লহরী

লিখেছেন:মিলি ঘোষ

"বই তোমার প্রথম প্রেম। তাই বই।"

                   --উন্মুখদা--

 

চিরকুটটা খুলে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল শ্রীলেখা। এত বছর পর.... 

খামের মধ্যে কাগজটা ঢুকিয়ে ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইল, "কোথায় উন্মুখদা ?"

গাড়ির মধ্যে একবার চোখটা ঘুরিয়েও নিল ।

"দাদা তো হাসপাতালে।"

"হাসপাতালে? কেন? কী হয়েছে উন্মুখদার?"

"আমি ঠিক বলতে পারব না। এই নম্বরে ফোন করলে জানতে পারবেন। দাদার বন্ধুর নম্বর।"

ফোন নম্বর লেখা আর একটা কাগজ এগিয়ে দিল ছেলেটি শ্রীলেখার দিকে।

ছেলেটি গাড়ি থেকে একটা বড়ো ব্যাগ বের করে বলল, "এটা কোথায় রাখব, ম্যাডাম?"

"হ্যাঁ, ভেতরে একটু দিয়ে যান ভাই।"

ব্যাগটা যে ভারী, বোঝাই যাচ্ছে। তাই শ্রীলেখার হাতে না দিয়ে সে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। সেরকমই নির্দেশ আছে হয়তো।

ছেলেটিকে বসতে বলে শ্রীলেখা ভেতরে গেল ওর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে।

ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে বলল, "না ম্যাডাম। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।"

"সেই কলকাতা থেকে এসেছেন আপনি, একটু কিছু না খেয়ে যাবেন না।" 

ভেতরে চলে গেল শ্রীলেখা।

 

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার পরেই চিন্তাটা চেপে ধরল শ্রীলেখাকে। 

উন্মুখদা হাসপাতালে কেন? সিরিয়াস কিছু? এতগুলো বই এক সঙ্গে পাঠিয়েই বা দিল কেন? বুকের মধ্যেটা ধক করে উঠল শ্রীলেখার।

টেবিলে রাখা কাগজটা দেখে মোবাইলে নম্বর টিপে বিফল হলো। ফোনের ওধারের ব্যক্তিটি ব্যস্ত থাকলে যেটুকু ধৈর্য্য ধরা দরকার এই মুহূর্তে শ্রীলেখার তা নেই। শেষমেশ কয়েকবারের চেষ্টায় ওদিক থেকে এল ভরাট কণ্ঠস্বর।

“কে বলছেন?”

“আমি শ্রীলেখা বসু।”

“ও, হ্যাঁ। আমি রঞ্জন। উন্মুখের বন্ধু। আপনি সোমনাথের বোন তো?”

“হ্যাঁ। আপনিও কি দাদার সঙ্গে এক কলেজে …”

"না, না। আমি সোমনাথকে একবারই দেখেছিলাম, উন্মুখের সঙ্গে।”

“আমি একবার উন্মুখদাকে দেখতে যেতে চাই। কাল তো রবিবার। কালকেই যাব।”

“বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে চলে আসুন। 'আর জি কর'এ ভর্তি আছে। আমি গেটে থাকব।” 

শ্রীলেখা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল উন্মুখের কী হয়েছে। তার আগেই লাইন কেটে গেল। আবার ফোন করতে সঙ্কোচ হলো। একেই কতবারের চেষ্টায় লাইন পাওয়া গেল। ভদ্রলোক কি খুবই বিজি? না কি উন্মুখদার কী হয়েছে জানাতে চাইছে না ফোনে? এমন হাজারো চিন্তা চেপে বসল শ্রীলেখার মাথায়।

 

মানব মনের বিচিত্র চলনে গা ভাসাল শ্রীলেখা। উন্মুখ অসুস্থ। তবু শ্রীলেখার মন কোথাও যেন গুনগুন করে। উন্মুখ চিরকুটটা কাঁপা হাতেই লিখেছে। শ্রীলেখা কি বোঝেনি? বার বার লেখাটা দেখছে। শুধু দুটো বাক্য। নিতান্তই ছোট। কিন্তু গভীরতায় সাগরতুল্য। খামটা রেখে বইয়ের ব্যাগটা টেনে নিল শ্রীলেখা। উন্মুখদা চিরকালই বাঁধন ভাঙার দলে। তাই বলে, এত বই! প্রতিটি বইয়ের প্রথম পাতার নিচের দিকে দু'তিনটে শব্দ। কোনোটায় লেখা - 'তোমার জন্য'। কোনোটাতে 'আমার লেখাকে'। অথবা 'আজ শুধু তোমার দিন'। 

