“Everything we call real is made of things that cannot be regarded as real.”
“If Quantum mechanics hasn’t profoundly shocked you, you haven’t understood it yet.”
---Niels Bohr
আমরা আমাদের চারপাশে যে ম্যাক্রো (বড় আয়তনের বস্তু) বিশ্বকে জানি তা কিছু সাধারণ নিয়ম এবং নীতির উপর কাজ করে, যেগুলি আমাদের অন্তর্দৃষ্টিতে গভীরভাবে খোদাই করা রয়েছে। যখন আমরা কোনো বস্তুকে ধাক্কা দিই বা টানতে থাকি, তখন সেটি স্থানান্তরিত হয়। উপরের দিকে একটি পাথর নিক্ষেপ করলে সেটি পৃথিবীতে ফিরে আসে। একটি প্রাচীরের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু সেটার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায় না। এইগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ঘটনা। কিন্তু যখন আমরা পারমাণবিক এবং উপ-পরমাণু জগতের (মাইক্রো) দিকে নজর দিই ছবিটা কিন্তু তখন সম্পূর্ণ বদলে যায়। আমরা যত বেশি পর্যবেক্ষণ করেছি, ততই স্পষ্ট হয়েছে যে এই মাইক্রোকণাগুলো এমন কিছু আইন বা নিয়ম অনুসরণ করে যা আমাদের ধ্রুপদী জগতের স্বীকৃত আইনের সাথে তুলনা করলে সত্যিই খুব অদ্ভুত মনে হবে। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে, এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স (বড় বস্তুর বলবিজ্ঞান) মাইক্রো স্তরে কাজ করবে না।
ব্ল্যাক বডি বিকিরণ
ব্ল্যাক বডি বিকিরণের (Black body radiation) সমস্যা দিয়ে এই গল্পের সূত্রপাত। একটি নিখুঁত ব্ল্যাক বডি হল এমন একটি বস্তু যা তার উপর পতিত সমস্ত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ শোষণ করে। এটি একটি নিখুঁত এবং আদর্শ বস্তু। এই ধরনের বস্তুর বিকিরণ বর্ণালী (radiation spectrum) রেলে-জিনসের (Rayleigh-Jeans) ধ্রুপদী আইন দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়নি। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (Max Planck) এই সমস্যার সমাধানের জন্য একটি গাণিতিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে আলো একটি অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গ নয়, বরং কোয়ান্টা (quanta) নামক শক্তির বিচ্ছিন্ন প্যাকেট দ্বারা গঠিত। এর মানে হল, শক্তি শুধুমাত্র কিছু ছোট ইউনিটের (কোয়ান্টা) অবিচ্ছেদ্য গুণক হিসাবে বিদ্যমান থাকতে পারে এবং অন্য কোনও স্বেচ্ছাচারী পরিমাণে তা উপস্থিত থাকতে পারে না।
প্ল্যাঙ্ক নিজেই এই বিষয়ে খুব বিভ্রান্ত ছিলেন এবং এই তথ্য বিশ্বাস করেননি । এটিকে একটি হতাশাজনক কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু যখন খতিয়ে দেখা হলো, অনুমানের সঙ্গে, সমীকরণগুলি নিখুঁতভাবে কাজ করে গেলো। এই সমন্বয়ের মাধ্যমে প্ল্যাঙ্ক 1900 সালে কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৌলিক রূপটি প্রস্তাব করেন। এই ধরনের ধারণার সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানুষের কিছুটা সময় লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। 1905 সালে আলবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein) আলোক-বৈদ্যুতিক প্রভাব (Photoelectric effect) আবিষ্কার করেন, যেখানে তিনি আলোর বিচ্ছিন্ন কোয়ান্টাকে ‘ফোটন’ (photon) নামক বিচ্ছিন্ন কণা হিসাবে বিবেচনা করেন। এই অবদানের জন্য 1921 সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য 1918 সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের আলোক-বৈদ্যুতিক প্রভাবকে "পুরাতন কোয়ান্টাম তত্ত্ব" (old quantum theory) হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
কোয়ান্টা যুগের সূত্রপাত
