্যালারির ছাদে, দরজার উপর তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন রিলিফ আর্ট - স্বর্গের অ্যাঞ্জেল দাঁড়িয়ে আছেন সেন্ট্রি হয়ে। মেঝেতে অনেক জায়গাতেই মোজাইক। তাদের ঔজ্জ্বল্য এমনই যে সহজে বিশ্বাস হবে না, এগুলি প্রায় হাজার কি দু-হাজার বছরের পুরানো কাজ। বরং মনে হতেই পারে কোনো নবীন শিল্পী বুঝি নতুন করে ঘরের মেঝের অলঙ্করণ করেছেন। তারই মধ্যে জায়গায় জায়গায় বসানো জানলাগুলি গ্যালারির ঘরগুলিকে প্রাকৃতিক আলোতে উজ্জ্বল করে রেখেছে। এর মধ্যে ইজপ্সিয়ান ঘরের উলটো দিকের জানলাগুলি উল্লেখযোগ্য। এই জানলার ওপারেই রয়েছে বোরগেজে বাগানের পাঁচিল ঘেরা একটি অংশ, সিক্রেট গার্ডেন। আর্টের প্যাট্রনদের লোকচক্ষুর আড়ালে বাগানের সবুজে নিভৃতে সময় কাটানোর জায়গা। মূল বাগানের মত এই বাগানটিও বিভিন্ন ফলিয়েজ এবং ভাস্কর্যে সজ্জিত। 

বোরগেজে গ্যালারির নীচের তলার প্রাণপুরুষ যদি হন বার্নিনি, তাহলে তার উপর তলার নিশ্চিত ভাবেই কারাভাজিও। বিখ্যাত এই চিত্রশিল্পীর বিতর্কিত জীবনের কিছু ঘটনা আগেই উল্লেখ করেছি। উল্লেখ করেছি কারাভাজিও কেন নিজেই তার বেশ কিছু ছবি সিপিওনে বোরগেজের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গ্যালারির দোতলার মূল ঘরে কারাভাজিওর যে ছবিটি প্রথম আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সেটি হল - ডেভিড উইথ দ্য হেড অফ গোলিয়াথ। জ্যাকের বর্ণনা অনুসারে কারাভাজিও ১৬০৯ কি ১৬১০ সালে চিত্রিত ছবিটি কার্ডিনাল সিপিওনে বোরগেজেকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন এই আশায়, যে তিনি হয়তো তাকে তার কাঙ্খিত রয়্যাল পারডন এনে দিতে পারবেন। ডেভিড উইথ দ্য হেড অফ গোলিয়াথ কারাভাজিওর অন্যতম এক বিতর্কিত ছবি। তার মূল কারণ, কারাভাজিও এখানে বালক ডেভিডের হাতে গোলিয়াথের যে কাটা মুন্ডুটির ছবি এঁকেছেন সেটা চিত্রিত হয়েছে তার নিজের মুখাবয়ব অবলম্বনে। শুধু তাই নয়, গোলিয়াথকে হত্যা করে ডেভিড এখানে উৎফুল্ল নয়, বরং তার দৃষ্টিতে মিশে আছে মমতা এবং মৃতের প্রতি সহমর্মিতা। কারাভাজিও তার জীবনের শেষের কয়েক বছর প্রচন্ড মৃত্যুভয়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল ভ্যাটিকানের নির্দেশে যেকোনো সময় কোনো গুপ্ত হত্যাকারী এসে তার শিরচ্ছেদ করে নিয়ে যেতে পারেন। কারাভাজিওর এই বিপুল উদ্বেগই চিত্রায়িত হয়েছে এখানে। 

 

কারাভাজিওর ডেভিড উইথ দ্য হেড অফ গোলিয়াথ (গোলিয়াথের মুখ কারাভাজিওর নিজের মুখের আদলে চিত্রিত)

