নও শুধু ছবি

লিখেছেন:গোপাল দাস

 

‘জলসাঘর’ সিনেমায় ছবি বিশ্বাস

একটি মজার ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়েছিল 'দাদাঠাকুর'। নাম ভূমিকায় ছিলেন ছবি বিশ্বাস। পরিচালক সুধীর মুখার্জি। ছবি বিশ্বাস যে ক'টি চরিত্রকে তাঁর অসাধারণ অভিনয়গুণে অমর করে গেছেন 'দাদাঠাকুর' সেগুলোর অন্যতম। বাস্তবের দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পন্ডিত তখন জীবিত কিংবদন্তি। এদিকে সিনেমার 'দাদাঠাকুর' ছবি বিশ্বাসের সেই বছরেই মোটর দুর্ঘটনায় জীবনাবসান হয়েছে ছবিটি মুক্তির কিছু আগেই। 'দাদাঠাকুর' ছবিটি রমরম করে চলছে পূরবী (বর্তমানে বিলুপ্ত) সহ কলকাতার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। শরৎপন্ডিত কোন কাজে কলকাতায় এসে উঠেছেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি মেসবাড়িতে। পূূরবী হলের সামনে দিয়ে তিনি স্বয়ং যখন হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর দিকে কারো নজর নেই, কিন্তু সিনেমার দাদাঠাকুরকে দেখার জন্য হলের সামনে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। তাঁর সফরসঙ্গী প্রসঙ্গটি উল্লেখ করায় দাদাঠাকুর তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, "ছবি দেখে লোকে বিশ্বাস করবে বলেই তো ছবি বিশ্বাসকে নেওয়া।"

১৯৩৬ থেকে ১৯৬২ এই ২৭ বছর ছিল তাঁর অভিনয়জীবন। এর মধ্যে রূপদান করেছেন প্রায় ২৫৬টি বাংলা ছবিতে বিভিন্ন রকমের চরিত্রে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালে এক একটি বছরে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ছিল ২১ থেকে ২৭। এমনও সময় গেছে একই সঙ্গে ছ' সাতটি ছবিতে কাজ করেছেন। স্টুডিওর এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে এক মেক-আপ ছেড়ে অন্য মেক-আপে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দ্রুত পায়ে ছুটোছুটি করতে হয়ছে তাঁকে। কিন্তু কোনো সময়েই এই বিভিন্ন ধরনের জটিল চরিত্রের অরণ্যে তিনি পথ হারাননি। কারণ তিনি ছবি বিশ্বাস। 

একজন সার্থক চরিত্রাভিনেতা বলতে যা বোঝায় ছবি বিশ্বাস ছিলেন তাই। তাঁকে ছাড়া সেসময় অনেক ছবিই কল্পনা করা যেত না। নায়কোচিত সৌম্যকান্তি রূপ, আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা এবং অভিনয় ক্ষমতা সবই তাঁর ছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রে তাঁর পদার্পণ ৩৪ বছর বয়সে, অর্থাৎ তখন তিনি যৌবনের প্রান্তসীমায়। নায়ক সাজার বয়স পেরিয়ে এসেছেন। যদিও তার আগে শখের যাত্রা-থিয়েটারে কিছু অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু অভিভাবকদের মত না থাকায় সেসব ছেড়ে দিতে হয়েছিল অচিরেই।

উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবারে ভূপতিনাথ বিশ্বাস ও কাত্যায়নী দেবীর চার ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শচীন্দ্রনাথের জন্ম ১৯০২ (মতান্তরে ১৯০০) সালের ১৩ জুলাই। ছবির মতো সুন্দর দেখতে ছিলেন বলে তাঁর মা ডাকতেন ছবি নামে। মা'কে হারিয়েছেন তাঁর দশ মাস বয়সে। তবু মায়ের দেওয়া এই নামটিই যেন তাঁকে সারাজীবন আগলে রেখেছিল। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পারিবারিক প্রাচুর্য ও সম্ভ্রান্ত পরিমণ্ডলে। ভূপতি বিশ্বাসের আদি নিবাস ছোট জাগুলিয়া গ্রামে। সেখানে প্রাসাদোপম 'কালী নিকেতন' তাঁদের বিখ্যাত বাড়ি। সেখান থেকে ভূপতিবাবু চাকরিসূত্রে চলে আসেন কলকাতায়। 

