অবলম্বন

লিখেছেন:ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য

 

ঠাকুর দালান থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরে মলয়। বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে। তাহলে কি বাবার কিছু হয়েই গেলো!

— হ্যালো।

— মিস্টার সুধাময় রায়ের বাড়ির লোক বলছেন?

— হ্যাঁ, আমি সুধাময় রায়ের ছেলে বলছি।

— জাস্টিন মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল থেকে বলছি।

— কিছু হয়েছে বাবার? 

গলা শুকিয়ে আসে মলয়ের।

কী শুনতে হবে এইবার কে জানে। গতকাল থেকে একদম ভালো নেই সুধাময়। পোস্ট অপারেটিভ রেসপিরেটরি প্রবলেম। সঙ্গে প্রেসার ফ্লাকচুয়েশন বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে আরও শতগুণ। 

মেজর সার্জারি হয়েছে সুধাময়ের মাথায় কয়দিন আগেই। সাব ডুরাল হেমাটোমা। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল মাস তিন চার আগে। প্রেসারের গণ্ডগোল হয়েছিল। বেসামাল হয়ে পড়ে যায় উঠোনে। চিকিৎসা হয়েছিল তখন। তারপর প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ধীরে ধীরে সুস্থও হয়ে উঠেছিল সুধাময়। হাঁটা চলা বলা স্বাভাবিক ছিল সবই। দিন দশেক আগে হঠাৎ করেই শরীরের ডান দিকের সচলতা কমে আসে। হাঁটতে না পারা, কথা জড়িয়ে যাওয়া চোখে পড়ে সবার। ভীষণ দুর্বল যেন। সেই অবস্থায় বিছানা নেয় সুধাময়। তারপর আর চোখ খোলেনি। সিটি স্ক্যান করে জানা যায় মাথার বেশ অনেকটা অংশে পুরানো রক্ত জমে রয়েছে, সেটা থেকেই...

এর আগে বাবাকে নিয়ে এত বড় বিপদের সামনে পড়েনি মলয়। চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছে। প্রতিমা বলে, অত ভাবিস না খোকা, যার ভাবনা তিনিই ভাববেন। বাড়িতে জাগ্রত মা রয়েছেন, কিসের চিন্তা? মা-কালীকে ডাক। তিনিই আমাদের সহায়, অবলম্বন। প্রতিমার কথা শুনে বিরক্ত হয়েছিল মলয়। মানুষটা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আর...

দিন চারেক আগে অপারেশন হয়েছে সুধাময়ের মাথায়। ঘন্টা খানেক উদ্বেগ বুকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে ছিল মলয় সেইদিন। অপারেশন শেষে মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাবাকে দেখার সুযোগ পেয়েছিল। ব্লাড, স্যালাইন, অক্সিজেন মাস্ক, মাল্টিপ্যারা মনিটর এইসব দিয়ে ঘেরা রয়েছে বাবা। সব কিছু দেখে শীতল স্রোত নেমে আসে শিরদাঁড়া দিয়ে। মানুষটা কী বাঁচবে আর!

এতো বড়ো সার্জারি। স্টেবল হতে সময় নেবে পেশেন্ট। বলেছিলেন ডাক্তারবাবু। তারপর থেকে কয়েকদিন হয়ে গেলো, অবস্থার উন্নতি তো হয়ই নি বরং শেষ দু দিন ধরে রক্তচাপ ভয়ংকর অনিয়মিত ভাবে ওঠা নামা করছে সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট ... 

কি হবে ডাক্তারবাবু? উদ্বিগ্ন হয়ে গতকাল জিজ্ঞাসা করেছিল মলয়। আজকের দিনটা দেখে তারপর বিকল্প ভাবনার কথা ভাবা যাবে। কিছুটা গম্ভীর গলায় বলেছিলেন ডাক্তারবাবু।

গতকাল হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়েছে মলয়ের। ভয়ানক দুশ্চিন্তা। কী যে হবে। ঘুম হয়নি রাতে। সুধাময়ের মুখটা মনে পড়েছে বারবার। 

