সোশ্যাল মিডিয়া প্রোপাগান্ডা মডেল

লিখেছেন:আখতার মাহমুদ

মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাংশান হচ্ছে মানুষের মননকে পুঁজিবাদী দুনিয়ার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। আর এ কারণে মিডিয়ার প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে সে তার স্বার্থ উদ্ধার করবে। সাধারণত অটোক্রেটিক কোনো রাষ্ট্রে মিডিয়া পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রণের টুলগুলো স্পষ্ট, যেমন- সেন্সরশীপ ও নানান নিষেধাজ্ঞা। অটোক্রেটিক রাষ্ট্রে প্রোপাগাণ্ডা মডেল বুঝতে পারা কঠিন নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে প্রোপাগাণ্ডা মডেলের অস্তিত্ব টের পেতে ও ধরতে আলাদা চোখ থাকা দরকার। নইলে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে গণতান্ত্রিক অবস্থায় চলমান মিডিয়া প্রোপাগান্ডা। তবে প্রোপাগান্ডা মডেল ফিল্টারের সাহায্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে প্রোপাগান্ডা মডেলের অস্তিত্ব বোঝা সম্ভব। 

 

C:\Users\SAT\AppData\Local\Microsoft\Windows\INetCache\Content.Word\Propaganda-Model.jpg

 

 

হারমেন ও চমস্কি তাদের ‘Manufacturing Consent- The Political Economy of the Mass Media’ (1988) বইয়ে প্রোপাগান্ডা মডেলের পাঁচটা ফিল্টার নিয়ে আলাপ করেছেন। যা দিয়ে প্রোপাগান্ডা বুঝে ফেলা সম্ভব। এগুলো হলো: 

১) মিডিয়ার মালিকানা

২) বিজ্ঞাপন

৩) তথ্যের উৎস

৪) শাস্তির ভয়-ভীতি

৫) ভিন্নমতকে বিচ্ছিন্ন করে তোলার চেষ্টা

 

মিডিয়ার আকার, মুনাফা বা মালিকানা থেকে প্রোপাগান্ডার রূপ বোঝা সম্ভব। মিডিয়া কাদের বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল, অথবা কারা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, শাস্তি দিতে চায়, ভয় দেখাতে সক্ষম। কিভাবে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরোধী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মতামতকে বাতিল করে কাজ উদ্ধার করা হয় - এসব থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি প্রোপাগান্ডার ধরন-ধারন। দিনশেষে মিডিয়ার মালিক, বিজ্ঞাপন দাতা বা বিজ্ঞাপনী সংস্থা, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ইত্যাদির স্বার্থ দেখার দায়িত্ব মিডিয়া ঘাড়ে তুলে নেয় নিজ স্বার্থেই। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অবধারিতভাবেই মিডিয়া কিছু সংবাদের বলি দিতে বাধ্য অথবা সংবাদকে পরিশোধন প্রক্রিয়ায় ফেলে উপস্থাপন করে, যাতে বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা পক্ষের জন্য ক্ষতিকর সংবাদ-তথ্য বাদ পড়ে যায়। 

সংবাদের এ বাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপার স্যাপার বুঝতে আমাদের আবার এজেন্ডা সেটিং থিওরী একটু করে বোঝা দরকার। এ থিওরি বলে - কিভাবে একটা বিষয়কে দেখা দরকার, সেটা মিডিয়াই মানুষকে ঠিক করে দেয়। ম্যাক'কম্বস ও শ’ নামক দু’জন গবেষক ১৯৬৮ সালে 'চ্যাপেল হিল স্টাডি’ নামে একটা গবেষণা পরিচালনা করেন, যে গবেষণায় তারা তৎকালে অনুষ্ঠিতব্য একটি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের কাছে জানতে চান এবং তারা দেখতে পান - সংবাদপত্র যে সব বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে আলাপ করেছে সাম্প্রতিককালে সেসবকেই মানুষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। উদাহরণে না গেলে বোধহয় ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না।

ধরা যাক একদম প্রান্তিক মানুষের কাছে ক্রমানুসারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হল এরকম:

১) দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি   

২) বাকস্বাধীনতা হরণ

৩) চলমান জনবিমুখ রাজনীতি

৪) সহ্যের বাইরে চলে যাওয়া নাগরিক সমস্যা (যানজট, মশা, দূষণ) 

৫) বেকারত্ব ও সামাজিক অপরাধ

 

কিন্তু দেখা গেল মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্রম হল:

১) নারীর পোশাক ছোট না বড় হবে এ বিতর্কের সংবাদ

২) বেকারত্ব ও সামাজিক অপরাধ

৩) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

৪) সহ্যের বাইরে চলে যাওয়া নাগরিক সমস্যা (যানজট, মশা, দূষণ)

 

এর ফলে প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষের চাওয়া নিয়ে আমরা চিন্তা করব না। আমরা বরং আলাপ করব মিডিয়ার ঠিক করা প্রায়োরিটি লিস্ট অনুসারে। 

