রাজবেশে ভিখারি সম্রাট যাত্রাপালার একটি মুহূর্ত (ছবি - লেখক)
১.
বাংলার প্রাচীনতম লোকশিল্পের তকমা থাকলেও ঠিক কবে থেকে এই লোকনাট্যের ধারার উদ্ভব ও বিকাশ, তা নিয়ে গবেষক মহল যথেষ্ট দ্বিধাবিভক্ত। যাত্রা বিশেষজ্ঞ ড: হংসনারায়ন ভট্টাচার্য্য যাত্রা শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে বলেছেন, “সংস্কৃত শব্দ ‘যা’ ধাতু (গমন করা) থেকে যাত্রা শব্দের উৎপত্তি। সুতরাং যাত্রা শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ প্রস্থান বা গমন।” ১
বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশে রথযাত্রা, দোলযাত্রা, চন্দনযাত্রা, স্নানযাত্রা-র মত দেবোৎসবের প্রচলনও সেই আদিকাল থেকেই এবং এই উৎসবের মূল উপাচারই হল দেব বিগ্রহ নিয়ে নৃত্য, গীত সহযোগে শোভাযাত্রা। ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন “…বাৎসরিক পূজা অথবা সাময়িক উৎসব উপলক্ষ্যে দেবতাকে রথে, শকটে অথবা শিবিকায় চড়াইয়া ভক্তেরা শোভাযাত্রা করিয়া নাটগীত করিতে করিতে এক স্থান হইতে অন্যস্থানে যাইত। এমনিভাবে পুণ্য দিনে নদীস্নানেও লোকে যাইত। দেবতার শোভাযাত্রা হইতে আধুনিক ‘যাত্রা’ কথাটি আসিয়াছে।” ২
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে গমনার্থক ‘যাত্রা’ সময়ের ধারাবাহিকতায় নাটগীত সহযোগে শোভাযাত্রার রুপ নিল। ক্রমে এই নাটগীত হয়ে উঠল যাত্রাভিনয়। যাত্রা সংস্কৃতির শুরুর শুরুটা এভাবেই দেশজ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বিধৃত হল। বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের উক্তিটি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য, “যাত্রা বা উৎসব উপলক্ষ্যে নাটগীতের অনুষ্ঠান হইত বলিয়া ক্রমে নাটগীতকেই যাত্রা বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।” ৩
তাই বহুকাল ধরেই যাত্রা, বাংলার লোকনাট্যের ধারায় সর্বাধিক প্রাচীন ও বহুল জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। তিনদিক খোলা মঞ্চে, চড়া দাগের আলো ও উপযুক্ত সাজপোশাক সম্বলিত অভিনয়ের বিমিশ্র রুপ হল যাত্রা, যা মূলত নাচ, গান এবং সংলাপের সম্মিলিত প্রয়োগে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও সামাজিক ঘটনাবলী চিত্রিত করে।
২.
