নানা রঙের ডোরাকাটা রাজকীয় বাঘ

লিখেছেন:জয়ন্ত কুমার মল্লিক

 

সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রতীকী বাঘ 

প্রতীকী স্কেচ - হরপ্পার সিলমোহরে বাঘ দেবী (বনবিবির আদিরূপ) 

অবিভক্ত ভারতবর্ষ (ভারতীয় উপমহাদেশ)-এ খ্রিস্টপূর্ব ২,৫০০ অব্দের হরপ্পার সিলমোহরে প্রথম এক দেবীকে মানব-পশু দ্বৈতরূপে দেখানো হয়েছে। সমসাময়িক গ্রিক ও মিশরীয় সভ্যতার স্ফিংস-এর (এর শরীরের নিচের অংশ সিংহাকৃতির এবং ওপরে মানুষের মাথার মতো) অনুকরণে, যার ঊর্ধ্বাঙ্গ সালংকারা এক মহিলার এবং নিম্নাঙ্গ বাঘের মতোই ডোরাকাটা (বাস্তবে যদিও অপ্রতিসম - সরু মোটা, ছোটো বড়ো, বিক্ষিপ্ত, ভাঙা ভাঙা ও বাঁকাচোরা)। উল্লেখ্য ব্রোঞ্জ বা বনহাসিলের প্রাথমিক যুগে আরণ্যক এই উপমহাদেশে তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী ধূসর কেশরী সিংহকে হঠিয়ে দাপুটে হলদে ডোরাকাটা বাঘের রাজকীয় অভ্যুত্থান ঘটেছিল। (পড়ুন শশাঙ্ক যাদব, ২০২৪ - https://doi.org/10.17087/jbnhs/2024/v121/170638) সেই সময়ে এই অঞ্চলে একই বংশোদ্ভুত সিংহ এবং বাঘ পাশাপাশি বাস করলেও বাঘ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি সংখ্যায় দেখা যেত। তুলনামূলকভাবে বন্য সিংহ কোণঠাসা বা সংখ্যায় নগণ্য হবার ফলে সিন্ধু উপত্যকায় আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলোতে বাঘ সিংহের স্থান দখল করে নিয়েছিল। যেমন পশুপতি সিলে ডানদিকে ওপরে হাতি ও নিচে বাঘ, বামদিকে ওপরে একশৃঙ্গ গন্ডার ও নিচে বুনো মোষ এবং আসনের নিচে দু’দিকে দু’টো মৃগ (কৃষ্ণসার) দেখা যায় (নিচের প্রথম ছবি দেখুন), সিংহ এখানে অনুপস্থিত। এমনকি মানুষ-বাঘ প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্বের দৃশ্য [মস্তকে সুদর্শন চক্রযুক্ত হস্তিবাহনা বনদেবী দু’হাতে এক জোড়া বাঘের সাথে যুদ্ধ করছেন (সুন্দরবনে ব্যাঘ্রবাহিনী একইভাবে বাঘকে শমিত করেন)], দ্বিতীয় ছবি (Plano convex molded tablet)-তে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তৃতীয় ছবিতে ১৯৯৭ সালে হরপ্পায় আবিষ্কৃত আর একটি নিদর্শনে দুই বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ে দেবী গজারূঢ়, মাথার ওপর চক্র রয়েছে (Harappa.com 1995-2025)।

পশুপতি সীল - উইকিপিডিয়া

হরপ্পা সভ্যতা - পশুপতি সিল 

 

 

হরপ্পা সভ্যতায় মানুষ ও বাঘের দ্বন্দ্ব 

 

 

গজারূঢ়া দেবী - হরপ্পা সভ্যতা 

বনের রাজা ডোরাকাটা-কেশরীর এই উত্থান - পতন সম্পর্কে স্কটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ জেন ম্যাকিনটোশের অভিমত প্রণিধানযোগ্যঃ 

In the Indus, where lions existed but tigers were far more common, the lion was generally replaced by the tiger. However, in Indus iconography, tigers were usually associated with a female deity, so the male figure is sometimes replaced by a female figure in the contest scene (Harappa.com 1995-2025).

জীবাশ্মপ্রমাণ

ভারতে বাঘের প্রাচীনতম জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশের কার্নুল গুহায় (আনুমানিক বয়স ১১,০০০ বছর আগে)। এই ধরণের শিলাচিত্র মধ্যপ্রদেশের অনেক স্থানে চিত্রিত করা হয়েছে, বিশেষ করে ভীমবেটকা, মহাদেও পাহাড় এবং পান্না বনাঞ্চলে। প্রাচীন মানুষ বাঘকেও 'টোটেম' (আত্মা, পবিত্র বস্তু বা প্রতীক যা একটা আদিম গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে) হিসেবে বিবেচনা করত এবং আশা করত যে তারা এদের তুষ্ট করে এমন শক্তি অর্জন করতে পারবে যাতে তারা সব ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে পারে। ভীমবেটকা (বর্তমানে রাতাপানি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অংশ) গুহায় বাঘের যে ১৫টা প্রস্তর চিত্র পাওয়া গেছে সেগুলো নব্যপ্রস্তর (নিওলিথিক), তাম্র (চ্যালকোলিথিক) এবং প্রারম্ভিক লৌহ যুগ (২৫০০-৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব)-এর সৃষ্টি বলে অনুমান করা হয়। 

পান্নায় শিলাচিত্রে লাল বা গেরুয়া রঙে আঁকা এক ডোরাকাটা বাঘের তাড়া করে হনুমান শিকার 

পান্নায় শিলাচিত্রে লাল বা গেরুয়া রঙে আঁকা এক ধনুকধারী শিকারির বাঘ শিকার; এখানে বিন্দুসমষ্টি দিয়ে পবিত্র পৌরাণিক আত্মার উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে।

ক্ষেত্র সমীক্ষায় জানা গেছে গোণ্ডি (Gōndi) গোঁড় অথবা গোণ্ড উপজাতির দেশে প্রাণীর রক্তের সঙ্গে গিরিমাটি মিশিয়ে আঁকা ছবি "Khoon ka chitre" (paintings made in blood)-এর সঙ্গে আধিভৌতিক ধারণাও জড়িয়ে আছে। এগুলোর প্রাচীনতা সম্পর্কে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে।

সামগ্রিক পর্যালোচনা

বাদাবনের স্বাভাবিক ডোরাকাটা বাঘ, বিশ্বে শিকারি সাহেবের দেওয়া নাম ‘রয়াল বেঙ্গল টাইগার’ নামে সুপরিচিত

আদিকাল থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির আঙিনায় বৈচিত্র্যময় হলুদ-কালো ডোরাকাটা (দেহের দু’পাশে বেশির ভাগই উল্লম্ব, পায়ে কিছু অনুভূমিক ও তির্যক এবং লেজে কয়েকটা অপ্রতিসম বলয়, ডগা কালো - উপরের আলোকচিত্র দ্রষ্টব্য) বাঘ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। 

তবে প্রথম ডোরাকাটা বাঘের কাঠের মডেল আমরা পাই ১৫৫১ সালে কনরাড গেসনারের হিস্টোরিয়া অ্যানিমেলিয়াম (প্রাণীদের ইতিহাস) বইতে। 

তারই সূত্র ধরে কার্ল লিনিয়াস ১৭৫৮ সালে বন্য বাঘের দ্বিপদ বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন (Panthera tigris)। ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত (তখন উপমহাদেশে বিচরণকারী বাঘের সংখ্যা ধরা হয় প্রায় ১ লক্ষ) রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর জঙ্গল বুক-এ বর্ণিত ‘শের খান’ (ডাকনাম লুংরি) থেকে আরম্ভ করে হালের শিবশঙ্কর মিত্রের "সুন্দরবন সমগ্র" (১৯৮৬) বইটির অভাবনীয় সামর্থের অধিকারী গহন বাদাবনের "রাজকীয় বাঙালি বাঘ" (Royal Bengal Tiger), অথবা আয়লা উত্তরকালে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ত্রাস ‘নানটু’ এবং সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রদেশ থেকে ওড়িশার সিমলিপালে নিয়ে আসা, ঝাড়খন্ড ও আমাদের জঙ্গল মহলের অতিথি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি জিনাত (নভেম্বর-ডিসেম্বর, ২০২৪ - সবাইকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল), কিংবা ঘেরাটোপে আমার সাথে রোজ সামনাসামনি দেখা হওয়া ‘এক যে ছিল বাঘ’ (১৯৭৩) সিনেমার নায়ক - প্রশিক্ষিত নিপাট ভদ্র (gentle) বাঘ শঙ্কর (সার্কাসে প্রথম চাকরির সূত্রে তার একক অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে) বা সত্যজিৎ রায়ের গুগাবাবার (পায়ে পড়ি) বাঘমামা (ঠিকানা ভারত সার্কাস) এরা সবাই একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন কিংবদন্তি চরিত্র, স্বরূপে দেবতা বা দেবীরূপে দেশকাল-জাতিধর্ম নির্বিশেষে পূজিত, নতুবা ঐশ্বরিক বাহনরূপে আবির্ভূত, স্বাধীনতা উত্তরকালে ভারতীয় সিংহের পরিবর্তে ঘোষিত (এপ্রিল, ১৯৭৩) জাতীয় পশু (যখন ভারতে বাঘের সংখ্যা ২০০০-এর কম) এবং জীবন্ত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক (‘বাঘ ও সংস্কৃতি’, সনৎ মিত্র, ১৯৮০)। 

স্কেচ জীবোকাঃ ব্যাঘ্রবাহনা দেবী, বিশেষ করে দুর্গা বা অন্য কোনো দেবীর রূপ, বিভিন্ন অঞ্চলে এবং কিংবদন্তিতে বিভিন্ন নামে পরিচিত।

প্রাচীন কালে মহাভারতেও বাঘ সংরক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া হয়েছিলঃ

निर्वनो वध्यते व्याघ्रो निर्व्याघ्रं छिद्यते वनम्।
तस्माद्व्याघ्रो वनं रक्षेद्वयं व्याघ्रं च पालयेत् ॥

महाभारत – उद्योग पर्व : ५.२९.५७

[বাঘ বন ছাড়া মারা যায়, আর একইভাবে বাঘ ছাড়া বন কেটে ফেলা হয়। বাঘ ছাড়া বন থাকতে পারে না এবং বন ছাড়া বাঘও থাকতে পারে না। বন বাঘদের আশ্রয় দেয় এবং বাঘ বন পাহারা দেয়।"]

