সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারে

লিখেছেন:রিঙ্কু চট্টোপাধ্যায়

 

৮ জানুয়ারি ২০২৪, ভোর পাঁচটা পাঁচ

বাপী ভাই এর টোটো চড়ে চলেছি পুরুলিয়া স্টেশনে। এই প্রথম তিনদিনের জন্য একা যাচ্ছি।

গন্তব্য সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার গোসাবা।

আমার উনি বার বার সতর্ক করে দিয়েছেন চলাফেরা যেন  সাবধানে করি।

শীতের এই ভোরের পুরুলিয়া কুয়াশাজড়ানো। তার মাঝেই দু একটা কোলকাতার নাইট বাস পুরুলিয়া ফিরছে। ওভারব্রিজ ছেড়ে বাগালবাবার আশ্রমের পাশ দিয়ে উঠলাম ঘাটকালী মন্দিরের সামনে, পাশেই রাজাবাঁধ। এখানেই একসময় পুরুলিয়ার যাবতীয় প্রতিমা বিসর্জন হত। ডানদিকের পরিত্যক্ত জমিতে এখন ফ্ল্যাট উঠেছে, লজ হয়েছে। নামোপাড়া হরিমন্দির দুর্গামণ্ডপের পাশ দিয়ে রথতলা। এই তেমাথার বাঁয়ে ঘুরতেই ছাউনি ঢাকা পুরুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী মণিবাঈজীর রথ রাখা আছে। ছোট্ট একটা পার্ক, পার্টি অফিস বাঁয়ে আর ডাইনে মহেশ্বরী লজ বছরখানেক হল হয়েছে। এপাড়ায় বেশ কয়েকটা পুরোনো বাড়ি এখনো রয়ে গেছে। সেসব পেরিয়েই স্টেশনের চূড়া, নতুন লাগানো আলোয় আলোকিত। বড় একটা হনুমান মন্দির সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে, সাথে শিবঠাকুর, গণেশও পূজিত হন। বাপি আমাকে এক্কেবারে স্টেশনের মুখে এনে নামিয়ে বলল, "সাবধানে যাবেন।"

ভোর পাঁচটা তেত্রিশ

এইমাত্র ট্রেন ছেড়েছে।

থ্রি টিয়ার কামরায় আমার সামনের মাঝবয়সী মহিলার ছেলে তাকে ছাড়তে এসেছিলেন। একেবারে শেষমুহূর্তে ওনারা কামরা খুঁজে উঠেছিলেন। এক্সপ্রেস ট্রেন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি হন্তদন্ত হয়ে ওই অবস্থায় ট্রেন থেকে নেমেছে। ভদ্রমহিলা ফোন করে ছেলের খবর নিচ্ছেন। আসলে অল্পবয়সী ছেলেরা এই ঝুঁকি নিয়ে ফেলে, নেহাৎ এখানে ছেলেটির কিছু হয়নি, কিন্তু হতে পারত। মহিলা এখন ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন।

এদিকে এই কামরায় প্রতিটি আসনের জন্য চাদরের প্যাকেট এখনো দিয়ে যায়নি। আমি আগে এসে একটা পেয়েছি, কিন্তু ভদ্রমহিলা বসে আছেন। যাই দেখি আরেকটা কোথাও পাই কিনা!

সকাল সাড়ে নটা

ট্রেন গিরিময়দান ছেড়ে খড়্গপুর ঢুকছে। বি ওয়ান কামরার তেত্রিশ নং লোয়ারে শুয়েই ছিলাম।

হকারের হাঁকডাকে বুঝলাম এই লাইনের আপাতত শেষ স্টপেজ এসে গেছে। এরপরই সাঁতরাগাছি, তারপর হাওড়া। আমি সাঁতরাগাছিতেই নেমে শেয়ালদা যাব ক্যাবে। কেননা এই ট্রেন খড়গপুর পর্যন্ত তার নির্দিষ্ট গতিতে এলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে এখন রোজই দেরি করছে! গুগল আর পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা তাই বলে।

