অসূয়া

লিখেছেন:রবীন বসু

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল মৌসুমী। বাড়ির কাছে আসতেই গানের রেশ ভেসে এল কানে। এত তাড়াতাড়ি তো গানের স্যারের আসার কথা না। তাহলে!

    

বাড়িতে ঢুকে দেখে, বসার ঘরে ছোট বোন মৌমিতাকে গান তোলাচ্ছেন সুদর্শন স্যার। সাধারণত স্যার এ সময় আসেন না, অন্য টিউশন থাকে। কিন্তু আজ এত তাড়াতাড়ি কেন? তাছাড়া সেও তো শিখবে! কলেজ ছুটির পর বিকেলে স্যারের আসার কথা। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপারে মৌসুমির খটকা লাগল। স্যার যেন একটু বেশিই ক্লোজ হয়েছে মৌ-য়ের! ওরা গানে ডুবে ছিল। কেউ-ই তাকে খেয়াল করেনি। নাক-উঁচু মৌসুমী এতদিন কোনও পাত্তাই দেয়নি সুদর্শনকে। সাদামাটা চেহারার সামান্য এক প্রতিবেশী যুবক। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বিএড করেছে। এসএসসি দিয়ে পাশ করে ইন্টারভিউয়ের পর প্যানেলে নামও উঠেছিল। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে আজও চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে আসেনি। বাবা রিটায়ার করার পর সংসারের অবস্থাও এখন সঙ্গিন। বড় ছেলে হিসেবে সুদর্শন তাই চাকরির অপেক্ষায় আর বসে থাকতে পারেনি। এক সময় সখ করে গান শিখত। পাড়ার বাণীচক্রে নিয়মিত যাওয়া আসাও ছিল। সেখানে পণ্ডিত রমেশ আচার্যের নজরে পড়ে। তারপর তাঁর তত্ত্বাবধানে শাস্ত্রীয় সংগীত ও রবীন্দ্র সংগীত শেখা। সেই সংগীতকে পাথেয় করে এখন সে অভাবী সংসারে তার বাবাকে সাহায্য করছে। সকাল বিকেল বেশ কয়েকটা গানের টিউশন করে সুদর্শন। সেই হিসেবে তাদের বাড়ি আসা। ছোটবোন মৌয়ের গলায় ভাল সুর আছে। গান শেখায় তার আগ্রহও বেশ। কিন্তু মৌসুমীর ততটা আগ্রহ নেই। পড়াশোনায় তার মন বেশি। সে চায় ভাল রেজাল্ট করে ভাল কোনও চাকরি করবে। তাদের মা পুরোনো ধ্যান-ধারণার লোক। মাই বললেন, মৌ-কে শেখাতে স্যার যখন আসছে বাড়িতে, তুই-ও নাহয় শেখ। বিয়ের বাজারে কাজে লাগবে। মৌসুমী আপত্তি করেনি। সেই থেকে দুই বোনের সুদর্শন স্যারের কাছে গান শেখা শুরু।

এখন সে ছোটবোনের প্রতি জেলাস হল। অসূয়াপূর্ণ গলায় বলে উঠল, “সেকি স্যার, আজ যে আপনি এত তাড়াতাড়ি?”

হারমোনিয়ামের রিড থেকে আঙুল সরিয়ে গান বন্ধ করে সুদর্শন মুখ তুলে দেখে সামনে মৌসুমী। মৌমিতাও দিদিকে দেখে।

“হ্যাঁ, আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছি। আগামীকাল মৌমিতার স্কুলে শিক্ষক দিবস। ওকে একক এবং সমবেত ভাবে অনেকগুলো গান গাইতে হবে। তাই আজ একটু বেশি সময় নিয়ে গানগুলো তুলে দিতে এসেছি।”

“কিন্তু আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, কয়েক সপ্তাহ আগে আমার কলেজে সোশ্যাল ছিল, আপনাকে রবিবার আসতে বলেছিলাম, কই তখন আসেননি তো!” মৌসুমীর গলায় বিদ্রূপের ঝাঁঝ। 

“সেদিন আমার চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। তোমাকে বলেছিলাম সে কথা। তাই আসতে পারিনি।”

কী এক দুর্বোধ না-বোঝানো যন্ত্রণায় মৌসুমি তখন অস্থির। হিসহিসে গলায় বলে, “বোনের প্রতি আপনার ফিলিংসটা বোধহয় একটু অন্য রকম, তাই না স্যার!”