বিতর্কের দ্বিতীয় কারণ অবশ্য ডেভিডের চিত্রায়ণ। এই ছবিতে এটা মোটেও স্পষ্ট নয়, কারাভাজিও এখানে কাকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কারাভাজিও তার মডেলের পরিচয় হিসেবে লিখেছেন ‘হিস ওন লিটিল কারাভাজিও’। এখন অনেকেরই ধারণা এই ছবিটি তার বালক বেলার চিত্ররূপ। তাহলে যা দাঁড়ায় তা হল এই ছবিতে কারাভাজিও নিজেই নিজেকে ধ্বংস করছেন, অর্থাৎ নিজেকে দোষারোপ করছেন তার ভীষণ পরিণতির জন্য। মতান্তরে, অনেক গবেষক উল্লেখ করেছেন কারাভাজিও ছিলেন উভগামী এবং সেক্ষেত্রে এই বালকটি ছিলেন খুব সম্ভবত তার প্রেমিক এবং সহকারী। আর তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ছবিটি আবার দ্বিতীয় একটি মাত্রা পায়। ডেভিডের মমতার কারণ হিসেবে উঠে আসে গোলিয়াথের প্রতি তার অনুরাগ, এবং তার এই পরিণতির জন্য কিছু মাত্রায় আক্ষেপ। কারাভাজিও ছবিটি এঁকেছিলেন তার প্রসিদ্ধ ব্যারোক স্টাইলে। বস্তুত চিত্রশিল্পে এই শৈলী প্রয়োগের ব্যাপারে তিনিই ছিলেন প্রথম পথিকৃৎ। শুধুমাত্র ডেভিড উইথ দ্য হেড অফ গোলিয়াথই নয়, তার বাকি ছবিগুলির মূল্যায়ণ করলেও দেখা যাবে সেগুলির রঙের ব্যবহার অত্যন্ত বাস্তবধর্মী, ছবির চরিত্রগুলিকে দেখলে মনে হবে তারা রক্ত মাংসের মানুষ এবং বাস্তবের জগতে বিচরণ করেন। এছাড়াও কারাভাজিওর ছবিতে টেনেব্রিজমের বহুল ব্যবহারও লক্ষণীয়। এই টেনেব্রিজম হচ্ছে অন্ধকার ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করে ছবির মূল চরিত্রগুলিকে আলোর ফোকাসে নিয়ে আসার পদ্ধতি। অনেকটা থিয়েটারের স্পটলাইটের মত কনসেপ্ট। ছবির প্রেক্ষাপটে আলো-আঁধারির এই যুগলবন্দী ছবিগুলিকে যেন এক্ষেত্রে আরো রহস্যময়, আরো মিস্টিরিয়াস করে তোলে। 

 