আজ সাতসকালে হাসপাতালের আই সি ইউ-তে ফোন করেছিল মলয়। সুধাময় রায় কেমন আছেন? জ্ঞান ফিরেছে? জিজ্ঞাসা করেছিলো অ্যাটেনডিং স্টাফকে। ডাক্তারবাবু না এলে পেশেন্টের অবস্থা বলতে পারবে না কেউ। কোন এক সিস্টার বলেছিল। তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে ছটফট করেছে বাবার কথা ভেবে। এক নাছোড় দুর্ভাবনা তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে মলয়কে। সুধাময় এখন ষাট, ভয়টা সেখানেই, বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও অবচেতনে ভাবনাটা উঁকি দেয় মাঝে মধ্যেই। 

ষাট বছর বয়সটা যেনো অভিশাপ রায় পরিবারের কাছে। এই বংশের পুরুষেরা কেউ ষাট বছর পার করেনি। কোনো না কোনো কারণে গত হয়েছে। বছর দুয়েক আগেই মলয়ের জেঠু বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিল হসপিটালে। আর বাড়ি ফেরেনি। জেঠুর বয়সও তখন ষাট বছর।

প্রতিমা একদিন বলেছিল, এইসব দেবতার রোষ। মা কালীকে অবহেলা করবার ফল। তাই তো বলি মা মঙ্গলময় তাঁকে ডাকো, নিজেকে সমর্পণ করো তাঁর কাছে। প্রতিমার মুখে এই কথা শুনে ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করেছিল সুধাময়। মা এইসব বলে সংসারে অশান্তি ডেকে এনো না, জেঠিমা শুনলে কী ভাববে! বলেছিল মলয়। 

গতকাল মনমরা হয়ে বাড়ি ফেরে মলয়। প্রতিমা সব শুনে বলে বিশ্বাস রাখ মা-কালীর চরণে। তোর দাদু জেঠুর সঙ্গে তোর বাবার অনেক তফাত। তোর বাবা ধার্মিক মানুষ। ভক্তি আছে মায়ের চরণে। তবে কী জানিস মায়ের অভিশাপ বড়ো ভয়ংকর, পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো মন থেকে মা কে ডাকিস খোকা। আবার সেই দাদু আর জেঠুর কথা! আশ্চর্য ! গৃহদেবীর কথা বলতে শুরু করলে মুখে আর্গল দিতে জানে না প্রতিমা। জেঠুর মৃত্যুর পর এই অভ্যাস যেনো লাগামহীন হয়ে উঠেছে। যখন তখন যেখানে সেখানে সামান্য সুযোগ পেলেই মা-কালীর মাহাত্ম্য বর্ণন শুরু হয়। পই পই করে বারণ করেছে মলয়। কে শোনে কার কথা।

মলয়ের এইসবে বিশ্বাস নেই। দাদু, জেঠু হার্টের পেশেন্ট ছিল। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণেই হয়তো চলে গেছে অকালে। প্রতিমা বলে অন্য কথা। এই সবই গৃহদেবীর রোষ।

এই ভাবনায় মলয় আর প্রতিমা দুই পৃথক মেরুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রতিমা বলে বাড়িতে জাগ্রত গৃহদেবী প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তোদের পূর্ব পুরুষ। কারণ তো কিছু আছে নিশ্চয়। তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা থাকাটা জরুরি। মায়ের নিত্যসেবা মন থেকে করা উচিত খোকা। আমি এই বাড়িতে এসে থেকে দেখছি মায়ের সেবায় অনীহা। তোর দাদু জেঠু মা-কালীর নাম শুনলেই বিরক্ত হত। হয়তো পুজো আর্চা করত ঠিকই তবে সবটাই যেন নিয়মটাকে মনে করে, অন্তর থেকে গৃহদেবীকে ভুলেই থেকেছে। সেটা আমি মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখে বুঝেছি। শুধু তাই বা কেনো, সংসারে সামান্য কিছু অনিষ্ট হলে সেই দায় গৃহদেবীর উপর চাপিয়েছে চিরকাল। তখন মুখের কথায় বাঁধন থাকেনি। যা মন চেয়েছে শুনিয়েছে মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে। কী অন্যায় কথা! এই সবের সাজা তাই পেতেই হয়েছে। এই যে মানুষগুলো ষাটের ঘরে পা রেখে চিরবিদায় নিয়েছে সে কী এমনি এমনি। তাদের জন্য কষ্ট আমারও হয়েছে আজও হয়, তবে জানবি মায়ের অভিশাপ। সেখানে কারো হাত নেই। এইসব কথা মানতেই পারে না মলয়। ঈশ্বরের সেবায় ত্রুটি হলে মানুষকে মরতে হবে! তাই হয়! মৃত্যু সে তো অনিবার।

