অর্চিষ্মান - পঞ্চম পর্ব

লিখেছেন:অপূর্ব দাশগুপ্ত

অর্চিষ্মান - পঞ্চম পর্ব 

অপূর্ব দাশগুপ্ত

 

ডুয়ার্সে হেমন্ত ঋতু টের পাওয়া যায়। ষড় ঋতুর এই চতুর্থ ঋতুটি এখনও এখানে হারিয়ে যায়নি বরং ভারি স্পষ্ট করে হেমন্ত  আসে এই ভূমিতে।  তার আগমন, বিস্তার আর বিদায় একটু লক্ষ্য  করলেই টের পাওয়া যায়। অগ্রহায়ণে এখানে  শীতের গন্ধ স্পষ্ট হয়। বাতাসে সামান্য হিম ধরে। অর্চিদের বাগানের বকফুল গাছটি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায়, যে দিকে দু চোখ যায়  চা বাগানের সবুজ বিস্তার জুড়ে শান্তি ছড়িয়ে থাকে। সেখানেও ফুটেছে হিমঝুরি আর ছাতিম ফুল। বাঙলার অন্যখানে বর্ষার শেষে যে ধান বোনা হয়েছে, শরতে যা বেড়ে উঠেছে, এবার তা ঘরে উঠবে। চা বাগানে ফসল উঠে গেছে বর্ষায়। ডুয়ার্সের ভয়ানক বর্ষায় ভিজে ভিজে পুরুষ শ্রমিকেরা, শিশু বুকে বেঁধে মেয়ে শ্রমিকেরা যে চা পাতা কারখানায় পৌঁছে দিয়েছে, তা থেকে যে চা তৈরি হয়েছে, বাক্স বন্দি হয়ে তারা দেশে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। চা উৎপাদন ঘিরে এখানে শ্রমিকদের মধ্যে কোন নবান্ন উৎসব নেই। শ্রমিকদের জীবন যেমন চলছিল, তেমনিই চলছে। এরই মধ্যে ডুয়ার্সে মোহময় হেমন্ত এসেছে।  

 

একদিন রবিবার। রবিবার অনেকেই অর্চিদের বাড়িতে তার বাবা-কাকাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতে আসেন। বাইরের বারান্দায় পাতা বেতের টেবিল ঘিরে রাখা আছে বেতেরই বোনা গোটা পাঁচেক চেয়ার, সেখানে বসে কথাবার্তা হয়, মা ঠাকুমারা অতিথিদের জন্যে চা জলখাবারের ব্যবস্থা করেন। আজ সুনীলের সঙ্গে যিনি দেখা করতে এসেছেন, তিনি চা বাগানের কোন বাবু নন, তিনি নতুন মানুষ, তিনি এসেছেন জলপাইগুড়ি থেকে, সেখানে তিনি কলেজে পড়ান। চা বাগানের মদেশিয়া শ্রমিকদের নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন। বিন্নাগুড়িতে চা বাগানের মালিকদের সংগঠন DBITA অফিসে তিনি গিয়েছিলেন খোঁজখবর করতে, সেখানে একজন সুনীলের পরিচিত কর্মচারি সুনীলের কাছে তাঁকে পাঠিয়েছেন। একটা চিঠিও লিখে দিয়েছেন, সুনীল যেন তাকে সাহায্য করে। সুনীলের আজকের অতিথির সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যে অর্চি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটু দূর থেকে বাবার সঙ্গে এই নতুন অতিথির কথা শোনে। বাবা বলেন, 

- আপনাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি বলুন তো?

অর্চি দেখে রোগা চেহারার এই নবাগত মানুষটি প্যান্ট-শার্ট পরে আছেন, কাঁধের বড়সড় কাপড়ের ঝোলা ব্যাগটি তিনি টেবিলের ওপরে রেখেছেন। পায়ের চামড়ার চটি ছেড়েছেন বারান্দার সিঁড়িতে। রোগা ফর্সা লোকটির চেহারায় একধরনের আকর্ষণ আছে। তিনি কথা বলেন ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে।

- চা বাগান সম্পর্কে যে সমস্ত লিটারেচার আছে, তা আমার দেখা হয়ে গেছে মোটামুটি, কলকাতায় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। এই এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে নানা ভাবে জড়িত, ম্যানেজমেন্ট, বাবু ও লেবারদের সঙ্গেও কিছুকিছু কথা হয়েছে, আমি এখন লেবার লাইনগুলি স্বচক্ষে দেখে নিতে চাই। আমি সে কারণেই এলাম।