কারাভাজিওর ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যানে

বোরগেজে গ্যালারিতে সংরক্ষিত কারাভাজিওর আরো একটি বিতর্কিত ছবি হল তার, ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যানে। প্রথম থেকেই এই ছবিটিকে ঘিরে এত রকম বিতর্কের সৃষ্টি হয় যে ছবিটির চিত্রায়ন শেষ হওয়ার মাত্র দু মাসের মধ্যেই সেটিকে বিক্রি করে দেওয়া হয় সিপিওনে বোরগেজের কাছে। ছবিটিতে কারাভাজিও ইনফ্যান্ট যীশুকে দেখিয়েছেন সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। ছবিটিতে কারাভাজিও ইনফ্যান্ট যীশুকে দেখিয়েছেন সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। এমনকি তার মা ভার্জিন মেরিও এই ছবিতে আংশিক ভাবে নগ্ন। শিশু যীশু এখানে তার পা দিয়ে একটি সাপের মুখ চেপে ধরেছেন। সেন্ট অ্যানে এবং মেরি আতঙ্কিত হওয়ার বদলে মূলত তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন তার এই কাজে। প্রসঙ্গত, যীশু ও মেরির এই যে নগ্নতা তা ভ্যাটিকান খুব ভালোভাবে মেনে নেয় নি। উপরন্তু যে মহিলাকে কারাভাজিও তার মেরির জন্য মডেল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনিও ছিলেন চার্চের চোখে একজন প্রস্টিটিউট। তার সাথে ছবিতে মেরির মুখের মিল থাকায় তা চার্চের ঘোরতর আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারাভাজিও নিজেও একই সময়ে তোমাসিনির হত্যা সংক্রান্ত জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন। সুতরাং চার্চ এই ছবিটি নিজেদের কাছে রেখে আর বিতর্ক বাড়াতে চায় নি। ১৬০৫ থেকে ১৬০৬ - কারাভাজিওর জীবনের সবথেকে বিতর্কিত ও ঘটনাবহুল এক অধ্যায়। এই সময় যেমন তার ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক ট্র্যাজেডি বয়ে আনে, আবার ঘটনাচক্রে এই সময়ই তার আঁকা ছবিগুলিও তাদের বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই সময়কালে আঁকা কারাভাজিওর দুটি বিখ্যাত ছবি - জন দ্য ব্যাপটিস্ট এবং সেন্ট জেরোম রাইটিং পরবর্তীকালে সিপিওনে বোরগেজের নিজস্ব সংগ্রহের অংশ হয়। যদিও, সিপিওনে এই ছবিদুটি কিভাবে এবং কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন তা আজও আমাদের অজানা। জন দ্য ব্যাপটিস্ট ছবিটিতে দেখা যায় একটি বালককে (সেন্ট জন), সে সম্ভবত কোনো পাথরে হেলান দিয়ে বসে, যদিও অন্ধকার ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে আমাদের কাছে তা সুস্পষ্ট হয় না। এই বালকটির শিশুসুলভ দেহ গাঢ় লাল রঙের কাপড়ে অংশত ঢাকা। তার চোখে মুখে স্নিগ্ধ বিষণ্ণতা এবং যেন সে কোনো গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন। এই জন ছিলেন যীশুর কাজিন অর্থাৎ তুতো ভাই এবং তিনিই পরে জর্ডনে যীশুর ব্যাপটিজমের কাজটি সুসম্পন্ন করবেন। দ্বিতীয় ছবি, সেন্ট জেরোম রাইটিংয়ে আমরা বৃদ্ধ জেরোমকে দেখি রুগ্ন শরীরে তার টেবিলে বসে ডায়েরি লিখতে। বোরগেজের সংগ্রহের এই দুটি ছবিই কারাভাজিওর ব্যারোক চিত্রের অন্যতম সেরা নমুনা এবং এই গ্যালারির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ গুলির মধ্যে অন্যতম। 

                                                           

কারাভাজিওর সেন্ট জেরোম রাইটিং 

সিপিওনে বোরগেজে তার জীবৎকালে অজস্র আর্ট ফর্ম সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু তাই বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, যে এই সমস্ত শিল্প সামগ্রী সংগৃহীত হয়েছিল সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে। সিপিওনে যেমন তার পছন্দের শিল্পীদের চরম পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, আবার তেমনি যেখানে প্রয়োজন হয়েছে নিজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য তিনি ছল চাতুরির আশ্রয় নিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। পোপ পঞ্চম পলের সাহায্য নিয়ে সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগে সিপিওনে রোমের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জিউসেপ্পে সেসারিকে গ্রেপ্তার করান এবং তার সংগ্রহের মোট একশ ছয়টি চিত্র বাজেয়াপ্ত করে নেন। বাজেয়াপ্ত করা এই ছবিগুলির মধ্যেই ছিল কারাভাজিওর কেরিয়ারের একদম প্রথম দিকের (১৫৯০ সালের কাছাকাছি সময়ে চিত্রিত) তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি - বয় উইথ আ বাস্কেট অফ ফ্রুট, বয় পিলিং ফ্রুট, এবং ইয়াং সিক বাকাস। প্রসঙ্গত, মিলান থেকে রোমে চলে আসার পর জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে কারাভাজিও বেশ কিছুদিন এই সেসারির অধীনেই অলঙ্করণের কাজ করেছিলেন এবং খুব সম্ভবত সেই সময়েই এই ছবিগুলি সেসারির সংগ্রহে আসে। এর মধ্যে বয় পিলিং ফ্রুট বাদ দিলে কারাভাজিওর বাকি ছবি দুটি এখনো এই বোরগেজে গ্যালারিতেই অবস্থান করছে। তবে যারা এখানে কারাভাজিওর প্রখ্যাত ব্যারোক স্টাইলের আঁকা খুঁজবেন তারা হয়ত একটু হতাশই হবেন। কারাভাজিও এই ছবিদুটি এঁকেছিলেন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক কারণে এবং পরবর্তীতে তার সিগনেচার টেনেব্রিজম এই ছবিতে প্রায় অনুপস্থিত। 