সাতসকালে হসপিটালে যাবার তীব্র ইচ্ছে হয় মলয়ের। এদিকে আজ বাড়িতে বিপত্তারিণী পুজো। গ্রামের মহিলারা ভিড় করে দাঁড়াবে ঠাকুর দালানের সামনে। এই বছর বাবা নেই, সব দিক সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মলয়। পুজোর কথা শুনলেই বিরক্ত হয়েছে। লাভ কী এই সব পুজো করে বুঝিনা। উপোস বার- ব্রত পালন, এসবে কি কিছু হয়? মলয়ের বিশ্বাস নেই সে সবে। কত মানুষই তো আছে ঠাকুর দেবতার ধার ধারে না। এইবার পুজো বন্ধ থাক মা। বাবার ওই অবস্থা। দিন দুয়েক আগে প্রতিমাকে বলেছিল মলয়। ছেলের কথায় জ্বলে উঠেছিল প্রতিমা। অমন ভাবনা কল্পনাতেও আনবি না খোকা, একি মতিভ্রম তোর! সংসারের যা কিছু আয় পয় সবই মায়ের কৃপায়। অল্প বয়সে তুই ভালো চাকরি করছিস সেও জানবি মায়ের আশীর্বাদ। পুজো করতেই হবে। কত লোকে মানত করে বসে আছে। আমি নিজেও তোর বাবার জন্য মানসিক করেছি। বুক চিরে রক্ত দেব। মায়ের সামনে ধুনো পোড়াবো। দেখিস ঠিক ফিরে আসবে তোর বাবা। মাথাটা শুধু ঠান্ডা রাখ। মা-কালীকে...

মলয় বলে মা বিপদ এলে কোন ঠাকুর দেবতা পাশে দাঁড়ায় না। সামলাতে হয় আমাদের। যার হয় সে বোঝে। মানুষটা হাসপাতালে...

তুই হসপিটালে গেলেই কি সুস্থ হবে তোর বাবা! শোন মা-কালীর উপর কেউ নেই। তাঁর ইচ্ছেতেই জগৎ চলে। তাছাড়া ওই মানুষটা সারা জীবন মায়ের সেবা করেছে, ওর কিছু হতেই পারে না, আমার বিশ্বাস...

প্রতিমাকে বোঝাবে কে! মাঝে মধ্যে মাকে দেখে অবাক হয় মলয়। প্রতিমার বেঁচে থাকবার দর্শন বড়ো অদ্ভুত পথে হেঁটেছে। রোগ ভোগ ঘাত প্রতিঘাত বিপর্যয় বিপন্নতা সমস্ত কিছুকে জগজ্জননীর ইচ্ছে বলেই মনে করে ইদানিং। সেখানে মানুষের কোনো হাত নেই। এ উপলব্ধি দিনে দিনে তার মনের গভীরে প্রবেশ করেছে। জীবনের প্রবাহমানতার রাশ গৃহদেবীর হাতে সমর্পণ করেই পরম শান্তি পায় প্রতিমা। ভালো মন্দ কোনো কিছুর জন্যই অভিযোগ নেই তার। দেবতার রোষ ভয়ংকর। তাঁকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত প্রতিমা। তাতে কে কী মনে করলো সে কথা ভাবতে বয়েই গেছে।  

সকাল বেলায় ঠাকুর ঘরে ঢুকেছে মলয়। পুজোর নৈবেদ্য আর উপাচার সাজিয়ে দিয়ে তারপর যাবে হসপিটালে। আগেই ফোন আসে হসপিটাল থেকে।

সুধাময়ের খবর জানতে চেয়ে গলা কাঁপে মলয়ের। বাবার মলিন নিস্তেজ মুখটা ভেসে আসে দুচোখের সামনে।

— হ্যালো, বলছি পেশেন্ট এখন কেমন আছে? মলয়ের মনের তীব্র কাতরতা কয়েকটি শব্দের গা জড়িয়ে বাইরে আসে।

— ওই ভাবে তো বলতে পারি না আমরা। ডাক্তারবাবু বলেছেন সুধাময়বাবুর আবার একটা ওটি করতে হবে। আপনি হসপিটালে আসুন। লাইন কেটে দেয়। 

ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকে মলয়। আবার অপারেশন! কী এমন হলো?

