মিডিয়ায় অপারেশন সিঁদুর (ছবি - ফার্স্টপোস্ট)
ব্রিটিশরা ভারতকে স্বাধীনতার সঙ্গে দুটো বিষয় ফাউ দিয়ে গিয়েছিল— এক, দেশভাগ এবং দুই, কাশ্মীর-বিবাদ। অবশ্য আমাদের দেশনায়করা যদি না চাইতেন, তা’হলে, হয়তো, দুটোই পরিহার করা যেতো। সমস্যা যেটা হচ্ছে, দুটো ঘটনাই এতদিনে ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, অথবা সমগ্র উপ-মহাদেশের যে, আজ আটাত্তর বছর বাদেও এই ইতিহাসের ভারে দেশবাসী পিষ্ট হচ্ছে এবং বলা যায়, দেশের রাজনীতি এই ইতিহাসের আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহলগামের বৈসরন উপত্যকায় ২৬ জন মানুষের যে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, তাতে শোকের থেকে ক্রোধের বেশি উদ্রেক হয়, এটা ঠিক। কিন্তু, প্রকৃত অপরাধীদের সন্ধান করার বদলে জনমানসের এই ক্রোধকে রাজনীতির পুঁজি করলে, সমগ্র ঘটনাটা অন্য মাত্রা অর্জন করে। প্রধানমন্ত্রী মোদী, বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত রেখে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে বললেন, “এই জঘন্য কাজের পিছনে যারা আছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে... কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না।” “সকলে বলিল— বাহবা বাহবা বাহবা বেশ”। কিন্তু খুনিরা তো পগার পার। পাকিস্তান সীমান্ত থেকে পহলগাম কমবেশি ২০০ কিমি তো হবেই। ‘পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদীরা’ ভারতের বিশাল সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা দলের ‘কড়া নজরদারি’ এড়িয়ে ভারতের ২০০ কিমি ভিতরে এসে অপারেশন করে নির্বিবাদে ফিরে গেল। সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ, এক পনি-ওয়ালা যুবক পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ দিলেন। ঘটনার পরে, সেনা-পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছবার আগেই, স্থানীয় মানুষজন আহত-বিপদগ্রস্থ পর্যটকদের স্থানীয় হাসপাতালে, নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে সাহায্য করেন। পরের দিন সমগ্র কাশ্মীর স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ পালন করে। সন্ত্রাস-বিরোধী পোস্টার নিয়ে দলে দলে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। আনন্দবাজারের রিপোর্ট, “মঙ্গলবারের পর থেকে সেই পহেলগাঁওকে আর চেনার উপায় নেই। রাস্তাঘাট থমথম করছে। বন্ধ রাখা হয়েছে সমস্ত দোকানপাট। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গুঞ্জন, ছোটখাটো জটলা থেকে ভেসে আসছে স্থানীয় ভাষায় বিলাপ। আর চলছে মিছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে পহেলগাঁওয়ের রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছেন বহু স্থানীয় মানুষ। মোমবাতি নিয়ে মিছিল করছেন তাঁরা। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, নিরীহদের হত্যার বিরুদ্ধে সেই মিছিল থেকে উঠছে স্লোগান। কাশ্মীরিরা বলছেন, ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’, ‘আমরা ভারতীয়’। এখনও পহেলগাঁওয়ে যে সমস্ত পর্যটক আটকে আছেন, তাঁদের আগলে রেখেছেন স্থানীয়েরাই।”
নিহত পর্যটকদের পরিবারগুলি ব্যতীত, আর যাঁরা এই সন্ত্রাসবাদী হামলায় সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন কাশ্মীরের মানুষ। তাঁদের রুটি-রুজির সংস্থান বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তার উপর শুরু হয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীর হামলা; ব্যাপক ধরপাকড় এবং সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত আদেশ, নিষেধাজ্ঞা জলাজ্ঞলি দিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর। কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্ররোচনায় কাশ্মীরের বিরুদ্ধে, কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক প্রচারে মুখরিত হয়েছিল বিভিন্ন বৈদ্যুতিন ও সামাজিক মাধ্যম। সমগ্র দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এমন পর্যায় পৌঁছেছিল যে, বিভিন্ন রাজ্যে যত্রতত্র কাশ্মীরিরা উন্মত্ত জনতার দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিলেন। পহলগামে জঙ্গি হামলায় মৃত নৌসেনার পত্নী হিমাংশী নারওয়াল “মুসলিম সম্প্রদায় বা কাশ্মীরি জনগণকে” দায়ী না করার জন্য আবেদন করেছিলেন বলে, হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর বিরুদ্ধেও কুৎসা করতে ছাড়েনি। পরিকল্পিতভাবে মানুষের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আবেগকে মুসলমান-বিদ্বেষের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছিল। সাধারণভাবে বাণিজ্যিক সংবাদপত্র গোষ্ঠী, শাসক দলের অনুসারী হলেও, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ইন্ধন জোগানোর এই প্রচেষ্টাকে তারাও মেনে নিতে পারেনি। আনন্দবাজার তাই তাদের সম্পাদকীয়তে লিখতে বাধ্য হয়, “সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদও ঠিক এই ঘৃণাকেই চায়। পহেলগামের মর্মান্তিক ঘটনাকেও সেই ঘৃণা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা তো বটেই, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা। এই ঘৃণা উগ্র হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রধান মূলধন, ফলে পহেলগামকে কেন্দ্র করে যত দূর পুঁজি বাড়িয়ে নেওয়া যায়, সে চেষ্টা চলছে। আইটি সেলের মিথ্যা প্রচার তীব্রতর হয়েছে; বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই একে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে দেগে দিয়ে তার বদলা নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। বহু সংবাদমাধ্যমও ন্যক্কারজনক ভাবে এই ভয়ঙ্কর খেলার দোসর— টেলিভিশনের জনপ্রিয় অ্যাঙ্কর ‘সেকুলার’-দের দেশত্যাগ করতে বলছেন। সংবাদমাধ্যম - সমাজমাধ্যমে তারস্বরে অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে যে, ধর্মে মুসলমান বলেই ভারতের প্রতিটি মুসলমান এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী। …দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্র জানে, ঘটনার অভিঘাত ফুরানোর আগেই যদি ঘৃণাকে সর্বাত্মক করে তোলা যায়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্মৃতিতে শুধু ঘৃণাই থাকবে।” (সম্পাদকীয়, ২৮ এপ্রিল ২০২৫)
২
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক-মুহূর্ত। হঠাৎ করে শ্রীনগরের অদূরে পুলওয়ামায় বিস্ফোরক-ভর্তি এক গাড়ি চলমান ভারতীয় সেনা কনভয়ের গাড়ির সারিতে ঢুকে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ৪০ জন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারান। কী করে শ্রীনগরের এত কাছে, পুরোপুরি সেনাবেষ্টিত পথে, ‘পাকিস্তানী সন্ত্রাসবাদীরা’ বিস্ফোরক-ভর্তি গাড়ি সমেত ঢুকে পড়ে, সে রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। কিন্তু দেশপ্রেমের প্রবল উন্মাদনায় ভারতের বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বালাকোটে উড়ে গিয়ে জঙ্গিঘাঁটি নাকি গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছিল। তাতেও তো জঙ্গিহানা রোখা গেল না। ছয় বছর বাদে, আবার যখন বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তখন জঙ্গিরা আবার দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরীহ পর্যটকদের উপর আক্রমণ চালালো। দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিদের অবাধ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সম্পর্কে সরকার কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ। অবশ্য কাশ্মীরের লেফটেনান্ট গভর্ণর, সম্ভবত দিল্লির প্রভুদের নির্দেশে, সম্প্রতি গোয়েন্দা ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
যাই হোক, এবারে আর একদিনের অভিযান নয়। রীতিমতো যুদ্ধ। নাম দেওয়া হল ‘অপারেশন সিন্দুর’।
৩