বনের রাজা বাঘ বিশ্বসেরা হয়েছে ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায়- ২১% ভোট পেয়ে বাঘ বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান অধিকার করেছে, আর সিংহ পেয়েছিল মাত্র ৯% ভোট, স্থান পঞ্চম। 

জৈবিক রঙ বনাম কল্পনার রঙ

ছাত্রাবস্থায় সিলেবাসে ছিল ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম ব্লেক রচিত "দ্য টাইগার" (The Tyger: Songs of Experience) "রোমান্টিক" যুগে ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কবিতা, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়াবে- রাতের অরণ্যে জ্বলন্ত উজ্জ্বলতা… অমর… ভয়ঙ্কর… (Tyger Tyger, burning bright, In the forests of the night: What immortal hand or eye, Dare frame thy fearful symmetry?), বাঘ এখানে ‘ভয়ঙ্কর আগুন রঙা’ হিসেবে প্রদর্শিত। যদিও স্পষ্টভাবে সেকথা বলা নেই, তবে ইঙ্গিতবহ মিশ্ররঙ গাঢ় হলদে থেকে কমলা-লাল বা সোনালি। 

আধুনিক বাংলা কবিতাতেও আমরা ব্লেকের ছায়া দেখতে পাই - 

চিত্রিত বিরাট বাঘ। ফিরে যায় ঘাসের জঙ্গলে।… ত্রিজগৎ নিশ্বাস হারায় চলন্ত হলুদ-কালো চিত্রখানি দেখে। বাঘ যায়। বনের আতঙ্ক হেঁটে যায়। বাঘ যায়। অন্ধকার বনের নিয়তি। চিত্রিত আগুনখানি যেন ধীরে-ধীরে হেঁটে যায়। প্রকাণ্ড শরীরে চমকায় হলুদ জ্বালা।…আমরা নিশ্চিন্ত বসে বাঘ দেখি ডিস্‌নির ছবিতে। 

কবিতা ‘বাঘ’- কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী- কাব্যগ্রন্থ নীরক্ত করবীঃ পৃষ্ঠা ৬০ 

“ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়” গানটা [গীতিকার আজাদ রহমানঃ দস্যু বনহুর (১৯৭৬)] কেউ কেউ ইউটিউবে  শুনে থাকবেন। গানটির এই বক্তব্য বৈজ্ঞানিক বিচারে সঠিক:

The dark colouration of the tiger stripes is produced by pigments known as eumelanin (primarily responsible for brown and black colours) and pheomelanin (reddish-yellow, sulfur-containing type), which are contained in the melanocytes (producing melanin, a complex polymer that originates from the amino acid tyrosine), which create the dark stripes against the orange background. The more melanin produced, the darker the pigmentation. White tigers have less melanin than brown tigers. 

‘আরণ্যক’ (১৯৩৯)-এর স্রষ্টার কাছে উত্তর বিহারের বনভূমিতে বাঘ অধরা থেকে গেছে, ঘণ্টাখানেক শৃগাল ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে হিমেল হাওয়ায় ঠান্ডা লাগার ভয়ে সত্যচরণ ক্যাম্পে ফিরে গেছেন। 

…লোকে বলে সরস্বতী কুণ্ডীর জঙ্গলে বাঘ আছে, জ্যোৎস্না-রাত্রে সরস্বতীর বিস্তৃত জলরাশির কৌমুদীক্ষাত শোভা দেখিবার লোভে রাসপূর্ণিমার দিন তহশীলদার বনোয়ারীলালের চোখে ধূলা দিয়া আজমাবাদের সদর কাছারি আসিবার ছুতায় লবটুলিয়া ডিহি কাছারি হইতে লুকাইয়া একা ঘোড়ায় এখানে আসিয়াছি। 

বাঘ দেখি নাই বটে, কিন্তু সেদিন আমার সত্যই মনে হইয়াছিল এখানে মায়াবিনী বনদেবীরা গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নাস্নাত হ্রদের জলে জলকেলি করিতে নামে।

আরণ্যক - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ১২৩

সারা রাত থাকলে অবশ্য বাঘ বা বনদেবীর দেখা পাবার সুযোগ থাকতো! তবে ২২ বছর পরে বিভূতিভূষণের এই অপ্রাপ্তি পুষিয়ে দিলেন ঋজুদার স্রষ্টা। বুদ্ধদেব গুহর ‘টাঁড়বাঘোয়া’ (আনন্দ, নভেম্বর ১৯৬১) উপন্যাসে এক মানুষখেকো বাঘের যে প্রাসঙ্গিক বর্ণনা পেয়েছিলাম তা এখানে তুলে ধরলাম। 

ঝাড়খণ্ডের পালামৌ অঞ্চলে পলাশবনার ওই বাঘ টাঁড় (খাঁ খাঁ পাথুরে ভূমিতে ঝাঁটি বা ঝাড় জঙ্গল)-এর মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে (অনেক সময় দিনের বেলাতেও) যাতায়াত করত বলেই স্থানীয়রা টাঁড়বাঘোয়া বলে ডাকত বাঘটাকে। টাঁড়বাঘোয়ার ডাক নাম ছিল পিলাবাবা। হলুদ রঙের বাঘটা ছিল বিরাট, ইয়া ইয়া দাড়ি গোঁফওয়ালা (তথ্যটি স্মরণে রাখুন), তাই অনেকে বলত পিলা (হলুদ) বাবা (বয়স্ক)। বিহারের বাঘের গায়ের রঙ সচরাচর পাটকিলে হয়। টাঁড়বাঘোয়ার রঙ হলুদ বলেই তার অমন নাম। টাঁড়বাঘোয়া এবং তার সঙ্গিনীর মর্মান্তিক পরিণতি নিয়ে ছিল এই শিকারকাহিনী।

তবে এখানে বলে রাখা দরকার বাঘের শরীরে সাধারণত দু’টি ধরনের লোম থাকে - একটি হলো মোটা (guard hair), যা শরীরের বাইরের স্তর হিসেবে কাজ করে এবং অন্যটি হলো নরম লোম বা পশম।  যখন বাঘের পুরনো লোম ঝরে যায়, তখন নতুন লোম গজায় (molting)। এই প্রক্রিয়া সাধারণত বছরের নির্দিষ্ট সময় বা ঋতুতে ঘটে। শীতকালে বাঘের লোম ঘন হয় এবং গরমকালে তা পাতলা হয়ে যায়, বিশেষ করে শীতের দেশে, প্রাসঙ্গিক আমুর বা সাইবেরিয়ার বাঘ। 

By the onset of the summer, the reddish ochre colour of its thick winter fur is replaced by a dark orange shade. At the same time, the coat becomes much shorter and thinner, and the black stripes on the body acquire richer tones. The predator becomes even more elegant and beautiful; at the same time the coat retains a camouflage colour. 

বাঘের লোমের রঙ ও প্রকার জিনগতভাবে নির্ধারিত হয়, কিন্তু তার লোম ঝরে যাওয়া বাহ্যিক কারণেও হতে পারে। এটা আবাসস্থলের পরিবর্তনের ওপরও নির্ভরশীল। বিভিন্ন পরিবেশে বাঘের লোমের রং এবং ঘনত্বের ভিন্নতা দেখা যায়। সহজ কথায়, লোমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের রং গাঢ় বা হাল্কা দেখায়। উল্লেখ্য বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের গবেষকরা বাঘের ঝরে পড়া লোম বাঘদের পারিবারিক সম্পর্ক চিহ্নিত (জিনোম সিকোয়েন্স) এবং পূর্বপুরুষের মানচিত্র বা নীল নকশা তৈরি করতে ব্যবহার করেছেন। ঝরে পড়া লোম জিনোমিক তথ্যের সর্বোত্তম উৎস।

রঙের রহস্যভেদের পর এবার নকশার কথায় আসি। রবি ঠাকুরের “এক যে ছিল বাঘ” (চিত্রবিচিত্র, পৃ. ৫৬-৫৮) কবিতায় বাঘের গায়ে “কালো কালো দাগ”-এর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ‘ডোরা’ কথাটি এখানে ঊহ্য রয়ে গেছে। তবে “…দেহ কেন ভরা কালো দাগে” তার ব্যাখ্যা রবি ঠাকুর না দিলেও তাঁর স্নেহধন্য চিত্রকর এর একটা অজৈবিক কারণ খুঁজে বার করে ছেলে (বড়ো হয়ে সেলুলয়েডের জগতে বিখ্যাত হয়েছেন) ভুলিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসু একবার সেই ছেলেকে একটা ডোরাকাটা বাঘ এঁকে দিয়েছিলেন। অনুসন্ধিৎসু ছেলেটি বাঘের লেজে এই কালো ছোপ (বাস্তবে বলয়) থাকার কারণ জিজ্ঞেস করায় নন্দলাল নাকি বলেছিলেন বাঘটা এক বাড়ির রান্নাঘরে মাংস চুরি করে খেতে ঢুকেছিল, তখনই ল্যাজের ডগাটা ঢুকে যায় জ্বলন্ত উনুনের ভেতরে, আর পোড়া লেজে এই কালো দাগের সৃষ্টি হয়। তবে একটু বড়ো হয়ে সত্যজিৎ নিশ্চয়ই বাবার লেখা ‘সেকালের বাঘ’ পড়ে এইসব কালো কালো দাগের যৌক্তিকতা বুঝতে পেরেছিলেন। 

যে জন্তু যে-রকম স্থানে যে-রকম অবস্থায় বাস করে সে অনুসারে তার চেহারা ও গায়ের রং কিছু না কিছু বদলিয়ে আসে। বাঘের গায়ে যে কালো কালো দাগ দেখতে পাও তাতেই বুঝতে পারা যায় যে, ঝোপ জঙ্গলে চলাফিরা তার অভ্যাস আছে—সেখানে বড় বড় ঘাসের ঝোপে যখন বাঘমশাই লুকিয়ে থাকেন তখন সেই খাড়া ঘাসের আলো-ছায়ার সঙ্গে বাঘের হলদে-কালোর ডোরাগুলি এমনিভাবে মিশিয়ে যায় যে হঠাৎ দেখলে বুঝবার যো নেই যে ওখানে ঝোপ ছাড়া আর কিছু আছে। 

