১২৫ তম জন্মবর্ষ : পল রবসন ( এপ্রিল ১৮৯৮ ) ও কাজী নজরুল ( মে ১৮৯৯ ) – অনন্ত প্রবাহপথে ছোট এক দূরত্ব পার ...

লিখেছেন:সজ্জ্বল দত্ত

কোনো কাব্যিক সূচনার ধার না ধরে পরিষ্কার ক'টি প্রশ্ন রাখি।...অফুরান প্রাকৃতিক সম্ভারে ভর্তি এই পৃথিবীর বুকে জন্মগ্রহণ করে আমি ঠিক কোথায় কবে কতখানি ক্ষতবিক্ষত হয়েছি, কে রেখেছে তাঁর হিসেব? ... প্রিয় নীলগ্রহের আপন অক্ষে ঘূর্ণনের অবধারিত ফলস্বরূপ এই বাংলায় শেষ বিকেলে চিলের ডানায় ভর করে যখন সন্ধ্যে নামে, ধীরে ধীরে গভীর হয় রাত, উল্টোদিকে সুদূর পাশ্চাত্যে সেই সন্ধ্যে বা রাত্তির পার করে আকাশের সম্রাট তখনই হয়ত রঙে রঙে ভরিয়ে তুলছে গোটা দিগন্ত ! ... বেশ কথা। কিন্তু সেই নির্জন নিস্তব্ধ রাতে আমি কি নিশ্চিন্তে ঘুমোই এখানে? নিশ্চিন্তে জেগে থেকে সেই রঙিন সৌন্দর্য্য উপভোগ করে উঠতে পারি সেখানে? ... কে বলবে 'হ্যাঁ'? শুনি, কে দায়িত্ব নিয়ে বলবে এই অনিবার্য মিথ্যেকথা ?... যে বলবে, সে বরং এই মিথ্যে থেকে বেরিয়ে এসে অন্য কথা বলুক । বিশ্বের এ' প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে সেই ব্যাথায় সাজানো স্তোকের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ যখন কোনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে, স্ফুলিঙ্গ নিভে গেলে আবারও যখন প্রাণ পায় ফুল, হালকা হাওয়ায় মাঠে মাঠে দুলতে থাকে সোনালী শস্যগাছ, তখন তাঁর কোনো দেশ কোনো কাল কোনো এদিক-উল্টোদিক ভেদাভেদ হয় ? 

"our lands may be far , but our hearts are close , your garden of flowers is right next to mine " . ( আলি সরদার জাফরি )। 

উনবিংশ শতকের একেবারে শেষ লগ্নে বিশ্বের দুই প্রান্তে এমনই দুটি ফুল প্রায় পাশাপাশি সময়ে ফুটে উঠল চিররক্তস্নাত প্রকৃতি-রাজত্বে। শুরু হল তাদের ধুলোকাদাময় দূষিত বাতাসে রঙিন পাপড়ি মেলে পথ চলা । গাছে গাছে আরও অজস্র ঝিমিয়ে থাকা ফুল যেন বাঁচার মন্ত্র পেল। আলোয় আলোময় স্বপ্নচেতনা তখন তাদের সব্বার সবটুকু সত্তা জুড়ে ....  

অত্যাচার, অবিচার, রক্তপাত, ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে এক জায়গায় এসে মিলিত হয়, তখন মানবদরদী কোনো তরুণ কবিহৃদয়ে বা শিল্পীহৃদয়ে ঠিক কতখানি রেখাপাত করতে পারে তা? ১৯১৭-১৯১৯, নজরুল সৈনিক হিসেবে করাচির সেনানিবাসে। রুশ বিপ্লবের সফলতায় প্রবল উল্লাস প্রকাশ করে ফেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কড়া ধমক খান। চাকরি প্রায় যায় যায়। কোনোরকমে সে যাত্রা রেহাই পেলেও যে কবিপ্রাণের একেবারে গভীরতম প্রদেশে প্রতিবাদের বীজ প্রাকৃতিকভাবেই রোপন করা, হাতে যদি থাকে তাঁর কাগজকলম, তো তাঁর ভবি কি এত সহজে ভোলবার? এই করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীন সময়ে তাঁর সহসৈনিকরা চলে গেলেন মেসোপটেমিয়া বা ইরাকে তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করতে। এই পটভূমিকায় রচিত নজরুলের "শাত-ইল-আরব" কবিতায় লিখিত লাইন --                                  

"শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর। / যুঝেছে এখানে তুর্কি-সেনানী, / য়ুনানী, মিস্‌রি, আর্‌বি কেনানি- / লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্‌ বেদুঈন্‌দের চাঙ্গা শির! / নাঙ্গা-শির্‌-"।                      

নজরুল যে কত বড় ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবি ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইরাক যখন পুরোপুরি ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হয়, তখন তাঁর যে অবস্থা হয় সেই অবস্থার সঙ্গে এই কবিতার মূলভাব মেলাতে বসলে।

মহান শিল্পীসত্তা কিভাবে "বিশ্ব" হয়ে ওঠে? কোন গুণে কিভাবে ছাড়ায় "দেশ”নামক এক শাসন-প্রয়োজনে নির্মিত কৃত্রিম ভৌগোলিক সীমান্ত? কিভাবে ছাড়ায় ভাষার বোধগম্যতার সীমানা? সে কি কেবলই সৃজনের ব্যঞ্জনায়, সূক্ষ্ম নান্দনিকতায়? বিশ্বজুড়ে আতঙ্কিত অত্যাচারিত মানবসমাজের কষ্ট আবেগ অনুভূতির সঙ্গে সৃজন ও সৃজনের বাইরের প্রতিটি মুহূর্তকে জড়িয়ে, সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে না পারলে কি তা সম্ভব? ১৯৩৪ সালে পল রবসন বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক সার্গেই আইজেনস্টাইনের আমন্ত্রণে রাশিয়ায় আসেন (আমার “ভ্যাকুলিঞ্চুক" গদ্যে এ'প্রসঙ্গে বিস্তৃত তথ্য আছে)। রাশিয়ার মাটিতে পা রাখার আগে কয়েকদিন তিনি ও তাঁর স্ত্রী Eslanda বার্লিনে কাটান। প্রবল ঝড় ও তুষারপাতের মধ্যে একদিন তাঁরা দুজনেই আটকে পড়ে রাত কাটিয়েছিলেন পূর্ব বার্লিনের কোনো এক রেলওয়ে স্টেশনে। তাঁদের কাছে না ছিল কোনো উলের বস্ত্র, না ছিল অন্য কোনো গরম পোশাক।  প্রবল ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একসময় দুজনেরই মনে হয় তাঁরা বোধহয় আর বাঁচবেন না। অথচ নিজেদের জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রবসন ও Eslandaর অনুভূতি -- , ( যা পরবর্তীতে তাঁদের ডায়েরি ঘেঁটে উদ্ধার করা হয়েছে ) "We suddenly understand for the first time what the feeling must be of a black in Mississippi or that of a jew in Nazi-ruled Germany , .... terror , fear , horror tension,... nerves strained to breaking point " . ... মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নির্যাতিত মানুষের যন্ত্রণার সঙ্গে নিজের মৃত্যুযন্ত্রণাকে যিনি এক করে ফেলতে পারেন, শিল্পী হিসেবে গোটা পৃথিবীর সেই হৃদয়কে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে? থাকা উচিত? ... বার্লিনের পরে পরেই বিপ্লবভূমি রাশিয়ার মাটিতে পা রেখে আজন্ম বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী রবসনের সেই প্রবাদপ্রতিম উক্তি "Here I am not a Nigro, but a human being for the 1st time in my life. "। 