আমার উনি ফোন করে কিছু খেয়ে নিতে বললেন, ব্যাগে বিস্কুট আর জ্যুস আছে, তাই খেয়ে নিই। সামনের মহিলা ঘুগনি খাচ্ছেন। আমাকেও অফার করেছিলেন। কিন্তু আমার পেটের অবস্থা খুব একটা ভাল না, তাই সবিনয়ে না বললাম।

বেলা এগারোটা বেয়াল্লিশ

সাঁতরাগাছি স্টেশনে নামলাম। শুরু হল ছোটা, সবাই এখানে ছুটছে, কেউ ট্রেন ধরবে, কেউ বাস ধরবে, আবার কেউ অফিসে হাজিরা দেবে!

আমিও তাদের সাথে এগিয়ে চলেছি। প্রথমে সাবওয়ে দিয়েই যাই দেখি কোন ট্যাক্সি পাই কিনা!

বেলা বারটা পাঁচ

সাবওয়ের বাইরে ট্যাক্সিওলাদের গলাকাটা ভাড়া শুনে আমার মত বেশ কয়েকজন আবার সাবওয়ের ভেতর দিয়ে ফিরে এসে স্টেশনের প্রিপেড ট্যাক্সি বুকিং এর সামনে লাইন দিয়েছি।

কিন্তু এ কী! দুজনের পর লাইন থমকে! ও, উনি বললেন গাড়ি নেই। এলে দেওয়া যাবে। অথচ বাইরে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে হাঁকছে, "কোথায় যাবেন!"

ঠিক এটাই হাওড়া স্টেশনে হয়। তাহলে আর কি লাভ হল এখানে নেমে!

দুপুর একটা পাঁচ

অনেক দরাদরি করে একটা প্রাইভেট গাড়ি শেয়ারে পাঁচশো টাকা দিয়ে শেয়ালদায় এসে নেমেছি।

ক্যানিং অবধি টিকিট কেটে হলদিরামের রেস্টুরেন্টে বসে আছি, মেয়েও এসে পৌঁছে গেছে ডায়মন্ড হারবার লোকালে। এবার কিছু খেয়ে একটা চল্লিশের ক্যানিং লোকাল ধরব।

বেলা তিনটে

সূর্য প্রায় হেলেছে পশ্চিমে, আর একটু পরেই ক্যানিং পৌঁছে যাব। এ যাত্রায় এক যুদ্ধজয় করলাম।

মেয়ের ইচ্ছেয় মহিলা কামরায় উঠে এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা হল।

ফাঁকা ট্রেনে জানালার পাশাপাশি মা মেয়ে বসেছিলাম, একটু পরেই সব আসন ভর্তি হল, গাড়ি ছাড়ল।  পার্কসাকাস, বালিগঞ্জ, যাদবপুর, ঢাকুরিয়া থেকে দলে দলে কাজ করতে আসা মহিলারা উঠে তিনজনের বসার জায়গায় চারজন তো বসলই, আবার দুই আসনের মাঝের জায়গায় দুদিকে মুখ করে তিন তিন ছজন দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের ব্যাগ থেকে বের হল লোহার আঁকশি। যেটা ট্রেনের হ্যান্ডেলে লাগিয়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চেপ্টাচেপ্টি হয়ে।

আমাদের বলা হল সোনারপুর এলে উঠতে হবে।

এনারা এই অলিখিত নিয়মেই প্রতিদিন যাতায়াত করেন। একদল ওঠে একদল বসে! সেই চিড়ে চ্যাপ্টা মহিলাকুলের ফাঁক দিয়ে আমলকী, বাদাম, জিভেগজা, শসা, কমলালেবু, চুড়ি-মালা-দুলের পসরা নিয়ে হকারেরা যাচ্ছেন। ওনারা কিনছেনও কেউ কেউ। কেউ ঝগড়া করছে বসার জায়গা নিয়ে তো কেউ গল্প জুড়েছে মনিব গিন্নীর ব্যবহার নিয়ে। এভাবেই সোনারপুর থেকে লাইন বদলে ট্রেন ছুটল বিদ্যাধরপুর, কালিকাপুর, চম্পাহাটি, পিয়ালী, গৌড়দহ, ঘুঁটিয়ারি শরীফ, বেতবেরিয়া ঘোলা, তালদি পেরিয়ে।

আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হল। একে একে অনেকেই নেমে গেছেন। ফাঁকা আসনগুলো একটু আগেই কত মূল্যবান ছিল, দখল করার কী চরম লড়াই! এখন যেন মূল্যহীন হয়ে বেবাক হাসছে।

বিকেল চারটে

ক্যানিং স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে কোনো অটোর দেখা পেলাম না, আমাদের যেতে হবে গদখালি জেটি। তাই পঞ্চাশ টাকা টোটো ভাড়া দিয়ে আসতে হল ক্যানিং অটোস্ট্যান্ডে সেখানে একটি ছেলে পাঁচশো টাকায় রাজী হল আঠাশ কিলোমিটার দূরে গদখালি জেটি পৌঁছে দিতে।

এখন তারই অটোতে চলেছি গদখালি, পথে পড়ল মাতলা ব্রীজ, কুলতলি, বাসন্তী সোনাখালি।

একটা জায়গায় রাস্তা চলে গেছে ধামাখালি হয়ে সরবেড়ি মোড়, সন্দেশখালি যেখানেই কদিন আগে কুখ্যাত শেখ সাহাজাহানের বাড়ির সামনে ইডির অফিসারদের ওপর হামলার ঘটনায় মিডিয়াকুল সরগরম ছিল!

বিকেল চারটে পঁয়ত্রিশ

বিদ্যাধরী নদীর ওপর একটা ছোট্ট লঞ্চে উঠেছি, ওপারেই গোসাবা জেটি।

এই নদীপথে ভটভটি নৌকোয় একরাশ নিত্যযাত্রী প্রতিদিন আনাগোনা করে, আর আছে ট্যুরিস্ট লঞ্চ, ছোট, বড়, মাঝারি। এই বেসরকারি লঞ্চ মালিকেরা নিয়মিত সুন্দরবন ভ্রমণ করায়।

আমারা যে বিশ্বাস হোমস্টেতে উঠব, তার মালিকের বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে কয়েকটি লঞ্চও আছে। আমরা অবশ্য কোলকাতা থেকে আগত একজন পর্যটকের সঙ্গে এই লঞ্চে চড়েছি ভাড়া মাথা পিছু পঞ্চাশ টাকা। ভটভটি নৌকোয় এই পারাপার টুকুর ভাড়া মাত্র পাঁচ টাকা।

কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সময় বাঁচাতে এই লঞ্চেই চড়েছি।

বিকেল পাঁচটা

বিশ্বাস হোমস্টের নবনির্মিত একটি ঘরে এসে উঠেছি।  কৈলাসবাবুর কর্মচারী আমাদের অনেকগুলো ঘর দেখিয়েছেন। তার মধ্যে এই ঘরটিই আপাতত আমাদের আজকের আস্তানা।

জেটিতে নেমেই গোসাবা বাজার। সোজা এসে ডাইনে বেশ কতগুলো দোকান পেরিয়ে রাস্তার দুপাশ জুড়ে নদীর পাড় জুড়ে বিশ্বাসবাবুর স্থাবর সম্পত্তি যার বেশিরভাগটাই লজ আর হোটেল। আছে বেশ কখানা দোকানঘরও।

উনি আবার এ অঞ্চলের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও! ওনার ব্যস্ততার সুযোগে কর্মচারীরা কাজে ফাঁকি দেয়, আর তাই বুঝি বহুল ব্যয়ে নির্মিত ঘরগুলো পরিচর্যাহীন। বালিশ, বিছানার চাদর অপরিচ্ছন্ন, বাথরুম বেসিন-আয়নাহীন। ঘরে একটা বিছানা ছাড়া দুটি ফাইবারের চেয়ার আর ছোট একটা টি টেবিল ছাড়া অন্য কোন আসবাব এমনকি জামাকাপড় ঝোলানোর কোন ব্যবস্থাও নেই।

