স্ফুরণ

লিখেছেন:অনিন্দ্য সান্যাল

 

অর্কপ্রভ আজ সত্তরোর্ধ্ব। তিনি এক বহুমুখী মেধা ও প্রতিভাসম্পন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বিগত কয় বৎসর তাঁর কাজ ক্রমশ গতিহীন হয়ে পড়েছিল। পারিপার্শ্বিক ভূলোক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন তিনি। ঘরের আবছায়ায় একাকী থাকতে চাইছিলেন। শুধু দয়াময়, তাঁর সব সময়ের সেবক - সেই সঙ্গে থাকতো আবছায়ার একটি অংশে।

এমন অবস্থা যখন গাঢ় হয়ে আসছে, একদিন সন্ধ্যায় এক স্বল্প পরিচিত সুধী মানুষ দেখা করতে এলেন অর্কপ্রভ’র সাথে। মানুষটি এসে তাঁর নানান কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করলেন এবং অনুরোধ জানালেন, পাহাড়ে, যেখানে ছোটবেলায় মাঝে মাঝেই বেড়াতে গিয়ে বিস্ময়কর নানান ভাবনা আসতো অর্কপ্রভর মনে, নানান প্রশ্ন করতেন তাঁর বাবাকে, যেসবের কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনী স্ফুরণ-এ উল্লেখ করেছেন, সেখানে তিনি একটিবার যেতে চান তাঁর সাথে। প্রথমটায় কাজের কথা বলে এড়িয়ে গেলেও পরবর্তী কয়েকটি অনুরোধে কিন্তু অর্কপ্রভর মন পরিবর্তন হলো। রাজি হলেন তিনি। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করে, অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হলেন তাঁরা।

অর্কপ্রভ প্রায় আঠারো বৎসর পর এলেন তাঁর স্ফুরণ-এর উৎসমুখে। প্রথম দিন কেটে গেল গোটা অঞ্চলটি ঘুরে বেড়িয়ে, স্মৃতি রোমন্থনে। রাত্রের ঘুম না-ঘুম পার করে ভোরবেলা বাংলোবাড়ির লাগোয়া রাস্তায় একা পায়চারি করতে করতে ভারী মনখারাপ হলো তাঁর। সামনের খাদে মাথা বার করা পাথরটির মাঝখানে আগের মতই পদ্মাসনে বসতে গিয়ে বুঝলেন দেহভঙ্গে পদ্ম ফোটাতে অপারগ তিনি এখন। বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে সহজ ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ মাথা নামিয়ে বসে রইলেন। তারপর মুখ তুলে দূরের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন... কোনো কথা নেই, কোনো সঠিক অভিব্যক্তি নেই।

সুধী কখন এসেছেন জানেন না, তিনিও তাঁর উপস্থিতি প্রকাশ করেন নি। দয়াময় এসে জানালো, চা এনেছি দাদামশায়! অর্কপ্রভ হাতের ইশারায় পাশে রাখতে বললেন। এই সুযোগে সুধী প্রশ্ন করলেন,

- সেই আর এই, সময়যাত্রা-টুকু কেমন লাগছে আপনার?

অর্কপ্রভ সচেতন হলেন, আবার দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে স্বাভাবিকের থেকে ধীর লয়ে বলতে শুরু করলেন,

- এই সময়যাত্রা আমার কাছে ‘টুকু’ নয়। সে যে কতটা, তার তল অতল কার কাছে গচ্ছিত, সে এক অপার বিস্ময়। তবে বলতে পারি, বাবার কথা মনে পড়ে বড় কষ্ট হচ্ছিল। দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম, তিনি কাছেই কোথাও আছেন। আমি তাঁকে আমার পাশটিতে ডাকলাম, একটা প্রশ্ন ভাবনা হয়েছে বলে। বাবা প্রশ্ন জানাতে বললেন, কিন্তু কাছে আসতে পারছেন না। কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল আকাশ। আমি বললাম, খাদ পেরিয়ে আকাশরেখা ধরে আপনার কাছে চলে আসতে পারি, কিন্তু খাদ আর আকাশ আলাদা করতে পারছি না আমি… গাঢ়তর হয়ে আসছে কুয়াশা... সব যদি হঠাৎ হারিয়ে যায় সেই উৎকণ্ঠায় তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলাম, আপনি কেমন আছেন বাবা?

বাবা কোনো উত্তর পাঠালেন না। চুপ করে অপেক্ষা করতে করতে বুঝলাম বাবা আর আমার কাছাকাছি নেই। তিনি ওই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন আমায়। ওখানে তাঁর ভালো থাকা, খারাপ থাকা আমার আর জানার বিষয় নয়।

ফিরে যেতে হবে আমার গুণ ও মানের ঘরে। সেখানে খোঁজ করতে হবে। না থাকলে অপেক্ষা। কোথাও তো ফিরে পেতে হবে তাঁকে।

এ পর্যন্ত জানিয়ে থামলেন অর্কপ্রভ। যেটুকু তাঁর নিজের রইল সে হল সেই শেষের দৃশ্যটুকু। খাদের নীচের দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন তিনি। সে অঞ্চলে কুয়াশা তখন হালকা হয়ে আসছে। চা বাগানের মেয়েরা কাঁধে ঝুড়ি নিয়ে উঁচুনীচু ঢালরাস্তায় গান গাইতে গাইতে কাজে চলেছে। কারো কারো বুকের কাছে আগলে ধরে রাখা শিশুর মুখ। পাহাড়ের কাছে পাওয়া সুরে কুয়াশা গুঁড়িয়ে ওরা একসাথে চলার রাস্তা করে নিচ্ছে। সেই স্নেহমাখা অরূপ সুর তিনি মন দিয়ে শুনে রেখেছেন।

অর্কপ্রভ আরো কয়েকটি দিন থাকতে চাইলেন পাহাড়ের কাছে। সুধী ফিরে এলেন পরের দিন। ফেরার সময় তাঁকে প্রণাম জানালো দয়াময়।

 

 

0 Comments
Leave a reply