সন্দেশ পত্রিকা যখন সত্যজিতের হাত ধরে প্রথম (মে ১৯৬১) প্রকাশিত হল তার প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল নন্দলাল অঙ্কিত সেই ডোরাকাটা বাঘের রঙিন ছবি। 

মূল কমলা-হলুদ চামড়ার ওপর এই অনন্য দাগের সমাহার ঘন অরণ্যের আবাসিক বাঘ ছাড়া মাংশাসী আর কোনো সমগোত্রের প্রজাতি, যেমন খোলামেলা অরণ্যের অধিবাসী অর্থাৎ সিংহ, জাগুয়ার, চিতাবাঘ বা তুষার চিতা কারোরই নেই। এমনকি বাঘের বাচ্চারাও গর্ভে থাকার সময় এই পরিচিত চিহ্নের অধিকারী হয়, বাবা-মার মতোই ডোরাসহ জন্মায়। নির্দিষ্ট জিনের উপস্থিতি এবং তাদের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ডোরাকাটা দাগের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ঘনত্ব এবং বিন্যাস নির্ধারিত হয়। তাই এই ডোরা জনে জনে অনন্য, একজনের সঙ্গে অন্যজনের মিল হয় না। এই কারণে বিংশ শতাব্দীর পায়ের ছাপ গোণার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা পাল্টে একবিংশ শতাব্দীতে গায়ের শতখানেক ভাঙাচোরা কালোডোরাই বাঘেদের ব্যক্তি পরিচয় নির্ধারণ করছে। তবে এই দাগ দেখে লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায় না। প্রাথমিকভাবে পায়ের ছাপ দেখে লিঙ্গ বোঝা গেলেও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় ব্যাঘ্রভূমি থেকে সংগৃহীত লোম ও মলের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে।

আগেই বলেছি বাঘের গায়ে নকশা বৈচিত্র্যপূর্ণ - কোথাও গাঢ় রং, কোথাও বা হালকা। ব্যাপনে নির্দিষ্ট রাসায়নিকের অসম বন্টনের ফলে এরকমটা হয়। প্রথম অবস্থায় রাসায়নিক যেখানে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে তীক্ষ্ম রেখা তৈরি করে। তীক্ষ্ম রেখার আশপাশের রেখা কিছুটা ঝাপসা থেকে যায়, তাতেই একটা অনন্য নকশা তৈরি হয়ে যায়। লক্ষ করলে বোঝা যাবে শরীরের পেছনের দিকে নকশার ঘনত্ব বেশি, সামনের দিকে কম। অণুর ঘনত্ব বেড়ে গেলে তার সামনের গতি নিয়ন্ত্রিত বা শ্লথ হয়। এখানে উল্লেখ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই নকশার কোনো পরিবর্তন হয় না, সারাজীবন একই থাকে। প্রকৃতির এই অভিনব নকশা তৈরির জটিল জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কথা এবার বলব।

Different tiger coat colour variants exhibit a consistent pattern in hair composition whereby 90% of hairs are zigzag hairs, which predominantly contribute to pelage colouration. Zigzag hairs from the orange background of a wild-type tiger are agouti-patterned with sub-apical pheomelanin bands and dark tips and bases, and the stripes on their face, sides, legs and stomach vary in width and length, whether they are single or double-looped, colouration from a light brown to dark black and are not symmetrical from one side of the tiger to the other (Mallick, JK. 2023. Mangrove Tiger: An Ethological Study, Ethics International Press Ltd, UK). 

চামড়ায় আড়াআড়িভাবে সাজানো, আঁকাবাঁকা বা ভাঙাভাঙা (প্রায় ৯০ শতাংশ) কালো ডোরাকাটা দাগগুলো আসলে বাঘের চামড়ার স্বাভাবিক রঙ। কেবল এদের বর্হিলোম নয়, চিকিৎসার প্রয়োজনে লোম কামিয়ে ফেলার পরেও বাঘের ত্বকেও উল্কির মতো এই একই নকশা দেখা গেছে। এই নকশার সুবিধা হল জঙ্গলের আড়ালে বাঘের পুরো চেহারাটা অন্যদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বিঘ্নিত রঙ দেখায়, এতে গাছপালার ফাঁকে ও ঘাস বনে লুকিয়ে থাকতে ও শিকার করতে বাঘের খুব সুবিধা হয়। মনে রাখতে হবে তার শিকার ক্ষুরওলা প্রাণী যেমন হরিণের চোখে কিন্তু বাঘের উজ্জ্বল কমলা রং ধরা পড়ে না, বরং সবুজ দেখায় এবং তা পটভূমির সাথে মিলে যায়।

Buy Mangrove Tiger: An Ethological Study Book Online at Low ...

বাঘের এই ডোরা দাগ গড়ে প্রায় ৯০টি থাকে [এক পাশে ২২টি ধরে দু’পাশে (সামনের দিকে কম ও পেছনের দিকে বেশি) ৪৪টি+মাথা-মুখ জুড়ে ১০টি+সামনের পায়ে (৩ x ২) ৬টি, পেছনের পায়ে (১০ x ২) ২০টি এবং ৮৫-১১০ সেমি লম্বা লেজে ১০টি বলয়], ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে সংখ্যা ±১০০ হতে পারে (কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সঠিক সংখ্যা জানা যায়)। অবিকল একই নকশার ডোরাকাটা দাগের বাঘ প্রাণীজগতে দু’টি নেই। যার ফলে বাঘেরা খুব সহজেই একে অপরকে শনাক্ত করতে পারে।

ভ্রামণিক থমাস পেন্নান্ট [১৭৯৮: ১৫৩ (The view of Hindoostan, Vol. 2: Eastern Hindoostan. London)] বয়স ও স্বাস্থ্য অনুসারে বাঘের চামড়ার রঙের তারতম্যের কথা বলেনঃ 

…the ground colour of a young or vigorous beast is almost of a brilliant orange; the black intense, and the little white it has is most pure. In old or fickly beast the black is dull, and the yellow fades to a sandy hue.

রবি ঠাকুরের ‘সুন্দরবনের বাঘ’ (চিত্রবিচিত্র, পৃ. ৭৮-৮১) কবিতার প্রথম দু’টো লাইন হলো - “সুঁদর-বনের কেঁদো বাঘ, সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ”। এই একই কাল্পনিক শব্দবন্ধের পুনরাবৃত্তি রয়েছে ‘বনে থাকে বাঘ’ (সহজপাঠ) কবিতায় “বাঘ আছে আম-বনে। গায়ে চাকা চাকা দাগ।“ কিন্তু বাস্তবে বাঘের এই বৈশিষ্ট্য নেই। বরং চিতা ও চিতা বাঘ দু’টি প্রজাতির হলুদ শরীরে এরকম দাগ বা কালো ফোঁটা আমরা দেখতে পাই। তবে একটু লক্ষ করলে বোঝা যাবে চিতাবাঘের কালো ফোঁটাগুলোর মাঝখানে হলুদ থাকায় অনেকটা বলয়ের রূপ নিলেও চিতার বেলায় কেবলই কালো ফোঁটা থাকে। আর বাঘের দেহে এরকম কালো চাকা দাগ না থাকলেও বাঘের দু’কানের পেছনে একটা বড়ো সাদা দাগ থাকে, যা দেখতে অনেকটা "নকল চোখ" (false eye)-এর মতো (নিচের আলোকচিত্র দ্রষ্টব্য)। 

জঙ্গলে বিশ্রাম-তথা-কাদাস্নানের সময় সতর্ক বাঘের খাড়া কালো দু’কানের ওপর সাদা ‘নকল চোখ’ দৃশ্যমান

এই দাগগুলো থাকায় বাঘকে আরও বড়ো দেখায় এবং পেছন থেকে আক্রমণ করতে আসা সম্ভাব্য শিকারীকে ভড়কে দেয়, কারণ তারা মনে করতে পারে বাঘ তাদের দিকেই সোজাসুজি তাকিয়ে আছে। এই দাগগুলো বাঘেদের আন্তঃযোগাযোগ এবং বাঘিনীর শাবকদের সাথে যোগাযোগের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে। তবে সিংহীর ক্ষেত্রে এর পরিপূরক হলো লেজের ডগার গোছা, যা আবার বাঘের নেই।

রাজতিলক 

সাহিত্যে ডোরাকাটা বাঘের কথা অনেক বলা হলেও যেটা বলা হয় নি সেটা রাজতিলকের কথা, অর্থাৎ বাঘ বা বাঘিনীর আর একটা ব্যক্তিগত পরিচিতি চিহ্ন হল তার জন্মগত কপালের উলকি। চীনা সংস্কৃতিতে, বাঘকে প্রাণীদের মধ্যে রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভালো করে লক্ষ করলে বুঝতে পারবেন বাঘের কপালে সাধারণত চারটে ডোরা কাটা দাগ দেখা যায়, যার মধ্যে তিনটে অনুভূমিক এবং সেই তিনটে দাগকে প্রায় মাঝামাঝি ছেদ করেছে একটা উল্লম্ব রেখা। বাঘের কপালে এই বিশেষ চিহ্ন দেখতে অনেকটা চীনা ভাষায় "রাজা" শব্দটিকে বোঝাতে ব্যবহৃত ওয়াং  [王 (Wáng)] চিহ্নের মতো। কপালে এই চিহ্ন বাঘের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যা প্রতিটি বাঘের ক্ষেত্রে আলাদা হয়। বাঘের ডোরাকাটা নকশা যেমন অনন্য, তেমনি কপালে থাকা এই চিহ্নটিও একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এটি শুমারির সময় বাঘ শনাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়। এটি শক্তি, সাহস এবং রাজকীয়তার  প্রতীকও বটে। 

 

চীনের অষ্টাদশ শতাব্দীর এক শিল্পকর্ম: পবিত্র কালো বাঘের কপালের মাঝখানে রাজচিহ্ন 

প্রাচীন চীনা পুরাণের প্রাথমিক স্তরে এটা মনে করা হতো যে মহাজাগতিক শক্তিগুলো যখন বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল, তখন পাঁচটি ভিন্ন রঙের বাঘের কারণেই পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ভেঙ্গে পড়েনি।

