ইদানিং প্রায় রোজই কলিং বেলের ডাকে ঘুম ভাঙছে। রিটায়ারের পর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত বইটই পড়ি, সিনেমা দেখি। বয়স হলে ঘুম কমে যায়, আসতেও দেরি করে। কিন্তু যায় একটু বেলায়, বড়জোর আটটায়। কিন্তু তার মধ্যেই একাধিকবার কলিং বেল বেজে উঠছে। দোতলার ব্যালকনি থেকে হাঁক মারি,
- কেএএএ?
বেল-বাদক পিছিয়ে আসে। ওপর দিকে মুখ তুলে বলে,
- পার্সেল।
- কী নামে?
- সোহিনী রায়।
সোহিনী প্রায় সারারাত জাগে। সবে এম বি বি এস শেষ করল। এইবার টার্গেট ইউ কে গিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা। ওর উঠতে বেলা বারোটা। তারপর চা খেয়ে চান খাওয়া সেরে চলে যায় ওর স্যারের রিসার্চ ইন্সটিটিউশনে। যেদিন নাইট ডিউটি থাকে, তারপরদিন প্রায় বারো ঘণ্টাই ঘুমায়। বাকি সময় হয় বই, নয় ইন্টারনেট। ছাব্বিশ বছর বয়সে পড়ল মেয়েটা সবে। হাসি নেই, বন্ধু নেই, নাচগান নেই, সিনেমা থিয়েটার নেই। শুধু বই আর বই। আর আছে অনলাইনে কেনাকাটা। দোকানে গিয়ে কবে শেষ কিছু কিনেছে আমরা কেউই মনে করতে পারিনা। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি যা যা লাগে সবই আসে অনলাইনে। আসে খাবারদাবার, জামাকাপড়, বইয়ের পাহাড়, ওষুধবিসুধ, সবকিছু। আর আসে অজস্র গিফট। কে বা কারা সেই গিফট পাঠায়, কেন পাঠায় আমরা কিছু জানি না। জিগ্যেস করলে রাগ করে। বলে,
- প্লিজ, লেট মি হ্যাভ সাম স্পেস।
আত্মীয়স্বজন আসা যাওয়া এমনিতেই কমে গেছে আজকাল। এলেও তাদের সঙ্গে খুব একটা কথাটথা বলে না। টুকটাক করে হাই হ্যালো সেরে নিয়েই নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পড়াশুনায় ভাল বলে কেউ কিছু মুখের ওপর বলে না। সবাই একটু দুঃখ পায় ঠিকই। কিন্তু আড়ালে তাদের নিজের নিজের ছেলেমেয়েদের বলে সোহিনীদিদির মতো হতে।
স্কুলে বরাবর ফার্স্ট। ডিভিশনে বরাবর স্টার মার্কস। নিট পরীক্ষায় চূড়ার একটু নিচে। প্রফেসরদের নয়নমণি, সহপাঠীদের ঈর্ষার পাত্রী। বন্ধুহীন, একা এক নিঃসঙ্গ পড়ুয়া। এহেন মেয়ের কেনাকাটা এখন অনলাইনেই নিরানব্বইভাগ হয়ে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জীবন যাচ্ছে আমার। ওর মা ভোরবেলা উঠে ইস্কুলে পালায়। আর যত ডেলিভারির ঝড় বয়ে চলে সকাল আটটা থেকে বেলা বারোটা অবধি আমার ওপর দিয়ে।
অথচ ওদের দেখে মায়াই হয়। শীর্ণ পাকানো সব শরীরগুলো। পিঠের ওপর বড় বড় বস্তা। বেশির ভাগই গরীব এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। কত আর পায়? শুনেছি পাঁচ থেকে দশহাজারের ভেতর ওদের রোজগার। তারমধ্যে খরচ আছে বাইকের তেল, টিফিন। ইদানিং এদের দেখে মন আরও খারাপ করছে কারণ, এক একজনের চেহারার ভেতর ঠিক নিম্নমধ্যবিত্ত ছাপটাও নেই। বরং পোশাক এবং স্বাস্থ্য আর চোখমুখের ধার দেখে তো রীতিমত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে।
সেদিন একটি বছর কুড়ির মেয়ে এসেছিল স্কুটি চেপে। চশমা চোখে, মাথায় হেলমেট। পরনে সালোয়ার কামিজ। পায়ে কেডস। দেখে তো চমকে গেলাম। চশমার ওপারে রীতিমত বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ। স্কুটির ওপর বসেই একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বোঁ করে চলে গেল। পেছনে সেই ঢাউশ ব্যাগ।
মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় এদের দেখলে। লেখাপড়া শিখে শেষে এই কাজ করছে? বাড়ি বাড়ি মাল দিয়ে বেড়ানো? শুনেছি লোগো লাগানো জার্সি, বাইক, হেলমেট, স্মার্টফোন, সবই নাকি এদের কিনতে হয় নিজের পকেটের টাকায়। এই কটা টাকায় সংসার পাতবে কী করে এরা!
