প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি

লিখেছেন:মানবেন্দ্রনাথ রায়

মূল প্রবন্ধ থেকে ভাষান্তর - অপূর্ব দাশগুপ্ত 

বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র কিনে সেগুলিকে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে পাঠাবার কাজে জার্মানদের অর্থ সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। আমি যখন এই কাজে চীনে পৌঁছেছিলাম তখন অ্যাডমিরাল ভন হিনটেজ ছিলেন সে দেশে জার্মানির রাষ্ট্রদূত। ইনি পরে ইম্পেরিয়াল জার্মানির শেষ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে ছিলেন। ইনি আমাকে বলেছিলেন যে যুদ্ধের সময়ে একমাত্র ‘ইম্পেরিয়াল জেনারেল স্টাফ’ এতো বড়ো টাকার অঙ্ক অনুমোদন করতে পারেন। তিনি আরো বললেন যে সামরিক দিক থেকে আমার পরিকল্পনাটি বাস্তবে রূপায়িত করা যেতে পারে এবং শীর্ষকর্তারা এই পরিকল্পনা অনুমোদন করতে পারেন, সে কারণে আমার এখনই বার্লিনে রওনা হওয়া কর্তব্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে নিপীড়িত জনসাধারণের প্রতি জার্মানদের অনুকম্পা বিষয়ে যতটুকু মোহ আমার অবশিষ্ট ছিল অ্যাডমিরাল ভন হিনটেজের সঙ্গে উপোরক্ত কথোপকথন শেষে  আমার সেটুকুও মন থেকে মুছে গেল। কিন্তু চীন বা জাপানে ভরসা করার মতো আর কোন অবলম্বন না থাকায় ঠিক করলাম বার্লিনে প্রধান সেনাপতিদের কাছে যাওয়াটাই শ্রেয়। তাছাড়া, আমি আমেরিকায় আশ্রয়প্রাপ্ত বিখ্যাত ভারতীয় বিপ্লবীদের কথা দেশে থকতে অনেক শুনেছিলাম, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হতেও আমি আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগর পার হওয়া ছিল বেশ কঠিন কাজ। আমার কোন সমুচিত পাসপোর্ট ছিল না আর আমেরিকার অভিবাসন আইন-কানুন এশিয়াবাসীদের ক্ষেত্রে ছিল পক্ষপাতমূলক। স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা জয় করে এসেছিলেন বটে কিন্তু মার্কিনিরা ভারতবর্ষকে তখনো আবিষ্কার করতে পারেনি।  

জার্মান অ্যাম্বাসেডারের পরামর্শে আমাকে বার্লিনে যেতে হচ্ছে সুতরাং তার অধীনস্থ মানুষ - জন এবং অন্যান্য ক্ষমতাশীল স্বদেশবাসীরা আমেরিকান একটি জাহাজে লুকিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবার ব্যবস্থা করতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। এই জাহাজের নাবিক-মাল্লা সবাই জার্মান। ব্রিটিশ পুলিশ আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছিল। কিন্তু আমাকে তো পিকিং থেকে সাংহাই যেতেই হবে। হ্যাংকাও পর্যন্ত আমি ট্রেনেই গেলাম তারপর ইয়াংসি নদী পার হয়ে নানকিং পৌঁছলাম স্টিমারে। সাংহাই পৌঁছোলেই যে সমস্ত সম্ভাব্য গুপ্ত অনুসরণকারীরা আমাকে পাকরাতে তৎপর হয়ে উঠতে পারে তাদের ঝেড়ে ফেলতে আমি নানকিং ও পুকোর মধ্যবর্তী অঞ্চলে মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক জার্মান গান-বোটে উঠে  পড়লাম। সে বোটে আমি গদর পার্টির এক  নেতা, ভগবান সিংএর দেখা পেলাম। তিনি যাচ্ছিলেন বার্মা, বিদ্রোহী ভারতীয় বিপ্লবীদের উৎসাহিত করতে, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে এখন ফিরে চলেছেন আমেরিকায়। সুতরাং এই মালবাহী বোটে তিনি হবেন আমার আরেকজন পলাতক সঙ্গী। 

