কোশী নদী পেরিয়ে

লিখেছেন:শাশ্বত বোস

 

 

১ 

সাতপুরোনো কালের নাটদালানে উপুড় করে রাখা বিশাল ঢাকটার দিকে একমনে চেয়েছিল স্বপন। এতো বড় ঢাক - এর আগে জীবনে ও একবারই দেখেছে। ছোটবেলায় মায়ের সাথে মামাবাড়ি গিয়ে ঢাকি পাড়ায় পড়ে থাকত ও দুবেলা। সেই পাড়ায় রতন ঢাকির বাড়িতে এমন জয়ঢাক দেখেছে ও। এই ঢাকটা লম্বায় প্রায় হাতদুয়েক। বিশাল মোটা পেটটা নিয়ে শান বাঁধানো মেঝেতে শুয়ে আছে, যেন দ্বারভাঙা থেকে আসা ভীম পালোয়ান গায়ে চুপচুপে করে তেল মেখেছে, বেশ কয়েক হাত মুগুর ভাজার পর আশ্বিনের ভেজা রোদে গা দিয়ে জিরোচ্ছে এখন। আজ এটাকে দেখে ছোটবেলায় দেখা ঢাকি পাড়ায় ঢাক ছাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল স্বপনের। ও পাড়ায় দিনরাত পড়ে থাকতে থাকতে ঢাকের বেশ কয়েকটা বোলও শেখা হয়ে গেছিল ওর। আজও স্বপন বেশ মনে করতে পারে, পুজোর আগে মামাবাড়ি গেলে ঢাকিদের ‘টট্টরি’ তে ঘুম ভাঙতো গোটা গ্রামের। লাইন করে ধানক্ষেত আর রেললাইনের পার ধরে ওরা চলে যেত ইস্টিশনের দিকে। সেখান থেকে রেল ধরে সোজা শিয়ালদহ। কেউ আবার যেত উল্টো পথে। কাশের বনের হালকা দুলুনিতে গা ভাসিয়ে ছায়াগুলো মিলিয়ে যেত নবাবগঞ্জের দিকে, সেখানে চৌধুরী বাড়িতে পুজো হত যে! দু তরফের দুটো পুজো, তাই ঢাকির দলও বুড়ো বটতলা থেকে বড় নদীর দুই ধারার গা বরাবর দুদিকে ভাগ হয়ে যেত। প্রায় ফুরিয়ে আসা জীবনটার কোণ বরাবর, প্রিজম রেখা বেয়ে কমলা রঙের রোদটা তখন ওদের কাঁধে ঝুলতে থাকা ঢাকগুলোর গায়ে পিছলে পড়ে মিইয়ে যাচ্ছে, শরীরের তালে তালে ঢাকগুলোর পিছনে বাঁধা মুরগীর পালকের লেজগুলো লাফাচ্ছে সমানে, - খুব ভোরের অল্প আঁচের উনুনের ধোঁয়ার মত ছবিগুলো হঠাৎই মনের মধ্যে ভেসে উঠতে থাকে স্বপনের। এই ঢাকটার গায়ের লোহার পাতে অবশ্য জং পড়ে গেছে। ঢাকের ওপর পড়ে থাকা কাঠিদুটোর পেছনে কাপড়ের ন্যাকড়া প্যাঁচানো। এই ঢাক কাঁধে নিয়ে বাজানো কোনো কুস্তিগীর পালোয়ানের পক্ষেও সম্ভব নয়। এক জায়গায় জগদ্দল পাথরের মত বসে থেকে চড়াম চড়াম বাজে এই ঢাক।

“মশাইয়ের কাছে আগুন আছে কি?” ফিনফিনে মিহি গলার আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে স্বপন। পিছনে যেন কে এসে দাঁড়িয়েছে। এসময়টা এখানে কে আসতে পারে! বারান্দার ঐদিকের পিলারে রহমান কাজ করছে আর এইদিকের কোণের পিলারটায় স্বপন। ২২-২৪ ইঞ্চির পেল্লাই পিলার এক একখানা, সেখান থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলে ঝুলে কাজ করতে করতে শরীরে খিঁচ লাগে স্বপনের। তার ওপর কাল রাতের বাবার পেসাদটা দু ছিলেম বেশী টানা হয়ে গেছিল বোধহয়, মাথার ভেতরটায় এখনও বোবা ধরে আছে। পিছন থেকে আবার গলা খাঁকাড়ির শব্দ ভেসে আসে, “কথাটা বাবুর কানে গেলো না বুঝি? অ! কত্তার ওদিকে তামুক সেবনের সময় হয়েছে, হীরালালটা আগুন নিয়ে বাজার থেকে ফেরেনি এখনও। তা বাপু রঙের কাজ পেইচ, বিড়ি টিরি ধরাও তো নাকি?” ভীষণ রকম হকচকিয়ে গিয়ে স্বপন এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকায়। একটা মাঝবয়সী খেঁজুরে মার্কা চেহারার লোক, কালো পানা গায়ের রং, মাথায় বিশাল টাক যেন নোয়াপাড়ার ফুটবল খেলার মাঠ, দুপাশে পাতলা ফিনফিনে দুধ সাদা চুল হাওয়ায় অল্প উড়ে ঘেঁটে গিয়ে উবরে যাওয়া বনলাটিম ফুলের মত দেখাচ্ছে। চোখদুটো কোটরে ঢোকানো, তার ওপর নাকের ডগায় শিয়াল পন্ডিতের মত একটা ময়লা হয়ে যাওয়া গোল ফ্রেমের চশমা ঝুলছে। পরনে কোর্টের আবদালীর মত পোশাক। হাতের রঙের কৌটো আর তুলির বুরুশটা পাশের আংটায় ঝুলিয়ে রেখে, দড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে মাটিতে নেমে আসে স্বপন। লোকটার সাথে চোখাচুখি হয় তার, একটু যেন ঠান্ডা নিশ্বাসও গায়ে এসে লাগে। লোকটা অমনি অভদ্রতা করে, রোগা রোগা ঠ্যাং নিয়ে তিড়িং বিড়িং করে বার তিনেক লাফিয়ে, দু পা পিছিয়ে যায়। “এই ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না বলে দিচ্চি, বলি কি জাত? মুখ দেখে তো কলু কাওলা মনে হচ্ছে! সরে দাঁড়াও কয়ে দিচ্চি, আমার ছায়া মাড়াবে নাকো মোটে! ব্যাটা কলুদের ছেলে! আগুন থাকলে ওই দূর থেকে দাও, দূর থেকে।”

কথাটা শুনে রাগ ধরে যায় স্বপনের। সেই সাথে আশ্চর্য্যও হয় খানিক। সত্যিই ওরা জাতে কলু। বাড়িতে একসময় তেলের ঘানিও দেখেছে ও। কিন্তু সেটা এই লোকটা জানলো কিভাবে? মুখ দেখে আবার জাত বলা যায় নাকি! 

“আজ্ঞে আমি বিড়ি খাইনা, খৈনি আছে, চলবে?” 

“কি বললি বেয়াদপ! বুড়ো কত্তা জানতে পারলে না জ্যান্ত পিঠের ছাল তুলে, কোশী নদীর চড়ে পুঁতে দেবে, বুঝেছিস? রায়নারায়ণ হেমেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীকে খৈনী দেকাচ্চ? আমাদের বিহারী পেয়েছিস? ব্যাটা বুৰ্বক কাহিকা!”

