পোসেইডন তার হিসেবের জাবদা খাতা নিয়ে বসেছেন নিজের দপ্তরে। তার হাতে এখন সীমাহীন কাজ, প্রশাসক হিসেবে পৃথিবীর সমস্ত জলের হিসেবই তাকে রাখতে হয়। চাইলেই তিনি যত খুশি সহকারী নিয়োগ করতে পারতেন, এমনকি তার অধীনে এখন যথেষ্ট সংখ্যক সহকারী মোতায়েনও রয়েছে; কিন্তু যেহেতু তিনি নিজের কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে, তাই সেই সহকারীদের সমস্ত কাজ ও হিসেব তিনি দ্বিতীয়বার নিজে মিলিয়ে দেখতে চান, আর সেই কারণেই তারা তাকে খুব বেশী সহায়তা করে উঠতে পারেন না। তবে এটা কখনোই বলা যাবেনা, যে তিনি নিজের কাজ খুব উপভোগ করেন, বরং তিনি যে এই কাজ করেন, তার একমাত্র কারণ হল তাকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; বস্তুত তিনি মাঝে মধ্যেই এমন সব কাজের জন্য দরখাস্ত করে বসেন, যেগুলো নাকি তার ভাষায় অনেক বেশি আনন্দদায়ক, যদিও যখনই তার কাছে সেইরকম অন্য কোন কাজ বা পেশার প্রস্তাব রাখা হয় দেখা যায় যে তার বর্তমান পেশাই তার জন্য সর্বাধিক উপযোগী। বলাই বাহুল্য, তার জন্য অন্য কোনো জীবিকার সন্ধান করা ভীষণই দুরূহ এক কাজ। আর যাই হোক, তার উপর শুধুমাত্র একটি মহাসাগরের দায়িত্ব তো আর ন্যস্ত করা যায় না। আর এমনও নয় যে, তাতে তার কাজের পরিমাণ এতটুকু কম হবে, শুধুমাত্র তার কাজের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমবে আর বীরশ্রেষ্ঠ পোসেইডনের পক্ষে সেই নতুন পদ যথেষ্ট সম্মানের হবে না। আবার যখনই তাকে এমন কোনো পেশার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার সাথে জলের সরাসরি কোনো যোগসূত্র নেই, তখন সেই পরিস্থিতির কথা কল্পনা করেই তিনি অসুস্থ বোধ করতে থাকেন, তার ঈশ্বরিক দম আটকে আসে, এমনকি তার পোক্ত বুকও কেমন যেন দুরু দুরু করে ওঠে। সত্যি কথা বলতে গেলে, তার এই অসুবিধাগুলোকে কেউই আর এখন তেমন গুরুত্ব দেয় না; যখন কোনো মহান ও শক্তিশালী পুরুষ অভিযোগ করে, তখন সবাইকেই মাথা নিচু করে তার সেই বক্তব্যের সাথে সম্মতির অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়, তা সে সামগ্রিক পরিস্থিতি যতই তার বক্তব্যের বিপরীতধর্মী বা হতাশাব্যঞ্জক হোক না কেন। আসলে কেউই বীরশ্রেষ্ঠ পোসেইডনকে পদচ্যুত করার কথা কোনোদিন ভাবতেও পারে নি; সেই কোন অনাদিকাল থেকেই সমুদ্রের দেবতা হওয়াই ছিল তার একমাত্র ভবিতব্য, আর সমুদ্রের দেবতা হয়েই তাকে চিরটাকাল থাকতে হবে।
তবে যেটা তাকে সব থেকে বেশী বিরক্ত করে এবং যা তার নিজের কাজের প্রতি অসন্তোষের মূল কারণ, তা হল সে সমস্ত গুজব ও আলোচনা যা প্রতিনিয়ত তার কানে এসে পৌঁছায়; যেমনটি, তিনি নাকি সবসময়ই তার সেই ভীমদর্শন ত্রিশূলটিকে সঙ্গী করে সামুদ্রিক ঢেউয়ের তালে ক্রমতরঙ্গে ভেসে এক থেকে অন্য সমুদ্র ভ্রমণ করে বেড়ান। বাস্তব তো তা নয়ই, বরং তিনি এখানে, মহাসাগরের এই অতল গভীরে বসে কেবল সীমাহীন ভাবে তার হিসেবই মিলিয়ে চলেছেন, মাঝেমধ্যে এক আধবার জুপিটারের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাত্রাই তার একঘেয়ে সে জীবন যাপনের