“শাট আপ, মৌসুমি। ভেবেচিন্তে কথা বল। আমি তোমাদের স্যার!” অপমানিত সুদর্শন ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।

শান্ত আর নম্র স্বভাবের মৌমিতা দিদির এই ব্যবহারে হতবাক। লজ্জিত। সে কঠিন গলায় বলল, “কী বলছিস দিদি! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ছিঃ!” 

“ছিঃ তুই কি বলবি! আমি বলছি, ছিঃ!” মৌসুমী একবার কড়াভাবে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে চলে চায়।

মৌমিতার চোখ ততক্ষণ জলে ভরে গেছে। সে মুখ নিচু করে নম্র স্বরে বলে, “সরি স্যার। আমি দিদির হয়ে ক্ষমা চাইছি।”

“ওকে। ঠিক আছে। কাল তোমার প্রোগ্রাম, না হলে আমি এখনই চলে যেতাম। এসো, বসো।” 

 

সেদিনের পর অনেক দিন সুদর্শন আর গান শেখাতে আসেনি। কারণ জানতে চাইতে মৌমিতা মাকে সেদিনের ঘটনা সব খুলে বলে। বলে দিদির অসভ্যতার কথা। তখনই মৌসুমীকে ডেকে মা বলেন, “তুমি যখন স্যারকে অন্যায় ভাবে অপমান করেছো, তখন তুমিই ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে আনবে। তুমি গান না শেখো ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমার জন্য মৌ কেন সাফার করবে!”  

মৌসুমীও পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবেছে, সেদিনের ব্যবহার ঠিক হয়নি। কেন সে অত উত্তেজিত হতে গেল! মৌ তো ছোট, ওকে নিয়ে তার এসব ভাবা উচিত হয়নি। তবে কি সে নিজেই ভিতরে ভিতরে এক অসূয়াতে ভুগছিল! যতই সাধারণ আর ছাপোষা ভাবুক সে সুদর্শনকে, মনের কোনও কোণে কি তার কোন ছাপ পড়েছে! সরল আত্মমগ্ন মুখ আর উদাস দৃষ্টি কি তাকে বিদ্ধ করেছে! তাই কি বোনের সঙ্গে মগ্ন ভাবে গান গাইতে দেখে সে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিল! তার মধ্যে জেগে উঠেছিল এক হিংসুটে মনের মৌসুমী!

উলটো দিকে সুদর্শনও ভাবে, না যাওয়াটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছে। আসলে মৌসুমী খুব জেদি আর তেমনই অহংকারী। তার মুখের উপর কেউ না বলুক সেটা সে একেবারেই টলারেট করতে পারে না। হয়তো রূপসী, আর পড়াশোনায় ভালো বলে তার এই অহঙ্কার। সেবার কলেজ সোশ্যালে গান গাইতে চান্স পেয়ে সে নিজেকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিল। চেয়েছিল সবাই তার প্রশংসা করুক। ছোটবোন মৌমিতাকে বোঝাতে চেয়েছিল, সব দিক দিয়ে সে-ই সেরা। তাই আগের দিন রবিবার স্যারকে সে আসতে বলেছিল ভাল করে রিহার্সাল করে নেবে বলে। স্যার না করায় তার মাথায় রাগ চড়ে গিয়েছিল। হয়তো সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সেদিন। এই রবিবার থেকে আবার সে গান শেখাতে যাবে সিদ্ধান্ত নিল।

 

কী কারণে আজ কলেজ ছুটি ছিল। তবু মৌসুমী বিকেলে বের হল। উদ্দেশ্য সুদর্শনের সঙ্গে দেখা করা। সে জানে শনিবার স্যার গাঙ্গুলিবাগানে গান শেখাতে যায়। পাড়ার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল মৌসুমী। সুদর্শন এ পথেই বাইক নিয়ে যাবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। দেখে সামনেই সুদর্শন আসছে। মোড় ঘুরতে যাবে, মৌসুমী গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। সুদর্শন বেশ অবাক হয়ে সাইড করে বাইক থামাযল।

মৌসুমী গম্ভীর গলায় বলে, “আপনার সঙ্গে কথা ছিল।” 

সুদর্শন জানতে চায়, “কী কথা?”

