সময় ও স্থানের বন্দী

লিখেছেন:প্রবীর রুদ্র

 

সময়ের বন্দী

যুগের ঊষালগ্ন থেকে মানুষ চিরকালই কালের বন্দী। সময় আমাদের বিন্দুমাত্র বিরতি না দিয়ে নিঃশর্তভাবে, একমুখী এবং সর্বোপরি আগ্রহহীনভাবে প্রবাহিত হয়েছে। সম্ভবত এটি ধারাবাহিকতার সেরা প্রাকৃতিক উদাহরণ। 

আলবার্ট আইনস্টাইনের (Albert Einstein) মতো মহান ব্যক্তিরা সময়ের প্রকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন এবং এর বুনন বোঝার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, সময়ের রহস্য আজ পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। সময়ের প্রবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে না পেরে এবং তার নিজস্ব সুবিধার জন্য সময়কে ব্যবহার করতে না পেরে মানুষ তার ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। 

মানুষের পক্ষে সময়ের সারণী বেয়ে সামনে বা পেছনে যাওয়া সম্ভব নয়। তাকে যেভাবে সময় চালনা করে সেভাবেই তাকে চলতে হয়। এক মুহূর্ত কেটে গেলে তা চিরতরে হারিয়ে যাবে সময়ের অসীমতায়। আমরা সকলেই আমাদের শৈশবের দিনগুলির জন্য আকাঙ্ক্ষা করি এবং আশা করি যে সেই দিনগুলিকে জীবনে আরও একবার যদি পুনরুদ্ধার করা যেত তাহলে দুর্দান্ত হত।

একইভাবে সময়ের প্রাকৃতিক প্রবাহের দ্বারা ভবিষ্যতের যে বিন্দু উপস্থিত হয়নি তাকে জীবদ্দশায় উপলব্ধি করা অসম্ভব। অসহায় ভাবে আমরা সময়ের বন্দী। মনে হয় যেন এক অদৃশ্য কারাগার আমাদের শক্ত করে ধরে রেখেছে এবং আমাদের বেরোনোর কোন ​​পথ নেই। মানুষের উপর সময়ের এই বিজয় এতই ব্যাপক যে তাকে জীবন-মৃত্যুর দুষ্টচক্রের মধ্যে থাকতে বাধ্য করেছে। মোক্ষলাভ মরীচিকার হাতছানি মাত্র।

বহুল প্রতীক্ষিত টাইম মেশিন (একটি যন্ত্র যা সময়ে ভ্রমণ করতে সক্ষম করে) (Time Machine) আপাতত এবং সম্ভবত আগামী বহু যুগের জন্য কল্পকাহিনীর একটি অধ্যায় ব্যতীত আর কিছুই নয়। সময় সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এতই সীমাবদ্ধ যে এমনকি একটি টাইম মেশিনের চিন্তাও সম্পূর্ণ বিলাসিতা বলে মনে হয়। অজ্ঞতা আমাদের এমন এক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে যে সময় আমাদের কাছে মায়া মনে হয় এবং সেই মায়াজালে আমরা সকলে বেষ্টিত।

 

স্থানেও কি আমরা বন্দী  !!

আমরা বেশিরভাগই মনে করি যে আমরা সীমাহীন স্বাধীনতা নিয়ে স্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম। প্রকৃতপক্ষে আমরা স্বাধীনভাবে সামনে এবং পিছনে, উপরে এবং নীচে, বাম এবং ডানদিকে চলাফেরা করতে পারি। এটি আমাদের স্থানের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক গতির অনুমতি দেয়। সেই অর্থে আমরা স্থানিকভাবে চলাফেরা করতে সত্যিই স্বাধীন। কিন্তু এখানে আমরা স্থানের মাধ্যমে গতির একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করব। 

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে স্থানিকভাবে আমাদের চলাফেরা আনেকটাই স্বাধীন যদি আমরা সেটা সময়ের সাথে তুলনা করি। এখন আমরা প্রশ্ন করি, আমরা কতদূর এগোতে পারি বা এখনো পর্যন্ত আমরা কতদূর এগিয়েছি?

আমরা জানি যে আমরা চাঁদে ভ্রমণ করেছি যার দূরত্ব পৃথিবী থেকে 384400 কিলোমিটার। হতে পারে আমরা অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে যাবো যার গড় দূরত্ব আমাদের থেকে 225 মিলিয়ন কিলোমিটার। এখানেই শেষ!!

আমাদের নিকটতম তারকা (Star) কোনটি?