সেই গান-বোটের ক্যাপ্টেনের অতিথি হয়ে এক সপ্তাহ আমরা কাটালাম। তিনি আমার এই বোটে যাত্রা করা কতটা অসুবিধাজনক সে কথা বললেন, বুঝলাম এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে আমি খুব প্রীতিকর একজন সহযাত্রীর সাহচর্য পাব না। এই ধীর গতির মালবাহী পোত প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে এক মাস সময় নেবে। ভগবান সিংএর বয়েস হবে ৫০এর কাছাকাছি। দশাসই তার চেহারা, তিনি ইতিমধ্যে মার্কিন-মস্তানদের অনেক অভদ্রতা আয়ত্বে এনেছিলেন, ওদিকে আবার আপত্তিজনক দিশি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি ছিলেন দৃষ্টিকটূভাবে খাদ্যরসিক এবং সঙ্গে বিয়ার পান করতেন গ্যালন গ্যালন। সাংহাই থেকে একজনের আসার কথা, আমরা তার জন্যে অপেক্ষা করছি, সে আমাদের নিয়ে যাবে বোটে, ছাড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে। ভগবান সিং খাদ্য পানীয়ের বিরাট এক লিস্ট প্রস্তুত করলেন। সাংহাই থেকে সেগুলি কিনে আমাদের সামনে হাজির করবেন। তিনি মাসখানেকের ব্যাবস্থা করছিলেন, বোঝা যাচ্ছিল এই একমাস তিনি খানা-পিনা-মৌজে ব্যস্ত থাকার আশায় আছেন।   

শেষে একদিন ভোররাতে আমাদের পাচার করা হল সাংহাই, তারপর গেলাম সেই বোটে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা দেখে বোঝা গেল আনন্দদায়ক সমুদ্র যাত্রার সম্ভবনা নেই। আমাদের জাহাজের পেছনদিকে নাবিকদের বাঙ্কের তলায়, রাডারের পাশে বসতে হবে। বোট ছেড়েছে কি ছাড়েনি, একজন  বৃদ্ধ নবিক এসে খবর দিল ব্রিটিশ পুলিশ খানা-তল্লাশি করতে আসছে। আমাদের লুকোতে হবে। ভীষণ তাড়াহুড়ো করে সে বাঙ্কের একটা তক্তা খুলে ফেলল। অন্ধকার এক গহ্বর দেখা গেল, আমাদের সেই গর্তে নেমে পেটের ওপর শুয়ে থাকতে হবে। দুঃখের বিষয় আমার সঙ্গীর পেটের মাপের তুলনায় গর্তটি তেমন প্রশস্ত ছিল না। দুজন গোদা নাবিকের নিষ্পেষণে তাকে নামতে হলো। শেষে যখন শক্তিমান র‍্যাডারের মন্থন-শব্দে বোট চলতে শুরু করলো, মনে হল বেশ কয়েক যুগ কেটে গেছে।

অন্তরাল থেকে বেড়িয়ে এলাম। বেলা অনেকটা গড়িয়েছে, তরী মাঝ সমুদ্রে। আর ভয় নেই। আমদের বন্ধু সেই প্রাচীন নাবিক আমদের ছোট্ট ঢাকা ডেকে তুলে নিয়ে এলেন, সেখানে একটা বিশালাকৃতির চাকার উপর দিয়ে চওড়া চেন গড়িয়ে যাচ্ছে। যাইহোক আমরা টাটকা বাতাস এবং আলোর আস্বাদ পেলাম। কিছু সময় যেতে না যেতেই আমার বন্ধুর মনে হল দ্বিপ্রাহরিক আহারের সময় হয়ে গেছে। খাবারের একটা বড়ো প্যাকেট ও গোটাকয় বিয়ারের বোতল বেড়িয়ে এলো। দ্বিতীয় দ্রব্যটি দিয়ে তিনি শুরু করলেন, ব্যাঙ্গ করলেন জীবনের আনন্দময় দিকগুলির প্রতি আমার অনীহার কারণে। হঠাৎ ঘূর্ণীয়মান চেন থেমে গেল, র‍্যাডারের গতিও শ্লথ হয়ে গেল এবং আমাদের বোট থেমে গেল। প্রবীণ নাবিক ছুটে এসে আমাদের আবার নিচে যেতে বললেন, অন্যরা ইতিমধ্যে তক্তা খুলে ফেলেছিল। একটা ব্রিটিশ যুদ্ধ-জাহাজ আমাদের থামবার সংকেত পাঠিয়েছে। আবার আমরা নিরাপত্তার জন্যে কবরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু আমার দোসর লাঞ্চ বাদ দিতে অপারগ, তিনি খাবার প্যাকেট নিয়েই গর্তে ঢুকেছেন, বিয়ারের বোতলগুলি অবশ্য ওপরে রয়ে গেছে। ভালো করে তখনো পেটের ওপর স্থিত হইনি, ঠোঙা খোলার খচমচ শব্দ কানে এলো এবং আমার দরদি সহচর আমাকে কিছু নিবেদন করতে চাইলো, ‘বাবুজি সস্যেজ খান।’ আমি জানি না এটা কী বস্তু। আমি তখনো নিরামিষাসী। কতক্ষণ আমি না খেয়ে থাকবো,তিনি সশব্দে বিস্ময় প্রকাশ করে সশব্দেই খাদ্যের স্বাদ নিতে লাগলেন। 