প্রথম বইটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আরণ্যক'। তারিখ দেওয়া, ২৩শে জুলাই, ১৯৯৪। শ্রীলেখার বুকচাপা শ্বাস বুকেই মিলিয়ে গেল। ৯৩' এর পর আর তো দেখা হয়নি। বইগুলো একটা একটা করে বার করতে লাগল শ্রীলেখা। এর কয়েকটা ওর আগেই পড়া। মোট কুড়িটা বই। ২০১৩ এর জুলাই পর্যন্ত।

 

সকাল থেকে প্রকৃতি আজ শরতের রূপে সেজেছে। এক পশলা বর্ষণের পরে আকাশের হাসি দেখে ভাবাই যায় না, একটু বাদেই সে ঘন মেঘে ঢেকে খোলামেলা পৃথিবীটাকে ছোট করে দেবে। হিসেব মতো এখন শ্রাবণের ঘনঘটা হওয়ার কথা। কিন্তু, আজ বোধহয় নিয়ম ভাঙার দিন। বিকেলের দিকে কোনওরকম আভাস না দিয়েই শন শন শব্দে বাতাসে ছুরির আঘাত। সঙ্গে আকাশের পেট চিড়ে ডাকিনীর মতো বিদ্যুতের হাসি। অসময়ে এত ঝড়! শ্রীলেখা বই পত্র ফেলে রেখে দরজা জানলা বন্ধ করতে ছুটল। কেমন ভয় ভয় করতে লাগল ওর। একেই কি অকাল-বৈশাখী বলে? প্রকৃতি আর মনুষ্য-জীবন কোথাও হয়তো এক সুরে বাঁধা। এই বাঁধনকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা শ্রীলেখার নেই। 

ঝড় বৃষ্টি থেমে গেলে দরজা জানলা খুলল শ্রীলেখা। ঘড়ি দেখল। এমন কিছু রাত হয়নি তো। সবে আটটা বাজে। ভয় ভয় ভাবটা নিজে থেকেই কেটে গেছে। বরং জানলা খুলে বৃষ্টি-স্নাত রাতের সুবাস পেল শ্রীলেখা।

বহুদিন পর শ্রীলেখা গলায় সুর আনল, 'আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার। পরাণ সখা বন্ধু হে আমার।'

গান থামতেই মনের কোন গহন থেকে কেউ যেন ডেকে বলল, শ্রীলেখা, তুমি কি অসুস্থ উন্মুখকে দেখতে যাবে? না কি, দীর্ঘ বিরহের পর তোমার উন্মুখদার সঙ্গে মিলিত হতে যাবে? 

 

১৯৯৩ থেকে ২০১৪, সময়টা নেহাত কম নয়। এই একুশ বছরে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যায়নি উন্মুখের সঙ্গে। অথচ উন্মুখ তখন মেমারিতে একটা স্কুলে পড়ায়। ইচ্ছা করলেই যোগাযোগ করতে পারত। প্রতি বছর ২৩শে জুলাইয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা কার্ড আসত বাড়িতে। কোনও নাম থাকত না, ঠিকানাও না। শুধু মেমারির পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প মারা। সকলেই বুঝত এ কার্ড কে পাঠায়। সেই কার্ড আসাও কয়েক বছর পরে বন্ধ হয়ে গেল। বছর তিনেক আগে দাদার এক বন্ধুর থেকে খবর পেয়েছিল শ্রীলেখা, উন্মুখ মেমারির স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যারাকপুরে চলে গেছে।

“ব্যারাকপুর কেন? কী করে সেখানে উন্মুখদা?”

সদুত্তর আসেনি। খবর বলতে ওইটুকুই। ভেবে কূল পায় না শ্রীলেখা। কী এমন কাজ উন্মুখদার, যে নিজের চাকরি ছেড়ে ব্যারাকপুরে চলে গেল? পলিটিক্স? নাকি, সোশ্যাল ওয়ার্ক? সমাজসেবা অবশ্য উন্মুখদার নতুন কিছু নয়। মানুষের বিপদে উন্মুখদা বরাবরই কোনও কিছু না ভেবেই ঝাঁপায়। এর জন্য মূল্যও কম দিতে হয়নি ওকে। আচ্ছা, অন্য কোনও আকর্ষণ নেই তো? তোলপাড় হয়ে যায় শ্রীলেখা।

 

আর জি কর'এর গেটের এক পাশে দাঁড়িয়েছিল রঞ্জন।

ভেতরে যেতে যেতে শ্রীলেখাকে বলল, "মেসে উন্মুখ আর আমি একটা রুম শেয়ার করে থাকি। কিন্তু এখন যা অবস্থা, হসপিটালে না দিয়ে উপায় ছিল না।"

এসব কথা শুনতে শ্রীলেখার একটুও ভালো লাগছে না। কতক্ষণে উন্মুখের কাছে যাবে ও। 

রঞ্জনের পাশে পাশে হেঁটে যাবার সময় ভাবছিল, "চিনতে পারবে তো উন্মুখদা আমাকে ?" 