চলুন না, “পার্কে গিয়ে বসে বলি।” 

“সময় লাগবে কি! আমি তো টিউশুনে যাচ্ছি।”

“তা একটু সময় লাগবে। একদিন না হয় একটু দেরিতেই গেলেন।”

মৌসুমীর চোখে কিছু কী ছিল! সুদর্শন আর না করতে পারেনি। তাছাড়া তার উপর রাগের গভীরতাও অনেক কমে গেছে। কৌতূহল বাড়ে। সে বলে, “একটু দাঁড়ান, আমি ফোন করে টিউশন বাড়িতে বলে দিই, দেরিতে যাব।”

 

ওরা পার্কে গিয়ে ঢোকে। মরা বিকেলের রোদ তখন গাছের মাথায়। অনেক পাখি ডাকছে। সুদর্শন বাইক স্ট্যান্ড করে। দু’জনে তারা পাশের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে। সুদর্শনের লাল বাইকটার দিকে অনিমেষে চেয়ে থেকে এক সময় মৌসুমী বলে, “আমার খুব ইচ্ছে, আপনার বাইকের পিছনে বসে একদিন সারা কলকাতা ঘুরি। বিখ্যাত সব স্ট্রীট ফুড খাই।”  

“ভাল তো!” সুদর্শন ঠেস দিয়ে বলে, “কিন্তু আমার বাইকে আপনি উঠবেন! ইগোতে লাগবে না!” 

মৌসুমী লজ্জা পায়। “যদি নাই উঠি, তাহলে বললাম কেন!” অনুযোগ তার গলার সুরে।   

ব্যাপারটা সহজ করার জন্য সুদর্শন বলে, “বেশ তো, নিয়ে যাব। তবে মাসের প্রথমে। তখন হাতে টাকা থাকবে।”

দু’ জনেই শব্দ করে হেসে ওঠে। এবার সুদর্শন বলে, “কী কথা বলবেন বলছিলেন!”

“ওঃ হ্যাঁ!” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মৌসুমী বলে, “ আসলে আমি সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি। আমার উচিত হয়নি ওরকম ব্যবহার করা। আসলে…” 

“আসলে কী?”

“আসল হল আমি কখন যে আপনাকে…” 

“আমি জানি তো! তাই যাতে আপনার হিংসে হয়, ইচ্ছে করেই মৌমিতার ক্লোজ হয়ে গান গাইছিলাম, দেখছিলাম আপনি রেগে যান কিনা! যদি রেগে যান, তাহলে বুঝব আপনি আমাকে ভালবাসেন। তখন এই ভ্যালেনটাইন ডে-তে লাল গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করব, ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনি যা রাগী…” 

“সেকি! আপনি এত দুষ্টু! থাকেন তো ভিজে বেড়াল হয়ে!” 

“কী করব বলুন! বাঘের ঘরে গান শেখাতে যাই যে!” 

 

সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ছোটবোন মৌ-কে জড়িয়ে ধরে মৌসুমী বলে, “জানিস বোন, আজ একটা কাণ্ড হয়েছে! তোর সুদর্শন স্যার না খুব ভাল! খুব! আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে!” 

মৌমিতা বুঝতে পারে না দিদির আজ হলটা কী! চির শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব! রসায়নটা বোঝার জন্য সে দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল! সেখানে তখন খুশির অথৈ সাগর! ওই চোখের অসূয়া যে কখন প্রেমে পরিণত হল মৌমিতা তা বুঝতেও পারল না।

 

1 Comments
  • avatar
    রবীন বসু

    30 January, 2025

    আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রবীন বসু

Leave a reply