পহলগাম হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে অবশ্য অপারেশন সিন্দুরই ভারতের প্রথম পদক্ষেপ নয়। ইতিপূর্বে ভারত পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে ‘সিন্ধু জলবন্টন চুক্তি’ একতরফা প্রত্যাহার করে নেয়। সিন্ধু চুক্তি বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালের এক আন্তর্জাতিক চুক্তি। শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, ঝিলম, চন্দ্রভাগা এবং সিন্ধু— এই ছয়টি নদীর জলবন্টন ব্যবস্থা এই চুক্তির মাধ্যমে নিরূপিত হয়েছিল। প্রথম তিনটি নদী ইস্টার্ণ বা পূর্বপ্রান্তের নদী বিভাগের অন্তর্গত এবং ভারত এই নদীগুলির জল ‘অবাধ’ ব্যবহারের অধিকারী। অন্য তিনটি নদী ওয়েস্টার্ণ বা পশ্চিম প্রান্তের নদী বিভাগের অন্তর্গত এবং পাকিস্তান এই নদীগুলির জল ‘অবাধ’ ব্যবহারের অধিকারী। ভারত এই নদীগুলির প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ কতটা আটকাতে পারবে এবং পাকিস্তানে তার প্রভাব কতটা পড়বে, তা’ এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত, এই চুক্তি প্রত্যাহারের ফলে যে ক্ষতিটা হবে, তার ফলভাগী হবে একমাত্র পাকিস্তানের গরিব কৃষক। সন্ত্রাস কতটা প্রতিহত করা যাবে, তা’ নেহাতই অনুমানের বিষয়।
৪
এরপরই শুরু হয় অপারেশন সিন্দুরের তোড়জোড়। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সাজসাজ রব। আকাশযুদ্ধে ফ্রান্স থেকে সদ্যপ্রাপ্ত রাফালে বিমানও ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানও শুরু করে ‘অপারেশন বুনিয়ান মার্সু’।
অল্প কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সেনা প্রধান আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়েছিল। তাঁরই নেতৃত্বে পাকিস্তান শুরু করে পাল্টা যুদ্ধ। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানান যে, “সুচিন্তিত ও নিখুঁত ভাবে সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত শিবির এবং অন্যান্য ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। কোনো অসামরিক ব্যক্তির ক্ষতি হয়নি।” পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র অবশ্য দাবি করেছিলেন যে, “ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ৩১ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ৫৭ জন আহত হয়েছেন।”
সে যাই হোক, মোদী টিমের যুদ্ধ উন্মাদনায় জল ঢেলে দিলেন স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১০ মে ২০২৫ ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম “ট্রুথ সোশ্যাল-এ” বার্তা দেন, “After a long night of talks mediated by the United States, I am pleased to announce that India and Pakistan have agreed to a FULL AND IMMEDIATE CEASEFIRE. Congratulations to both Countries on using Common Sense and Great Intelligence”। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র সচিব (Secretary of State) মার্কো রুবিও “এক্স” সমাজ-মাধ্যমে আরও বিস্তারিত লেখেন যে, “Over the past 48 hours, VP Vance and I engaged with senior Indian and Pakistani officials, including Prime Ministers Narendra Modi and Shehbaz Sharif, External Affairs Minister Subrahmanyam Jaishankar, Chief of Army Staff Asim Munir, and National Security Advisors Ajit Doval and Asim Malik. I am pleased to announce the Governments of India and Pakistan have agreed to an immediate ceasefire and to start talks on a broad set of issues at a neutral site” (NEWS18, May 10, 2025)। মোদী বা মুনির কেউই ট্রাম্পের মধ্যস্থতা করার কথা স্বীকার না করলেও, দু-পক্ষই, ১০ মে, অর্থাৎ মাত্র চার দিনের মাথায় রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন।
কর্নেল সোফিয়া কুরেশি (ছবি - এনডিটিভি)
কেউ মানুক আর নাই মানুক, ডোনাল্ড ট্রাম্প, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরের দিন থেকেই, নিজেকে বিশ্বের স্বঘোষিত প্রভু হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা প্রকাশ্যেই বলেছেন, “ট্রাম্প যেন ভুলে না যান যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, বিশ্বের সম্রাট হওয়ার জন্য নয়।” কিন্তু সবাই তো লুলা নন। তাই শুধু পাক-ভারত যুদ্ধে নয়, “হাজার বছরের কাশ্মীর সমস্যা” সমাধানেও তিনি যখন ট্রুথ-বার্তা দেন, তখনও ‘হাউডি মোদী’র সাহস হয় না, ‘নমস্তে ট্রাম্পে’র কথার প্রতিবাদ করার।