 

সুনীল কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপরে বললেন, আপনি এসেছেন, খুব খুশি হয়েছি আমি। আপনি দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম করুন, আমি বিকেলে একজন লোক দিয়ে দেবো, সে আপনাকে মদেশিয়া লাইনে নিয়ে যাবে। আমি নিজে সেখানে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব না। আমি থাকলে আপনার কাজেরও ক্ষতি হবে। 

খানিক্ষণ কথাবার্তা বলার পর সুনীলকে একবার বের হতে হল। গতকাল সন্ধ্যার পর তিনি আরো কিছুক্ষণ অফিসের কাজ করেছিলেন। ফিরে এসে মনে করতে পারছিলেন না পেছনের জানালাটা তিনি বন্ধ করে এসেছিলেন কিনা। তাই এই ছুটির দিনেও তাকে একবার অফিস যেতে হল। যাবার আগে সুনীল বলে গেলেন, আপনি যে ক’দিন কাজ করবেন আমার এখানেই থাকবেন কিন্তু।

ইতিমধ্যে ভদ্রলোকের জন্যে লুচি বেগুন ভাজা নিয়ে অর্চির ঠাকুমা বারান্দায় এলেন। তাকে দেখে ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বললেন, আমি আকাশ, আকাশ বসু। চারুবালা ঘোমটাটি মাথায় তুলে বললেন, আপনি বসেন, খাবার খান, আমি চা আনথেছি।

খাবার খেতে খেতে আকাশের অর্চির দিকে দৃষ্টি পড়ে। অর্চিকে ডেকে তিনি তার সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। অর্চি ফুটবলে কোন পজিশনে খেলে, কী তার প্রিয় সাবজেক্ট, এইসব আরো নানা প্রশ্ন।

- কবিতা পড়?

- পড়ি তো।

- কার কবিতা পড়?

- বাড়িতে সঞ্চয়িতা আছে, বনলতা সেন আছে, পদাতিক আছে, শীতের প্রার্থনা বসন্তের উত্তর আছে। আরো অনেক কবিতার বই আছে। সুকান্ত সমগ্র।

- এসব পড়ে কে?

- এসব আমার ছোট কাকার বই।

- তোমার কোন কবিতার বই সবচেয়ে ভালো লাগে?

- রূপসী বাংলা আর পদাতিক।

শুনে আকাশ অবাক হয়। আকাশ থেকে পড়ে তিনি বলেন -   

- বলো কী জীবনানন্দ আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুজনকে একসাথে ভালোবাসো? আজব ছেলে তুমি। তোমার কোন কবিতা মুখস্ত আছে? বলতে বলতে তিনি টেবিলে রাখা ব্যাগ থেকে একটা চৌকোমত যন্ত্র বের করেন, একটা চাবি টিপে বলেন, শুরু করো। 

অর্চি দেখে চৌকো বাক্সটির উপরে দুটো চাকা ঘুরতে শুরু করে। চাকা দুটিকে বেষ্টন করে বাদামি রঙের ফিতেও ঘুরতে থাকে। অর্চি যন্ত্রটিকে দেখছিলো, আকাশ তাড়া দিয়ে বললেন, আরে শুরু করো। 

অর্চি ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুরু করে, 

- এসেছে শরৎ হিমের পরশ। 

আমলকি বন বলতে বলতে তার মনে হয়, এটা ঠিক হচ্ছে না, বড্ড ছোটদের কবিতা। সে কবিতা থামিয়ে বলে, 

- আমি অন্য কবিতা বলবো।

আকাশ বলেন, 

- তাই বল, শুরু করো।

অর্চি তখন আবৃত্তি করে,

- হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।

কবিতা শেষ হলে আকাশ চাবি টিপে যন্ত্রটি বন্ধ করে। পরে আবার চালু করলে, যন্ত্রটি এসেছে শরত থেকে আমি অন্য কবিতা বলবো হয়ে হাজার বছর হয়ে থামে। অর্চি জিজ্ঞাসা করে, 

- টেপ রেকর্ডার?