আচমকা ঘাবড়ে গেলে স্বপনের মুখটা হাঁ হয়ে যায়, এটা ওর জন্মগত। লোকটার কথা শুনে হাঁ এর মুখটা আরও বড় হল। এত্ত বড় নাম ও জন্মে শোনেনি। লোকটা এবার স্বপনের দিকে একপা সরে আসে। একটা চোখ হালকা করে টিপে বলে, “তা বিড়ি যখন খাস না, এক টিপ খৈনিই দে। কত্তাকে বলে দেবখন, হীরু ব্যাটা দেশলাই আনার পয়সা নিয়ে হাটে গিয়ে ভাঙ খেয়ে উড়িয়ে দিয়েচেকো।”

স্বপন এবার আরো হকচকিয়ে যায়। পকেট থেকে খৈনির ডিবেটা বার করতে গিয়ে ওর হাত ফস্কে সেটা মাটিতে পরে যায়। অমনি লোকটা সেটা ছোঁ মেরে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা লাগায় বারান্দার উল্টো দিকে। চুনের ডিবেটা তখনও স্বপনের বাম পকেটে পড়ে আছে। ওর চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে, লোকটা দোতলার বারান্দার বাঁ দিকের ঘরগুলোর একটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। হ্যাঁ, স্বপন ঠিকই দেখেছে, ঠিক যেন কর্পূরের মত উবে গেল লোকটা। পিছন থেকে তখন রাজেন ওকে ঠেলা দিচ্ছে, “কিরে ট্যাবলা! টিফিন করবিনি? কোন জগতে থাকিস? কটা বাজে খেয়াল আচে রে? নে নে, চল চল।” রাজেনের তাড়া খেয়েও যেন সম্বিৎ ফেরে না স্বপনের। সে তখনও বারান্দার উল্টো দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওর চোখে পড়ে একটা প্রায় ছ ফুটের মত ছায়া, পরনে ঢাউস আলখাল্লার মত পোশাক, বারান্দাটার উল্টো দিকে পায়চারি করছে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে স্বপনের। ছায়ামূর্তিটা এবার মুখ তুলে তাকায় স্বপনের দিকে। তার মাথার বিশাল লম্বা লম্বা চুল খোলা হাওয়ায় উড়ছে তখন। নাকের নীচে চওড়া পাকানো গোঁফ, সোনার মত উজ্জ্বল গায়ের রং, লাল লাল চোখদুটোয় সে কী ভীষণ বিরক্তি! সেই দেখে স্বপন ভিমড়ি খায় আরকি। পিছন থেকে রাজেন ধরে ওকে ঝাঁকুনি দেয়, “কিরে? কি দেখতিচিস অমন করে? কি আচে রে ওকেনে?” 

ভয়ের ঘোর কাটতেই স্বপন দেখে, সেই ছায়ামূর্তিটা কোণের ঘরের দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ঠিক যেমন আগের লোকটা গেছিল। নিজের দুহাত চোখের উপর ঘষে নিয়ে, সে রাজেনকে বলে, “কিছু না, চল।”

রসুলগড়ের এই বাড়িটা নাকি পুজোর পর সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হবে। সরকার থেকেও পয়সা দিচ্ছে, কিসব যেন ইতিহাস আছে বাড়িটার! দূর থেকে দেখলে মনে হয়, একটা নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ, দীপহীন অমাবস্যায় হাজার তারার নিষ্পলক চোখের বহুকাঙ্খিত ঘুম যেন পেয়ে বসেছে বাড়িটাকে। বাড়িটার দক্ষিণ দিকের জানলার গরাদগুলো বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ‘আয় ঘুম, যায় ঘুম’ ধ্বনি। ওদের ঠিকাদারই পুরো কাজটা পেয়েছে। সেই কাজের জন্যই স্বপন আর তার দলবল - যেমন রাজেন, শিবু, ফিরোজ, রহমান এদের শহর থেকে দূরে এই অজ পাড়া গাঁয়ে আসা। ওদের ঠিকাদারই এখানে দুপুরে ওদের রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একদিন অন্তর শহর থেকে এসে সে কাজ দেখাশোনা করে। স্বপনরা এই বাড়িটাতেই থাকছে এই কদিন। গ্রামেরই এক রাঁধুনি ঠাকুর ওদের জন্য ভাত-ডাল-সবজি রাঁধে। সপ্তাহে একদিন ওরা নিজেরা পয়সা দিয়ে আমিষ রান্না করিয়ে খায়, মাছ কিংবা ডিম। স্বপনের ঠিক পাশটাতেই খেতে বসেছিল শিবু। ব্যাটার খুব বদ স্বভাব, নিজেরটা খাওয়া হয়ে গেলেই লোকের পাতের দিকে হাত বাড়ায়। আজও যথারীতি এক কান্ড। অন্যান্য দিন শিবুর পাশে স্বপন খেতে বসলে চেঁচামেচি আরম্ভ করে দেয়, আজ আর কিছু বললো না। স্বপন শুধু হাতের ভাতটা মাখতে মাখতে মুখটা কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে শিবে, দোতলার বারান্দার উত্তর দিকের পিলারটায় তুই কাজ করছিলিস না? ঠিকেদার কি নজরদারী করতে আমাদের পেছনে লোক লাগিয়েছে নাকি রে? সারাটা সকাল আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছে, তোর দিকেও গেছিল।” 

শিবু খেতে খেতে বিষম খায় ভীষণ জোরে। আমতা আমতা করে বলে, “কই, তাই নাকি? জানি না তো।” 

“উঃ! তুই আবার জানিস না। ঠিকেদারের এঁটুলি আমার!” 

শিবু স্বপনের হাতটা ধরে বলে, “মাইরি আমি কিছু জানিনা, বিশ্বাস কর। শিবুর হাতটা ছাড়িয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে কপালে ভাঁজ পড়ে যায় স্বপনের। সত্যি কথা বলছে শিবু? তাহলে সকালে যাদের দেখলো ওরা কারা!

 