ছবি বিশ্বাসের পড়াশুনা হিন্দু স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং বিদ্যাসাগর কলেজে। কলেজজীবনে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে যাতায়াতের সূত্রে কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নরেশ মিত্র, শিশির ভাদুড়ি প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন। এখানেই শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে মঞ্চাভিনয়ের সুযোগ ঘটে যুবক ছবির। পাশাপাশি পাড়ার ক্লাব, কাঁকুরগাছি নাট্যসমাজ, শিকদার বাগান স্ট্রিটের বান্ধব সমাজ ইত্যাদি জায়গায় থিয়েটার ও বিভিন্ন যাত্রাপালায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। এর মধ্যে বান্ধব সমাজের "নদীয়া বিনোদ" যাত্রাপালায় নিমাইয়ের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় গুণীজনের প্রশংসা লাভ করেছিল।

অভিনয়ের সুখ্যাতি আর সুন্দর চেহারার সুবাদে নজরে পড়ে গেলেন সেকালের বিখ্যাত প্রযোজক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলির। তিনি সুযোগ দিলেন তাঁর 'অন্নপূর্ণার মন্দির' ছবিতে। ছবিটির পরিচালক ছিলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত অভিনেতা তিনকড়ি চক্রবর্তী। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৬ সালের ১৩ জুন। রূপালী পর্দায় তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। ছবিটি অবশ্য বাণিজ্যিক ভাবে সাফল্য পায়নি। এর কয়েক বছর পরেই "চোখের বালি" ছবিতে মহেন্দ্র, "শর্মিষ্ঠা"তে যযাতি এবং শিশিরকুমারের "চাণক্য" ছবিতে সেকেন্দর প্রভৃতি চরিত্রে অভিনয় করলেও সাফল্য তেমনভাবে ধরা দেয়নি। এই সময়ে তাঁর আরো কয়েকটি ছবি হল 'নিমাই সন্ন্যাস', 'বাংলার মেয়ে', 'প্রতিশোধ', 'হারানিধি' প্রভৃতি। 

১৯৪১ সালে সুযোগ পেলেন নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে হেমচন্দ্র চন্দ্রর পরিচালনায় 'প্রতিশ্রুতি' ছবিতে। ব্যাস আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ছবি বিশ্বাসকে। পরের বছরেই (১৯৪২) মুক্তি পেয়েছিল তাঁর অভিনীত 'পাষাণ দেবতা', 'অভয়ের বিয়ে', 'পরিণীতা' প্রভৃতি ১৩টি ছবি।

 

‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমায় ছবি বিশ্বাস 

১৯৫৯ সালে মুক্তি পেল তপন সিংহ পরিচালিত 'কাবুলিওয়ালা'। নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের অসাধারণ অভিনয়। রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক প্রাপ্ত এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে উচ্চ প্রশংসিত এই ছবিটি ভারতীয় সিনেমার একটি ল্যান্ডমার্ক। তপন সিংহ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, '"কাবুলিওয়ালা'র প্রতিটি ফ্রেমেই অসাধারণ হয়ে ধরা দিয়েছেন ছবি বিশ্বাস। তবুও তার মধ্যে ছবিদার ডবল প্লে করার মুহূর্তটি অনবদ্য, যেখানে কাবুলিওয়ালা মিমিকে প্রথম দেখছে আর দেখতে দেখতেই সুদূর আফগানিস্তানে তার নিজের মেয়ের কথা ভাবছে। একই দৃশ্যে দুটো দৃশ্য। প্যারালাল শটে বর্তমানকে ধরে অতীতে ফিরে যাওয়ার ওই রূপকল্পনার দৃশ্যে ছবিদার অভিনয় অবিস্মরনীয়।"