মেয়ের কাজ নিয়ে আসা, তাই ভাবছি কাজ শেষ হলেই এবারের মত গোসাবাকে টাটা বাই বাই করব।

কর্মচারীটিকে বার বার বলে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার আর ঘরের বাইরে বারান্দায় একটা জলের ড্রাম কলসহ ব্যবস্থা করলাম। এখানে খুব ঠাণ্ডা, অনেকটা পুরুলিয়ারই মত।

রাতের খাবার অর্ডার নিয়ে গেল। মেয়ের জন্য চিকেন ভাত আর আমার রুটি বলেছি। যাই একটু হেঁটে আসি।

রাত নটা

বসে আছি অপেক্ষায়, কখন খাবার জন্য ডাক আসবে!

সন্ধ্যেবেলা গোসাবা বাজারে ঘুরতে গিয়ে দেখলাম অত্যাবশকীয় সমস্ত পণ্য যেমন আসবাবপত্র, সাজগোজ, কাপড়চোপড়, রাস্তার ধারে চা, ভাজাভুজি,মিষ্টির দোকান থাকলেও খাবার হোটেল সেভাবে চোখে পড়ল না। এক মনোহারী দোকানে এটাসেটা দেখলাম, মেয়ে দুজোড়া শাঁখাপলা কিনে দিল। দোকানীকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন পাখিরালয় এর দিকে ভাল ভাল রেস্টুরেন্ট, হোটেল আছে। অগত্যা অপেক্ষায় আছি কখন খাবার আসবে!

৯ জানুয়ারি ২০২৪, সকাল সাড়ে নটা

বসে আছি গোসাবা বিডিও ঘাটের পাশে একটা ছিমছাম চায়ের দোকানে। দোকানের মালকিন রূপা বিশ্বাস, আমার চেয়ে কিছু ছোটই হবে। নিজেই খুব যত্ন করে আমার জন্য চিনি ছাড়া চা বানাচ্ছে। আর কোন কর্মচারী দোকানে দেখছিনা। আমার সামনে আরো দুজন একটু আগে চা খেয়ে গেলেন। ওনারা আমাকে এ জায়গায় নতুন দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কবে এসেছি, কোথায় উঠেছি এইসব। রূপা একই সঙ্গে পরিষ্কার ডেকচিতে ভাত, তরকারিও রান্না করছে দেখছি! সে জানাল, থানা আর বিডিও অফিসের কয়েকজন ওর কাছে দুপুরে ভাত খায়। মনে পড়ে গেল গতকাল রাত প্রায় সাড়ে দশটায় অনেক অপেক্ষা, বার বার ফোন করার পর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হোমস্টের বাইরের উঠোনে যখন খেতে এলাম, দেখি দুজনকেই ভাত খেতে দিয়েছে। বলল আমি নাকি ভাতই চেয়েছি। রুটি চাইলে দেরি হবে। এসেছি সুন্দরবন অঞ্চলের গোসাবা আইল্যান্ডে। যা পাই তাই সই, আর দেরি না করে খেতে বসেছিলাম।

ভাতটাই যা গরম ছিল বাকি ডাল,সবজি,আলুভাজা এমনকি চিকেনটাও খুব ঠাণ্ডা। কোনরকমে তাই খেয়ে আমরা মা মেয়ে ঢুকে পড়েছিলাম কম্বলের তলায়। সামনে এই পরিচ্ছন্ন রান্না দেখে মনে হচ্ছে আজ দুপুরে এখানে খেলেই হত! কিন্তু.......