১) হলুদ বাঘ - সব ধরনের বাঘের সর্বোচ্চ শাসক, সূর্যের প্রতীক;
২) লাল বাঘ - গ্রীষ্মের শাসক, আগুনের অধিকর্তা;
৩) কালো বাঘ - শীতের শাসক, জলের অধিকর্তা;
৪) নীল বাঘ - বসন্তের শাসক, মাটির অধিকর্তা; এবং
৫) সাদা বাঘ - শরতের শাসক, ধাতব পদার্থের অধিকর্তা। 

বাস্তবে এই নানা রঙের বাঘেদের সম্পর্কে জৈবিক ব্যাখ্যা সহকারে আলাদা করে বিশদে আলোচনা করেছি।

Meet Machli, the World's Most Famous Tiger  

ছবিতে রণথম্ভোরের প্রয়াত মাছলি- বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বাঘিনী ১১টা সন্তানের জননী- পাঁচ বারে সাতটা মেয়ে আর চারটে ছেলে। মাছের মতো অদ্ভুত নকশা থাকার কারণে তার এই নামকরণ করা হয়েছিল।

অর্ধকেশর ও গালপাট্টা 

পালোয়ান বাঘের অর্ধকেশর ও গালপাট্টা- আমার দেখা এক আপাত নিপাট সভ্যভদ্র রাজকীয় বাংলার বাঘ, সাকিন ভারতীয় সুন্দরবন

মরদ বটে- বিশাল মাথা, ঘাড়েগর্দানে, মুখে গোটা দশেক বিভিন্ন ধরনের সরু-মোটা কালো ডোরা কাটা, থ্যাবড়া গোলাপি নাকের ডগা, বড়ো নাসারন্ধ্র, চোখে বড়ো লেন্স ও চক্ষুতারা যা চোখে আলোর পরিমাণ বাড়ায়, লম্বা লম্বা সংবেদনশীল ঝাঁটা গোঁফ, চিবুক, গাল, চোয়াল আর ঘাড়ে ঝাঁকরা চুল (ruff), সিংহের কেশর (mane)-এর তুলনায় একে হয়ত ‘অসম্পূর্ণ কেশর’ বলা যেতে পারে! ভাগ্যিস এই ঘনিষ্ট মুহূর্তের চিত্রটা তোলা সম্ভব হয়েছিল, নইলে দূর থেকে দেখলে এতসব ভালো করে বোঝাই যায় না! 

কিন্তু অরণ্যের এই শ্রেষ্ঠ জোয়ান মরদের অর্ধকেশর ও গালপাট্টার কার্যকারণ জানলে আশ্চর্য হবেন। লড়াইয়ের সময় অন্য বাঘ থাবা দিয়ে ঘাড়ের চারপাশে আঘাত করলে পালোয়ান বাঘের অর্ধকেশর ও গালপাট্টা তাকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে, কিন্তু এই ধরণের পুরু লোমের আস্তরণহীন কোনো বাঘ সেই সুবিধা পাবে না। যেহেতু মাত্র কয়েকজন পালোয়ানের এই সুরক্ষা বর্ম থাকে এবং বাঘবনে সবসময় স্বজাতি ও বিজাতিদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়, সেহেতু এই পালোয়ানদের কম শক্তিশালী বা সাধারণ দুর্বল সব বাঘেদের হারিয়ে রাজত্ব করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একে অরণ্যে একনায়কতন্ত্র আখ্যা দেওয়াই যায়। আর জিনের প্রসারে এই পালোয়ানদের ভূমিকা যথেষ্ট। সেখানে তার প্রাইম টাইমে রাজত্বের অন্য বাঘেদের বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একটু ফিরে দেখুন বুদ্ধদেব গুহর টাঁড়বাঘোয়ারও একই রকম রাজকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু বাঘিনীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। ছোটো-বড়ো সবাই সব সময় মিলনে স্বাগত!!!

নানা রঙের বাঘ 

চোখের মধ্যে এক ধরনের অণুরঙ্গকে আলোর নানা তরঙ্গ আলাদা ভাবে ধরা পড়ে। আর দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক থেকে রং বা বর্ণ উৎপত্তি লাভ করে। রংগুলোকে তাদের ধরন ও উৎস অনুযায়ী মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়- একটা হচ্ছে  মৌলিক রঙ  (লাল, সবুজ এবং নীল),  যৌগিক রঙ (তিনটি মৌলিক রঙ থেকে যেসব রঙ পাওয়া যায়) এবং মিশ্র রঙ। এর মাঝে কিছু পার্থক্যও আছে। 

দৃশ্যমান (প্ৰায় ৩৯০ ন্যা‌নোমিটার থেকে ৭০০ ন্যা‌নোমিটার) বৰ্ণালী বা আলোর নানা রং 

রং

তরঙ্গ দৈর্ঘ‍্য (ন্যানোমিটার)

কম্পাঙ্ক (টেরাহার্জ)

লাল

~ ৭০০–৬৩৫

~ ৪৩০–৪৮০

কমলা

~ ৬৩৫–৫৯০

~ ৪৮০–৫১০

হলুদ

~ ৫৯০–৫৬০

~ ৫১০–৫৪০

সবুজ

~ ৫৬০–৪৯০

~ ৫৪০–৬১০

নীল

~ ৪৯০–৪৫০

~ ৬১০–৬৭০

বেগুনী

~ ৪৫০–৪০০

~ ৬৭০–৭৫০

 

বর্ণালীর তীব্রতা অনুসারে দেখা যায় কম-তীব্রতার কমলা-হলুদ হল বাদামি এবং কম-তীব্রতার হলুদ-সবুজ হল জলপাই সবুজ। আদতে সাদা এবং কালো বলে কোন রঙ নেই। সাদা একটা অ্যাক্রোমেটিক রঙ, সব রঙের সমষ্টি যা মানুষের চোখে সবচেয়ে হালকা রঙ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। আর কালো হচ্ছে দৃশ্যমান আলোর অনুপস্থিতি বা সম্পূর্ণ শোষণের ফলে হয়; এটাও একটা অ্যাক্রোমাটিক রঙ, ক্রোমা ছাড়াই, যেমন সাদা এবং ধূসর। তবে প্রাণীজগতে একই প্রজাতির দু-এক জন স্বাভাবিক বর্ণের হয় না। বাঘের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটে। তাই আমরা বন্য আবাসে স্বাভাবিকের পাশাপাশি ভিন্ন রঙের বাঘ দেখতে পাই, এগুলো ব্যতিক্রম বা অস্বাভাবিক এবং নানা সমস্যার দেখা দেয়। সেটা অস্বাভাবিক বাঘের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য তেমনি সংরক্ষকদেরও চিন্তার বিষয়।

আমরা যখন সামনাসামনি বাঘ দেখি, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে দু’টো ভিন্ন রঙ চোখে পড়ে - দেহের উপরিভাগ ও পার্শ্বদেশ কমলা-হলুদ এবং নিম্নভাগ সাদা ও মুখে, গলায় এবং পায়েও কিছু সাদা ছোপ থাকে। যাইহোক, বাঘের আরো কয়েকটা প্রচ্ছন্ন রঙ বা মিশ্রণ রয়েছে। এই রংগুলো স্বাভাবিক হিসাবে বিবেচিত হয় না, বরং প্রজননশাস্ত্রে একে অসঙ্গতি বা ‘মিউটেশন’ বলা হয়। 

The Taqpep gene has been implicated in changes in stripe shape and width, making it a strong candidate for the pseudomelanistic phenotype in tigers, where stripes may be broadened or even disappear. 

এই অস্বাভাবিক জিনগত পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক (কমলা- হলুদের ওপর কালো ডোরা দাগযুক্ত) বাঘ জিনগতভাবে দুর্বল হচ্ছে, কমছে প্রজনন ক্ষমতা এবং ছোটো নির্দিষ্ট সীমানায় আবদ্ধ হয়ে পড়ার ফলে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও ক্রমে হারিয়ে ফেলছে, যেমনটা ঘটেছে ওড়িশার সিমিলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে, এরপরে উপশিরোনামায় আলাদা করে বলবো সেই কথা। 

বাদামি বাঘ

সুন্দরবনে কালো বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে (সঠিক তারিখ অজানা), একটি হাইপোমেলানিস্টিক বাঘের দেখা পাওয়া গেছিল বাংলাদেশ সুন্দরবনে (২২.২২২°উত্তর, ৮৮.৮৩৯°পূর্ব), সম্ভবত খুলনা বা বাকেরগঞ্জ এলাকায়। এই বাঘটিকে কালো ডোরা ছাড়াই দেখা গিয়েছিল (স্ট্যানলি হেনরি প্রেটার, ১৯৩৭)। 

জানা গেছে, বাঘটি খোলা জঙ্গলের বালুকাময় এলাকায় লুকিয়ে থাকত। ঘটনাটি ১৬ই অক্টোবর, ১৯৩৬ সালে "টাইমস" সংবাদপত্রে প্রকাশিত ডব্লু এইচ কার্টারের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়। বাঘটির রঙ ছিল আগাপাশতালা বাদামি, কিন্তু কালো নয়। চামড়ায় স্বাভাবিক রঞ্জক পদার্থ কম থাকার ফলে এই অবস্থা হয়, অনুপস্থিত থাকার জন্য নয়। তবে সুন্দরবনে ফ্যাকাশে রঙের এই প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের দেখা মেলা এক অতিবিরল ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৯২৯ সালে রেজিনাল্ড ইনেস পোকক একটা বাদামি বাঘের রেকর্ড করেছিলেন যার গায়ের ডোরা শুধুমাত্র চামড়ার রঙের চেয়ে একটু গাঢ়। এছাড়া আরও দু’টো রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। 

Captain Guy Dollman (1936) reported from the British Museum (Natural History) in The Times that in the Central Provinces of India a tiger was shot some years back. It possessed a dark brown background with black stripes. The then Deputy Commissioner at Betul in Central Provinces had in his bungalow a tiger skin that had a background of chocolate brown and sources informed about the presence of another such tiger in the area where the first one was killed (Brander, 1937, based on reports from J. A. Clough, the sportsman and barrister in Calcutta).