২ 

দুপুরের খাওয়া খেয়ে একতলার একটা বড় ঘরের মেঝেতে ওরা একটু গড়িয়ে নেয়। বহু পুরোনো দিনের রাজবাড়ি, বড় বড় খিলান, কড়ি-বরগা। প্রায় ১২ ফুটের লিন্টন। এই স্টাইলের বিশাল বিশাল আর্চ-ধাঁচা, এসব আগে কখনও দেখেনি স্বপন। এই ঘরটাতেই রাতে শোয় ওরা, দক্ষিণের একটা জানালা খোলা থাকে সবসময়। এই দিকটাতে পেছনের মাঠটা পেরোলে একটা অর্ধেক বুজে যাওয়া নদী পরে। এখানকার লোকেরা বলে ‘কানা দামোদর’- একসময় এই নদীটা দামোদরের প্রধান শাখা নদী ছিল। অনেকে আবার বলে এটাই নাকি পুরাণের ‘কোশী নদী’ বা ‘কৌশিকী’। একসময় নদীতে জল ছিল প্রচুর, নদীটা তখন নাকি এ বাড়ির আরো গা ঘেঁষে বইতো। কালের নিয়মে নদীতে এখন চড়া এসেছে। জায়গায় জায়গায় শুধু হাঁটু জল, তাতে গরু-বাছুর-ছাগল চড়ে দিব্যি! ধানের চাষও হয়েছে মাঝে মাঝে। নদীর একপাশে বাঁধানো ঘাট, তাতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সময় থেকে হয়তো একটা নৌকা বাঁধা রয়েছে। ওটার আর প্রয়োজন পড়ে না এখন, দিব্যি হেঁটে নদী পেরোনো যায়। ওপারে একটা ঘন বাঁশঝাড়, সেখানে সন্ধ্যের পর আলো জ্বলতে দেখেছে স্বপন। সন্ধ্যের দিকে রোজ ও, শিবু আর রাজেন এইখানটাতে গাঁজার কল্কেতে টান দিতে আসে। রাতে খেতে যাওয়ার আগে অবধি এক ছিলেম-দু ছিলেম। কোনো কোনো দিন আবার সেবার কোন মাত্রা থাকে না। ওদের ঠিকাদার যদিও সন্ধ্যের পর এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে বারণ করেছে, বনে বাঁদাড়ে ধেঁড়ে শেয়াল-টেয়াল থাকতে পারে! বাড়িটার চারপাশ বেশ ফাঁকা ফাঁকা, আশেপাশে কয়েক ক্রোশের মধ্যে জনবসতি প্রায় নেই। সেদিন দুপুরে ঘন্টাখানেক বিশ্রামের পর কাজে ফিরে গেল স্বপন। আবার বিকেল অবধি ঝুলে ঝুলে কাজ করলো। নাহ্‌ এর মধ্যে আর কাউকে দেখেনি স্বপন, আর কেউ কিছু চাইতেও আসেনি। কিন্তু গন্ডগোলটা বাঁধলো সেদিন রাতে ঘুমাতে যাবার সময়। একটা ভয়ানক দম বন্ধ করা চাপ বুকের উপর অনুভব করল স্বপন। যেন বুকটা ফেটে হৃৎপিন্ডটা বেরিয়ে আসবে এখুনি। চোখের সামনে স্পষ্ট স্বপন দেখতে পাচ্ছে, একটা গ্রাম, একটা বসতি। একটা পোড়ো মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছে সেই জনপদ। চারপাশে মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যার মত কাজে ব্যস্ত। কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছে না। যেন আশ্চর্য্য কোন এক মায়ার গাঢ় অন্ধকার ঢেকে রেখেছে পুরো এলাকাকে। মন্দিরে বেজে চলেছে ঢাক-ঢোল-শিঙে-কাঁসি-কাড়া-নাকাড়া। একটানা আওয়াজটা যেন রক্তস্রোতের দামামা বাজিয়ে দিতে থাকে স্বপনের আড়ষ্ট দেহের শিরা থেকে উপশিরায়। সময়টা দিন নাকি রাত, নাকি দিন কিংবা রাতের মাঝামাঝি একটা সময়, সেটা ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারে না স্বপন। হঠাৎ করেই মন্দিরের সামনের হাড়কাঠটার দিকে নজর যায় স্বপনের। আর সাথেসাথেই ওর বুকের ভেতরটা যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। একটি অপরূপা সুন্দরী মেয়েকে স্নান করিয়ে, লাল পেড়ে বেনারসী পরিয়ে, গলায় লাল রঙের একটা ফুলের মালা দিয়ে, হাড়িকাঠের সামনে বলির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মেয়েটি তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মন্দিরের ভিতর দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে আবারও আঁতকে ওঠে স্বপন। কী ভয়ঙ্কর সেই রূপ! এ যেন কোন দেবী নন, সাক্ষাৎ পিশাচিনী! বিশালকায় দুটো চোখ, পাংশুটে মুখ আর ঠোঁটের দুপাশে ধারালো তরোয়ালের ফলার মত দুটো দাঁত দিয়ে যেন ফালাফালা করে ফেলতে চাইছেন কোন মনুষ্য দেহের পুরু চামড়া মাংসের আস্তরণ। রক্ত চাই ওঁর, নরবলির রক্ত! তাঁর হাত পাঁচেক লম্বা জিভটা যেন মাটি ছুঁতে চাইছে। তিরতির করে কাঁপছে অন্ধকার পৃথিবীর ক্রন্দনরত বাতাসে। এ যেন পাথর বা ধাতুর মূর্তি নয়, এ মূর্তি যেন জীবন্ত। বাজনার আওয়াজ হঠাৎ যেন বেড়ে গেল। চারপাশ লাল করে আগুনের একটা লেলিহান শিখা কোন এক অদৃশ্য সৌরজগৎ থেকে উড়ে এসে চারপাশটাকে লাল করে দিতে লাগলো। গেরুয়া রঙের পাগড়ি পরা একটা সুপুরুষ লোক, কপালে লম্বা সিঁদুরের টিপ পরে, তরোয়াল হাতে এতক্ষণ তৈরী ছিল। এবার বলির বাজনার সাথে তাল মিলিয়ে হাতের উদ্যত তরোয়ালটা নিয়ে নৃত্য করতে লাগলো। বাজনাটার তীব্রতায় যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মেয়েটির যাবতীয় দুঃখ-শোক-কষ্ট-কান্না। তরোয়ালটা এবার সজোরে নেমে এলো হাড়কাঠের ওপর। মেয়েটির মাথা ধর থেকে ছিটকে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল সামনের দিকে। তাজা রক্তের সমর্পিত ধারার স্বাদ আস্বাদনে কিলবিল করে ছুটে আসতে লাগলো এক শ্রেণীর বিচিত্র পতঙ্গ আর করালগ্রাসী জন্তুর দল। সেই পিশাচ মূর্তির লোলজিহ্বাও যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো বলির রক্তের ধারার অভিমুখে, তার অধীশ্বরীর অন্তরে সুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক কালের থেকে আদিম উদগ্রতায় লালিত শোনিত পিপাসা মেটাবার লক্ষ্যে। অন্ধকারের আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র আলোর কুপি উল্টে ক্রমশ বদলে যেতে লাগলো আলোর তন্ময়তা। প্রচন্ড চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে পড়ল স্বপন। ওর ঠিক পাশটাতেই শুয়ে ছিল রণজিৎ। সে হলো রঙের মিস্ত্রিদের হেলপার। তার অনেক বদ অভ্যেসের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সে ঘুমের মধ্যে ভুল বকে আর সিনেমার হিরোইনদেরর কথা ভাবতে ভাবতে এর ওর গায়ে পা তুলে দেয়। আজ স্বপনের চিৎকারে ওরও ঘুম ভেঙে গেছে। উঠে বসে গো-বেচারার মত সেও এদিক ওদিক দেখতে থাকে। বাকিরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রণজিৎ স্বপনকে ধরে ঠেলা দিতে থাকে, “কিরে ট্যাবলা, কী হল রে তোর? স্বপ্ন দেখছিলি?” স্বপনের চোখে মুখে তখনও তীব্র আতঙ্ক লেগে আছে। তখনও ওর কানে বাজছে সেই ভয়ঙ্কর ঢাক-ঢোল-কাঁসির বাজনা। চোখের সামনে ভাসছে সেই মর্মন্তুদ দৃশ্য। জিভ সরে আর কোন কথা বেরোয় না স্বপনের মুখ থেকে। এমনিতেই ছোট থেকে ওর মৃগী আছে। খিঁচুনি উঠলে দাঁত কপাটি লেগে, চোখ কপালে তুলে যা তা অবস্থা হয় ওর! শুক্কুরবারে সন্তোষী মা করে এখন একটু ভালো আছে স্বপন। তাই ভরসা করে এতদূর কাজে এসেছে। পাশে রাখা কলসিটা উপুড় করে এক গ্লাস জল স্বপনের মুখের কাছে ধরে রণজিৎ। আজ প্রায় হপ্তাখানেক হল এ বাড়িতে কাজে লেগেছে স্বপন, আজ অবধি তো কই এমন হয়নি! বাড়ির জন্য বড্ড মন কেমন করতে থাকে স্বপনের। আজ বাকি রাতটা সে জেগেই কাটিয়ে দেবে। আকাশের চাঁদ ছোট হচ্ছে ক্রমশঃ। সামনেই অমাবস্যা, বোধহয় মহালয়ার অমাবস্যা!

