লোকবিশ্বাসে সিঁদুর

লিখেছেন:চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত

 

ভারতবর্ষের পূর্ব অংশের রাজ্যের মহিলাদের বিবাহ চিহ্ন লাল বা মেটে রঙের একটি গুঁড়ো, অর্থাৎ সিঁদুর,যা মাথায় চুলের ফাঁকে সিঁথিতে পরা  হয়। বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার বাঙালিরা এবং নেপালের বিবাহিতা মেয়েরাও সিঁদুর পরে। সিঁদুরের সঙ্গে লোকাচার ছাড়াও স্বামীর মঙ্গলের সম্পর্ক রয়েছে। তাই বিবাহিতা বহু মেয়েকেই “সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক” বলে আশীর্বাদ করা হয়। একই কারণে বৈধব্য হলে সেই সিঁদুর তুলে দেওয়া ধর্মীয় বিধান, বলাও হয় যে সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে। 

প্রাচীনকাল থেকেই নানা প্রত্ননিদর্শন ও রচনায় সিঁদুরের অস্তিত্ব রয়েছে:

১. বেলুচিস্তানের মেহেরগড় থেকে উৎখনন করা নিওলিথিক যুগের নারী মূর্তিগুলোতে দেখা যায় সিঁথিতে সিঁদুরের মতো রঙের প্রয়োগের ইঙ্গিত রয়েছে।
২. জনশ্রুতি অনুযায়ী রাধা কুমকুম অর্থাৎ সিঁদুর দিয়ে কপালে শিখার মতো একটি নকশা তৈরি করেছিলেন, যে লাল রঙ দেখে কৃষ্ণ কামতাড়িত হয়েছিলেন।
৩. মহাভারতে দ্রৌপদী হস্তিনাপুরে ঘটে যাওয়া বস্ত্রহরণ ঘটনায় তাঁর স্বামীদের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশা ও ঘৃণায় সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলেছিলেন।
৪. ললিতা সহস্রনামা ও সৌন্দর্য লহরী গ্রন্থেও সিঁদুর ব্যবহারের উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। 


এইভাবে সিঁথি লাল হয়ে ওঠার আবার একটি নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও রয়েছে - আদিমকালে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন ছিল। অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তুলনায় দুর্বল গোষ্ঠীটি হেরে গেলে, বিজয়ী দলের পুরুষরা লুঠপাট চালাত। তাতে বস্তুহরণ যেমন ছিল, তেমনই ছিল বিজিত গোষ্ঠীর নারীদের হরণ। তারপর লুঠের "মাল" ভাগ বাটোয়ারা করার সময় নাকি কোনো বীরপুঙ্গব পছন্দের কোনো মেয়ের মাথায় বাড়ি মেরে রক্তপাত ঘটিয়ে নিজের সম্পত্তির প্রমাণ দাখিল করত। সেই রীতিটিই নাকি আজকের সিঁথির সিঁদুরের পূর্বপ্রতিমা। নারীবাদীরা এমন ব্যাখ্যা যে ঘোরতর অপছন্দ করেন, তা বলাই বাহুল্য। সেসব নিয়ে কোনো বিতর্কে যাবোনা এই লেখায়। 

বরং আজো সিঁদুর নিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় জাতিকৌমের বিবাহের যে নানা রীতি রয়েছে, সেগুলোর প্রতি আলোকপাত করা যাক -