শক্তির কোয়ান্টার এই ধারণার আবির্ভাবের একই সাথে মনে হয়েছিল যে যেহেতু পদার্থের কাঠামোগত উপাদান বা বিল্ডিং ব্লকগুলি এই অদ্ভুত আইনটি অনুসরণ করে, তাই এই ধারণার উপর ভিত্তি করে সমগ্র ভৌত বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শক্তি কোয়ান্টার ধারণাটি ব্যবহার করে নিলস বোর (Niels Bohr) অবশেষে তার পারমাণবিক কাঠামোর মডেলটি উপস্থাপিত করেন, যা আজ পর্যন্ত স্বীকৃত মডেল। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে বিভিন্ন কক্ষপথে নিউক্লিয়াসের (nucleus) চারপাশে ঘূর্ণায়মান ইলেক্ট্রনগুলি (electron) শক্তি ধারণ করতে পারে, যা শক্তি কোয়ান্টার অবিচ্ছেদ্য গুণক, এবং এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে রূপান্তর এই ধরনের শক্তি কোয়ান্টার শোষণ বা মুক্তির সাথে যুক্ত। সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক (electromagnetic) শক্তির মতো প্রকৃতির মৌলিক শক্তির একটি কোয়ান্টাম বিবরণের সন্ধান করতে শুরু করেন। রিচার্ড ফাইনম্যান (Richard Feynman) তাঁর কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিকস (Quantum Electrodynamics) তত্ত্বের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তির কোয়ান্টা নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এখনো পর্যন্ত আমরা মহাকর্ষীয় বলের (gravitational force) সঠিক কোয়ান্টাম বিবরণ খুঁজছি, যাকে কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ (Quantum gravity) তত্ত্ব বলা হয়। স্ট্রিং তত্ত্ব (String theory), লুপ কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ (Loop quantum gravity), মাধ্যাকর্ষণের রামধনু (gravity’s rainbow) ইত্যাদি, এগুলি কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিযোগী, তবে কেউই মাধ্যাকর্ষণের যথাযথ ত্রুটিহীন কোয়ান্টাম চিত্র তৈরী করতে সক্ষম হয়নি।
তরঙ্গ-কণার দ্বৈততা: প্রকৃতির অদ্ভুত এক চিত্র
উপ-পারমাণবিক কণাগুলির ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা করতে গিয়ে দেখা গেল যে কেবল ধ্রুপদী বলবিজ্ঞান বা ক্লাসিকাল মেকানিক্সের (classical mechanics) স্বীকৃত চিত্রই ব্যর্থ হয়নি, তার সাথে কণাগুলির প্রকৃতি বা পরিচয় সম্পর্কে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিরও একটি গুরুতর সংশোধনের প্রয়োজন। এটি স্পষ্ট হয়েছিল যখন দেখা গিয়েছিল যে, ক্ষুদ্র জগতের পদার্থবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের চারপাশে উপস্থিত সমস্ত পদার্থের তরঙ্গ এবং কণার দ্বৈত চিত্র (wave-particle duality) গ্রহণ করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে একটি অদ্ভুত এবং আশ্চর্য দৃশ্য যেখানে পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে পদার্থের উভয় অবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, একটি কণা যখন পর্যবেক্ষকের দ্বারা পর্যবেক্ষিত হয় না, তখন সেটি একটি বিচ্ছিন্ন তরঙ্গ হিসাবে বিদ্যমান থাকে, কিন্তু যখনই পর্যবেক্ষক তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, তখনি সেই তরঙ্গের সম্পূর্ণরূপে পতন ঘটে এবং সেটি একটি বিশুদ্ধ কণার রূপে অবস্থান করে। সমতুল্যভাবে বলা যেতে পারে যে, যখন কোনও কণার বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা হয়, তখন তরঙ্গের একযোগে পতন ঘটে।
এটি নিলস বোর এবং ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের (Werner Heisenberg) কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার (Copenhagen interpretation) অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি এমনই অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য একটি ধারণা ছিল, যা আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো একজন দিগ্গজ বৈজ্ঞানিক মেনে নিতে পারেন নি এবং তিনি লিখেছিলেন- "It seems as though we must use sometimes the one theory and sometimes the other, while at times we may use either. We are faced with a new kind of difficulty. We have two contradictory pictures of reality. Separately neither of them fully explains the phenomena of light, but together they do". উপরোক্ত উক্তিটির তর্জমা করলে দাঁড়ায়- মনে হয় যে আমাদের কখনও একটি তত্ত্ব এবং কখনও অন্যটি ব্যবহার করতে হবে, যখন কখনও মনে হচ্ছে আমরা উভয়ই ব্যবহার করতে পারি। আমরা নতুন ধরনের একটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের কাছে বাস্তবতার দুটি পরস্পরবিরোধী