একটি বুড়ো মানুষ, ব্রিজের ধারে - আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে

লিখেছেন:সুজাতা পান্থী সরকার

একজন বৃদ্ধ মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এসে বসল রাস্তার ধারে। তার চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা, পরনের জামাকাপড় জীর্ণ, ধুলোয় ভরা।

সামনেই নদীর ওপর একটা ব্রিজ ... যার ওপর দিয়ে নদীর এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে খচ্চর-টানা অসংখ্য গাড়ি, ট্রাক, পুরুষ, নারী, শিশু...

 

ব্রিজটা পেরিয়ে খাড়া তট বেয়ে টলমল করতে করতে ওপরে উঠছে গাড়িগুলো। তারপর আস্তে আস্তে রওনা দিচ্ছে সামনের রাস্তাটা ধরে… ব্রিজ পার হতে গিয়ে কোনো গাড়ি সমস্যায় পড়লে সৈন্যরা হাত লাগিয়ে ঠেলে তুলতে সাহায্য করছে। এর পাশাপাশি গ্ৰামের গরীব চাষ করে খেটে খাওয়া মানুষেরা গোড়ালি পর্যন্ত ধুলো মাড়িয়ে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে ...

কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি একইভাবে অনেকক্ষণ বসে আছে রাস্তার পাশে। মানুষটি এতই ক্লান্ত, এক পা নড়বার ক্ষমতা নেই তার।

 

আমার দায়িত্ব সবাইকে ব্রিজ পার হতে সাহায্য করা এবং শত্রুরা কোন দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে এসব নজরদারি করা। 

সেসব করে ব্রিজ পেরিয়ে সবেমাত্র এপারে এলাম। এখন আর বেশি গাড়ি নেই। মানুষজনের চলাচলও কমে এসেছে। কিন্তু বৃদ্ধ মানুষটি এখনো ঠায় বসে আছে তেমনি। নড়াচড়ার নামগন্ধ নেই।

 

- 'কোথা থেকে আসছেন?' জানতে চাইলাম।

- 'সান কার্লোস থেকে।'একটু হেসে জবাব দেয় বৃদ্ধটি।

 

ওই শহরেই তার জন্ম। নিজের জন্মভূমির নাম বলতে সবারই ভালো লাগে। সেই ভালোলাগার কারণেই তার আনন্দ। আর সেই জন্যেই তার মুখে এক চিলতে হাসি...

- 'সেখানে আমি পশুপাখির দেখাশুনা করতাম।' সে বুঝিয়ে বলল।

- 'ও আচ্ছা।' নিরাসক্ত গলায় আমি জবাব দিলাম। বললাম ঠিকই। যদিও সঠিক বুঝতে পারলাম না, মানুষটি কি বলতে চাইলো।

- 'হ্যাঁ।' সে বলে চলল, 'আমি পশুপাখিগুলোকে দেখভাল করার জন্যেই থেকে গিয়েছিলাম। যদিও আগেই অন্য সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আমি সর্বশেষ। আমিই সবার শেষে সান কার্লোস ছেড়ে এলাম।'

 

লোকটিকে দেখে কিন্তু রাখাল বা পশু খামারের লোক বলে মনে হয় না। তার কালো, ধুলো মাখা জামা কাপড়, ফ্যাকাসে মুখ আর ষ্টিল ফ্রেমের চশমা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ধরনের পশু পাখি ছিল?' 