এতটুকু আসলে ভূমিকা ছিল, মূলত আমি একটা বিষয় খুঁজে দেখতে চেয়েছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা কিভাবে কাজ করে। কোন কোন এজেন্ডার প্রোপাগান্ডা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী। স্বাভাবিকভাবে এ অনুসন্ধানটা আমি বাংলা ভাষীদের মধ্যে চালিয়েছি। বাংলায় সোশ্যাল মিডিয়ায় মূলত দুটো পক্ষ প্রভাবশালী, এদের উঁচু আওয়াজের জন্য অনেক সময়ই প্রান্তিকদের আওয়াজ আমাদের কানে পৌঁছায় না। এমনকি কর্পোরেট হাউজ, রাজনৈতিক দলগুলোও এদের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না সোশ্যাল মিডিয়ায়।

তবে এর মানে আবার এমন নয় যে রাজনীতি বা কর্পোরেট হাউজগুলোর প্রভাব সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। প্রভাব আছে। এ দুইগ্রুপকে কাজে লাগিয়ে জায়ান্ট কর্পোরেট হাউজগুলো বা রাজনীতি স্বার্থ উদ্ধার করে নেয় কৌশলে। এ দু’পক্ষ বুঝতেও পারে না তারা অন্যের স্বার্থের জন্য লড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ধরা যাক, কোনো প্রভাবশালী কোম্পানির খাদ্য পণ্যে মারাত্মক ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া গেছে, এটা প্রকাশিত হয়েছে এবং নানান সমালোচনা চলছে। কিন্তু এসব সমালোচনাকে চলতে দিলে যেহেতু ব্যবসায়ের ক্ষতি তাই মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে হয়তো এদের পিআর ডিপার্টমেন্ট সামনে নিয়ে আসবে অন্যকিছু। 

হয়তো তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় প্রকাশিত হবে: অমুক নায়িকা বিয়ে ছাড়াই মা হয়েছেন! 

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাশালী দুটো গ্রুপও কিন্তু বসে থাকেন এসব ইস্যুর জন্য। এসব পেলে তাদের পোয়াবারো।

আবার এমন হতে পারে কোনো পলিটিক্যাল স্ক্যান্ডাল সামনে চলে এলো এবং প্রচুর সমালোচনা শুরু হলো এ নিয়ে। তো এসব ঠেকানোর সহজ উপায়, নতুন মুলো (তর্ক-বিতর্কের রসদ) ঝোলানো সোশ্যাল মিডিয়ার সামনে।

মুলোটা হতে পারে এরকম: নারীর পোশাক খাটো হবে না লম্বা হবে?

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী যে পক্ষগুলোর কথা আমি বলছি তারা হলো: 

১) ভার্চুয়াল ধার্মিক গ্রুপ * 

২) সেক্যুলার গ্রুপ **  

এদের ক্ষেত্রে এসে খেয়াল করেছি, প্রচলিত এজেন্ডা সেটিং থিওরি বা প্রোপাগান্ডার ফিল্টার থিওরি পুরোপুরি কাজ করছে না। যেমন পাঁচটি ফিল্টারকে নতুন করে না সাজালে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল হবে। 

নতুন করে এভাবে সাজাতে পারি আমরা:

১) আদর্শ

২) আয়ের উৎস

৩) তথ্যের উৎস

৪) শাস্তির ভয়-ভীতি

৫) ভিন্নমতকে বিচ্ছিন্ন বা দুর্বল করে তোলার চেষ্টা

 

এখানে হারমেন ও চমস্কির ফিল্টারের শেষ তিনটি (৩-৫) পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি আমার। এগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক।

তো এ ফিল্টারগুলো দিয়ে আমরা বুঝতে পারব সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডার ধরন। মানুষটার আদর্শ কী, তার আয়ের উৎস কী বা এ আয়ের উৎস তার মতামতকে প্রভাবিত করছে কিনা। কোন উৎস থেকে সে তথ্য উপস্থাপন করছে। ফেসবুকে ব্যান হওয়া বা আইনের কোনো শাস্তির ভয় তার মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করে কিনা। ভিন্নমতকে দমন বা বাতিল বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা তার আছে কিনা। এসব তথ্য বিবেচনা করে কোনো মতামত প্রোপাগান্ডা কী প্রোপাগান্ডা নয় সেটা বলা যায়।

চলুন এবার ফিরে আসি আমাদের বাংলায় প্রভাবশালী দুই গ্রুপের ‘এজেন্ডা সেটিং’ এর আলাপে। মজার বিষয় হলো, এ দুই গ্রুপের প্রায়োরিটি লিস্ট তৈরী করতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখলাম তাদের প্রায়োরিটি লিস্ট প্রায় একই। কেবল আদর্শটা আলাদা। 

দেখুন-

আগেও আলাপ করেছি আবারো ঝালাই করে নিই সাধারণ প্রান্তিক মানুষের প্রায়োরিটি লিস্ট: 

১) দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ২) বাকস্বাধীনতা হরণ, ৩) চলমান জনবিমুখ রাজনীতি, ৪) সহ্যের বাইরে চলে যাওয়া নাগরিক সমস্যা (যানজট, মশা, দূষণ), ৫) বেকারত্ব ও সামাজিক অপরাধ। 