সকালে বেরিয়েছিলাম নদীর তীর বরাবর গোসাবা গ্রাম দেখতে। মেয়ের রিসার্চের কাজ যে ফিশারি অফিসার দাদার মাধ্যমে হবে তিনি রোজ কল্যাণী থেকে যাতায়াত করেন। তিনি আসবেন তারপর মেয়ের সঙ্গে তার কাজ। হোমস্টে থেকে বেরিয়ে একদিকে বাজার, অন্যদিকে ঘাটের পাশে পাশে ছোট ছোট দোকান, মাঝে মাঝারি মাপের রাস্তা - যে রাস্তায় টোটো ছাড়া অন্য কোন যানবাহন চলতে দেখছিনা। রাস্তার অন্য পাশে পর পর থানা, ফুলে ভরা সৎসঙ্গ আশ্রম আর তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে চলে গেছে গ্রামে যাবার ঢালাই পথ।

থানা আর সৎসঙ্গ আশ্রমের মাঝে একটা বড় মাঠ, রূপার এই দোকানের সামনে থেকেই সেই মাঠ দেখা যাচ্ছে। রূপা বলল মাঠের ওপারেই বিডিও অফিস।

আমাদের আজ ওখানেই যেতে হবে।

চা খেতে খেতে রূপার সাথে গল্প হল; ওর শ্বশুর বাড়ি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে, এখানে ওর বাবার বাড়ি। বাবার মৃত্যুর পর ও আর ওর বর এসে এখানে এই দোকান দিয়েছে। আগে এখানেই বাবার মাছের আড়ৎ ছিল। একটিই ছেলে রূপার। সে এখন ব্যাঙ্গালোরে নার্সিং পড়ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে গোসাবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি করবে, বা অন্য কোথাও....!

দোকানের পেছনেই রূপাদের বাড়ি, নদীর পাড় ঘেরা উঠোনে মা মেরির মূর্তি। রূপারা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান।

অথচ হিন্দুদের মত শাঁখা, সিঁদুর পরে। ওরা ভালবেসে এই বাঙালি আচারটুকু আপন করে নিয়েছে।

সামনেই ঝুড়িতে রাখা ছোট ছোট ডিম দেখে আগ্রহী হলাম। ও বলল, বাড়ির হাঁসের ডিম, খাবেন?

বললাম সেদ্ধ করে রাখ, মেয়েকে নিয়ে আসছি।

বেলা এগারোটা

মেয়েকে নিয়ে এসে রূপার যত্ন করে বানিয়ে দেওয়া পাঁউরুটি, ডিমসেদ্ধ চা দিয়ে সকালের খাওয়া সেরে আশ্রমের পাশেই সৎসঙ্গ পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। একটু দূরেই নদীর বুকে বালি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।

ওদিকে রাস্তা থেকে একটু নীচুতে স্কুলের উঠোনে এখন শিশুদের মেলা, সঙ্গে বাবা-মায়েরাও আছেন অনেকেই। দু একজন সাইকেলে বা মোটর সাইকেলে আসছে। গতকাল থেকে আজ অবধি এখানে কোন চারচাকা গাড়ি চোখে পড়েনি। ধুলো, ধোঁয়া বর্জিত দক্ষিণপ্রান্তের নদীচরের পাড় বরাবর বাঁধানো উঁচু রাস্তার ওপারের নীচু জমিতে স্কুল, ঢুকতে হলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়।

ঢং ঢং ঘন্টা বাজল, ছেলেমেয়েরা সব জড়ো হয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। এক মাস্টারমশাই সবার উদ্দেশ্যে বলছেন,"বাচ্চারা তাড়াতাড়ি স্কুলে না আসার জন্য স্কুলের পঠনপাঠন এর দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই বাবা মায়েরা বাচ্চাদের সময়ে নিয়ে আসবেন।"

ওই তো এবার শুরু হল প্রার্থনা।

জনগণমন, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।

সমবেত একদল কচিকাঁচার গলায় একলাইন গান গাওয়ার পর আরেকদল উচ্চকিত গলায় সেই সুর এক স্কেল ওপরে ধরে গাইল, আবার পরের লাইন প্রথম দল নীচের সুরে, পরের দল তার সপ্তকে।

এই অভিনব জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে ওরা ওদের প্রার্থনা সঙ্গীত শেষ করে ক্লাসে চলল। লাইন দিয়ে অভিভাবকেরাও সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন রাস্তায়। আমরাও যাই। এবার টোটো আসবে তাতে চড়ে বেরোব গ্রাম পরিদর্শনে আর মৎস্যচাষীদের সাক্ষাৎকার নিতে।