ক. মাহালি: বর কনে একসঙ্গে পিঁড়িতে বসে। গ্রামের সমস্ত মানুষের উপস্থিতিতে বর কনের সিঁথিতে পাঁচবার সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। তবে সিঁদুর পরাবার আগে কনের বাবাকে পণের টাকা মিটিয়ে দিতে হয়। নইলে সিঁদুরদান হয়না।
খ. মুন্ডা: বরের গায়েহলুদের সময় তার কড়ে আঙুল একটু কেটে নি:সৃত রক্ত দিয়ে একটা ন্যাকড়া ভিজিয়ে রাখা হয়, যার নাম সিনাই। বিয়ের ঠিক আগে সেই সিনাই বর প্রথমে নিজের ঘাড়ে ছোঁয়ায়, তারপর কনের গলায় ছোঁয়ায়। এরপর তারা নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ালে শুরু হয় সিঁদুরদানের আচার যাতে বর ও কনে দুজনেই পরস্পরের কপালে তিনবার সিঁদুর দিয়ে চিহ্ন দেয় আর মালাবদল করে বিবাহ সম্পন্ন করে। লক্ষণীয় যে এখানে দুজনেই দুজনকে সিঁদুর পরায়, যা লিঙ্গসমতার ইঙ্গিতবাহী।
গ. খাড়িয়া: সর্বসমক্ষে কনে সম্প্রদান হলে বর ও কনে নিজেদের আসনে উঠে দাঁড়ায় এবং পরস্পরের কপালে সাতবার সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। এরপর মালাবদল করা ও গাঁটছড়া বাঁধা হয়। সিঁদুর বিনিময়ের পরেই উৎসব করতে ধামসা আর মাদল বাজানো হয়। এই বিবাহটিও লিঙ্গসমতার ইঙ্গিতবাহী।
ঘ. হো: এই জাতিকৌমের বিবাহে অবশ্য বরপক্ষকেই কন্যাপণ দিতে হয়। তারপর বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর দেবার অধিকার পায়। হো বিবাহ চার রকমের।  তার মধ্যে অন্যতম 'দিকু আন্দি' বিয়ের সময় বর ধারালো ছুরি হাতে কনেকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে শেষ প্রদক্ষিণের সময় তার কপালে সিঁদুরের টিপ দেয়। এর অর্থ কনেকে পরবর্তীকালে স্বামী হিসেবে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। আরেক ধরণের বিয়ে হল 'অপরতাপি বিবাহ' যখন ছেলে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে কনের বাড়ি গিয়ে জোর করে তার কপালে সিঁদুর লেপে দেয়। শুধু বাড়িতে নয়, হাটে বাজারে, যেকোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো মেয়ের মতামত না নিয়ে তার কপালে সিঁদুর লেপে দিলেই তাকে বৈধ স্ত্রী বলে সমাজ মেনে নেয়। তবে এ ধরণের বিয়েকে এখন হো সমাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।
ঙ. সাঁওতাল: সাঁওতাল জনজাতির মধ্যে ৭ রকমের বিয়ের প্রচলন আছে। মোটামুটি দেখা যায় বিবাহ মন্ডপে তিনবার বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করার পরে বর শালপাতায় মোড়া সিঁদুর বের করলে, জগা মাঝি (গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতাশালী সদস্য) কনের মাথা গামছা দিয়ে ঢেকে দিয়ে তাঁর পাওনা পাগড়ির জন্যে অপেক্ষা করেন। সেটি বর দিয়ে দিলে তিনি গামছা খুলে নেন। বর তখন পৃথিবীর উদ্দেশে মাটিতে তিনবার সিঁদূর ফেলে তারপর পূবদিকে মুখ করে সূর্যদেবকে সাক্ষী রেখে কনের সিঁথিতে তিনবার সিঁদুর লেপে দেয় আর গ্রামের লোকে "হরিবোল সিঁদুরদান" ধ্বনিতে মুখর হয়। এটি 'কিরিঞ বাপলা' বিয়ে, যা দুই পরিবারের সম্মতিতে হয়। কিন্তু এর ঠিক বিপরীত' ইতুৎ সিদুর বাপলা' হল জবরদস্তি করে বিয়ে, যেখানে ছেলেমেয়ের মধ্যে ভাল ভালবাসা সত্ত্বেও পরিবারের অমত থাকলে সুযোগ বুঝে ছেলেটি মেয়েটির সিঁথিতে জোর করে সিঁদুর লেপে দেয়। সাঁওতাল আচারে একবার সিঁথিতে সিঁদুর লাগলে সমাজ সেই মেয়েকে সেই ছেলের বৈধ স্ত্রীয়ের স্বীকৃতি দেয়। বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা সাঁওতাল মেয়েদের দ্বিতীয়বার বিয়েও সমাজ স্বীকৃত, কিন্তু বিয়ের সময় বর একটি সাদা ফুলে তিনবার সিঁদুর লাগিয়ে অন্যদিকে মুখ করে কনের খোঁপায় সেই ফুল গুঁজে দেয়।
চ. লোধা: এই জাতিকৌমের বিবাহে মন্ত্রোচ্চারণ হয়না। কনের কপালে ও মাথায় বর সিঁদুর দিলেই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়। তারপর জোড়ে "দেহরি" অর্থাৎ দেবতার কাছে তারা সুখী সংসারের আশীর্বাদ চায়।
ছ. শবর: এই জাতের বিবাহে কন্যা সম্প্রদান হলে বর বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে কনের সিঁথিতে সাতবার সিঁদুর লাগিয়ে দেয় এবং মালা বদল করে।
জ. ভূমিজ: মন্ত্রপাঠ করে কন্যা সম্প্রদানের পরে বর ডানহাতের কড়ে আঙুল দিয়ে তিনবার কনের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। এ সময় দুজনে হাত ধরে থাকে। সিঁদুরদানের পরে বর কনের হাতে বালা পরিয়ে দেয় আর উপস্থিত অতিথিরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
(গ, ছ এবং জ -- তিনটি কৌমের বিবাহ আচারেই বেজোড় সংখ্যায় সিঁদুর পরানো হয়। ৩ সংখ্যাটি লোকবিশ্বাসে একটি পরিবারের প্রতীক, অর্থাৎ পুরুষ নারী ও তাদের মিলনে উৎপন্ন সন্তান। ৭ সংখ্যাটি আবার ভারতীয় বিশ্বাসে শুভবাচক ----- হিন্দু বিয়েতে সপ্তপদী নামে একটি আচার আছে, যাতে আগুনকে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে করতে বর-কনে প্রতিটি পদক্ষেপে একটি করে মোট সাতটি প্রতিজ্ঞা করে। যেমন - একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, সম্মান করা, এবং সব পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে থাকা ইত্যাদি। এই আচারের মাধ্যমে বর-কনে তাদের নতুন জীবনের সূচনা করে।
ঝ. বিরহড়: বর কনে যথাক্রমে পশ্চিম ও পূব দিকে মুখ করে দাঁড়ালে চারদিক পর্দা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। তারা পরস্পরের দিকে চাল ছুঁড়ে দেয়। তারপর দুজনের আঙুল থেকে এক ফোঁটা করে রক্ত বের করে একটি কাপড়ের টুকরোর ওপর লাগানো হয়। রক্তলাগা কাপড় বর বউ পরস্পরের গলায় তিনবার করে বোলায়। এরপর বর মাটিতে তিন ফোঁটা তেল ফেলে তাতে সিঁদূর মেশায়। তারপর পাঁচজন সাক্ষীর সামনে সেই তেলসিঁদুর কনের কপালে ও সিঁথিতে পরিয়ে দেয়।  খ এর সঙ্গে এই আচারের মিল পাওয়া যাচ্ছে।)
ঞ. কোঁড়া: সমাজের পাঁচজন মান্য ব্যক্তির সামনে বর কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেয়।
ট. এবার আমাদের পরিচিত হিন্দু বাঙালিদের বিয়েতে আসা যাক : চোখ ঢেকে পিঁড়িতে চড়ে বরকে সাতবার প্রদক্ষিণ করার পরে কনের সঙ্গে তার শুভদৃষ্টি ও মালাবদল হয়। তারপর কন্যাসম্প্রদান, দুজনের যথাক্রমে ডান ও বাঁ হস্তবন্ধন করে মন্ত্রোচ্চারণ করা, আগুনকে ঘিরে জোড়ে সাতপাকে প্রদক্ষিণ করে, লাজাঞ্জলি দিয়ে পাশাপাশি আসনে বসার পরে বর অন্যদিকে তাকিয়ে আঙটি বা কুনকে দিয়ে বাঁ পাশে বসা কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলে, লজ্জাবস্ত্র দিয়ে কনের মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। কনের নাকের ওপর সিঁদুর ঝরে পড়লে সবাই বলে স্বামী তাকে খুব ভালবাসবে। বিয়েতে সিঁদুর কৌটো উপহার হিসেবেও খুব জনপ্রিয়।

