শ্রীপান্থ

লিখেছেন:শুভাশিস চক্রবর্তী

 

'আমরা আর ঝাঁকে ঝাঁকে না খেয়ে মরতে দেব না বাঙালিকে'- লেটারহেড প‍্যাডের একদম নীচে কথাটি লেখা, যার শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি সংস্থাটির নাম: 'দায়'। প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে প্রাণ দিয়েছিলেন তেরোশ পঞ্চাশ বঙ্গাব্দে, মানুষেরই তৈরি দুর্ভিক্ষে। সেই মন্বন্তরের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে, মৃত মানুষদের স্মরণে আর বাংলার শিল্পী-সাহিত‍্যিকদের গৌরবময় ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেবার দায় গ্রহণ করেছিলেন শ্রীপান্থ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির আয়োজনে ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে ভারতীয় জাদুঘরে রামকিঙ্কর বেজ, জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ প্রমুখ শিল্পীর তিয়াত্তরটি ছবির প্রদর্শনীর ব‍্যবস্থা হল। উদ্বোধক হিসেবে অশীতিপর শিল্পী গোবর্ধন আশকে সুদূর বেগমপুর থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আয়োজনের মাত্রা বুঝতে গেলে পাতা উলটাতে হবে শ্রীপান্থ সম্পাদিত 'দায়' নামের গ্রন্থটির; একজন সংবেদনশীল মানুষের সামাজিক কর্তব্যের আদল কেমন হবে এটি যেন তার স্মারক হয়ে আছে। গ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন অমর্ত‍্য সেন। প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ পত্র লিখেছিলেন শ্রীপান্থ নিজে। চলতি বছরে মানুষ-খেকো মহামন্বন্তরের আশি বছর পূর্তির পরে এসে এখন সেই চিঠির একটি লাইন স্মরণ করে নেওয়া যেতে পারে: আমরা কি ভুলে যাব বাঙালি শিল্পী ও সাহিত্যিকরা মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে কীভাবে কলমে, তুলিতে অশ্রুপাত করেছিলেন সেদিন?

এমন দায় শ্রীপান্থ-ছদ্মনামা নিখিল সরকার আরও অনেকবার নিয়েছেন। ১৯৭৮ সাল। একটি লিটল ম‍্যাগাজিনের শারদীয় সংখ‍্যায় বাংলা বইয়ের জন্মকথা নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে খেয়াল করলেন সে বছর বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর পূর্ণ হল। কিছু একটা উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। আনন্দবাজার পত্রিকার কর্তৃপক্ষ রাজি দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপনে: আদি যুগ থেকে সমকাল পর্যন্ত বইয়ের প্রদর্শনী, হ‍্যালেডের ব‍্যাকরণ বইটির পুনর্মুদ্রণ, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ: এই হল পরিকল্পনা। উদ‍্যোগটিতে যাঁরা শ্রীপান্থের সহযোগী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই খ‍্যাতনামা, নিজের পরিসরে উজ্জ্বল: রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিত্তরঞ্জন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, চিত্রা দেব প্রমুখ। প্রদর্শনীর জন‍্য বই সংগ্রহ করতে উত্তরপাড়া থেকে শান্তিপুর, প্রায় অর্ধেক বঙ্গদেশ চষে ফেলেছিলেন এই নক্ষত্রেরা। ১৯৭৯-র ফেব্রুয়ারিতে ময়দানে আয়োজিত অভিনব প্রদর্শনীতে বই ও পুরনো ছবি ছাড়া ছিল উনিশ শতকের প্রথম দিকের কাঠের মুদ্রাযন্ত্র, কাঠের হরফ, ব্লক ইত্যাদি। নিপুণ বিন‍্যাসে, সুচারু কর্মকুশলতায় এবং অনন্ত শ্রমে নিখিল সরকার একে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলেছিলেন: বস্তুত আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর একটি গর্বিত উদ‍্যোগ হিসেবে এই আয়োজন আজও অদ্বিতীয় হয়ে আছে।

