বিজ্ঞান এখন জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, মানুষের মনোজগৎ, বস্তু জগত প্রায় সর্বত্র ব্যাপ্ত। বিজ্ঞান যুক্তি নির্ভর, প্রমাণ নির্ভর। কোন অলৌকিকতায় বিজ্ঞান বিশ্বাস করে না। মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটেছে, ঘটে চলেছে বা ঘটবে সব কিছুর মধ্যে রয়েছে ও থাকবে কার্যকারণ শৃঙ্খলা। সেই প্রাচীনকাল থেকে যখন বিজ্ঞান চেতনার সেভাবে বিকাশ ঘটেনি, কার্যকারণ সূত্র মানুষের কাছে সেভাবে প্রকাশিত হয়নি, জগত ও জীবনের বহুমাত্রিক জটিলতার রহস্য উন্মোচিত হয়নি তখন মানুষ অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে রহস্য ভেদের চেষ্টা করেছিলেন নানা অলৌকিকতাকে আশ্রয় করে। যেখানেই রহস্যময়তা ও বিস্ময় সেখানে মানুষ তাঁর কল্পনা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এটা এক ধরনের সরলীকরণ বলা যেতে পারে। এভাবেই মানুষের মনে তৈরী হয়েছিল দেবতার বিগ্রহ, স্বর্গ, নরক, অতিমানবিক শক্তি ইত্যাদি। ধর্মীয় পরিমণ্ডলে দেবতাকে আশ্রয় করে তৈরি হয়েছিল অনেক অলৌকিক আখ্যান বা কাহিনি। সেসব কাহিনীর প্রতি বহু মানুষের এসেছিল বিশ্বাস ও আস্থা। সে বিশ্বাস ও আস্থা এখনো বহু মানুষের মধ্যে বর্তমান। বিভিন্ন পৌরাণিক বিশ্বাস, লৌকিক বিশ্বাস, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নানা প্রথা, সংস্কার, সংস্কৃতি ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিও মানুষের কাছে দেবতারূপে পূজিত হয়েছে। যেখানেই কার্যকারণ সূত্র মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি সেখানে অলৌকিক দৈব শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। শুরু হয়েছে সাকার নিরাকার দৈবশক্তির পূজা, স্তব-স্তুতি। সামাজিক মানুষ সমস্যা ও সংকট মুক্তির জন্য সেই শক্তির সাহায্য ও কৃপা প্রার্থনা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক মানুষের দেব-দেবী পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাগতিক চাওয়া পাওয়া। জাগতিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার জন্য মানুষ মানত করেন দেবতার কাছে। ইচ্ছে পূরণ হলে তিনি দেবতাকে বিশেষ কিছু প্রদান করেন। এ-যেন অনেকটা গিভ এন্ড টেক পলিসি। ঈশ্বরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এক্ষেত্রে থাকে না। জীবনে দুঃখজনক কিছু ঘটলে বহু মানুষই ভাগ্য ও দেবতাকে দায়ী করেন। তাঁদের মনে হয় ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন তাহলে তিনি কেন এই বিপদ থেকে তাঁর ভক্তকে, অনুরাগীকে রক্ষা করতে পারলেন না। এই অবস্থায় অনেকের মনেই ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থা আসে। আবার কেউ কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় নাস্তিকতার দর্শন। বিজ্ঞানমনস্ক নাস্তিক মনে করেন জগত, জীবন ও মহাবিশ্ব এক কার্যকারণ শৃংখলার অনিবার্য পরিণতি। বিবর্তন, অভিব্যক্তি, অভিযোজন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সরল থেকে জটিল জীবের সৃষ্টি হয়েছে। এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবে ক্রম পরিণতি। এবং এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। প্রতিটি জীব কোষেই জটিল জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিরন্তর প্রবহমান। বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতিতে জীবদেহে জিনগত নানা পরিবর্তন ঘটে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এভাবে চলতে চলতে জীবজগৎ বা বিভিন্ন প্রজাতি কোথায় যে পৌছাবে তা আমরা জানিনা। তাই বলতে হয় -”শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলিবে?” সবটাই প্রকৃতির কার্যকারণ সূত্রের