 

৩ 

পুজোর যে আর খুব বেশী দেরী নেই তা এইসময়ের আকাশটা দেখলেই বেশ বোঝা যায়। বর্ষার ভারী মেঘের মাঝে হঠাৎই হালকা সাদা তুলোর মত মেঘ ভেসে চলে আসছে। অমনি আলোয় ঝলমল করে উঠছে চারিদিক। পুবের রোদটা বাড়িটার ছাত থেকে উত্তর দিকের ঘরগুলোর সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে, ঝুপ করে স্বপনের গায়ে এসে লাফ দিয়ে পড়ে। মিঠেকড়া রোদ, সাথে গাছগাছালির হাওয়া - স্বপনের মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। ছেলেবেলায় দিদিমার মুখে মেঘলা রাতে একটা গল্প শুনেছিল স্বপন। এক আশ্চর্য্য দরজার গল্প, সেই দরজা খুললে এপারের যত ধুলো-কাদা-রোদ-বসন্ত উড়িয়ে নিয়ে যাবে ওপারে। শিউলি বেছানো পথ পেরিয়ে সেই দরজাটা। তার গায়ে অদ্ভুত সব নকশা খোদাই করা। সেই দরজা পেরিয়ে ওপারে গেলে, সংসারের সব বোঝা মাথা থেকে বেরিয়ে গাছ হয়ে যায় আর শরীরটা হাজার হাজার ডাল পালার মত হাত দিয়ে সেগুলোকে ধরে রাখে। পাখির মত হালকা শরীর নিয়ে নতুন জন্ম পায় জীবনটা। আজ হঠাৎই গল্পটার কথা মনে পড়ে যায় স্বপনের। দূরের মাঠের ধারে নবাবী খিলানগুলোর ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কুমোরটা ঠাকুরের গায়ে সাদা ঢেলা রঙের পোঁচ চাপিয়েছে সবে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছেলেবেলার আরও কত কী মনে পড়ে যায় স্বপনের! ছোটবেলায় মামা বাড়ি গিয়ে ভাইবোনেরা মিলে মেঠো পথের আল ধরে দৌড়াত ওরা। দূরের আকাশ, শেষ হতে না চাওয়া ধানক্ষেতটা ওকে ডাকত যেন হাত বাড়িয়ে। ওর পাড়া থেকে ওরই বয়সী একটা ছেলে ওর সাথে ঘুরতে যেত ওর মামাবাড়ির গ্রামে। নাম ‘মদন ব্যাপারী’, মদনা। মদনাটার খুব ছোট বয়সে বাপ মরে গেল, সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে পড়াশুনা ছেড়ে গ্যারাজে ঢুকলো সে। স্বপন তো তবু ক্লাস সিক্স অবধি পড়েছে, মদনাটা ফোরের বেশী এগোতে পারেনি। প্রায়ই ও স্বপন কে বলত, "চ ট্যাবলা, বাইরে চলে যাই। কাজও ভালো, বাইরে পয়সাও বেশী। দুই ভাইয়ে একসাথে থাকবো।” স্বপন বড়াবড়ই ঘর কুনো, ওর কথায় রাজি হয়নি কোনোদিন। সেই তো আজ পেটের দায়ে ভিটেমাটি ছেড়ে বাইরে আসতে হয়েছে ওকে। শন শন করে একটা হিমেল হাওয়া স্বপনের গায়ে এসে লাগে। সেই হাওয়াটাকে সারা গায়ে জড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়ে স্বপন। হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে এলো কালকের সেই ফিনফিনে কন্ঠস্বর, “ব্যাটাচ্ছেলে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে? খালি ফাঁকি দেওয়া! কাজের নামে খইভাজা?” 

পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে স্বপন দেখে কালকের সেই রোগা কালো মতন টাক মাথা লোকটা। ঝাপসা ফ্রেমের চশমার কাঁচের ফাঁক দিয়ে একটা চোখ ছোট করে স্বপনের দিকে তাকিয়ে, গালে আঙুল দিয়ে বিজ্ঞ মার্কা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বপনের খুব রাগ ধরলো এবার। কাজের সময় পেছন পেছন খবরদারি স্বপনের সহ্য হয়না মোটে। ও এবার হাতের কাজ ফেলে লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল, “বলুন কী বলছেন? আপনি কে? সেই কাল থেকে আমার কাজের সময় পেছনে এসে ঘোরাঘুরি করছেন। ঠিক চিনলাম না তো!” 

লোকটা নিজের সরু সরু কাঠি বার করা আঙুল গুলো দিয়ে শূন্যে অঙ্ক কষতে থাকে আর মাঝে মাঝে টাক চুলকোতে থাকে। সেই সাথে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগে, “আমি কে? কে আমি? উম্‌ম্‌ কে আমি? আমি কে? এই আমিই কি সেই আমি, যে আমিটা আমি ছিলাম, নাকি এই আমিটা ঠিক মতন আমি নই? এটা আবার অন্য আমি! তাহলে আমি কে?” স্বপনের অস্বস্তি বাড়ে, মনে মনে ভাবে “এতো আচ্ছা গাঁইয়া পাগলের পাল্লায় পড়া গেল!” গলা খাঁকারি দিয়ে সে এবার লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, “মনে পড়লো?” স্বপনের কথায় সম্বিৎ ফেরে লোকটার, বলে, “হুউম মনে পড়েছে আমি কে, কিন্তু তোকে কেন বলতে যাব আমি কে! আমি যে আমি সে।” প্যাকাঠির মত ছুঁচলো সরু সরু আঙুলগুলো স্বপনের মুখের সামনে ঘোরাতে ঘোরাতে চশমার আগা দিয়ে একবার স্বপনকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে লোকটা বলে, “বলতো আমি কে?” লোকটার কথা শুনে স্বপনের মাথার ভিতর কয়েকশো ইদুঁর ছুটোছুটি শুরু করে দেয় একসাথে। এই হেঁয়ালির অর্থ কী! লোকটা বোধহয় স্বপনের মনের কথা বুঝতে পারে। দুপা ডান দিকে সরে গিয়ে পেছনে হাত দিয়ে একটা শামলা টুপি বার করে নিয়ে আসে, তারপর আঙুলের ডগায় সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, “আমি কে সেটা জেনে তুমি কী করবে হে ছোকরা! তোমার সাথে কী যেন একটা দরকার ছিল আমাদের, তাই শুধোতে এয়েচিলাম।” স্বপন পড়ে মহাবিপাকে। লোকটার গা থেকে একটা উদ্ভট গন্ধ ছাড়ছে। অনেক দিন ধরে কোন ঘর বন্ধ থাকলে যেমন গন্ধ ছাড়ে, সেই গন্ধটার সাথে পচা আরশোলা, টিকটিকি আর বাসি মশার ধূপ - এইসব কটা একসাথে মিশলে যে গন্ধ, ঠিক সেইরকম একটা গন্ধ! লোকটা নিজের ছুঁচালো পানা থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে আবার গভীর চিন্তায় ডুব দেয়, আপনমনে সুর করে বলতে থাকে, “তোমার সাথে কী যেন দরকার ছিল! কী যেন! কী যেন! কে যেন পাঠাল আমায়! কে যেন! কে যেন!” স্বপনের মুখের হাঁটা আবার বড় হয়। মনে মনে ভাবতে থাকে, “এ আবার কী রে ভাই!” লোকটা অমনি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে, স্বপনের দিকে দু পা সরে আসে, বলে, “পড়েছে, মনে পড়েছে, নিশ্চয়ই পড়েছে। আসলে মগজে অনেক ভার তো! তাই চট করে মনে পড়তে চায় না। তোমাকে বড় কত্তা তলব দিয়েচেন!” ঘাবড়ে গিয়ে স্বপনের কপালে ত্রিশূলের ফলার মত একটা ভাঁজ পড়ে যায়। চোখ মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “আজ্ঞে তিনি কে?” লোকটা এবার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ওঠে, “উঃ! বড় কত্তাকে চিনিস না? বলি দুবেলা যার অন্ন খাচ্ছিস, তাঁকেই চিনিস না? রায়বাহাদুর হেমেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীকে চেনেন না উনি!” রাগে গজ গজ করতে থাকে লোকটা। বড় একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে বুঝতে পারে স্বপন। এই বাড়ির এখনকার মালিক এখানেই থাকেন না কি? কই ওদের ঠিকেদার বা অন্য কেউ তো বললো না এবাড়িতে লোক থাকে! জামা কাপড়ে হাতটা একবার মুছে নিয়ে স্বপন বলে, “আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। নিন চলুন।” লোকটা এবার খেঁকিয়ে ওঠে, “উঁহু, এখন কিরে আহাম্মক! এখন কত্তামশাইয়ের বিশ্রামের সময় নয়? রাতের বেলায় আসিস, প্রথম প্রহরের তোপ পড়লে। দোতলার সিঁড়ির কাছে আমি থাকব।” কথাটা শুনে স্বপন উত্তেজনার বশে বাৎকর্ম করে ফেলে। এটা ওর একটা বড় বদ অভ্যেস! হজমের সমস্যা স্বপনের বংশগত। যত দিন যাচ্ছে রোগটা যেন বাড়ছে ওর। অমনি লোকটা তিড়িং করে দু পা পিছিয়ে গিয়ে কাঁধের উড়নিটা নাকে চাপা দিয়ে সোজা হন হন করে বারান্দার উল্টোদিকে হাঁটা দেয়। সেদিক থেকে ভেসে আসা একটা ঠান্ডা হাওয়ায় স্বপনের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। লোকটা ক্রমশঃ সেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকে। নিজেই বড় লজ্জায় পড়ে যায় স্বপন। ছেলেবেলায় এই জন্য ইস্কুলে ওর নাম হয়ে গেছিল ‘বিষ পাদ’। মোক্ষম সময়ে ‘মিসাইল’ একটা ঝেড়ে দিলে ভুতের বাপও পালায়। স্কুলে বিজ্ঞানের মাস্টার কিলু বাবু ওকে দেখলে বলতেন, “বাবা স্বপন, তোমার পেটের ভেতর আস্ত অ্যাসিডের কারখানা আছে বাবা। তা বাবা, ওটা ইস্কুলে সাপ্লাই না দিয়ে কলকারখানাগুলোয় গিয়ে সাপ্লাই দাও গা! কাজে দেবে খনে।” 