 

 

 

 

 

কারাভাজিওর বয় উইথ আ বাস্কেট অফ ফ্রুট

বোরগেজে গ্যালারির উপরের তলায় কারাভাজিওকে বাদ দিয়েও আরো বহু বিখ্যাত ইটালিয়ান চিত্রকরের ছবি সংগৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কালেকশন সম্ভবত রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত চিত্রকর রাফায়েল এবং টিশানের। ইটালিয়ান হাই রেনেসাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী রাফায়েলের জন্ম হয়েছিল ১৪৮৩ সালে ইটালির আরবিনো শহরে। রাফায়েলের বাবা ছিলেন আরবিনোর রাজসভার চিত্রকর এবং তার মারফতই রাফায়েল চিত্রশিল্পের প্রতি ক্রমশ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাফায়েলের কাজ ফ্লোরেন্স, জেনোয়া সহ ইটালির বিভিন্ন শহরে সমাদৃত হতে থাকে। ১৫০৮ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে রাফায়েল পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের আমন্ত্রণে আরবিনো ছেড়ে পাকাপাকিভাবে রোমে চলে আসেন এবং সেখানে পৌঁছে সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকার প্রধান স্থপতি বা আর্কিটেক্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাফায়েলের তত্বাবধানেই ব্যাসিলিকা সংলগ্ন কয়েকটি ঘরের সংস্কার এবং অলঙ্করণের কাজ সম্পূর্ণ হয়। ভ্যাটিকানের এই ঘরগুলি বর্তমানে রাফায়েল রুম নামে পরিচিত। রোমে রাফায়েল তার জীবনের শেষ বারো বছর সময় কাটিয়েছিলেন। ভ্যাটিকানের কাজ এবং অন্যদিকে তার বিভিন্ন রোমান্টিক অ্যাফেয়ারের ক্লান্তি জনিত কারণে ১৫২০ সালে গুড ফ্রাইডের দিন মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে রাফায়েলের মৃত্যু হয়। বলাই বাহুল্য তার এই অতি অল্প বয়সে মৃত্যু রেনেসাঁ আর্টের পক্ষে এক অপূরণীয় ক্ষতি। মৃত্যুর পর রাফায়েলকে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হয় রোমের প্যানথিওনে। 

              

