রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব নাগরিক, মহামানবিক। মানুষের ধর্মই তাঁর শ্রেষ্ঠ ধর্ম, পরম সাধনা। বিচিত্র ধারার সৃষ্টির মধ্যেই তাঁর বিকাশ, তাঁর পথ চলা। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ভীষণ সজীব এবং জীবনবাদী। তিনি বিভিন্ন দেশে নানারকম বৈচিত্র্যময় পটভূমিতে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল প্রতিবেশের যে সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেইসব ঘটনাপ্রবাহ তাঁর আবেগধর্মী মননে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তার প্রকাশ ঘটেছে সাহিত্য সাধনার বিস্তীর্ণ পরিসরে।
পৃথিবীর যেকোনো দেশে প্রবলের উৎপীড়ন, আর্তের ক্রন্দন রবীন্দ্রনাথকে বিচলিত করত। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে সর্বক্ষেত্রেই কলম ধরেছেন—কন্ঠ সোচ্চার করেছেন। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম ভারতীয় সাহিত্যিক যিনি ফ্যাসিবাদের ভয়ানক আগ্রাসী ও বর্বর রূপ উপলব্ধি করে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর সোচ্চার কন্ঠ ও তীক্ষ্ণ লেখনিকে হাতিয়ার করে।
ফ্যাসিবাদ কী, এই প্রশ্ন আমাদের মনে আসতেই পারে। ফ্যাসিবাদ হল একনায়কতন্ত্রের অধীনে প্রবল উগ্র জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক ভাবধারা যেখানে গণতন্ত্রের স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়”। কারণ পুঁজিবাদ টিকে থাকে মুনাফাকে উপজীব্য করে। তার জন্য তাকে পররাজ্য গ্রাস ও লুন্ঠনের পথে তথা সাম্রাজ্যবাদের পথে যেতে হয়। আর রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন আন্তর্জাতিকতার সবচেয়ে বড়ো বিপদ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। তাই তিনি সারা জীবন দৃঢ়তার সাথে তাঁর অজস্র গান, কবিতা, রচনা, সাহিত্যকীর্তি ও বক্তৃতায় ওই দুই বিপদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন। ফ্যাসিবাদের পররাজ্য গ্রাসের ও লুন্ঠনের বর্বর অভিযানের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র বিষোদগার তাঁকে যথার্থভাবেই পৃথিবীর কবি রূপে উত্তীর্ণ করেছে।
সম্পূর্ণতার সাধনাই ছিল রবীন্দ্র সাধনার মূল কথা। রবীন্দ্রনাথ এমন এক পৃথিবীর জন্য তাঁর সাধনার সুকৃতিকে রেখে গেছেন, যে পৃথিবীর মানুষ হবে সব অর্থেই পূর্ণ প্রকাশিত। চিন্তায়, চেতনায়,জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, মানবতার উল্লাসে অফুরান এক মহা মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই স্বপ্নের পৃথিবী আজও অনেক দূরে। মানুষের ধর্ম গ্রন্থে তিনি বললেন, 'ধর্ম একটাই-তা হচ্ছে মানুষের ধর্ম।' বিলেত যাওয়ার আগে তিনি লিখলেন.......