 

৪ 

বাকিটা দিন স্বপন আর কারো সাথে তেমন কথা বলেনি। দুপুরে বা রাতে ঠিক মত খাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না ওর। একটা অজানা উত্তেজনায় ভেতর ভেতর কেঁপে উঠেছে সমানে। রাতে শিবু রাজেনের পাশে শুয়ে মটকা মেরে পড়ে থেকেছে, কান পেতে থেকেছে কখন আসবে সেই সংকেত! ওর মন আজ বড় অশান্ত। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা চিরে দূর থেকে গুম গুম গুম করে তিনবার খুব ভারী একটা শব্দ ভেসে আসে। ছোটবেলায় লোহার নলের ভেতর গন্ধক পুড়ে হাতল ঠেলে বিশাল শব্দ করে হনুমান তাড়াত ওরা। এই আওয়াজটাও অনেকটা সেই রকম। মোবাইলের ঘড়িতে স্বপন দেখে ঠিক বারোটা বাজে এখন। বাকিরা তখন গভীর ঘুমের দেশে। রণজিৎটা নায়িকার স্বপ্ন দেখছে নির্ঘাৎ! ঘরের বিশাল দরজাটা খুব সাবধানে ফাঁক করে আস্তে আস্তে বাইরে বের হয় স্বপন, কেউ যাতে টের না পায়। ওর ভেতরে একটা চাপা কৌতূহল কাজ করছে এখন। বাইরে তখন বাঁকা চাঁদের আলো সামনের খোলা মাঠটা বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নাটমন্দিরের চাতালেও। পশ্চিমদিকের আমবাগান থেকে ভেসে আসছে প্যাঁচার ডাক। ঐদিকটায় কখনো সখনো গেছে স্বপন। প্রায় দশ বিঘে জমির ওপর আমবাগান, বহু পুরোনো সব গাছ, পেল্লাই সব গুড়ি। একদিকে আবার নতুন চারা বসানো। একতলার বারান্দা জুড়ে তখন সূচিভেদ্য অন্ধকার! বড় বড় বন্ধ ঘরগুলোর দরজার ওপার থেকে ভেসে আসছে চামচিকে বাঁদুরের ডানা ঝাপটানোর বীভৎস আওয়াজ। সেই আওয়াজটার সাথে মিশে বেনামী গুরুমন্ত্রের মত কানে বাজছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার নিয়মমাফিক মুখবন্ধ আর মাঝে মাঝে মাঠের দিক থেকে ভেসে আসা সোনা ব্যাঙের ডাক। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে স্বপন সিঁড়ির কাছটায় আসে। ঠান্ডা মার্কা জমাট অন্ধকারে চারপাশে প্রায় কিছুই দেখা যায় না। দোতলার সিঁড়ির মুখটায় একটা হালকা আলোর রেখা দেখতে পায় যেন স্বপন! সেদিক বরাবর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে অন্ধকারে হোঁচট খায়। পুরোনো আমলের মাটির সিঁড়ি, জায়গায় জায়গায় তার আধখাওয়া শরীর থেকে ইঁট বেরিয়ে এসেছে কোনরকমে। দোতলার মুখটায় উঠে দুপুরের কালোমতোন লোকটাকে দেখতে পায় স্বপন আলো আঁধারিতে। লোকটাকে ছায়ার মতন মনে হয় স্বপনের! হাতে একটা পুরোনো দিনের কারুকাজ করা কাঁচের বাতিদানী, ভেতরে একটা মোমবাতি জ্বলছে প্রায় নিভু নিভু। স্বপনকে উপরে উঠে আসতে দেখে সোজা পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে দিল লোকটা। ওই অল্প আলোতেও স্বপন দিব্যি বুঝতে পারে লোকটা নাকে এখনো কিছু একটা চাপা দিয়ে রেখেছে। মনে মনে লজ্জায় পড়ে যায় স্বপন। দোতলাটায় প্রায় সারাদিন কাজ করলেও এত ভাল করে এর আগে কখনও লক্ষ্য করেনি স্বপন। বারান্দাটার ঠিক মাঝখান বরাবর ঝুলতে থাকা বিশাল বেলোয়ারী ঝারলণ্ঠনটাও চোখে পড়েনি এর আগে। নোনা ধরা দেওয়াল থেকে অন্ধকার হাঁ এর মত মুখ বের করা মোমদানিগুলোতেও বাতিরা সব তিরতির করে কাঁপছে। মনে মনে স্বপন ভাবে দোতলাটার ছিরি যেন ফিরে গেছে। পশ্চিম দিকের দরজাটার মাথায় একটা প্রকান্ড জংলী মোষের মাথা চোখে পড়লো স্বপনের। এর আগে ওটা ওখানে ছিল কি? হিম হিম কুয়াশায় ঘিরে ধরা অন্ধকারে হাতে দুটো বল্লমধারী প্রহরীকেও যেন দেখলো ও দরজাটার বাইরে। পুরো বারান্দাটা জুড়ে পুরোনো দিনের ফরাস বেছানো। বাহারী নকশা করা চেয়ার টেবিল সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওর আগে আগে গিয়ে দরজাটায় আলতো করে চাপ দিল লোকটা। দরজাটা প্রচন্ড বিরক্তিকর একটা শব্দ করে খুলে গেলো। লোকটার পিছু পিছু ঘরটার ভেতর ঢুকে এলো স্বপন। ঘরটা দেখলেই বোঝা যায়, এটা কোন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের শোবার ঘর। বয়স হলেও ঘরের প্রতিটা কোনা থেকে আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে বার্মা টিকের গোল পালঙ্ক, তার ঠিক মাথার দিকে একটা প্রকান্ড সিংহের মুখ, কাঠের ভাঁজে ভাঁজে খোদাই করা তার বিন্যস্ত কেশরাজি আর প্রবল পরাক্রমের গল্প। সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা ত্রিতল ঝাড়বাতিটার আলো পড়ে চোখদুটো তার যেন অন্ধকারেও যেন জ্বলছে। পুরো ঘরের দেওয়াল জুড়েই প্রায় বিশাল বিশাল তৈলচিত্র আর জন্তু জানোয়ারের মাথা টাঙানো আছে। ঘরের এককোণে একটা পুরোনো দিনের দেরাজ আলমারি, সেটার গায়ের কারুকাজ দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। লোকটা এগিয়ে গিয়ে সামনের দেওয়াল জুড়ে টাঙানো একটা ছবির সামনে হাতের মোমদানিটা রাখল। ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল স্বপন। এই সৌম্যকান্তি রাজপুরুষকেই সেদিন সকালে দোতলার বারান্দায় পায়চারী করতে দেখেছিল না? ছবিটার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা বেশ কিছুক্ষণ হল। হঠাৎ ছবিটা কাঁপতে শুরু করলো। ছবির ভেতর থেকে ভেসে এলো গমগমে কণ্ঠস্বর, “এই সে?” কালো লোকটি মৃদু ফিনফিনে গলায় উত্তর দিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, এই সে। কোন ভুল নেই, আমি লক্ষণ মিলিয়ে নিয়ে এয়েচি।” ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসে না। লোকটি ভাসা ভাসা গলায় আবার বলে ওঠে, “মহারাজ এবার তাহলে সংকেত দিন।” একটা ঘড়ঘড়ে ধ্যাতানির শব্দে ঘরটা ভরে ওঠে, “সংকেতের আমি কি জানিরে হতভাগা নায়েব! বলি বয়সের সাথে কি মগজেরও মাথা খেয়েচ? শেষের রাতে সংকেতটা তুই তোর খেরোর খাতায় নিখে রেখেচিলি ভুলে গেলি?” মস্ত বড় জিভ কেটে নায়েব ক্ষমা প্রার্থনার সুরে হাত জোড় করে ছবিটার সামনে বলে ওঠে, “ক্ষমা করে দিন হুজুর, বয়সের হিসেব কষতে কষতে চোখের মাথা খেয়েছি, চালশে পড়ে চোখে সব ঝাপসা দেখি এখন। মগজে সব পুরোনো কথা আর আসেও না চট করে। বলাবলি কথা বলতে কি ঘিলুখানা শুক্কে গেচে এক্কেরে।” এই বলে লোকটা নিজের জামা কাপড় হাতড়াতে লাগলো। এমন ভাব করতে লাগলো যেন সারা শরীর চুলকাচ্ছে। হঠাৎ পিঠের দিকের জামার তলা থেকে একটা জরাজীর্ণ শালু মোরা খাতা বার করে মুখখানা ঘিয়ে ভাজা শাঁকালুর মত করে নেড়ে চেড়ে ঘেঁটে দেখতে লাগলো। হঠাৎ একটা পাতা দেখে চোখ কপালে তুলে, রোগা ঠ্যাংগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে নাচতে লাগলো, “পেইচি হুজুর পেইচি, পাবো না মানে? পেতেই হবে।” ছবির ওপাশ থেকে গমগমে স্বর ভেসে আসে আবার। “পেয়েচ? উদ্ধার করেছ! এবার পড়ে শোনাও এঁকে।” স্বপন এতক্ষন হাঁ করে দেখছিলো শুধু, ওর দুটো ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে একটা মাছি গলে যাওয়ায় সেটাকে একটুও বিষম না খেয়ে গিলে নিয়ে মুখটা বন্ধ করলো এবার। নায়েব মশাই হাতে খাতাটা নিয়ে পড়তে লাগলেন, 

