নোনা জলের আর্তি

লিখেছেন:মিলি ঘোষ

 

 

বৈশাখের গরম হিসেব মানেনি। সকাল থেকেই সূর্য তার যাবতীয় আক্রোশ ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর মাটিতে। গ্রামে তবু গাছগাছালি মানুষকে দু'হাত দিয়ে আগলে রাখে। সে হলো প্রকৃতির ভালোবাসা। প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় শহরে। বড় গাছ কেটে গগনচুম্বী অট্টালিকায় সেজেছে শহর। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বাড়ির ছাদে ছাদে বাহারি ফুলের গাছ অথবা এক চিলতে বারান্দায় ঝুলন্ত টবে দোদুল্যমান গুটিকয় ফুল। এতে কি আর তাপ আটকায়? সূর্য এদের দেখে আর হাসে। 

স্কুলে গরমের ছুটি পড়তেই অর্চিশা বাবার পেছনে ঘুরঘুর শুরু করেছে। কিছু একটা বলার ইচ্ছা। সাহস করে ঠিক বলেও উঠতে পারে না। মার সঙ্গেই ওর গল্প বেশি, স্কুলের বন্ধুদের কথা, ম্যামদের কথা। কিন্তু এই একটা ব্যপারে বাবাকে ম্যানেজ করতে না পারলে যে কার্যসিদ্ধি হবে না, সে ক্লাস ফাইভের অর্চিশা ভালোই জানে। 

এক রবিবারে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বলেই ফেলল, "আমার বন্ধুরা তো ছুটি পড়লে বাবা-মা'র সঙ্গে কত জায়গায় বেড়াতে যায়। আমরা কোথাও যাই না কেন, বাবা?"

শোভনের বুকটা ধক করে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইল, "বন্ধুরা খুব বেড়ায় বুঝি?"

"হ্যাঁ, বাবা। মেঘারা সিকিম যাচ্ছে। তন্নিষ্ঠারাও তো পুজোর সময় রাজস্থান যাবে। আনন্দে ওদের ঘুমই আসছে না, জানো।"

শোভন চুপ। অর্চিশা বাবার মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষায়। বাবা কি কিছুই বলবে না?

অর্চিশা বাবার গলা জড়িয়ে বলল, "ও বাবা।"

শোভন গলার স্বর একটু নামিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "আমরাও যাব।"

"যাবে? বাবা? কোথায় যাব আমরা?"

"দেখি, কোথায় যাওয়া যায়। পুজোর ছুটিতে যাব।"

 

অনলাইনে যে রিসর্টটা বুক করেছিল শোভন, সমুদ্র থেকে পাঁচ সাত মিনিটের হাঁটা-পথ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখার সাধ অপূর্ণ রাখতেই হলো। পুরীর সি-বিচের একদম সামনের রিসর্টগুলোর প্রতিদিনের ঘর ভাড়া দেখে ওদিকে আর এগোতে সাহস পায়নি শোভন। একটু পেছনের দিকে হলেও তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সমুদ্রের হাওয়া ভালোই পাওয়া যায়। বেশ একটা চুল এলোমেলো করে দেওয়া মাতাল মাতাল হাওয়া। কোনারক যাবার প্ল্যানটা ওরা আগেই বাতিল করেছে। তিনদিন শুধু পুরীতে কাটানোর ইচ্ছা নিয়েই আসা। 

অর্চিশা মাকে বলল, "ইস্ মা, এখান থেকে যদি সমুদ্রটা দেখা যেত!"

শোভন তাকাল আঁখির দিকে। চোখে অপারগতার ছায়া। আঁখি জানে সি-বিচের সামনে হোটেল নেওয়া ওদের মতো মধ্যবিত্তের আওতার বাইরে। কিন্তু অর্চি এখনও ছোটই। প্রতিদিনের যাপন কচিপাতায় প্রভাব ফেলুক চায়নি আঁখি।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "ওই হোটেলগুলো আগে থেকেই বুকড্, সোনা। এটাও নেহাৎ মন্দ নয়। কী সুন্দর ব্যালকনিটা বল। কত হাওয়া দেখেছিস!" 

