ঋত্বিককুমার ঘটকের সঙ্গে আলাপ - প্রথম পর্ব

লিখেছেন:নির্মাল্যকুমার মুখোপাধ্যায়

না, সরাসরি কোনদিনই আলাপ হয়নি। আর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু তাঁর সিনেমার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটিকেই, আমি মনে করি, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপের সূত্রপাত। ধ্রুপদী সঙ্গীতের খেয়াল শুরু হয় আলাপ দিয়ে। ঋত্বিকের মতো একজন একই সঙ্গে ধ্রুপদী এবং যুগপৎ আধুনিক চলচ্চিত্র শিল্পীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল তাঁর শেষতম চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছিল সেই মহা-ছায়াছবি। 

নব্বুইয়ের দশকের একদম শেষ ভাগ। আজন্ম মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠার ফলে সিনেমা বলতে শহরের তিনটে বানিজ্যিক হলই ছিল দেখার একমাত্র ভরসা। এমনই সে শহর, যেখানে তিনটে হলেই একসঙ্গে ‘শোলে’ চলেছিল প্রায় ছ মাস। শেষের দিকে শেষ শো-য়ে লোক হত কম। তখন চলত 'জওয়ানি কি আগ' টাইপের ছবি। প্রথম দুটো শো কিন্তু হাউসফুল ছিল শেষ দিন অবধি। 

এই অবস্থায় জানতে পারলাম, শহরের কিছু মানুষ তৈরি করেছেন একটা সিনে ক্লাব। তথ্যটি দিল কবি জয় গোস্বামী। সে তখনও রানাঘাটের বাসিন্দা ছিল। তাঁর সঙ্গে এক শহরের বাসিন্দা হিসেবে আলাপ ছিলই। সে-ই একদিন টেনে নিয়ে গেল স্থানীয় রবীন্দ্রভবনে। সেই হলের অবস্থা তখন ঝুরঝুরে। তারই মধ্যে, প্যাসেজে একটা টেবিল পেতে তার ওপর প্রোজেক্টর চাপিয়ে দেখান শুরু হয়েছে বুনুয়েল, ত্রুফো, গোদার। সামান্য গুটিকয় মাঝবয়সী মানুষ প্রায় নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে নিয়ে আসছেন কলকাতার সিনেক্লাব থেকে ক্যানগুলো। লোডশডিং হয়ে গেলে বাইরে গিয়ে ধূমপান করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। সেইসব সিনেমা দেখতে ভিড় হচ্ছে না, কিন্তু যারা দেখতে যাচ্ছেন, তারা ঢুকছেন যে মানুষটি হয়ে, বার হয়ে আসছেন অন্য মানুষ হয়ে। সিনেমা, এই রকম যে হতে পারে, আমাদের ধারণার বাইরে ছিল তখন। মনে আছে 'সেভেন্থ সিল' সিনেমা একবার সকালে দেখার পর দুপুরে বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে এসে বিকেলে আবার চালানো হয়েছিল কারণ, ক্যান রাখা যাবে না। কলকাতায় ফেরত যাবে সেই রাতেই। 

সেইসব দুনিয়া কাঁপানো সিনেমা বেশির ভাগই ছিল সাদাকালো। রঙিন ছবির হাতছানি এড়িয়ে সেইসব সিনেমা আমাদের টেনে নিয়ে যেত, সে বড় সহজ কাজ নয়। সিনেমাগুলো কোনটাই শোলের মতো সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে চলত না। শেষ হত দেড়, বড় জোর দু ঘণ্টার মধ্যে। পঞ্চাশ মিনিটের সিনেমাও আসত। 

একদিন শো শেষে সিনে ক্লাবের সেক্রেটারি ঘোষণা করলেন, ঋত্বিক ঘটকের 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' আনা হবে। দেখান হবে রানাঘাট টকিজে ৩৫ মিমি-র পর্দায়, বড় প্রোজেক্টর মেশিনে। সেইজন্য হল ভাড়া এবং আরও ব্যয়-দায় বহন করবার জন্য কিছু বাড়তি চাঁদা দিতে হবে সদস্যদের। শুরু হবে সকাল নটায়।