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো।
মানবতার পতন, মহাযুদ্ধের মারণযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে গভীর যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে। কিন্তু তিনি আশাহত হননি। তিনি আজীবন বিশ্বাস করে এসেছেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।
১৮৭৮ সালে সদ্য তরুণ রবীন্দ্রনাথ বিলেত রওনা হন ব্যারিস্টার হবার উদ্দেশ্যে। ইংল্যান্ডের ঐশ্বর্য, প্রবল প্রতাপ ও উজ্জ্বল পরিবেশ তাঁকে যতটা প্রভাবিত করে তার থেকে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাদের পরদেশ শাসনের কলঙ্ক। ইঙ্গ-ভারত সম্পর্ক সমমর্যাদাসম্পন্ন না হয়ে একের উপরে অন্যের আধিপত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুণ দু তরফেই যে মনুষ্যত্বের বিড়ম্বনা ঘটেছিল তার কোনোটিই তরুণ কবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৮৭৮ সালে এই ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় তরুণ রবি ইতালি ঘুরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ ইতালি সফর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে আনে না।
১৮৮১ সালে ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ প্রবন্ধে চীনদেশে ইংরেজের আফিম ব্যবসার প্রতিবাদে তরুণ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লোভে বলপূর্বক বিষপান করানো হইল। এমনতর নিদারুণ ঠগীবৃত্তি কখনো শুনা যায় নাই।—অর্থ সঞ্চয়ের এইরূপ উপায়কে ডাকাইতি না বলিয়া যদি বাণিজ্য বলা যায়, তবে সে নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে। ইহা আর কিছু নয়, একটি সবল জাতি দুর্বলতর জাতির নিকটে মরণ বিক্রয় করিয়া কিছু লাভ করিতেছেন।’
দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রা বিষয়ে রচিত ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়েরী’তে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, 'অপ্রতিহত ক্ষমতার দম্ভ জাতীয় চরিত্রের মূলে আক্রমণ করে। যে স্বাধীনতাপ্রিয়তার ভিত্তির উপর তোমার জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠিত, তলে তলে সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তা বিশুদ্ধতা নষ্ট করে।’
‘কর্মের উমেদার’ প্রবন্ধে ওই একই বছরে একই প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘লোহার কলের সঙ্গে সঙ্গে রক্ত মাংসের মানুষকে সমান খাটিতে হইতেছে। কেবল বণিক সম্প্রদায় লাভ করিতেছেন এবং ধনী সম্প্রদায় আরামে আছেন ‘।
১৮৯৩ সালে প্রকাশিত ‘রাজনীতির দ্বিধা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘য়ুরোপীয় জাতি য়ুরোপে যত সভ্য, যত সদয়, যত ন্যায়পর, বাহিরে ততটা নয়—।’ এইভাবে ক্ষমতায় মদমত্ত ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন এইভাবে।
১৯১৬ সালে জাপান গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাপানের সংস্কৃতিজগৎ দেখে অভিভূত হলেও জাপানীদের উগ্র জাতীয়তাবাদ কবিকে আশঙ্কিত করেছিল। জাপান যাওয়ার আগের বছর ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র নিখিলেশের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন, "ও দেশকে সাদাভাবে সতর্কভাবে দেশ বলেই জেনে, মানুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করে, তারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না, চীৎকার ক'রে মা বলে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে তাদের কেবল সম্মোহনের দরকার হয়, তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয়, যেমন নেশার প্রতি।" স্পষ্টতই উগ্র জাতীয়তাবাদের হিংস্র ধারণার প্রতি আজীবন ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ।
যেখানেই মানুষের সভ্যতা আক্রান্ত হয়েছে, মানবতার মূল্যমান বিপর্যস্ত হয়েছে, সেইখানেই বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদী কন্ঠ ধ্বনিত হয়েছে। রঁমা রঁল্যা, অঁরি বারবুস, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদ বিরোধী মহামঞ্চে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল ১১ই নভেম্বর, ১৯১৮ সাল। একমাস পরে ২৩শে ডিসেম্বর, ১৯১৮ শান্তিবাদ ও বিশ্বমৈত্রীর প্রতীক বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হল। ১৯২৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর কবি বিশ্বভারতীকে সাধারণের হাতে উৎসর্গ করার জন্য সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় তিনি বললেন, ”কোনো জাতি যদি স্বাজাত্যের ঔদ্ধত্যবশত ধর্ম ও সম্প্রদায়কে একান্ত আপন বলে মনে করে তবে সেই সত্য বিনষ্ট হয়ে যাবে।” সবরকম বিভেদের উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতী ও বিশ্বমানবতাবাদ সমার্থক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিজেতা-বিজিত দেশের নরনারীর হাহাকার, বিপুল সম্পদহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা কবির মনকে নাড়া দিয়েছিল নানাভাবে, চঞ্চল করেছিল তীব্রভাবে। যার ফসল তাঁর বেশ কিছু কবিতার সৃষ্টি। জার্মানির বিরুদ্ধে বেলজিয়ামের প্রতিরোধ সংগ্রামে বেলজিয়ানদের বীরত্ব তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ওই ঘটনা স্মরণে রেখে তিনি লেখেন .........
বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।
পথ জুড়ে কী করবি বড়াই,সরতে হবে।।
লুঠ করা ধন ক’রে জড়ো কে হতে চাস সবার বড়ো-
এক নিমেষে পথের ধুলায় পড়তে হবে।
নাড়া দিতে গিয়ে তোমায় নড়তে হবে।।
১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাস। ইতালি তখন এক ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের কেন্দ্রস্থল। অবশ্য এই পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটা বছর পিছিয়ে যেতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর লীগ অব নেশনস গঠিত হয় তৎকালীন বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্রনায়কদের নেতৃত্বে। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বশান্তি রক্ষা করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা গেল ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে বনেদি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির হাত থেকে অনেক উপনিবেশ কেড়ে নিয়ে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল। ফলে দুনিয়া জুড়েই ইউরোপে রাজনৈতিক শক্তির একটি ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হল এবং প্যারিস শান্তি সম্মেলনে সম্পাদিত চুক্তিগুলির দ্বারা আদৌ স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল না। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি ইতালি ও জার্মানিতে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছিল।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদের প্রবর্তক বেনিতো মুসোলিনি। ১৯১৯ সালে মুসোলিনি ফ্যাসিস্ট পার্টির ভিত্তি স্থাপন করলেও ফ্যাসিবাদের জনক কিন্তু তিনি নন। এর আবিষ্কর্তা হলেন ভিলফ্রেদো পারেতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে প্রবল অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয় এবং সর্বস্তরে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দিল। একের পর এক মন্ত্রীসভার পতন ঘটায় ক্রমেই গণতন্ত্রে মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছিল। প্রথমে অরল্যান্ডো, তারপর নিত্তি, গিওলিট্টি, বোনোমি.....কেউই টিকে থাকতে পারলেন না। সোসালিষ্ট, কম্যুনিস্টদের নেতিবাচক রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মুসোলিনির নেতৃত্বেই দেশের সমস্যা সমাধান হতে পারে এই আস্থা রেখে ইতালির হাজার হাজার মানুষ তাঁর দলে যোগ দিল। ১৯২২ সালের ৩১শে অক্টোবর ইতালির রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল বেনিতো মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করলেন। আর এরপর থেকেই বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অমানবিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শরূপে ফ্যাসিবাদের আত্মপ্রকাশ সমস্ত মানব সভ্যতার বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করল। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হল, যে ইউরোপ ছিল সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতা, উদারনৈতিকতা ও সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের ধারক ও বাহক সেই ইউরোপই হয়ে উঠল এই নিকৃষ্ট মতাদর্শের সূতিকাগার। আর ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই দ্বিতীয়বারের জন্য ইতালিতে পদার্পণ করলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি স্পেনের বার্সেলোনা ঘুরে ইতালির জেনোয়া বন্দরে অবতরণ করলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদী আদর্শে বেঁধে ফেলা আদৌ সহজ নয়। এদিকে সংবাদপত্র, মুদ্রণযন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজনৈতিক সংগঠন, সরকার বিরোধী সমালোচনা সব কঠোর হাতে অবদমিত হয়েছে। স্যোসালিস্ট ও কম্যুনিস্টদের উপর শ্বেতসন্ত্রাস চলছে পূর্ণমাত্রায়। এরকম পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে আবার ইতালি যেতে দেখে এদেশের এবং পাশ্চাত্যের চিন্তাশীল ও রবীন্দ্র অনুরাগী ব্যক্তি মাত্রই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না কি করে মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাবাদের মিলন