রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান বলে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন তার জীবৎকালে দৈহিক বা মানসিক অত্যাচারের শিকার হন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০২২ এর হিসেব অনুযায়ী সে বছর মহিলাদের উপর দেশব্যাপী মোট নির্যাতনের সংখ্যা হলো ৪,৪৫,৫২৬। প্রসঙ্গত, এদের প্রত্যেকটিই রিপোর্টেড কেস। সুতরাং, আমাদের মতন দেশে যেখানে নারী নির্যাতনের মত ঘটনা খুব সহজে সামনে আসে না, আসলেও চেপে যায় বিবিধ কারণে সেখানে নথিবদ্ধ না হওয়া মোট কেসের সংখ্যা যে কত হতে পারে তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। এবং, নারীর প্রতি এই সহিংসতার ঘটনা আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান।
প্রসঙ্গত, নারীর প্রতি সহিংসতা বহুমাত্রিক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সহিংসতার বেশিরভাগই আবার নিজ সঙ্গী বা পার্টনারের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা (ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স)। এছাড়াও রয়েছে বিবিধ যৌন অত্যাচার, মানবপাচার, নারীহত্যা, এবং মহিলা যৌনাঙ্গ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত নানা ধরনের হিংস্রতা ও বর্বরতা। বর্তমানে ইন্টারনেট পরিসরেও ঢুকে পড়েছে নারীর প্রতি হিংস্রতার ঘটনা যাকে আমরা ডিজিটাল ভায়োলেন্সের আওতায় ফেলছি। নারীর ওপর এই অত্যাচারের মূলে বিভিন্ন কারণ রয়েছে যা সমাজতত্ত্ববিদ ও মনোবিদরা ব্যাখ্যা করেছেন তাদের তৈরি বিভিন্ন তত্ত্ব এর মাধ্যমে। এই সহিংসতার পেছনে নির্দিষ্টভাবে যে কারণই লুকিয়ে থাকুক না কেন, বড় করে বা ম্যাক্রো লেন্সে দেখতে গেলে দেখা যাবে তার গভীরে রয়েছে আমাদের সমাজের মজ্জায় ঢুকে থাকা পিতৃতন্ত্রের বীজ।
পিতৃতন্ত্র শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল পিতার শাসন। ঐতিহাসিক ভাবে, পিতৃতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করা হয় পরিবারের সর্বাধিক বয়ষ্ক পুরুষটির (মেল হেড) একনায়কতন্ত্রী শাসনকে ব্যাখ্যা করতে। এই পিতৃতন্ত্র এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থার কথা বলে যাতে পুরুষের হাতে রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক, ও নৈতিক সহ সমস্ত কর্তৃত্ব। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাব এই সামাজিক ব্যবস্থা কিভাবে প্রায় সভ্যতার সূচনা থেকেই পুরুষ ও নারীর কাজের ক্ষেত্রকে শ্রমের বিভাজন দ্বারা আলাদা করে দেয়। ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস তার ‘দ্য অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’ (১৮৮৪) বইটিতে উল্লেখ করেছেন যে সম্পত্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা থেকেই আজকের পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব। ঘরের বাইরে, যা খাদ্য উৎপাদনের জগৎ সেটা হয়ে যায় পুরুষের কাজের জায়গা, আর ঘরের কাজ, সন্তান উৎপাদন ও লালন পালনের যে জায়গা তা নির্ধারিত হয় মহিলাদের জন্য। সেখান থেকেই পুরুষদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। প্রাচীন গ্রীসে দেখা যায় পরিবারের মাথা সবসময়ই হতেন একজন পুরুষ। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, পুরুষের চেয়ে মেয়েদের রক্ত শীতল তাই তারা বিবর্তনগত দিক থেকে কোনোদিন পুরুষ হয়ে উঠতে পারে নি। তার বিভিন্ন রচনায়, নারীকে নৈতিকভাবে, বুদ্ধিগতভাবে এবং শারীরিকভাবে পুরুষের থেকে অধম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে নারী পুরুষের সম্পত্তি, সমাজে তার ভূমিকা শুধুই প্রজনন এবং গৃহে পুরুষদের সেবা করা। আবার অন্যদিকে প্রাচীন প্রাচ্যে ইতিহাসগত দিক থেকে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করা ও সমাজ তৈরি করার কাজ থেকে নারীকে আলাদা রাখার ব্যাপারটি লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতেও নারীকে একটি পুরুষের সমান সম্মান প্রদর্শন করা হয় নি। সে গীতা হোক, কি কোঅরান, কি বাইবেল কি জেন্দাবেস্তা। বস্তুত, পিতৃতন্ত্র আলাদা আলাদা ব্যক্তির লিঙ্গবাদ নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রনের সাথেও সম্পর্কিত, যা সমাজে তৈরি করেছে নারী পুরুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্য। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় এই বৈষম্যপূর্ণ অবস্থান থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতার জন্ম। এর বাইরেও বিভিন্ন সমাজতত্ত্ববিদরা তাদের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন যে পুরুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও তার হিংস্র আচরণের জন্য অনেকখানি দায়ী, যেমন তার কাজের জায়গায় অবসাদ, অর্থের সমস্যা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চাপ ইত্যাদি।
এবারে বরং তত্ত্বের ভিড়ে না গিয়ে একটু বাস্তবে দৃষ্টি ফেরানো যাক। স্বাধীনতার আগে আমাদের দেশে যখন নব ঔপনিবেশিকতাবাদ কড়া নাড়ছে সে সময় নারীকে সম্পূর্ণভাবে ঘরের সাথে, এবং ব্যক্তিগত জীবন-নির্বাহের সাথে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ, এক নতুন পিতৃতন্ত্রের জন্ম হল যে নারীকে তার নির্দিষ্ট অক্ষপথে বন্দী করে ফেলল। একজন নারী হবেন আদর্শ স্ত্রী এবং অবশ্যই স্নেহ ভালোবাসায় পূর্ণ একজন আদর্শ মা। এই নব্য পিতৃতন্ত্রের বেড়াজাল অতিক্রম করে তৎকালীন সময়ের নারীরা জনপরিসরে আসার জন্য যে রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই তা ছিল বেশ দুর্গম। সেই সময়ে সমাজের প্রত্যাশা ছিল যে নারী শুধু পুরুষের দৃষ্টি থেকেই নিজেকে রক্ষা করবে না, বরং রক্ষা করবে তার পরিবারকে এবং তার সেই পরিবারের অন্তর্নিহিত ঐতিহ্যটিকেও।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উদারপন্থী নারীবাদীরা আশা রেখেছিলেন যে সংবিধান অনুযায়ী নারী পুরুষের যে সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে, তাতে মহিলারা নিজেদের জায়গা নিজেরাই দখল করে নেবে। বাস্তবে যদিও তা প্রতিফলিত হয়নি। বীণা মজুমদার এবং লতিকা সরকারের লেখা ট্যুওয়ার্ডস ইক্যুয়ালিটি রিপোর্টে দেখা যায় যে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর মধ্যে নারী এবং পুরুষের সেক্স রেশিও নিম্নগামী, অর্থাৎ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পুরুষের তুলনায় জন পরিসরে নারীদের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। নারীরা আবার প্রাক্স্বাধীনতার দিনগুলির মত পরিবারের অন্দরে নিজেদের আবদ্ধ করেছেন।