তবে শ্রীলেখার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, যত লম্বা সময় পার হোক, উন্মুখদাকে চিনতে ওর ভুল হবে না। কিন্তু কঙ্কালসার উন্মুখকে হাসপাতালের বিছানার সঙ্গে মিশে থাকতে দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না শ্রীলেখা। একবার উন্মুখের দিকে একবার রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, কোথাও ভুল হচ্ছে না তো! 

উন্মুখ কিন্তু চিনতে পারল শ্রীলেখাকে। অবশ্য উন্মুখ জানত শ্রীলেখা আসবে। ঠোঁটের এক পাশ সামান্য নড়ে উঠল। চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। 

রঞ্জন টুলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, "আপনি বসুন ওর পাশে।"

তারপর নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। উন্মুখ বাকশক্তি হারিয়েছে। কিন্তু শ্রীলেখা? কত কী ভেবেছিল, কিছুই বলতে পারছে না। ও নিজেই বুঝতে পারছে না, আসাটা ওর ঠিক হলো, না ভুল। এই উন্মুখকে দেখবে বলে কি দৌড়ে এসেছে শ্রীলেখা ? মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে। মনের মধ্যে শুধু জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসা। এ কোন উন্মুখদা? যার গলায় ডিবেট, তাৎক্ষণিক শোনার জন্য লোকে মুখিয়ে থাকত, সেই উন্মুখদা কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে ? ওরই ভোকাল কর্ড নষ্ট হতে হলো ?

উন্মুখের ডান হাতের কয়েকটা মাত্র হাড় নিজের মুঠোয় বন্দী করল শ্রীলেখা। হঠাৎ ওর রঞ্জনের কথাগুলো মনে পড়ল। রঞ্জন কেন তখন বলল, ওরা মেসে একটা ঘরে থাকে। ও কি চাইছে শ্রীলেখা উন্মুখকে নিয়ে যাক? ভার মুক্ত হতে চাইছে রঞ্জন? 

সাহসে ভর করে বলেই ফেলল উন্মুখকে, "তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো উন্মুখদা। আমাদের প্রান্তিকের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যাব। ও বাড়ি এখন ফাঁকা। ওখানকার মাটি তোমাকে একেবারে ভালো করে দেবে। আমরা আবার এক সঙ্গে স্বপ্ন দেখব।"

কথাগুলো বলার সময় বুক কাঁপতে লাগল শ্রীলেখার। উন্মুখের ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা। অশ্রু-স্নাত সে হাসি দৃষ্টি এড়ায়নি শ্রীলেখার। উন্মুখ জানে, এ মিথ্যে স্বপ্ন। নিজের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে একশো ভাগ ওয়াকিবহাল ও। গলার ক্যানসার, কিডনি কাজ করছে না। একটার পর একটা অর্গান অকেজো হয়ে যাচ্ছে। সবটাই জানে উন্মুখ।

হাসপাতালের নির্দিষ্ট সময়ের শেষে উন্মুখের অসহায় চাউনির দিকে তাকিয়ে বলে এল শ্রীলেখা, "আমি আবার আসব দু'সপ্তাহ পরে।"

উন্মুখের চোখের দৃষ্টিতে কী ছিল কে জানে। দু'সপ্তাহ শুনে কি হতাশ হয়েছিল উন্মুখ? শ্রীলেখা নিশ্চয়ই বুঝেছিল।

বলল, "সামনের রবিবার স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে। আমাকে থাকতেই হবে। সেজন্য শনিবারও কাজ আছে। পরের রবিবার আমি আসছি।"

উন্মুখ চোখের পাতা ফেলে সম্মতি দিল।

 

রঞ্জন নিচে অপেক্ষা করছিল।

অত্যন্ত কুণ্ঠিত স্বরে বলল, "বইগুলো পাঠাতে বেশ দেরি হয়ে গেল ম্যাডাম। মাস চারেক আগে উন্মুখ বইগুলো আপনার ঠিকানায় পাঠাতে বলেছিল। কাগজে বোধহয় কিছু লিখেও দিয়েছিল। তারপর হঠাৎ ওর কন্ডিশন এত খারাপ হলো, আমরা ওকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।"

"আমরা মানে?" কী এক শঙ্কা নিয়ে প্রশ্নটা করে বসল শ্রীলেখা।

"দলের ছেলেরা।"

শ্রীলেখা না বুঝে তাকিয়ে রইল।

রঞ্জন কিছু একটা অনুমান করে বলল, "আপনি কিছু জানেন না?"

মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে না বলল শ্রীলেখা। অভিমান অসম্মান মিলেমিশে একাকার। শ্রীলেখার চোখে প্রায় জল এসে গেল। রঞ্জন বুঝতে পারল শ্রীলেখা আবার একটা ধাক্কা খেল।

সহজ হবার ভঙ্গিতে বলল, "আপনি আবার কবে আসবেন বলুন। সেদিন আপনাকে সব খুলে বলব।"

সন্ধ্যার কলকাতা তখন অপরূপা। অনভ্যস্ত চোখে ঘোর লেগে যায়। শ্রীলেখাও দেখছে নগরীর সাজ। তবে, চোখে ঘোর নেই। সেদিকে তাকিয়েই বলল, "নাহ্, থাক।"

মরমে মরে গেল রঞ্জন। মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঁকি দিল। একটা মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের ওপর অভিমান করা কি অন্যায়? নাকি, ভালোবাসা এমনই! হয়তো জন্ম মৃত্যুর ঊর্ধ্বে থাকা এ এক অনন্য অনুভূতি।

 

সেই শেষ দেখা। এর ঠিক দশ দিন পরেই সব বন্ধন উপেক্ষা করে চলে গেল উন্মুখ। তার আগে দু'দিন ধরে সূর্য তার নিজের ক্ষমতা জাহির করেছে। কিন্তু সেদিন ছিল আকাশের চোখে অবিরত ধারা। তবে খুব সন্তর্পনে। মেঘের ওপারের সাবধানী গুরু গুরু ধ্বনি পর্যন্ত নয়। হয়তো উন্মুখের ঘুম যাতে না ভাঙে, সে'জন্যই।  

রঞ্জন ফোন করেছিল। যেতে চায়নি শ্রীলেখা। শুধু ঘরে বসে পুরো একটা দিন একটানা কেঁদেছে। কান্নাটা গোঙানির মতো। একটা অব্যক্ত কষ্ট। সেটা এতদিন পর উন্মুখের খোঁজ পেয়েও চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা, নাকি একাকিত্বের ভার, সে ও'ই জানে। শ্রীলেখার দাদা মারা যাবার পর ওর মা'ও ঠিক এই ভাবে গোঙাত।

স্কুলের সহকর্মীরা, আশেপাশের লোকজন ছুটে এসেছিলেন। কার জন্য শ্রীলেখা এত কাতর বুঝতে পারেননি কেউ। তবে অনেকেই জেনে গেলেন ছোটোবেলার এক বন্ধুর আকস্মিক প্রয়াণে শ্রীলেখা আঘাতপ্রাপ্ত। 

 

*** 

 

জানলাটা খোলা মাত্র অন্ধকার ঘরে চাঁদের আলো হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল। যেন অপেক্ষায় ছিল। পূর্ণিমা নাকি? আকাশের দিকে মুখ তুলতেই সোনার থালা চওড়া হেসে শ্রীলেখার দিকে তাকাল। জানলা দিয়ে এসে ওর বিছানায় সে স্বর্ণকণা ছড়িয়ে দিল। বিছানার ঠিক সেই জায়গায় গা এলিয়ে নিজেকে স্বপ্নের রাজকন্যা মনে হলো শ্রীলেখার। কোনওদিন শ্রীলেখা এই স্থানে নিজেকে বসাতে চায়নি। চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আজ হঠাৎ সে কল্পনাবিলাসী হলো। এই ভাবনায় কোথাও হয়তো কিছু সুখ ছিল। তবে তা ক্ষণস্থায়ী। ভেসে যেতে যেতেও ফিরে এল শ্রীলেখা। একটু বাদে উঠে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিল। অনেক রাত পর্যন্ত বসে উম্মুখের পাঠানো বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল। বই পড়ার জন্য যে একাগ্রতা দরকার তা এখন শ্রীলেখার নেই। উন্মুখকে হারিয়ে কিছুটা অমনোযোগী বলা যায়। কিন্তু বইগুলোর স্পর্শ পেতে ভালো লাগল। বই খুললে উম্মুখের হাতের লেখা। তার ওপরে হাত বোলাতে বোলাতে স্মৃতির অতলে ডুবে গেল শ্রীলেখা। 

প্রান্তিকে আমাদের এই বাগান ঘেরা ছিমছাম বাড়িটা ছিল বাবার প্রাণ। এই বাড়িতেই দাদার সঙ্গে আসত উন্মুখদা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই বন্ধুর আলোচনা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক সময় বাবাও অংশ গ্রহণ করত। আমি তখন কোন্ ক্লাস? সিক্স কী সেভেন। ওদের কথাবার্তা কিছুই তেমন বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম, উন্মুখদা সমাজের ভালো চায়। অভাবী, নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। 

দাদা মাঝেমাঝে বলত, "রাজনীতিতে জড়াস না। তোর নিজের ক্ষতি হবে। কলেজ ইউনিয়নগুলো তোকে ইউজ করে। তার একমাত্র কারণ, তুই যে কোনও বিষয় নিয়ে ভালো বলতে পারিস।"

"আরে যে কোনও বিষয় নিয়ে বলব কেন ? আমার নিজের তো একটা আদর্শ আছে।"

"তোর আদর্শের কোনও মূল্য ওদের কাছে নেই রে। থাকলে, সব দল তোকে পেতে চাইত না।"

হয়তো দাদাই ঠিক ছিল। কিন্তু উন্মুখদা যা বলত, আমার তা'ই ঠিক বলে মনে হতো। মনে হতো উন্মুখদা কত জানে। ওর মতো করে সবাই কেন ভাবতে পারে না ? 