এবার আমাদের ঠিক মাথার ওপরেই পায়ের আওয়াজ ও মনুষ্য কন্ঠ কানে আসায় আমরা চমকে উঠলাম। নাবিকের ছোট কেবিনের ওপর বেশ কয়েকজন মানুষ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে। তাদের কথোপকথন পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি, একটি দাম্ভিক কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আমি নিশ্চিত ছোকরাগুলো এখানেই আছে, কোথায় যেতে পারে?’ এই কথাগুলি বলা হচ্ছে ঠিক আমাদের মাথার ওপরের তক্তার ওপর ভারি বুটের পা ঠোকার তালে তালে। সকরুণ ফিসফিসানি কানে এলো, ‘বাবুজি আব তো পাকড়ায়া।’ চরম বিরক্তিতেও আমার পক্ষে যখন হাসি চেপে রাখা অসম্ভব হচ্ছে তখন ঝরে পরা উষ্ণ কোন তরলে  আমার জামা কাপড় নিজে নিজেই ভিজে উঠলো। সেই কলুষিত স্থানে আরো বেশ কিছুক্ষণ আমাকে পড়ে থাকতে হল। ভাবছিলাম বিপ্লবী হিরো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন কিনা? আমাদের সুহৃদ সেই নাবিক বন্ধুদের উপনিবেশীয় অদম্য পুলিশ অফিসারদের তর্জন গর্জন শুনতে হচ্ছিল। তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আমাদের ঝামেলা মিটল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। সমস্ত মালপত্র উল্টেপাল্টে জাহাজের আগাপাশতলা খানাতল্লাসি করা হয়েছিল। সুতরাং এসব মিটতে বেশ কয়েক ঘন্টা লেগে গিয়েছিল।

আমাদের যখন আবার ওপরের চাকা-ঘরে যাবার অনুমতি দেওয়া হল তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমার সঙ্গী ক্ষুধার্থ নেকড়ের মত খাদ্যদ্রব্যের উপর ঝাপিয়ে পড়ল, সঙ্গে বেশ কয়েক বোতল বিয়ার। খাদ্যের মধ্যে ছিল রুটি, মাখন আর চিজ। ক্লান্তিহর সান্ধ্য বাতাস দিচ্ছিল, কিন্তু ভগবান সিং তখনো আতঙ্কিত। আদিম প্রয়োজন মিটলেই সে জিজ্ঞেস করলো, হতভাগারা রাত্রে ফের হানা দেবে না তো। আমাদের ফেরেশ্তার মতো অভিভাবক আশ্বস্ত করে জানালো যে আমরা প্রাদেশিক জলসীমার বাইরে পৌঁছে গেছি, চারদিন পর আমরা কোবে বন্দরে পৌঁছাবো। এই চার দিনে আমাদের বোট কেউ ছুঁতে পারবে না এবং তারপর আমেরিকান ধব্জাকে উপেক্ষা করার সাহস জাপানিদের হবে না।

