পরিযায়ী পাখির পাঁচালি

লিখেছেন:নবীনা রায় মজুমদার

 

পাখির কোনো দেশ নেই। ডানায় ভর করে খোলা আকাশে উড়ে বেড়ায় তারা। খাবার আর নিরাপদ আবাসের সন্ধানে পাখি এক দেশের সীমা ছাড়িয়ে চলে যায় অন্য দেশে। প্রতিবছর দেশে শীত আসে। আর শীতের সঙ্গে আসে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। দূর দেশ থেকে তারা আসে একটু আশ্রয় আর খাদ্যের আশায়। বিশেষ করে যেসব দেশে শীতের তীব্রতা খুব বেশি, খুব ঠাণ্ডায় যেখানে পাখিগুলোর টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে; খাবার থাকে না, বাসা বাঁধার জায়গা থাকে না, সেসব দেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আমাদের দেশে চলে আসে। তার জন্য ওদের হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস উড়তে হয়। কখনো কখনো এমন দূর থেকে আসে ওরা যে সেখান থেকে উড়ে আসতে আসতেই পথে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়। আবার কিছুদিন আমাদের দেশে থেকে তারা ফেরার পথ ধরে। ফিরে যেতেও আবার তিন মাস তাদেরকে উড়তে হয়। তার মানে এইসব পাখির বছরে ছয়মাস শুধু উড়তে উড়তেই কেটে যায়। 

নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির এই প্রতি বছর বা কয়েক বছর পরপর একটি নির্দিষ্ট সময় বা ঋতুতে অন্তত দুটো অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়া করার ঘটনাকেই পাখির পরিযান বলে। আর এখান থেকেই তৈরি হয়েছে ‘পরিযায়ী পাখি’র ধারণা। বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে দেখেছেন, এই পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ সংখ্যক প্রজাতিই পরিযায়ী, অর্থাৎ তারা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পুরোনো বাসা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে নতুন বাসা গড়ে তোলে। আবার ঋতু অতিক্রান্ত হলে পথ চিনে ফিরেও আসে। কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত এই পথ, এক দেশ থেকে অন্য দেশ, এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে অবলীলায় উড়ে যায় এই পরিযায়ীরা।

 


 

* সাইবেরিয় চুনীকন্ঠী 

 

ভারতের মতো গ্রীষ্ম প্রধান দেশে বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় নিঃসন্দেহে শীতকাল। আর যদি পরিযায়ী পাখি নিয়ে আগ্রহ থাকে, তাদের কাছ থেকে দেখতে হয়, ছবি তুলতে হয়, তাহলে ভ্রমনের সেরা সময় কিন্তু সেই নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। এই সময় সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে আসে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের নানা প্রান্তের জলাভূমিতে। আর শুধু সাইবেরিয়াই নয়, ইওরোপ, রাশিয়া, চীন কিংবা তিব্বতের শীতার্ত এলাকাগুলি থেকেও এই ঋতুতে নানা প্রজাতির পাখি উড়ে আসে তিনদিক সমুদ্রে ঘেরা তুলনায় উষ্ণ আবহাওয়ার দেশ ভারতে। আবার শীত কমতে শুরু করলে তারা ফিরে যায় যে যার পুরোনো আস্তানায়। শীতকাল ছাড়া সারা বছর এসব পাখিদের দেখা মেলেনা বলেই এদের অতিথি পাখি বলা হয়। 

এইসব পাখিদের দেহে অসাধারন এক সংবেদ ও সারা প্রদান কৌশল আছে যা দিয়ে ওরা শত শত এমনকি হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকই আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারে। যাত্রা পথের আকাশ, নক্ষত্র, পাহাড়, নদ নদী, অরণ্য, ইত্যাদি ওরা চিনে রাখে এবং এসবের সাহায্যে ঠিকই আবার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যায়। শীতের মরসুমে পৃথিবীর উত্তরগোলার্ধের কিছু কিছু এলাকায় অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা পড়ে। কয়েক ইঞ্চি বরফের পুরো আস্তরনের তলায় ঢাকা পড়ে যায় মাটি। ভীষণ শীতে, বরফ পাতের মধ্যে এই সব পাখির স্বাভাবিক খাবারের ভাঁড়ারেও টান পড়ে। তুলনায় উষ্ণ একটা আস্তানা আর খাবারের খোঁজে দলে দলে এরা পাড়ি জমায় দক্ষিণের দিকে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাখিগুলো আমাদের দেশের বিভিন্ন বন জঙ্গল, হাওর, বাওর, খাল, নদী, চর, বিল, জলাশয়ে এসে জড়ো হয়। প্রসঙ্গত, ওরা জানে কখন ওদের কোন দেশে আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য আসার আগে ওরা পাখার নিচে বেশি চর্বি জমা করে রাখে। মাইলের পর মাইল ওরা উড়ে চলে সেই সঞ্চিত চর্বির শক্তিতে। ওদের পরিযান স্বভাবটাও বেশ অদ্ভুত। সাধারণত ওরা দল বেঁধে চলে। ওদের রঙবেরঙের সৌন্দর্যে শীতের দিনে রঙিন হয়ে ওঠে আমাদের জলাশয়গুলো।


 

* নীলগলা ফিদ্দা 

 