জীবনের টানাপোড়েন এমন, সত্যির সঙ্গে কিছুটা মিথ্যে মেশাতেই হলো আঁখিকে। আঁখি জানে, শোভন আর্থিক চাপের জন্য অনেক সময়ই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। বাগুইআটিতে মোটামুটি মাথা গোঁজার মতো একটা ফ্ল্যাট। তার ইএমআই চলছে। মেয়েকে নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে ভালোরকম ডোনেশন দিতে হয়েছে। 

বাড়ি ফিরে হতাশ গলায় বলেছিল শোভন, "স্কুল তো নয়। সব বিজনেস সেন্টার।"

আঁখির এখানেই আপত্তি। 

বলল, "এতগুলো টাকা শুধু ভর্তি করাতে! অন্য কোনও সাধারণ স্কুলে দিতে পারতে।"

"যুগটাই তো ইঁদুর প্রতিযোগিতার, আঁখি। পাল্লা না দিতে পারলে আমার মতোই ঘষটাতে হবে।"

শোভনের কণ্ঠস্বরে যে বেদনা ঝরে পড়েছিল, আঁখি তার সবটুকুই কুড়িয়ে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। বিয়ের পরে সেই কবে হানিমুন গেছিল, তাও আবার মন্দারমণি। লোকে কাশ্মীর যায়, গোয়া যায়। আঁখির অবশ্য এই নিয়ে কোনওদিন কোনও আক্ষেপ ছিল না। তারপর এই পুরীতে আসা।

 

ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার দিকে। শোভন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। মনের মধ্যে হর্ষ-বিষাদের আলোছায়ার ঘূর্ণি। গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে দিন কয়েকের মুক্তি পেতেই তো বেড়াতে আসা। ব্যস্ততার নিরিখে যে অক্ষমতা ঢাকা পড়ে যায়, অবসরে তা'ই প্রকট হয়ে শোভনের সামনে এসে দাঁড়াল। শোভন সিগারেট শেষ করে ঘরে এসে দেখে অর্চিশা ঘুমিয়ে পড়েছে। আঁখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।

শোভনকে দেখে বলল, "শোবে না?"

শোভন মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। বুকের কষ্ট বুকেই চেপে বলল, "আমার পক্ষে কোনোদিনই অর্চির এই ইচ্ছা মেটানো সম্ভব নয়।"

"ছোটোবেলায় তো আমরাও কত কী আশা করতাম। বাবা মায়ের কষ্ট কী অত বুঝতাম!" আঁখি বোঝায় শোভনকে।

শোভন স্ত্রীকে কাছে টেনে বলে, "তুমি আমার বিরাট ভরসার জায়গা। স্তম্ভের মতো সংসারটাকে দু'হাতে ধারণ করে আছ। আজ পর্যন্ত কখনও কিছু চাইলে না আমার কাছে। চাইলে আমি কী বা দিতে পারতাম!"

"আর যা আমি না চেয়েই পেয়েছি, তা দেবার ক্ষমতা বহু পুরুষের থাকে না, সেটা জানো? আমাদের মধ্যে এই ভালোবাসাটুকু বেঁচে থাক।"

শোভন আঁখিকে আরও নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নেয়। 

সমুদ্রে তখন কোনও পর্যটক নেই। সি-বিচে লোক নেই। কিন্তু ঢেউ উঠেছে উথাল-পাথাল। 

 

নীল দিগন্তে ফুলের আগুন না লাগলেও পরের দিনটা শুরু হলো শরতের শিউলি ঝরা ভোরের মতো। শোভনরা সকাল সকাল স্নান সেরে পুরীর মন্দিরে গেল পুজো দিতে। মন্দিরের ঘন্টার ধ্বনির সঙ্গে পা মিলিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আঁখি গুনগুন করে, "মধুর, মধুর ধ্বনি বাজে, হৃদয়কমলবনমাঝে।" 

লাইন পড়েছিল। বেশ একটু সময়ও লাগল। পুজো দেওয়া হয়ে গেলেও আঁখি অনেকক্ষণ দু'হাত জড়ো করে প্রণাম করার ভঙ্গিমায় মাথা নত করে রইল। অর্চি একটু ছটফট করছে। 

বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, "মা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে কেন?"   