 অর্চি টেপ রেকর্ডারের কথা জানে, তবে চা বাগানে তখনো কারো বাড়িতে এ যন্ত্র আসেনি। 

বিকেলে যখন শূলেমন নামে এক মদেশিয়া শ্রমিককে দিয়ে সুনীল আকাশকে কুলি লাইনে পাঠাবার উদ্যোগ করছেন, আকাশ হঠাৎ প্রস্তাব দিলেন, 

- অর্চিষ্মানকে নিয়ে যাই সুনীল দা? সুনীল বলেন, 

- ও গিয়ে করবে কী? অর্চি জানে বাবুদের ছেলে মেয়েদের যেতে নেই কুলি লাইনে। ওরা অসভ্য, হাঁড়িয়াখোর, গালাগালির ওস্তাদ, মিশতে নেই ওদের সাথে। 

নিজেও সে সেখানে যাবার আগ্রহ বোধ করেনি কোনদিন। আজ কিন্তু তার খুব যেতে ইচ্ছে হল। আসলে সে আকাশের সঙ্গ চাইছিলো। সুনীলের খুবই আপত্তি ছিল কিন্তু শেষে আকাশের জোড়াজুড়িতে তিনি রাজি হলেন।

বিকেল বেলা। রোদ হালকা হয়ে আসছে। চা গাছগুলির ওপর ছায়া গাছগুলির ছায়া ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে। শূলেমন আকাশ আর অর্চিকে নিয়ে রওনা দিল বিচ লাইনের দিকে। চা বাগানে মদেশিয়া শ্রমিকদের পাশাপাশি নেপালি শ্রমিকেরাও কাজ করে। নেপালি শ্রমিকদের আলাদা লাইন, মানে বাসস্থান। আকাশের উৎসাহ মদেশিয়া শ্রমিকদের উপর, তাই শুলেমন তাকে মদেশিয় লাইনেই নিয়ে চলে, এই লাইনে সে নিজেও থাকে। চা বাগানের ভেতরের রাস্তাগুলো সাদা নুড়ি পাথর বিছানো। সাইকেল, এমনকি পায়ের চাপেও চড়চড় শব্দ হয়। বামদিকে ফ্যাক্টরি, আর একটু এগোলেই, দুদিকে চা বাগান শুরু।

ডানদিকে চা বাগানের মধ্যে অনেকটা জায়গা নিয়ে সম্পূর্ণ কাঠ ও চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি একটি বাংলো। টিনের চাল এবং কাচের জানালা। সামনে সবুজ বাগিচা। ফুল ও ফলের গাছে ঘেরা। বাংলোর পেছনে সবজির বাগান। শূলেমন এখন গাইডের ভূমিকায়, সে তাই আকাশকে চিনিয়ে দিয়ে বলে, বড়া সাহেবকার বাংলো। অর্চি ও আকাশ তাকিয়ে দেখে সেই সবুজ গালিচায় দুটি ফুলের মত বাচ্চা একজন নেপালি আয়ার নজরদারিতে খেলছে। একটা বাঘা কুকুরও রয়েছে সাথে। সাহেবের জিপ গাড়িটি বাংলোর তলে রাখা। আরেকটি অ্যাম্বাসডারও দেখা যাচ্ছে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে রেল লাইনের ধারে এসে পৌঁছায়। আসাম থেকে এই লাইন চলে যাচ্ছে  শিলিগুড়ির দিকে। রেল লাইনের ওপারে অন্য চা বাগান। শূলেমন তাদের নিয়ে ডান দিকের মাটির রাস্তা ধরলো। একটু এগিয়েই শুরু হল কুলি লাইন। কুলি লাইনে প্রবেশ করে কিছুটা এগুতেই অর্চির নাকে এসে লাগলো একটা পচে ওঠা গন্ধ। কুলি লাইনের ঘরগুলি প্রায় সবই কাঁচা ঘর, কাঠ অথবা বাঁশের কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ। মাথায় খড়ের আচ্ছাদন। দু একটি বাড়ি দেখা গেল চুন-সুরকির পাকা বাড়ি। অকাশ বললেন, 

- শূলেমন, এবাড়িগুলিতে কারা থাকে? 

