ঋত্বিক কুমার ঘটকের সঙ্গে আলাপ - দ্বিতীয় পর্ব

লিখেছেন:নির্মাল্যকুমার মুখোপাধ্যায়

 

অথচ এই মানুষটার বাবা, সুধীশ ঘটক, ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বড়দা, মণীশ ঘটক, ইনকাম ট্যাক্সের নামী অফিসার এবং কনসালট্যান্ট, সুলেখক। ‘যুবনাশ্ব’ নামে তিনি ছিলেন বেশ খ্যাত। কল্লোল যুগে তার ছোটগল্প রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। সেই সময়কার সমাজের লুম্পেন প্রলেতারিয়েত চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছিল তার গল্পের নায়ক।  

তারই বড় মেয়ে মহাশ্বেতা দেবী। বয়সে ঋত্বিকের প্রায় সমান সমান। তিনিও বড় হয়ে বাম আন্দোলন, আদিবাসীদের অধিকার এবং জঙ্গলের উপজাতিদের অধিকার ও লড়াই নিয়ে অসাধারণ সব কাজ করে গেছেন। পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার। 

মেজদা, সুধীশ ঘটক, ১৯৩৭ সালেই ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে ফটোগ্রাফি এবং টেকনিকালার জগতে উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রিধারী এক দক্ষ নাম। দেশ বিদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতায় জীবনের ঝুলি সম্পৃক্ত। বম্বেতেও কাজ করেছেন অনেক জায়গায়। রামেশ্বর বাগচি, এই ছদ্মনামে লেখালিখি করেছেন, তবে কম। সুগায়ক। ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধে যেতে হয়েছিল তাকে। 

সেজদা, আশিস ঘটক। লোকচক্ষুর আড়ালে একজন সংগঠক, সুগায়ক এবং জনসংযোগ রক্ষায় দক্ষ একজন পরিশীলিত মানুষ। 

ন’দা, লোকেশ ঘটক। কর্মজীবনে নেভাল কমোডর ছিলেন। তিনিও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ছবি তোলা, আঁকা, গান গাওয়া, তার সঙ্গে একজন কৃতী নেভি অফিসার হিসেবে সুখ্যাত। ঋত্বিকের ছবি বানানোর ক্ষেত্রে ইনি ছিলেন একজন বড় প্রেরণাদাতা। 

কনিষ্ঠ ঋত্বিক। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ততদিনে বোঝা গেছে যে এই বংশের ছেলেরা কোনও না কোনও দিকে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাবেই। ঋত্বিকের শুরু গল্প লেখা দিয়ে। ষোল বছর বয়সেই দেশ পত্রিকায় গল্প ছাপা হয়ে গেল। গল্পগুলো পড়লে শিহরণ হবেই। তখনই কাশ্মীর পার্টিশন এবং যুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ একটি গল্প নামিয়ে ফেলেছেন। যেখানে শেখ আবদুল্লা নিজে একটা চরিত্র। এই ধরণের বিতর্কিত লেখা ছাপার পর তিনি যে কেন গ্রেপ্তার হয়ে যাননি সেটাই আশ্চর্যের। 

চারটি বোন। প্রত্যেকে সুশিক্ষিত, মার্জিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমূল লিপ্ত। শেষের বোন আর ঋত্বিক ছিলেন যমজ। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বিবাহসূত্রে থাকতেন এবং একাত্তরের যুদ্ধে সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরিবারের অনেককেই বাড়ি ঘিরে ফেলে গুলি করা এবং গ্রেপ্তার করা হয়।

ঋত্বিক কী কী দেখেছেন যেগুলো তাকে বাধ্য করেছে গল্প নাটক এবং সিনেমায় এতটা ভাঙচুর করতে? 

প্রথমেই দেখেছেন দেশভাগ। দেশভাগের ক্ষত অনেকেই কালের নিয়মে সারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঋত্বিক আজন্ম পারলেন না সেরে উঠতে। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি ছটফট করেছেন এই দেশভাগের করাতের দাগকে মেনে নিতে না পাড়ার যন্ত্রণায়।

তিনি দেখেছেন ছেচল্লিশের দাঙ্গা। শুধু দেখছেন তাই নয়, নিজে ফিল্ডে নেমে ত্রাণ বিলি করেছেন শিবিরে শিবিরে। কাজেই তার কাছে দাঙ্গা একটা খবরের কাগজের বিষয় বা দোতলার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে পাশের পাড়া দাউদাউ করে জ্বলছে টাইপের দেখা ছিল না। 

তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হয়েই বসে থাকেননি। গণনাট্যের একজন চূড়ান্ত সক্রিয় কর্মী ছিলেন। লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন অজস্র গণনাট্য প্রযোজিত নাটক। তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে দলিল, সাঁকো, জ্বালা অমর হয়ে আছে।  