সেদিন একটা ছেলে এল সাইকেলে। ডেলিভারি নিতে নিতে বললাম,
- সাইকেলে কতদূর কভার কর?
বলল,
- স্যার, গড়িয়া থেকে গড়িয়াহাট আর ওদিকে পাটুলি থেকে টালিগঞ্জ।
- বাড়ি?
- মুকুন্দপুর।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ওর শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
- জল খাবে বাবা?
- না স্যার, তাড়া আছে।
বলেই, বোঁ করে সাইকেলে উঠে উধাও হয়ে গেল ছেলেটা।
ইদানিং আবার কানে আসছে, ঠিক বেঠিক জানি না, কোনও কোনও কোম্পানি নাকি মাইনেটা সময়মত এদের হাতে তুলে দিতে গড়িমসি করে। বকেয়া ফেলে রাখে দিনের পর দিন। এইসব সাতপাঁচ ভাবনা থেকে আমি আজকাল আর এদের মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারিনা। একদিন চড়া রোদের ভেতর একটা বছর পঁচিশের ছেলে, রোগা, এসে বাইক রেখে সানসেটের নিচে দাঁড়াল। মুখ তেতে বেগুনি। প্যাকেটটা নেওয়ার পর বললাম,
- ভাই, জল খাবে?
ছেলেটি সন্ত্রস্ত স্বরে বলে উঠল,
- না না আঙ্কেল, এখনও অনেকগুলো মাল ডেলিভারি বাকি। এই দেখুন না, ঘনঘন ফোন করছে কাস্টমার।
- নাম কী বাবা তোমার?
- কানাই সামন্ত।
- বাড়ি কোথায়?
- রামঠাকুর আশ্রমের ঠিক পেছনে। আসি আঙ্কেল।
আজ বেল মারার পর যখন বলল ‘পার্সেল’, আমি দোতলা থেকে যথারীতি হাঁক দিলাম,
- কী নাম?
- সোহিনী রায়।
বলেই, ছেলেটি দুপা পিছিয়ে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকাল। দেখামাত্র আমি আরও বিষণ্ণ হয়ে গেলাম। আমাদের যৌবনে মা মাসিরা এদের বলত রাজপুত্রের মতো চেহারা। এখন নাকি বলা হয় হ্যান্ডু, ড্যুড। বয়স সাতাশ আটাশ হবে বড়জোর। ফর্সা, লম্বা, হাল্কা ক্রিম রঙের শার্ট। গুঁজে পড়েছে চকলেট রঙের প্যান্টের ভেতর। জুতোয় পালিশ। চোখে বুদ্ধিদীপ্ত ফ্রেমের চশমা। চুল সামান্য পাতলা হলেও বেশ কায়দা করে এলোমেলো করা। গলির ভেতর, বাড়ির সামনে বা পাশে, বাইক তো দূরস্ত, একটা সাইকেলও নেই ধারে কাছে। একদম পায়দল। তার মানে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনদিন!
আগে অনেকেই একটা লিস্ট বার করে নামধাম মিলিয়ে সই করাত। এখন আর ওসব পাট নেই। দু একজন ওটিপি চায়, বেশির ভাগই চায় না। কিন্তু এই ছেলেটা বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বার করল। ভাঁজ খুলে মেয়ের নামটা খুঁজে বার করে আমার দিকে পেন ঘুরিয়ে ধরে বলল,
- আপনি কে হন, স্যার?