খেলা। কিন্তু সে খেলার শেষ নেই তা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। তাই আমাদের জানা বা বোঝা শেষ হয়ে যায়নি। যত সময় যাবে একটার পর একটা রহস্য ও বিস্ময় আমাদের সামনে হাজির হবে। বিজ্ঞান সেই রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে যাবে। এমনিতেই ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এসব নিয়ে রয়েছে অনন্ত কোটি প্রশ্ন। আমরা আমাদের বোধ বুদ্ধি ও পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে কতটুকুই তার রহস্য ভেদ করতে পেরেছি। কোটি কোটি বিস্ময় ও রহস্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের ভাবতে হচ্ছে ভিনগ্রহী বা এলিয়েনদের অস্তিত্ব আছে কিনা এসব নিয়েও। এলিয়েন যদি থাকে তবে তারা কেম,ন তাদের জীবনযাত্রা কেমন, তাদের বিজ্ঞান প্রযুক্তি আছে কিনা, তারা মানুষের চেয়ে উন্নত না অনুন্নত,তাদের বোধ-বুদ্ধি কেমন, তাদের গ্রহটি কেমন আমরা এখনো এসব জানি না। যদি থাকে তাহলে সেখানেও রয়েছে এক মহারহস্য ও বিস্ময় । আবার জীব কোষের ভিতরেও রয়েছে নানা রহস্য। সেখানেও অনুসন্ধান চলছে। সবটা আমাদের এখনো জানা হয়ে ওঠেনি। জানতে জানতে বহুকাল লেগে যাবে। জীবদেহের ভিতরে এই যে নিরন্তর প্রক্রিয়াটি চলছে সেটি আমাদের দৃশ্যগোচর নয়। আমরা তা বুঝতেও পারি না। তা অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন দেহকোষে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, তাকে ইমিউনিটি দিয়ে প্রতিরোধ ও সংকট মুক্তির যে ক্রিয়া চলছে তা যেন এক স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়- “আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।” কিন্তু প্রক্রিয়াটি চলছে। আবার আমাদের মনোজগত সেও এক বড় রহস্যময় জগত। মনের চেতন, অবচেতন, অচেতন স্তরের যে বিন্যাস সেও এক রহস্য। মনোবিজ্ঞানী, মনোবিদেরা সে সব রহস্য সন্ধানে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আজকে যে মনোচিকিৎসা চলছে তার ভিত্তিতে ফ্রয়েড, ইয়ুঙদের মত বহু মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞান নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের মন আসলে আমাদের মস্তিষ্ক বা ব্রেনের বিভিন্ন কার্যকলাপের সমবায়ে গঠিত একটি বিশেষ সত্তা। কোটি কোটি কোষ, স্নায়ূ, কোষ মধ্যস্থিত নানা জৈব রাসায়নিক পদার্থ সব মিলিয়ে এক জটিল প্রক্রিয়ার সমন্বয়। এর সব রহস্য এখনো উদঘাটিত নয়। তবে উদঘাটন প্রক্রিয়া চলছে। আমরা এখনো পর্যন্ত যেসব রহস্য ভেদ করতে পারিনি সেগুলি নিয়ে একটা বিস্ময় কাজ করে সাধারণ মানুষের মনে। হয়তো একজন বিজ্ঞানী বা গবেষক তার কারণ অনুসন্ধান করেন, কার্যকারণ সূত্র খুঁজতে থাকেন, কিন্তু গড়পড়তা সাধারণ মানুষ এতটা গভীরে যেতে পারেন না। বিজ্ঞান নির্দেশিত বা আবিষ্কৃত সত্য যতক্ষণ না তাঁদের সামনে আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা বিস্ময় রহস্যে মুগ্ধ থাকেন। এইযে মহাবিশ্ব বা ব্রহ্মাণ্ড এর ব্যাপ্তি ও অসীমতাও আমাদেরকে বিস্ময়াবিষ্ট করে। এই সূত্র ধরেই মানুষের মনে অনেক সময়ই স্থান করে নেন ঈশ্বর। এই অনন্ত সৃষ্টির পেছনে তাঁরা দেখেন এক স্রষ্টাকে। অভিকর্ষ, মহাকর্ষ, কোয়ান্টামতত্ব, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স এ রকম অনেক কিছু নিয়ে ব্রহ্মাণ্ডে এক অদৃশ্য শক্তির শৃঙ্খলা পূর্ণ খেলা চলছে। সবটাই যেন অদৃশ্য এক মহাশক্তি। আমাদের প্রথাগত যে ধর্মভাবনা সেখানে রয়েছে মূর্তি পূজা, নিরাকার উপাসনা, ধ্যান, জপ, যোগ সাধনা ইত্যাদি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে কিছু রিচুয়্যাল, প্রথা, সংস্কার, আচার বিচার, অলৌকিকতায় আস্থা, বিশ্বাস ইত্যাদি। পৃথিবীতে বহু