ছবি রয়েছে। পৃথকভাবে এগুলির কোনওটিই আলোর বৈশিষ্ট্যকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করতে পারে না, কিন্তু তারা একসাথে তা পারে। তিনি আসলে এই ধারণাটি অপছন্দ করতেন এবং বলেছিলেন- "God does not play the dice with the universe" অর্থাৎ ঈশ্বর মহাবিশ্বের সঙ্গে পাশা খেলেন না। তাই হয়তো আইনস্টাইন মহাবিশ্বের একটি অসম্পূর্ণ এবং অনিশ্চয় চিত্রকে বিশ্বাস করতে পারেননি এবং আমৃত্যু এই কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও অনেক বিজ্ঞানী যেমন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, আরউইন শ্রোডিঙ্গার, আর্থার কম্পটন ইত্যাদি, এই ধারণার বিকাশে জড়িত ছিলেন, 1927 সালে পদার্থের তরঙ্গের মতো আচরণ পরীক্ষামূলকভাবে প্রদর্শন করার জন্য ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী লুই ডি ব্রোগলিকে এই আবিষ্কারের স্বত্ব দেওয়া হয়। এই প্রচেষ্টার জন্য ডি-ব্রগলি (De-Broglie) 1929 সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়া
পদার্থের তরঙ্গ-কণার দ্বৈততা যত বেশি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে থাকে, ততই পদার্থবিদদের চোখের সামনে ক্ষুদ্র স্তরে অনিশ্চয়তার একটি চিত্র উঁকি দেয়। এটি স্পষ্ট হয় যখন আমরা তরঙ্গ আকারে কণার অস্তিত্ব বিবেচনা করি। এই ধরনের অনিশ্চয়তাকে বোঝার জন্য সম্ভাবনার গাণিতিক তত্ত্বকে (Mathematical Theory of Probability) ব্যবহার করা প্রয়োজন কারণ আমরা ধ্রুপদী বস্তুর সুপরিচিত নির্ধারক জগতে আর বাস করছি না। এই ব্যাখ্যার একটি সঠিক গাণিতিক তত্ত্ব স্থাপন করার জন্য, আমাদের একটি তরঙ্গ ফাংশন (Wave function) এবং একটি বৈজ্ঞানিক নীতির প্রয়োজন ছিল যা কোয়ান্টাম স্তরে অনিশ্চয়তাকে ভালভাবে সংজ্ঞায়িত করে।
তরুণ জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (Werner Heisenberg) 1927 সালে তাঁর অনিশ্চয়তা নীতি (Uncertainty Principle) প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে একটি কোয়ান্টাম কণার বেগ এবং অবস্থান একযোগে পরিমাপ করা যায় না। তিনি এটিকে একগুচ্ছ গাণিতিক অসমতার (Mathematical Inequality) মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন যা নির্ভুলতার একটি মৌলিক সীমা (fundamental limit to the accuracy) স্থাপন করে যার সাহায্যে একটি কণার ভৌত পরিমাণের নির্দিষ্ট জোড়ার (pairs of physical quantities) প্রাথমিক অবস্থা (Initial conditions) থেকে পূর্বাভাস দেওয়া যেতে পারে। হাইজেনবার্গ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ম্যাট্রিক্স গঠনও (matrix formulation) তৈরি করেছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স তত্ত্ব তৈরি করার জন্য 1932 সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এরউইন শ্রোডিঙ্গার (Erwin Schrödinger) ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান-আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তরঙ্গ তত্ত্ব (Wave theory) তৈরি করেছিলেন। 1926 সালে শ্রোডিঙ্গার তাঁর বিখ্যাত তরঙ্গ সমীকরণ (Wave equation) প্রকাশ করেন যা গাণিতিকভাবে একটি তরঙ্গ ফাংশন (Wave function) নির্ধারণ করে। তিনি প্রথমে এটি সময়-স্বাধীন (Time-independent) ব্যবস্থার জন্য উদ্ভূত করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে এটি হাইড্রোজেনের (Hydrogen) মতো পরমাণুর জন্য সঠিক শক্তি আইগেনভ্যালু (Energy eigenvalue) দেয়। পরে তিনি তরঙ্গ ফাংশনের সময় নির্ভরতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত গতিশীল সমাধান (dynamic solution) প্রকাশ করেন। শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণের জটিল সমাধানের মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বাস্তব সংখ্যা (Real numbers) থেকে জটিল সংখ্যায় (Complex numbers) স্থানান্তরিত হয়। শ্রোডিঙ্গার কোয়ান্টাম তত্ত্বের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা (probabilistic interpretation) এবং সমগ্র ম্যাট্রিক্স মেকানিক্স দ্বারা খুবই