ডাক্তারবাবুর পার্সোনাল নম্বরে ফোন করে মলয়। ফোন বেজেই চলে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ডাক্তারবাবুকে ধরতে ব্যর্থ হয়।

— কে ফোন করেছিল খোকা? 

প্রতিমাকে সব কথা বলে মলয়। 

পুজোর জোগাড় তো হয়েই গেছে। তুই তাহলে হসপিটাল চলে যা। আমি একবার সুবোধকে ফোন করি, সকাল সকাল পুজোয় বসে পড়ুক। আর শোন তোর বাবার গায়ে মাথায় মায়ের এই চেলিটা বুলিয়ে দিবি, তোর বাবা ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। বলে একটা ছোট লাল চেলি মলয়ের হাতে দেয় প্রতিমা। 

ওহ মা। এসবে...

তুই থাম। 

প্রতিমার কথায় কান দেয় না মলয়। হসপিটাল রওনা দেয়। 

হসপিটালে এসে কনসেন্ট পেপারে সই করে মলয়। সুধাময়ের অপারেশন হবে আবার। এই ধাক্কা সামলাতে পারবে বাবা! চিন্তা হয় মলয়ের।

দেখুন ওনার হার্টের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেটা মাথায় রাখতেই হয়। আর দ্বিতীয় বার এই অপারেশন যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ সন্দেহ নেই। তবে অন্য কোনো উপায়ও নেই আমাদের হাতে। ভিতরের জমে থাকা রক্ত বের করতেই হবে, নয়তো ইনফেকশনের হাই চান্স থাকে। ডাক্তার বাবুর কথা শুনে এক অজানা ভয় আঁকড়ে ধরে মলয়কে।

ওটির সামনে বসে মলয়। মনে তোলপাড় চলে। অবান্তর ভাবনার হাত থেকে রেহাই পেতে মোবাইল ফোন হাতে নেয়। সাব ডুরাল হেমাটোমা সার্চ দেয় গুগুলে। এই কয়দিনে হাজার বার এই অপারেশনের ঝুঁকি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছে মলয়। কখনো ভয় কখনো বা আশার আলো সঞ্চার হয়েছে মনে।

সুধাময়ের মুখটা মনে পড়ে। অপারেশনের আগে বাবাকে দেখেছে, দুর থেকে। নিস্তেজ। জীবিত না মৃত বোঝার উপায় নেই। কেমন এক মন খারাপ করা ভাবনা ভিড় করে মনে। মুমূর্ষ মানুষ দেখলে মৃত্যুর কথাই ভাবনায় আসে প্রথম। বাঁচবার সমস্ত আশাকে ধুয়ে মুছে দিয়ে লেলিহান মৃত্যু ভাবনা ফণা তোলে মনে। মানব মনের এ এক অবোধ্য গতি। 

দু চোখ বন্ধ করে মলয়। রুখে দাঁড়ায় ঋণাত্বক ভাবনার বিরুদ্ধে। এই সময় দুর্বল হলে চলে না। ফোনটা রাখতে হাত দেয় পকেটে। চেলির কথা মনে পড়ে। বাবার গায়ে মাথায় বুলিয়ে দিতে হবে অপারেশনের পর।  