সম্ভব। যাইহোক, ১৯২৬ সালের ৩০শে মে রবীন্দ্রনাথ ইতালির নেপলস বন্দরে পৌঁছালেন। তাঁর এবারের সঙ্গী পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধূ প্রতিমা ঠাকুর, ঘনিষ্ঠ সঙ্গী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, নির্মলা মহলানবিশ, শ্রীনিকেতনের সচিব প্রেমচাঁদ লাল, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষ, ত্রিপুরার রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মণ। প্রথমে ফ্যাসিবাদের স্বরূপ বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে তাঁর মনে হচ্ছিল এর মধ্যে কোথায় যেন একটা কী ধরণের যেন গ্লানি লুকিয়ে আছে। ফ্যাসিবাদের উগ্র সাম্রাজ্যবাদী রূপ, তার জাতিবিদ্বেষ এবং যুদ্ধবাজ চরিত্র রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন। ফলে ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান নিতে শুরু করলেন তিনি। ভিয়েনা থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর ক্ষোভের কথা জানালেন। এটা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা এবং বিপদ সম্পর্কে অবহিত করে, তাঁকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্রে রম্যাঁ রলাঁর ভূমিকা প্রশ্নাতীত। একথা বলাই যায় রলাঁর মতো এত বড়ো সুহৃদ ইউরোপের মাটিতে রবীন্দ্রনাথের আর কেউ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের এই ইউরোপ সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা তথা শিক্ষা ছিল ফ্যাসিজম ও যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা। এই ঘটনার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ দুনিয়াব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসোলিনির এই মতান্তরের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হল বিশ্বভারতী। ফ্যাসিবাদের সপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করবার যে পরিকল্পনা করেছিলেন মুসোলিনি-ফর্মিকি, তার উপরেও জল ঢেলে দিল রবীন্দ্রনাথের অস্বীকৃতি। ১৯২৬ সালের পর থেকেই ক্রমান্বয়ে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে উদাত্ত কন্ঠস্বর শোনা যেতে থাকল রবীন্দ্রনাথের।
রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবিরোধী ভূমিকা সব অর্থেই ছিল বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। পন্ডিত নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখেরা যেখানে চারের দশকের আগে পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারনাই গড়ে তুলতে পারেননি, সেখানে সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট বুঝেছিলেন সভ্যতার শত্রু ফ্যাসিবাদ। তাই তিনি তাঁর গল্পে, নাটকে,গানে, ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সংগ্রাম চালনা করেছেন।
১৯৩৫ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালি আফ্রিকার সুপ্রাচীন দেশ আবিসিনিয়া (অধুনা ইথিওপিয়া) আক্রমণ করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মর্মবেদনার কথা প্রথম জানান তাঁর বন্ধু এন্ড্রুজকে লেখা চিঠিতে। পরে তিনি রচনা করেন ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি। ছায়াবৃতা আফ্রিকার প্রতি কবির সহানুভূতি ও হাহাকার শত সহস্র কন্ঠে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হল ধূলি তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে,
ফ্যাসিস্ট ইতালি ও জার্মানির মদতপুষ্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কো ১৯৩৬ সালে স্পেনের গণতন্ত্র ধ্বংস করে স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলে সমগ্র স্পেনে তার প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে সংগ্রাম শুরু হয়। আমরা জানি স্পেনের যুদ্ধে পপুলার ফ্রন্টের হয়ে রণাঙ্গনে সামিল হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি কর্মীরা। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বয়সের ভারকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে লেখা সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থে ‘চলতি ছবি’ কবিতায় স্পেনের গৃহযুদ্ধের ছবি ফুটে উঠেছে .........