কোবে বন্দরে আমাদের জাহাজ সারারাত্রি অবস্থান করবে। জাহাজ নোঙ্গর যখন ফেললো তখন অন্ধকার নেমেছে। জেটিতে জায়গা হয়নি, অনেকগুলি নৌকার মাঝে সে দাঁড়ালো। দেখলাম যেকোন একটা নৌকোতে নেমে পড়ে তীরে পৌঁছানো যায়। আমার সহযাত্রীকে আমি একটা বেশ উত্তেজক প্রস্তাব দিলাম, চলুন এরমধ্যে একটা নৌকোতে চড়ে আমরা তীরে চলে যাই এবং শহরে একটু মজা করে আসি। তিনি বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘ঠিকই, জাপান ছেড়ে  যাবার আগে শেষবারের মত একবার জাপানিবাইজি বাড়ি দেখে না যাওয়াটা দুঃখজনক হবে। আমরা নাবিক বন্ধুবরের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সে রাজি হয়ে বললো দড়ির মই বেয়ে র‍্যাডারের কাছাকাছি যেকোন নৌকোতে আমরা নেমে পড়তে পাড়ি, কিন্তু ফিরে আসতে হবে অন্ধকার থাকতে থাকতেই। নিরাপদে তীরে পৌঁছে খবরটা তাঁকে দিলাম, ‘আমি আর জাহাজে ফিরছি না, আমাকে জরুরি একটা কাজে রাসবিহারীর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে টোকিও। ইয়োকোহামা থেকে আমাকে নৌকো ধরতে হবে। এই অবাঞ্ছিত সঙ্গীটিকে ঝেড়ে ফেলতেই মিথ্যে বলা। সেও তখন তার রাত্রিকালীন প্রমোদ শিকারে ত্বরা করছিল। সুতরাং আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে ঢের সহজেই আলাদা হওয়া গেল। পরম অব্যাহতি পেয়ে আমি টোকিওর প্রথম গাড়িটি ধরতে দ্রুত রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

রাসবিহারীর সঙ্গে আবার দেখা করবার ঝুঁকি নিলাম না। আমি যে আবার তাদের দেশে ঢুকেছি এ খবর জাপানি পুলিশের না পাওয়াই মঙ্গল। এবার তাদের পাতা ফাঁদ থেকে বার হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। টোকিওর একটা হোটেলে উঠে কামরা বন্দি হয়ে রইলাম আর কী ভাবে প্রশান্ত মহাসাগর টপকানো যায় তার মতলব আঁটতে লাগলাম। চীনে থাকতে জার্মানিরা আমার জন্য একটা ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান পাসপোর্টের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল। পাসপোর্টটি দেওয়া হয়েছিল পন্ডিচেরির এক বাসিন্দাকে। দেওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, ধর্মতত্ত্ব পড়তে সে প্যারিস যাবে। ধর্মতত্ত্ব—একটা নির্বিষ উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয়েছে এটি। তবে একজন বৈধ যাত্রী হবার জন্য আমার চাই এই পাসপোর্টের ওপর আমেরিকান ভিসা। আমি স্থির করলাম সম্মুখ সমরেই নেমে পড়বো। কোটের ল্যাপেলে লাগিয়ে নিলাম সোনার ক্রুস এবং অতি বিষন্ন মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম আমেরিকান কনস্যুলেটে। একজন যুবতী আমাকে অভ্যর্থনা করে আমার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। আমার গল্প শোনার পর তিনি পাসপোর্ট নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, একটু পরে তিনি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি শুধু মার্কিন দেশের ভেতর দিয়েই যেতে চাই। ভাবি খ্রিস্টান পাদ্রি আরেকটি অণৃত ভাষণ উচ্চারণ করলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থিয়লজিকাল সোসাইটির পরবর্তী সেমেস্টারে ভর্তি হতে সে প্যারিস পৌঁছাতে চায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে সে আমার পাসপোর্টে সেই অভিপ্রেত ম্যাজিক ছাপটি মেরে আনলো যার বলে, স্বর্গে না হোক ‘ঈশ্বরের দেশে’র দ্বার আমার সম্মুখে উন্মোচিত হয়ে গেল। আমাকে দেখেই নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছিল যে আমি বেশ খুশি। আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই মেয়েটি, যিনি কিনা একটু আগে রূপকথার দেবীর ভূমিকা নিয়েছিল, সে করমর্দন করে আমাকে অভিনন্দন জানাল। তিনি বললেন প্যারিস যাত্রা খুবই চিত্তাকর্ষক ব্যাপার, তিনি বললেন যদি আপনার সঙ্গে যেতে পারতাম। ভারতীয় খ্রিস্টান যুবকের সঙ্গ নিশ্চয়ই খুব আনন্দদায়ক হত। তিনি বললেন, ঠিক আছে, হয়ত আমি একদিন প্যারিস-কনস্যুলেটে বদলি হয়ে যাব।