"ঠাকুরকে ডাকছে। মনের কথা বলছে। তুমি ডাকোনি?"

"না তো! মনের কথা তো আমি মাকেই বলি। ঠাকুরকে বলব কেন? ঠাকুর কি আমার মা?"

শোভন হাসল মেয়ের কথা শুনে। বলল, "ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছা। তোমার আজকে ডাকতে মন চাইছে না। পড়ে একদিন চাইতে পারে। সেদিন ডেকো।"

"সেদিন আবার নিয়ে আসবে আমাকে পুরীতে?"

"আসব সময় সুযোগ মতো।"

এবার শোভনও বিরক্ত হলো একটু। এতক্ষণ ধরে প্রণাম করার কী আছে! এই ভিড়ে দাঁড়ানো যায়! কেন জানি না সামনে দাঁড়ানো তিন মূর্তিকে ঈশ্বর ভাবতে ইচ্ছা হলো না শোভনের। মনে হলো তাঁরা রক্ত মাংসের মানুষ। শোভনের মন ঈর্ষান্বিত হলো - আঁখি কি আমার থেকেও তাঁদের বেশি ভালোবাসে? কী এত কথা আঁখির যা ও আমাকে বলতে পারে না! কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বলেই যাচ্ছে!

মনুষ্য-জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ঈর্ষা, যা ভগবানকেও ছেড়ে কথা বলে না। হয়তো এ এক রকমের অধিকারবোধ, যেখানে ঈশ্বরের স্থান নেই। এই সংকীর্ণতা থেকে বেরোতে পারল না শোভন।

 

হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সমুদ্রে নামবে বলে প্রস্তুত হয়েই বেরোল ওরা। বেলা বেড়েছে। রোদ একটু চড়ার দিকে। তবু, কত মানুষ জলে নেমেছে। তিনজন এক জায়গা দিয়েই ছিল। অর্চি কিন্তু বাবার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে লাগল। ঢেউ এলেই বাবা আর মেয়েতে লাফিয়ে উঠে যুঝে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শক্তির সঙ্গে। আঁখির মনোবল তখন তলানিতে ঠোক্কর খাচ্ছে। কী এক অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে অর্চি আর শোভন।    

চিৎকার করছে আঁখি, "আর দূরে যেও না। এবার চলে এসো।" 

সমুদ্রের ভয়ংকর গর্জন আঁখির আর্তনাদকে চাপা দিতে ক্ষণিকের সময়ও নিল না। তারপরেই একটা বড়ো ঢেউ। আঁখির চোখ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওরা। আঁখি আর খুঁজে পাচ্ছে না ওদের। মরিয়া হয়ে নিজেই এগিয়ে চলল। সমুদ্রের নোনা জলে আঁখির চোখের জল মিশে যেতে লাগল। কখনও ডুবে কখনও ভেসে আঁখি কোন্ অনন্তের দিকে এগিয়ে চলেছে ও নিজেও জানে না। হঠাৎ মাথার ওপরে এক বিশাল ঢেউ। কেউ একজন এসে আঁখিকে ধরে বলল, "ভয়ের কিছু নেই।" একটি ছেলে ওকে পাড়ের দিকে নিয়ে আসতে লাগল। সমুদ্রের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে মানুষের ত্রাতা হিসেবে কাজ করে যারা, ছেলেটি তাদেরই একজন।

"কিন্তু ওরা যে ..."

পরপর ঢেউয়ের ধাক্কায় আঁখি কথা শেষ করতে পারে না। 

ছেলেটি বলল, "ওরাও আসছে পেছনে। আমাদের লোক আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে।"

আঁখি ঘাড় ঘোরাতে গিয়েও পারল না। 

সি-বিচে এরপর ওদের ঘিরে লোকজনের ভিড়। নানা জনের নানা কথা উড়ে আসতে লাগল। 

ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে আপনি অত ভেতরে চলে গেলেন। একটা বিপদ হলে কী হতো বলুন তো! - ইত্যাদি ইত্যাদি।

শোভন বুঝতে পারে কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু অর্চি খুব আনন্দ পেয়েছে।

ভিজে নাইটি গায়ে আঁখি বালিতে প্রায় শুয়ে পড়েছে। এক পাশে সাগরের তীব্র গর্জন আর ওপরে গাঢ় নীল আকাশ। আঁখি যেন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে বিচরণ করছে - সকালে মন্দিরে দাঁড়িয়ে এত যে প্রার্থনা, সব কি মিথ্যে! নাকি আরও বড়ো কিছু থেকে ঈশ্বর আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন!