সময় দেখে মলয়। দুপুর আড়াইটা বাজে। বাড়ির কথা ভাবনায় আসে। ঠাকুর দালানের সামনে ব্রতীদের ভিড়। ধুপ ধুনোর গন্ধ। ঢাকের শব্দ। উলু ধ্বনি। সুবোধ কাকু মন্ত্র পড়ছে। গ্রামের বেশ কিছু পুরুষ মহিলা সব দণ্ডি কেটে ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে একপাশে। পুষ্পাঞ্জলি দেবে এইবার। নতুন বস্ত্র গায়ে দিয়ে প্রতিমা বসেছে বিপত্তারিণী মায়ের সামনে। বেল কাঁটা নিজের বুকে ফুটিয়ে কেউ রক্ত বের করছে। সুধাময়ের জীবন ফিরে পেতে গৃহদেবীর চরণে রক্ত - মা মানত করেছে। এই সবের কি আদৌ কোনো অর্থ আছে? মাঝে মাঝেই ভাবে মলয়। সদর্থক কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। মাকে বললেই বলবে কিসে কী হয় তোর না জানলেও চলবে খোকা। বিশ্বাস করতে শেখ। তাঁর চরণে বিশ্বাস, তাঁকে অবলম্বন করে বাঁচা। গৃহদেবীর পুজোর ব্যাপারে বড্ড একরোখা প্রতিমা। এই নিয়ে জেঠুর সঙ্গে প্রতিমার বেঁধে গিয়েছিল একবার, জেঠুর মৃত্যুর আগের বছরে। পর পর বেশ কয় বছর মলয়ের জেঠুর ব্যবসায় মন্দা। তেমন আয় নেই। এদিকে বছরে তিন তিনটে বড়ো পুজো হয় গৃহদেবীর। খরচ যথেষ্ট। ফলমূল, নানা উপকরণ, কয়েক শ মানুষকে ভোগ খাওয়ানোর আয়োজন… জেঠু বলে নিয়ম মেনে পুজো করলেই চলবে এইবার। ঘটা করে লোকজন ডেকে ভোগ খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। সে কথা শুনে শিউরে উঠে ছিল প্রতিমা। বলেন কি দাদা! মায়ের পুজোর বেলায় যত অভাব! যার আশীর্বাদে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা তাঁকে অপমান করা চলে না। প্রতিমার কথা শুনে মলয়ের বাবা আর জেঠু দুজনেই অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তবে প্রতিমা নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়েনি। সমস্ত নিয়ম মেনে পুজো করতে বাধ্য হয়েছিল মলয়ের বাবা, জেঠুর সত্যিই সামর্থে কুলায়নি সেবার। মলয়ের বাবা-ই সমস্ত খরচ করেছিল। পরের বছর চলে গেছে জেঠু। প্রতিমার কথায় দেবতার অভিশাপ। মানতে কষ্ট হয় মলয়ের। মা যে কেন এমন বলে!

এরই মাঝে প্রতিমার ফোন আসে। খবর নেয় সুধাময়ের। বাড়িতে পুজো মিটেছে ভালোভাবে। বুক চিরে রক্ত দিয়েছে প্রতিমা। ধুনো জ্বালিয়েছে। তার নিটোল বিশ্বাসের কথা আবারও শুনিয়েছে মলয়কে। 

 

সময় দেখে মলয়। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে আসে এইবার। প্রায় চার ঘণ্টা পার হয়ে গেল। চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে আসে মলয়ের। হঠাৎ চোখ যায় সামনে। দেখে ওটি থেকে একটা ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসে দুজন স্টাফ। উঠে দাঁড়ায় মলয়। সামনে এগিয়ে যায় মন্থর পায়ে। সাদা চাদরে ঢাকা রয়েছে কেউ। মানে মৃত! হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে মলয়ের। তাহলে সুধাময়... পেশেন্টের নাম জিজ্ঞাসা করে মলয়। নাম জানে না ওরা। ট্রলি ঠেলে নিয়ে চলে যায় করিডোর ধরে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মলয়। চেয়ে আছে ওই ট্রলির দিকে। শরীরে জোর নেই যেন। কেঁপে ওঠে দু পা। এইবার পড়েই যাবে বুঝি। আচমকা কে যেন হাত রাখে কাঁধে। চমকে ওঠে মলয়। ফিরে দেখে ডাক্তারবাবু। বলে অপারেশন হয়েছে। তেমন ভালো কিছু বলতে পারছি না। রেসপিরেটরি প্রবলেম ভীষন। ঈশ্বরকে ডাকুন। পারলে আজ হাসপাতালের কাছাকাছি স্টে করুন আপনি, কখন কী প্রয়োজন পড়ে। চলে যায় ডাক্তারবাবু। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় মলয়ের। মাথাটা দপদপ করছে। এরপর? বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে। করিডোরের চেয়ারে বসে। দুর্ভাবনায় উথাল পাতাল মন। বুজে আসে চোখের পাতা। ডাক্তারবাবুর মুখেও সেই ঈশ্বরের কথা! প্রতিমার কথা মনে আসে। তবে কি মানুষের জীবন মৃত্যু সবই ঈশ্বরের ইচ্ছেয়! পাপ, পুণ্য, দেবতার রোষ, কর্মফল শব্দ গুলো ভিড় করে মনে। ভোঁতা হয়ে আসে মলয়ের নিজের চিন্তা শক্তি। মৃত্যু সে তো জীবের অনিবার্য পরিণতি। ঈশ্বর মানা না মানায় কী যায় আসে! আসলে ঈশ্বর বুঝি মানব মনের একটা অন্য রকম বোধ, অন্য রকম ভাবনা। যার যেমন ভাবনার গভীরতা তার তেমন ঈশ্বর-দর্শন। ডাক্তারবাবু আর প্রতিমার ঈশ্বর কি একই রকম! কে জানে।