দ্বাদশ শতকে রচিত জয়দেবের ‘গীত-গোবিন্দম’ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর রচনাশৈলী নিরীক্ষণ করে তাকে নাটগীতি শ্রেণীর রচনা বলে অভিহিত করেছেন গবেষকরা। এটিকে যাত্রাগানের প্রাথমিক পর্যায় বলে মনে করা যেতে পারে। ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন, “মনে হয় জয়দেবের দলে কবিই অধিকারী ছিলেন, সম্ভবতঃ মূল গায়েনও। পরাশর প্রভৃতি আত্মীয় ছিলেন দোহার ও বায়ন। নাচ করিতেন পদ্মাবতী।” ৪ ডঃ সেন তাঁর বৈষ্ণবীয় নিবন্ধে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে ‘গীতিনাট্যকাব্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।
মধ্য পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর বঙ্গসংস্কৃতি সমৃদ্ধ হল এক মহামানবের আবির্ভাবে, তিনি শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩)। সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মের প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নৃত্যগীতাভিনয় তথা কৃষ্ণযাত্রাকে। কবি কর্ণপুরের ‘চৈতন্য চন্দ্রোদয়’ নাটকে মহাপ্রভুর কৃষ্ণলীলা অভিনয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশকে নবদ্বীপে চন্দ্রশেখর আচার্যের বাসভবনে শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং ‘রুক্মিণী স্বয়ম্বর’ আখ্যান অভিনয় করলেন, মহাপ্রভুই সকলের চরিত্রভাগ করে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘আসরী অভিনয়’ বা ‘যাত্রাভিনয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। ৫
নাটগীত সম্বলিত শোভাযাত্রা যা বিগত শতাব্দীগুলোতে আবর্তিত হয়েছে বাংলার পথে ঘাটে, চৈতন্যদেব তাকে তুলে আনলেন বাড়ি কিংবা মন্দিরের আঙ্গিনায়। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সুইজ্যারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় (১৮৫২-১৯১০) কর্তৃক রচিত ‘Yatras or The Popular Dramas of Bengal’ নামাঙ্কিত যাত্রা বিষয়ক প্রথম গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় যে, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই নিয়মিত কৃষ্ণযাত্রার অভিনয় হত এবং ভারতের সর্বস্তরের জনগণের কাছে তা জনপ্রিয় ছিল। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বেই কৃষ্ণযাত্রা প্রচলিত থাকলেও তাকে ধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন মহাপ্রভুই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কৃষ্ণযাত্রার নবরূপকার তিনিই।
চৈতন্যদেবের তিরোভাবের পরেও যাত্রার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে কৃষ্ণযাত্রার ঘরানাই বিদ্যমান ছিল। অষ্টাদশ শতকের দোরগোড়ায় বিভিন্ন রুচির যাত্রাগানের (শক্তিযাত্রা, নাথযাত্রা, পালযাত্রা প্রমুখ) আবির্ভাব ঘটলেও তার মধ্যে রাধা-কৃষ্ণাশ্রিত কাহিনীর আধিপত্য ছিল অধিক। এইসময় কৃষ্ণযাত্রায় ‘কালীয়দমন’ আখ্যান জনপ্রিয়তা পায় ও ক্রমে কৃষ্ণযাত্রা ‘কালীয়দমন’ যাত্রা নামে পরিচিত হয়।
৩.