আমরা অনেকেই জানি যে এটি হল প্রক্সিমা সেন্টোরি (Proxima Centauri)। এটি আলফা সেন্টোরি ট্রিপল স্টার সিস্টেমে (Alpha Centauri triple star system) অবস্থিত একটি ছোট এবং কম ভরের তারা। এটি আমাদের থেকে 4.2 আলোকবর্ষ (light years) দূরে অবস্থিত। এখন 1 আলোকবর্ষ হল সেই দূরত্ব যা আলো এক বছরে প্রায় 300000 কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডের প্রচণ্ড গতিতে ভ্রমণ করে। এখন আমরা যদি হিসাব করি তাহলে দেখতে পাব যে,

1 আলোকবর্ষ = 9461,000,000,000 কিলোমিটার।

 

আমাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি

নাসা পার্কার সোলার প্রোব (Nasa Parker Solar Probe) এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা দ্রুততম মানব-নির্মিত বস্তু। 27 সেপ্টেম্বর, 2023 মহাকাশযানটি সূর্যের পৃষ্ঠের কাছাকাছি যাওয়ার সময় 394,736 মাইল প্রতি ঘন্টা (635,266 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা) গতি ছুয়েছিল। এখানে মনে রাখা দরকার যে শুক্রের (Venus) কাছাকাছি ফ্লাইবাই থেকে সামান্য মাধ্যাকর্ষণের (gravity) সহায়তা এই মহাকাশযানটি পেয়েছিল। 

নাসা জুনো প্রোব (Nasa Juno Probe) মানুষের দ্বারা নির্মিত আরেকটা অন্যতম দ্রুত মহাকাশযান। এটি জুলাই, 2016-এ বৃহস্পতির (Jupiter) চারপাশে একটি কক্ষপথে স্খলিত হয়েছিল। এটি সংক্ষিপ্তভাবে প্রায় 2,66,000 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা (1,65,000 মাইল প্রতি ঘন্টা) গতি কে স্পর্শ করেছিল। অবশ্যই সূর্যের নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ এখানেও একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

হেলিওস-I (Helios-I) এবং হেলিওস –II (Helios- II), যা 1970 এর দশকে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল, তারা প্রায় 2,41,000 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা (1,50,000 মাইল প্রতি ঘন্টা) গতিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল।

আমাদের তৈরি করা অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির মহাকাশযান হল ডিপ স্পেস (Deep Space), নিউ হরাইজন (New Horizon), ভয়েজার (Voyager) ইত্যাদি। এগুলোর সর্বোচ্চ গতি প্রায় 60,000 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা।

 

সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন

এমনকি যদি আমরা আমাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মহাকাশযান (2024 সালে পার্কার সোলার প্রোব) দ্বারা অর্জিত সর্বোচ্চ গতির কথা বিবেচনা করি তবে ক্রমাগত মাধ্যাকর্ষণের (gravity assist) সাহায্য নিয়ে আমাদের নিকটতম নক্ষত্রে (প্রক্সিমা সেন্টোরি) পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় 6555 বছর। মানুষের গড় আয়ু যদি 80 বছর ধরা যায়, এটি 100 টিরও বেশি মানব প্রজন্মের সমান হবে। 

কি মনে হচ্ছে? হাস্যকর না ভয়ঙ্কর !!??

এর মানে হল যে একজন মহাকাশচারী যে প্রক্সিমা সেন্টোরি বা এর এক্সোপ্ল্যানেট (সৌরজগতের বাইরের একটি গ্রহ) (exoplanet) প্রক্সিমা বি (Proxima B) ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার জীবদ্দশায় বা কয়েক জীবদ্দশায় এটিতে পৌঁছাতে পারবে না। সে তার বা তার জৈবিক গঠন দ্বারা পরাজিত। অন্য কথায়, মানুষের জীবনকাল আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের জন্য সম্পূর্ণরূপে অনুপযুক্ত। এই সংখ্যাগুলি এতটাই বিস্ময়কর যে মহাকাশ ভ্রমণকে বাস্তবতার বাইরে বলে মনে হয়। যদিও আমরা স্বাধীনভাবে ইচ্ছামত চলাফেরা করতে পারি, স্থানিকভাবে আমাদের চলাচল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ বলে মনে হয় যখন বড় দূরত্বের (আন্তঃনাক্ষত্রিক) ভ্রমণ বিবেচনা করা হয়। এই অর্থে আমরা স্থানের মাধ্যমেও বন্দী।

 

হাতে সময় খুব কম

মহাবিশ্বের বিস্তার এবং তার বর্ধিক গতিতে সম্প্রসারণের সাথে সাথে ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ, চাঁদ, সবই প্রতি মুহূর্তে আমাদের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে সরে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে এটি গবেষণার জন্য এবং আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। আমাদের খুব দ্রুত কাজ করতে হবে, অন্যথায় অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। সবকিছু আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং থেকে যাবে শুধুই একরাশ হতাশা।

ব্যর্থ হলে কি হবে!!