১৯৬০ সালে তপন সিংহ তৈরি করলেন 'ক্ষুধিত পাষাণ'। এই ছবিতে ছবি বিশ্বাস পোস্টমাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করলেন। ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রোল। সেই প্রসঙ্গে তপন সিংহ লিখেছেন, --- "নিউ থিয়েটার্স আমার জন্য একটা ঘর ছিল যেখানে বসে যাবতীয় কাজ করতাম। ক্ষুধিত পাষাণ-এর জন্য আউটডোরে যাব, তার মাত্র ক'দিন আগের ঘটনা। ছবিদা উঁকি দিলেন মেকআপ করা অবস্থায়। মনে হয় কোন ফ্লোরে শট দেওয়ার ফাঁকে এসেছিলেন। উনি বসতেই ক্ষুধিত পাষাণ-এর পরিকল্পনা ওঁকে বললাম। শুনে বললেন, শক্ত ব্যাপার। কী করে করবে ? গল্প তো বিশেষ নেই। মুখে কথাটা বললেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে খুশিও হলেন। বসে চিত্রনাট্যের কাজই করছিলাম। ছবিতে পোস্টমাস্টার এর ভূমিকা নিয়ে শটগুলো ওঁকে পড়ে শোনলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে এই চরিত্রে নেব বলুন তো? ছবিদা ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি রেখে বললেন, একজনই আছে তাকে নিতে পারো, তার নাম ছবি বিশ্বাস। আমি তো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বললাম সে কী, মাত্র দু-তিন দিনের কাজ, রাত্রি বারোটার ফ্লাইট, ওখান থেকে গাড়ি।‌ আপনি কি পারবেন? আপনার শরীর এই ধকল সইতে পারবে? উনি হেসে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ খুব পারবো, তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন? তখন উনি স্টারে নিয়মিত থিয়েটার করছিলেন। মাত্র তিন দিনের জন্য গিয়ে সানন্দে অসাধারণ কাজ করেছিলেন। পোস্টমাস্টার আর তুলোর কালেক্টরের সিরিও-কমিক দৃশ্যগুলো দর্শকরা উপভোগ করেছিলেন। দেখতে বসে ছবিদা আর সৌমিত্রর হাসি গোটা হলে ছড়িয়ে পড়ত। আফসোসের কথা পুনে ফিল্ম আর্কাইভে এক অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে গেছে 'ক্ষুধিত পাষাণ'-এর প্রিন্ট। যতদূর জানা যায় অন্য কোন সরকারি আর্কাইভে এই ছবির কোন প্রিন্ট নেই।"

১৯৫৮ সালে মুক্তি পেল সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’। আর তারপর ১৯৬২ সালে 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'। এই দুই ছবির মুখ্য চরিত্রে রূপদান করলেন ছবি বিশ্বাস। দুই মহীরুহের যুগলবন্দিতে সৃষ্টি হলো ভারতীয় সিনেমার আরেক মাইলফলক। এর আগে অবশ্য সত্যজিৎ রায়ের 'দেবী'তেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। 'পরশপাথর'-এও ছিল তাঁর গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' প্রসঙ্গে সত্যজিৎবাবু বলেছেন, "এই সময়ে তাঁর যে কর্মস্পৃহা দেখেছি, তাতে এই মনে হয়েছিল যে, তিনি যেন অভিনয় সম্পর্কে একটা নতুন উদ্দীপনা অনুভব করছেন, এই প্রৌঢ় বয়সেও যেন এক নবলব্ধ অগ্রগতির প্রয়াস তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে।” প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক সেবাব্রত গুপ্ত যথার্থই বলেছিলেন, 'জলসাঘর', 'দেবী' ও 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবিকে শুধু ডাইরেক্টরস ফিল্ম বলা যাবে না কেবল ছবিদার জন্য। কারণ ছবি তিনটিতে সত্যজিৎ রায়ও আছেন, ছবি বিশ্বাসও আছেন। আর এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, "ছবিবাবুর মতো অভিনেতা না থাকলে জলসা ঘরের মতো কাহিনীর চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হতো কিনা জানি না। বোধহয় না। একদিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃষ্যকারিতা, অন্যদিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে পতনের ট্রাজেডি --- একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।"