লালচে বাদামি বাঘ

লালচে-বাদামি বাঘ বিশেষ করে সুমাত্রায় পাওয়া যায়। এই বাঘের গায়ের রঙ গাঢ় লালচে-বাদামি, যা কালো ডোরাকাটার ওপর দেখা যায়। তবে পোকক (১৯৩৯) একটা নমুনার উল্লেখ করেছেন যার সাধারণ মাটির চেয়ে সামান্য গাঢ়  লালচে বাদামি ডোরা ছিল। এটা উত্তর ইরাণে আলবুরজের এক স্থানীয় জাতি ছিল। কিছু বাংলার বাঘের লালচে-বাদামি রঙ দেখা যায়, যা সাধারণত ফ্যাকাশে সোনালি বা কমলা রঙের চেয়ে গাঢ়। 

 

Brown tiger walking on brown sand during daytime photo – Free Animal Image  on Unsplash

সাদা বা বগা বাঘ

বাঘ মাঝে মাঝে আংশিক বা সম্পূর্ণ সাদা দেখায়। তথাকথিত "সাদা" বাঘের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডোরা গাঢ় বাদামি বা লালচে-কালো হয় এবং সাদা রঙের বিপরীতে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই ধরণের ডোরাকাটা বাঘের অস্তিত্ব ওড়িশা, বিলাসপুর, সোহাগপুর এবং রেওয়া থেকে রেকর্ড করা হয়েছে। মির্জাপুরে একটা বাঘের (মিসেস ক্রেগি হ্যালকেট) এই রকম বাদামি ডোরা ছিল। একটা সম্পূর্ণ সাদা বাঘ, যার গায়ের নকশা কেবল প্রতিফলিত আলোতে দেখা যেত, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক্সেটার চেঞ্জ মেনাজারি (চিড়িয়াখানা)-তে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং হ্যামিল্টন-স্মিথ তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। এটি সম্ভবত একটা ভারতীয় নমুনা ছিল। যদিও ডোরার উল্লেখ করা হয়নি, গোলাপী চোখ এবং দৃশ্যত "খাঁটি সাদা বা অ্যালবিনো" বৈশিষ্ট্যযুক্ত এক জোড়া তরুণ বাঘ ১৯২২ সালে কোচবিহার থেকে পাওয়া গিছল। ভি. এন. নারায়ণ এই তথ্য দিয়েছিলেন।

ভারতের বনভূমি সাদা বাঘের জন্মভূমি হলেও বন্য সাদা বাঘ বিংশ শতাব্দীর প্রথমেই রাজসিক শিকারের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল আমলে সাদা বাঘের রেকর্ড পাওয়া যায় আবুল ফজল আল্লামী বিরচিত আকবরনামার দ্বিতীয় খন্ডে শিকারের একটা রঙ্গিন চিত্র থেকে। ১৫৬১ সালে সম্রাট আকবর যখন মালব থেকে রাজধানী আগ্রায় ফিরছিলেন তখন পথে একটা বাঘিনীকে তার পাঁচটা শাবকসুদ্ধ দেখতে পান। শাবকদের মধ্যে দু’টো ছিল সাদা বাঘ। ব্রিটিশ আমলে প্রথম সাদা বাঘ সম্পর্কে জানা যায় ১৮২০ সালে।  ১৮৯২ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে ভারতের পুণা, আসাম, ওডিশা, ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর ও পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে বেশ ক’টা সাদা বাঘ শিকার করা হয়, যাদের কয়েকটার নমুনা কলকাতা জাদুঘর ও বিহারে সংরক্ষিত রয়েছে। ১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে আসামের উচ্চভূমিতে একটা সাদা বাঘ গুলি করে মারা হয়। ১৯০০ সালে একটা জীবিত সাদা বাঘ দেখা যায় মায়ানমার ও ভারতের মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আসামের উচ্চভূমিতে একটা চাবাগানে দু’টো সাদা বাঘ দেখা যায়। সেই থেকে বাগানটার নামকরণ করা হয় বগা বাঘ চাবাগিচা। আসামি ভাষায় বগা শব্দটার অর্থ সাদা। 

উপরের ছবিতে নন্দনকানন জুলজিক্যাল পার্কে বিশ্রামরত বাংলার সাদা বাঘ জিভ দিয়ে পাঞ্জা চাটতে ব্যস্ত। SLC45A2 জিনের মিউটেশনের জন্য মেলানিনের ঘাটতিতে লক্ষণীয় শারীরিক বৈশিষ্ট্য - তুষার নীল চোখ, গাঢ় বা উজ্জ্বল লালচে বাদামি ডোরাকাটা দাগ, নাক ও ঠোঁটে ধূসর গোলাপি ফোঁটা। থাবার রঙ গোলাপি বা কালো দু’রকমই হতে পারে, নির্ভর করে কতটা মিউটেশন হয়েছে তার ওপর।

১৯২০-১৯৩০ সালের মধ্যে শুধু বিহারে ১৫টা সাদাবাঘ মেরে ফেলা হয়। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির জার্নালে ১৭টা সাদা বাঘ শিকারের তথ্য পাওয়া গেছে। আলিপুর চিড়িয়াখানায় প্রথম সাদাবাঘ দেখতে পাওয়া যায় ১৯২০ সালে। ১৯২২ সালে, ভিক্টর নীতেন্দ্র নারায়ণের রিপোর্ট অনুসারে, দু’টো খাঁটি গোলাপী চোখের সাদা বাঘ, একটা পুরুষ এবং একটা স্ত্রী, কোচবিহার রাজ্যে গুলি করে মারা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের শীতকালে জিম করবেট একটা সাদা বাঘের ছবি তুলেছিলেন যার কথা তিনি ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো’ গ্রন্থতে উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৯ সালে নেপালের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী একটা সাদা বাঘ শিকার করেন।

বিশ্বদরবারে সাদা বাঘ পরিচিতি লাভ করে ভারতের মধ্যপ্রদেশের রেওয়া অঞ্চলের মহারাজাদের মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে রেওয়ার তৎকালীন মহারাজা গুলাব সিং জঙ্গল থেকে দু’বছর বয়সী একটা সাদা বাঘ ধরে এনে পাঁচ বছর ধরে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ গোবিন্দগড়ে পোষেন। এরপর ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জকে তা উপহার দেন। রেওয়া প্রাসাদের শিকারের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯০০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে রেওয়ার আশপাশের জঙ্গলে আরও আটটা সাদা বাঘ দেখা গিছল। রেওয়ার মহারাজা মার্তন্ড সিং ১৯৪৭ সালে শেষ একটা সাদা বাঘ শিকার করেছিলেন। এরপর ১৯৫১ সালে ৪টে স্বাভাবিক বর্ণের বাঘ মারেন ও সেগুলোর সঙ্গী একটা ন’মাসের পুরুষ সাদা শাবককে জীবন্ত ধরে আনেন গোবিন্দগড়ের প্রাসাদে। সেই সাদা শাবকটার নাম রাখা হয় মোহন। বেগম নামের এক সাধারণ বাঘিনী ও মোহনের মেলামেশায় যে শাবকগুলোর জন্ম হয়, তারা কেউ সাদা চামড়ার ছিল না। পরে রাধা নামের অন্য এক সাধারণ বাঘিনী ও মোহনের মিলনে ১৯৫৮ সালের ৩০শে অক্টোবর চারটে সাদা বাঘের জন্ম হয়- তিনটে মেয়ে ও একটা ছেলে। এভাবে এই প্রথম একটা সাদা ছেলে শাবকের জন্ম হলো। মোহনের ঔরসে রাধা চারবার গর্ভধারণ করে ১৪টা শাবকের জন্ম দেয়। তার মধ্যে ১১টা ছিল সাদা এবং তিনটে স্বাভাবিক রঙের। মোহন ১৯৬৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ১৯ বছর ৭ মাস বয়সে মারা যায়।  হিসেব করে দেখা যায় যে মোহন ১৯৭০-এর দশকের শুরু অবধি ৪৮টা সাদা বাঘের জন্ম দিয়েছিল। এই প্রথম ভারতে ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’-এর মাধ্যমে সাদা বাঘের জন্ম হয়। পরবর্তীতে নীলাদ্রি, হিমাদ্রি নামে দু’টো সাদা বাঘ এবং মালিনী নামে এক সাধারণ বাঘিনীর জন্ম দেয় রাধা। রেওয়ায় বাঘগুলো ৫৮ বারে মোট ১৭০টা শাবকের জন্ম দিয়েছিল, যার মধ্যে ১১৪টা (৬৭.০৫%) ছিল সাদা। মোহনের বংশধরেরা বর্তমানে ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক ও অভয়ারণ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সাদা বাঘগুলো স্বাভাবিক বর্ণের বাঘ থেকে বড়োসড়ো হলেও মোটেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় না। কারণ, ওদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা যথেষ্ট দুর্বল থাকে। তাই সাধারণ বাঘের তুলনায় ওরা বেশি রোগাক্রান্ত হয়। যেমন, শিলিগুড়ি সাফারি পার্কে রয়েছে কিক্কা। বছর কয়েক আগে সে দু’টো শাবকের জন্ম দিয়েছিল। তবে জন্মানোর পর থেকে শাবকরা দুর্বল ছিল। তাদের চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু তাদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। যত্ন না পেয়ে তার প্রথম শাবক মারা যায়।  এতটাই দুর্বল যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দ্বিতীয় শাবকের ওপর পড়ে গিয়েছিল। তাতে দ্বিতীয় শাবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। তারপরেই কিক্কার যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। উল্লেখ্য, জন্মগত সমস্যা ছিল ওই বাঘিনীর। তার পেছনের পা দু’টো উল্টোদিকে ভাঁজ করা। তাছাড়া কোমরের নিচের অংশ আগের থেকে অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তার চিকিৎসার জন্য প্রথমে কড়া ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি উলটে হাঁটুর নিচের অংশে ক্ষয় ধরা পড়েছিল। এই অবস্থায় শাবক প্রসব করার পরেই আরও দুর্বল হয়ে পড়ে কিক্কা।

