কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত – নিসর্গের এক পূজারী

লিখেছেন:সজল চক্রবর্তী

 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (ছবি - https://banglasahitya.net/) 

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কে আমরা 'ছন্দের যাদুকর' বলেই জানি! অথচ তিনি যে একজন নিসর্গ-পূজারীও তা আমাদের খেয়াল-ই থাকে না। অথবা ব'লতে পারি, আমরা তাকে 'ছন্দের যাদুকর' বলেই 'দেগে' দিয়েছি। ...আর তিনি যে-উপাচার নিয়ে বসেছিলেন, নিসর্গ পূজা'র জন্য তা যেন লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেল। এর জন্য আমরা কি কিছুটা দায়ী নই? অবশ্যই দায়ী।

এখন, কেন দায়ী? সেটাই বুঝিয়ে বলি। স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বা রুদ্ধ দল/মুক্ত দলের কূটকচালিতে আমি যাচ্ছি না। বরং সহজভাবে বলা যেতে পারে, সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দে একটা দুলকি চাল বা হাল্কা লাফিয়ে চলা দেখতে পাই। আর এই হাল্কা লাফিয়ে চলাটাই সত্যেন্দ্রনাথের কবিতার প্রাণ! এবং ছন্দের এই চলার পিছনে আছে রুদ্ধদল বা হসন্ত(্)-এর প্রভাব। আর রুদ্ধ দল বলতে হসন্ত চিহ্নিত দলগুলোকেই আমরা বুঝি। উদাহরণ স্বরূপ:অ-প-মা-ন্ । 

.... এবার আমি রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা এবং নজরুলের একটা কবিতার উল্লেখ করছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'আবির্ভাব' কবিতায় লিখেছেন, "চল চপলার চকিত চমকে করিছে চরণ বিচরণ।" এখানে, যে চলাটা আছে, সেই চলাটা কেন জানি না – একটু মন্থর বা ধীর লয়ের! আর কারণটা সহজেই অনুমেয় – রুদ্ধদল বা হসন্ত-এর প্রয়োগ সামান্যই।

এবার, কাজী নজরুল ইসলামের, চল চল চল কবিতা'টি দেখা যাক, 

"চল চল চল !
ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল 
নিম্নে উতলা ধরণী তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল 
চল চল চল।"

এখানে যে-চলাটা আছে, সেই চলা'টা কিন্তু দ্রুত লয়ের। কারণ, এখানে হসন্ত বা রুদ্ধ দলের প্রয়োগ এবং প্রভাব।

এবার একটা আশ্চর্যের কথা বলছি। বলছি 'মুক্ত দল' অথচ চলছে ধীর লয়ে। কিংবা বলছি, 'রুদ্ধদল' আর চলাটা দ্রুত লয়ের।এ যেন এক আপাত-বৈষম্য (Paradox) ! তা যাই হোক – সত্যেন্দ্রনাথের "ভোরাই" কবিতা'র একটা লাইন লিখছি, "আনকো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্মকলির হাই-তোলা" – এখানে রুদ্ধ দল বা হসন্তের প্রয়োগ বা প্রভাব বেশি। সত্যেন্দ্রনাথের প্রায় সব কবিতায় এই হসন্তের প্রয়োগ দেখা যায় – যা তাঁর কবিতার ছন্দের গতি বৃদ্ধি করেছে। আর এই কারণেই নিসর্গের পূজারী সত্যেন্দ্রনাথকে আমরা ছন্দের যাদুকর হিসেবে 'দেগে' দিই।... এবার দেখা যাক, নিসর্গ পূজার জন্য সত্যেন্দ্রনাথ কী উপাচার সাজিয়ে বসেছেন! 'দূরের পাল্লা' কবিতা'টি কাছে এনে দেখি – 

"পাড়ময় ঝোপঝাড় 
জঙ্গল-জঞ্জাল
জলময় শৈবাল 
পান্নার টাঁকশাল।"

এখানে 'পান্না' -সবুজ রঙের রত্ন - কী সুন্দর তুলনীয় হ'য়েছে শৈবাল-এর সঙ্গে! আর এত শৈবাল! যেন, পান্নার এক টাঁকশাল / MINT ! কী সুন্দর নিসর্গ বর্ণন! কিংবা, 

১)  বুনোহাঁস ডিম তার 
               শ্যাওলায় ঢাকছে।

 ২) চুপচুপ – ওই ডুব
        দ্যায় পান কৌটি
        দ্যায় ডুব টুপটুপ 
          ঘোমটার বৌটি।

৩) ডাক পাখি ওর লাগি 
      ডাক ডেকে হদ্দ
   ওর তরে সোঁত-জলে
       ফুল ফোটে পদ্ম।

এত সুন্দর নিসর্গ বর্ণন, সত্যেন্দ্রনাথের আগে কেউ ক'রেছেন বলে তো মনে হয় না। এই "দূরের পাল্লা" কবিতা'য় আমরা ছন্দের টুং-টাং শুনতে পাই। তদুপরি পেয়ে যাই নিসর্গের এক অচিন্তনীয় 'টাঁকশাল' ! প্রকৃত প্রস্তাবে,"দূরের পাল্লা" কবিতা'টি পুরোপুরিই এক অনাবিল 'Landscape Painting ' ! ... আবার 'ভোরাই' কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথের আঁকা পদ্মকলির হাই-তোলা কি ভোলা যায়? কী অনায়াসে সুনিপুণ চিত্রকল্প। "আনকো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্মকলির হাই-তোলা।" কিংবা 'ঘুমের রানী' কবিতা'র "তোঁত পোকাতে তাঁত বোনে আর জানলাতে দেয় পর্দা।"- তে এক অনির্বচনীয় নিসর্গের ডালি সাজিয়ে তিনি বসেন। কবি "পাল্কীর গান" কবিতায় "পেরজাপতির হলুদ বরণ / শশার ফুলে রাখছে চরণ।"-এ প্রজাপতিকে 'পেরজাপতি' করে ছন্দের ভারসাম্য বজায় রাখেন, ছন্দের যাদুকর বলেই। তদুপরি, প্রকৃতির কোন্ কোণে থাকা ছোট্ট প্রজাপতিটির চালচলন ও তাঁর নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই তিনি নিসর্গ-প্রীতিতেও অনবদ্য!

কবি সত্যেন্দ্রনাথ নিসর্গে নিমজ্জিত একজন কবি, তাই তিনি যে-সুনিপুণ শৈলীতে পদ্মকলির হাই-তোলা, তোঁত পোকার তাঁত বোনা কিংবা শশার ফুলে প্রজাপতির চরণ স্থাপন কে চিত্রায়িত করেন তা অবাঙমানসগোচর এবং আমাদের হৃদপিণ্ডে রাখা 'ম্যাণ্ডোলিন'-এ অনুরণন তুলে দিয়ে যায়। আর আমরা বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে বসে থাকি ঘরের দাওয়ায়।

পরিশেষে  – আমরা কোকিলের 'কুহু'তে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেভাবে তার রূপের কথা ভুলে গেছি বা যাই, ঠিক একই ভাবে তাঁর ছন্দের টুং-টাং সত্যেন্দ্রনাথের নিসর্গ-প্রীতিকে আড়ালে রেখে দিয়েছে ।

 

0 Comments
Leave a reply