বিস্মৃত লেখিকা শৈলবালা ঘোষজায়া

লিখেছেন:গোপাল দাস

শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়া অফুরান আত্মপ্রত্যয়, জেদ, নিষ্ঠা, আত্মসম্মানবোধ আর সৃজনশীলতায় আত্মস্থ থেকে অবিরাম অনুশীলন চালিয়ে বাংলা সাহিত্যের উচ্চ আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর নামের আগে 'শ্রী' এবং পদবীর শেষে 'জায়া' শব্দটি একটু অদ্ভুত লাগে না! আসলে বাড়ির বউয়ের লেখালেখির চর্চা তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ভালো চোখে দেখত না। তাই তাঁদের কাছে আত্মপরিচয় গোপন রাখার জন্য তিনি নামের আগে 'শ্রী' এবং পদবির শেষে ব্যাকরণসম্মত 'জায়া' অর্থাৎ 'স্ত্রী' (তাঁর স্বামী নরেন্দ্রমোহন ঘোষের) শব্দটি ব্যবহার করতেন। তাঁর সময়ে তিনি যথেষ্ঠ খ্যাতিমান হলেও আজকের দিনে তিনি একজন প্রায় বিস্মৃত সাহিত্যিক। এবছরে তাঁর ১৩০ তম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি এই প্রতিবেদনে।

শৈলবালার জন্ম ১৮৯৪ সালের ২ মার্চ (১৩০০ বঙ্গাব্দের ১৯ ফাল্গুন) অধুনা বাংলাদেশের কক্সবাজারে। তাঁর বাবা কুঞ্জবিহারী নন্দী ছিলেন চট্টগ্রামের কক্সবাজার অঞ্চলে সহকারি শল্যচিকিৎসক। মা হেমাঙ্গিনীদেবী ছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষের জ্ঞাতি বোন। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বর্ধমানের সরাইটিকরে গ্রামে। বর্ধমানের রাজবাড়ি সংলগ্ন বালিকা বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী শৈলবালা বিদ্যালয় শিক্ষার বাইরেও বাবা ও বড় দাদার কাছে শিক্ষালাভ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯০৭ সালে তাঁর বিয়ে হয় বর্ধমানের মেমারি গ্রামের হোমিওপ্যাথির ছাত্র নরেন্দ্রমোহন ঘোষের সঙ্গে। তাঁদের সুস্থ-স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবন ছিল মাত্র ১২/১৩ বছরের। কারণ হোমিওপ্যাথি পাশ করে কয়েক বছর ডাক্তারি করার পর নরেন্দ্রমোহন ১৯২০ সালে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হন। সেই অবস্থায় ১০ বছর বেঁচে ছিলেন।

তাঁর লেখা 'শেখ আন্দু' উপন্যাস সেসময়ে পাঠকমহলে এবং আমাদের ঘুণধরা সমাজে আলোড়ন তুলেছিল। এই উপন্যাসের নায়ক দরিদ্র মুসলমান ড্রাইভার শেখ আনোয়ারউদ্দিন ওরফে আন্দু এবং নায়িকা হিন্দু মনিবকন্যা লতিকা। মামুলি আবেগসর্বস্বতাকে পরিহার করে হিন্দু-মুসলমানের সেই প্ৰণয়কাহিনী ধর্মান্ধ এবং রক্ষণশীল মানুষের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জোরালো বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। সেকালের ঘুনধরা সমাজ তাঁর এই দুঃসাহসিক লেখাকে মোটেই ভালভাবে নেয়নি। কিন্তু মানবিক চেতনার দুয়ারে ঘা দিতে সক্ষম হয়েছিল অবশ্যই। জনপ্রিয় এই উপন্যাসটি প্রথমে (১৯১৫ সালে) প্রবাসী পত্রিকায়, পরে গ্রন্থাকারে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল 'গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স' থেকে এবং চার বছরের মাথায় (১৯২১ সালে) ছাপা হয়েছিল এর দ্বিতীয় সংস্করণ। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির তৃতীয় সংস্করণ।