রাফায়েলের দ্য ডিপোজিসন 

বোরগেজে গ্যালারিতে সংগৃহীত রাফায়েলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, দ্য ডিপোজিসন। ১৫০০ সালে পেরুজিয়ার ব্যাগলোনি পরিবারের অন্তর্দ্বন্দে সেই পরিবারেরই এক তরুণ সদস্য গ্রিফোনেটো ব্যাগলোনির মৃত্যু হয়েছিল। গ্রিফোনেটোর মা তার ছেলের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে রাফায়েলকে তাদের ব্যক্তিগত চ্যাপেলের জন্য একটি অল্টারপিস বানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। রাফায়েলের চিত্রিত এই বিখ্যাত অল্টারপিসটি প্রায় এক শতাব্দীকাল তাদের এই চ্যাপেলেই সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু ১৬০৮ সালে সিপিওনে বোরগেজের আর্ট কালেক্টরের দল চ্যাপেলটি লুট করে ছবিটিকে রোমে নিয়ে আসে। এবং তার পর থেকে ছবিটি স্থান পায় সিপিওনের বোরগেজে ভিলায়। পরবর্তীকালে উনিশ শতকের শুরুতে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ক্যামিলো বোরগেজের কাছ থেকে এই ছবিটি প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন; যদিও পরে আবার ১৮১৫ সালে সেটিকে বোরগেজে গ্যালারিতেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে ছবিটির আর কোনো স্থান পরিবর্তন ঘটে নি। রাফায়েল তার এই ছবিটিতে যীশুর মৃত্যুর পর তার পরিবার ও নিকট বন্ধুদের বিলাপের চিত্র এঁকেছেন। ছবিটিতে দৃশ্যায়িত হয়েছে কিভাবে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে যীশুর মৃতদেহটিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সমাধির উদ্দেশ্যে, আর তাকে ঘিরে আছেন যীশুর প্রিয় বন্ধুরা এবং স্বল্প সংখ্যক আত্মীয় পরিজন। হৃদয়বিদারক এই দৃশ্যের অভিঘাতে যীশুর মা মেরি অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন, তার মাথা হেলে পড়েছে শিষ্যাদের কোলে। অন্যদিকে শেষ যাত্রায় মেরি ম্যাগডালেন হাত ধরে আছেন তার প্রিয় বন্ধুর। যীশুর বাকি যেসব বন্ধুরা উপস্থিত, তাদের কেউ এখানে শ্রদ্ধাবনত, কেউ কাঁদছেন, কেউ ছুঁয়ে আছেন তার মৃত শরীর। রাফায়েল এই ছবিটির চিত্রায়নের জন্য লাল, নীল, হলুদ, এবং সবুজ ইত্যাদি বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করেছেন। প্রসঙ্গত এই ধরণের রঙের ব্যবহার কিন্তু রেনেসাঁ আর্টের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্য ডিপোজিসন ছাড়াও রাফায়েলের অন্য যে ছবিটি এখনো বোরগেজে গ্যালারিতে সংগৃহীত রয়েছে সেটি হল - লেডি উইথ আ ইউনিকর্ন। এই ছবিটি চিত্রিত হয়েছিল ১৫০৬ সালে। রাফায়েলের এই ছবিটির অনুপ্রেরণা ছিল লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত শিল্পকর্ম মোনালিসা। বস্তুত মোনালিসা এবং লেডি উইথ আ ইউনিকর্ন এই ছবিদুটির সেমব্লেন্স কিন্তু মারাত্মক। তবে যদি রাফায়েলের বাকি কাজগুলির সাথে তার এই ছবিটির তুলনা করি হয়তো এটিকে তার জীবনের অন্যতম সেরা কাজগুলির মধ্যে স্থান দেওয়া যাবে না।

 

 

 

 

   

 

 

 

 

 

 


 

                                       

