তোমার স্বর আমার স্বর - মিলে সুর মেরা তুমহারা!

লিখেছেন:পিয়া চক্রবর্তী

কিছু কিছু দিন অনেক কিছু পালটে দেয়। কিছু কিছু ঘটনা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কিছু কিছু সময়, বা তার মধ্যে দিয়ে যাওয়া, গোটা সমাজটাকেই বদলে দেয়। ঠিক যেমন কোভিডের আগে এবং পরে - এই দুই ভাগে পৃথিবীকে ভাগ করে নেওয়া যায়। কোন কিছুই পুরোটা আগের মতন নেই। ঠিক তেমনই, বিগত দুই মাস ধরে আমরা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। ৯ই আগস্ট ঘটে যাওয়া আর জি কর মেডিকেল কলেজের ভয়াবহ ঘটনা - ও তার পরবর্তীতে আকার পাওয়া গণ আলোড়ন এবং আন্দোলন - সবটাই পালটে দিচ্ছে কি? সময় বলবে। বা হয়তো বলতে শুরু করেছে একটু একটু করে!

আসলে অনেক দিন ধরে জমতে থাকা একটা ক্ষোভের পাহাড় যেন ভলকেনোর মতোই উপছে পড়েছে। চারিদিকে লাভাস্রোত। আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও, তা দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ার পিছনে একাধিক কারণ লুকিয়ে আছে। এই ক্ষোভের অনেকগুলি পরত আছে। 

রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জমে আছে একরাশ রাগ, বিরক্তি ও হতাশা। এই সরকারের দুর্নীতি নিয়ে ‘সুনাম’ আছে চিরকালই, তবে বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে একে বেছে নিয়েছিল - হয়তো কিছুটা লেসার ইভিল তত্ত্ব মেনে। এই ঘটনা মানুষকে মনে করিয়ে দিল, যে আপোষ করতে গিয়ে সেই দুর্নীতির বাসাটাকে এতটাই পোক্ত হতে দেওয়া হয়েছে, যে তা আজ খাস কলকাতা শহরের বুকে এক তাজা প্রাণ, এক ডাক্তারের জীবন, অবিলম্বে শেষ করে দিল। শুধু তো তাতে গিয়ে থেমে থাকলো না, ক্ষমতার দম্ভ আজ এত বেশি, যে যেই প্রতিষ্ঠানে এই নিকৃষ্টতম ঘটনা ঘটল, তার অধ্যক্ষকে অপসারণ বা শো কজ না করে সোজা অন্য কলেজে বদলি? এ কেমন দৃষ্টান্ত? এ কেমন ন্যায়? 

আজকের দিনে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও নারীর শরীর যে একটি যুদ্ধক্ষেত্র, ক্ষমতাদখলের সবচেয়ে বড় টার্গেট, তা কোথাও না কোথাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হল। যেই শহর নারী নিরাপত্তার জন্য গর্ব করে, সেখানে একজন কর্মরতা নারীকে এমন হিংসার শিকার হতে হল। কোথাও না কোথাও গিয়ে এই প্রশ্নও উঠলো - এটা কি শুধু মাত্র ডাক্তারদের বিষয়? না, তা তো নয়। এটা আসলে আরও বড় একটি বিষয়। একটা ঘটনা আমাদের একাধিক সমস্যার সূত্র দিল - নারীদের রাতবিরেতে কাজ করার অধিকার, যে কোন মানুষের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার এবং নারী ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গের মানুষের নিরাপত্তার অধিকার।

দু-তিন দিন আগে খবর পেলাম জয়নগরে একটি নয় বছরের নাবালিকা মেয়েকে ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে। কোচিং পড়ে ফিরছিল সে। তারপর আবার গতকাল ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যাত্রাগাছিতে। ফাঁসি, মৃত্যুদণ্ডের বিধানগুলি আরও বড় করে প্রচার করা হচ্ছে। নতুন বিল পাস করা হচ্ছে সেই মর্মে। কিন্তু এত কিছুর পরেও ধর্ষণ কি বন্ধ হচ্ছে? নির্ভয়ার ধর্ষকেরা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার এত বছর পরে কি গোটা দেশে ধর্ষণ কমেছে? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। 

আমরা আজ দুর্গাপুজোর মধ্যে আছি। আবার থেকেও নেই। আমরা জানি যে উৎসবের সময় এসেছে কিন্তু সেই মেজাজে মিশে আছে অনেকটা মনখারাপ। শুধু তো মন খারাপ না, অনেকটা রাগ, অসহায়তা আর অনিশ্চয়তা। তিলোত্তমা কি সত্যিই বিচার পাবেন? আমরা কি এই আন্দোলনের গতিপথ ধরে রাখতে পারব? মেয়েদের অধিকার, প্রান্তিক মানুষদের অধিকার নিয়ে যে রাত দখলের লড়াই শুরু হয়েছে, তা সত্যিই ফিরিয়ে আনতে পারবে তো হারিয়ে যাওয়া অধিকার? ঘুরে ফিরে এসে একটা লাইনই কেবল মাথায় ঘুরছে - হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে! যাদের আর কিছু নেই, তাদের গলার জোর আছে। একা নয়, সমবেত কণ্ঠের জোর। সবাই মিলে লড়াইটা চালিয়ে গেলে একদিন জাস্টিস আসবেই। মিলে সুর মেরা তুমহারা - তো সুর বনে জাস্টিস কা। 

 

*লেখক বিশিষ্ট সমাজকর্মী

 

 

0 Comments
Leave a reply