বিচলিত হয়েছিলেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যাকে উপহাস করার জন্য, তিনি “শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল প্যারাডক্স” (Schrödinger's Cat paradox) নামে পরিচিত বিখ্যাত চিন্তা পরীক্ষাটি (thought experiment) কল্পনা করেছিলেন। তিনি নিজেকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের অনিশ্চয়তা নীতি এবং সম্ভাব্য (probabilistic) দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে রেখেছিলেন, কারণ তিনি সেগুলিতে বিশ্বাস করতেন না। এই বিষয়ে, তিনি বলেন- "I don't like it and I am sorry I ever had anything to do with it", অর্থাৎ আমি এটা পছন্দ করি না এবং আমি দুঃখিত যে আমি কখনও এর সাথে জড়িত ছিলাম। তবুও, তার তরঙ্গ সমীকরণ সর্বজনীনভাবে বিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব হিসাবে গৃহীত হয় এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উপর ব্যাপক কাজের জন্য তিনি 1933 সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন।
“শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল প্যারাডক্স” (ছবি - উইকিপিডিয়া)
পল ডিরাক (Paul Dirac) ছিলেন একজন ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উন্নয়নে তার আপেক্ষিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের (relativistic quantum mechanics) তত্ত্বের মাধ্যমে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ছিল ডিরাক সমীকরণের (Dirac equation) প্রণয়ন যা ফার্মিয়নের (Fermion) আচরণকে বর্ণনা করে। এটিই সেই সমীকরণ যা প্রতিপদার্থের (Anti-matter) অস্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অবদানের জন্য তিনি শ্রোডিঙ্গারের সাথে পদার্থবিজ্ঞানে 1933 সালের নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নেন। তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতার (General Relativity) সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা আমৃত্যু আলবার্ট আইনস্টাইনের স্বপ্ন ছিল। ঘটনাক্রমে, এই কাজটি এখনও চলছে এবং আমরা আজ অবধি সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি সফল মহীয়ান সমন্বিত তত্ত্ব (grand unified theory) খুঁজে পাইনি।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিকাশ বিংশ শতাব্দী জুড়ে অব্যাহত ছিল এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে। রিচার্ড ফাইনম্যান (Richard Feynman), একজন আমেরিকান পদার্থবিদ, তার কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিকসের (Quantum Electrodynamics) বিকাশের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজমের (Electromagnetism) সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমন্বয় সাধন করেছিল। তিনি জুলিয়ান শোইঙ্গার (Julian Schwinger) এবং শিনিচিরো তোমোনাগার (Shinichiro Tomonaga) সাথে যৌথভাবে 1965 সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ফাইনম্যান তার ফাইনম্যান ডায়াগ্রামের (Feynman diagrams) জন্য খুব বিখ্যাত ছিলেন যা উপ-পরমাণু কণার আচরণ বর্ণনা করে এবং তাদের গাণিতিক অভিব্যক্তির জন্য একটি সচিত্র উপস্থাপনা পরিকল্পনা করে।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রভাব
বিশ্বাস করা হয় যে তত্ত্বের অদ্ভুত অবাস্তব প্রকৃতি আমাদের যথেষ্ট জ্ঞানের অভাবকে চিহ্নিত করে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের কিছু প্রভাব যেমন কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট (Quantum Entanglement) সত্যিই বিস্ময়কর! কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট বলে যে বড় স্থানিক দূরত্ব দ্বারা পৃথক দুটি কণা একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া বা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং একই বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য একসাথে সংযুক্ত হতে পারে। যেন আমাদের কাছে একই কণার দুটি অনুলিপি রয়েছে যা একটি বড় স্থানিক দূরত্ব দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। অসাধারণ! এই ধারণাটি আলবার্ট আইনস্টাইন, বরিস পোডলস্কি (Boris Podolsky) এবং নাথান রোজেন (Nathan Rosen) দ্বারা 1935 সালের একটি গবেষণাপত্রে সম্বোধন করা হয়েছিল, যা ইপিআর প্যারাডক্স (EPR paradox) হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। তারা এই ঘটনাটিকে একটি অসম্ভব ঘটনা বলে মনে করেছিলেন কারণ এটি সরাসরি কার্যকারণ নীতি (causality principle) লঙ্ঘন করেছিল।