যুদ্ধ লাগল স্পেনে;
চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতঘ্নীবাণ হেনে।
এই সময়েই ‘লীগ এগেনষ্ট ফ্যাসিজম এন্ড ওয়ার’ নামে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এই সংঘের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। এই সংঘের অন্য সদস্যরা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, জয়প্রকাশ নারায়ণ, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, এস এ ডাঙ্গে, এন জি রঙ্গ প্রমুখ।
তিনের দশকে জাপানের চীন আক্রমণ ও আগ্রাসনের ঘটনা রবীন্দ্রনাথ মেনে নিতে পারেন নি। এই প্রসঙ্গে তাঁর অনুরাগী জাপানি কবি নোগুচির সঙ্গে খোলা চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘ বিতর্ক চলে। জাপান তাঁর ভালোবাসার দেশ হলেও তার রাজ্যলিপ্সাকে তিনি ক্ষমা করতে পারেন নি। তাদের জন্য তাই শুভেচ্ছার বদলে তিনি অভিসম্পাতই বর্ষণ করেছিলেন। জাপানের একদল সৈনিক চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে ভগবান বুদ্ধের মূর্তির সামনে যুদ্ধের জয় কামনা করছে এই মর্মে সংবাদপত্রে একটি সংবাদ দেখে কবি খুবই ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। শান্তির দূত বুদ্ধের সামনে অন্যায় যুদ্ধের সাফল্য কামনার ভণ্ডামিকে তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে আক্রমণ করে ওই সময়েই কবি লেখেন ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাটি।
বন্ধু অমিয় চক্রবর্তীর উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘দেখলুম দ্বারে বসে ব্যথিত চিত্তে, মহাসাম্রাজ্যশক্তির রাষ্ট্রমন্ত্রীরা নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে দেখতে লাগল জাপানের করাল দ্রংষ্ট্রাপংক্তির দ্বারা চীনকে খাবলে খাওয়া।—দেখলুম ওই স্পর্ধিত সাম্রাজ্যশক্তি নির্বিকার চিত্তে আবিসিনিয়াকে ইটালীর হাঁ- করা মুখের গহ্বরে তলিয়ে যেতে দেখল, মৈত্রীর নামে সাহায্য করল জার্মানির বুটের তলায় গুঁড়িয়ে ফেলতে চেকোশ্লোভাকিয়াকে, দেখলুম নন-ইন্টারভেনশনের কুটিল প্রণালীতে স্পেনের রিপাবলিককে দেউলে করে দিতে, দেখলুম ম্যুনিক প্যাক্টে নতশিরে হিটলারের কাছে একটা অর্থহীন সই সংগ্রহ করে অপরিমিত আনন্দ প্রকাশ করতে।—এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স জয়ী হোক একান্তমনে এই কামনা করি। কেননা মানব ইতিহাসে ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলংকপ্রলেপ আর সহ্য হয়না।’
দুঃখের হলেও সত্যি, আবিসিনিয়া, স্পেন ও চীন রণাঙ্গন-প্রায় সর্বত্রই ফ্যাসিস্টদের আক্রমণের মুখে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবিরোধী মুক্তিফৌজের পরাজয়ের খবর আসছিল। এই সময় কবি তাঁর অবিস্মরণীয় দুটি কবিতা রচনা করেন.........
নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস–
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।
অপর কবিতাটির (‘যেদিন চৈতন্য মোর’) অবিস্মরণীয় কয়েকটি লাইন আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে :
মহাকালসিংহাসনে
সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,
কন্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী
কুৎসিত বীভৎসা-‘পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন
নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের
হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধকন্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে
নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে'।
১৯৩৮ সালের মে মাসে কবির জন্মদিনে ফ্যাসিস্টদের বিশ্বগ্রাসী বীভৎস পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে ‘জন্মদিন’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাটি কবি রচনা করেন :
ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা,
মাংসগন্ধে মুগ্ধ যারা, একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা
শ্মশানের প্রান্তচর, আবর্জনাকুণ্ড তব ঘেরি
বীভৎস চিৎকারে তারা রাত্রিদিন করে ফেরাফেরি,
নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।
শুনি তাই আজি
মানুষ-জন্তুর হুহুঙ্কার দিকে দিকে উঠে বাজি।
১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ‘মিউনিখ চুক্তি’। আসলে এই চুক্তি ছিল হিটলারের সব দাবি মেনে নিয়ে তাকে তুষ্ট করার এক নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার চুক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়াকে একঘরে করে কেন্দ্রীভূত ফ্যাসিস্ট আক্রমণে যাতে সে ধ্বংস হয়ে যায় তার ব্লুপ্রিন্ট। এই চুক্তির পরিণামে চেকোশ্লাভিয়া পুরোপুরি ফ্যাসিস্টদের কবলে চলে যায় এবং ফ্যাসিস্ট আক্রমণ পূর্বমুখী অর্থাৎ সোভিয়েতমুখী গতি লাভ করে। ষড়যন্ত্রের শিকার সোভিয়েত রাশিয়াকে কৌশলগত কারণে ফ্যাসিস্ট আক্রমণ সাময়িক ঠেকিয়ে রাখতে ও চূড়ান্ত আক্রমণের আগে নিজেদের গুছিয়ে নিতে জার্মানির সঙ্গে ১৯৩৯ সালে অনাক্রমণ চুক্তি ও সন্ধি সম্পাদন করতে হয়। যদিও দুই বছর পরে ১৯৪১ সালের ২২শে জুন ফ্যাসিস্ট জার্মানি সোভিয়েতকে আক্রমণ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিবর্তিত হয়ে যায়। অর্থাৎ মিউনিখ অর্ঘ্য দিয়েও নাৎসি হিটলারের জঠরানলকে প্রশমিত করা যায়নি। কারণ সোভিয়েত আক্রমণের আগে ক্রমান্বয়ে পোল্যান্ড, ফ্রান্স, আলবেনিয়া ফ্যাসিস্ট কবলে চলে যায়। মিউনিখ বিশ্বাসঘাতকতায় কবি এতটাই বিচলিত ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তা অন্য কোনো ঘটনায় আগে হননি।
বিশ্বপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক ফিনল্যান্ড আক্রমণের ঘটনাটিকেও ভালো চোখে দেখেন নি। এই ঘটনায় তাঁর মনোবেদনা প্রকাশ পায় ‘অপঘাত’ কবিতায়.........
টেলিগ্রাম এল সেই ক্ষণে
ফিন্ল্যান্ড্ চূর্ণ হল সোভিয়েট বোমার বর্ষণে।
এইক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, কবি সোভিয়েত রাশিয়াকে সম্পূর্ণ অন্য চোখে দেখতেন। ১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণ ছিল তাঁর কাছে ‘এ জন্মের তীর্থ দর্শন’। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘অন্য কোনো দেশের মতোই নয়, একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে।’ আন্তর্জাতিকতা বোধকে রবীন্দ্রনাথ চিরকালই উগ্র স্বাজাত্যবোধের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার স্বরূপ সন্ধান বোধহয় পেয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের মধ্যেই। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন ফরাসি বিদ্রোহ ঘটেছিল এই অসাম্যের তাড়নায়। সেদিন সেখানকার পীড়িতেরা বুঝেছিল এই অসাম্যের অপমান ও দুঃখ বিশ্বব্যাপী। তাই সেদিনকার বিপ্লবে সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের বাণী স্বদেশের গণ্ডি পেরিয়ে উঠে ধ্বনিত হয়েছিল। কিন্তু টিঁকল না। এদের এখানকার বিপ্লবের বাণীও বিশ্বব্যাপী। আজ পৃথিবীতে অন্তত এই একটা দেশের লোক স্বাজাতিক স্বার্থের উপরেও সমস্ত মানুষের কথা চিন্তা করছে।’ এহেন সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকা তিনি সমর্থন করেন নি।
সোভিয়েত ফিনল্যান্ড আক্রমণ করল কেন? ফিনল্যান্ড ছিল নাৎসি জার্মানির পক্ষে। নাৎসি জার্মানির সঙ্গে যৌথভাবে তারা ম্যানারহাইম দুর্গশ্রেণি গড়ে তুলেছিল এবং সোভিয়েতের লেনিনগ্রাদ থেকে মাত্র ২১ মাইল দূরে দুর্গের অংশে অনেক ভারী কামান সাজানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। এছাড়াও ফিনল্যান্ড ব্রিটেন কর্তৃক প্রচুর অস্ত্রসম্ভারেও সজ্জিত ছিল। তাই বিশ্ববাসী, সোভিয়েতের মানুষ ও বিশ্বব্যাপী প্রকৃত শান্তি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নাৎসি বাহিনীকে সোভিয়েত সীমান্ত থেকে অনেকটা দূরেই প্রতিহত করার স্বার্থেই সোভিয়েত রাশিয়াকে ফিনল্যান্ড আক্রমণ করতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী নিজেকে বারবার উত্তরণের পথে পাল্টেছিলেন বলেই তাঁর শুভাকাঙ্খীদের কাছে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হয়ে পরবর্তী সময়ে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সোভিয়েত জয়যুক্ত হবেই এই প্রত্যয়ে বলীয়ান থেকেছেন এবং অন্য সকলকেও সেই আশাবাদে উজ্জীবিত করেছেন। একইভাবে প্রথমদিকে ইতালির শাসক মুসোলিনী সম্পর্কেও তিনি মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই সেই মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে প্রকৃত সত্য অনুধাবনে তাঁর মতো সত্যদ্রষ্টা কবির অসুবিধা হয়নি। ১৯২৭ সালে বিখ্যাত ফরাসি মনীষী ও সাম্যবাদী নেতা অঁরি বাঁরবুস ও ফরাসি দার্শনিক রোঁমা রোঁলার মধ্যে মত বিনিময়ের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুনীদের কাছে ‘স্বাধীন আত্মাদের প্রতি’ শীর্ষক আবেদনপত্র পাঠান, তাঁদের অনুমোদনের জন্য। যার মূল সুর ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার। ওই আবেদনের সমর্থন জানিয়ে লেখা জবাবে দ্বিধাহীনভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা প্রকাশ হওয়া ছাড়াও প্রকট হয়ে উঠেছিল ফ্যাসিবাদের অন্তর্নিহিত জরাগ্রস্ত অবস্থা সম্পর্কে কবির দৃঢ় প্রত্যয়। হিটলার-মুসোলিনীর মতো দানবদের ছবি আঁকেন কবি এই ভাষায় :
রক্তমাখা অস্ত্রহাতে যত রক্তআঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।
ফ্যাসিস্ট আক্রমণে ফ্রান্সের পতনের সংবাদে রবীন্দ্রনাথ এতটাই উত্তেজিত ও বিচলিত হয়ে পড়েন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জরুরী তারবার্তা পাঠিয়ে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে আহ্বান জানান। এ যেন সারা বিশ্ববাসীর প্রতিনিধি হিসেবে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলা ও যুদ্ধে আমেরিকাকে অবতীর্ণ হবার অনুরোধ। যদিও ইতিহাস অন্য পথে চলেছিল। ফ্যাসিস্টদের প্রতিরোধে দুই কোটি মানুষের জীবন আহূতির মাধ্যমে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া। ফ্যাসিস্ট জার্মানির সঙ্গে সোভিয়েতের মরণপণ সংগ্রামের খবর রোগশয্যায় শায়িত কবি খুবই