দাদার মৃত্যু সংবাদটা উন্মুখদাই এসে জানিয়েছিল। বন্ধুরা মিলে পাঞ্চেত বেড়াতে গেছিল। সেখানে দামোদরের জলে তলিয়ে গেল দাদা। দাদা ? এখনও যেন বিশ্বাস হয় না। দাদার জায়গায় উন্মুখদা হলেও হয়তো বিশ্বাস হতো। কারণ, উন্মুখদা বরাবরই বেহিসাবী। বেড়া ভাঙতেই ওর আনন্দ। কিন্তু দাদার মতো ঠান্ডা মাথার মানুষ দামোদরের ভয়াবহতার কথা জেনেও সাঁতার কাটতে নামবে?

বেড়াতে যাওয়ার ব্যপারে সব থেকে বেশি আগ্রহী ছিল উন্মুখদা'ই। তাই দাদাকে মা'র কাছে ফিরিয়ে দিতে না পেরে নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেছিল ও। বাড়িতে আসা কমিয়ে দিল। শুধু পুজোর পরে মা বাবাকে প্রণাম করতে একবার আসত। 

তবে, আগের মতো আর বলত না, "কাকিমা, আমার নাড়ু কোথায় ?"

শুধু হাতে করে একটা বই নিয়ে এসে দাদার টেবিলে রেখে যেত। বইটা যে মৃত বন্ধুর উদ্দেশ্যে আনা নয়, সকলেই বুঝত।

মা'ও নাড়ু করা বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, নারকেল নাড়ু ছিল দাদার ভীষণ প্রিয়। 

একবার পুজোর পরে উন্মুখদা এলে বাবা বলেছিল, "যোগাযোগটা এভাবে বন্ধ করে দিলে উন্মুখ! তবু, তোমাকে দেখলে মনে হয় সোমু এখনও ...."

কথা শেষ করতে পারেনি বাবা। গলা ধরে এসেছিল। 

 

আজ শরীরটা ঠিক বশে নেই শ্রীলেখার। রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে শ্রীলেখা উঠে বসে। ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত একটা। অন্যদিন দু'টোর আগে ঘুমই আসে না। সকালে উঠেই তো স্কুল। বাড়ি ফিরে খাতা দেখা। কিন্তু রাতের এই সময়টা ওর একান্ত নিজের। বইপত্র পড়ে। একই বই বারবার পড়ে দেখে। সময়ের ব্যবধানে সাহিত্যের অর্থ বদলে যায়। একই লেখা, একই পাঠক। কিন্তু দর্শনের প্রভেদ থাকে। এই সময়টুকু তাই শ্রীলেখা নষ্ট করতে রাজি নয়। পৃথিবীও হয়তো গতি কমায় তখন। ঘরের লাইট জ্বেলে রবীন্দ্রনাথের 'গল্পগুচ্ছ' উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে শ্রীলেখার চোখে পড়ল একদম শেষ পৃষ্ঠার সাদা অংশে খুব ছোট হরফে কী যেন লেখা। 

"নেচারটা আমার তারাপদর মতোই। তবু আমি তারাপদ হতে পারিনি। কারণ, তারাপদ হওয়া অত সহজ নয়। পারলে তো সব ভুলে নিজের মতো ছুটে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু, পারলাম কই ?" 

আর একদিন মৈত্রেয়ীদেবী'র 'ন হন্যতে'র শেষ পাতায় উন্মুখের হাতের লেখা খুঁজে পেয়েছে শ্রীলেখা, 

"তুমি তো জানো লেখা, পরজন্মে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু আজ শেষ বেলায় মন বলছে, পরজন্ম থাক। পরজন্ম সত্যি হোক। আর একটা সুযোগ বলতে পারো। পরের জন্মে সত্যি যদি তোমাকে পাই, ফিরিয়ে দিও না, লেখা।"

শ্রীলেখা তারিখটা দেখল। ২৩/০৭/২০১৩. এটাই শেষ উপহার। এরকম প্রতিটি উপহারে কোথাও না কোথাও উন্মুখ তার অস্তিত্ব রেখে গেছে। উন্মুখের হয়তো বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন এই বইগুলো শ্রীলেখার কাছে ও ঠিক পৌঁছে দেবে। পচা গলা জীর্ণ পৃথিবীর অবসান ঘটিয়ে নতুন ভোরে উন্মুখ আসবে। যখন দিগন্তের ওপারে সোনালী রেখা সবেমাত্র উঁকি দেবে, উন্মুখ এসে ডাকবে, "লেখা, দরজা খোলো।" 