'শেখ আন্দু' শ্রী শৈলবালা ঘোষজায়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। যদিও এই উপন্যাস প্রকাশের আগে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন 'মোহের প্রায়শ্চিত্ত' নামে একটি নাটক, যা প্রকাশিত হয়েছিল 'শেখ আন্দু'-র পরে। নাটক, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, আত্মকথা, ঐতিহাসিক কাহিনী প্রভৃতি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছড়িয়ে ছিল তাঁর সৃষ্টি। তার প্রকাশিত গ্রন্থের কয়েকটি হল : ‘জন্ম অপরাধী', ‘জন্ম অভিশপ্তা', 'নমিতা', 'ইমানদার', 'তেজস্বতী', 'জয়পতাকা', 'চৌকো চোয়াল', 'স্মৃতিচিহ্ন', 'পাহাড়ের পথে', 'মহিমাদেবী', 'অরু', 'গঙ্গাপুত্র', 'রঘু সর্দার', 'অন্তরের পথে' প্রভৃতি। একদা সাড়া জাগানো তাঁর এইসব গ্রন্থগুলির অধিকাংশই আজ আর পাওয়া যায় না। শোনা যায় তাঁর বেশকিছু রচনা এমনকি প্রকাশের মুখও দেখেনি।

শৈলবালা লিখতেন রাত জেগে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। সাহিত্যচর্চায় স্বামীর সহযোগিতা পেলেও রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সমর্থন একেবারেই পাননি। তাঁর স্বামী নরেন্দ্রমোহনই 'শেখ আন্দু' উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি 'প্রবাসী' পত্রিকার অফিসে পৌঁছে দিতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান বিধবা যুবতী শৈলবালা নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও মনের জোর হারাননি। রক্ষণশীল যৌথ পরিবারের আচরণবিধি ও সংস্কার তাঁর দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। একদিকে পিতৃগৃহ থেকে অর্জিত শিক্ষা ও আধুনিকতা, অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির চার দেওয়ালের গন্ডিবদ্ধ বিরক্তিকর জীবন। স্বামীর অকালমৃত্যুতে নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রতারনার শিকার হয়ে দিন কেটেছে অসহায় শৈলবালার।

মনের শান্তির খোঁজে কখনো মেমারিতে, কখনো বর্ধমানে, কখনো পুরুলিয়ার রামচন্দ্রপুরে শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে গিয়ে থেকেছেন। জীবনের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকেই সংগ্রহ করেছেন সাহিত্যসৃষ্টির রসদ। সাহিত্যসাধনার মধ্যে নিমগ্ন থেকে ভুলতে চেয়েছেন জীবনের দুঃখ-গ্লানি। আবার এই মানুষটিই মেমারি বিদ্যাসাগর স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে প্রাতঃ বিভাগে প্রথম নারীশিক্ষার সূচনা করেছিলেন। এছাড়া মেমারি গ্রামে প্রতিবেশী মহিলাদের নিয়ে মহিলা সমিতি গঠন করেছিলেন। মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে নারীশিক্ষা এবং তাঁদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে নানান কর্মকান্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ফর্সা, সুমুখশ্রী অথচ তেজদীপ্ত শৈলবালার অন্তঃকরণটি ছিল অতিশয় কোমল। দরিদ্র প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের তিনি বিনা বেতনে পড়াতেন। তাদের নিজের হাতে তৈরি খাবার খাওয়াতেন। 

'শেখ আন্দু' উপন্যাসের বিষয় নির্বাচন ও প্রকাশভঙ্গির মধ্য দিয়ে শৈলবালা তাঁর লেখকসত্ত্বার শক্তি ও সম্ভাবনার পরিচয় দিয়েছিলেন। ভাবলে অবাক লাগে মুসলমান সমাজ ও জীবন নিয়ে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় না থাকা সত্বেও কী নিপুণতার সঙ্গে 'শেখ আন্দু' সহ 'নমিতা', 'মিষ্টি শরবত', 'অভিশপ্ত সাধনা', 'ইমানদার', 'অবাক' প্রভৃতি মুসলমান জীবনভিত্তিক কাহিনী অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তিনি রচনা করেছেন। তাঁর সময়ে প্রচলিত ধ্যানধারনার বিপরীতে গিয়ে মুসলমান চরিত্র নির্মাণে তাঁর স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছেন।