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বা অন্তিমলগ্নে চৈতন্য প্রভাবিত কৃষ্ণযাত্রার সমৃদ্ধি ম্লান হতে শুরু করে, কারন অষ্টাদশ শতক ছিল অবক্ষয়ের যুগ। শতকব্যাপী মুসলিম শাসনের অধীনতা কাটিয়ে বঙ্গজীবন ফের আবদ্ধ হল ইংরেজ শাসনের নাগপাশে ফলে এক জঘন্য রুচি বিকৃতির শিকার হল বঙ্গ সংস্কৃতি, বাদ গেলনা যাত্রাও। স্থূল ভাঁড়ামো ও কৌতুকরস মিশে যাত্রা ক্রমেই হয়ে উঠল নিম্নরুচির সংস্কৃতি। এই কালপর্বে ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালা তৎকালীন যুগরুচির প্রভাবজাত ফসল। আঠারো শতকের শেষে আর উনিশ শতকের গোড়ায় যাত্রাকে অবক্ষয়ের কিনারা থেকে টেনে আনলেন শিশুরাম অধিকারী। শিশুরাম ছিলেন কালীয়দমন যাত্রার প্রবর্তক। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কথায় “…. শিশুরাম হইতে তাহার পুনর্বিকাশ হয়।” ৬
উনিশ শতকে একে একে যাত্রাগানকে নবরূপে সঞ্জীবিত করলেন পরমানন্দ অধিকারী, গোবিন্দ অধিকারী, কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রমুখ। সকলেই যাত্রাকে ভক্তিরসে পুনরায় সিঞ্চিত করার চেষ্টা করলেন। যাত্রায় হল সংলাপ ও গানের বদল। ১৮৭২ সালে কলকাতায় পেশাদার রঙ্গালয়ের আবির্ভাব ঘটলে দেশীয় লোকনাট্য যাত্রাকে আবার তার অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম শুরু করতে হয়। যাত্রার রূপ (Form) ও রীতি (Content)-তে আসে আমূল বদল। এই সময়ে যাত্রার অঙ্গনে পা রাখলেন মতিলাল রায়। মতিলাল রায়ের হাতে পালাবদল হল যাত্রার। অষ্টাদশ শতকের প্রভাবে যে যাত্রা হয়ে উঠেছিল লোকরঞ্জনের একটি নিম্নমানের অনুষ্ঠান, যে যাত্রাকে সমাচার দর্পণ, সংবাদ প্রভাকরের মত প্রভাবশালী পত্রিকা বর্জনের ডাক দিয়েছিল, সেই যাত্রাকেই অশ্লীলতার দায় থেকে মুক্ত করে লোকশিক্ষার ধারক ও বাহক করে তুললেন মতিলাল রায়। আধুনিক যাত্রার পুরোধা পুরুষ মতিলাল রায়ের যাত্রার বিষয়বস্তু ছিল বাল্মীকির রামায়ণ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মহাভারত।
৪.
বিশ শতকে যাত্রা দাঁড়ালো আরেক বাঁকবদলের মুখে। উনিশ শতকের যাত্রায় আমরা দেখেছিলাম পৌরাণিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে বিভিন্ন পালা। বিংশ শতকীয় যাত্রা সেই ধর্মীয় ভাবধারার খোলস ছেড়ে ক্রমে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত হতে লাগলো। কাহিনিতে দেখা গেল চারপাশের মানুষজনও। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ ছিল বিংশ শতকের স্বদেশী চেতনার জোয়ার। এ বিষয়ে পথ দেখালেন চারণকবি মুকুন্দ দাস। পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক যাত্রার অবসান হয়ে ঐতিহাসিক ও দেশাত্মবোধক যাত্রা রচনার সূত্রপাত হয় এই যুগেই। তিনি তাঁর স্বদেশী যাত্রার মধ্য দিয়ে বঙ্গবাসীকে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করলেন। তাই “যাত্রায় সামাজিক পালারচনার পথপ্রদর্শক বাংলার চারণকবি মুকুন্দ দাস।” ৭
এই প্রসঙ্গে আরো যাঁদের নাম উল্লেখ করতেই হয় তাঁরা হলেন ভোলানাথ কাব্যশাস্ত্রী, ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ বাগ প্রমুখ। বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে যুগচেতনা ও সমসাময়িকতার প্রয়োগ করলেন এই পালাকারেরা। মঞ্চে উঠে এলো হিটলার, লেনিন, থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের নেতাদের চরিত্র, এল শ্রমিক, নিম্নবিত্ত পরিবার মানুষরাও। ফলে যাত্রা হয়ে উঠল বাস্তবতার দর্পন।
৫.