“অনুমান দিন-ক্ষণ সতেরোশ সাল ।।
বর্গী আইলো দেশে নবাবের কাল ।।
পেয়ারের হেমেন পাইলেন রায়চৌধুরী মান ।।
দস্যু করিলা লুঠপাট রক্তসুরাপান ।।
হেমেন ও বর্গী রাজার সমর হইলা ।।
কোশী নদীর পূর্ব পারে পন্ডিত পলাইলা ।।”

 

এই অবধি পড়া শেষ হয়েছে কি হয়নি, ছবির ভেতর থেকে আবার গম্ভীর স্বরে ধমক ভেসে এলো, “এসব কি ছড়ার কথা পড়ছ হে? অপদার্থ বুড়ো হাবড়া কোথাকার! আসল লাইনগুলো পড়।” ধমক খেয়ে থতমত হয়ে নাকের ডগায় চশমাটা এনে খাতার পাতা উল্টোতে লাগলেন নায়েব মশাই। একটা পাতার সামনে থেমে খাতাটা মুখের কাছে টেনে এনে পড়তে লাগলেন, 

“পূব দিকে নদীর পাড়ে দেবী ধামসীর ধাম ।।
বেদীতলে লুকাইয়া রাখে, করি মনোষ্কাম ।।
বক্ষমাঝের রুধির ধারা সমর্পিলে তবে ।।
প্রসন্না হইলা দেবীর সম্পদ লভিবে ।।”

 