শূলেমন জানালো, 

- সর্দারমন রহেলা। 

শূলেমন তাদের নিয়ে এলো সীতারামের বাড়ির উঠানে। তারপর সে হাকডাক করে সকলকে ডেকে আনতে লাগল, 

- বাবুরা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে।

তার ডাকে অনেক মদেশিয়া পুরুষেরা এসে জড়ো হল। সীতারাম একটা কাঠের চেয়ার নিয়ে এসে আকাশকে বসতে দিল। এই সীতারামকে অর্চি চেনে। সে সুনীলের স্টোর ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। নানা কাজে সে তাদের বাড়িতে প্রায়ই আসে। সীতারামের মেয়ে মৈয়া বেশ কয়েক বছর তাদের বাড়িতে কাজ করেছে। সে অর্চিদের বাড়ির সকলের খুব আপন হয়ে উঠেছিল। সীতারাম অর্চির সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিল, মাল-বাবুকার লেড়কা। সীতারাম একটা চা প্যাকিং এর ভেনেস্তার বাক্স দেখিয়ে অর্চিকে সেখানে বসতে বলল, খোকা বাবু এখানে বসো। 

আকাশ তার কাজ শুরু করল, ব্যাগ থেকে বের করল টেপ রেকর্ডার, তোমাদের বাড়িগুলিতে পায়খানা, স্নানের ঘর কোথায়? আকাশের কথায় সকলে হেসে ওঠে, এতো চা বাগান চারপাশে পায়খানার কী দরকার? আর প্রতিটি লাইনে ট্যাঙ্ক আছে। প্রতিদিন সেখানে জল ভরে দেওয়া হয় কোম্পানি থেকে। বাড়ির মেয়েরা সেখান থেকে বাসন টাসন মেজে নিয়ে আসে, খাবার জল ভরে আনে। অর্চি  দেখল সীতারামের বাড়ির ঘর উঠোন বেশ পরিষ্কার, এমনকি দাওয়ায় রাখা কাঁসার বাসন-পত্রগুলিও বেশ ঝকঝকে। আকাশের কিছুটা সাদ্রি ভাষা জানা ছিল, হিন্দি, সাদ্রি ও বাংলা মিশিয়ে সে বেশ কাজ চালিয়ে নেয়। অর্চি দেখে, অল্প সময়ের মধ্যে সে বেশ সকলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে এবং মদেশিয়া মানুষেরা তাকে বেশ পছন্দ করছে। 

- তোমরা সকলে তো কংগ্রেস পার্টিকে ভোট দাও?

 সীতারাম উত্তরে বলে,

- হামনি আগে কংগ্রেসমে রহি এখন বহুতঝন লাল পার্টিমে চইল গেলয়।   

- লাল পার্টি মানে তো আর.এস.পি?

- হা বাবু। আর.এস.পি। ননীয়াবাবুর পার্টি।

অর্চি খুব ছোটবেলায় দেখেছে, তদের চা বাগানে কংগ্রেস পার্টির খুব রমরমা ছিল। লেবারদের মধ্যে তেমন কেউ ছিল না যে কিছুটা লিখতে পড়তে জানে, সাহেবদের সঙ্গে কথা কইতে জানে। তাই আলিপুরদুয়ার বা হ্যামিল্টনগঞ্জ থেকে বাঙালি বাবুরা এসে পার্টি চালাতেন। অর্চি তার ছোট কাকার কাছে শুনেছিল যে, সারা বাংলা যখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল তখনো চা বাগানের শ্রমিক বা বাবুরা কেউ কোন আন্দোলনে যোগ দেয়নি। আসলে বৃটিশ আমলে চা বাগানের কুলিদের চা বাগানের বাইরে যাবার অনুমতি ছিল না। বাইরের কারো পক্ষেও চা বাগানে প্রবেশ করা ছিল দুষ্কর। চা বাগান পত্তনের পর, স্থানীয় মানুষেরা চা বাগানে কুলির কাজ করতে কেউ আগ্রহী হয়নি, সাহেবদের তাই কুলির অন্বেষণে তাকাতে হয়েছিল বিহার - ছোট নাগপুরের উপজাতিদের  দিকে। ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগণা থেকে যে সব অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়  ভাষাভাষীর মানুষ ডুয়ার্সের চা বাগানে এলো, তাদের এ অঞ্চলে নাম দেওয়া হল মদেশিয়া। এসব তত্ত্ব আকাশের ভালো করেই জানা, কিন্তু অর্চি অবাক হয় এখানে এসে আকাশ যেন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে। এইটুকু সময়েই সে মদেশিয়া লেবারদের এতটাই আপন করে নিয়েছে যে  তাদের খবরাখবর নিতে নিতে অকাশ বলে, তোরা মদেশিয়ারা বহুত গুরবক, রাগ নেই কেন তোদের? নেপালি লেবারদের ম্যানেজমেন্ট সমঝে চলে কেন জানিস, ওরা তোদের মত চুপ করে থাকে না। এর মধ্যে সীতারামের বউ একটা ঝকঝকে গ্লাসে চা নিয়ে আসে, বলে, বাবু চা পিইলে। আকাশ হেঁকে বলে চা কীরে, তোরা কি হাড়িয়া খাওয়া ছেড়ে দিলি?