রেওয়া থেকে নীলাদ্রি, হিমাদ্রি এবং মালিনীকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। এরাই আলিপুরের সমস্ত সাদা বাঘের আদি পিতামহ-পিতামহী। তারপর আলিপুর চিড়িয়াখানার সাদা বাঘ অনির্বাণ ও সাধারণ বাঘিনী কৃষ্ণার সন্তান দু’টো সাদা শাবক বিশাল (জন্ম ২০০৫) ও রূপা (জন্ম ২০০৬) ছোটো থেকে এক সঙ্গেই বড়ো হয়। রূপাকে চোখে হারাতো বিশাল। যদিও বিশালের প্রতি রূপার টান কোনো দিনই অতটা বোঝা যায়নি। কিন্তু তাদের এই মেলামেশা ভালো চোখে দেখেননি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। তাই যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পরেই প্রেমে নেমে আসে নিষেধাজ্ঞা। দু’টো আলাদা খাঁচায় পাশাপাশি তাদের রাখা হয় কারণ বিশাল ও রূপা একই মা বাবার সন্তান হওয়ায় তাদের মিলনে যে সন্তান জন্মাবে, তার জিনগত সমস্যা হতে পারে। আলাদা হওয়ার পরে অন্য কোনো বাঘিনীর দিকে ফিরেও তাকায়নি বিশাল। সময় অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে রূপার কাছে ফিকে হয়ে যায় পুরনো প্রেম। অন্য বাঘেদের সঙ্গে তার কিঞ্চিৎ বন্ধুত্বও হয়। চিড়িয়াখানা সূত্রের খবর, বেশ কয়েক বার চিড়িয়াখানার কয়েকটা সাধারণ বাঘিনীর সঙ্গে বিশালের মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রত্যেক বারই বিশাল প্রত্যাখ্যান করেছে সঙ্গিনীদের। চিড়িয়াখানায় বিশালের সঙ্গিনী হওয়ার মতো সাদা বাঘিনী নেই। অনন্যা নামে একটা সাদা বাঘিনী থাকলেও সে দীর্ঘ দিন ধরেই অসুস্থ। সম্ভবত সাধারণ বাঘের কমলা রং বিশালকে আকর্ষণ করত না।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৩ লাখ টাকা দিয়ে দু’টো বাংলার বাঘ কিনে আনা হয় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়। উদ্দেশ্য চিড়িয়াখানার বাঘের অভাব পূরণ করা। এর মধ্যে বাঘটার বয়স ছিল ১১ মাস, আর বাঘিনীর বয়স ৯ মাস। দু’টো কাঠের বাক্সসহ বাঘ দু’টোর ওজন ছিল ৪২০ কেজি। বাঘ দু’টোর নাম রাখা হয় ‘রাজ’ ও ‘পরী’। সেই দম্পতির ঘরেই ২০১৮ সালের ১৯শে জুলাই জন্ম নেয় নতুন তিনটে সাদা বাঘশাবক। এর মধ্যে অবশ্য একটা শাবক মারা যায়। বেঁচে থাকা দু’টো শাবকের মধ্যে একটা সাদা রঙের ‘শুভ্রা’, বাংলাদেশের প্রথম সাদা বাঘিনী  ও অন্যটা চিরাচরিত রঙের নাম ‘জয়া’। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় একটা খাঁচায় রাখা হয় বাবাকে; আরেকটা খাঁচায় মায়ের সঙ্গে রাখা হয় শুভ্রা ও জয়াকে। মূলত নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা। জন্মের পর মায়ের দুধ পান করতো সাদা বাচ্চাটা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরাচরিত মাংস খাওয়া শুরু করে এই সাদা বাঘও। প্রতিদিন ৬ কেজি মাংস খেত তারা। তাদের প্রথম পছন্দ গরু, এরপর মুরগির মাংস। ব্যতিক্রমী এই সাদা বাঘের এক বছর বয়স পার হলে দেখা যায় ২০০ গ্রাম ওজনের বাঘের বাচ্চা ৮০ কেজি হয়েছে। এভাবে ১৮ মাস পর্যন্ত বাঘগুলোকে মায়ের সঙ্গে রাখা হয়। এর পর ধীরে ধীরে পৃথক খাঁচায় নেওয়া হয়। আড়াই বছর পর তারা প্রজননক্ষম হবে। 

এরপর ২০২২ সালের ৩০ জুলাই আরও চারটে সাদা বাঘের জন্ম হয়। এক মাস আলাদা একটা খাঁচায় মা ‘পরী’র সঙ্গে তাদের রাখা হয়েছিল। পদ্মা, মেঘনা, সাঙ্গু ও হালদা- নদীমাতৃক বাংলাদেশের চারটে নদীর নামে নামকরণ করা হয়েছে এই চারটে সাদা বাঘ শাবকের। হালদা বাঘিনী, বাকি তিনটে বাঘ। প্রতিটা বাঘ শাবকের ওজন প্রায় দেড় কেজি। মায়ের দুধ পান করে বেড়ে উঠছে তারা। এক মাস পর মুরগির মাংস খেতে দেওয়া হবে বাঘ শাবকদের। এদের নিয়ে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বাঘের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬টা। এর মধ্যে পাঁচটা দুর্লভ সাদা বাঘ, তিনটে ছেলে ও দু’টো মেয়ে। শুভ্রার জন্মের অল্প কয়েক দিন পরই আরেকটা সাদা বাঘ জন্ম নেয় গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। এই বছরের এপ্রিলে আরেকটা সাদা বাঘের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায়। তবে এসব সাদা বাঘের মা–বাবা কিন্তু মোটেও সাদা নয়, বরং স্বাভাবিক সোনালি-হলুদ বর্ণের। সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা বাঘ এখন দুর্লভ।

অ্যালবিনো বাঘ দেখতে পুরোপুরি সাদা। অন্যদিকে সাদা বাঘের চোখ তুষার নীল ও গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলো গাঢ় বা লালচে বাদামী ও উজ্জ্বল, যা যে কোনো কোণ থেকেই সহজে চোখে পড়ে। এ ছাড়া সাদা বাঘের নাক ও ঠোঁটে ধূসর গোলাপি ফোঁটা থাকে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, একটা জিনের (বংশগতির নিয়ন্ত্রক) সামান্য পার্থক্যের কারণেই বাঘ কখনো সাদার ওপর ডোরাকাটা, কখনো বা কমলার ওপর ডোরাকাটা হয়ে থাকে। বাঘ কেন সাদা হয়? আসলে বাঘের মধ্যে বর্ণহীনতার (অ্যালবিনিজম) রেকর্ড থাকলেও সাদা বাঘ কিন্তু মোটেও বর্ণহীন (অ্যালবিনো) নয়। অবশ্য আগে অনেকের এমনই ধারণা ছিল। কোনো প্রাণীর শরীরের রঙের জন্য দায়ী জীবদেহের কোষের স্বাভাবিক রঞ্জন বা পিগমেন্ট। এই কোষের জিনের সামান্য পার্থক্যেই বাঘের শরীরের রং পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানীরা সাদা বাঘের দেহকোষের জিন পরীক্ষা করে দেখেছেন কোষের মধ্যে বিশেষ রঞ্জক জিন ‘এসএলসি৪৫এ২’ আছে। এই বিশেষ রঞ্জক কালো-হলুদ রং তৈরিতে বাধা দেয়। কিন্তু সাদা বাঘের গায়ে হাল্কা কালো ডোরার কারণ ‘এসএলসি৪৫এ’ জিনের মধ্যে ‘এ৪৭৭ভি’ নামক অ্যামাইনো অ্যাসিডের পরিবর্তন। সাদা বাঘের ক্ষেত্রে এই হলুদ রঞ্জক সৃষ্টিকারী জিন প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। তাই এই রঞ্জক তৈরির প্রক্রিয়া অ্যামাইনো অ্যাসিড পরিবর্তনের ফলে বা ‘পয়েন্ট মিউটেশন’-এর কারণে রাসায়নিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাদা বাঘের সবচেয়ে আশ্চর্যকর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রতি মুহূর্তে এর চোখের রঙ বদলায়। কিছুক্ষণ পরপর এর চোখ লাল, হলুদ, সাদা ও কমলা রঙ ধারণ করে। অ্যালবিনো ও সাদা বাঘের মধ্যে যে পার্থক্যগুলো রয়েছে, তা ভালোভাবে লক্ষ করলেই ধরা যায়। অ্যালবিনো বাঘের চোখ গোলাপি ও গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলো অস্পষ্ট, যা শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটা কোণ থেকে লক্ষ করলেই ধরা পড়ে। বাঘের এই বর্ণবৈচিত্র্য মূলত বাংলার উপপ্রজাতিতেই দেখা যায়, অন্যান্য উপপ্রজাতিতে নয়। অবশ্য সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু চিড়িয়াখানায় সাইবেরিয়ার সাদা বাঘ দেখা গেছে। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশে কেবল ভারতেই সাদা ও অ্যালবিনো বাঘ দেখার তথ্য রয়েছে। আশির দশকে বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানীরা সাদা বাঘ গবেষণায় দীর্ঘ পদক্ষেপ নেন। 

কালো বাঘ 

সাদা বা সোনালি রঙের হালকা ত্বকে গাঢ় কালো ডোরাকাটা বাঘ একেবারে বিরল। কালো বাঘকে দীর্ঘদিন ধরে পৌরাণিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ ধরনের কালো ডোরাকাটা বাঘের অন্যতম কারণ হলো জিনগত রূপান্তর। মিউটেশনের কারণে বাঘের স্বতন্ত্র কালো ডোরা খুব বড় ও মোটা হয়ে যায় এবং কমলা রঙের ওপর তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে ভারতীয় সুন্দরবনের ঝিলা-২ নম্বর জঙ্গলে সাধারণ বাঘের থেকে বিরাট আকারের একটি কালো বাঘ দেখার দাবি করেছিলেন সাতজেলিয়ার দুই মৎস্যজীবী; খাঁড়ির ধারে জাল টানার সময় তাদের আর এক সঙ্গী মৎস্যজীবীকে বাঘটি টেনে নিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে যায়। সুন্দরবনে কালো চিতা বেড়ালের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলেও, ক্যামেরার ফাঁদে এখনও কালো বাঘ ধরা পড়ে নি, অতীতেও এরকম বাঘ দেখার রেকর্ড নেই।

