লড়াই
আমার বিশ্বাসের দাম তুমি দিয়েছিলে তোমার লাভা দিয়ে। সাথে জুটিয়েছিলে আরও বেশ কিছু আগ্নেয়গিরি। আমার যে চন্দ্রমল্লিকা একদিন তোমারই হত, তুমি সেই নিষ্পাপকে পুড়িয়েছিলে গরম ছাই দিয়ে। তুমি বা তোমরা। যে বিশ্বাস নিয়ে নীলকণ্ঠ জড়িয়ে ওঠে শিউলি গাছের ডাল, সেই বিশ্বাস নিয়ে আমিও জড়িয়েছিলাম তোমাকে। বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন। আমি পড়েছিলাম একবুক পলি নিয়ে।
… একটু দাঁড়াও। শেষটা শুনে যাও। আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি। তোমরাও আছ। মাঝে আছে শুধু কিছু লোহার খুঁটি আর অনেক উপরে ঘুলঘুলি দিয়ে একটু চুঁইয়ে পড়া আলো যেটা সেদিনও পড়েছিল ওই বন্ধ পাম্প হাউসের ঘরে, আমার চোখে।
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি
প্রেমের গতি যে সর্পিল সেটা আমি মূলাধারেই বুঝেছিলাম,
নিদ্রিত সেই সর্পকে আমি জাগিয়েছিলাম
নীলকণ্ঠ হব ব’লে।
পদ্মকাঁটায় রক্তাক্ত হয়েও স্বাধিষ্ঠানে পৌঁছেছিলাম
শুধু তোমার খাতিরে।
মণিপুরে উপস্থিত হলাম, পেলাম চুম্বন।
তোমার শাড়ি আলুলায়িত, কেশ অবিন্যস্ত,
তুমি চলমান, আমি অনুসরণত…অনাহতর দ্বার উন্মোচিত।
তোমার শ্বেতধবল স্কন্ধে আমার ওষ্ঠ অমৃতের স্বাদ পেয়েছিল,
বিশুদ্ধে পৌঁছেও আমার সে ঘোর কাটেনি।
তুমি ক্লান্ত, আমি মিলনের উত্তেজনায় কম্পমান,
তুমি অনাবৃত হলে আজ্ঞায় এসে।
আমি আর এগোতে চাই না,
তুমি স্মিত হেসে বললে, ‘আর একটু চলো
ব্রহ্মলোকের শয্যায় আমরা মিলিত হব’
এত আলো সহস্রারে! এত আলো!
মিলন কি একেই বলে…
অ-মৃত কথন
“দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে ।।” - গীতা ২/৫৬
বৃক্ষতলে সমাহিত চিত্ত
নিষ্কম্প বায়ুর ন্যায়,
উচ্চ-অনুচ্চ, শ্রেয়-ত্যাজ্য,
কাঙ্খিত-অনাকাঙ্খিত, সৌম্য-কদর্য
কোনও বোধই আন্দোলিত করে না আর-
অথচ অপাঙ্ক্তেয় নয় তারা;
যে ‘মার’ ক্ষত বিক্ষত করেছে প্রতিটি ক্ষণে
সেই এনে দিয়েছে অনাকাঙ্খিত স্বাদ
যা তৃপ্ত করেছে সুজাতার পায়েসের অধিক,
লাভ করেছি সেই গোপন তত্ত্ব
‘গহকারকং গবেসন্তো
দুক্খা জাতি পুনপ্পুনং’।
রাজবস্ত্র-চীবর, স্বর্ণ বা মৃ্ৎপাত্র
অমৃত হোক, হোক সে গরল
সমচোখে ক’রে যাব দান, আর্যসত্য,
সহস্র সহস্র বৎসর ধ’রে।
একটি ছবি
একবুক কুয়াশা মেখে মেয়েটি প’ড়ে আছে
দেখো, আচ্ছন্ন চৈতন্য মেখে মেয়েটি প’ড়ে আছে,
ফ্লাড লাইটের আলো আঁধারে সিল্যুয়েট দেখা যায় –
তার কেশরাশি অবিন্যস্ত, মণি অচঞ্চল, স্থির
বিস্ময়স্তব্ধ দৃষ্টিতে খেলা করে অরোরা বোরিয়ালিস
নাকি হামিংবার্ড?
পাশে প’ড়ে থাকা ভাঙা ক্লিপ সে’কথা জানে,
যে নদীর উজান বেয়ে সে পাল তুলেছিল,
আঁকা ছিল অশ্বমেধের ঘোড়া
বায়ু বয়েছিল হ্রেষাধ্বনির মতন,
সেই নদীতটে, বালুচরে –
তার শীতল ওড়নায় নামে কুয়াশা, ধীরে
বিভ্রান্ত অস্তিত্ব হারিয়ে যায় মরীচিকার মতন,
মেয়েটি প’ড়ে আছে, ওর একটি ছবি আঁকো …
অন্ধ
অন্ধত্ব আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারেনি।
যে অন্ধকার আকন্দ পাতা বেয়ে নেমে আসে,
যে অন্ধকার হেমলকের শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে থাকে,
যে অন্ধকার তুমি দেখেছিলে –
সিলিং ফ্যান থেকে ঝোলা ফাঁস দেওয়া দড়িতে,
আমি সেই অন্ধকার থেকেই আলো খুঁজে নিই;
কালো কাচের ভিতর থেকে, স্টিক্স নদীর ভিতর থেকে
একে একে উঠে আসে –
হোমার, মিলটন, হেলেন, ব্রেইল
জেগে ওঠে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়,
সূক্ষ্ম, অতিন্দ্রিয় সেই তরঙ্গ
বাদুড়ও যার পায় না নাগাল,
তাই বুনে বুনে আমি লিখে চলি কবিতা,
না, অন্ধত্ব আমার দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারেনি –
আমি তোমাদের থেকে ভালো দেখতে পাই।