বাংলায় পরিযায়ীদের কথা উঠলেই প্রথমেই আসে সুন্দরবনের নাম। শীতের শুরুতেই পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমায় এই হাওর, বিল, খাঁড়ির দেশে। সুন্দরবন পাখিরালয়ের জলাশয় সহ কাছাকাছির মধ্যে মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জের নানা জায়গায় এসময় দেখা মেলে বিদেশি পাখিদের। এসব পরিযায়ী পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নানা ধরণের হাঁস আর রাজহাঁস, কালেম, ডাহুক, ছোটো সরালী, খঞ্জনা, চটক, মাঠ চড়াই, কসাই পাখি, গাঙ চিল, নীল শির, লাল শির, কালো হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, খুদে গাঙচিল, উন্তি হাঁস, জিরিয়া, চখাচখি পাখি, বালি হাঁস, বড়ো সরালী, কালিপক, জলময়ূরী, ডুবুরি ইত্যাদি। আর যদি কলকাতার কথাই বলি, তাহলে রাজারহাটের জলাভূমি এবং অবশ্যই সাঁতরাগাছির সেই ঝিলের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। সেখানেও কত ধরনের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। 

ভাবতে অবাক লাগে এই সুন্দর পরিযায়ী পাখিদের ওপর কিছু দুষ্টু মানুষের নজর থাকে। শিকারীর দল মেতে ওঠে পরিযায়ী পাখি শিকারে। দেশে আইন থাকলেও তা উপেক্ষা করে শিকার চলে। আর তাছাড়া আগে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে যতটা শীত থাকতো এখন সেখানে পরিবেশ কিছুটা উষ্ণ হয়ে ওঠায় অনেক পরিযায়ী পাখির পরিযানকালীন আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আমাদের দেশেও জলাশয়ের পরিধি সঙ্কুচিত হচ্ছে। জলাশয়ে থাকা মাছ, শামুক, ইত্যাদি কমে যাচ্ছে। ফলে যে নিশ্চিত খাদ্য ও আশ্রয়ের আশায় পরিযায়ী পাখিগুলো এদেশে আসতো ওরা এসে আর সেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেনা। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের সঙ্গে আমাদের আঘাত পরিযায়ী পাখিগুলোকে ক্রমশ বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। পাখিকে বলা হয় প্রকৃতির অলঙ্কার। পাখি পোকা মাকড় খেয়ে ফসল রক্ষা করে। পাখির বিষ্ঠা থেকে জমিতে ফসলের উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। মোট কথা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পাখির রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উল্লেখ্য, আয়লা-আমফানে, মানুষের অসাবধানতায়, নানান সরকারি প্রকল্পের ধাক্কায় যদিও ধুঁকছে সুন্দরবন, নষ্ট হয়ে গেছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য - তবু আজও পথ চিনে নিজেদের ছেড়ে যাওয়া ঠিকানার খোঁজে প্রতিবছর ফিরে আসে টেরেক স্যান্ডপাইপার, কমন রেডশ্যাঙ্ক, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভার, গ্রে হেডেড ল্যাপউইং বা ধূসর খঞ্জনা, ইউরেশিয়ান কারলিউ, টেমেনিঙ্ক স্টিন্টের মতো পরিযায়ীরা। কলকাতার খুব কাছে সাঁতরাগাছির ঝিলেও নভেম্বরের শুরু থেকে উড়ে আসতে শুরু করে অতিথি পরিযায়ীরা। হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে স্টেশন চত্তরের গা লাগোয়া লম্বা ঝিলের জলে শীতের ক'মাস ঘাঁটি গাড়ে হুইসলিং ডাক, পিনটেল ডাক, পায়েড কিংফিশার, ওয়াইল্ড স্প্যারোর মতো পাখিরা। 

আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা ক্রমশ কমছে। এদের সংরক্ষণ করতে হলে আমাদেরকে পাখির বন্ধু হতে হবে। পাখির সাথে হাতে হাত মেলাতে হবে। সাথে খেয়ালও রাখতে হবে পৃথিবীর এই সৌন্দর্যের প্রাণীকে আমরা যাতে হারিয়ে না ফেলি। চোরা শিকারীদের হাত থেকে আমাদেরকেই তাদের রক্ষা করতে হবে। নিজেদের আনন্দের জন্য, আনন্দ বললে ভুল হবে, ক্ষনিক আনন্দের জন্য তাদের ব্যবহার না করে, তাদেরকে শিকার না করে বরং আসুন তাদের দুহাত মেলে স্বাগত জানাই।

 

* দুটোই সাইবেরিয়া থেকে শীতকালে আমাদের দেশে আাসে। মোটামুটি অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত থাকে। তারপর আবার ফিরে যায়। ছবি দুটোই দঃ ২৪ পরগাণার বারুইপুর জেলখানার মাঠ থেকে তোলা।এ দের আকার ঠিক চড়ুই পাখির মতোই। অত্যন্ত লাজুক পাখি। হোগলবন বা খড়িবনের মধ্যে থাকে। মাটিতে ঘুরে ঘুরে ছোটো ছোটো পোকামাকড় খায়।

 

ছবিঋণ এবং ছবির অনুলেখন - কপিল বাগ 

 

 

0 Comments
Leave a reply