এইসব আলোচনা যখন চলছিল, অর্চি দেখতে পায় সীতারামের মেয়ে দুহাতে দুটি জল ভরা বালতি নিয়ে উঠোনে ঢুকে অর্চিকে দেখে অবাক হয়ে হাসলো। মৈয়া বেশ কিছুদিন অর্চিদের বাড়িতে কাজ করেছে, তার সাথে অর্চির বেশ সখ্যতা ছিল। মৈয়াকে দেখে অর্চি উঠে এসে জিজ্ঞেস করে,

- কেমন আছিস মৈয়া?

- আচ্ছা আহি। তোয় ক্যাসান আহিস? বাবু ওউর বুড়া মাইঝি ক্যাসান আহে?

মৈয়া অর্চির সঙ্গে ‘তুই’ সম্বোধনে কথা বলে, তুমির ব্যাপারটা সে বোঝে না। 

- সকলে ভালো আছে।

তারপর একটু থেমে অর্চি বলে,

- তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না কেন?

- ঘরমে বহুত কাম। হেইকরে অর্চি বাবু মাই বাপ কামঅমে জায়েন, ছোটকা ছোটকা ভাই বহেনকে দেখেক পড়েল, খানা বানায়েক পড়েল, বরতন ধোয়েক পড়েল।

এই বলে মৈয়া হাসে।

মৈয়ার কালো মুখের ঝকঝকে হাসিটি বড়ো সুন্দর। অর্চি দেখে মৈয়া শাড়ি পরে আছে, শাড়ি পরার ঢংটি তাদের অনেকটাই বাবু বাড়ির বাঙালি মেয়েদের মত। চুল সে বেঁধেছে খুব টেনে। স্কুলে সে যায়নি কোনদিনও, অথচ তার কথা বার্তা, শরীরী ভাষা একেবারে সংকোচহীন, শিষ্টাচারপূর্ণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৈয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অর্চির চোখ যায় ঘরের ভেতরে। সে দেখতে পায় ঘরের এক কোণে একটা ধনুক আর তার পাশে টিনের চোঙায় রাখা আছে বেশ কয়েকটা তীর। তীরগুলির পেছনে নানা রঙের পালক আঁটা। জিনিসটা অর্চিকে খুব আকর্ষণ করে। সে বলে মৈয়া আমি একটু তোদের ঘরে ঢুকছি, এই বলে সে ঘরের ভেতরে ঢুকতে গেলে সহসা মৈয়া তাকে বাধা দেয়, বলে না বাবু, না। অর্চি আশ্চর্য হয়ে বলে কেন? আমি ধনুকটা একবার দেখবো, এই বলে সে ঘরে ঢুকে যায়। ঘরে ঢুকে সে আশ্চর্য হয়ে দেখে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে কাজলদি। কাজলদির মুখখানা ফ্যাকাশে, সে যেন ভয়ে কেঁপে উঠছে। অর্চি আশ্চর্য হয়ে বলে, কাজলদি তুমি? কাজলদি প্রায় ছুটে এসে অর্চির হাত দুটি চেপে ধরে, অনুনয় করে বলে, আমি যে এখানে এসেছি তুই কাউকে বলে দিস না ভাই, প্লিজ। অর্চি ভেবে কূল পায় না, কাজলদি এখানে কেন? কাজলদির বাবা, তুষারবাবু চা বাগানে কাজ করেন না, তাঁর বড় ব্যবসা। চা বাগানে নানা  প্রয়োজনীয়  জিনিস সাপ্লাই দেওয়া ছাড়াও তাঁর আরো কয়েক ধরনের ব্যবসা রয়েছে। সেই সূত্রে তাঁর চা বাগানের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। বাবুদের চেয়ে অর্থকড়ির দিক থেকে উপরের স্তরে অবস্থান এই তুষার বাবু্র। এমন বাড়ির মেয়ে লেবার লাইনে কী করছে? অর্চির বিস্ময় কাটছে না দেখে কাজলদি বলে, তোকে সব বুঝিয়ে বলবো পরে, এখন তুই কথা দে কাউকে বলবি না। অর্চি বলে, তুমি বলছো যখন আমি কাউকে বলবো না কিন্তু তোমার কোন ভয় নেইতো কাজলদি? 