বেলা তিনটে

রাজেশ বিশ্বাস। বছর কুড়ির তরুণ, আমাদের আজকের টোটো চালক।

বেলা পৌনে বারোটায় ও এসে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বাস হোমস্টের সামনে। আমরা চেক আউট করে ওর টোটোতে চড়ে থানা পেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়েই ডাইনে সেই প্রশস্ত মাঠ আর তার বাঁয়ে নীল-সাদা দোতলা পাকাবাড়িটিই গোসাবার বিডিও অফিস। টোটো দাঁড়াতেই ভেতর থেকে এই ব্লকের মৎস্য আধিকারিক ডক্টর রাজদীপ গুপ্ত, মেয়ের ইউনিভার্সিটির দাদা বাইরে এসে প্রবীর পাহাড়ি নামে এক স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। প্রবীরবাবু একাধারে ATMA র প্রজেক্ট আধিকারিক, আবার মৎস্যজীবীদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির পরিচালকও। উনি টোটোর সামনে রাজেশ এর সঙ্গে বসলেন, আমরা চললাম গ্রামের ভেতরে।

প্রথমেই গেছিলাম আরামপুর পঞ্চায়েতের অধীনে তুলসী হালদারের জমিতে। বছর সত্তরের কার্তিক হালদার কৃষিরত্ন সম্মানে ভূষিত।

প্রায় কুড়ি বিঘা জমিতে তিনচারটি পুকুরে যেমন নানা ধরনের মাছ চাষ করছেন, তেমনই ধান, সব্জির খেত সবুজে আলোকিত।

কিছু কিছু জমিতে বর্ষায় জল জমলে মাছ চাষ হয়। এখন সেখানে আলু, টমেটোর চারারা মাথা তুলেছে। তুলসীবাবুর  উঠোনে ছাদবিহীন মাটির চারদেওয়ালের ছোট্ট রান্নাঘরে রান্না করছিলেন ওনার স্ত্রী। পাশেই উঁচু করে একতলা পাকা দালান থেকে উনি ওনার প্রাপ্ত সম্মানগুলি নিয়ে এসে দেখালেন। ওনার সহকারী জেলে জলে নেমে জাল ফেলে তিনচারটে পুকুর থেকে জ্যান্ত মাছ তুলে দেখালেন। বাটা, রুই, কাতলা, সিলভার কার্প, চিংড়ি এসব তো ছিলই আর ছিল আমার এক চেনা নামের অচেনা মাছ রূপচাঁদা! রূপোলী চ্যাপ্টা লালচে আভাযুক্ত এই মাছ কখনো দেখিনি, খাইওনি। ওনারা দিতে চাইলেও নিতে পারিনি, কেননা বাড়ি ফেরার দিন এখন অনিশ্চিত।

খুব ভাল লাগল তুলসী হালদার আর ওনার সহকারী কার্তিক মণ্ডলের আন্তরিক ব্যবহার।

শুধু পুকুর ভর্তি মাছ নয়, তার পাড় বরাবর চাষ করছেন লাউ, বরবটি, কুমড়ো আরো কত সব্জি!

এরপর ফোনাফুনি করে প্রবীর বাবু আরো কয়েকজন চাষীকে ডেকে নিলেন। শীতের ভরা রৌদ্রে আমরা মাঠের আলপথ বেয়ে চললাম শিশুপাল দাসের পুকুরপাড়ে। আদুল গায়ে বছর তিরিশের শিশুপাল এসে জানালেন মিষ্টি জলের মাছ চাষ করলেও বন্যায় আসা নোনা জলের স্রোতে তেমনভাবে লাভ হয়না, তাই কখনও কখনও কাঠের কাজ, রঙের কাজ এসবও করেন। অভিমন্যু মণ্ডল, সত্যরঞ্জন মণ্ডল তাদের গোয়ালে গরু, পুকুর ভর্তি মাছ, হাঁস-মুরগীর খামার দেখিয়ে জানালেন আয়লা, আমফান, যশ এর দাপটে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। গ্রামের সবাই ভয়ে থাকেন কখন প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে আবার তাণ্ডব চালাবে! তবু ওরই মধ্যে মাছের চারা আনা, খাবার দেওয়া বাদ দিলেও কোন কোন বছর মাছ থেকে বছরে লাখখানেক টাকা আয় হয়! 