কৃতজ্ঞ চিত্তে পথে আমি একটি খ্রিস্টান-বইয়ের দোকনে গেলাম এবং আমার অস্ত্রাগারটকে আরো শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে সুন্দর করে রাইস-কাগজে ছাপা মরক্কো-বাঁধাই হোলি বাইবেলের এক কপি কিনে ফেললাম। তারপর গেলাম স্টিমবোটের অফিসে। সেখানে পরবর্তী বোটের ফার্স্ট-ক্লাসের টিকিট কাটলাম। বোটটি ছাড়বে দুদিন পরে। এইভাবে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবার জন্য নিরাপত্তার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে এবার বেপরোয়া একটা কাজ করবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি রাসবিহারীকে জানাতে চাইলাম যে আমি জাপানে আছি এবং মার্কিন দেশ হয়ে জার্মানি যাচ্ছি। গতবার যখন টোকিও এসেছিলাম তখন একজন ভারতীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁকে ধরে রাসবিহারীর দূতের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। সে প্রচেষ্টার খুঁটিনাটির মধ্যে না গিয়ে সংক্ষেপে বলি, গভীর রাত্রিতে আমি রাসবিহারীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম এবং সেখান থেকেই সোজা চলে যাই ইয়কোহামার জাহাজ ঘাটায়। ভোর ভোর আমদের বোট ছাড়ার কথা।

এই প্রথম আমার আরামদায়ক সমুদ্র-যাত্রা। আমাদের জলযানটি একটা বড়সড় জাপানি লাইনার। তখনকার দিনের গতির নিরিখে এ জাহাজটির প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে ২ সপ্তাহ সময় লাগবে। মাঝখানে একদিনের জন্য থামবে হনুলুলুতে। সিঙ্গাপুর থেকে কোবে যাওয়াটাই জাহাজে আত্মগোপন করে যাত্রা করার প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল আমার। অত্মগোপন করেই জাভা থেকে ইন্দো-চীন এবং ফেরত আসা, তারপর জাভা থেকে ফিলিপাইনস। সেসময় এই সমস্ত সফর আরামদায়ক ছিল না, কিন্তু মাঝেমাঝে পর্যটনগুলি হয়ে উঠেছিল বেশ উত্তেজনাপূর্ণ, যেমন হংকংকে এড়িয়ে যাবার তাগিদায় গভীর সমুদ্রে লাইফ-বোটে চড়ে এক জাহাজ থেকে অন্য এক জাহাজে গিয়ে ওঠা। 

ইতিপূর্বে আমি দু-দফায় বঙ্গোপসাগর পার হয়েছি, গিয়েছিলাম মাদ্রাস থেকে পেনাঙ এবং সেখান থেকে আবার ফিরে আসা। এ যাত্রায় পাসপোর্ট লাগে না এবং আমি ছিলাম বৈধ একজন যাত্রী। কিন্তু তখন আমি নিতান্তই নাবালক, জাহাজের প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের ইয়োরোপীয়ান আদপ-কায়দা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। আমার সহযাত্রীরা ছিলেন ব্রিটিশ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেনা, ঔপনিবেশিক আধিকারিক আর রাবার ব্যবসায়ী। নেটিভদের প্রতি তাদের ব্যবহার ঔদ্ধত্বপূর্ণ এবং কঠোর না হলেও, ছিল শীতল আর ক্ষমাশীল ধাঁচের। তাই আমি এসব যাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়তাম এবং কোনভাবেই সমুদ্র যাত্রা উপভোগ করতে পারতাম না।  

প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে এই দীর্ঘ যাত্রার অভিজ্ঞতা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। এই মধ্যবর্তী সময়ে আমি অনেকটাই বিশ্বনাগরিক হয়ে গেছি। আমি এখনো নিরামিশাষী ঠিকই তবে ইয়োরোপীয়ান কায়দায় খেতে এবং পোশাক পরতে শিখেছি, সুতরাং অপরিচিত সঙ্গে আর অস্বস্তি বোধ করছিলাম না।