 

*** 

 

দশটা বছর কেটে গেল, উন্মুখ নেই। আর পাঁচ বছর চাকরি আছে শ্রীলেখার। নিজেকে গুটিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ওকে গ্রাস করেছে। পৃথিবীর রঙও একটু একটু করে পাল্টেছে। মাঝেমাঝে শ্রীলেখার মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। আবার সূর্যের নরম আলোয় সকালে জেগে উঠে ভাবে, বেঁচে থাকাটাও জরুরী। শুধু একটা প্রশ্ন শ্রীলেখার রয়ে গেছে। উন্মুখদা ব্যারাকপুরে কোন দলে যোগ দিয়েছিল। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েছিল? নাকি, সমাজ সচেতন মানুষটা সম্পূর্ণ নিজে একটি দল তৈরি করেছিল। উন্মুখদার চলত কীভাবে? কিছুই জানতে পারেনি শ্রীলেখা। রঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করলে জানা যেত। কিন্তু মারাত্মক আত্মসম্মানবোধ থেকে শ্রীলেখা রঞ্জনের কাছে জানতে চায়নি। 

 

সন্ধ্যা হবো হবো। আকাশে তখন বিষণ্ণতার ছোঁয়া। সূর্য ডোবা পৃথিবীর নিভে আসা আলোয় দাঁড়িয়ে বাগান দেখছিল শ্রীলেখা। স্কুল থেকে ফিরে এই সময়ে শ্রীলেখা গাছে জল দেয় রোজ। সবথেকে শান্তির জায়গা এই বাগানটা। এখানে রাগ, দুঃখ, অভিমান কিছু নেই। কিন্তু প্রাণ আছে। একটু জল, একটু খাবার পেলেই গাছেরা ফুল ফোটায়। কত কম চাহিদা নিয়ে ওরা বেঁচে আছে। আজ ঝাঁজরির জলে হঠাৎ যেন শ্রীলেখা মায়ের মুখ দেখতে পেল। সেই প্রত্যাশাহীন ক্লান্ত চোখ দুটো।

শ্রীলেখা অস্ফুটে ডাকল, "মা!"

মা যেন শ্রীলেখাকে নিয়ে বেশ কিছুটা পথ পিছিয়ে নিয়ে যাবে বলেই হাত বাড়াল। 

বাবা মারা যাবার পর মা বড্ড একা হয়ে গেছিল। আমি তখন চন্দননগরে একটি স্কুলের শিক্ষিকা। হস্টেলে থাকতাম। সপ্তাহান্তে যখন বাড়ি ফিরতাম, দেখতাম মা রাস্তার দিকে চেয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ছুটি কাটিয়ে সোমবার খুব ভোরে উঠে ফেরার ট্রেন ধরতে হতো। তখনও মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একই ভাবে চেয়ে থাকত। গলির মুখে এসে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতাম। ভোরের আধা আলো আধা অন্ধকারে মায়ের ক্রমশ আবছা হয়ে আসা চেহারাটা আমার চোখের পাতা ভিজিয়ে দিত। 

একবার মা বলল, "কিছু একটা সিদ্ধান্ত নে তো এবার। ও আর আসবে না রে।" 

কথাটা শেলের মতো বিঁধেছিল বুকে। ভীষণ ছোট মনে হয়েছিল নিজেকে। অথচ মা কিন্তু ঠিকই বলেছিল। মার অভিজ্ঞ মন বাস্তবটা বুঝেছিল। উন্মুখদা আর আসেনি। কোনওদিন আসেনি।

মা যেদিন মারা যায়, সেদিন ছিল রবিবার। বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়া বাড়তি কোনও অসুবিধা মা'র ছিল না। সকাল থেকে স্বাভাবিকই ছিল। 

কিন্তু বিকেলের পরে হঠাৎ মা এসে বলল, "তোকে যে আমি কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না রে শিলু।" মা'র চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।

"আর কী দেবে, মা ? এত ভালোবাসা রাখারও যে আর জায়গা নেই।"

বললাম, "চলো না মা। চন্দননগরে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে তুমি আর আমি থাকি এক সঙ্গে। থাক এ বাড়ি তালা দেওয়া।"

"না রে। তোর বাবার খুব সাধের এ বাড়ি। অযত্নে ফেলে রাখতে পারি না আমি। আর তা ছাড়া ..."

"তা ছাড়া ?"

"এই বাড়ির প্রতিটি দরজায় জানলায় আমি আজও সোমুর গায়ের গন্ধ পাই। হাতের ছোঁয়া পাই।"

"মা!"