গ্রামের একমাত্র কাঁকড়া চাষী মধু মণ্ডল শহরে গেছেন তাই ওনার স্ত্রী আশালতা আমাদের কাঁকড়ার পুকুর দেখালেন, দেখালেন পাড়ে পড়ে থাকা মৃত কাঁকড়ার দেহাবশেষ। গ্রাম্য গৃহবধূ আশালতা বললেন বছর বছর কাঁকড়া ছাড়া হয় কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তাদের বাঁচানো যায় না। তবে যদি বাঁচে ভালই দাম পাওয়া যায়!

সবশেষে রাজেশ এর টোটোয় চড়ে গেলাম রাঙাবেলিয়া মুক্তিধাম এর কাছে সুখেন দাস এর পুকুর দেখতে। এখানে প্রায় সব পুকুরেই সবরকম মাছ ছাড়া হয়, যেটা নাকি মাছ চাষের পরিপন্থী। অথচ প্রশাসন থেকে সেভাবে ট্রেনিং বা অর্থসাহায্য কিছুই এরা সেভাবে পায়না। মেয়েকে সরকারের প্রতিভূ মনে করে সবাই নিজেদের ক্ষোভের কথা জানালেন!

আমরা বাজারে যে মাছ তিন চারশো টাকায় কিনি, সেই মাছের অর্ধেক দামও এরা পায়না! মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া সমাজবন্ধুদের কথা।

চাষী রোদে পুড়ে জলে ভিজে আমাদের জন্য ফসল ফলায়, জেলে নদী, পুকুর, খাল বিলে মাছ চাষ করে, জাল ফেলে তা ধরে আমাদের মাছের যোগান দেন। এদের কথা কজন ভাবেন? একশ্রেণীর ব্যবসায়ী নিজেদের লাভের বখরা বাড়াতে দিন দিন এদের প্রতি অবিচার করে চলেছে আর প্রশাসন ঘুমিয়ে আছে। চলছে দুয়ারে সরকার। রাজনীতির চাপে যেটুকু সাহায্য আসছে তা কুক্ষিগত করে রেখে নেতারা বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের পেটোয়া কিছু মুষ্টিমেয় তোষামোদকারীদের মাঝে।

এই তো আমাদের ভারতবর্ষ! এখানে চাষী দাম পায়না, দাম পায় দলীয় রাজনীতি!

এখন ফেরার পালা। ওপার থেকে একটা সবুজ বোট এসে নোঙর বাঁধল বিডিও ঘাটে, আমরা মা-মেয়ে আর রাজদীপ চড়ে বসতেই লঞ্চ ছেড়ে দিল। ঘাটের ওপারে বিশ্বাস হোমস্টে দূরে সরে যেতে লাগল। পড়ে রইল গোসাবা বাজার, শিশুদের কণ্ঠের জাতীয় সঙ্গীত, রূপার ছোট্ট দোকান। বিদ্যাধরীর বুক বেয়ে আমরা চললাম গদখালি, সেখানে প্রদীপের অটো অপেক্ষা করছে রাজদীপের জন্য, আমরা তাতে করেই আবার কুলতলি বাসন্তী হয়ে ক্যানিং স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন ধরে জনারণ্যে মিশে যাব।

নদীবক্ষের কুঁড়ে ঘরে থাকা মৎস্যচাষীরা তাদের দিন কাটাবে অনিশ্চয়তার দোলাচলে সেকথা লেখা হবে মেয়ের আগামী গবেষণাপত্রে!  কিন্তু এদের কি অবস্থার পরিবর্তন হবে? এও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ! 

ছবি - লেখিকা

0 Comments
Leave a reply