 

হোটেলে ফেরার পথে একটাও কথা বলল না আঁখি। হোটেলে ফিরেও না। দুপুরে ভালো করে খেল না। সারাদিন নিঃশব্দে চোখের জল ফেলল। শোভন অনেকবার সরি বলেছে। আঁখি উত্তর দেয়নি। শুধু অর্চি যখন গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "সরি মা। আর কক্ষনো এরকম করব না।" তখন আঁখির মন ভিজল। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদল। তবে, এ অশ্রুতে আঁখির মনের ভিতরে জমে থাকা আতঙ্ক আর দ্বিধায় মেশা অভিমান নামক বস্তুটা ক্রমশঃ তরল হতে লাগল।

বিকেল বিকেল আবার ওরা গেল সি-বিচে। আদিগন্ত অশেষ জলরাশির পশ্চিম প্রান্তে সূর্য একটু একটু করে নেমে যাচ্ছে। ভিজিয়ে নিচ্ছে নিজের জ্বলন্ত শরীর। তলিয়ে যাচ্ছে সে কোন্ অতলে। অথচ আকাশময় তখনও রঙের খেলা। যার প্রতিফলনে সাগরের সাদা ফেনা রক্তিম হয়ে উঠেছে। মানুষ দু'চোখ ভরে দেখছে সে দৃশ্য। প্রকৃতির স্বাদ নিতেই তো মানুষ ছুটে বেড়ায় পাহাড় থেকে সাগরে। প্রকৃতির কাছে মানুষ যেমন অসহায়, তেমন ঋণীও।

সন্ধের পরে কিছু কেনাকাটা সেরে ফেরার সময় অর্চি বাবার কাছে বায়না করল, "বাবা, এখানে কত বাঙালি রেষ্টুরেন্ট। একদিন এখানে লাঞ্চ করলে হয় না?"

শোভন এক কথায় রাজি। বলল, "কালকেই করা যেতে পারে। তোমার কোনটা পছন্দ বলো। সেটাতেই করব।"

 

পরেরদিন অর্চির পছন্দ মতো বাঙালি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে হঠাৎ উল্টোদিকের টেবিলে চোখ আটকে যায় শোভনের। অবিকল সুচন্দ্রা। কিন্তু কী করে সম্ভব? চন্দ্রা তো কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে! তখন ঠিক এরকমই দেখতে ছিল। তাহলে কি মেয়েটি চন্দ্রার বোন সুদীপা? কিন্তু ওকে তো অন্যরকম দেখতে ছিল। কিছুটা মিল ছিল ঠিকই। চন্দ্রার পরে দুই ভাই। তারপর দীপা। তারমানে বড়ো হয়ে একদম দিদির মতো দেখতে হয়েছে। মনে হয় নববিবাহিতা। হাজব্যান্ডের সঙ্গে গল্পে একেবারে মশগুল। শোভন ভাবছে আর মেয়েটিকে এক দৃষ্টিতে দেখছে। আঁখি অর্চিকে পাশে নিয়ে শোভনের সামনের চেয়ারে বসেছে। শোভনকে কী একটা বলতে গিয়ে দেখে ও অপলকে কিছু দেখছে। কোনও মানুষকে যে দেখছে, সে ব্যপারে নিশ্চিত আঁখি। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে এক দম্পতি নিজেদের মধ্যে হেসে হেসে গল্প করছে। আর শোভন ওই মহিলার দিকেই তাকিয়ে। আঁখির শরীরটা রি-রি করে উঠল। শোভন এরকম! এমন নয় মহিলা অসামান্য সুন্দরী। তবে আধুনিকা। 

বিরক্তিতে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েও মনে হলো, "মুখটা যেন চেনা চেনা! আগে কি কোথাও দেখেছি?"