যাত্রার বিবর্তন থেমে থাকতে পারেনা কারণ শিল্প ও সময় পরস্পর সাপেক্ষ। সমকালীনতার প্রভাবে যাত্রা বর্তমান সময়েও বাঁক বদলের সাক্ষী। অনীক ব্যানার্জী রচিত, নির্দেশিত ও অভিনীত “রাজবেশে ভিখারি সম্রাট” নামক একটি আধুনিক যাত্রাপালার পাঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বদলটি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে…… কীভাবে এই পালা পৌরাণিক, ও মহাকাব্যিক উপাদানের প্রতীকী ব্যবহার ও বর্তমান রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার এক জটিল অথচ অর্থবহ সংমিশ্রন ঘটিয়ে যাত্রার ধারাবাহিক বিবর্তনের শরিক হয়েছে, সেটির পর্যালোচনা এই পর্বের লক্ষ্য।
পালাটির গল্পে রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নায়ক দেবব্রত-র লড়াই, মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন সংগ্রাম, প্রেম, আত্মত্যাগ, সম্পর্কের জটিলতা ইত্যাদি বিষয়।এই ভাবনাকেই সাংকেতিক আকারে প্রকাশ করেছেন পালাকার, নির্দেশক অনীক ব্যানার্জী, যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিটি সংকেতের আড়ালে খেলা করছে সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্যোতনাগুলি।
শুরুতেই দেখতে পাই, এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাতে হস্তিনাপুর গ্রামের রাজা, শান্তনুর পুত্র হিসেবে জন্ম নিচ্ছেন এই পালার নায়ক দেবব্রত। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেই মারা যান রানী মা ও গুজব রটে যায় যে, তাঁর সদ্যোজাত সন্তানও মারা গেছে। সত্যবতী-র (শান্তনুর গুরুকন্যা) হীন চক্রান্তে তাঁর পুত্রকেই (কলিঙ্গ) জ্যেষ্ঠ পুত্রের তকমা দিতে বাধ্য হন শান্তনু। এই ঘটনায় রাজবাড়ির দীর্ঘদিনের কর্মচারী মহাদেব ও আমিনার কথোপকথন বিশ্লেষণ করলে পালাটির সামগ্রিক চলন সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায় -
এই কথোপকথন থেকেই পরিষ্কার হয়, পালাটি মূলত অগ্রসর হবে, হস্তিনাপুর গ্রামে ঘনিয়ে আসা আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারকর্তা হিসেবে দেবব্রতর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
ওপরের সংলাপ নিছক কাব্যময়তা নয়, পালার নামকরণের সূত্রে পালার মূল চরিত্রের পরিচিতি প্রদান নিঃসন্দেহে দর্শকের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সংলাপটির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বেশকিছু শব্দবন্ধ (শঙ্খের ধ্বনি, আজানের শব্দ, ভিখারি সম্রাট) এক একটি গুরুত্বপূর্ন সংকেত। যুগপৎ ‘আজানের শব্দ’ ও ‘শঙ্খের ধ্বনি’ শব্দবন্ধগুলি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যাবতীয় সাম্প্রদায়িকতার ইতি টেনে দিতে চেয়েছেন পালাকার। তাছাড়াও হিন্দু পরিবারে জন্ম নিলেও দেবব্রত মানুষ হচ্ছেন আমিনা নামক চরিত্রটির কাছে, যদিও দেবব্রত আমিনা-কে গঙ্গা নামেই জানেন। ‘ভিখারি সম্রাট’ শব্দটির একটি রাজনৈতিক ব্যাঞ্জনা আছে, যা দেবব্রত চরিত্রের পরিচয় দেয়। পালার শুরুতে দেখা যায় কলিঙ্গ চরিত্রটি একটি বিরাট প্লাস্টিকের মোড়ক থেকে আত্মপ্রকাশ করছেন। প্লাস্টিকের মোড়ক একটি অভিনব সংকেতের দৃষ্টান্ত। এটির দ্বারা মাতৃগর্ভের প্রতীক নির্মাণ যেমন সম্ভব হয়েছে, পাশাপাশি প্লাস্টিকের মত দূষণকারী পদার্থ কলিঙ্গের নেতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আভাসও দেয়।
৬.