চাঁদার ব্যাপারে দেখলাম কোনও প্রশ্নই কেউ করল না। কেবল আমি ভাবলাম, নামটুকু শুনেছি। দেখিনি কোনোদিন। সত্যজিৎ মৃণালও খুব একটা এই মফস্বলে দেখান হত না। তবু দু একটি দেখেছি কলকাতার হলে গিয়ে। দেখাই যাক, ইনি কী বলেন। 

নির্ধারিত সকালে, হাড় কাঁপান মাঘের ঠাণ্ডা অগ্রাহ্য করে টকিজে এসে হাজির হলাম। শুরু হল ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপন।

আজ যখন মাঝে মাঝে জয় গোস্বামীর কবিতায় তাঁর ব্যক্তি জীবনের কথা পড়ি, তাঁর স্ত্রী কন্যার নাম উল্লেখ করে তিনি লেখেন, তখন ভাবি, নিশ্চয়ই ও সেদিন ‘যুক্তি তক্কো …’ দেখে বুঝে নিয়েছিল শিল্পীর ব্যক্তিজীবন আর তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে কোনও ফাঁক রাখবার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং সেই ফাঁক না রাখতে পারলে সেই শিল্পকর্ম হয়ে উঠবে তাঁর কাছে বাস্তব, একীভূত এবং ভীষণ ভাবে স্বচ্ছ।

সিনেমায় ‘নীলকণ্ঠ বাগচি’ সেজে ঋত্বিকবাবু যখন আত্মপ্রকাশ করলেন তখন বুঝিনি; তবে পরে ওনাকে আরও পড়তে গিয়ে, খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, নীলকণ্ঠ মানে হল দেবাদিদেব মহাদেব, যিনি সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে আসা গরল কেউ নিতে চাইল না দেখে নিজেই কণ্ঠে ঢেলে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে বাকি সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে আরও জানতে পারলাম কী ভাবে তিনি তাঁর পুরাণ-চেতনাকে সিনেমায় কাজে লাগিয়েছেন বহুবার। এমনকি এই বাগচি পদবি তাঁদের বংশের আদি পদবি, তাকেও তিনি নিয়ে এসে বসিয়ে দিলেন চরিত্রের নামের পাশে। একদম উলঙ্গ হয়ে নিজেকে ক্যামেরার সামনে ছুঁড়ে ফেলবার সঙ্কল্প নিয়েই তিনি এই সিনেমা শুরু করেছিলেন। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সংলাপ, সন্তানের প্রতি স্নেহ, মায়া মমতা, সমস্তই একেবারে ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি মুহূর্তের নির্যাস দিয়ে তৈরি করেছেন। তাঁর মদ্যপ অবস্থা, ভবঘুরে আত্মা, অস্থির চিত্ত, রাজনৈতিক উদ্ভ্রান্তি, একই সঙ্গে সমাজবাদের ওপর গভীর আস্থা, সেই সময়কার, তাঁর ভাষায়, মিসগাইডেড তরুণদের রাজনৈতিক ভাষ্য এবং অ্যাকশন দৃশ্য সুনিপুন মমতায় তুলে এনে একদম ছুঁড়ে মারলেন স্ক্রিনের ওপর। এত লো বাজেট, এত বাধাবিঘ্নময় তাঁর সিনেমাজীবনের যাত্রাপথ, এত উপেক্ষা, এত অবহেলা, এত আর্থিক অনিশ্চয়তা, কোনও কিছুই তাঁর তেজকে এতটুকু কমাতে পারল না। শেষ দৃশ্যে তিনি যেন তাই, ক্যামেরার লেন্সের ওপর নয়, গলে পচে যাওয়া গোটা সিস্টেমটার ওপরেই দেশি মদের বোতলটা উপুড় করে ঢেলে দিলেন।

মনে হল, যে গরল তিনি সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়িয়েছেন, এইবার, শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত বমি করে তুলে ফেলে দিলেন দর্শকের কোলের ভেতর। 

ক্রমশ ...

0 Comments
Leave a reply