১৯৭০ এর পর থেকে বহির্জগতে নারীর উপর হিংস্রতার বেশ কিছু ঘটনা সামনে আসে যা কিন্তু সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। ১৯৭২ সালের দোসরা মার্চ মথুরার উপর ঘটে যাওয়া সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা কারোরই অবিদিত নয়। মথুরা ছিলেন মহারাষ্ট্রের এক তরুণী, এবং জন্মসূত্রে আদিবাসী কন্যা। মহারাষ্ট্রের গদচিরোলি জেলার দেশাইগঞ্জ থানার চত্ত্বরে দুই পুলিশকর্মী দ্বারা তিনি ধর্ষিতা হন। এর পরে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক যে ঘটনাটি ঘটে তা হল সেশন কোর্টে অভিযুক্ত দুজনেই ছাড়া পেয়ে যায়। কারণ হিসাবে দর্শানো হয়, যেহেতু মথুরা আদিবাসী সুতরাং তার যৌন সঙ্গমের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সুপ্রিম কোর্টে কেস চলে। প্রচুর হইচই এবং প্রতিবাদের পর শেষপর্যন্ত দ্য ক্রিমিনাল ল্য অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৮৩র মাধ্যমে ভারতীয় ধর্ষণ আইনে বড়সড় এক সংশোধন আসে। আর এই সংশোধন হল যৌন মিলনের ক্ষেত্রে সম্মতির ধারণা।
আমরা কেউ ভুলিনি নব্বইয়ের দশক জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নারীর প্রতি হিংস্রতার নানা ঘটনা। নারীর দেহ যেন রণক্ষেত্র বারবার তা প্রমাণ হয়েছে। মনে পড়ে রাজস্থানের ভানওয়ারি দেবীর ঘটনা। ১৯৯২ সালে রাজস্থানের বিভিন্ন পরিবারে বাল্যবিবাহ রোধের চেষ্টা করায় ক্ষুব্ধ হয়ে উচ্চবর্ণের পুরুষেরা তাকে গণধর্ষণ করেছিলেন। সেখানেও দীর্ঘদিনের লড়াই আর তার পর আসে বিশাখা নির্দেশিকা যার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে তৈরি হয় কর্মক্ষেত্রে অ্যান্টি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট সেল এবং ইন্টারনাল কমপ্লেনটস্ কমিটির ধারণা। ২০১২ সালে দেশের রাজধানী দিল্লিতে ঘটে যাওয়া নির্ভয়া কাণ্ড আবার আমাদের ঘুম ভাঙায়।
রাত দখল, ১৪ই আগস্ট (স্থান - বিরাটি বণিক মোড়) ছবি - রাজর্ষি ঘোষ
আর আজ এখন ২০২৪! কলকাতার তিলোত্তমার ঘটনা সব দিক থেকেই নজিরবিহীন। কর্মক্ষেত্রে অন ডিউটি থাকাকালীন অবস্থায় এক সরকারি ডাক্তারকে বীভৎস ভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হল। পরবর্তী সময়ে দেখি এই অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মহিলারা রাত দখল করছেন। যে রাত কে পিতৃতন্ত্র বেঁধে দেয় মেয়েদের জন্য বিপদের সময়কাল হিসেবে, সেই রাতকেই মহিলারা দখল করেছে আমাদের রাজ্য, দেশ এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও। বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, এবং অবশ্যই নারীদের প্রতি হয়ে চলা বিভিন্ন অসম্মান ও নির্যাতনের ঘটনাকে তুচ্ছ করে দেখানোর প্রবণতাকে ধিক্কার জানিয়েই এই প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছে। স্লোগান উঠেছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। প্রসঙ্গত, আমরা যে জাস্টিস এর দাবি জানাচ্ছি, এখানে নিজেদের কাছে ভীষণ পরিষ্কার থাকা দরকার - এই জাস্টিস বা বিচার ঠিক কিসের জন্য। একটি সিস্টেমের পরিবর্তন এত তাড়াতাড়ি হয় না, কিন্তু প্রতিবাদ আমাদের জারি রাখতে হবে - ঘর থেকে, ছোট থেকে ছোট যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে। লিঙ্গ সংবেদনশীলতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা বৃদ্ধির জন্য পরিবারের ছোট বাচ্চাটিকে প্রথম থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা দেওয়ার দরকার, আর দরকার প্রচুর কর্মশালা আয়োজনের। দায়িত্ব বাবা মায়ের, দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এবং অবশ্যই সুশীল সমাজের। আমরা কেউই সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না।
26 October, 2024
লেখাটা ভালো। তবে আমাদের দেশের স্বাধীনতার আগে "নব ঔপনিবেশিকতা" কেন? সাবেক ঔপনিবেশিকতা বলতে লেখক কোন পর্যায়টি চিহ্নিত করতে চেয়েছেন?