বহুদিন পর সেদিন মা দাদার জন্য কাঁদল। অঝোরে কাঁদল। 

সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল মা। সব পাতা ঝরে গেল। শুধু কাঠামোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল গাছটা।

 

এ'সব ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা নেই শ্রীলেখার কাছে। ঠিক ওই দিনই ওর মা কেন বলল এত কথা ? নিজেকে যেন উজাড় করে দিল। এর আগেও তো শ্রীলেখা ওর মা'কে চন্দননগরে গিয়ে থাকার কথা বলেছে। তখন তো এ'সব কথা বলেনি। মা থাকতে মিউচুয়াল ট্রান্সফারের চেষ্টা করেও পায়নি শ্রীলেখা। সেই সুযোগ এল কিছু কাল পরে, যখন ওর মা নেই। কার কাছে ফিরে এল শ্রীলেখা? এ যে মৃত্যুপুরী! এখন আর দরজায় অপেক্ষারত মা'কে দেখা যায় না। পুরো সংসারটা ঠিকঠাক সাজানো। শুধু মা'ই নেই। বাবা, দাদা তো সে কবেই চলে গেছে। তারপর থেকে মা'কেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিল। অসীম একাকিত্বের মাঝে তাই মা আসে বারেবারে। সে স্বপ্নেই হোক আর বাস্তবের চোরা পথেই হোক।

 

*** 

 

আজ বহুদিন পরে শ্রীলেখা ছাদের ঘর পরিষ্কার করতে গেল। এটা ছিল সোমনাথের ঘর। জিনিসপত্র বলতে একটা তক্তপোশ, তাতে বিছানা পাতা। আর একটা চেয়ার, টেবিল, কিছু বই ও সোমনাথের ছবিটা। যত্নে সাজানো। মা ছাড়া কে করবে এত যত্ন। দরজা খুলে সত্যিই আজ দাদার শরীরের ঘ্রাণ পেল শ্রীলেখা। ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখল। মা কি এই গন্ধটাই পেত সারা বাড়িতে ? 

ছাদের দরজা খোলা পেয়ে রোদটাও আজ নিজের অধিকারে পা ফেলেছে ঘরে। ঘন নীল আকাশ আজ। আর তিন দিন পরে সপ্তমী। কোনও মণ্ডপ থেকে মৃদু একটা ঢাকের বাদ্যি ভেসে আসছে। কিছু কিছু শব্দ থাকে, যা মানুষকে এক লহমায় পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। সোমনাথের ফটোর দিকে একবার তাকাল শ্রীলেখা। প্রতি বছর পুজোর সময় মা দাদার জন্য জামা কিনে এই ছবির সামনে রেখে যেত। বলে যেত, "পুজোতে পরিস।" ক'দিন পরে দাদার আলমারিতে তুলে রাখত। শ্রীলেখার বুকের মধ্যে পাথর চেপে বসছে। শুধু রাশি রাশি সাদা কালো স্মৃতি। মধ্য দূরত্বের শূন্যে একভাবে তাকিয়ে শ্রীলেখা।

হঠাৎ সোমনাথের ছবির দিকে তাকিয়ে শ্রীলেখা আস্তে আস্তে বলল, "তোর এই ঘরে বড্ড মায়া জড়ানো রে, দাদা। কত কথা মনে পরে এ'ঘরে এলে।"

"উন্মুখের কথা ভাবছিস তো ? সত্যি, সে'সব দিন কেমন হারিয়ে গেল, বল ?"

"কেন, আমি তোর কথা ভাবতে পারি না ?"

দাদা যেন হাসল। ভালো করে দেখল শ্রীলেখা সোমনাথের ছবিটা। দাদা কি সত্যিই হাসল ? কেন ? ওর কি মনে হলো, আমি এ ঘরে শুধু উন্মুখদার টানেই আসতে পারি ? 

তারপর নিজের মনেই বলল, "মানুষ না থাকলে কত সুবিধা দেখেছিস দাদা ? যেমন খুশি ভাবা যায়। যেমন খুশি কথা বলা যায়। মনে হয় তোরা যেন উত্তর দিচ্ছিস। এমন করে তাকিয়ে আছিস, যেন কত গল্প করতে চাস।"

 

সেই কবে উন্মুখ বলেছিল, "লেখা, কলমটা ধরো এবার। তোমার যা মনে হয়, তা'ই লেখো। দু'লাইন, দশ লাইন, কুড়ি লাইন। যেমন ইচ্ছা।"

হেসে উড়িয়ে দিয়েছে শ্রীলেখা, "আমি লিখব? তুমি ক্ষেপেছ উন্মুখদা? ও লেখা কেউ পড়বে না।"

"নিজের জন্যই লেখো।"