আগ্রহের সঙ্গে রাখতেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ গ্রন্থে রানী মহলানবিশের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সংবাদপত্রে যেদিন জার্মানদের অগ্রগতিতে একটু ভাঁটার খবর থাকত সেদিন কবি মুখের কাছে কাগজখানা ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। আর যেদিন জার্মান সৈন্যর সাফল্যের খবর থাকত সেদিন হেডলাইন পড়া শেষ হলেই কাগজখানা ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিতেন। যেদিন কবির দেহে অপারেশন হয়, সেই কালান্তক অপারেশনের দিনে, ৩০শে জুলাই ১৯৪১ সাল, সোভিয়েত বাহিনী হিটলারের বাহিনীকে প্রতিহত করতে শুরু করেছে। অপারেশন থিয়েটারে যাবার ঠিক আগে রোগগ্রস্ত কবি খুব খুশি হয়ে বললেন, 'পারবে পারবে, ওরাই পারবে। ভারি অহংকার হয়েছে হিটলারের! গোয়েরিং গোয়েরিং, এখন দেখুক গোয়েরিং কী হয়। দুশমনরা।'
আর একটি বিবরণে মৈত্রেয়ী দেবী বলছেন, “মনে পড়ে প্রত্যেকদিন রেডিওতে যুদ্ধের খবর শুনে, খবরের কাগজ হাতে নিয়ে মানুষের এই হিংস্রতায় এই কলঙ্কে কি বেদনা পেতেন। আমাদের কাছে দূর দেশের যুদ্ধ অনেকটা পরিমাণেই যুদ্ধের গল্প ছিল। কিন্তু সকল দেশ সকল মানুষ যাঁর আপন, তাঁর কাছে আর্ত মানুষের দুঃখ প্রতিদিন অত্যন্ত প্রত্যক্ষ হয়ে পৌঁছত। এত কষ্ট পেতেন যে ইচ্ছে করত না তাঁকে খবর শোনাই। কিন্তু উপায় ছিল না।” তাই গভীর বেদনা নিয়েই কবি লিখেছিলেন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’, আহ্বান করেছিলেন অনন্ত পুণ্যের আবির্ভাব। আবার বেদনাপূর্ণ হৃদয়েই বিদ্রুপ করে লিখেছিলেন,
ঐ শোনা যায় রেডিওতে বোঁচা গোঁফের হুমকি;
দেশবিদেশে শহর গ্রামে গলাকাটার ধুম কী।
…
গ্যাঁগোঁ করে রেডিওটা কে জানে কার জিত–
মেশিন্গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্য বিধির ভিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ও দেশের পরাধীনতার গ্লানি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মানবতাবাদের এই কবি তাঁর শেষ রচনা ‘সভ্যতার সংকট’-এ উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।
কবির ভবিষ্যদ্বাণী বিফলে যায়নি। ফ্যাসিবাদী শক্তির পরাজয় ঘটেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছে। তাঁর কথাতেই বলতে হয়........
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মধ্যে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।
বিশ্বমানবতার সংকটে রবীন্দ্রনাথ সব কালের অভ্রান্ত কন্ঠস্বর হয়ে থেকে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে যাবেন অনন্ত প্রেরণার ধ্বনি হয়ে। মানবতার পতন, মহাযুদ্ধের মারণযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকে গভীর যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে বারে বারে। কিন্তু তিনি আশাহত হননি। তিনি আজীবন বিশ্বাস করে এসেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। চিরবিদায় নেবার আগে তাঁর ঐতিহাসিক রচনা 'সভ্যতার সংকট' -এ তিনি ব্যক্ত করে গেলেন এই বিশ্বাসের কথা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস রেখেছিলেন, যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে আগামী দিনের যে মানুষের জন্ম নেবে, তারা সবাই নতুন দিগন্তের পথ দেখাবে। মানুষের মধ্যেই তিনি মহামানবের অশেষ সম্ভাবনা বারবার আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বিশ্বমানবতার সংকটে এই মানুষকেই তিনি আশা, আলো, অন্তহীন বিশ্বাস হিসেবে দেখেছেন। নতুন যুগের মানুষকে বন্দনা করে তিনি তাই বলে গেলেন,
ওই মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক -
এল মহাজন্মের লগ্ন।