সিঁদুরের লাল রঙের কিছু অন্য তাৎপর্যও আছে। লাল রঙ নারী হয়ে ওঠার প্রতীক অর্থাৎ রক্তস্রাব হয়ে ঋতুমতী হবার সংকেত, যার ফলে সে সন্তান ধারণে সক্ষম হয়। আবার এমন বিশ্বাসও আছে যে লম্বা সাদা সিঁথির গোটা দৈর্ঘ্যে লাল রঙের উপস্থিতির অর্থ কোনো নারীর অক্ষত যোনিতে প্রথমবার পুরুষের শারীরিক সংস্পর্শের কারণে সতীচ্ছদ হয়ে রক্তপাত হওয়া। তাই একটি মেয়ের যখন বিবাহ জীবন শুরু হয় তখন ধরে নেওয়া হয় সে ঋতুমতী ও সন্তান ধারণে সক্ষম (অপ্রাপ্তবয়স্ক বিবাহের ক্ষেত্রে অবশ্য এ সবই লঙ্ঘিত হয়।) এরপর স্বামীর সহবাসে তার সতীচ্ছদ হয়ে তার বিবাহ পরিপূর্ণতা পাবে (consummation of marriage)। ভবিষ্যতে এই সমাজস্বীকৃত সহবাসের ফলে সে সন্তান ধারণ করে স্বামীর বংশের গতি অক্ষত রাখতে পারবে। 