কলকাতা তাঁকে 'পেয়ে' বসেছিল: মহানগরীর প্রতি এক অদ্ভুত 'নেশার ঘোরে এক গ্রন্থাগার থেকে আর এক গ্রন্থাগার, এক বই থেকে আর এক বইয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই পরিক্রমায় প্রথম জানার উত্তেজনায় পাঠকদের কিছু জানাবার তাগিদ বোধ করেছি।'- লিখেছেন শ্রীপান্থ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছর দশেক পরে 'নগর ইতিহাস' একটি বিশেষ বিদ‍্যা (ডিসিপ্লিন) হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। পাশ্চাত্য থেকে তার ঢেউ ভারতে ঠিকঠাক আছড়ে পড়ে ১৯৭৯-র আশেপাশে। এই বিদ‍্যার পেশাদারি আতসকাচের নীচে কলকাতাকে নিয়ে আসেন প্রদীপ সিংহ, সৌম‍্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ‍্যায় প্রমুখ। তাঁদের সমান্তরালে 'সখের ইতিহাস' চর্চাশিল্পী শ্রীপান্থ স্মৃতির মন্ত্রে মুগ্ধ এই আজবনগরীর বাবুবৃত্তান্ত, নারীর ইতিবৃত্ত থেকে বটতলা, মেটিয়াবুরুজের কিসসা শুনিয়ে বাঙালি পাঠককে 'কলকাতার নেশা' ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কলকাতা কেন্দ্রিক ইংরেজি বইগুলিতে পেশাদার ঐতিহাসিকের মুন্সিয়ানা উঁকি দেয় হয়তো, কিন্তু বাংলা রচনাবলিতে গবেষক শ্রীপান্থের হাতে চুম্বন করেন এক অনন‍্য গদ‍্যশিল্পী, নিভৃতচারী কথাকার। একথা স্বীকার করতে আপত্তি নেই- 'পপুলার কালচার'-কে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে ও নতুন অভ‍্যাসে পড়তে শিখিয়েছিলেন তিনিই। 

'ফ‍্যান্সি মার্কেট' শব্দটির প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই সাধারণের মনে আভাস থাকবে সৌখিনতার। কিন্তু 'ফ‍্যান্সি' আসলে ফাঁসি! কলকাতার যেসব মোড়ে মিনিবাসের স্টপেজ, একদা সেখানে ছিল ফাঁসিকাঠ: 'ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে কলকাতায় অপরাধ ও শাস্তির ইতিহাস।' লঘুপাপে গুরুদণ্ডের মৃত্যুলীন অতীত দাঁড়িয়ে আছে আমাদের নিত‍্যযাত্রার মোড়ে মোড়ে - অপ্রত‍্যাশিত এমন সব তথ‍্যে চমকে দিয়েছেন নিখিল সরকার।

মোহন্ত মহারাজের প্রেমলীলার অবৈধ জালে জড়িয়ে পড়ে এলোকেশী খুন হয়ে যান স্বামী নবীনের হাতে; উনিশ শতকের শেষ দিকে সহবাস সংক্রান্ত আইন নিয়ে বিতর্ক এমন উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠে যে সেকালে বাংলার অসংখ্য পুরুষ বালিকা বধূদের সঙ্গে শরীরি সম্পর্ক স্থাপনের সমর্থনে ফতোয়া জারি করে বসে: 'মোহন্ত-এলোকেশী সম্বাদ' বা 'কেয়াবাৎ মেয়ে'-র মতো বইয়ের কেন্দ্রে আছে উল্লিখিত ঘটনাগুলি। নারী বিষয়ক রচনাগুলিতে 'জেণ্ডার স্টাডিজে'র পূর্ণাঙ্গ রসদ ক্রমবিকশিত হয়ে ওঠে। বোঝা যায় সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠার মাপমতো লেখার যাহোক একটা কিছু নয়, নারী জাগৃতির ভিন্ন দায় বহন করে গেছেন শ্রীপান্থ। 'বিজয়নগরের মহারাজার মৃত্যুর পর চার হাজার সহমৃতা রানীকে কোন ছলে-বলে-কৌশলে দাবানলের মতো চিতার আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল?'- সতীদাহের ইতিহাস লিখতে বসে মর্মান্তিকতার অবয়ব তাঁর কলমে এমন তেতে ওঠে যে তা ঝলসে দেয় পাঠকের ছুটিবিলাসী  রবিবারোয়ারি সত্তাকে।