"জোর করছ কেন বলো তো? ও'সব আমার আসে না।"

"তোমাকে তো আমি রঙ তুলি হাতে নিতে বলিনি। দাবার ঘুটিও সাজাতে বলিনি। ওই সব কাজ যারা পারবে, তাদের। আবার তুমি যেটা পারবে, সেটা তোমার।"

তবু কোনওদিন আঁচড় পর্যন্ত কাটেনি শ্রীলেখা।

শ্রীলেখার কাছে পঞ্চান্ন একটা সংখ্যা মাত্র। এত ভাঙা গড়া, এত উত্থান পতন! শ্রীলেখা হাসে, আসল বয়সটা নিশ্চয়ই একশো দশ হবে।

সোমনাথের ঘর ভালো করে পরিষ্কার করে ওরই টেবিল চেয়ারের দখল নিল শ্রীলেখা। 

দাদার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, "তোর চেয়ারে একটু বসলাম, বুঝলি?"

উন্মুখের সিগেরেটের ধোঁয়ার গন্ধটা এখনও যেন তাজা। চোখ বুজলেই গন্ধটা ঘিরে ধরে। শ্রীলেখা ডায়রি খুলে বসল। কবেকার ডায়রি। উন্মুখই দিয়েছিল। একটা দাগও পড়েনি। আজ প্রথম সেটি কলমের ছোঁয়া পেল। পাতাগুলো লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এই লালচে রঙ কীসের ইঙ্গিত বহন করছে, বিরহ? শূন্যতা? নাকি দৃঢ়তার প্রতীক?

 

শ্রীলেখা লিখতে শুরু করল,

তুমি বলেছিলে উন্মুখদা, আমাদের সংসারে প্রাচুর্য না থাক, ছন্দ আছে। তোমার বাউন্ডুলে হাত ধরলে নাকি সেই ছন্দটুকু যাবে আমার। তাই হাত সরিয়ে নিলে! এই যে তোমার জায়গা থেকে আমাকে বিচার করলে, এ কি অসম্মান নয় আমার? তোমার জীবন, তোমার জগৎ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলে না। এ কী অবহেলা নয়?

এই পঞ্চান্ন বছরে নবজন্ম হয়েছে আমার বহুবার। প্রতিটি জন্ম থেকে জীবনকে দেখেছি। জলের অপর নাম জীবন হলেও জলের ধর্ম কি সে পালন করে? যে দিকে ঢাল পায় জলের মতো সেদিকে গড়ায়? জীবন? না, গড়ায় না। জীবনের গতিপথে প্রচুর চড়াই উৎরাই। তবে, সত্যিই যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, তোমারও জন্ম হয়েছে এতদিনে। এত বড়ো পৃথিবীতে কোথায় লুকিয়ে আছ, বলো তো?

তুমি নিজেই বলেছ, তুমি তারাপদ হতে চেয়েছিলে। কিন্তু পারনি। পারনিই যখন, ফিরে আসনি কেন? কী ভাবছ, আমিও একখানা 'স্ত্রীর পত্র' লিখছি? 'স্ত্রী' শব্দটার প্রতি আমার যে কোনও বাড়তি অনুভূতি নেই, সে তুমি ভালোই জানো। আমার কাছে অনেক দামি 'বন্ধুত্ব'। তবে একটা ব্যপার, জীবনের কাছে কিন্তু দু'জনেই আমরা ডাহা হেরেছি। কারণ, তুমি যা হতে চেয়েছিলে, তা তুমি পারোনি। আর আমি যা পেতে চেয়েছিলাম, পাইনি। নবজন্ম হলেও তুমি আসবে না, জানি। নতুন জীবনে তোমার নাম পাল্টে যেতে পারে। চেহারার পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তুমি তো তুমিই থাকবে। 

রাতের দিকে দূর থেকে ভেসে আসা সাঁওতালদের মাদলের তাল আজকাল আমাকে পাগল করে দেয়, জানো? ওদের ঝকঝকে মাটির বাড়ি, নিপুণ হাতের আলপনার সামনে দাঁড়ালে মাথা আপনেই নত হয়। ওই লাল মাটি, ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুড়ির সারির পথে ভেসে আসা সাঁওতালি সুরে কী সাংঘাতিক মাদকতা আছে। ওদের হাঁড়িয়ার চেয়ে তা কোনও অংশে কম নয়। সাঁওতালদের মাটির জীবন আমাকে চুম্বকের মতো টানে। দেরিতে হলেও বুঝেছি, ওদের সহজতা আর সারল্যের মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে, তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে মিশে যেতেই হবে ওদের মাঝে। তবে, ভয় একটা রয়েছে। আমার চেহারা যে তথাকথিত ভদ্রলোকেদের মতো। ওরা আমাকে ফিরিয়ে দেবে না তো?  

 

*****



 

0 Comments
Leave a reply