দেবব্রত-র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় মহাকাব্য মহাভারতের বিখ্যাত চরিত্র দেবব্রত (ভীষ্ম)-র(৮) সঙ্গে তাঁকে মিলিয়ে দিচ্ছেন পালাকার। একই নামকরণের পাশাপাশি বেশ কিছু মহাকাব্যিক উপাদান উল্লিখিত চরিত্রের মধ্যে সংযুক্ত করেছেন তিনি। মহাভারতের কাহিনী আবর্তিত হয়েছিল মূলত যেসব জায়গায় তার মধ্যে অন্যতম হস্তিনাপুর রাজ্য। শুরুতেই উল্লেখিত হয়েছে এই পালাও সংগঠিত হচ্ছে হস্তিনাপুর গ্রামে। নামটি যে রুপকধর্মী তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মহাভারতের ভীষ্ম তাঁর কঠোর প্রতিজ্ঞার কারণে বারংবার আলোচিত হন। পালার দেবব্রতর মুখে বসানো বেশ কিছু সংলাপ ও কবিতার অংশের দ্বারা চরিত্রটির মানসিক দৃঢ়তা, ও সঙ্কল্পে অবিচল থাকার পরিচয় মেলে। দেবব্রত এক জায়গায় বলছেন, “এই হস্তিনাপুর গ্রাম থেকে অধর্মকে আমি চিরজীবনের মত মুছে দেবো, এই হস্তিনাপুর গ্রাম থেকে পাপকে আমি চিরজীবনের মত উপড়ে ফেলে দেবো…...আর, এ এক ভিখারি মায়ের ভিখারি সম্রাটের প্রতিজ্ঞা।” কিংবা ক্ষমা করে দেওয়ার প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করছেন “ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে।”
মহাভারতের ভীষ্ম একাধিক অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কুঠার ও ধনুক। এই পালায় নায়কের হাতে সর্বদা ধরে থাকা কুঠারটি একদিকে যেমন নায়কের উপস্থাপনাকে মহাকাব্যের ভীষ্মের সাথে মিলিয়ে দেয়, পাশাপাশি দর্শককে চরিত্রটির গুরুত্ব ও তার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে নতুন অভিজ্ঞতা দেয়। ‘ড্রামা উইদিন আ ড্রামা”-র প্রয়োগ চরিত্রটির সার্বিক বিকাশ ঘটায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে পালার নায়ক পালার মাঝেই নট্ট কোম্পানির বিখ্যাত যাত্রাপালা ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’-র সংলাপ বলছেন এবং মঞ্চে তা অভিনীত হচ্ছে স্বপ্নালু বাস্তবতায়। এভাবেই মহাকাব্যিক উপাদানের মিশেলে এ যুগের দেবব্রত চরিত্রের বিকাশ ঘটিয়েছেন শ্রী ব্যানার্জী। এ পালার খলনায়কের ভূমিকায় এক মনোবিকারগ্রস্ত চরিত্রের নির্মাণ ও তাকে পৌরাণিক রাক্ষসের সঙ্গে প্রতীকায়িত করেছেন পালাকার। চরিত্রটির নাম কলিঙ্গ। “কলি(কাল/যুগ)-র অঙ্গ আমি কলিঙ্গ” সংলাপটি বারংবার উচ্চারিত হয়েছে উল্লিখিত চরিত্রটির মুখে, জোরালো এই প্রতীকী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে অপকর্ম ও দু:সময়ের প্রতিনিধি (৯) হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে চরিত্রটি।
৭.