দায় কি শুধু কাগজে-কলমে বা প্রদর্শনীতে বহন করেছেন নিখিল সরকার? স্বদেশের পরাধীনতা তাঁর মতো সংবেদনশীল মানুষকে চিন্তিত করবে, এটাই স্বাভাবিক। মহাত্মা গাঁধীর ডাকে দেশ তখন উত্তাল, পূর্ববঙ্গের প্রত‍্যন্ত গ্রামের নদীর জলেও তার প্লাবন ডেকেছে। ভেসে গেলেন নিখিল। স্কুলের ছাত্র তো কী আছে! জ্ঞান সেন ও আরও সহপাঠীদের একজোট করে পিকেটিং, ইংরেজ ভারত ছাড়ো বলে হুঙ্কার: খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান ছোট-বড় সভাগুলিতে। 'ওঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গৌরীপুরের ওই ছাত্র আন্দোলন সেকালে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।'- স্মৃতিকথায় লিখেছেন নিখিল সরকারের সহপাঠী শিশির ভৌমিক। দেশভাগ হল। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাঁধল। রক্তাক্ত স্বাধীনতা! সহযোগীদের নিয়ে নিখিলবন্ধু গ্রাম থেকে গ্রামে পৌঁছে যান: সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে। যে কোনও মূল‍্যে এই মারণখেলা রোধ করতে হবে। পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি, তবু 'দায়' শব্দের মন্ত্রক্ষমতায় আস্থা হারাননি সেই কৈশোরেও।

ম‍্যাট্রিকুলেশনের পর ছন্দপতন ঘটে গেছিল লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায়। কলকাতায় এসে তাই যা কিছু ডিগ্রি অর্জন, সবই কলেজহীন ছাত্র হিসেবে। পেটের দায়ে দিনরাত গৃহশিক্ষকতা করেছেন এই পর্বে। স্বাধীন সাংবাদিকতায় কিছু নগদ লাভ ঘটছিল। লেখাগুলি ছাপ রেখে যাচ্ছিল পাঠকের মনে। 'চাষ ও চাষী' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিলেন, সঙ্গে 'যুগান্তর' কাগজে ধারাবাহিক কলাম লেখা। বার্তা সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন বসু স্নেহের নিখিলকে পরামর্শ দিলেন ইতিহাসকেন্দ্রিক সুখপাঠ‍্য রচনাগুলির ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব‍্যবহার করতে। দক্ষিণাবাবুর পছন্দ 'শ্রীপান্থ' নামটি। সেই দাক্ষিণ‍্যে ময়মনসিংহের নিখিলবন্ধু সরকার কলকাতার ইতিহাস সন্ধানী পথিকবন্ধুতে পরিণত হয়ে গেলেন অতঃপর। ১৯৬১-র পয়লা জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রবেশ: পরবর্তী সাড়ে চার দশকে বাঙালি পাঠকের কাছে কলকাতার কড়চা, পুস্তক পরিচয়, সম্পাদকীয় পাতা আর 'শ্রীপান্থ' যেন অভিন্ন সত্তা হয়ে গিয়েছিল।