তাকাবে না ভেবেও ঘাড়টা অল্প ঘুরিয়ে বুকের মধ্যেটা ছ্যাৎ করে উঠল আঁখির - সুচন্দ্রা না? শোভন ফটো দেখিয়েছিল ওর। কিন্তু শোভন যে বলেছিল....

আর কিছু ভাবতে পারল না আঁখি। কারোকে কিছু বুঝতেও দিল না। চুপচাপ খাবার খেয়ে নিল। বেরোনোর সময় দেখেল শোভন এক ঝলক তাকাল মেয়েটার দিকে। হোটেলে ফিরে শুয়ে পড়ল আঁখি। কিন্তু ঘুমোলো না। মা ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে অর্চি বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বাবার সঙ্গে বকবক শুরু করল। শোভন মেয়ের কথা শুনছে, আবার শুনছেও না। 

কখনও শুধু হ্যাঁ বা না। সুস্পষ্ট অন্যমনস্কতার ইঙ্গিত। বারো বছরের বিবাহিত জীবনে এই শোভনকে দেখেনি আঁখি। এ ওর চেনা শোভন নয়। বিয়ের আগে ও সুচন্দ্রার কথা জানিয়েই বিয়ে করেছিল। ওর অকাল প্রয়াণের কথাও বলেছিল। 

বলেছিল, "তোমার বাবা-মায়ের মত আছে কিনা জেনে তবেই সিদ্ধান্ত নিও।"

মত ছিল না। দুজনেই আপত্তি করেছিলেন। ওঁদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে আঁখিকে। 

বোঝাতে হয়েছে তাঁদের, "আজ যদি শোভন তোমাদের ছেলে হতো, তোমরা দ্বিতীয়বার বিয়ে দেবার চেষ্টা করতে না? এমন নয় ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে ওর ক্যারেকটার নিয়ে কথা উঠতে পারে। স্ত্রী মারা গেছে স্ট্রোকে। তাতে শোভনের দোষটা কোথায়?"

মা খুব ধীর গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, "মারা গেছে ব'লেই মনের মধ্যে আজীবন থেকে যাবে। তোর ভালো লাগবে? আরও একজন ভালোবাসায় ভাগ বসালে? নাই বা সে সামনে থাকল।"

আঁখি কয়েক মুহূর্ত থমকেছিল মায়ের কথায়। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "এখন আর ফেরা সম্ভব না মা। আমি শোভনের ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারব না।"

আজ এত বছর পরে আঁখির সব কথা মনে পড়ছে। কিন্তু শোভন বা ওর বাড়ির কেউ কোনোদিন ঘুণাক্ষরে জানতেও দিল না যে, সুচন্দ্রা জীবিত। তবে কি ওদের ডিভোর্স হয়েছিল? সেটাই বা চেপে যাবার কী আছে। ডিভোর্স হতেই পারে। 

বিকেল হতে না হতে শোভন বেরোনোর জন্য উশখুশ করতে লাগল।

আঁখিকে বলল, "কালকেই তো ফেরার ট্রেন। চলো একটু ঘুরে আসি।" শোভনের বাইরে যাবার অতি আগ্রহ দৃষ্টি এড়ায়নি আঁখির। হাত পা অবশ লাগছে, চলার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়েছে আঁখি। শুধু মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

শোভন কী খুঁজছে? কার প্রতীক্ষায় ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে! আঁখির বুকের মধ্যে দামামার শব্দ। জীবন কত দামি! প্রতিটি মানুষের কাছে তার নিজের জীবনের একটা মূল্য আছেই। বাস্তবের কষ্টিপাথরে ঘষে সেই জীবনকেই আজ তুচ্ছ মনে হলো আঁখির। মহাসাগরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে অত্যন্ত নগণ্য মনে হলো। কাল যখন ও পাগলের মতো জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন যদি এই বিপুল জলরাশি ওকে টেনে নিয়ে যেত বহুদূরে, যেখান  থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়, তাহলে কি কারোর কিছু এসে যেত? উত্তর নেই আঁখির কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে অর্চি মায়ের হাতটা ধরল। কেন কে জানে! আঁখি অর্চির মুখের দিকে তাকাল। অর্চি তাকাল না। ওর চোখ সামনে বহু দূরে, যেদিকে তাকালে বোঝা যায় পৃথিবী গোল। অর্চির নিবিষ্ট চোখের দিকে তাকিয়ে আঁখি নিজের মনেই বলল, "তবু আমাকে বাঁচতে হবে।"