অত্যাচারী শাসক, মানবতাবিরোধী শাসক, অনায়াস শোষণের জন্য  বিভিন্ন গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণতার বিষপান করানো শাসক কবে সহ্য করেছে পৃথিবীর দুই ভিন্নপ্রান্তে হলেও ক্রমশঃ বিকশিত হতে থাকা এমন দুই রক্তেমাংসে হেঁটে চলে বেড়ানো স্বাধীন সত্ত্বাকে, যাদের লেখনী যাদের কথা যাদের সুর এবং সর্বোপরি যাদের শোষিতর পক্ষে থাকার সরাসরি বার্তায় হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ অনুপ্রাণিত হন, ভাবতে শেখেন, জোরালো কন্ঠে করতে শেখেন প্রতিবাদ।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজী নজরুলের ঘনিষ্ঠতার কথা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার কথা, বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে নজরুলের একাধিকবার বাংলাদেশ সফরের কথা, স্বাধীন বাংলা হওয়ার পর কোলকাতা সফরে এসে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডের সভায় বঙ্গবন্ধুর নিজ উদ্যোগে নজরুলকে ডেকে নেওয়ার কথা কারো অজানা নয় । ... বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের শেষাংশে যে "জয় বাংলা" স্লোগান উচ্চারণ করেন , নজরুল তাঁর "পূর্ণ অভিনন্দন" কবিতায় তা বহু বহু আগে ব্যবহার করেছিলেন । বাংলা ভাষায় "পূর্ণ অভিনন্দন" এবং যে কাব্যগ্রন্থে এটি অন্তর্ভুক্ত হয় সেই "ভাঙার গান" ইতিহাসগত  ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবতঃ এই বাংলায় বসে বাংলা ভাষায় লেখা কোনো কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থের রাষ্ট্রকতৃক নিষিদ্ধকরণ এবং তাঁর সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়ার ঘটনা সেই প্রথম। সাল ছিল ১৯২৪। ইংরেজ শাসকের স্পষ্ট ব্যাখ্যা।  কবির অপরাধ -- কবিতাটির জায়গায় জায়গায় মানুষের মুক্তির ইঙ্গিত, বিজয়ের ইঙ্গিত। ... কিন্তু কবির লেখনীশক্তির ভেতর দিয়ে উঠে আসা মানুষের স্লোগান মানুষের আবেগ কি এইভাবে দমিয়ে রাখা যায়? নজরুলের ব্যবহৃত সেই শব্দবন্ধ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে তাঁর ভাষণে তুলে আনলেন কোনো এক প্রিয় রাষ্ট্রনেতা এবং আজ তা বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান। 

সময়ের পার্থক্য প্রায় দশ বছরের বেশি হলেও কী অদ্ভুত সমাপতন!  পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ভারতের তৎকালীন জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাঁর ব্রিটেনসফর কালে নিজ উদ্যোগে দেখা করলেন সদ্য রাশিয়া থেকে ব্রিটেনে ফিরে আসা মানবতাবাদী কবি-গীতিকার-শিল্পী পল রবসনের সঙ্গে। সেই সাক্ষাতে পণ্ডিত নেহেরুর কাছে রবসন অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেন। বর্ণবিদ্বেষ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ কে গোটা বিশ্ব থেকে সমূলে উৎপাটিত করার বিষয়ে এই কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদী গায়ক ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অন্যতম নেতা যৌথ বিবৃতি দেন, যা বড় করে প্রচার করা হয় ব্রিটেন ও ভারতবর্ষে ।

 

*                 *              *              *  

 

             "We are the peat bog soldiers 

               Marching with our spades to the moor.

               Up and down the guards are marching,

               No one , no one can get through . 

               Flight would mean a sure death facing 

               Guns and barbed wire block our view ,

               We are the peat bog soldiers 

               Marching with our spades to the moor ".

১৯৩৩ সালে নাৎসী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের ওপর সেনা অত্যাচারের প্রতিবাদে ক্যাম্পেই লেখা এবং গাওয়া এই গান যখন ১৯৩৮ এ পল রবসন তাঁর কন্ঠে নতুন করে রেকর্ড করলেন এবং গোটা জার্মানি জুড়ে তা তুমুল জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল, তৎক্ষণাৎ মিটিংয়ে বসল হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান কাউন্সিল । সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে যদি জার্মান সেনা কোনোদিন ব্রিটেন দখল করতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে এই কৃষ্ণাঙ্গ গায়ককে গ্রেফতার করা হবে। 

স্পেনের গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহীদের পূর্ণ সমর্থন, আফ্রিকার ও লাতিন আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে দাঁড়ানো, মাতৃভূমি আমেরিকার সরকারের তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা, মার্কিন FIB র তাকে কড়া নজরদারিতে রাখা  এই প্রতিবাদী গায়ক ও গীতিকারের সঙ্গে এই বঙ্গের বিদ্রোহী কবির একটিই বড় তফাত -- পল রবসনের বিরুদ্ধে একাধিক রাষ্ট্রের তীব্র ক্ষোভ থাকলেও তাকে বাস্তবে কখনো গ্রেফতার হতে হয়নি । কিন্তু নজরুলের "অগ্নিবীণা " প্রকাশিত হওয়ার পর পরই তাকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল, একইসঙ্গে অগ্নিবীণা হয়েছিল নিষিদ্ধ। ... পল রবসনের we are the pet bog soldiers যখন জার্মানিতে প্রবল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, সঙ্গে পাচ্ছে নাৎসী সরকারের হুমকি, ঠিক তখনই এই বাংলায় এক তরুণ কবি-গীতিকার তাঁর " ধূমকেতু "র পথরচনায় লিখছেন:

"একটিমাত্র টুকরো ভারতীয় ভূমিও আর এই সাম্রাজ্যবাদী বিদেশীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। যারা অস্ত্রের জোরে ভারতের স্বৈরশাসক হয়েছে এবং এই পবিত্র ভূমিকে শ্মশানে পরিণত করেছে, তাদের তল্পিতল্পা সহ সাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে "।

কোন রাষ্ট্র সহ্য করবে এই কথা? ফলতঃ ধূমকেতুর জন্য কবির দ্বিতীয়বার কারাবাস। 

দুই মহান বিপ্লবী কবি-গীতিকারের ভৌগোলিক ভূখণ্ড ও খণ্ড কালপ্রবাহ অতিক্রম করে যাওয়া নিয়ে দীর্ঘ থেকে অতি দীর্ঘ আলোচনা চালানো যায়। 

"joy beats oppression, 

but oppression will make you pay,

cause our joy is fleeting while oppression never goes away.. you look them right in the eye , 

yea you shout and sing them down,

but joy, our joy, don’t really care for fighting

while oppression will just wait around for you to blink. 

joy beats oppression,

but oppression will make you pay. "  

এই গান যখন লিখছেন পল রবসন, সময়গত ভাবে তাঁর সামান্য দূরত্বে বসে স্থানগত ভাবে বহু মাইল দূরত্বে বসে এই বঙ্গে কবি নজরুল তখন লিখছেন 

         "শোন অত্যাচারী ! শোন রে সঞ্চয়ী ! 

          ছিনু সর্বহারা হব সর্বজয়ী "

এবং সঙ্গে সঙ্গে কবির অন্তর নিঃসৃত এই ন্যাশানাল সঙ্গীত দূর প্রবাসী তাঁর কোনো বন্ধুর সঙ্গীতের সঙ্গে মিলে গিয়ে দেশ ও বাঙালী-সংস্কৃতির সীমানা ছাড়িয়ে অতি সহজে অতি অনায়াসে প্রবেশদ্বারে টোকা মারতে সক্ষম হয়ে উঠছে সেই সমস্ত মানুষের, যাদের অন্তর পূর্ণ হয়ে আছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চাপা আগুনে, শুধু ফুঁড়ে বেরোনোর অপেক্ষা।   

এই বাংলার নরম মাটিতে বসে নজরুল গ্রীক সৈন্যদের সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে ফেরা তুরস্কের কাণ্ডারী মহাবাহু কামাল পাশা কে উদ্দেশ্য করে লিখছেন:

 "পরের মুলুক লুঠ করে খায় ডাকাত তারা ডাকাত!

 তাই    তাদের তরে বরাদ্দ ভাই আঘাত শুধু আঘাত!সয়া

কি বলো ভাই, শ্যাঙাৎ? 

হুর্‌রো হো ! 

হুর্‌রো হো !!

দনুজ দলে দলতে দাদা এম্‌নি দামাল কামাল চাই !

কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই !

হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই !" 

আবার সেই তুরস্কেরই কবি নাজিম হিকমত, শুধুমাত্র বিদ্রোহের কবিতা বিপ্লবের কবিতা লেখার অপরাধে যার ৬১ বছরের জীবনের ১৭ বছরই কেটেছিল কারা অন্তরালে, তিনি কবিতা লিখছেন, নাম - ' পল রবসন ', এবং সেই কবিতা যখন বাংলা ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে, হয়ে উঠছে তা বাঙালীর সময় অতিক্রম করে যাওয়া তীব্র আবেগ । 

        "ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না 

                    নিগ্রো ভাই আমার পল রবসন। 

           আমরা আমাদের গান গাই 

                    ওরা চায় না, ওরা চায় না।"