সারা বিশ্বে একমাত্র ভারতেই পাওয়া যায় এই কালো বাঘ। ওড়িশার সিমলিপালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কালো বাঘের দেখা মেলে। ওড়িশা বনবিভাগের বাঘ বিশেষজ্ঞ লালা অশ্বিনী কুমার সিং (১৯৯৯)-এর মতে, ১৯৭৫-১৯৭৬ সালে সিমলিপালের জঙ্গলে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে কালো বাঘ রেকর্ড করা হয়েছিল, যখন বন কর্মকর্তারা দুই বিদেশী পর্যটকের সঙ্গে একটা উজ্জ্বল শীতের দিনে মাতুঘর তৃণভূমির দিকে যাওয়ার রাস্তায় দু’টো পূর্ণবয়স্ক কালো বাঘ দেখেছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই একটা গ্রামের ছেলে এক কালো বাঘকে আত্মরক্ষার জন্য মেরে ফেললে বিষয়টা চাক্ষুষ প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঘটনাটা ঘটে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের পশ্চিমে ভান্দন নদী উপত্যকায় পোদাগাদ গ্রামে। বাঘটার দৈর্ঘ্য ছিল (নাকের ডগা থেকে লেজের ডগা) ১৯৫.৫ সেমি, মাথা (নাকের ডগা থেকে কান) ২৩ সেমি, লেজ ৭০ সেমি, সামনের কাঁধের উচ্চতা ৬৩.৫ সেমি, ওপরের শ্বাদন্ত ৬.৫ সেমি, নিচের শ্বাদন্ত ৫.৫ সেমি, কুকুরে দাঁত ২.৫ সেমি, পেছনের পাঃ বাম ১০.২ x ৭.৬ সেমি, ডান ১০.৭ x ৭.৬, সামনের পাঃ  বাম ৯.২ x ৯.০ সেমি, ডান ৯.৮ x ৮.১। এক সপ্তাহ আগে বাঘটা চার থেকে পাঁচটা ছাগলকে আহত করেছিল যা পরে গ্রামবাসীরা নিয়ে যায়। ২০শে জুলাই বাঘটা ৬৭ বছর বয়সী সুরাই বেসরার গোয়ালঘরে প্রবেশ করে এবং তাকে আহত করে, কিন্তু পরিবারের সবাই তাকে আক্রমণ করলে সে পিছু হটে। পরের দিন সকালে সুরাইয়ের ছেলে সালকু পাশের ভুট্টা ক্ষেতে বাঘটাকে দেখে। বাঘটা সালকুকে তাড়া করলে সে তার ঘরে ছুটে আসে এবং সেখান থেকে তিনটে তীর ছুড়ে বাঘটাকে হত্যা করে।

সাধারণ ডোরাকাটা বাঘ এবং কালো বাঘ একই প্রজাতি। কোনো কোনো বাঘের ত্বকে রঞ্জক পদার্থ মেলানিনের আধিক্য ঘটায় দেহের বর্ণ সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে কালো হয়ে যায়। সেগুলোকেই ‘সিউডো-মেলানিস্টিক টাইগার’, ‘ব্ল্যাক টাইগার’ বা কালো বাঘ বলা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, সাধারণ বাঘ দম্পতির দু’-তিনটে শাবকের মধ্যে একটার রং কালো। বস্তুত, বাঘের চেয়ে চিতাবাঘের (লেপার্ড) ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে অনেক বেশি। কালো চিতাবাঘকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’।

১৭৭৩ সালে, দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের কেরালায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে থাকাকালীন শিল্পী জেমস ফোর্বস কয়েক মাস আগে চোরাশিকারিদের গুলিতে মৃত একটা কালো বাঘের জলরং ছবি এঁকেছিলেন (স্টোনার, ১৯২৪)। তিনি সেই বাঘটার বর্ণনা দিয়েছেন।

I also have the opportunity of adding the portrait of an extraordinary Tyger [sic], shot a few months ago by the Nairs in this neighbourhood, and presented to the chief as a great curiosity. It was entirely black yet striped in the manner of the Royal-Tyger, with shades of a still darker hue, like the richest black, glossed with purple. My pencil is very deficient in displaying these mingled tints; nor do I know how to describe them better than by the difference you would observe in a black cloth variegated with shades of a rich velvet.

Rare Melanistic Tiger’s skin seized from fringe village of Similipal, four poachers arrested 

টাওয়ার অফ লন্ডন মেনাজেরিতে ইস্ট ইন্ডিজের একটা কালো বাঘ প্রদর্শন করা হলেও সেটা একটা কালো চিতাবাঘ হবার সম্ভাবনা বেশি ছিল। ১৭৮৬ সালে প্রকাশিত "সোফি ইন লন্ডন" বইতে এই বড়ো বেড়ালটার কথা বলা হয়েছে:

The all-black tiger, which Mr. Hastings brought with him from the East Indies is most handsome, but his tigery glance is horrible.

শুরুর দিকে কালো বাঘের সত্যাসত্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। ১৮৪৪ সালের ২৭শে জানুয়ারী ‘অবজারভার’ পত্রিকায় রেকর্ড রয়েছে যে জাভার রাজার কাছ থেকে নেপোলিয়নের জন্য উপহার হিসেবে একটা কালো বাঘ (সম্ভবত একটা কালো চিতাবাঘ) পাওয়া যায়। এই বাঘটা লন্ডনের পিকাডেলিতে কেন্ড্রিকস মেনাজারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৮৪৬ সালের মার্চ মাসে, প্রকৃতিবিদ সি.টি. বাকল্যান্ড চট্টগ্রামের পাহাড়ে (বর্তমানে বাংলাদেশে) একটা কালো বাঘের খবর দিয়েছেন। সেখানে সে গবাদি পশুদের ওপর আক্রমণ চালাতো। তাকে একটা বিষাক্ত তীর দিয়ে মারা হয়েছিল এবং তার দেহটা পরে যখন আবিষ্কৃত হয় তখন সেটা একদম পচে গিয়েছিল। ফলে সেটার সঠিক চিহ্নিতকরণ সম্পর্কে ধন্দ দেখা দেয়। ১৮৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে, কর্নেল এস. ক্যাপার শিকারির টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একটা সম্ভাব্য কালো বাঘের দেখার কথা বলেছিলেন; সেটা জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গিছল। সেই এলাকায় কালো চিতাবাঘের উপস্থিতি এবং দূর থেকে সঠিকভাবে আকার বিচার করার অসুবিধের ফলে এটাকে একটা সন্দেহজনক প্রতিবেদন করে তোলে। অবশ্য ই. পি. গি "দ্য ওয়াইল্ডলাইফ অফ ইন্ডিয়া" (১৯৬৪) বইতে কালো বাঘ দেখার  বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। 

সিমলিপালের কালো বাঘ

ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের শাল-পিয়ালের ঘন নওরঙ্গা রেঞ্জের জঙ্গলে বড়মকাবাড়ি এলাকা কালো বাঘের মূল ঘাঁটি। ২০১৮ সালের গণনায় এখানে ৮টা কালো বাঘ ছিল। তার পরের ২ বছরে এদের সংখ্যা ১০ থেকে বেড়ে ১৩টা কালো বাঘের বাস সিমলিপালে। এখানে বাঘেদের চামড়ায় মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তারা হয়ে যাচ্ছে মেলানিস্টিক টাইগার বা কালো বাঘ। বাঘের হলুদ ডোরা এ ভাবেই কালোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ বাঘের জিনগত সমস্যা। ওই নির্দিষ্ট এলাকায় যে ক’টা বাঘ থাকে, মিলন হচ্ছে তাদের মধ্যেই। যাকে বলে ‘ইনব্রিডিং’। এদের মধ্যে অন্তত একটা বাঘের জিন মেলানিস্টিক [transmembrane aminopeptidase Q (Taqpep)]। ফলে তার জিনগত বৈশিষ্ট্যই ছড়িয়ে পড়ে বাঘেদের কালো বানিয়ে দিচ্ছে। ঠিক যেমন এর বিপরীত ঘটনাতে চামড়ার রং অত্যধিক সাদা হয়ে গিয়ে অ্যালবিনো বা সাদা বাঘের জন্ম হয়। ‘ট্যাকপেপ’ জিন সব বাঘের জিনোমেই আছে এবং এর থেকে যে প্রোটিন-উৎসেচক তৈরি হয় সেটাই গায়ের ছোপ/ডোরা কেমন হবে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। সিমলিপালের কালো বাঘেদের এই ট্যাকপেপ জিনে ছোট্ট একটা পরিবর্তন (বা ‘মিউটেশন’) ঘটে গেছে। তাই তার থেকে তৈরি ‘ট্যাকপেপ’ প্রোটিন-এর কার্যক্ষমতা পাল্টে গেছে, আর তার ফলে গায়ের ডোরাকাটা দাগগুলো ঘন কালো এবং চওড়া হয়ে উঠেছে। এ জিনিস বন্ধ করার একমাত্র উপায় বাঘেদের মধ্যে জিন বৈচিত্র্য বাড়ানো অর্থাৎ সিমলিপালের বাঘেদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া কিংবা অন্য কোথাও থেকে বাঘ এনে সিমলিপালে ছেড়ে দেওয়া।

আগেই বলেছি সিমলিপালের জঙ্গলে এদের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেছিল সেই ১৯৯৩ সালে। সেবার বাঘটি এক সাঁওতাল কিশোরকে টেনে নিয়ে যায়। ২০০৭ পর্যন্ত অনেক বছর  তাদের আর দেখা পাওয়া যায় নি সেখানে। এরপর ধীরে ধীরে তারা ফের ফিরতে শুরু করে। কিন্তু বনদপ্তরের ট্র্যাপ ক্যামেরাতেই প্রথম দেখা গেল অদ্ভুতদর্শন এই ঘন চওড়া কালো ডোরার বাঘ। একটা সাড়ে তিন বছরের কালো পুরুষ বাঘের মৃতদেহ ২০২৩ সালের ১লা মে প্রকল্পের কোর এলাকায় নাওয়াঙ্গা রেঞ্জের বাদামাক্কাবাদিতে পাওয়া গিয়েছিল। বন কর্মকর্তারা বলেছেন যে বাঘটার দেহে আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে মনে করা হচ্ছে এটা অন্য কোনো এক পুরুষের সঙ্গে আঞ্চলিক লড়াইয়ের কারণে মারা গেছে।

পান্ডে (২০১৬: ২০-২১) এই কালো বাঘের আধিক্যের ফলে বিপন্ন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বে অশনি সংকেত দেখিয়েছেন।

The black tiger like the white tiger is an aberration of the Royal Bengal tiger and has no conservation value. The increased sightings of black tigers is not a cause for celebration but gives an ominous message that inbreeding depression is putting the existence of the already highly endangered Royal Bengal Tigers at stake.