ধর্ম সম্প্রদায় রয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত, পথ, প্রথা, সংস্কার, দর্শন ইত্যাদি রয়েছে। এসব ধর্ম পালনের উদ্দেশ্য হলো মোক্ষলাভ, নির্বাণলাভ, ঈশ্বরের সাযুজ্য লাভ, পরমাত্মায় লীন হওয়া, স্বর্গ লাভ, সহজানন্দ বা পরমানন্দ লাভ ইত্যাদি। জগতের প্রতিটি ধর্মেই ঈশ্বর লাভের নানা সাধন পদ্ধতি রয়েছে। আসলে ধর্মশাস্ত্রে যাঁকে ঈশ্বর বলা হচ্ছে তিনি এক মহাশক্তি, মহাচৈতন্য। আমাদের দেশে তাকে মাটি পাথরের মূর্তি রূপে পূজা স্তব-স্তুতি করা হয়। এই মহাশক্তি কখনো নারীরূপে কখনো পুরুষরূপেও কল্পিত। ভক্তের মনের সুবিধাজনক বাসনা অনুযায়ী, ভাব অনুযায়ী ভক্ত তাঁর উপাসনা করেন। গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন তাঁকে যে যে রূপে ভজনা করেন তাঁকে তিনি সেই রূপেই কৃপা করেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা - “আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তাই গো।” আসলে সেই এক মহাশক্তিকে মহাচৈতন্যকে নানা জন নানা রূপে ভজনা করছেন। বিভিন্ন রিচুয়্যাল, প্রথা, সংস্কার, আচার-বিচারগুলোও কালে কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। এগুলোর অনেক নেগেটিভ দিকও আছে। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোর মধ্যে গোঁড়ামি সংকীর্ণতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কিছু সুবিধাবাদী মানুষের হাতে পড়ে ধর্মের মধ্যে অনেক বিকৃতিও ঢুকে গেছে। এসব দেখে শুনে বহু যুক্তিবাদী মানুষ ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অনেক ধর্মসংস্কারক এসে যুগে যুগে অনেক সংস্কার কার্য করেছেন। যাতে ধর্ম মানুষের মনে ও জীবনে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু এখনো বিভিন্ন ধর্ম গোষ্ঠীর মধ্যে বিরুদ্ধ ভাব দেখা যায়। একে অপরের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব অনেক ক্ষেত্রেই নেই। তাই অনেকেই ধর্ম বিবর্জিত জীবন কামনা করেন। কবি তো বলেছেন - “ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে / অন্ধ সে জন মরে আর শুধু মারে।” এসব দেখে শুনেই কেউ কেউ ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাদের মতে এটা যেন একটা নেশাজাত দ্রব্যের মতো। কোন সাধকের ভাবসমাধি, অলৌকিক দর্শন কোন কোন যুক্তিবাদীদের মনে হয়েছে শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা। প্রচলিত ধর্মে অনেক যোগী পুরুষ অলৌকিক সিদ্ধাই জাতীয় কান্ড দেখান। যুক্তিবাদীর কাছে এটা এক ধরনের ম্যাজিক বা জাদু। অনেক সাধক বলেন সিদ্ধাই ঈশ্বর লাভের অন্তরায়। তাই তাঁরা ওপথ পরিত্যাগ করেন। রিচ্যুয়াল, প্রথা, আচার বিচার, সংস্কার এসব কিছু ধর্মের বহিরঙ্গ বিষয়। আসলে ধর্মের সারকথা হল অন্তরে শুদ্ধতম চৈতন্যের জাগরণ। প্রকৃত ধর্ম মানুষকে পশুত্ব থেকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করে। মানুষ এই দেব ভাবে উন্নীত হলে দেবোপম হয়ে ওঠেন। এরকম দেবোপম মানুষ জগতে বহু আবির্ভূত হয়েছেন। যীশু, মহম্মদ, গৌতম বুদ্ধ, চৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, নানক, কবীর এরকম অনেক উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। সুফি বাউল এসব ধর্মমতেও আমরা দেখি উদার অসাম্প্রদায়িক মানবতার আলো। প্রকৃত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা জগতের সকল জীব, জড় সকলেরই মঙ্গল কামনা করে। প্রকৃত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা বলে বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়। মানুষকে পশুত্ব ত্যাগ করে দেবত্বে উন্নীত হতে ষড়রিপু জয়ের কথা বলে ধর্ম। এই রিপু গুলি হল কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ ও মাৎসর্য্য। এসব রিপুগুলি মানব দেহের আধারেই লালিত পালিত হয়। এগুলি অসংযত লাগামছাড়া হয়ে গেলে মানুষ পশুতে পরিণত হয়। সমাজ জীবনে ডেকে আনে অবক্ষয়ের অন্ধকার। খুন, যখম, ধর্ষণ এসব পাশবিক ক্রিয়াকর্ম অনিয়ন্ত্রিত রিপু ও প্রবৃত্তির তাড়না থেকেই ঘটে। প্রকৃত ধর্ম এসব থেকে মুক্তির পথ দেখায়। কীভাবে অনিয়ন্ত্রিত রিপু ও প্রবৃত্তিগুলিকে বশে আনা যায় বা সংযত করা যায়, অনিয়ন্ত্রিত আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে লাগাম দেওয়া যায় তার উপায়ও প্রকৃত ধর্ম আমাদের বলে দেয়। ধর্ম মানুষকে সত্বগুণে পৌঁছানোর উপায় বলে দেন। মানুষের মধ্যে যদি সত্বগুণের বিকাশ ঘটে তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। এখন দেখা যায় তমোগুণের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে অবক্ষয়ের অন্ধকার। প্রকৃত ধর্মের সঙ্গে মানবতার কোনো বিরোধ নেই। বরং প্রকৃত ধর্ম মানবতার পরিপূরক। মানুষ যাকে দেবতার রূপে পূজা করেন সে দেবতা আসলে চৈতন্যশক্তিরই আর এক নাম। জীবসেবা, জীবকল্যাণ, নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম এগুলো আমাদের ব্যবহারিক দৈনন্দিন জীবনে একান্ত প্রয়োজন। এসব গুণগুলি যুগ যুগ ধরে প্রকৃত ধর্মের মধ্যে সুরক্ষিত হয়ে আসছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ধর্মান্ধ মানুষ ধর্মের এই প্রকৃত তাৎপর্যটি অনুধাবন না করে তার বাইরের কক্ষপথে ঘুরে বেড়ান। কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন না। বিপদটা তৈরি হয় এখান থেকেই। প্রাচীনকাল থেকেই দেখা গেছে পাপ পুণ্য স্বর্গ নরক ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে স্বেচ্ছাচারী নীতিভ্রষ্ট মানুষদেরকে মহত্বর সত্যের প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে স্বর্গ নরকের অবস্থান মানুষের মানসিক অবস্থায় । ভালো কাজের যে আনন্দ সেটাই স্বর্গসুখ, আর অন্যায়, অসত্য, মিথ্যাচার, অনৈতিক কার্যকলাপ, ভন্ডামি জনিত কাজের যে কুফল সেটাই নরক ভোগ। অনেক সময় ঈশ্বর বা অন্তরের শুদ্ধতম চৈতন্য শক্তির কাছে মানুষের যে অনুতাপ ও অনুশোচনা সেটা মানুষকে অপরাধমুক্ত হতে সাহায্য করে, মানবতা ও মনুষ্যত্বে উত্তরণে সাহায্য করে। তাই ধর্ম বলতে শুধু দেব-দেবীর পূজাই নয় আপন অন্তরে শুদ্ধতম চৈতন্যশক্তির আরাধনাই ধর্ম। বিবেকানন্দ তো স্পষ্টভাষায় উচ্চারণ করেছেন “জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন “জীব সেবাই শিব সেবা।” মনের পাশবিক শক্তিকে জয় করে মানুষ যে কোন সময়ই দেবত্বে উত্তীর্ণ হতে পারে। প্রকৃত ধর্ম এই দেবত্ব অর্জনের সহায়ক। বিজ্ঞানের সঙ্গেও যে ধর্মের একটা যোগ থাকা দরকার সেটা মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনও বলেছেন। তবে এ ধর্ম কোন প্রচলিত দেবতার পূজো নয়। এ ধর্ম মানবতা ও মনুষ্যত্বে স্থিত। বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে আশ্রয় করে মানুষ যদি যন্ত্রমানব হয়ে ওঠে তাহলে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়ে যেকোনো সময় এই সুমহান মানবসভ্যতা ও পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে যে স্বেচ্ছাচার, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, অবক্ষয়, আগ্রাসন, অপরিমিত ভোগবাসনা মানব সভ্যতার উপর থাবা বসাচ্ছে সেখানে শুদ্ধতম চৈতন্যশক্তির একটা বড় ভূমিকা আছে। বিবেকানন্দ নাস্তিক বলতে তাঁকেই বুঝিয়েছেন যার নিজের উপর বিশ্বাস নেই। এই যে আত্মবিশ্বাস এর মধ্যে রয়েছে এক অপরিমিত শক্তি। এর সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত থাকতে হবে এক শুভ বোধ ও শুভ চেতনা। এই শুভবোধ ও শুভচেতনার আলোকে ছুঁয়ে থাকাই হল প্রকৃত ধর্ম।