এ ছাড়াও বহু স্মরণীয় চরিত্রে তিনি রূপদান করেছেন। তার কয়েকটি হল --- 'সমাধান' (১৯৪৩), 'পথ বেঁধে দিল' (১৯৪৫), 'দুই পুরুষ' (১৯৪৫), 'সাত নম্বর বাড়ি' (১৯৪৬), 'চন্দ্রশেখর' (১৯৪৭), 'রাত্রির তপস্যা' (১৯৫২), 'ওরা থাকে ওধারে' (১৯৫৪), 'ঢুলি' (১৯৫৪), 'সদানন্দের মেলা' (১৯৫৪), 'সবার উপরে' (১৯৫৫), 'শঙ্কর নারায়ণ ব্যাংক' (১৯৫৬), 'ত্রিযামা' (১৯৫৬), 'একদিন রাত্রে' (১৯৫৬), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৫৭), 'পৃথিবী আমারে চায়' (১৯৫৭), 'রাস্তার ছেলে' (১৯৫৭), 'অন্তরীক্ষ' (১৯৫৭), 'পথে হলো দেরি' (১৯৫৭) প্রভৃতি। নিজেও পরিচালনা করেছিলেন দুটি ছবি --- 'প্রতিকার' (১৯৪৪) এবং 'যার যেথা ঘর' (১৯৪৯)। যদিও বাণিজ্যিক ভাবে দুটিই অসফল। 

'কাবুলিওয়ালা' ছবির জন্য বার্লিনে আন্তর্জাতিক সম্মানলাভ ছাড়াও ১৯৫৯ সালে তিনি পেয়েছেন 'সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি' পুরস্কার। ১৯৬০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। সর্বোপরি বাংলা ছবির দর্শকদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার চিরকালীন স্থান করে নিয়েছেন তাঁর অসামান্য অভিনয়গুণে। মাত্র ছাব্বিশ বছর বাংলা চলচ্চিত্র এবং থিয়েটারের সেবা করে জনপ্রিয়তার যে শিখরে তিনি পৌঁছেছিলেন তা আজও অম্লান।

মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের সম্পর্ক নিয়ে একটু বললে খুব অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। উত্তমকুমারকে ছবি বিশ্বাস পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। উত্তমবাবুর পিতৃবিয়োগের পর তাঁর গুরুদশায় ছবিবাবু প্রতিদিন সকালে উত্তমের বাড়িতে যেতেন। উত্তমবাবুর বাবা যে ইজিচেয়ারে বসতেন সেটিতেই ছবিবাবুকে বসতে অনুরোধ করতেন উত্তম। বহু ছবিতে দুজনে একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। শুটিংয়ের সময় কোন শট ছবিবাবুর মনোমত না হলে উনি যতবার রিটেক করতে বলতেন উত্তমকুমার এক বাক্যে তা মেনে নিতেন। ছবিবাবুর পরামর্শ এতটাই মূল্যবান ছিল মহানায়কের কাছে। একদিন এক দাম্ভিক জমিদারের চরিত্রে শট দিয়ে উত্তমকুমার শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রকম হলো বল তো? শুভেন্দুবাবু উত্তরে বললেন, একটু ছবিদার মত হয়ে গেল না? কয়েক সেকেন্ড ভেবে উত্তমের জবাব, কী করব বল, বেরোবার কোন রাস্তা রাখেন নি। অন্য কোনভাবে করলে এর চেয়ে ভালো হতো না। একজন অগ্রজ প্রতিভার প্রতি একজন অনুজ প্রতিভার শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এমন নমুনা বড় একটা দেখা যায় না।

 

‘দেবী’ সিনেমায় ছবি বিশ্বাস 

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি পেশাদার মঞ্চেও ছবি বিশ্বাসের ছিল অনায়াস বিচরণ। মীরকাশিম, ধাত্রীপান্না, দুই পুরুষ, পথের দাবী, শাজাহান, প্রফুল্ল, ডাকবাংলো, শ্রেয়সী প্রভৃতি নাটক তাঁর অসাধারণ অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ। ১৯৫৯ সালের ১২ মার্চ স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল 'ডাকবাংলো'। মনোজ বসুর 'বৃষ্টি' উপন্যাসের নাট্যরূপ। প্রধান চরিত্র বিশ্বেশ্বরের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের সাড়া জাগানো অভিনয়। এর আগে প্রায় ৯ বছর মঞ্চাভিনয় থেকে তিনি সরে এসেছিলেন হাঁপানির জন্য। 'দেশ' পত্রিকায় এই নাটকের রিভিউতে লেখা হলো — "এই নাটকের মাধ্যমে প্রখ্যাত নট ছবি বিশ্বাসের দীর্ঘকাল পরে মঞ্চাবতরণ স্টারের নবতম নাট্য উপহারটিকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে। ছবি বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয়ের স্বাক্ষর বহন করছে এই নাটক। বিশ্বেশ্বরের অন্তর্দ্বন্দ্ব, আশা-অভীপ্সা এবং সর্বোপরি তাঁর আত্মভোলা সরল প্রকৃতি তিনি অপূর্ব কৃতিত্বের সঙ্গে রূপায়িত করেছেন। প্রায় ২৩৮ রজনী চলেছিল এই নাটকটি।"