রসিক বাঙালী মাত্রেই জানেন, বাংলা ভাষায় নাজিম হিকমতের এই কবিতা অনুবাদ করে তাতে সুরারোপ করেছিলেন কমল সরকার এবং বাংলার গণসঙ্গীতের প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও তাঁর দল ' মাস সিঙ্গার্স ' এটিকে গণসঙ্গীত হিসেবে প্রতিটি শহরে, গ্রামে, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দেন। বাংলার মানুষের, কবি নজরুলের রাজ্যের মানুষের হৃদয় উদ্বেলিত হয় পল রবসনে। আজও, এই চরম নিষ্পেষিত-সময়ে, চরম ভেদাভেদের সময়ে দাঁড়িয়েও বাংলার সর্বহারা শ্রমিক কৃষক এই কথা স্পষ্টভাবে জানানোর হিম্মত দ্যাখায় যে নিগ্রো পল রবসন তাদের ভাই।   

উল্টোদিকে আবার সময়ের আরও এক কালখণ্ড পেরিয়ে পল রবসনের মাতৃভূমি আমেরিকার বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক উইনস্টন ল্যাংলি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর এত বছর পরেও ভীড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামে খাস সাদা চামড়া সোনালী চুলের আমেরিকান সাহেবদের কাছে কবি নজরুলকে পরিচয় করাচ্ছেন এই বলে - 

"The voice of his poetry embraced in the struggle for human wholeness is the ' direction of civilization." কী ভাবে সভ্যতার দিকনির্ণয়কারী কাব্যস্বর? ভাঙা ভাঙা বাংলায় সুদূর সাগরপারের অডিটোরিয়ামে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ল্যাংলি উচ্চারণ করছেন "বলো বীর , চির উন্নত মম শির”। অতঃপর তাদের বোধগম্য ভাষায় এই লাইনটি অনুবাদ করে বলা মাত্র হাততালিতে ফেটে পড়ছে গোটা অডিটোরিয়াম।

আর এইখানে, ঠিক এইখানে এই পটভূমিকায় দাঁড়িয়েই বোধহয় কোনো কবির কলম নিঃসৃত শব্দশিল্পের আবেগ দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে হাজার হাজার বছরের সভ্যতার গতিপথে শত অত্যাচার শত রক্তপাতের মধ্যেও মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতাকে, স্পর্ধাকে। .... একশো পঁচিশ বছর? ... এই সামান্য সময় কোনো মাপকাঠি এমন দুই মানবতাবাদী কবি-গীতিকার-শিল্পীর প্রতিভা বয়ে চলায় ? 

নিজে জন্মগতভাবে আমেরিকান, রয়েছেন ব্রিটেনে, একজন গান গেয়েছেন ব্যথিত হয়ে -

 " When Israel was in Egypt’s land 

            Let my people go ! 

Oppressed so hard they could not stand,

Let my people go!

             Go down, Moses , 

              Way down in Egypt’s land , 

              Tell old pharaoh 

To let my people go!

            "Thus spoke the Lord," bold Moses said

             “Let my people go ! "  

আর একজন নিজে মুসলিম, গান লিখছেন " হে গোবিন্দ রাখো চরণে "। গিরিরাজ হিমালয়-বুকে অরূপ আলোর প্রথম উদয়দৃশ্যে সমস্ত হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ নোংরা নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে কে জানে কোন্ অদৃশ্য শক্তির সামনে মাথা নত করে চির বিদ্রোহী সেই কবি লিখছেন :  

         "সম্বর সম্বর মহিমা তব , হে ব্রজেশ ভৈরব , আমি ব্রজবালা। 

          হে শিব সুন্দর, বাঘছাল পরিহর , ধর নটবর-বেশ , পর নীপ-মালা।”

মাত্র একশো পঁচিশ বছর? ... মানুষের চাপা আর্তনাদ কবিতা বা সঙ্গীত হয়ে উঠলে সময়স্রোতে বয়ে চলার ক্ষেত্রে একশো পঁচিশ কোনো সময়?

২০২৩ এ পল রবসনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে অদ্ভুত এক ট্যুরের আয়োজন করেছিল West Philadelphia cultural alliance, একদিনের জন্য বাসে রবসনের জন্মভিটে দর্শন। মানুষের প্রবল উৎসাহে শেষ অবধি প্রচুর সংখ্যক বাসের আয়োজন করতে হয় উদ্যোক্তাদের। সারাদিন সেই বাসে প্রাণের আবেগে পল রবসনের গান গাইতে গাইতে মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তাঁর জন্মস্থানে গিয়ে। 