৫ 

সেই রাতের কথা কাউকে কখনও জানায়নি স্বপন। বেমালুম হজম করে ফেলেছিল। তবে এটা ও খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল, এই বাড়ি, তার মালিক রাজা হেমেন্দ্র নারায়ণ, তাঁর নায়েব, দোতলার ঘর, সেই ঘরে কাটানো সেই রাত, এর কোনোটাই স্বাভাবিক বা লৌকিক নয়। বাস্তবগ্রাহ্য চেতনতার ঊর্ধ্বে এঁরা সবাই। স্বপন গরীব মানুষ, একেবারে যাকে বলে দিন আনা - দিন খাওয়া। তবে ও শুনেছে এককালে ওদের পূর্ব পুরুষদের প্রচুর টাকা কড়ি ছিল। আজ আর সে দিনকাল নেই। জাতে কলু হলেও ওদের জ্ঞাতিদের নাকি রত্ন পাথরের ব্যবসা ছিল। সে ব্যবসা যারা ধরে রাখতে পেরেছে তারা আজও অবস্থাপন্ন। অথচ সেই বংশেরই ছেলে হয়ে স্বপন ঠিকাদারের কাছে দিন মজুরের কাজ করে। সবই ওর অদৃষ্ট! সে কপালকে স্বপন মেনে নিয়েছে। ছোট থেকেই ও একটু কুঁড়ে প্রকৃতির। মায়ের কাছে ছেলেবেলায় তার জন্য কম কথা শোনেনি ও। ওর মা খালি মদনার সাথে ওর তুলনা করে বলতেন, “ওরে হতচ্ছাড়া, ওই ছেলেটাকে দেখে শেখ! বাপ নেই, ঐটুকু বয়সে কেমন সংসারের জোয়াল টানছে!” পড়াশোনাটাও তেমন করেনি স্বপন। তবে স্বপন সৎ, আবার ওর মনে লোভ জাগেনা যে তা নয়। সে লোভ জীবজগতে কার নেই? তবে এখন স্বপনের মনে তাগিদটা জাগে বেশী। ছেলে মেয়েদুটোকে ও অনেক দূর পড়াশোনা শেখাবে, তার জন্য অনেক টাকা চাই। সেদিন রাতে সেই ছড়াটার মানে বিন্দুবিসর্গও বোঝেনি স্বপন, শুধু বুঝেছিল ওতে কোথাও একটা অসীম সম্পদের ইঙ্গিত দেওয়া আছে, যা পেলে যে কারো কপাল খুলে যেতে পারে। আর স্বপন পেলে তো ওর চোদ্দ পুরুষ বসে খাবে! শুধু কোন এক দেবীকে সন্তুষ্ট করার কথা বলা ছিল ছড়ায়। কোন দেবী ভেবে কূল পায় না স্বপন! সেই রাতের পর থেকে প্রায় রোজ দুপুরবেলা নায়েব মশাই ওর কাছে আসেন। এসেই একটা সরু বেতের লাঠি দিয়ে সজোরে খোঁচা মারেন স্বপনের কোমরে। খুব বিরক্তি আসে স্বপনের। কাজের সময় এরকম কেউ করে? এক একদিন মুখ খিঁচিয়ে উঠলে, নায়েব মশাই তাঁর শিয়াল পন্ডিতের চশমাটা নাক বরাবর একটু তুলে, নাক মুখ কুঁচকে বলে ওঠেন, “অহ ব্যাটার গুমোর দেখ! কাজ করে যেন উনি উল্টে দিচ্ছেন। ভালোই তো ফাঁকি মারছ চাঁদু! জানিস এতে রাজবাড়ীর পয়সা নষ্ট হয়? এমনিতেই বলে আমাদের কত অভাব, কত দেনা চারিদিকে!” স্বপন হাসে মনে মনে, ভাবে লোকটা এখনও সেই রাজা-রাজরার আমলেই পড়ে আছে। রাজবাড়ীর রাজত্বই যে আর নেই সে খেয়াল রাখে না। নায়েব মশায়ের চোখ থেকে চশমাটা নাকের ডগায় নেমে আসে। আবার স্বপনের দিকে দুপা সরে এসে একটু নিনু হয়ে বলেন, “আঃ চটছিস কেন? বলাবলি কথা বলতে কি, রাজবাড়ীর এখন খুব টাকার দরকার বুঝলি? এ বাড়ির দশ ঘড়া মোহর পোঁতা রয়েচে, ওই নদীর ওপারে ধামসী দেবীর মন্দিরে। ওটা তোকে খুঁজে বার করতে হবে বুঝলি? ওপারে গিয়ে দেবীর পায়ের তলায় বসে একমনে রাজবাড়ীর কথা, নিজের কথা বলবি, মা দয়া করলেই ব্যাস কেল্লা ফতে! তবে হ্যাঁ তোর শরীর থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত দিতে হবে। কিন্তু মনে রেখো মোহর পেলে দুটো ঘড়া ওই নাটমন্দিরের চাতালে রেখে যাবে ব্যাস! বাকি মোহর তোর।” রক্ত দেবার নাম শুনে স্বপনের মুখ কাঁচুমাঁচু হয়ে যায়। ছোট থেকেই ও ভয়ানক ভীতু। রক্ত পরীক্ষা করতে গেলে দশবার ভিরমি খেত আগে। মুখটা ছোট মতন করে ও বলে, “রক্ত দিতে হবে? ও বাবা! ও আমি পারবো না! সে কিরকম কাঁচাখেগো দেবী গো? ও আপনি অন্য কাউকে দেখুন গে যান। বাড়িতে আমার পরিবার আছে, দুটো ছোট বাচ্চা আছে। ওরা সব আমার পথ চেয়ে আছে। তাছাড়া ঘড়া গুলো ভারী হবে নিশ্চয়ই! আমি একা অতগুলো ঘড়া টেনে নিয়ে আসব কিকরে এপারে? আপনি বরং শিবু কিংবা রাজেনকে বলগে যান। ঠিকেদারের কাজ ওদের আর ভালো লাগছে না, মোহর পেলে শিবু ব্যাটা গোটা কতক রেসের মাঠের ঘোড়াই কিনে নেবে।” দেঁতো হাসি হেসে ওঠে স্বপন। নায়েবের চোখ এবার ধূর্ত হয়ে ওঠে। একটা চোখ টিঁপে স্বপনের চোখের সামনে এসে তিনি বলে ওঠেন, “কেন রে ব্যাটা? তোর বড়লোক হবার সাধ জাগে নে? ওই মন্দিরে কি পোঁতা আছে জানিস? নবাবী আমলের মোহর! তার একটাও পেলে তোর পরিবারের জীবন ধন্য হয়ে যাবে রে। আর এই ঠিকে কাজ করে খেতে হবে নে, বুঝলি? আর ঐটুকু তো রক্ত, ও দিয়ে দিবি, পারবিনি? কিরে?” অমনি নায়েব মশাইয়ের পেছন থেকে দুটো বামন গোছের মুসলমান ছেলে পরনে লুঙ্গি-ফতুয়া আর মাথায় মুসলমানী তাকিয়াহ, থুতনির গোড়ায় ছুঁচলো দাঁড়ি বেরিয়ে এসে ফেউ জুড়লো, “পারবে পারবে, নিশ্চই পারবে। আমরা যখন আছি তখন তো পারতেই হবে।” কথাগুলো বলতে বলতে ওরা নায়েবমশাইয়ের আসে পাশে পায়চারী করতে থাকে। আর ওদের মাথাগুলো দুপাশে সমান তালে দুলতে থাকে। নায়েব মশাই ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি নিয়ে এসে বলেন, “ওই তো আব্দুল আর মনসুর তোকে কোশী নদী পার করে দেবে। ওরে বাপু একটা ঘড়া পেলে তোর ছেলে মেয়েদের আর কোন কষ্ট থাকবেনা। তখন পেট পুড়ে বসে পোলাও কালিয়া খেয়োখন। এবার দে দিকিনি দুটিপ খৈনি দে।” স্বপন তক্কে তক্কে ছিল, আবার ওর খৈনির ডিবে ঝেড়ে দেবার তাল করেছে লোকটা। স্বপন আজ পকেটে করে শিবুর খৈনির ডিবেটা নিয়ে এসেছে, হাতে করে সেটা বাড়িয়ে দেয় নায়েব মশাইয়ের দিকে। স্বপনের হাত থেকে ডিবেটা নিয়ে এক টিপ বার করে হাতে কচলে মুখে পোড়ার বদলে নাকে দিয়ে বসেন তিনি। অমনি হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে বিশাল হাঁচি দিয়ে মাটিতে পড়ে যান। চোখ থেকে চশমাটা ছিটকে মাটিতে পরে যায়। বেঁটে ছেলে দুটো ছোটাছুটির বেগ বাড়িয়ে দেয়। স্বপন ভালোমানুষি করে মাটি থেকে নায়েব মশাইয়ের চশমা, হাতের লাঠি এগুলো কুড়িয়ে দেয়। তিনি নিজে আব্দুল মনসুরের কাঁধে ভড় দিয়ে কোনোরকমে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, “মাথাটা এক্কেরে গেচে গা! কোথার জিনিস কোথায় পুরিচি গা! ছ্যাঃ ছ্যাঃ!” বামন ছেলেগুলো কখনো হাঁটে না, সবসময় হালকা দৌড়ায় আর দুদিকে মাথা নাড়ে। ঐভাবে নায়েব মশাইয়ের দুটো হাত ধরে ওরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। শুধু যাবার সময় কথা হয় সামনে কৃষ্ণা নবমী তিথিতে সন্ধ্যারাতে কোশী নদীর ঘাটে নৌকা নিয়ে তৈরী থাকবে ওরা। ঐখান থেকেই শুরু হবে স্বপনের নতুন জীবনের যাত্রাপথ।

 