প্রতিবেশী মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা আদায়ের জন্য তাঁদের নিয়ে তিনি যে মহিলা সমিতি গঠন করেছিলেন তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর 'অরু' উপন্যাসে। এই আখ্যানে সুধা অরুকে বলছে --- "আপনি বিদ্যালয় সংলগ্ন ওই যে নারী-শিল্প বিভাগটা খুলেছেন, সন্ধ্যার অবকাশে গ্রামের বয়স্ক মেয়েরা ওখানে এসে ওই যে কাটছাঁট সেলাই বোনা শেখে, ধর্মগ্রন্থ পাঠ শোনে, ও বিভাগটা বেশ কাজের জিনিস হয়েছে। সদুপায়ে ওদের ওতে কিছু উপার্জনও হচ্ছে, ঝগড়াঝাঁটি, পরকুৎসা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদির বালাইও কমেছে। আপনাদের পরিশ্রমে ওদের মজ্জাগত কুসংস্কার অনেক পরিমাণে সংশোধিত হয়েছে।" অরু তথা অরুন্ধতী তার এতদিনের নিষ্ফল দাম্পত্যের প্রাচীর ভেঙে স্বামী বিবেকানন্দের সেবাধর্মের আদর্শকে নিজের জীবনের ব্রত করে নিয়েছে। উপরন্তু গ্রামের অসহায় মহিলাদেরকে আলোকিত জীবনের পথ দেখানোর কাজেও নিজেকে সঁপে দিয়েছে। এ-তো শৈলবালার নিজের জীবনকথা। শৈলবালা সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট নারী-চরিত্রের মুখে প্রতিবাদী প্রশ্ন উচ্চারণ করাতে পেরেছেন। লেখনীর মাধমে তাঁর এই বিদ্রোহ ঘোষণা সেযুগের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই সাহসী পদক্ষেপ।

তাঁর 'রঙীন ফানুস', 'গঙ্গাপুত্র' প্রভৃতি উপন্যাসে নিম্নবর্গের দরিদ্র মানুষের যে ছবি তিনি এঁকেছেন তাতে দেখা যায় প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও তাঁদের সংযম, সহৃদয়তা ও সততার গুণে তাঁরা সুশিক্ষিত সমাজের মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে। ১৯১৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস 'শেখ আন্দু'তে জাতধর্মের বেড়া ভেঙেছিলেন শৈলবালা। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত 'গঙ্গাপুত্র' উপন্যাসেও অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে আবার ভেঙেছিলেন জাতধর্মের বেড়া। এক ব্রাহ্মণ পরিবারের বধূকে মৃত মনে করে সৎকার করতে আনা হয়েছিল শ্মশানে। কিন্তু ঝড়-জলের রাতে মৃতদেহ দাহ না করেই পরিবারের লোকেরা চলে যায়। শ্মশানের ডোম লালু বুঝতে পারে আসলে সে মৃত নয়, তখনও প্রাণ আছে, কিন্তু স্মৃতিভ্রষ্ট। মেয়েটিকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় সে খুঁজে পেয়েছিল নিজে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে তার সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে। সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে এই অখ্যানকে বৈপ্লবিক বলতেই হয়।

সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি হিসেবে শৈলবালা পেয়েছিলেন একাধিক উপাধি। কবিকঙ্কন চন্ডীর উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে 'সরস্বতী' উপাধি লাভ করেছিলেন। এছাড়া নদীয়ার মানদমন্ডলী তাঁকে 'সাহিত্য ভারতী' ও 'রত্নপ্রভা' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। তাঁর বিপুল সাহিত্যসম্ভার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলেও যথাযথ মূল্যায়ন এবং সংরক্ষণের অভাবে তিনি এবং তাঁর সৃষ্টি দুই-ই আজ প্রায় বিস্মৃতির অতলে। প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের বাইরে শৈলবালার অপ্রকাশিত রচনার পরিমাণও কম নয়। বর্তমানে তাঁর 'সেরা পাঁচটি উপন্যাস সংকলন', কয়েক বছর আগে প্রকাশিত একটি 'অগ্রন্থিত রচনা সংকলন' এবং একটি গল্প সংকলন (এটি সম্ভবত এখন আউট অফ প্রিন্ট) ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়না।

শৈলবালার লেখনী দীর্ঘকাল সক্রিয় ছিল। তাঁর রচনায় অত্যাচারিত নারীর কথা যেমন এসেছে, পাশাপাশি এসেছে নারীশিক্ষার কথাও। তিনি দেখিয়েছেন মেয়েরা শুধু পরিবারেই নির্যাতিত হয় না, সমাজও নানাভাবে প্রতিবন্ধক হয়েছে তাঁদের মর্যাদা ও উন্নতিলাভে। ঊনবিংশ শতকের শেষলগ্নে জন্মে তিনি শত বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে সমগ্র নারীসমাজকে সামাজিক উত্তরণের পথ দেখিয়েছিলেন। আজকের অবক্ষয়ী সমাজের প্রেক্ষাপটে শৈলবালা ঘোষজায়ার মতো মানুষের জীবনকাহিনী ও তাঁর রচনা এখনও পথ দেখাতে পারে, হতে পারে আলোর দিশারী।


 

# লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী ও প্রাবন্ধিক।

 

1 Comments
Leave a reply