ট্র্যাজেডি হল এই যে, এই কমিউনিস্ট পার্টিই তাকে শো কজ করে। তেইশটা মোট চার্জ দেয়। তার মধ্যে প্রধান ছিল, সিনেমা করবার নামে কমরেডদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে নয়ছয়, মদ্যপান এবং নারীসঙ্গের প্রতি লোভ। 

তিনি প্রতিটি চার্জ ধরে ধরে উত্তর দেন এবং ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। তিনি গ্রুপ থিয়েটার বানাতে শুরু করেন নিজের দল তৈরি করে। একসময় বম্বে চলে যান সিনেমার গল্প এবং চিত্রনাট্য লেখার কাজে। কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫৫ সালে তাকে বহিষ্কার করে দেয়। 

ততদিনে তার জীবনে প্রেম এসেছে। সুরমা ভট্টাচার্য নামে শিলং থেকে কলকাতায় চলে আসা, নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি করবার অভিযোগে শিলং জেলে বন্দী থাকা এক মহীয়সী নারীর সঙ্গে তার প্রেম এবং দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। কন্যাপুত্র সন্তানরা এক এক করে আসতে শুরু করে আর সঙ্গে আসতে শুরু করে একের পর এক ছবির ব্যর্থতার স্রোত। প্রথম ছবি নাগরিক, জীবদ্দশায় মুক্তি পেল না। অযান্ত্রিক প্রশংসা পেল কিন্তু বক্স অফিস পেল না। কিছুটা টাকা এবং অনেকটা খ্যাতি দিল একমাত্র মেঘে ঢাকা তারা। সেই টাকাও জলে গেল কোমল গান্ধার ছবি করতে গিয়ে। নাগরিক সিনেমার ধার মাথার ওপর চেপে রইল। তবু চেষ্টা চরিত্র করে তৈরি করলেন সুবর্ণরেখা এবং যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি এবং সহযোগিতায় পরিচালনা করলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণের কালজয়ী উপন্যাস নিয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। সেই ছবি ভারতে আসতে দেরি হল নানা জটিলতার জন্য। যুক্তি তক্কো আর গপ্পো কিন্তু মানুষকে ভাবাল। খুবই ক্রিটিকাল থিঙ্কিং নিয়ে এই ছবি। নিজের জীবন এবং সমকালীন প্রায় সব রাজনৈতিক ইস্যু সরাসরি চলে এল এই ছবিতে। এখানে যেন নিজের মন এবং শরীরের শবব্যবচ্ছেদ নিজেই করলেন ঋত্বিক। পৃথিবীতে এইরকম ভাবনার ছবি এবং পরিচালক নিজেকে সরাসরি এইভাবে ক্যামেরার সামনে উলঙ্গ করিয়ে দাঁড় করানোর নজির বড় একটা নেই। 

ঋত্বিক তাঁর নিজের সময়ের থেকে শিল্পভাবনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন এটাই বোধহয় তাঁর ট্র্যাজেডি। সত্যজিৎ রায়ের মতো তাঁর ছবিতে আদৌ হলিউডি প্রভাব ছিল না। বরং কিছুটা রুশ পরিচালক আইজেন্সটাইন যেন পেছনে এসে দাঁড়াতেন। জাপানের মিজগুচিও কাঁধে হাত রেখেছেন মাঝে মাঝে। 

মদ্যপানজনিত তাঁর শরীর ধ্বংসের কথা আমরা সবাই জানি। অনেকেই বলে থাকেন হতাশা থেকে তিনি মদ্যপান করতেন। কিন্তু আমি যেটুকু সুরমা ঘটকের লেখায় পেলান, আদৌ তিনি হতাশায় কোনদিন ভুগতেন না। পরপর ছবি ফ্লপ করলেও তাঁর মুখে কোনদিন আর ছবি করব না, কথাটা কেউ শোনেনি। তাঁর সমস্যা ছিল স্নায়বিক। প্রবল অস্থির চিত্তের মানুষ হওয়ার ফলে মদ্যপান না করলে কাজের প্রতি তাঁর মনঃসংযোগ স্থির হত না। একটা একদম ক্লিনিকাল সমস্যা। এর আধুনিক নাম এলকোহল ডিপেনডেন্সি। সমস্যা ছিল, তিনি ধৈর্য ধরে এই অসুখের চিকিৎসা করাতেন না। খুব বেশি বেকায়দায় পড়লে হাসপাতালে ভর্তি হতেন, একটু সুস্থ হতেই যে কে সেই।

বিজন ভট্টাচার্য তাই বলতেন, “ওর ভেতরে একটা ম্যাসোকিস্ট বাস করে যে নিজেকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।”

 

চলবে

 

0 Comments
Leave a reply