ছবি বিশ্বাস ছিলেন মনেপ্রাণে শিল্পী। অভিনয় ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাঁর শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। অবসর পেলেই ছবি আঁকতেন। মাটির ফুলদানি, মাটি এবং প্লাস্টিকের নানা পাত্র, প্লেট প্রভৃতির উপর ছবি এঁকে ‌রং করতেন। তেল রং বেশি ব্যবহার করতেন। এছাড়া বাটিকের কাজ, বাঁশের কাজ, এমব্রয়ডারির কাজ করতেন সময় পেলেই। ভালোবাসতেন বাগান করতে। তাঁর কলকাতার বাড়িতে নিজের হাতে করা বাগান ছিল দেখার মতো। ফুল কখনো ছিঁড়তেন না, কাটিং করতেন। ৩০ রকমের গোলাপ ও ৬০ রকমের জবা তাঁর সংগ্রহে ছিল। ইন্দোনেশিয়া থেকেও আনিয়েছিলেন জবার চারা। ফুলগাছ সম্বন্ধে তাঁর পড়াশোনা ছিল গভীর। এছাড়া প্রচুর ফল ও সবজি চাষ করতেন বাগানে। অতিথিদের নিজের হাতে তৈরি ফুলের তোড়া উপহার দিতেন। এছাড়া আবৃত্তি করতেন এবং আবৃত্তির ক্লাস নেওয়াও শুরু করেছিলেন একসময়।

১৯৬২ সালের ১১ জুন ছোট জাগুলিয়ায় পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার সময় মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগরে যশোর রোডের উপরে ছবি বিশ্বাসের গাড়িতে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মালবোঝাই লরি ধাক্কা মারলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তিনি নিজেই চালাচ্ছিলেন গাড়িটা। স্টিয়ারিং-এর ধাক্কায় তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়। কলকাতা আর.জি.কর হাসপাতালে আনা হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, ছবি বিশ্বাসের দেহ পোস্টমর্টেম না করার। সকলেই জানেন এটা দুর্ঘটনা, তাই শিল্পীর দেহে ছুরি-কাঁচি চালানো মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ নয়। ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুর পর অনেকগুলি শোকসভার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শোকসভাটি হয়েছিল ২৪ জুন ১৯৬২ কলকাতার মহাজাতি সদনে। সেদিন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতাপূর্ণ বক্তব্যের অংশবিশেষ তুলে দিলাম --- "মৃত্যু অপ্রতিরোধ্য জানি। কিন্তু তবু ছবিবাবুর মৃত্যু আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। কল্পনা করতে পারিনি আজকের বিপর্যস্ত সমাজজীবনে একজন শিল্পীর প্রতি এমন হাহাকার শোনা যাবে। সেদিন হাসপাতালে জনসমাগম দেখে, তাঁর শোকযাত্রায় অভূতপূর্ব জনতার হাহাকার দেখে আমার সে ভ্রান্ত ধারণা দূর হলো। চেষ্টা করেছিলাম হাসপাতালে যেতে কিন্তু অপ্রতিরোধ্য জনতার ভিড়ে দূর থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে এসেছি। ছবিবাবু অসামান্য প্রতিভাধর শিল্পী। . . . . তাঁর মৃত্যু রঙ্গজগতের অপূরণীয় ক্ষতি। যেন নাট্যজগতের শিল্পীদের মিছিলে শিরোভাগে মশালধারী অকস্মাৎ পড়ে গেলেন।"

 

 

0 Comments
Leave a reply