ভয় একটু আছে অর্চি, তুই আমাকে একটু এগিয়ে দে, আমি সদর দিয়ে যাবো না, ওখানে অনেক মানুষ, চিনে ফেলবে। বাইরে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ইতিমধ্যে ঘনিয়েছে। কাজলের ফিরতে হবে দ্রুত। মৈয়া বলে পেছনে একটা বড় জানলা আছে, ওখান দিয়ে তোরা চলে যা, অর্চি বলে চলো কাজলদি, এই বলে গারদহীন জানলা দিয়ে অর্চি নেমে যায়। তারপর সে হাত বাড়িয়ে বলে নেমে এসো কাজলদি, আমার হাত ধরো। তারা দুজনে নেমে পড়ে। কাজলদিকে কুলি লাইনের বাইরে পৌঁছে দিয়ে অর্চির ফিরতে একটু দেরি হয়।

ফিরে এসে সে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য দেখেতে পায়। সে দেখে, আকাশ এক হাত শূলেমনের গলা বেষ্টন করে অন্য হাতে আরেকজন মদেশিয়া শ্রমিকের পিঠ জড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। মুখে তার মাতালের হাসি ঝুলে আছে।  দুজন পুরুষ মাদল বাজাচ্ছে। দু-একজন মেয়েও নাচে সামিল হয়েছে। 

 

বর্ধমান

সেদিন টাউন হলে যে তিনটি ছেলের সঙ্গে অর্চির আলাপ হয়েছিল, তারা বর্ধমান শহরের বিভিন্ন পাড়ায় থাকে। এদের সঙ্গে অর্চির বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অর্চি এদের সঙ্গে গল্প করতে করতে টের পায় এরা শহরে থাকলেও এদের গ্রামে ঢের ভূ-সম্পপ্তি আছে। ওদের বেশভূষা চমৎকার। হাসি খুশি ফুর্তিবাজ ছেলে সকলে। এদের মধ্যে প্রবীরের চেহারা বেশ নায়কোচিত, ফর্সা লম্বা। অর্চির মত ছেলের দেখা ওরা প্রথম পেল বুঝি, যাদের কোন জমি জমা নেই, নিজস্ব দেশ নেই এদেশে, বাড়ি ঘর নেই। অর্চির মুখের অনেক কথা আর উচ্চারণ শুনে তারা হাসে।

- বাঙাল নাকি বে?

অর্চি হেসে বলে,

- আমি এদেশেই জন্মেছি, দাদু বাবা ঠাকুমা এরা ওপার থেকে এসেছছিল।

- দুখী দুখী মুখ কেনবে তোর শালা? দেশে পেমিকা ফেলে এসেচো? 

অর্চি ওদের বন্ধু বলেই মেনেছে, তাই সে বলে,

- শুধু প্রেমিকা না রে আমি আমার সব কিছুই ফেলে এসেছি।

কৃপা ছেলেটাই সবচেয়ে ডাকাবুকো, সে অর্চির পিঠে একটা চাপড় কষিয়ে বলে,

- ছাড় তো মারা, (কৃপা প্রায়সই ব কে ম বলে) আমিও দেশে একটা পটিয়ে ছিলাম, তাকে ফেলে এখানে এসে প্রথম প্রথম সে কী দুঃখ রে ভাই। এখন সব দুঃখু চুকে বুকে গেছে।

টাউন হলের বাইরে ভগীদার দোকানে ওরা বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। অর্চির চায়ের দোকানে বসে এরকম আড্ডার অভিজ্ঞতাও প্রথম, কিন্তু তার ভালই লাগছে, ওদের সঙ্গে গল্প গুজবে মসগুল হয়ে থাকতে এখন তার ভালো লাগে। কৃপা, যার পুরো নাম কৃপাসিন্ধু, এই লিকপিকে ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে, ওঠ ওঠ এবার প্রবীর, চল, মিউনিসিপাল গার্লস ছুটি হল বলে। চায়ের পয়সা মিটিয়ে প্রবীর, কৃপা আর রঞ্জন হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে। অর্চি কিছু বুঝতে পারে না, কোথায় চললি বলতো হঠাৎ, কথা নেই বার্তা নেই। রঞ্জন বলল, তোর তো আবার সাইকেল নেই, আমারটায় উঠে পড়। অর্চি আবার বলে, কিন্তু যাবো কোথায়? কৃপা এবার রেগে উঠে বলে, এ মালটা বোঝে না কিছুই। শুনলি না মিউনিসিপাল গার্লস ছুটি হচ্ছে?