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন (Quantum Teleportation) হল প্রেরক থেকে প্রাপকের কাছে কোয়ান্টাম তথ্য পরিবহনের একটি পদ্ধতি যারা একে অপরের থেকে স্থানিকভাবে পৃথক। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে কোয়ান্টাম তথ্য যদি ফোটন (photon), ইলেকট্রন (electron) ইত্যাদির আকারে থাকে তাহলেই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন সম্ভব। কিন্তু টেলিপোর্টেশনের ক্ষেত্রে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হবে ভৌত বস্তুকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা, যা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (Quantum computing) হল অধ্যয়নের একটি ক্ষেত্র যেখানে আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতিগুলি ব্যবহার করে কম্পিউটার-ভিত্তিক প্রযুক্তিগুলি অধ্যয়ন করি। এই পরিমণ্ডলে, আমরা আসলে খুব জটিল শাস্ত্রীয় সমস্যাগুলি (classical problems) সহজে সমাধান করতে কোয়ান্টাম আইনের ব্যবহার করি। এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলি তাদের ক্লাসিক্যাল প্রতিরূপ থেকে অনেক বেশি জটিল এবং সম্পূর্ণ আলাদা। উচ্চ মাত্রার জটিলতার সমস্যাগুলি এই মেশিনগুলি ব্যবহার করে দক্ষতার সাথে সমাধান করা হয়, যা মৌলিক উপাদান হিসাবে কোয়ান্টাম আইন ব্যবহার করে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স হল প্রকৃতির একটি তত্ত্ব যা সবচেয়ে মৌলিক স্তরে কাজ করে। আমরা জানি যে প্রকৃতি এত সহজে তার গোপনীয়তা প্রকাশ করবে না। তত্ত্বটি এখনও তার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করা হয় এবং আমরা জানি না যে পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণের জন্য আমাদের কত সময় অপেক্ষা করতে হবে যাতে কোয়ান্টাম স্তরে একটি সম্পূর্ণ চিত্র প্রস্ফুটিত হয়। বছরের পর বছর ধরে আমরা পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন তত্ত্বকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে সমন্বয় করে পরিমাপ করার দিকে নজর দিয়েছি। এটি প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে কারণ একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব মৌলিক স্তরে কাজ করে এবং অন্যান্য সমস্ত তত্ত্বকে অবশ্যই কোয়ান্টাম স্তরে এই আইনগুলি মেনে চলতে হবে। বর্তমানে, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় ধাঁধা হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স কে মহাকর্ষের সাথে সমন্বয় করা যা কোয়ান্টাম মহাকর্ষের (Quantum gravity) একটি সন্তোষজনক তত্ত্ব প্রদান করে। আইনস্টাইন সহ অনেক অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি এটি অর্জনের জন্য কাজ করেছেন, কিন্তু আমরা এখনও একটি সন্তোষজনক ফলাফল পেতে পারিনি। কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ পরীক্ষা করার জন্য ব্ল্যাক হোলের (Black Hole) অভ্যন্তরে যে সিঙ্গুলারিটি (singularity) থাকে তাকে একটি নিখুঁত পরীক্ষাগার বলে মনে করা হয়। ব্ল্যাক হোল পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং তাই আমরা অদূর ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ কিছু অর্জনের ব্যাপারে আশাবাদী। সম্ভবত আমরা পরবর্তী হাইজেনবার্গ বা শ্রোডিঙ্গার বা ডিরাকের জন্য অপেক্ষা করছি আমাদের পথ দেখানোর জন্য।
ব্ল্যাক হোল ও সিঙ্গুলারিটি (ছবি - https://faraday.physics.utoronto.ca/)
আমাদের সঠিক পরিচয় কি? কোয়ান্টাম মেকানিক্স কি পারে আমাদের জীবন পালটে দিতে?