আমাদের অক্ষমতার ফলাফল হবে ভয়াবহ। আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক দূরবর্তী পরিণতি হবে। সম্ভবত আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি অন্ধকার তারাবিহীন আকাশ দেখতে পাবে। তারা জীবনে এবং মরণে একটিই বিশ্বাস পোষণ করবে যে এই মহাবিশ্বে তারা একা এবং তাদের কোথাও যাওয়ার নেই। এক দুর্ভাগ্যজনক ও বিরক্তিকর জীবন যা স্বর্গের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত!! নক্ষত্র, গ্রহ, ছায়াপথের গল্পগুলি তাদের জন্য কেবলমাত্র স্বপ্নে দেখা কল্পকাহিনী হয়ে উঠবে যা তারা কিংবদন্তী হিসাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রেরণ করবে। ধীরে ধীরে নীরবে সময় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে।

মহাকাশ ভ্রমণ আমাদের জন্য নিছক পছন্দ না বাধ্যতামূলক? আদৌ কি প্রয়োজন আছে?

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবির্ভাবে মানব সভ্যতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। কিন্তু প্রতিটি সাফল্যের পাশাপাশি তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। দূষণ, বন উজাড়, ওজোন স্তরের অবক্ষয়, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদির কারণে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে মেরু বরফের স্তর গলে গেছে এবং সমগ্র পৃথিবীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

জীবনে এর প্রভাব ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যত দিন যাচ্ছে ততই এর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে এই প্রক্রিয়া অদূর ভবিষ্যতে মনুষ্যজাতিকেও ছুয়ে ফেলবে। শেষের শুরু হয়তো হয়েই গেছে ! সর্বনাশ কি খুব বেশি দূরে !! পৃথিবী দীর্ঘ সময়ের জন্য জীবন টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত জায়গা থাকবে না যদি না আমরা এটির  সংরক্ষণের জন্য গুরুতর পদক্ষেপ নিই।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের একটি বিকল্প আস্তানার কথা ভাবতেই হবে। আমাদের অন্য গ্রহের সন্ধানে আরও বেশি করে মহাকাশ ভ্রমণের চেষ্টা করা উচিত যা জীবন ধারণের জন্য অনুকূল হতে পারে। ভাগ্য যদি সহায় হয় তাহলে হয়ত সেরকম একটি গ্রহের সন্ধান আমরা পাবো এবং সেটিকে উপনিবেশ করার কথা আমরা ভাবতে পারবো। কিছু এক্সোপ্ল্যানেট প্রতিশ্রুতিশীল লক্ষণ দেখিয়েছে এবং ইতিমধ্যেই সেই তালিকায় রয়েছে। সুতরাং মহাকাশ ভ্রমণ আর বিকল্প নয় বরং শীঘ্রই মানব জাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে বাধ্যতামূলক হবে।

আমরা ইতিমধ্যেই ওয়ার্প ড্রাইভ (warp drive), ওয়ার্ম হোল (wormhole) ইত্যাদির কথা ভেবেছি যা আমাদের এই উদ্যোগে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এগুলি এখনও নিছকই তত্ত্ব এবং হলিউড চলচ্চিত্রে চিত্রিত বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বস্তু হিসাবে বিবেচিত হয়। খুব শীঘ্রই আমাদের এই তত্ত্বগুলো থেকে বাস্তবিক ফলাফল পেতে হবে।

আশা করি আমরা শীঘ্রই স্থান এবং সময়ের জটিল রহস্য বুঝতে পারব এবং প্রকৃতির সমস্ত রহস্য উদঘাটন করব। এটি আমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে আমাদের আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে। আর হয়ত সেদিন আমরা স্থানিক অদৃশ্য কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যাব।

 

1 Comments
  • avatar
    Rajarshi Ghosh

    28 April, 2024

    প্রবীর বাবুর হাত ধরে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে ধারা পুরোগামীতে শুরু হল তা যেন ভবিষ্যতেও জারি থাকে।

Leave a reply