 

 

সমুদ্রের এক দখলদারি চরিত্র আছে। সে নিজে তর্জন গর্জন করবে। নিজের ইচ্ছায় উত্তাল হবে। নিজেকে ভাঙবে, গড়বে। কিন্তু মানুষকে চুপ করিয়ে রাখবে। তার বিশালতায় নত হয় না এমন মানুষ কম। মানুষ পারে শুধু তাকিয়ে থাকতে। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল। শুধু ভাঙা আর গড়া। শুধু আছড়ে পড়া আর পিছিয়ে যাওয়া।

"শোভনদা না?" জিন্স পরা একটি মেয়ে টগবগিয়ে সামনে এল।

চমকে ঘুরে তাকাল তিনজনেই।

শোভন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মেয়েটির হাতদুটো ধরে বলল, "চন্দ্রা!"

"আমি দীপা, শোভনদা। সুদীপা। চন্দ্রার বোন।"

"হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি দীপা। চন্দ্রা হবেই বা কী করে! একদম চন্দ্রার মতো দেখতে হয়েছ।"

"দিদি ওয়াজ ভেরি লাকি। আজও তুমি দিদিকে মিস করো।"

পাশেই অর্চি আর আঁখি বসে আছে। দীপার কথায় অস্বস্তিবোধ করে শোভন। কথা ঘোরানোর জন্য ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, "আমার স্ত্রী আঁখি আর কন্যা অর্চিশা।"

আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল, "আঁখি, তোমাকে সুচন্দ্রার কথা বলেছিলাম না। ওর বোন সুদীপা।"

আঁখি হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। দীপার স্বামী এগিয়ে এসে শোভনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, "আমি ধ্রুব।"

ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলে অর্চি জানতে চাইল, "এরা কারা? বাবা?"

শোভন ঢোঁক গিলে বলল, "আমার অনেক দিনের পরিচিত। বহুকাল পর দেখা হলো।"

শোভন মাঝেমাঝে আড়চোখে আঁখিকে দেখছে। কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ওর কে জানে! নিজের মনেই ভাবছে শোভন, "আমি তো সকালেই বুঝেছি, ও চন্দ্রার বোন দীপা। তবু কেন যে ওর হাতদুটো ধরে বলে ফেললাম, চন্দ্রা! কী উত্তর দেব আমি আঁখিকে?"

আঁখি কিন্তু চুপ। সমুদ্রের ঢেউ গুণে চলেছে। একটা ব্যপারে ও নিশ্চিত হলো, শোভন ওকে মিথ্যে বলেনি। কিন্তু ও নিজে কী পেল? সেই তো শোভনের মনপ্রাণ জুড়ে শুধুই চন্দ্রা। সেই বিয়ের পরে মন্দারমণি, তখন জীবন ছিল অন্যরকম। তারপর এই পুরী। পুরীর সমুদ্র আঁখিকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। এই জন্যই কি বলে, সাগর যা টেনে নেয়, তা'ই আবার ফিরিয়ে দেয়! শোভন তো ওর জীবনের বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। তবু আজ আঁখির মনে হলো শোভন অন্যের অথবা অন্য কেউ শোভনের। মা তো ঠিকই বলেছিল। নাহ্, আর কিছু ভাবতে ওর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কতক্ষণে কলকাতা ফিরবে। একবার ছুটে যাবে মার কাছে। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে যাবে? মাকে তো ও কিছুই বলতে পারবে না। তবু আঁখি যাবে। মা'কে প্রণাম করে নীরবে জানিয়ে আসবে, "মা, তুমিই ঠিক ছিলে। আমিই ভুল।"

 

0 Comments
Leave a reply