- ‘হরেক রকমের।' মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো বৃদ্ধ মানুষটি। - 'এখন ওদের ফেলে চলে যেতে হচ্ছে।'

কথা বলতে বলতেই বারবার তাকাচ্ছি ব্রিজের দিকে। আর এবরো নদীর ডেল্টাকে আক্রমণ সাজিয়ে শত্রুদের আনাগোনা আছে কিনা তাই নজরে রাখছি। সন্দেহজনক যে কোনো শব্দেই চমকে উঠছি বারবার।

টহল দিতে দিতে ওদিকটায় বেশ কিছু সময় কেটে গেল। এদিকে ফিরে এসে দেখি, বৃদ্ধ লোকটি তখনও বসে আছে ব্রিজের পাশেই।

 

- 'কি কি পশুপাখি ছিল ?' আবার গিয়ে বসে পড়লাম বৃদ্ধটির পাশে।

- 'সবশুদ্ধ তিনটে জন্তু।' সে ব্যাখ্যা করে। 'দুটো ছাগল, একটা বেড়াল আর চার জোড়া পায়রাও ছিল।'

- 'সেগুলো ফেলেই তো এখন চলে যেতে হচ্ছে?' জিজ্ঞাসা করলাম। 

- 'গোলন্দাজরা আসছে তো। এজন্যই ক্যাপ্টেন বলল, গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে সবাইকে ।'

- 'বাড়িতে আর কেউ নেই?' জিজ্ঞাসা করলাম। কথা বলছি ঠিকই...কিন্তু আমার চোখ রয়েছে ব্রিজের ওপারে যেখানে ঢালু জমি বেয়ে তাড়াহুড়ো করে নামছে শেষ কটা গাড়ি।

 

- 'না'... সে বললো। 

- 'শুধু যে পশুপাখিগুলোর কথা বললাম, সেগুলোই ছিল আমার। বেড়ালটা নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারবে - জানি। কিন্তু অন্যগুলোর যে কী হবে বুঝতে পারছি না।'

 

- 'কোন্ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন?'

- 'আমার কোনো রাজনীতি নেই।' জবাব দেয় বৃদ্ধ মানুষটি। 'আমার বয়স এখন ছিয়াত্তর। এই বয়সে একটানা বারো কিলোমিটার হেঁটে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আর কোথাও যাওয়ার শক্তি নেই আমার।'

- 'এই জায়গাটা ভালো না।' আমি বললাম। 'যদি সম্ভব হয় আর একটু হেঁটে এগিয়ে যান। এই রাস্তায় ট্রাক পাবেন।  তোরতোসা যাবার রাস্তা যেখানে বেঁকেছে সেই মোড়ে।'

- 'একটু বসি। তারপর উঠে যাব।' সে বলল। 'ট্রাকগুলো কোথায় যাবে?'

- 'বারসেলোনার দিকে।' তাকে বললাম। 

- 'ওখানে আমার চেনাজানা কেউ নেই। তবু ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।'

 

মানুষটা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আমার দিকে। ক্লান্ত... খুব ক্লান্ত সে। তবু নিজের উৎকণ্ঠা ভাগাভাগি করে নিতেই যেন আবার বলল,- 'বেড়ালটা নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারবে - জানি। তাকে নিয়ে কোন ভাবনা নেই। কিন্তু অন্যগুলো তো আছে। অন্যগুলোর কি হবে বলে মনে হয়?'

- 'তারাও নিজেদের মত টিকে থাকবে। দেখবেন...'

- 'তাই মনে হয় আপনার?'

- 'না হবার তো কিছু নেই'। আমার দৃষ্টি ওপারের তীরের দিকে। দূরের অস্পষ্ট পথটাতে আর কোনো গাড়ি চোখে পড়ছে না।

- 'কিন্তু গোলাগুলি কামানের মধ্যিখানে ওরা করবেটা কি... আমাকেই যখন কামানের কথা বলে চলে যেতে বলেছে... সেখানে।'

- 'পায়রার খাঁচার দরজা খুলে রেখে এসেছিলেন তো?'