'পাকরাজেশ্বর' গ্রন্থের ভূমিকায় রন্ধন বিষয়ে যে নিবিড় অনুসন্ধানী গবেষক নিখিল সরকারকে পাওয়া যায় তিনি লইট‍্যা মাছের শুঁটকিতে কাঠালের বিচি দিয়ে অপূর্ব একটি পদ রান্না করতেন; গুণগ্রাহীদের হাতে-কলমে শিখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অবশ‍্য শেখার থেকে চাখার দিকে আগ্রহ  ছিল বেশি। ঘুগনি তৈরি করতেন অসামান্য: 'চলে এসো বিকেলে, ঘুগনি খাওয়াব'- এমন ফোন অনেকেই পেয়েছেন। লবণহ্রদের 'কৃষ্ণকলি' বাড়ির একতলার বসার ঘরে একটা চৌকির উপর বালিশে ঠেস দিয়ে আধশোয়া নিখিল সরকার। পরনে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, পান চিবোচ্ছেন। বেসিনে গিয়ে কুলকুচি করে আবার এসে মুখে পান গুঁজে বসছেন, মাঝে মাঝে মুখে ফেলছেন জর্দা। আড্ডায় হয়তো কোনও বিষয়ে গভীর আলোচনা চলছে। বেশ গম্ভীর পরিবেশ। হঠাৎ একটা সরস মন্তব্য করে এক নিমেষে 'সেমিনার সেমিনার' ভাব থেকে আড্ডাকে নিজের পদমর্যাদা ফিরিয়ে দিতেন তিনি। সেই আড্ডায় ফকিরমোহন সেনাপতির মেয়ের লেখা ওড়িয়া ভাষায় রান্নার বই থেকে শুরু করে জ‍্যঁ অঁতেলমের 'দ‍্য ফিলোজফার ইন দ‍্য কিচেন' সব চলে আসত অনায়াসে। আসত দেশি মাগুর মাছের দর, সোভিয়েতের পতন, কালাহাণ্ডির দুর্ভিক্ষ, গড অব স্মল থিংসের প্রসাদগুণ থেকে মার্কেজ, কুন্দেরা, শাঁটুলবাবু, নিরোদ সি চৌধুরীর প্রসঙ্গ: সৎ, ঋজু, নিরহংকার, সুরসিক মানুষটি বিদ‍্যার সুগন্ধি মাখানো খোশ গল্পে আসর মাতিয়ে রাখতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

আড্ডা ছাড়াও এই বাড়িতে তৈরি করেছিলেন 'পাপু স্মৃতি পাঠাগার'। পাপু তাঁর দ্বিতীয় সন্তান, একমাত্র পুত্র, পোশাকি নাম সুব্রত। জন্ম ১৯৬০ সালে। মাত্র নয় বছর বয়সে বাড়ির সামনেই, চলন্ত বাসে চাপা পড়ে অকালমৃত্যু হয় তাঁর। বাল‍ক পাপুর কবিতা লেখা ও ছবি আঁকার হাত চমকে দিয়েছিল কাছের মানুষদের। সেইসব অমিত সম্ভাবনার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে 'পাপুর বই'-এ। তাঁর একটি কবিতা একসময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে 'কিশলয়' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯৬-এর ২৫ অগস্টে সল্টলেকের বাড়িতে পুত্রের স্মৃতিতে তৈরি পাঠাগারের উদ্বোধনী সভায় উপস্থিত ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আবীরলাল মুখোপাধ‍্যায় প্রমুখ। অন‍্যত্র একটি প্রদর্শনীতে পাপুর আঁকা ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন লেডি রানু মুখোপাধ‍্যায় ও পরিতোষ সেন।