৩৭০ ধারা বাতিলের পর, কাশ্মীর এখন খোলা বাজার। গত দু’বছরে, কেন্দ্রীয় সরকার ৮৩,৭৪২ জন বহিরাগতকে, কাশ্মীরে ডোমিসাইল সার্টিফিকেট দিয়েছে। কাশ্মীরের জমিতে কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ শুরু হয়ে গেছে। ব্যবসায়ী মানুষ ট্রাম্প সেই খবর রাখেন না, তা তো নয়। তাই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তাঁর উৎসাহের উৎসটাও খুব একটা গোপন নয়। দেখা যাক, কাশ্মীর সমস্যার অদ্যাবধি ঘোষিত দ্বিপাক্ষিক চরিত্রটা বজায় থাকে কিনা।
৫
এই মুহূর্তে পৃথিবীটা এক যুদ্ধক্ষেত্র এবং একই সঙ্গে নিপীড়ন ভূমি। ইউক্রেন, প্যালেস্তাইন, আফ্রিকার সুদান সহ বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চলছে। যবে থেকে উপনিবেশবাদের আবির্ভাব হয়েছে, তবে থেকে যুদ্ধই জমি ও সম্পদ লুণ্ঠনের প্রধানতম পন্থা। কাশ্মীরের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার আগে ভারত ভূখণ্ডের ‘দেশীয় রাজ্যগুলি (৫৬৫টি) Stanstill Agreement বা স্থিতাবস্থা চুক্তি দ্বারা ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর উক্ত রাজ্যগুলি যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে নূতন করে স্থিতাবস্থা চুক্তির মাধ্যমে শর্তাধীন স্বাধীন সত্তা বজায় রাখতে পারতো, অথবা Instrument of Accession বা অন্তর্ভূক্তি দলিলের মাধ্যমে ভারত বা পাকিস্তান ভুক্ত হতে পারতো। যেমন, হায়দ্রাবাদের নিজাম ভারতের সঙ্গে তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মাধ্যমে প্রথমে স্থিতাবস্থা চুক্তি করেছিল। জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন শাসক মহারাজা হরি সিং নিজেদের স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার উদ্দেশে ভারত ও পাকিস্তান, উভয় রাষ্ট্রের নিকট স্থিতাবস্থা চুক্তি প্রেরণ করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার প্রাথমিক ভাবে চুক্তি করতে সম্মতি জানিয়ে কাশ্মীরের মহারাজাকে চিঠিও দিয়েছিল। ভারত কিন্তু তৎক্ষণাৎ সম্মতি দেয়নি। ভারতের প্রশাসন মহারাজার প্রতিনিধিকে আলোচনার জন্য দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানায়। এরপর কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ক্রমশ জটিল হতে শুরু করে। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গি আক্রমণে ভয় পেয়ে, মহারাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করলে, ভারত সরকার ‘অন্তর্ভুক্তি চুক্তি’তে স্বাক্ষরের বিনিময়ে কাশ্মীরে সেনা পাঠাতে সম্মত হয়। অবশেষে ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ ভারত সরকারের পক্ষে গভর্ণর-জেনারেল মাউন্টব্যাটেন এবং জম্মু ও কাশ্মীরের পক্ষে মহারাজা হরি সিং অন্তর্ভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন। জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভূক্ত চুক্তির শর্ত অনুসারেই ভারতীয় সংবিধানে ৩৫এ এবং ৩৭০ ধারা সংযুক্ত হয়েছিল।
ইতিমধ্যে পঞ্চনদ দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মহারাজা হরি সিং-এর কাশ্মীর এখন চতুর্বিভাজিত। পশ্চিম প্রান্তে এক খণ্ড পাকিস্তানের দখলে; যার নাম ‘আজাদ কাশ্মীর’। পূর্ব প্রান্তে বেশ বড়ো এক খণ্ড চীনের দখলে; যেটা ‘আকসাই চীন’ নামে পরিচিত। এবং ভারতের মধ্য লাদাক জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাক-ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখাকেই বাস্তবত কাশ্মীরের পশ্চিম প্রান্তের সীমান্ত রেখা হিসাবে মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
পূর্ব প্রান্তে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Actual Control- LAC) বরাবর, মাঝেমধ্যে চীন এবং ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ছোটোখাটো সংঘর্ষ লেগে থাকলেও, সেটাকেই সীমান্তরেখার মান্যতা দেওয়া হয়েছে।
৬