- বাবা।
- এখানে কাইন্ডলি একটা সই করে ফুল সিগনেচার দিয়ে ডেট দিয়ে দেবেন স্যার।
বললাম,
- এসব তো উঠে গেছে আজকাল। তোমাদের কোম্পানি এখনও এই সিস্টেম কেন রেখেছে?
- আমাদের নতুন স্টার্ট আপ স্যার। ওটিপি সিস্টেম এখনও চালু করতে পারিনি। একটু কষ্ট করে সইটা করে দেবেন স্যার।
সই করে দিলাম। কাগজটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল। একবার ভাবলাম জল খাওয়ার কথা বলি। ঐটুকুই তো আমার ক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু ততক্ষণে দেখি গলির বাঁক পার হয়ে চলে যাচ্ছে ছেলেটা।
ভুরভুর করে একটা দামি সেন্টের গন্ধ বার হচ্ছে প্যাকেটের গা থেকে। নানা রঙের ফিতে দিয়ে বাঁধা হয়েছে দামি মোড়কটাকে। সোহিনীকে কেউ গিফট পাঠিয়েছে। ইদানীং কে যে ওর বন্ধু, কে যে সহপাঠী, কে কে গিফট পাঠায়, কিছুই বুঝতে পারি না। মেয়ে যেদিন থেকে ইস্কুলের নদী পার করে কলেজের সাগরে গিয়ে পড়েছে সেদিন থেকে আমরা অসহায়। এরপর তো গিয়ে পড়বে বিদেশে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের মহাসাগরে। তবে এত গিফটের ভেতর কোনটা যে ওর মনের মানুষ পাঠায় তার বিন্দুবিসর্গ ধরতে পারি না আমরা দুজনেই। মাঝে মাঝে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলি,
- তুমি কিছু টের পাও না?
মাথা নেড়ে বলে,
- নাঃ। তুমি কি পাও?
- তুমি না পেলে আমি কী করে পাব? মেয়ে তো?
- ও, ছেলে হলে বুঝি পেতে?
এখানেই কথা থেমে যায়। দু একবার ওর মা মেয়েকে বলতে গিয়েছিল,
- বাইরে যাওয়ার আগে একটা ছেলে দেখি?
এমনভাবে তাকাল, যেন ও বাইরে দাঁড়ানো পাগলাগারদের ডাক্তার আর আমরা খাঁচার ভেতর থেকে সেই ডাক্তারকে এই প্রস্তাবটা দিচ্ছি।
সোহিনীর গলার আওয়াজে চমক ভাঙল,
- তোমার হল? আমি বেরোব, চা দাও।
যাক, আজ একটু আগে উঠেছে। আমি তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে দেখি বসে আছে ডাইনিং টেবিলের বাঁ দিকের চেয়ারটায়। সকালের একফালি রোদ এসে পড়েছে মুখের একপাশে, সাগরের ঢেউয়ের মতো চুলের ভেতর হারিয়ে গেছে সেই রোদ।
গায়ে ফুলতোলা গোলাপি ঢোলা স্লিপিং গাউন। থুতনির নিচে হাতের চেটো রেখে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। এত মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে। নজর লাগার ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মনে পড়ে যাচ্ছে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি নিয়ে আসার দিনটা। এতটুকু থেকে এত তাড়াতাড়ি এতবড় হয়ে যায় কী করে মানুষ?
