নারী চেতনায় প্রতিবাদের স্বরূপ

লিখেছেন:নীলেশ নন্দী

 

গুলাবি গ্যাং (ছবি - https://gulabigang.in/) 

বিশেষ কোন প্রতিবাদে আন্দোলন বা লড়াই করা যেমন মানুষের রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনই মানবিক অধিকারও। তবে ব্রিটিশ আমলের মতো আমাদের ভারতবর্ষে বর্তমান সময়ের রাজনীতি কিংবা আন্দোলনের স্বরূপ, প্রকৃতি কখনোই একই রকমের হতে পারে না। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকালের আগে কোন গণ-রাজনীতির প্রচলন ছিল না। সেই সময় রাজ্য বা সাম্রাজ্যের যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ে রাজাদের রীতিনীতি অনুযায়ী তাঁদের মধ্যেকার কিছু সীমিত নীতি ছিল, যাকে বলা হতো রাজনীতি। কালক্রমে সাম্রাজ্য এবং রাজ্যসমূহের বিস্তার-সংকোচন ও আধিপত্য বিলুপ্তির কারণে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষদের মধ্যে রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব বিস্তার হয়। তবুও তার নাম রাজনীতি হয়েই থেকে যায়।

আমাদের সমাজে নারীদের একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে, নিজ আকাঙ্খার জগৎ আছে। তারা পিছিয়ে থাকলে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও অনেকেই তারা চিরটাকাল অবজ্ঞা, এবং তাচ্ছিল্য পেয়ে এসেছে। আদতে এই অবজ্ঞার পিছনে একটি কারণ রয়েছে। আজ থেকে প্রায় দু'হাজার তিনশো বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা অক্ষম ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন। তাঁর এই কথাই বুঝি যুগের পর যুগ ধরে পুরুষরা মেনে চলেছে। ফলে নারীদের স্বপ্ন, জীবন, প্রতিভাকে বিকশিত হতে না দিয়ে সেই পথ রোধ করে দেওয়া হয়েছে। নারীরা যখন আজ সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছে, বিভিন্ন গবেষণা, শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে সব ধরনের পেশায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের পুরুষদের সমকক্ষ প্রমাণ করেছে; এমতাবস্থায় নারীদের অপমান করার প্রবণতা, নারী নির্যাতন, এবং তাদের উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার আমাদের দেশে ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এখনও নারীরা পরিচিতি পায় পুরুষদের পরিচয়ে। বিয়ের আগে তার বাপের পরিচয়ে এবং বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ে। 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীরা লেখালেখির মাধ্যমেই মূলত প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তাদের লেখার আড়ালে থাকত অবদমিত আত্মপ্রকাশের যন্ত্রণা। সেই সময়ের নারীরা যাবতীয় মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। কন্যাসন্তানের জন্ম হলে কেউ সাড়ম্বরে তাদের স্বাগত জানাত না। সারাজীবন তাদের জীবন ভার বয়ে বেড়াতে হতো। কারও শৈশবে তো কারও কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হয়ে যেত। আর কৈশোর না পেরোতেই সন্তানের জন্মদান। এটাই ছিল সেই সময়ের নারীদের জীবনচক্র। তবে তৎকালীন সময়েই ইংল্যান্ডে যে নারী কেবলমাত্র কলমের শক্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে জাগ্রত এবং সচকিত করেছিলেন, তাঁর নাম মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট। তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠী, স্পষ্টভাষী প্রচারক এবং নারীমুক্তির প্রথম পথ প্রদর্শক। নারী শিক্ষা, নারী অধিকার সমস্ত বিষয়ে তিনিই প্রথম বই লিখে গিয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় সম-অধিকার নিয়ে নারীদের আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের নির্যাতন চলে তাদের উপর। গ্রেফতারও হন অনেক নারী। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ১৯০৯ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

ভারতীয় নারীবাদীরা ভারতের নির্দিষ্ট পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে কিছু স্বতন্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করেন। কারণ ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের অধিকার ও শিক্ষার বিষয়গুলোতে বিশেষ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। নারীরা সমাজে কিছু বাধার সম্মুখীন হয় যা পাশ্চাত্য সমাজে বিদ্যমান নয় বা প্রচলিত নয়। বেশ কিছু নারী সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ করেন। যেমন সম্পত পাল দেবী একজন প্রাক্তন সরকারী কর্মী এবং পাঁচ সন্তানের জননী, যিনি ভারতে বেড়ে ওঠার সময় তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে গার্হস্থ্য নির্যাতন এবং সহিংসতা লক্ষ্য করেন। এর ফলে তিনি "গুলাবি গ্যাং" নামে একটি সজাগ দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন, যারা নির্যাতনকারীদের খুঁজে বের করে বাঁশের লাঠি দিয়ে মারধর করে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা অপরাধ স্বীকার করে।

অবমাননা থেকে মুক্তির দায়িত্ব হোক, কিংবা অচেতন জড়ত্ব থেকে বেরিয়ে এসে সচেতন অস্তিত্বের ভূমিকা পালন, সবকিছুই নারীদের প্রতিবাদের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হবে। মুছে ফেলতে হবে যাবতীয় অমর্যাদার চিহ্ন।


 

0 Comments
Leave a reply