পালাটির সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন দেখা যায় কলিঙ্গের ক্ষমতালিপ্সায়। সম্পত্তিলোভ তাকে উন্মাদ করে তোলে, সে ক্রমাগত অত্যাচার চালাতে থাকে গ্রামবাসী ও শান্তনুর ওপর। এমতাবস্থায় গ্রামে প্রবেশ করে এক বহিরাগত ব্যবসায়ী (বটুকনাথ বদ্যি) যিনি হস্তিনাপুরের প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করতে চান। এই দৃশ্যকল্পের নির্মাণের মধ্য দিয়ে পালাকার সচেতনভাবেই ছুঁয়ে গেছেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যারেটিভকে। সত্যবতী চরিত্রের ক্রমপরিণতি ঘটে ‘ভৈরবী মা’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রটিও রুপকধর্মী। মহাভারতের শান্তনুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সত্যবতীর ইমেজ নির্মাণের পাশাপাশি ‘ভৈরবী মা’ চরিত্রের মাধ্যমে ধর্ম ব্যবসায়ীদের চরিত্র উন্মোচিত করেছেন পালাকার।
বহিরাগত ব্যবসায়ীর উদ্যোগে যখন হস্তিনাপুরের অরণ্য নিধন পর্ব শুরু হয়, সেই সময় দেবব্রত প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন প্রকৃতির রক্ষাকর্তা হিসেবে। এই দৃশ্যে দেবব্রত নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এই বলে: “প্রাকৃতিক সম্পদকে যারা নিজেদের স্বার্থে ধ্বংস করে তাদের যম, লাভের আশায় যারা নির্বাকদের প্রাণ নিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করে তাদের যম, যাদের অমানবিকতার কারণে নিরীহ মানুষদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় তাদের যম।” এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয় যে দেবব্রত চরিত্রটি মহাকাব্যের মোড়কে সৃষ্ট হলেও তাঁর সমাজচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবের কাছাকাছি। বটুকনাথ চরিত্রটি মুনাফাসর্বস্ব ব্যবসায়িক প্রতিনিধি যিনি অনায়াসে বলতে পারেন “আমি একজন ব্যবসায়ী আর গাছ কাটাই আমার ধর্ম।” চরিত্রটি কর্পোরেট আগ্রাসনের মূর্ত প্রতীক। এই দৃশ্যেই দেবব্রত বলছেন, “আমি চাই এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা গ্রামে এক একটা অতন্দ্র প্রহরীর মত ভিখারি সম্রাটের জন্ম হোক, যারা চিৎকার করে বলবে, সাবধান, স্বার্থলোভী অমানবিক মানুষের দল, তোমরা সাবধান, যে কুঠারে তোমরা গাছেদের আর্তনাদ লিখেছ সেই কুঠারেই লেখা হবে তোমাদের সর্বনাশ।” অরণ্য (পড়ুন, সামাজিক দায়বদ্ধতা) রক্ষার এ এক ব্যতিক্রমী আহ্বান।
৮.
কলিঙ্গের অত্যচারে ক্লিষ্ট শান্তনুর সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয় দেবব্রতর। দীর্ঘকাল পর বাবা ছেলের দেখা হওয়ার মুহূর্তটি একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকের মোড়কে বেঁধেছেন অনীক ব্যানার্জী। এখানেও তিনি মুন্সিয়ানার সঙ্গে সংকেতের ব্যবহার করেছেন। শান্তনুর হাতে থাকা বাঁশিটি চেয়ে বসেন দেবব্রত, শান্তনুও “এ বাঁশি তো তোমার” বলেই দিতে রাজি হয়ে যান, নেপথ্যে তখন বাজে রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে / বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে।’ বাঁশির হস্তান্তর, দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রতীক হয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়। পালার শেষে গঙ্গা ওরফে আমিনার আসল পরিচয় জানতে পারে দেবব্রত। আমিনা জানায়, সে এতকাল শুধু তার কর্তব্য পালন করেছে……সঠিক সময়ে রাজবাড়ির আসল উত্তরাধিকারীকে ফিরিয়ে দেওয়ার কর্তব্য। সে জানিয়ে দেয় দেবব্রত যেন আর তাকে মা বলে না ডাকে। এই দৃশ্যে ব্যথিত দেবব্রত গান ধরেন : “এ পথে কোনো ঋণ নেই……… শুরুর কথায় লেখা আছে তাই / শুরুর কাছেই একা ফিরলাম / যত ভাঙ্গন তুলে নিক এ মন / বলতেই হবে বিসমিল্লা।” দৃশ্যের সঙ্গে গানটির প্রাসঙ্গিক ব্যবহার বেশ কিছু অজ্ঞেয় উত্তর দর্শককে দিয়ে দেয়। পালাকার বুঝিয়ে দেন, মা ডাকের কোনো ধর্ম হয়না, তাই আমিনা পরধর্মের হলেও তাকে মা বলে ডাকাটা দেবব্রতের অধিকার।
শেষ দৃশ্যে কলিঙ্গ ও দেবব্রতর মধ্যে লড়াই আদতে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্ম প্রতিষ্ঠার লড়াই। কলিঙ্গকে হত্যা করার আঙ্গিক পৌরাণিক নৃসিংহ অবতারের চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলে, যেখানে সাউন্ডট্র্যাকে বেজে ওঠে নৃসিংহ প্রণাম মন্ত্র। ক্লাইম্যাক্সে দেখা যায় কলিঙ্গকে হত্যা করার পর দেবব্রত নিজেও ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। মহাকাব্যের ভীষ্ম ধর্মস্থাপনের যুদ্ধে শরশয্যায় প্রাণত্যাগ করেন, মঞ্চের দেবব্রতও প্রাণ ত্যাগ করেন ঠিক একই কারণে, তবে দুজনের অবস্থান ছিল আলাদা। এই স্বতন্ত্রতাই পালার দেবব্রতকে বিশিষ্ট করে তোলে। পালা শেষ হয় পরাবাস্তবতার ছোঁয়া রেখে যেখানে দেখা যায় মৃত্যুর পরেও দেবব্রত গাইছেন “……এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা আমায় ছাড়া।”
৯.