  প্যাসিফিকের ওপর দিয়ে আমার এই দু সপ্তাহের জাহাজের অভিজ্ঞতা যেন পলকা বরফের ওপর দিয়ে স্কেটিং করা। প্রথম শ্রেণির সেলুনের খাবার টেবিলে যারা খেতে আসতেন তাদের বেশির ভাগ জাপানি। যাত্রীদের অধিকাংশই সে দেশের। বাদবাকিরা ছিলেন জাপান, চীন প্রভৃতি প্রাচ্য দেশ ফেরত আমেরিকান খ্রিস্টান মিশনারি। এদের মধ্যে আবার অনেকে বেশ কয়েক বছর ভারতে কাটিয়েছেন। আপনারা কল্পনা করে নিতে পারছেন যে একজন অখৃস্টানের পক্ষে শিক্ষিত খ্রিস্টান ধর্ম-পন্ডিতদের অনুকরণ করা কতটা কঠিন অথবা একজন বশংবদ শিক্ষানবিশ যে কিনা পুরুতগিরির অভিলাষী। পরিস্থিতি্ পূর্বানুমান করে আমি একটা এক শয্যা বিশিষ্ট কামরা নিলাম যতে ভিড়াক্রান্ত ডেক এড়িয়ে চলতে পারি। আমি যদি অসুস্থতার ভান না করি তবে অলক্ষিত থাকা বেশ মুশকিল, কিন্তু আমি তা করতে লজ্জা বোধ করলাম। কুখ্যাত চীন সমুদ্রের ঝাপটা খেয়ে আমি একজন পোক্ত নাবিক হয়ে উঠেছিলাম এবং আমার মজবুত শরীরের জন্য আমার গর্বও ছিল। ম্যানিলা থেকে নাগাসাকি যাবার পথটুকুতে আমাদের জাহাজ খোলের মতো দোল খেল। একমাত্র আমি একাই এই দুর্যোগে সুস্থ থেকেছিলাম।।

বিষয়টা হল আমি এই দু সপ্তাহব্যাপী সাগর-পাড়িতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। খাবার টেবিলে আছেন একজন আমেরিকা-যাত্রী, দক্ষিণ ভারতীয় মহিলা, তিনি শিক্ষকতা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে আমেরিকা চলেছেন, আরেকজন একেশ্বরবাদী আমেরিকান পাদ্রি, ইনি টোকিয়োতে দর্শনশাস্ত্র পড়ান। খাবার টেবিলে এদের দুজনের মাঝে আমি বসি। দ্বিতীয়জন আমার কাছে বেশ সুবিধাজনক সহযাত্রী কেননা তার কথাবার্তা প্রধানত স্বগতোক্তি, আমাকে শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতে হয়। তার কথাবার্তাও চিত্তাকর্ষক, যদিও তার ধর্মতত্ত্ব মাঝেমাঝে বেশ দুর্বোধ্য। একদিন তিনি আমার ঘড়ির চেন থেকে ঝুলন্ত ক্রুসটির দিকে আঙুল তুলে বললেন, কেন আমি এটা পরেছি। খ্রিস্টান পাদ্রির কাছ থেকে এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুলে আমি অবাক। খ্রিস্টানদের মধ্যে সম্প্রদায়গত ভাগাভাগির ঘোরপ্যাঁচ সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আমি জানতাম না যে একেশ্বরবাদীরা ট্রিনিটি বা যিশুর ক্রুশারোহনের কাহিনীতে বিশ্বাস করে না, ফলে আমি চিরাচরিত উত্তর দিলাম। তিনি তার চরিত্রানুসারে ভদ্রভাবে হাসলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কী সত্যি বিশ্বাস করি যে যিশুখ্রিস্ট সত্যি ছিলেন এবং ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। আরো অবাক হয়ে আমি আত্মরক্ষাত্মক অবস্থানে ফিরলাম, বললাম আমি ক্রুশটা ধারণ করি একারণেই যে এটি এক উচ্চতম আদর্শবাদের প্রতীক, এক মহান আদর্শের কারণে আত্মবলিদান। এরপর সেই দর্শনের অধ্যাপক তার দীর্ঘতম স্বগতোক্তিতে ডুবে গেলেন, এই স্বগতোক্তিতে কোন সুনির্দিষ্ট মতামত প্রকাশ পেল না, বরং তা যেন আত্মবিলাপের মতো। 