মেলানিজ়মের আধিক্য কমিয়ে সিমিলিপালের বাঘের হলুদ-কালো ডোরাদার স্বাভাবিক অবয়ব ফেরাতে তাডোবা-আন্ধেরি ব্যাঘ্রপ্রকল্প (মহারাষ্ট) থেকে জ়িনত ও যমুনাকে এনেছিলেন সিমিলিপাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারাও বিবাগী হয়ে যায়। বাঘিনি জ়িনত চলে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গল মহলে। আর বাঘিনি যমুনাও একই সময় সিমিলিপাল ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল বালেশ্বর জেলার কুলডিহা অভয়ারণ্যে।  

সোনালি বাঘ ('ট্যাবি টাইগার' বা 'স্ট্রবেরি টাইগার')

সোনালি বাঘ হলো সাধারণ বাঘ বিশেষত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একটা বর্ণসংকর। বিশেষ জিন মিউটেশনের কারণে এদের গায়ের লোম কমলা না হয়ে হয় সোনালি। যেহেতু এরা বাংলার বাঘের বর্ণসংকর, তাই এদের আকার স্বাভাবিক বাঘের মতই হয়। পুরুষদের ওজন ১৭০-২৫৮ কেজি, আর স্ত্রীদের ওজন ১০০-১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়। এই বাঘগুলো ডোরাহীন বা প্রায় ডোরাহীন হয়। বিশেষত পেটের দিকে ডোরা থাকেই না। বিংশ শতকের শুরুর দিকে এই বাঘ বনে পাওয়া যেত বলে জানা যায়। ১৯৩২ সালে শেষ এক জোড়া বন্য সোনালি বাঘকে মহীশুরের বনে শিকার করা হয়েছিল। ভীম ও সুমিতা নামে পোষা ভাই-বোনের মিলনে এই জিনের উদ্ভব ঘটায়। এরাই পালিত সোনালি বাঘের পূর্বপুরুষ মনে করা হয়। কিছু সোনালি বাঘ নানা চিড়িয়াখানায় থাকার কথা শোনা গেছে। সোনালি বাঘের সংখ্যা ৩০-এরও কম। বাংলার বাঘ ও সাইবেরিয়ার বাঘের মধ্যেও এই পরিব্যক্তির কথা জানা গেছে।

প্রথম নিশ্চিত বন্দি অবস্থায় জন্ম নেওয়া সোনালি বাঘ ১৯৮৭ সালে পাওয়া যায় (১৯৮৩ সালে একটা সোনালি বাঘের জন্মের প্রতিবেদন রয়েছে, তবে এটা যাচাই করা যায় নি)। ১৯৮৭ সালে জোসিপ মার্কানের দু’টো সোনালি বাঘ ছিল- একটা তিন মাস বয়সী বাঘ এবং একটা তিন সপ্তাহ বয়সী বাঘিনী- যার মূল্য ছিল ৬০০,০০০ ডলার। স্পষ্টতই সোনালি রঙের বাঘ পেতে কয়েক বছর প্রজনন প্রচেষ্টা করতে হয়েছে। 

undefined 

একবিংশ শতকে, সম্ভবত বিশ্বে একমাত্র কাজিরাঙার জঙ্গলেই দেখা মিলেছে একটা সোনালি বাঘের। ২০১৬ সালে ক্যামেরা ট্রাপে প্রথম এর ছবি পাওয়া যায়। বাঘটার মুখ এবং দেহের নিচের অংশ সাদা, যখন শরীরের ওপরের অংশ হালকা লাল-বাদামী ডোরা সহ ফ্যাকাশে কমলা রঙের (দাস ও অন্যান্য, ২০২১)। বাঘটাকে ঘাসবনে বেশি দেখা যায়। ছবিতে দেখা গেছে একাধিক গণ্ডার যখন তৃণভূমিতে ঘাস খাচ্ছে, সেই সময় বাঘটি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এইভাবে গণ্ডারের সঙ্গে রয়াল বেঙ্গল টাইগারকে দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু যখন বাঘ কিছু শিকারের লক্ষ্যে থাকে তখন তারা এই ভাবে গণ্ডারের চারণ ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে। একে একা একাই কাজিরাঙায় ঘুরতে দেখা যায়, এমনকি দিনের বেলাতেও। এটা রয়্যাল বেঙ্গলের এক বিরল বর্ণসংকর। যা জিনের পশ্চাৎমুখী গঠন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া বাঘেদের আন্তঃপ্রজননের কারণে হয়ে থাকতে পারে। সোনালি বাঘিনি ১০৬এফ-এর বয়স ২০২০ সালে ছিল সাত বছর। অন্য বাঘের সঙ্গে লড়াইতে সামনের বাঁ পা ও নাক জখম হয়েছিল সোনালি বাঘিনীটার। ২০১৭ সালে নীলগিরি জীবমন্ডলে এই রকম একটা বাঘের দেখা পাওয়া গেছে।

নীল বাঘ

পঞ্চতন্ত্রে কৃত্তিম নীল শেয়ালের উল্লেখ আছে। আর এই বাঘের পশম নীলাভ এবং তার ওপরে গাঢ় ধূসর ডোরাকাটা। কেউ কেউ বলেন নীল বাঘ বলে কিছু নেই, সবটাই উদ্ভট কল্পনা নয়তো বাংলার বাঘের বিরল রূপান্তর। যত নীল বা মাল্টিজ বাঘ দেখা গেছে, তার বেশিরভাগই দক্ষিণ চীনা উপ-প্রজাতির এবং বেশিরভাগই চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে দেখা যায়। তবে, কোরিয়ায় সাইবেরিয়ার বাঘের শেষ আবাসস্থল থেকেও "নীল" বাঘের খবর পাওয়া গেছে। 

হ্যারি আর কল্ডওয়েল (১৯২৫), এক খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক এবং বড়ো শিকারি (ভারি অদ্ভুত শখ, ধর্মপ্রচারকের শিকারি হওয়াটা শকিংও বটে!), একটা মাত্র নীল বাঘের উদাহরণ দিয়ে বলেছেনঃ

…the markings of the animal were marvellously beautiful. The ground colour seemed to be a deep shade of maltese, changing into almost deep blue on the underparts.

 

এই বাঘের গায়ের ডোরাগুলো একটা সাধারণ বাঘের মতোই অর্থাৎ এটা আংশিকভাবে মেলানিস্টিক। ক্যালডওয়েল ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাঘটাকে দেখেছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব চীনের ফুজিয়াহ (পূর্বে ফুকিয়েন) প্রদেশের ফুটসিং অঞ্চলে। খুব কাছ থেকে এই বাঘটি দেখতে পেয়ে তিনি প্রথমে তাকে গাঢ় নীল পোশাক পরা একজন পুরুষ ভেবেছিলেন। 

অবশ্য ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তিনি বিশ্বের কাছে এর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য এটিকে গুলি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কাছাকাছি দু’টি শিশুকে দেখতে পান। শিশুদের ক্ষতি করতে না চাওয়ার জন্য তিনি নিজের ইচ্ছেকে সংবরণ করেন, কিন্তু ততক্ষণে বাঘটা চলে গেছে। 

এরপর ক্যাল্ডওয়েল নীল বাঘের জন্য অনেক ব্যর্থ অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন এবং তাঁর ছেলে জন সি. ক্যাল্ডওয়েলও সাথে ছিলেন। বেশ কয়েকবার জন পাহাড়ি পথ ধরে যাবার সময় মাল্টিজ রঙের লোম দেখতে পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। ক্যাল্ডওয়েলের অনুসন্ধান তাঁর বই "ব্লু টাইগার" (১৯২৪) (ওপরের ছবিতে দ্রষ্টব্য) এবং তাঁর শিকার সঙ্গী রয় চ্যাপম্যান অ্যান্ড্রুজ (আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সহযোগী কিউরেটর এবং ১৯১৬-১৯১৭ সালের মিউজিয়ামের এশিয়াটিক জুওলজিক্যাল এক্সপিডিশনের নেতা) তাঁর "ক্যাম্পস অ্যান্ড ট্রেইলস ইন চায়না"  (১৯২৫, অধ্যায় সপ্তম) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। 

১৯৬০-এর দশকে ওকলাহোমাতে একটা ধোঁয়াটে নীল ছদ্ম-মেলানিস্টিক বাঘের জন্ম হয়েছিল। রিচার্ড পেরি তাঁর "দ্য ওয়ার্ল্ড অফ দ্য টাইগার" বইতে পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে চীনের নীল বাঘগুলোকে নীল শয়তান বলা হতো কারণ তারা প্রায়শই মানুষ শিকার করে খেতো। এছাড়াও চীনের অন্যান্য অংশে নীল বাঘের ঘটনা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে (হিউভেলমান্স, ১৯৮৬)। 

সম্প্রতি, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে মাঝেমধ্যে নীল বাঘের উপস্থিতির খবর পাওয়া গেছে। ক্যাল্ডওয়েলের শিকার অভিযান ইঙ্গিত দেয় যে নীল বাঘগুলি দুর্গম অঞ্চল পছন্দ করে যেখানে মানুষের সাথে তাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। যেহেতু উত্তর কোরিয়ার সরকার বাইরের লোকদের প্রবেশাধিকার দেয় না, তাই তাদের দেখা সম্পর্কে তদন্ত করা সম্ভব হয় নি। 

বেশিরভাগ মাল্টীজ দক্ষিণ চীনের উপপ্রজাতি বর্ণসংকর। নীলবর্ণসংকর সম্ভবত বিলুপ্ত। সাইবেরিয়ার বাঘদের মধ্যেও নীলবাঘের খবর পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন, এরকম বর্ণসংকর হওয়া প্রায় অসম্ভব। শুকার বলেন যে নীল বাঘের দু’টি ভিন্ন জোড়া রিসেসিভ অ্যালিল থাকে- নন-আগোটি (s/s), এবং পাতলা (d/d) যা একত্রিত হয়ে একটি ঘন নীল-ধূসর রঙ তৈরি করে দেয় যা ব্রিটিশ নীল এবং রাশিয়ার নীল গৃহপালিত বেড়ালে দেখা যায়, কিন্তু ডোরাকাটা নীল বাঘ তৈরি করে না। তাই আজও নীল বাঘ বিশ্বের রহস্যময় বড়ো বেড়ালদের মধ্যে অন্যতম।

আলোকচিত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার - জয়ন্ত কুমার মল্লিক, সপ্তর্ষি রক্ষিত ও অনুরাধা বিশ্বাস 



 

0 Comments
Leave a reply