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে আগামী ১৯ শে মে ২০২৪ রবিবার সেখানকার Town Square Community Centre এ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বর্ণাঢ্য নজরুল-একশো পঁচিশ জন্মবার্ষিকী পালন। ... ইউরোপের ফিনল্যাণ্ডে , ফ্রান্সে এবং আরও অন্যান্য দেশে প্রবল উদ্যমে চলছে এ' বছরের ২৪ শে মে বিদ্রোহী কবির একশো পঁচিশ তম জন্মজয়ন্তী পালনের প্রস্তুতি। নিকটবর্তী প্রতিবেশী বাংলাদেশে তো জাতীয় কবিকে ঘিরে জাতীয় উৎসব ! এ' দেশে এই রাজ্য ছাড়াও ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকায় এই বছর নজরুল-জন্মজয়ন্তী উদযাপনের বড়সড় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে । 

 

*             *             *             * 

 

কী জানি কেন, বারবারই মনে হয়, কাজী নজরুলের জন্মের পর একশো পঁচিশ বছর পার হয়ে গেল, জাতপাত, উঁচু-নীচু ভেদ, ধর্মান্ধতা এবং সর্বোপরি আর্থিক শোষণ এ'সব এই মনুষ্যসৃষ্ট সমাজে এখনও কেন এত জীবন্ত, এত বাস্তব, এখনও বহু মানুষের কাছে কেন জীবনের অন্যতম উপলব্ধি স্বরূপ? ... পল রবসনের মতো মানুষের জন্মের পর একশো পঁচিশ বছর পার হয়ে গেল, কেন এই সুপার কম্পিউটার, রোবট, কৃত্রিম মেধার মতো তথাকথিত উন্নয়নের যুগে দাঁড়িয়েও পৃথিবী জুড়ে মানুষের অধিকারকে এইভাবে ধূলায় লুন্ঠিত হতে হয়? কেন বর্ণবিদ্বেষ? কেন কালো চামড়ার মানুষ দেখলেই এখনও হাওয়ায় ভেসে আসে ক্রীতদাস-ক্রীতদাস গন্ধ? ... গোটা বিশ্বে এ' কোন অস্থির সময় যেখানে একটি ভূখণ্ডকে আধুনিক অস্ত্রে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরেও রক্তলোলুপ আক্রমণকারীদের অসহায় নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হত্যা করে নরমেধ যজ্ঞের উৎসব চালিয়ে যেতে হয়?  

বিদ্রোহী কবি ও বাংলার নিগ্রো-ভাই রবসনের কবিতা, গান, গানের কথা এই নিষ্ঠুরতম সময়ে মানুষকে যেন বাঁচতে শেখায়, হৃদয়ের গোপনতম কোণে জমে থাকা ব্যথার অব্যক্ততাকে ভাষা দেয়, সুর দেয়। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে শেখে মানুষ - কত দিন? আর কতো দিন ? উত্তর পায় সে একাকী নির্জনে বসে আপনমনে কবিতাপড়ায় : 

"যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, 

অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম র-ণভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রণক্লান্ত 

আমি সেইদিন হব শান্ত।”

একমাত্র সেইদিন, সেইদিনই শান্ত হবে মানুষের নজরুল ও রবসন সম্পর্কে আবেগ। তাঁর আগে তাদের প্রতিটি জন্মে এভাবে আপ্লুত হয়ে কলম ধরবেই কোনো না কোনো ভবিষ্যতের আলোচক। একই কথা ফের, এই দুই মহান বিপ্লবী শিল্পীর জন্য একশো পঁচিশ কোনো বিস্ময় জাগানো সময়ই নয়, রাস্তার ধারে অবহেলায় পড়ে থাকা ছোট্ট এক মাইলস্টোন মাত্র । 

 

2 Comments
  • avatar
    Asit Chakraborty

    29 August, 2024

    অসাধারণ একটি লেখনী আপনার কলমে যা সমৃদ্ধ করলো । কাজী নজরুলের ১২৫ তম জন্মদিনে পথের দাবী গণ সাংস্কৃতিক সংস্থার সাহিত্য পত্রিকা ঈশান এর উদ্যোগে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হবে আগামী লিটল ম্যাগাজিন ও বইমেলায় ( ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ) আমরা লেখা চাই । অনুমতি দিলে এই লেখা আমরা সানন্দে গ্রহণ করবো । শ্রদ্ধা সহ - অসিত চক্রবর্তী

  • avatar
    Sajjal Dutta

    01 December, 2024

    এই চোখে পড়ল আপনার কমেন্টটি অসিতবাবু । আমার ফোন নম্বর 7686986076 । ফোনে একবার কথা বললে ভালো হয় ।

Leave a reply