- তো আমরা কী করতে যাচ্ছি?

- হিড়িক বুঝিস? হিড়ক? হিড়িক মারতে যাচ্ছি।

অর্চির এখন মুখ ফুটেছে, আমাদের স্কুল কো-এড ছিল কিনা, তাই মেয়েদের স্কুলে আমাদের দৌড়ে যেতে হত না।

- বাঙাল হইতে পারস, তয়, কপাল কইর‍্যা আইসিলি তুই অর্চি, রঞ্জন বলে।

জি.টি. রোড দিয়ে তিনটি সাইকেল স্পিড তোলে। রঞ্জনরা স্পিডের মাথায় সাইকেল ভাঁজ খাওয়ায়। জিটি রোড দিয়ে বাস চলছে, বড়ো বড়ো পাঞ্জাব বডির বাঘা ট্রাক চলছে, ওরা তোয়াক্কা করে না, সাইকেল ছোটায় ঝড়ের বেগে। একজন বৃদ্ধ ছাতা মাথায় রাস্তার ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন, কৃপা সাইকেল টাল খাইয়ে বৃদ্ধের ছাতায় টোকা মেরে বলে গেল, সামলে দাদু, রাস্তা থেকে নামো, ফুটপাথ আছে তোমার জন্য। গার্লস স্কুলের সামনে এসে তারা ব্রেক কষে দাঁড়ায়। দেরি হয়নি বড় একটা, স্কুল সবে ছুটি হয়েছে। মেয়েরা বের হচ্ছে একা কিংবা দোকা অথবা গুচ্ছে, গুচ্ছে। অর্চি দেখে এতো বীরত্ব দেখিয়ে আসা ছেলেগুলি অকুস্থলে এসে কেমন ভদ্র হয়ে গেছে। বাড়াবাড়ি তেমন কিছু করছে না। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে শুধু। একটু পরে প্রবীর বলে, ওই অনামিকা আসছে। স্কুলের ইউনির্ফম পরা মেয়েদের অর্চির সব্বাইকে একরকমই লাগছিল, তারই মধ্যে প্রবীরের অনামিকা তাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় প্রবীর মেয়েটিকে ডাকে, অনামিকা? অনামিকা একবার প্রবীরের দিকে চেয়ে অল্প একটু হেসে এগিয়ে যায়। কৃপা বলে, 

- প্রবীর বল না ‘আরতী’ হলে ‘ববি লেগেছে, কাল ম্যাটিনিতে ডাক, বলেছিলি ডাকবি। 

প্রবীর বলে, না থাক। বোঝা যায় অতটা সাহস, বা অতটা এগুতে প্রবীর পারেনি এখনো। রঞ্জন এই সময় বলে ওঠে,

- এই যাঃ আমারটা গেল কোথায়?

কৃপা বলে, তোর আবার কোন টা?

- ওই যে আসছে গেটের কাছে। 

- এটা তোর কী করে হয়, কালতো অন্য একজনকে দেখালি।

রঞ্জন বলে, দেখিয়েছিলাম বুঝি? তবে আজ ভুল করেছি। তার কথায় সকলে হেসে ওঠে।

 অর্চি দেখে রিক্সায় ওঠার আগে অনামিকা একবার পেছন ফিরে চায়। প্রবীর তাকে হাত নাড়ে। 

স্কুলের ভেতরের অংশ আর বাইরের স্থানটুকু একটু পরেই জনশূন্য হয়ে আসে। এমন কী ছোলা-বাদাম-কুল-কারেন্টয়ালারা পর্যন্ত পসরা গুটিয়ে চলে যায়। কিশোরীদের কলরোল থেমে এলে জায়গাটাতে নীরবতা নেমে আসে। কৃপা বলে, 

- অনামিকা তো হল না, কাল আমরাই ‘আরতী’ হলে ‘ববি’দেখে আসি।

সকলে রাজি হয়। প্রবীর অর্চিকে বলে,তুই দেখবি তো অর্চি? 

অর্চি বলে, কাকাকে বলে দেখি। কৃপা শুনে মুখ বেকিয়ে বলে, আর এক কাজ কর, বাবা কে জলপাইগিড়িতে একটা পোস্টকার্ড ছাড়, বাবা আমি ‘ববি’ দেখবো কাল।

রঞ্জন শুধরে দিয়ে বলে, টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাম। অর্চি বলে, আমি যাবো না তো বলিনি। কাকাকে জিজ্ঞেস করে আসবো বলেছি। 

রঞ্জন বলল, ওসব ছাড়ো বস, কিন্তু টিকিট পাবি?