আর কদিন পর এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আমার বাবা বলতেন বিলেতে যাবে। আমরা বলি ইউ কে। এখন আরও স্পেসিফিক, ইয়র্কশায়ারে। বছর তিনেক মিনিমাম থাকবে ওখানে। ঠাকুর ঠাকুর করে একটা ছেলে যেন, ওখানে হলেও জোটে। এদেশে তো চারিদিকে বেকার। ঝকঝকে ছেলেমেয়েরাও আজকাল ডেলিভারির কাজ করে খাচ্ছে। ওদেশে নিশ্চয়ই এত আকাল পড়েনি। সোহিনীর মাপ মতো ছেলে হয়ত এখানে আছে। কিন্তু আমরা তাদের নাগাল কী করে পাব? আমি ছাপোষা কেরানি আর ওর মা মাস্টারনি। গরীব ঘরের ছেলেরা আগে হামেশা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হত। বড়লোকের মেয়েরা তাদের প্রেমেও পড়ত। বাংলা সিনেমা তো দাঁড়িয়েই ছিল সেই সব গল্পের ওপর। এখন বড়লোকের ছেলেরা টুকটাক করে ডাক্তার হচ্ছে। ততো বড়লোক তো আমরা এখনও নই। কাজেই ওইসব ঘরের ছেলেরা আমাদের নাগালের বাইরে। তাই একমাত্র ভরসা হল সোহিনী। ও যদি অন্তত ওর সহপাঠীদের ভেতর থেকে, সিনিয়ার জুনিয়ার জাত গণ গোত্র রাশি মিলুক আর নাই মিলুক, একটা খুঁজে নিতে পারে তো আমরা নিশ্চিন্ত হই।
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভুরু কুঁচকে দেখে মোড়কটা খুলতে খুলতে মেয়ে চলে গেল ঘরের ভেতর। পা দিয়ে ঠেলে বন্ধ করে দিল ওর বেডরুমের দরজাটা। আনন্দের রেখামাত্র দেখা গেল না মুখের কোথাও। আমি ফিরে গিয়ে চা বসালাম ইলেকট্রিক কেটলিতে। এক মিনিটও কাটেনি। দুম করে খুলে গেল দরজা। ধমাস করে মোড়ক ছেঁড়া প্যাকেটটা ডাইনিং টেবিলের ওপর আছড়ে ফেলে দিয়ে ধড়াম করে ফের বন্ধ করে দিল দরজাটা। কেবল শুনতে পেলাম,
- লস্ট, গেট লস্ট।
সাবধানে উঁকি মারলাম। মোড়কের গায়ে কোনও কোম্পানির লোগো নেই। আশ্চর্য! খেয়াল করিনি তো! নামহীন প্যাকেটের ভেতর থেকে উঁকি মারছে আরও কিছু পিচবোর্ডের সুদৃশ্য বাক্স। সবার ঢাকনা খোলা। কোনটায় নামী কোম্পানির চকলেট। কোনটায় কেক। কোনটায় সুন্দর সুন্দর স্টিকার। এক পাশে দামি কাগজে সুন্দর করে হাতের লেখায় একটা খোলা চিঠি। কাঁপা হাতে চিঠিটা তুলে নিলাম। কেটলি অফ করে নিজের ঘরে চলে গেলাম সোজা। চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।
‘যাচ্ছ, যাও। আটকাব না। আমি তো বলেইছি, এখান থেকেই এম ডি-টা করে নেব। শুধু বলব, আমার মায়ের কথা ভেবে রেজিস্ট্রিটা করে তারপর যাও। বিয়েতে, তোমার মতো, আমারও বিশ্বাস নেই। কিন্তু মা? আমার মাকে তো তুমিও বিশ্বাস কর। আমার বাবা নেই, মা-ই সব। কিন্তু তোমার তো বাবা মা দুজনাই আছেন? তাদের তো তুমি ভালোবাসো, বিশ্বাস কর? জীবন তো শুধু একটা মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সমাজ যে চেহারা নিয়েই আসুক না কেন, তুমি আমি আমরা আসলে সবাই সবার সামাজিক সম্পত্তি। দায় সবারই সমান। দায়িত্বও সেইজন্য তো সবাইকে ভাগ করেই নিতে হবে। কথাটা তুলতে গেলেই তো তুমি অবুঝের মতো ফেসবুক, ইন্সটা, হোয়াটসঅ্যাপ, ফোন, সব ব্লক করে দিচ্ছ। তাই এইভাবে এসে জানানো ছাড়া আরও কোনও রাস্তা ছিল না আমার সামনে। বাকিটা তোমার ওপর।’
স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বাড়ির দরজা অবধি সেধে এসেছিলে তুমি! ইশ্, এক গ্লাস জল খেয়ে যাওয়ার কথা কেন বললাম না? কেন জিগ্যেস করলাম না, বাবা, তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়…..
*****