"সুভো ঠাকুর বলে: ওর কুষ্টিতে বন্ধু-স্থানে জন্মলগ্ন থেকেই নাকি শনি ঠাকুরের বক্র কটাক্ষ! সেই কারণে বন্ধু-ভাগ‍্য আজন্মই ওর নেহাতই মন্দ। ও শেষ বয়সে এই নিখিল-বিশ্বে-- নিখিল বিশ্বাস নয়, নিখিল সরকার নামে একজন নিস্বার্থ বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়েছিল। কিন্তু সেও আজকাল আর ওর খোঁজ-খবর নেওয়ার কথা বিস্মৃত।"- ১৯৮৪ সালের ১৭ মার্চ তারিখে লেখা সুভো ঠাকুরের এই অভিনব ও আন্তরিক চিঠিটির মতো অসংখ্য সুহৃদের অজস্র চিঠি নিখিল সরকার সযত্নে রক্ষা করেছেন। আইসিএস অশোক মিত্র ১৯৮৭-র ২৩ অক্টোবর কবি ও সম্পাদক সমর সেন প্রসঙ্গে নিখিলবাবুকে লিখেছেন: "এখন আবার নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে, মৃত্যুর পর তাঁর (সমর সেনের) উপরে বই লিখে, সেটি বিক্রি করে, তাঁর স্ত্রীকে ঠকিয়ে তাঁর লেখা চিঠিপত্র এবং অন‍্যান‍্য রচনা ফাঁকতালে ছাপিয়ে দু পয়সা লোঠার জন‍্যে কতিপয় প্রগতিশীল ব‍্যস্ত হয়েছেন।" পাশাপাশি ১৯৯৩ সালে সোমনাথ হোরের লেখা একটি চিঠির শেষাংশ তুলে ধরতে পারে প্রকৃত শিল্পীর সামাজিক কর্তব‍্যের অধুনা দুষ্প্রাপ্য একটি ধারাকে: "আনন্দবাজার অফিস থেকে ৫০০্ টাকার এই চেকখানি পাঠানো হয়েছে, আমি ত জানি না, ওঁরা কবে কী ছেপেছেন। সে যাই হোক- যদি আপনাদের তরফ থেকে এটিকে Students Health Home-এ জমা করানো যায়, তবে সুখী হব।" শ্রীপান্থ যত চিঠি পেয়েছেন তার প্রত‍্যত্তুর পত্রগুলি কি হারিয়ে গেছে? কিছুই কি সংগ্রহ করা সম্ভব নয়? দশক পেরোলে শ্রীপান্থের শতবর্ষ উদযাপনের আয়োজন নিশ্চয়ই কিছু হবে। সেই উপলক্ষটিকে পাখির চোখ করে কালের অতলে পত্রাবলিসমূহ চিরতরে হারিয়ে যাবার আগে একটা জোরদার অনুসন্ধানের দায়িত্ব আমরা যেচে কাঁধে নিতে পারি? নিলে, সেটা খুব বেশি 'লেখালেখির কেরিয়ারকে' ক্ষতিগ্রস্থ করবে না বলেই আশা করা যায়।

''শোক সংবাদ'-এর ভূমিকা লিখলাম।… পথিক কষ্ট করে শ্রুতলিপি নিয়েছে।… নিজে একবার ভাল করে পড়ে কাউকে দিয়ে কম্পোজ করিয়ে শক্তিবাবুকে দিলেই তিনি প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থা করবেন। তোমাকে যন্ত্রণা দিতে বাধ্য হচ্ছি বলে দুঃখি। কী করব, উপায় নাই। আর কয় দিন তেল আছে কে জানে!'- প্রিয়ভাজন সহকর্মীর প্রতি এই চিঠি লেখার দুই মাসের মাথায় নিখিল সরকার প্রয়াত হন। প্রয়াণ তারিখ ১৭ অগস্ট, ২০০৪। চিকিৎসক তাঁকে জানালেন শরীরে ক‍্যান্সার বাসা বেঁধেছে; অফিসে এসে বলেছিলেন: 'ফাঁসির আদেশ হয়ে গেছে।' কেমোথেরাপি ইত্যাদির যন্ত্রণা অসহ‍্য হয়ে উঠেছিল। তার মধ‍্যেও পত্রিকার লেখা, অন‍্য দায়িত্ব পালনের মনের জোর হারাননি। প্রতি বছর পয়লা মে তাঁর জন্মদিনে কাছের মানুষদের সমাগম হত, তুলনাহীন আতিথেয়তায় খাওয়া-দাওয়া শুকতো দিয়ে শুরু হয়ে পায়েসে শেষ হত। গত ১ মে জন্মদিন। পরমায়ু বাহাত্তরে থেমে না গেলে আমরা হয়তো তাঁর শেষ ইচ্ছের স্ক্র‍্যাপ বইটি পেয়ে যেতাম। সাদামাটা অল্পে সন্তুষ্ট মানুষটি স্বপ্নের বইটি নিয়ে বলেছিলেন: 'এ-জীবনে যে কয়েকটা বই লিখলাম, তাতে আমি খুশি। হুড়োহুড়ি করার প্রয়োজন নেই। 'কলকাতার স্ক্র‍্যাপ' বইটি লিখতে পারলেই আমার জীবনের সাধ মেটে।'

 

 

0 Comments
Leave a reply