আমরা আসলে কে তা বোঝার জন্য আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করতে পারি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে যে অনেকগুলি বিভিন্ন সম্ভাবনা সহাবস্থান করতে পারে এবং তাদের মধ্যে যে কোনও একটি যে কোনও সময়ে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। একটি লটারির পাত্র থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে বলটি তোলা হয় শুধু সেই বলটাই তো সম্পূর্ণ খেলাটার পরিচয় তৈরি করে না। যে বলগুলি পাত্রে পড়ে রয়েছে এবং তাদের সুযোগের জন্য আপেক্ষা করছে তারাও খেলার একটি অংশ। আমরা প্রত্যেকেই সম্ভাবনার এক অনন্য সমষ্টি বা সুপারপজিশন (superposition)। আমাদের শক্তি এবং দুর্বলতা, আমাদের সাফল্য এবং ব্যর্থতা, আমাদের লক্ষ্য এবং আমাদের পার্শ্ব অনুসন্ধান, স্থান এবং সময় উভয়ের সাথেই পরিবর্তিত হয়, কখনও কখনও অদৃশ্যভাবে, কখনও কখনও ভূমিকম্পের মতো অপ্রত্যাশিত উপায়ে। আমাদের প্রকৃত আত্মার একটি সম্পূর্ণ বিবরণ, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরিভাষায় আমাদের তরঙ্গ ফাংশন খুবই জটিল। আমরা অনুমান এবং আনুমানিকতার উপর নির্ভর করে, পরিস্থিতি সরলীকৃত ও সীমিত করে, সেই জটিল অঙ্ক সমাধান করার চেষ্টা করি। কিন্তু তারপরেও তরঙ্গ ফাংশনটি বর্ণনা করতে পারে না যে সেই নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের পরিচয় কি। তবে সে এটা বলে দিতে পারে যে আমরা যে কোন মুহূর্তে কী হতে পারি: এক গুচ্ছ অন্তহীন সম্ভাবনা। আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিকাল পরিচয়গুলি সেই তরঙ্গ ফাংশনের মতো: সমস্ত সম্ভাবনার একটি সুপারপজিশন যা সিস্টেমটি পর্যবেক্ষণ করা হলে ভেঙে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট মানের রূপ নেয়। হয়তো এমনটা ঘটে যখন কেউ আমাদের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেয় বা কোন ধারণা পোষণ করে বা যখন আমরা কিছু মুহুর্তের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় থাকতে বাধ্য হই, যেমন শিক্ষক, বিজ্ঞানী, সিইও (CEO), রাজা, মন্ত্রী, কর্মচারী, পিতামাতা, স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য সম্ভাবনাগুলি কিন্তু মুছে যায় না। এগুলি সাময়িকভাবে ন্যূনতম একটি মাত্রায় অবস্থান করে। এই ক্লাসিকাল রূপ থেকে একটি কোয়ান্টাম মেকানিকাল পরিচয় অবশেষে পুনরায় ফিরে আসবে এবং আবার একটি জটিল তরঙ্গ ফাংশন গঠিত হবে যা আগের চেয়েও আলাদা হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত অন্যরা আমাদের কীভাবে দেখবে তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। কিন্তু হয়তো আমরা আমাদের নিজস্ব তরঙ্গ ফাংশন, যা আমাদের আসল পরিচয় বহন করে তার প্রশংসা করতে শিখতে পারি। আমাদের অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত জটিলতা এবং অপ্রত্যাশিততার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে শিখতে পারি। বুঝতে হবে অন্যরা আমাদের এক মুহুর্তে যেভাবে দেখে তা আমাদের সম্পূর্ণ পরিচয় নয় কারন আমরা ক্লাসিকাল বস্তু নই। সমস্ত সম্ভাবনাগুলি বাস্তবায়িত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা কোয়ান্টাম জীব আমরা । অপ্রত্যাশিততা এবং জটিলতা যা আমাদের সংজ্ঞায়িত করে তা ভালবাসতে এবং উপলব্ধি করতে শিখতে হবে কারণ সেটাই আমাদের আসল পরিচয়। আমাদের এই পরিচয় যদি আমরা সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারি তাহলে জীবনের প্রতি আমাদের যে ধারনা তা হয়তো বদলে যাবে। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তার একটি বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন:
“When you change the way you look at things, the things you look at change” অর্থাৎ আমরা যখন যে কোন জিনিসের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি, তখন আমরা যে জিনিসটি দেখছি তা পরিবর্তিত হয়। তাই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব থেকে বড় শিক্ষা হল এই যে যদি আমরা জীবন কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পালটাই তাহলে আমাদের জীবনও পালটে যাবে। তাই সঠিক চশমা পরুন এবং জীবনকে সঠিকভাবে দেখতে শিখুন।
*****