যাত্রাপালার নিজস্ব একটি চলন আছে সেই চলনকে আশ্রয় করেই তাকেও আঙ্গিকগত ভাবে আধুনিক করে তোলা যায় তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই পালাটি। লোকায়ত মাধ্যম হিসেবে যাত্রা শিল্পের বিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নজর রাখলেই দেখা যায় যাত্রার বাঁকবদলে যুগের প্রভাব চিরকালই অনুঘটকের কাজ করে এসেছে। ‘রাজবেশে ভিখারি সম্রাট’ পালাটি সেই ধারাবাহিকতার এক প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ নিদর্শন। পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক উপাদানের দ্বারা বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক ঘটনার প্রতিচ্ছবি নির্মানের মধ্য দিয়ে পালাকার ঘোষণা করেছেন ভারতের চিন্তাধারার সর্বোত্তম সারসংক্ষেপ, “যথা ধর্ম তথা জয়” (১০)।
সূত্র নির্দেশিকা :
গ্রন্থ
১) ডঃ হংস নারায়ন ভট্টাচার্য – যাত্রাগানের গোড়ার কথা, নাট্যলোক ১ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা – ৫
২) ডঃ সুকুমার সেন – বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার, পৃষ্ঠা – ১৫
৩) ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য – বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস, পৃষ্ঠা – ৬৯
৪) ডঃ সুকুমার সেন – বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পূর্বার্ধ, পৃষ্ঠা – ৪৩
৫) ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় – বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৪০৮
৬) রাজেন্দ্রলাল মিত্র – বিবিধার্থ সংগ্রহ, মাঘ ১২৬৫ বঙ্গাব্দ ইং ১৮৫৯
৭) ডঃ গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য – বাংলা লোকনাট্য সমীক্ষা, পৃষ্ঠা ৭৩
ওয়েবপেজ/ জার্নাল
৮) https://en.wikipedia.org/wiki/Bhishma (সংগ্রহের তারিখ ২৭/০৫/২০২৫)
৯) https://www.wisdomlib.org/definition/kaliyuga (সংগ্রহের তারিখ ২৭/০৫/২০২৫)
১০) অ্যাথালে, অনিল (২০১০-১০-০৬)। প্রতিরক্ষা গবেষণা: ভারতের অ্যাকিলিস হিল । ভারতীয় প্রতিরক্ষা পর্যালোচনা । ২৫ (৩)। ল্যান্সার পাবলিশার্স: ৩২।
http://www.indiandefencereview.com/news/defence-research-indias-achilles-heel/0/ (সংগ্রহের তারিখ ২৭/০৫/২০২৫)
গ্রন্থপঞ্জী
১) মণ্ডল, রতন, কুমার। (১৯৯৯)। বাংলার যাত্রা ও ব্রজেন্দ্র কুমার দে। প্রথম সংস্করন। অনুভবপত্র প্রকাশনী