রাফায়েলের লেডি উইথ আ ইউনিকর্ন

কারাভাজিও ও রাফায়েলের বিখ্যাত ছবিগুলোকে বাদ রাখলে বোরগেজে গ্যালারিতে আর যে ছবিগুলি স্থান পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল ভেনিসের চিত্রকর টিশানের স্যাক্রেড ও প্রোফেন লাভ। ১৫১৪ সালে চিত্রিত এই ছবিটির বিশেষত্ব হল এখানে একই মডেলকে ব্যবহার করে ছবির প্রধান দুটি চরিত্রেরই অবতারণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ছবির বাঁদিকের চরিত্রটি সম্পূর্ণ ভাবে বস্ত্র পরিহিতা, সেখানে ভেনাসের আদলে চিত্রিত ডানদিকের চরিত্রটি আংশিক ভাবে বস্ত্রহীন, অর্ধনগ্ন। বোঝাই যাচ্ছে, টিশান এখানে স্যাক্রেড বলতে বাঁদিকের নারী চরিত্রটিরই উল্লেখ করেছেন; যদিও এই ছবির আইকোনোগ্রাফি নিয়ে এখনো নানা রকম বিতর্ক এবং প্রশ্ন রয়েছে। বস্তুত, ডানদিকের চরিত্রটি যদি ভেনাসের আদলেই রচিত হয় তাকে কি সত্যিই প্রোফেন বলা চলে? এই ছবিটি ছাড়াও গ্যালারিতে টিশান, বাসানো, ডোমেনিচিনো, ডোসি, কোরেজিও, বেলিনি, পিটার পল রুবেনস সহ আরো বিভিন্ন চিত্রকরের ছবি আমরা দেখেছি। এদের মধ্যে কারাভাজিও ও রাফায়েলের কথা আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ, এই এত সমস্ত নক্ষত্রের ভিড়ে তাদের কাজগুলি সত্যিই সূর্যের সমান, সহজেই তারা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। তার জন্য কোনো গাইডিং লাইটের দরকার হয় না। প্রসঙ্গত প্রায় চারশো পাঁচশ বছরের পুরোনো ছবিগুলি এখনো কী উজ্জ্বল। কত সহজেই তাদের এই যুগের কোনো শিল্পীর আঁকা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। দুঃখ হয় আমরা আমাদের শিল্প সংস্কৃতিকে এই ভাবে কেন সংরক্ষিত রাখতে পারি না। আজ থেকে একশ বছর পর কি কেউ কোনোদিন যামিনী রায় বা রামকিঙ্করের কাজ গুলো আদৌ খুঁজে দেখবে? কোথায় খুঁজে পাবে তাদের? আদৌ পাবে তো? কী দশা হবে তাদের এই অজস্র শিল্পকর্মের? 

টিশানের স্যাক্রেড অ্যান্ড প্রোফেন লাভ 

 

বোরগেজে গ্যালারি নিয়ে কিছু লেখার সমস্যা হচ্ছে সেটা শেষ পর্যন্ত ভ্রমণকাহিনীর থেকেও ইতিহাসের বই বেশি হয়ে যায়। এই লেখায় যতটুকু যা তথ্য দিলাম তার অধিকাংশই জ্যাক ভ্রমণ কালে আমাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন। আর বাকিটুকু, বিশেষত সাল ও তারিখ আমাকে পড়াশোনা করে বের করে নিতে হয়েছে। পরিভ্রমণের শেষে আমরা এসে উপস্থিত হলাম বোরগেজে বাগানের সামনে। এখানেই জ্যাক আমাদের বিদায় জানালেন। জ্যাকের জন্য কোনো ধন্যবাদই যথেষ্ট নয়। তার মত শিক্ষিত ও মার্জিত গাইড শুধু আমাদের দেশে কেন এমনকি বিদেশ সফরেও পাওয়া বেশ দুষ্কর। আমাদের অনুসন্ধিৎসু মনের তৃপ্তি ঘটানো তো আর সহজ কাজ নয়। দুঘন্টার এই ইতিহাস সফরের জের বুকে নিয়ে, এবং তারপর অল্প কিছু সময় বাগানে অতিবাহিত করে আমরা ঘরের পথ ধরলাম। ততক্ষণে আড়াইটা বেজে গেছে। পেট চোঁ চোঁ করছে। ঘুমের থেকেও এখন বেশি দরকার দুপুরের খাবার। 

 

বোরগেজে গার্ডেন থেকে বোরগেজে ভিলা 

 

*****

ক্রমশ 

ছবি - রাজর্ষি ঘোষ 

 

0 Comments
Leave a reply