একরাশ উদ্বেগ নিয়ে সে রাতটা হাসপাতালের চেয়ারেই কেটেছিল মলয়ের। পরদিন সকাল বেলায় সুধাময়কে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে। তারপর আত্মীয় পরিজনদের খবর দেওয়া, দাহ পর্ব সব কেমন করে যেন মিটে গেল নির্বিঘ্নে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কত কিছু ঘটে গেলো। ষাট বছরে জাগতিক মায়া কাটিয়ে চলে গেছে সুধাময়। বড়ো ভালো মানুষ ছিল বাবা। গৃহদেবীর প্রতি তার ভক্তির কথা সবাই বলে। তাতে লাভ কী হল! সেই তো অকালেই চলে যেতে হল। কষ্টও কিছু কম পায়নি। উঠতে বসতে প্রতিমা শুনিয়েছে মলয়কে তোর বাবা গৃহদেবীর সেবা করেছে মন দিয়ে, সে ঠিক ফিরে আসবে। কোথায় কি!

 

আজ ভোর থাকতেই ঘুম ভেঙেছে মলয়ের। পুব আকাশের লালিমা তখনও ঘন হয়ে ওঠেনি, সূর্যোদয়ের দেরি আছে। নানা কথা ভেবে বিষণ্ণতায় নুইয়ে আসে মন। আজ তিনদিন হলো সুধাময় চলে গেছে। চোখে জল আসে মলয়ের। হঠাৎ মাথায় কার যেনো স্পর্শ অনুভব করে। খোকা, ডাকে প্রতিমা। উঠে দাঁড়ায় মলয়। মায়ের সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। সুধাময়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিমা জড়িয়ে ধরে ছেলেকে। স্বামীর ছবির দিকে চেয়ে কাঁপা গলায় প্রতিমা বলে - তুমি চলে গেলে, আমার একমাত্র অবলম্বন খোকাকে আশীর্বাদ করো ও যেনো সুস্থ থাকে। দীর্ঘায়ু হয়। আর কথা নেই, কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রতিমা। মালয়কে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলে। মলয়কে বুকে নিয়েই বেঁচে থাকতে চায় প্রতিমা বাকি জীবন। ঠাকুর দুয়ারে চল, মায়ের মন শান্ত করতে চেয়ে বলে মলয়। থাক, তোর বাবার ছবির সামনেই বসি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে প্রতিমা। মা-কালীর দুয়ারে যাওয়ার অনিচ্ছা প্রকাশ করে সুধাময়ের ছবির সামনে একটা চেয়ারে বসে। শক্ত মুঠিতে ধরে থাকে মলয়ের হাতটা। বলে তুই আমার পাশে বস খোকা, তুই ছাড়া... মায়ের মুখের কথা ভেসে যায় কান্নার তোড়ে।

অবাক হয়ে প্রতিমাকে দেখে মলয়। সুধাময়ের মৃত্যু দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে প্রতিমাকে। মৃত্যু জীবনের অনিবার্য পরিণতি। সে কালের নিয়মেই আসে। দেব দেবীর রোষ মানুষের কল্পনা মাত্র। এ উপলব্ধি আজ হয়তো হৃদয় ছুঁয়েছে তার। শেষ কয়দিন ঠাকুর দালানের দিকে পা ফেলেনি, ভগবানে জমাট বিশ্বাস শিথিল হয়েছে যেন। স্বামীর অকালে চলে যাওয়া প্রতিমার ভিতরের মানুষটাকেও বদলে দিয়েছে অনেকখানি। নিদারুণ যন্ত্রণায় বিদ্ধ প্রতিমার গলায় গৃহদেবীর প্রতি অভিযোগের সুর স্পষ্ট, আজই প্রথমবার শুনলো মলয়।

0 Comments
Leave a reply