- 'হ্যাঁ'।

- 'তাহলে ওরা উড়ে যাবে।'

- 'ওরা না হয় উড়ে যাবে। কিন্তু অন্যগুলো! ওদের কথা এখন না ভাবাই বোধহয় আমার জন্য ভালো। তাই না? কি জানি , কি আছে ওদের কপালে...', সে বলে।

 

- 'বিশ্রাম শেষ হলে এবারে যাওয়াই ভালো। উঠে পড়ুন।' আমি তাগাদা দিই। 'হাঁটার চেষ্টা করুন। দেরি হলে পরে কোনো গাড়ি নাও পেতে পারেন।'

- 'ধন্যবাদ'। বলে বৃদ্ধ মানুষটি খালি পায়ে উঠে দাঁড়ালো। এপাশ-ওপাশ দুললো। কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই আবার ধপ করে ধুলোর মধ্যে মাটিতে বসে পড়ল ক্লান্ত ভঙ্গিতে। 

 

- 'আমি তো শুধু পশুপাখি গুলোর দেখাশোনা করছিলাম।' 

আমার দিকে না তাকিয়েই আপন মনে অবুঝের মতো বিড়বিড় করে বলে চলে সে... 'আমি তো শুধু পশুপাখিগুলোর দেখাশোনা করছিলাম। এতে দোষের কি ছিল?' 

কথাগুলো সে আমাকে বলছিল না।

 

এতে তার দোষের কিছু ছিল না। বৃদ্ধটিকে নিয়ে আমি যে কোথাও যাব, আমার সেই সুযোগ নেই। 

আজ ইস্টার সানডে। শত্রুপক্ষ গোপনে এগিয়ে আসছে এবরো নদীর দিকে।

 

ধূসর বিবর্ণ দিন। মেঘলা আকাশ। মেঘগুলো নিচু হয়ে ঝুলছে। তাই তাদের প্লেনগুলো ওড়েনি।

এইটুকু সৌভাগ্যই বৃদ্ধটির কপালে জুটবে। সেই সঙ্গে এই সত্যিটা... যে বারো কিলোমিটার পেছনে বেড়ালরা নিজেই নিজের খেয়াল রাখছে। 

 

বৃদ্ধ লোকটির জীবনে এই একমাত্র সান্ত্বনা…

********** 

 

লেখক পরিচিতি - 

বিংশ শতকের প্রভাবশালী মার্কিন লেখকদের মধ্যে অন্যতম আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে। তাঁর জন্ম - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওক পার্ক, ইলিনয়ে, ২১জুলাই, ১৮৯৯ সালে। প্রথম উপন্যাস দ্য সান অলসো রাইজেস্‌ প্রকাশিত হয় ১৯২৬ এ। এছাড়াও তার প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল, আ ফেয়ারওয়েল ট্যু আর্মস (১৯২৯), ট্যু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট (১৯৩৭), ফর হুম দ্য বেল টোলস (১৯৪০), দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি (১৯৫২), ইত্যাদি। এর মধ্যে, দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি উপন্যাসের জন্য হেমিংওয়ে ১৯৫৩ সালে পুলিৎজার এবং ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই উপন্যাসটি এক অশক্ত বৃদ্ধ জেলে সান্তিয়াগো, তার অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম এবং সেই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে এক বিশালকায় মার্লিন মাছ শিকারের গল্প বলে।

হেমিংওয়ের রোমাঞ্চপ্রিয় বর্ণময় জীবনযাত্রা ও ভাবমূর্তি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয়। তার খ্যাতি মূলত সাহিত্যিক রূপে হলেও, তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, মুষ্টি যোদ্ধা, নাবিক, শিকারি এবং আরো অনেক কিছু। হেমিংওয়ে এর প্রতিটি গল্প বা উপন্যাস প্রায় তার নিজের জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ১৯৬১ সালের ২রা জুলাই হেমিংওয়ের মৃত্যু হয়। হেমিংওয়ের পরিবারে দীর্ঘ মানসিক অবসাদ ও স্বাস্থ্য জনিত সমস্যার ইতিহাস ছিল। জীবৎকালে হেমিংওয়ে নিজেও এই অবসাদের শিকার হন। ১৯৬১ সালের ওই ঘটনাবহুল দিনে, হেমিংওয়ে নিজ মুখগহ্বরের ভিতর বন্দুক চালনার মাধ্যমে আত্মহত্যা করেন।

 


 

0 Comments
Leave a reply