সিঁদুর তাই আর শুধুমাত্র বিবাহ চিহ্ন নয়, নারীত্বপ্রাপ্তি, বিবাহের সম্পূর্ণতা ও সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাকেও প্রতীকায়িত করে। সেই কারণে বাঙালি সমাজে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের আগে দেবীকে সিঁদুর পরিয়ে বরণ করে শুধু বিবাহিত মেয়েরা এবং পরবর্তী সিঁদুরখেলাতেও তাদেরই যোগদান বিধেয়। 

তবে সিঁদুর যে শুধু মেয়েদের তা নয়। সিঁদুরের লাল রঙের সঙ্গে যেহেতু রক্তের সম্পর্ক রয়েছে তাই একটু পিছিয়ে গেলে মনে পড়বে সেকালে ডাকাতরা লুঠপাট করতে যাবার আগে শক্তিদেবীকে (মূলত: দেবী কালী) পুজো দিয়ে থান থেকে পুজোর উপাচারের সিঁদুর দিয়ে কপালে তিলক আঁকত। এমনকী শত্রুর রক্ত দিয়েও তিলক আঁকার প্রচলন ছিল। অতিমাত্রায় উগ্র প্রেমিক আবার সিঁদুর না পেলে নিজের আঙুল কেটে বাঞ্ছিতার সিঁথিতে সেই রক্ত লাগিয়ে দিয়ে তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করত। এখনো পুজোর শেষে কপালে পবিত্র সিঁদুরের টিপ বা টীকা আঁকা প্রচলিত আছে। অর্থাৎ রক্ত ও সিঁদুর সমীকৃত হয়ে যায় কখনো এবং তা শক্তি, প্রতিহিংসা, স্বীকৃতি ও দৈব আশীর্বাদকেও প্রতীকায়িত করে। 


কিন্তু ইদানীং সিঁদুরকে নিয়ে নানা আধুনিক ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, যার অন্যতম হল সিঁদুর নাকি সাজের বা মেকাপের অঙ্গ। তাই অবিবাহিত মেয়েরাও সাজের জন্যে লাল সিঁথি রাখতে পারে। একই যুক্তিতে তারা পুজোর সিঁদুর খেলাতেও অংশ নিচ্ছে। এই সূত্রে সিঁদুর নিয়ে দুটি ঘটনা বলি : 

এক বিখ্যাত দক্ষিণী অভিনেত্রী সামাজিক ভাবে বিধবা। কিন্তু তিনি অনেক বছর ধরে সিঁদুর পরে থাকেন। কৌতূহলী সাংবাদিকদের প্রশ্নে জানিয়েছিলেন তিনি তাঁর মাকে ভালবাসেন বোঝাতে সিঁদুর পরেন, দক্ষিণ ভারতীয় রীতি মেনে। দক্ষিণ ভারতের সমাজে অবশ্য এমন কোনো রীতি আছে কী না জানা যায়না। নিন্দুকেরা বলে কোনো এক বিশেষ পুরুষের সঙ্গে বিবাহ না হলেও, তাঁর প্রতি গভীর প্রেমের অনুভূতি থেকে তিনি সিঁথি রাঙিয়ে রাখেন এবং মানসিকভাবে নিজেকে বিবাহিত ভাবেন। 