 কৃপা বলল, ওটা আমার উপর ছেড়ে দে তোরা।

পরদিন দুপুরে আরতী সিনেমা হলে পৌঁছে অর্চি দেখে কৃপা-প্রবীর-রঞ্জন আগেই এসে গেছে। টিকিটের জানালা খুলতে দেরি আছে, কিন্তু এখনই সিনেমা হলের সামনে লোকে লোকারণ্য। ইতিমধ্যে বিশাল লাইন পড়ে গেছে। রাজকাপুরের এই ছবি হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। ছবির গানগুলিও হিট, লোকের মুখে মুখে ফিরছে। সর্বোপরি আছেন নবাগতা নায়িকা ডিম্পল, যিনি নাকি এ ছবিতে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। এতো জনসমাগম দেখে অর্চি ঘাবড়ে যায়। কৃপাসিন্ধু তাকে আশ্বস্ত করে, আমার বলা আছে চারটে টিকিট। ওরা তাই হল থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে একটি টেলারিং সপের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, এখানে ছায়া রয়েছে। আরতী সিনেমা মূল রাস্তা থেকে বেড়িয়ে যাওয়া একটা প্রশস্ত গলির মধ্যে। সে গলিও দোকান পাটে বোঝাই, শুধু সিনেমা হলের সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। টিকিট কাউন্টার খুলতেই সেখানে ধুন্ধুমার বেধে গেল। হাতে স্টিলের বালা পরা একটি যুবক তিন চারজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেলের চেন ঘুরিয়ে লাইনের মুখটা ভেঙে দিল। প্রবীর বলল, এরা স্বরূপ পার্টির ছেলে। 

পশ্চিবঙ্গে এ সময়টাতে রাজনৈতিক ডামাডোল চলছিল। নব কংগ্রেসী উগ্র যুবকদের উত্থান ইতিমধ্যে দেখা গেছে, রাজনীতির ছেলেরা তখনো ক্লাবগুলির দখল নেয়নি। ক্লাবগুলি তখনো প্রাইভেট মস্তানদের দখলে। এরকম একজন মস্তান হলেন স্বরূপ। আরতী সিনেমাতে আজকের হামলাবাজরা স্বরূপের ছেলে। রঞ্জন বলল, আজ সিনেমা দেখা হয়ে গেল। কৃপা দমবার ছেলে নয়, সে বলল, আরে দেখনা শেষ পর্যন্ত কি হয়। মন্টুদার ক্লাবে খবর পৌঁছে যাবে এখনই। বলা বাহুল্য মন্টু হল স্বরূপের প্রধান প্রতিদ্বন্দী মস্তান। বর্ধমান শহরকে দুটি ভাগে ভাগ করে রাজ করে প্রধানত এই দুটি দল। একটু পরেই রে রে করে ছুটে আসে আরো জনা ৬/৭ ছেলে, হাতে তাদের রড এবং চেন। এখন সিনেমা হলের সামনে সাধারণ দর্শকেরা আর কেউ নেই, সকলেই দূরে সরে গেছে এবং দূর থেকে কুরুক্ষেত্রের দিকে নজর রেখেছে। ঝারপিট কিছুটা চলার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উর্দিধারীরা এসে পৌঁছে গেলে যুদ্ধ থেমে যায়। খানিকটা রক্তারক্তি হয়েছে বটে, তবে পুলিশ ধরপাকড় চালিয়ে আর ঝামেলা বাড়ায় না। পুলিশের তত্বাবধানে আবার নতুন করে লাইন পরে। দুই পার্টির ছেলেরা প্রথমেই সামনে দাঁড়িয়ে যায়, দুএকজন রক্তাক্ত শরীরে। বলাবাহুল্য এরকম ছোটখাটো ঝামেলায় স্বরূপ বা মন্টুর মত মহীরূহ্রা ঘটনাস্থলে স্বশরীরে আসে না। একটু পরে একটি সিড়িঙ্গে মার্কা ছেলে এসে কৃপার হাতে চারটে টিকিট পৌঁছে টাকা নিয়ে যায়। কৃপা ছেলেটি চলে গেলে জানায়, 

- এই ছেলেটি মন্টু পার্টির, আমাদের বাদামতলায় থাকে।

চলবে

ছবিঋণ - https://www.naturetravelagency.com/blogdetails.php?uri=dooars-tourist-places

0 Comments
Leave a reply