আমার অপর সহযাত্রী মহিলা ছিলেন অধিক ঝঞ্ঝাট বহনকারিনী, যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কোন ঝঞ্ঝাট সে পাকাতে চায় না বরং সে বেশ মজাদার এবং বন্ধুবৎসল। দুজনেই ভারতবর্ষীয়, যদিও জাতিগত পরিচয়ে একজন সৎ এবং অপরজন ছদ্ম রেনিগেড, আমরা আলাপ শুরু করলাম আমাদের ছোটবেলার কাহিনী দিয়ে। ভারত মাতার সাংস্কৃতিক ঐক্যের ভাষাগত বিভিন্নতা আমাকে সাহায্য করল এই ব্যাখ্যা দিতে যে কেন পন্ডিচেরী নিবাসী হয়েও আমি মেয়েটির মাতৃভাষা তামিল বলতে পারি না। জন্মসূত্রে আমি বাঙালি, চন্দননগরে থাকার সূত্রে ফরাসী নাগরিক, মাত্র কয়ের বছর পন্ডিচেরীতে বাস করছিলাম ফ্রান্সের কাছাকাছি আসবার উদ্দেশ্যে। মিস গ্রে (তার এই নাম) আমার বিশ্বনাগরিকত্বের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ। আমি জানতে পারলাম সে একজন অনাথ মহিলা, খ্রিস্টান কোন প্রতিষ্ঠানে সে বড় হয়েছে এবং সে কেবল ইংরেজী বলতে পাড়ে। সে ইংরেজি পড়িয়ে আসছে বহুদিন যাবত। সে একজোড়া মিশনারির সঙ্গে চলেছে তাদের দত্তক কন্যা হিসেবে। মিস গ্রে’র গায়ের রঙ বাদামি, তবু কিন্তু তার সুভদ্র আমেরিকান অভিভাবকেরা একজন কালো আদমির সঙ্গে মেয়ের মেলামেশা ভালো চোখে দেখছেন না। কিন্তু তার আমার সঙ্গে মেলামেশার জন্য জোরাল যুক্তি ছিল। তার গায়ের রঙের কারণে সাদা চামড়ার  মানুষজনের সঙ্গে তার মেলামেশা সম্ভব ছিল না, জাপানিরা পর্যন্ত নিজেদের উঁচুবর্ণের প্রতিনিধি বলে ভাবতে লাগলো। ভাগ্য সহায়, তাদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা করতে উদ্যোগী না হতে গেলে, সে অবশ্য এতো বৈষম্য খেয়াল করতো না। আমি এসময় ডেকে একটা নির্জন কোণ খুঁজে নিয়ে বাইবেল পড়অতাম, পড়ে যেতাম বারবার। এতে আমার লাভ হয়েছিল। অন্য যাত্রীরা আমাকে নিয়ে কানাকানি করতো, বলতো এ একজন ধর্মতত্ত্বের ছাত্র, এ নিশ্চয়ই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করবে।

এক প্রভাতে ডেকে অবিস্মরণীয় এক প্রদর্শনী দেখতে পেলাম। গতকাল পর্যন্ত জাপানিরা তাদের জাতীয় পোশাক পরিধান করেই ছিল, শুধু অফিসারেরা নৈশভোজের টেবিলে নৈশভোজের উপযুক্ত পরিচ্ছদ সজ্জিত হয়েই আসতেন। সে সকালে কারও গায়ে আর কিমানো দেখা গেল না, সকলেই ইয়োরোপিয়ান পোশাকে নিখুঁত সজ্জিত হয়ে এসেছে। মিস গ্রে, তিনি শাড়ি পরিহিতা নন, জাপানিদের অনুকরণপ্রবনতা সম্পর্কে শ্লেষাত্মক কিছু মন্তব্য করলেন। আমিও খুব একটা জাপানিদের পছন্দ করতাম না ,আমি তার সঙ্গে সহমত হলাম। এই যে জাপানিদের বহিরাঙ্গের পরিবর্তন তার কারণ হলো জাহাজ হনুলুলুর কাছাকাছি এসেছে। বিকেলে আমরা আমেরিকান সভ্যতার চৌকিতে এসে পৌছঁলাম। সমস্ত যাত্রীরাই আমুদে শহরটিতে রাত কাটাতে নেমে গেল। সমুদ্র সৈকতে পায়চারি করবার জন্য দর্শনের অধ্যাপক আমাকে ডেকে নিলেন। আমরা জাহাজে ফিরে এসে এক শান্তিপূর্ণ সন্ধ্যা কাটালাম। ডেক থেকে শহরের অতুলনীয় আলোকসজ্জা দেখতে লাগলাম। এটাই আমার প্রথম কোন আমেরিকা নগরী দর্শন। 

 

0 Comments
Leave a reply