মাঝে সামান্য বৈচিত্র্যটুকু নিয়ে আসে। যদিও একথাও উল্লেখ না করলেই নয় যে, প্রতিবারই তার যাত্রাশেষে তিনি ভয়ঙ্কর কুপিত ও উত্তেজিত হয়ে নিজ গৃহে ফিরে আসেন। আর এরই পরিণতিতে, তিনি কখনোই সেই ভাবে সমুদ্র দেখে উঠতে পারেন নি, হয়তো বা তার দ্রুত যাত্রাপথের মাঝে অলিম্পাস পর্বতের উত্তরণ পথে কখনো এক-আধ ঝলক - ব্যস ওইটুকুই, আর সমুদ্রভ্রমণের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। একসময় তিনি বলতেন, যে তার এই সমুদ্রভ্রমণ, তিনি সৃষ্টির শেষের অপেক্ষায় বিলম্বিত করে রেখেছেন; হ্যাঁ, হয়ত তখন কোনো এক নীরব মুহূর্ত এসে উপস্থিত হবে, প্রলয়ের ঠিক আগের সেই মুহূর্ত, যখন তার সমস্ত হিসেব নিকেশের পালা শেষ হলে, খুব দ্রুত, একটিবারের জন্য সব ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়তে পারবেন - দিগন্তবিলীন সেই নীল সমুদ্রের উদ্দেশ্যে।
*বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক ফ্রানজ্ কাফকার জন্ম - ১৮৮৩ সালের ৩রা জুলাই, বর্তমান চেক রিপাবলিকের রাজধানী শহর - প্রাগের এক ইহুদি পরিবারে। কাফকার রচিত কাহিনীগুলি মূলত বাস্তবতা (রিয়েলিজম্) ও কল্পনার (ফ্যান্টাসি) মধ্যে এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। সাধারণত তার লেখায় সমাজ-বিচ্ছিন্ন, ও একাকী নায়কেরা বিচিত্র কোনো পরাবাস্তব পরিস্থিতি এবং তারই সাথে উদ্ভুত কোনো অকল্পনীয় সোশ্যিও-ব্যুরোক্রাটিক ক্ষমতা (পাওয়ার) ও তার বিবিধ আস্ফালনের সম্মুখীন হয়। পরাবাস্তবতা, একাকীত্ব, অপরাধবোধ এবং এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস - এগুলোই ছিল কাফকার লেখার মূল উপজীব্য।
১৯২৪ সালের ৩রা জুন, মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে টিউবারকুলোসিস রোগে ভুগে ফানজ্ কাফকার জীবনাবসান হয়। এখানে বলে রাখা দরকার, কাফকার ক্রনিক সেলফ-ডাউটের সমস্যা ছিল। যার জেরে, তিনি জীবৎকালেই তার অধিকাংশ রচনা নষ্ট করে ফেলেছিলেন। বাকি যে সামান্য অংশটুকু রক্ষা পায়, তার মধ্যেও বেশ কিছু লেখা চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছে। বস্তুত, কাফকার অধিকাংশ লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল তার মৃত্যুর পর। (যদিও তিনি নিজে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন তার অসমাপ্ত ও অপ্রকাশিত লেখাগুলি নষ্ট করে ফেলার জন্য। কী ভাগ্যিস তা মানা হয় নি!) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তার লেখা বিশ্বজনীন পরিচিতি লাভ করে।
প্রসঙ্গত, কাফকা তার সাহিত্য রচনা করেছেন জার্মান ভাষায়, - ইংরেজিতে নয়, এবং পরে তার সে সাহিত্য বিশ্বের সমস্ত প্রধান ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কাফকার যেসব সাহিত্যকর্ম আজও পাঠকমহলে তুমুল জনপ্রিয়, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - তার বিখ্যাত উপন্যাসিকা দ্য মেটামরফোসিস (১৯১৫) এবং তার অকালমৃত্যুর পর প্রকাশিত হওয়া দুটি উপন্যাস - দ্য ট্রায়াল (১৯২৫) এবং দ্য ক্যাসেল (১৯২৬)।