 

ভার্চুয়াল ধার্মিকদের প্রায়োরিটি লিস্ট:

১) নারীর পোশাক ছোট না বড় হবে এ বিতর্ক

২) ধর্মের অবমাননা

৩) সেলিব্রেটি সেক্যুলার/মডারেট ধার্মিকদের সমালোচনা

৪) সেক্যুলারদের পক্ষে যায় এমন নীতি প্রণয়নের সমালোচনা

৫) ব্যক্তিগত জীবন ও দর্শন।

 

সেক্যুলারদের প্রায়োরিটি লিস্ট: 

১) নারীর পোশাক ছোট না বড় হবে এ বিতর্ক

২) ধর্মের সমালোচনা করার স্বাধীনতা

৩) সেলিব্রেটি ধার্মিক/মডারেট সেক্যুলারদের সমালোচনা

৪) ধার্মিকদের পক্ষে যায় এমন কোন নীতি প্রণয়নের সমালোচনা

৫) ব্যক্তিগত জীবন ও দর্শন।

 

এর মানে আমরা দেখছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাবশালী গ্রুপগুলো যে এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে তা আসলে প্রান্তিক মানুষের এজেন্ডা নয়। এ উভয় গ্রুপ মূলত স্ব স্ব ক্ষেত্রে কালচারাল ডমিনেন্স অর্জনে ব্যস্ত এবং এই দুই গ্রুপের অর্জনে প্রান্তিক মানুষ খুব কমই উপকৃত হয়। বরং যেসব তর্ক তারা সামনে নিয়ে আসেন এবং দিনের পর দিন এসব নিয়ে যখন পড়ে থাকেন তখন অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হারিয়ে যায় চোখের আড়ালে।

এই দুই গ্রুপের একটা ভয়ানক সমস্যা হলো, এরা নিজেদের পপুলিজম কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের প্রায়োরিটি লিস্ট ঠিক করে দেয়ার চেষ্টা করেন: মানুষ কী পড়বে, কী দেখবে, কী শুনবে, কতটা বলবে কতটা বলবে না, কোন সিনেমাটা দেখবে কোনটা দেখবে না, কোনটা উচ্চমার্গ কাজ, কোনটা নিম্নমার্গ...

বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান- বইও তাদের এসব আলাপে হারিয়ে যায়। কেননা তাদের আলাপে যেসব বইয়ের নাম উঠে আসে সেসব ছাড়া মানুষকে তারা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের দিকে তাকাতে দিতে চান না। তারা পছন্দও করেন না যে মানুষ তাদের দেখানো বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই-পুস্তক পড়ুক। সোশ্যাল মিডিয়ার ডমিনেন্ট গ্রুপ হিসেবে এদিক থেকে এ দুই গ্রুপ বেশ সফল। নিজেদের পছন্দনীয় বই-বিনোদন ব্যতীত তারা অন্যান্য বই-বিনোদনের প্রতি মানুষের মনে একটা অনাগ্রহ চমৎকারভাব তৈরি করেছেন। এজন্য তারা সাধুবাদ পেতে পারেন কিনা সেটা নিঃসন্দেহে নতুন এক গবেষণার বিষয়।

কিন্তু সবশেষে এসে প্রশ্ন হলো, আমরা নিজেদেরকে সোশ্যাল মিডিয়া প্রোপাগান্ডার প্রভাব থেকে কতটা মুক্ত রাখতে পারছি? আমরা কতটা সচেতন সোশ্যাল মিডিয়া প্রোপাগান্ডার বিষয়ে? আমরা কী অন্ধের মতো প্রোপাগান্ডার পেছন পেছন হাঁটছি না মগজটা চালু রেখে হাঁটছি?

যদি আপনি এসব প্রশ্নের উত্তর আগে কখনো খুঁজে না দেখেন তবে এখনো খুব বেশি দেরি হয়নি, মাথাটা তুলুন, প্রশ্ন করুন - আমাদের সাধারণ মানুষের প্রায়োরিটি লিস্ট ঠিক করে দেওয়ার তোমরা কে হে বাপু?

 

*ভার্চুয়াল ধার্মিক গ্রুপ বলে আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ হল, ভার্চুয়াল পৃথিবীর বাইরে ধার্মিকদের বিশাল অংশ রয়েছে যারা নিজেদের ধর্ম পালন ও ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান অর্জন এবং এর প্রচার নিয়েই ব্যস্ত। সত্যিকারের ধার্মিকদের কাছে মেকি ভার্চুয়াল পৃথিবীর কোনো মূল্যই নেই, তারা বরং মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থাকতেই পছন্দ করেন। 

**সেক্যুলারদের প্রায় সকলেই ভার্চুয়াল জগতকে জরুরি ও প্রয়োজনীয় মনে করেন বলে সিংহভাগ সেক্যুলারদেরই আমরা ভার্চুয়াল জগতে দেখি। তাই আলাদা করে তাদের আগে ভার্চুয়াল যুক্ত করার দরকার মনে হয়নি।

 

(বাংলাদেশ) 


 

0 Comments
Leave a reply