বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘রাশিয়ার চিঠি’র ইনার কভার (ছবি - https://granthagara.com/)
বাংলার ভ্রমণ সাহিত্যের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন আর তাতে রবীন্দ্রনাথের অবদান বহুমূল্য। তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ শক্তি ও গভীর রসবোধ তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার লেখ্যগুলি বিশেষভাবে মনোজ্ঞ করে তোলে। বিদেশের রীতি-নীতি, শৃঙ্খলাবোধ, দৈনন্দিন জীবনের মধ্য দিয়ে কবি সেই দেশের নাড়িটিও যেন অনুভব করতেন। সেইজন্যেই ভ্রমণ রচনার স্বাদ গ্রহণের সাথে সাথে সেই দেশের মর্মটি পাঠকরা যথেষ্ট অনুধাবন করতে পারেন। এর ফলে ভ্রমণরচনাগুলির শুধুমাত্র সাহিত্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তা নয়, তাদের ইতিহাস-মূল্যও বেড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ (১৮৮১), ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি’ (১৮৯১), ‘জাপান যাত্রী’ (১৯১৯), ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩১), ‘পথের সঞ্চয়’ (১৯৩৯) প্রভৃতি আরও অনেক ভ্রমণরচনাগুলি তাই ইতিহাস ও সাহিত্য দুই বর্গকেই সমৃদ্ধ করে।
“রাশিয়ার চিঠি” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পত্র-প্রবন্ধ সঙ্কলন। প্রকাশকাল ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ (ইংরেজি ১৯৩১)। সোভিয়েত রাশিয়ার শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত মতামত ব্যক্ত হয়েছে এই গ্রন্থের চোদ্দটি পত্র-প্রবন্ধে ও চারটি প্রবন্ধে। গ্রন্থে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতা যেমন ধরা পড়েছে, তেমনই উক্ত ব্যবস্থার নানা দোষত্রুটির দিকগুলি তুলে ধরেও তার সমালোচনা করেছেন কবি। তিনি যখন রাশিয়া গেলেন তখন তাঁর বয়স সত্তর। কবি বলছেন – “আমার পৃথিবীর মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে, প্রিয় হবার নয়।” কবির নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা সম্যক ধারণা পাই এই কথাটির থেকে।
ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ
১৯১৭ সালের বলশেভিক পার্টির বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ায় নব-অভ্যুত্থান বিশ্বইতিহাসের এক যুগান্তকারী কাল পর্ব। রাশিয়ার Tsar সরকারের অসহ্য শাসনমাত্রায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর যে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দানা বেঁধেছিল তার ঐতিহাসিক নেতৃত্বে ছিলেন লেনিন। এই বিপ্লব এগিয়ে যাওয়ার আগেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সহিংস উন্মত্ততা, যা সমগ্র পৃথিবীর জন্যেই ছিল এক সর্বগ্রাসী মহাসংকট। পৃথিবীব্যাপী এত সংঘাতময় অরাজক অবস্থা- এক দেশের প্রতি অন্য দেশের সশস্ত্র আক্রমণের সেই অনভিপ্রেত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা ছিল একেবারে ভিন্ন মাত্রার। ফলে শুরু হওয়া যুদ্ধের উন্মত্ততায় লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর লেনিন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার অভ্যুত্থান ঘটান – মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক আগেই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিক উপাদান দেশের মর্মে বিকাশ না করায় জার-সরকার প্রবর্তিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার পুরোপুরি রদবদল করা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক ধনবাদী দেশ সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় যা পুরো পরিস্থিতিকে বেসামাল করে দেয়। ফলে প্রায় তিন বছর রাশিয়ায় চলে গৃহযুদ্ধের মতো আভ্যন্তরীন সংঘর্ষ। ১৯১৮-এ বিশ্বযুদ্ধের পরেও দু’বছর তার রেশ থাকে। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার হাল ধরেন। মার্কসীয় অর্থনীতিকে অনুসরণ করে বলশেভিক পার্টির আদর্শ ১৯২৬ সালের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার অস্থিতিশীল বিপন্ন সমাজকাঠামোকে অনেকটাই সামলে, স্থিত করে দেয়। এর মাত্র চার বছর পর, অর্থাৎ ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যান রাশিয়া ভ্রমণে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থা কবিকে কতখানি মুগ্ধ করেছিল তার প্রমাণ ‘রাশিয়ার চিঠি’।
‘রাশিয়ার চিঠি’-র মূল বিষয়
রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন সেখান থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি কী ভাবে অত তাড়াতাড়ি দেশটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর একটি বিশেষ অবস্থানে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে। এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য বৈষম্যহীন সমাজে সব মানুষকে একটা সমান অবস্থানে নিয়ে আসা তার যোগ্যতা আর অধিকারের মাপকাঠিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ, অসহায়, নির্বিত্ত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের করুণ আর্তি, এটাই প্রত্যেক দেশের স্বাভাবিক চিত্র। অথচ রাশিয়া সামাজিক সমতার জন্য তার জনগণের বৈষয়িক ও অবস্থানগত যে পরিবর্তন এনেছে সেটাই দেখবার মতো। কবির মতো “যা দেখেছি আশ্চর্য ঠেকবে। অন্য কোনও দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে।”
রবীন্দ্রনাথ সেইসব বঞ্চিত মানুষদেরকে বলছেন “সভ্যতার পিলসুজ” – “মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে – উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।” এরা দেশের ‘বাহন’ – “তাদের মানুষ হবার সময় নেই। দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সবচেয়ে কম খেয়ে, কম প’রে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান।”
কবির মতে এই শ্রেণীর মানুষগুলির জন্য “যথাসম্ভব তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সুখ সুবিধার জন্য চেষ্টা করা উচিত।” আর “রাশিয়ায় একদম গোড়া ঘেঁষে এই সমস্যা সমাধান করবার চেষ্টা চলছে।”
রাশিয়া মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসার মতো অধিকারকে সর্বোতভাবে বজায় রেখে আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকেও সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত রাশিয়াকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে কবির মনে হয়েছে যে শিক্ষাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যা মানবিক বৈষম্য ঘুচিয়ে সাধারণকে এক ক’রতে পারে। এ শিক্ষা শুধুমাত্র অক্ষরজ্ঞান বা প্রাতিষ্ঠানিক নয় বরং প্রায়োগিক যা প্রতিদিনের জীবন নির্বাহের চালিকাশক্তি। কবি আশ্চর্য হয়ে দেখছেন –
“আমাদের সকল সমস্যার সবচেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা। … এখানে সেই শিক্ষা যে কী আশ্চর্য উদ্যমে সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হচ্ছে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষার পরিমাণ শুধু সংখ্যায় নয়, তার সম্পূর্ণতায়, তার প্রবলতায়। কোনও মানুষই যাতে নিঃসহায় ও নিষ্কর্মা হয়ে না থাকে এজন্য কী প্রচুর আয়োজন ও কী বিপুল উদ্যম।”
কৃষি অর্থনীতির শুধু আধুনিকীকরণই নয়, ভূমিতে সমষ্টিক ব্যবস্থাপনা ব্যাক্তিক মুনাফার চাইতে বেশী গুরুত্ব পায়। মানুষের যোগ্যতা অনুসারে উপার্জনক্ষমই শুধু না, বিনোদনের মাত্রায়ও তাদের সম্পৃক্ত করবার সমান উদ্যোগ। কবি দেখছেন–
“এখানে থিয়েটারে ভালো ভালো অপেরা ও বড়ো বড়ো নাটকের অভিনয়ে বিষম ভিড়, কিন্তু যারা দেখছে তারা কৃষি ও কর্মীদের দলের। কোথাও এদের অপমান নেই। ইতিমধ্যে এদের যে দুই - একটা প্রতিষ্ঠান দেখলুম সর্বত্রই লক্ষ্য করেছি এদের চিত্ত জাগরণ এবং আত্মমর্যাদার আনন্দ।”
কবি এখানে শিক্ষার ছাঁচে-ঢালা বিধিকে গলদ বলেই বিচার করেছেন - যা কলের পুতুল তৈরি করবার মাফিক। রবীন্দ্রনাথ এদের কার্যপ্রণালীতে বিভাগ করা কর্মভার বা division of labour লক্ষ্য করছেন। ‘রাশিয়ার চিঠি’-র প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়েতেই আমরা দেখতে পাই কবি রাশিয়ার কার্যাবলীর সাথে ভারতবর্ষ, তাঁর শান্তিনিকেতন তথা ইংল্যান্ডের কার্যপ্রণালীর সম্যক তুলনা করছেন। There is an element of critical study in his observations of how the country is reviving itself.
কবি বলছেন–
“রাশিয়া যে কাজে লেগেছে এ হচ্ছে যুগান্তরের পথ বানানো।”
সোভিয়েত রাশিয়ায় রবীন্দ্রনাথ (ছবি - https://dhaaramagazine.in/)
রাশিয়ায় রবীন্দ্রনাথ দেখলেন জাতিভেদ, বর্ণভেদ কিংবা ধর্মীয় বিভাজন – এ সমস্তকেই তারা জয় করতে সমর্থ হয়েছে। সোভিয়েত-বিপ্লবীরা ধর্মতন্ত্রকে যে নির্মূল করে দিয়েছে কবি তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছেন। তাঁর কাছে “ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভাল।”
রাশিয়ায় এসে কবির মনে হয়েছিল এদেশে না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন তাঁর অসমাপ্ত থেকে যেত। যদিও কবি মূলত রুশ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, জীবন বিস্তারের অগ্রগতি দেখবার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, এখানে পৌঁছে শুধু শিক্ষার সর্বব্যাপকতা নয়, শ্রমিক-কৃষকের জাগরণ, আত্মবিশ্বাসের উন্মেষ, সাহস, সবই তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সমগ্র ‘রাশিয়ার চিঠি’ জুড়ে সেই কথাই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার এই প্রশংসার ফাঁকে বলশেভিক পরীক্ষানিরীক্ষা এবং তাদের মতাদর্শের সম্পর্কেও স্বল্প পরিসরে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ব্যক্ত করেছেন–যা আজকের সমসাময়িক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।