কাশ্মীরের সমস্যাকে সীমান্ত সমস্যা হিসাবে দেখাটাই ভুল। বস্তুত প্রথম থেকেই কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারত ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এসেছে। কাশ্মীর প্রসঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত রাষ্ট্র প্রথমাবধি কাশ্মীরের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে এসেছে। বারংবার নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সেই ইতিহাস আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই। কিন্তু ফল যেটা হয়েছে, ক্রমাগত উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রনীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল এবং ক্ষোভ প্রকাশের গণতান্ত্রিক পথগুলিও ক্রমশ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কাশ্মীরের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলিও সঠিক পথে জনগণকে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর প্রায় ৩৩ বছর কাশ্মীরে হিংসাত্মক আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল না। বলরাম পুরী লিখেছেন, “ধীরে ধীরে, নতুন প্রজন্ম থেকে উদ্ভূত নতুন এক নেতৃত্ব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শুরু করে।” ১৯৮৮ সালের জুন মাসে প্রথম কাশ্মীরে হিংসাত্মক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। পুলিশের গুলিতে তিন ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিন বন্ধ ডাকা হয়েছিল। ঐদিন শ্রীনগরে টেলিগ্রাফ অফিস এবং দূরদর্শন কেন্দ্র লক্ষ্য করে দুটি শক্তিশালী বোমা ছোঁড়া হয়।
পাকিস্তান-ভারত দুপক্ষই জানে যে, কাশ্মীর-বিবাদে নতুন করে আর পাওয়ার কিছু নেই। তবু যে কাশ্মীরের বুকে সন্ত্রাসবাদী হানাদারি হয়, দুই দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তার কারণটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিশাল বেকার বাহিনী, প্রবল দারিদ্র্য দুই দেশেরই অর্থনৈতিক প্রতিচ্ছবি। অথচ অতিধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিরাম নেই। পাকিস্তানে শাসনতন্ত্রে মোল্লাতন্ত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য, ভারতের বুকে বিগত দেড় দশক ধরে হিন্দুত্ববাদী শাসকরা ক্ষমতাসীন। জনগণের মৌলিক সমস্যাকে আড়াল করতে, বিদ্বেষের রাজনীতি উভয় দেশের শাসক গোষ্ঠীর মূলধন।
অন্যদিকে দেশের মানুষ ভুখা থাকলেও, যুদ্ধাস্ত্র আমদানি এবং যুদ্ধাস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুটি দেশই বিশ্ব-তালিকার ক্রমপর্যায় উচ্চ স্থানের অধিকারী। অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে ভারত দ্বিতীয় এবং পাকিস্তান পঞ্চম স্থানাধিকারী। অস্ত্রের বিপুল সম্ভার যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করে। যুদ্ধে আন্তর্জাতিক অস্ত্র-উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির বাণিজ্যিক স্বার্থও জড়িত। মোট কথা এই দুটি দেশ সমস্যাটির কূটনৈতিক সমাধানের বদলে বারেবারে যুদ্ধে যে লিপ্ত হয়, তার কারণ দুই দেশেরই অন্তর্দেশীয় এবং বহির্দেশীয় বাধ্যবাধকতা আছে।
৭
আন্তর্জাতিক স্তরে পহলগাম হত্যাকাণ্ড চূড়ান্ত ধিক্কৃত হলেও ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর তেমন আন্তর্জাতিক সমর্থন জোটেনি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সাফল্য এল অন্যদিক দিয়ে। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়ে, সংসদের তাবৎ বিরোধী দলগুলিকে নরেন্দ্র মোদী নিজের পাশে টেনে নিলেন। সিপিআইএম, কংগ্রেস থেকে তৃণমূল— কেউই মোদী প্যাকেজের বাইরে থাকল না। সবাই নরেন্দ্র মোদী সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে দু’হাত তুলে সমর্থন জানিয়ে মোদীর হয়ে দৌত্যে বেড়িয়ে পড়লেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোতে দেশকে ভেসে যেতে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপি-বিরোধীরাও আজ সামিল।
নরেন্দ্র মোদীর কপালে এটাই ‘সিন্দুরে’র জয়তিলক। দেশবাসী কিন্তু সিঁদুরে মেঘ দেখছে।
*লেখক জানিয়েছেন, এই বক্তব্য জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে রচিত। ইতিমধ্যে সিন্ধু ও গঙ্গা উভয় নদীখাতেই প্রচুর জল ও নুড়ি গড়িয়ে গেছে। সুতরাং এই বক্তব্যকে শুধু ও শুধুমাত্র সেই সময়ের নিরিখেই বিচার করা বাঞ্ছনীয়।