দ্বিতীয়টি অতি সাম্প্রতিক। ফ্রান্সে সদ্যসমাপ্ত বিখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবের ফ্যাশন শোতে বিশ্বের তাবড় তাবড় সুন্দরী অভিনেত্রীদের সমাগম হয়েছিল, যাঁরা লাল কার্পেটে হাঁটলেন অনুষ্ঠানের প্রথা মেনে। এবারে অনেক ভারতীয় শিল্পীরাও ছিলেন। কিন্তু নজর কেড়েছেন এক বিশ্বখ্যাত ভারতীয় শিল্পী যিনি সাদা পোশাকের সঙ্গে গা ভর্তি লাল গয়না আর সিঁথি ভর্তি সিঁদুর দিয়ে তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট প্রদর্শন করেছেন। এ নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে কারণ সংবাদমাধ্যমের দৌলতে তাঁর বিবাহিত জীবন নিয়ে অনেকদিন ধরেই নানা কিছু শোনা যায়, এমনকী বিচ্ছেদের কথাও। তাই অনেকের মতে সিঁথিভরা সিঁদুর এঁকে তিনি এভাবেই নিঃশব্দ প্রতিবাদে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সমালোচকদের রুচিবিহীন অনুপ্রবেশ বন্ধ করিয়েছেন। 

কিন্তু মুশকিল হল, অনেকে আবার এই অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। তাঁরা যে জটিল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ---- সেটি রাজনৈতিক তো বটেই, সাম্প্রদায়িকও। অল্প কিছুদিন আগে জঙ্গী হানায় আমাদের দেশের কিছু নিরীহ নাগরিকের প্রাণ গেছে। শোনা গেছে অন্য ধর্মভুক্ত বিদেশি জঙ্গীরা গুলি করার আগে ধর্ম জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল। সেই আক্রমণে বিধবা হয়েছিলেন যে নারীরা, তাঁদের সেই মুছে যাওয়া সিঁদুরের স্মরণে আমাদের সেনাবাহিনী তাদের সশস্ত্র প্রত্যুত্তরের নাম রেখেছিল  “অপারেশন সিঁদুর”........... এই নামকরণে আপাতভাবে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়, কিন্তু এই ঘৃণ্য জঙ্গী নাশকতার সঙ্গে বড্ড বেশি করে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে ধর্মকে। তাই সিঁদুরের নামে প্রতি আক্রমণটাও হয়ত পালটা একটা সাম্প্রদায়িকতাকেই উস্কে দেয়। ফলে বিশ্বসুন্দরী নায়িকা ব্যক্তিগত না ধর্মীয় না রাষ্ট্রীয় ---- ঠিক কোন কারণে মিডিয়ার ভরা বাজারে সিঁথি রাঙিয়ে কার্পেটে এলেন, তা যেমন বলা মুশকিল, তেমনই তিনি সিঁদুর পরে সেনাদের সমর্থনে বিদেশের মাটিতে দেশভক্তি প্রদর্শন করেছেন, এমন ব্যাখ্যাও অকাট্য মান্য নয়, কারণ তিনি গত দুদশক ধরে একটি আন্তর্জাতিক পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যডার হিসেবেই কান এ যান, একথাও সবার জানা। 

তবে সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে আজ অবধি সিঁদুর যে নানা ব্যঞ্জনায়, নানান প্রয়োজনে ভারতীয় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে আছে তা অবশ্য অস্বীকার করা যায়না। তাই আজো রবীন্দ্রনাথের বাঁশি কবিতার সেই একটি পঙক্তি "পরণে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর", রোম্যান্টিকতা ও পরিপূর্ণ গার্হস্থ্য জীবনের অন্যতম সেরা প্রতীক হয়ে আছে।

তথ্যসূত্র :
১৷ "সিঁদুর", ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, লোকসংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকা, ১৯৯৫ ( জুলাই সংখ্যা)
২। বাঙালী জীবনে বিবাহ, শঙ্কর সেনগুপ্ত, ১৯৭৪

 

0 Comments
Leave a reply