৬ 

মহালয়ার আগের কৃষ্ণ পক্ষের নবমীর দিন থেকে এই রাজবাড়ীতে দেবীর বোধন শুরু হয়ে যায়। অর্ধনির্মিত দেবী প্রতিমাকে শাড়িতে সুসজ্জিত করে চুয়া-চন্দন-সিঁদুর দিয়ে শুরু হয় আরাধনা। গ্রামের মেয়ে-বৌয়েরাই এসে সব জোগাড় যন্ত্র করেন। আজ সারাদিন কাজের ফাঁকে স্বপন শুধু সেই দিকেই চেয়ে থেকেছে আর অপেক্ষা করেছে কখন সন্ধ্যে হবে। একটা ভীনগ্রহী উৎসুকতায় ভরে গেছে ওর সারা বুক। সত্যি যদি এক ঘড়া মোহরও ও আনতে পারে ওর ভবিষৎ জীবনটা অনেক মসৃণ হবে। বয়স বাড়ছে, এখন এতটা কষ্টের কাজ আর করতে পারে না স্বপন। একটু হালকা, একটু আরামের জীবন! বুক ভরে একটা শ্বাস নেয় স্বপন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে নদীর চড় জুড়ে। রাজবাড়ীর সামনের মাঠটা জুড়ে শুধু জোনাকি আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। স্বপন রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে খুব সন্তর্পণে ঘাটের দিকে এগোতে থাকে। আজ ও কায়দা করে শিবু রাজেনকে এদিক থেকে ভাগিয়েছে। কটা টাকা দিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিয়েছে গঞ্জের হাটে, ভাঙের শরবত খেতে। ওদিককার হাটে পুজোর কদিন মেলা বসে স্বপন জেনেছে। তাড়াতাড়ি ওপার থেকে ফিরতে পারলে বৌয়ের জন্য বাহারী সাজের জিনিস নিয়ে যাবে মেলা থেকে, মনে মনে ভাবে স্বপন। ঘাটের কাছে এসে ও দেখে নায়েব মশাই দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে সেই রঙিন কাঁচের লম্ফ; আর সেই মুসলমান বেঁটে ছোকড়াদুটো ঝলমলে পোশাক পরেছে, মাথায় দুটো নাহারী টুপি পরে, গায়ে আতর চড়িয়ে নৌকার উপর উঠে বসেছে। নৌকায় দুটো মশাল জ্বলছে। স্বপন আর দেরী না করে নৌকায় উঠে বসে। ছোকড়াদুটো তালে তালে মাথা দোলাতে দোলাতে নৌকা ছেড়ে দেয়। পিছন ফিরে স্বপন আর কাউকে দেখতে পায় না, নায়েব মশাই ততক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। চারপাশে চোখ বুলিয়ে স্বপন লক্ষ্য করে কোশী নদীতে জল বেশ বেড়েছে। অন্য সময় এই নদীর চড়ায় বনকলমীর ঝাড় হয়ে থাকতে দেখেছে স্বপন। আজ নৌকা বাইতে বিশেষ কষ্ট হচ্ছে না। কুলকুল শব্দে নদী বয়ে চলেছে নিজের তরঙ্গিনী গতিতে, যেন সাম্যালয়ে জীবন চলছে। খুব বিশেষ চওড়া না নদীটা। দূর থেকে এঁকে বেঁকে এসে আবার দূরে মিলিয়ে গেছে। গাঢ় অন্ধকারে কালচে নদীর জল মায়া বুনছে যেন! উত্তেজনার চোটে স্বপন আবার বাৎকর্ম করে ফেলে। বায়ু নির্গত করে হালকা হবার বদলে আরও সতর্ক হয়ে ছোকড়াদুটোর মুখের দিকে তাকায়। আজ লক্ষ্য করে ওদের মুখের গড়ন কেমন যেন একরকম! অনবরত ওরা দুজনে দুজনের বিপরীত দিকে মাথা দোলাচ্ছে ঠিক যেন দুটো পেন্ডুলাম ক্লক। নৌকার দাঁড় বাইতে বাইতে সমানে মুখে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে বলে চলেছে, “আব্বুলিশ/ বাপপুলিশ/ ছাপপুলিশ/ কাপপুলিশ।” ওদের দেখে স্বপনের একটু অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়। নৌকো আস্তে আস্তে ওপারে ভেড়ে। স্বপন নৌকো থেকে চড়ার বালিতে পা দিলে ওরা আবার নৌকো ভাসিয়ে দেয় জলে। পেছন ফিরে বেশ অনেকক্ষণ ওদের দিকে চেয়ে থাকে স্বপন। দূর থেকে ওদের সমবেত কণ্ঠ ভেসে আসে, “আবার দেখা হবে।” অস্ফুট স্বরে স্বপন জিজ্ঞেস করে, “কবে? কোথায়?” উত্তর আসে, “ওপারে। হয়তো বা কালই হয়তো বা পরের জনমে।” খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ছেলেদুটো। নৌকোটা ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশে যায়। 

হালকা অন্ধকারের সর ভেঙে নদীর পাড় থেকে হোঁচট খেতে খেতে সমতলে উঠে আসে স্বপন। ছেলেগুলো একটা মশালও দিয়ে যায়নি। এই অন্ধকারে আর কিছু না হোক সাপ খোপও তো থাকতে পারে! মনে মনে ভয় পায় স্বপন। এভাবে রাজা আর তাঁর নায়েবের কথায় ভুলে এপারে চলে আসাটা ওর উচিৎ হয়নি। স্বপন মোটেই বোকা নয়, আজ অবধি ওর ঠিকেদার ওকে টুপি দিতে পারেনি। আসলে অভাবের জ্বালা বড় জ্বালা। অভাব আর পেটের খিদেই জন্ম দেয় লোভের। অতিরিক্ত লোভ থেকেই পাপ করে মানুষ। কথায় আছে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু! হয়তো ও নিজেও সেই লোভের শিকার! হয়তো ওর ওপারে ফেলে আসা জীবনটা, ওর খাটনির জীবনটাই ভালো ছিল। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সামনে লাল কাঁকড় ভরা মেঠো পথ পায় স্বপন। দূর থেকে একটা আলোর রেখা ভেসে আসছে। চারপাশে ঘন বাঁশ বেতের জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু পথ। আলোটা যেন স্বপনকে টানতে থাকে। নায়েব কোন দেবীর মন্দির বলেছিল যেন! সবার আগে ওই মন্দিরটাকেই খুঁজে বার করতে হবে। কিছুদূর এগোতে সামনে একটা জটলা চোখে পড়লো স্বপনের। কিছু লোক জড়ো হয়েছে একটা ফাঁকা জায়গায়। তাদের বেশভুষো খনি শ্রমিকের মত, হাতে একটা করে মশাল। এদের সামনে ঢ্যাঙা মতন একটা লোক উত্তেজিত হয়ে, ভাষণ দেবার ভঙ্গীতে কিছু যেন বলছে। ঠিক যেমন পিকেটিং বা জনসভায় হয়, সেরকম। অনেকক্ষণ কান পেতে ওদের কথা শোনে স্বপন। কিন্তু বিন্দুবিসর্গ কিছু বুঝতে পারে না। এটা ঠিক কি ভাষা? খুব গ্রাম্য মেঠো বাংলাও তো নয়! বিরক্ত হয়ে স্বপন আবার সামনের পথ ধরে। একটা আদিবাসী বস্তি চোখে পড়ে ওর। মাটির বাড়িগুলোর গায়ে মশাল জ্বলছে, দেওয়ালে লতাপাতা আঁকা। বাড়িগুলোর পিছনের দিকে ধানক্ষেত। ছেলে-বুড়ো-মেয়েছেলে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ির দাওয়ায় বসে আছে। জঙ্গলটা এখানটায় আরো ঘন হয়েছে যেন। আরো কিছুদূর এগিয়ে একটা টোল চোখে পড়লো স্বপনের। একদল কচিকাঁচা একসঙ্গে জড়ো হয়ে বসে নামতা পড়ছে আর ওদের সামনে বসে একজন গুরুমশাই, মাথাভরা টাক, পিছনের টিকিতে একখানা কলা বাঁধা, চোখমুখ টিকোলো, কালো রঙের দড়ি পাঁকানো চেহারা, একটা ছিপছিপে বেত রাখা ঠিক পাশটায়। বেতের লাঠিটা দেখে স্বপনের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় ইস্কুলে ও আর মদনা পাশাপাশি বসত পেছনের বেঞ্চিতে আর অংকের স্যারের ক্লাসে দুজনে কি বাঁদরামিটাই না করতো! তারপর ধরা পড়লে এরকম বেতের বাড়ি কত খেয়েছে দুজনে। একজন দোষ করলে অন্যজন হাত বাড়িয়ে দিত আগে থাকতে। একদিন তো মদনা মার খাওয়ার সময় স্যার এর গায়ে টিকটিকি ছেড়ে দিয়েছিল তারপর বেশ কিছুদিন আর ইস্কুল মুখো হয়নি দুজনে। মদনাটা চিরকালই বড্ড সাহসী ছিল। কোথায় যে গেলো ছেলেটা! সেই শেষ যবে স্বপন দেখেছিল তার প্রাণের বন্ধুকে সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। বার বার মনের মধ্যে ভেসে উঠছিলো মদনের মুখটা। সেই মুখটা যেটা স্বপন শেষ বার দেখেছিল। অজানা অন্ধকারে হারিয়ে যাবার আগে হাড়ভাঙ্গা খাটতে খাটতে কৈশোরের চোয়াল ভেঙে যাওয়া একটা মুখ। চোখদুটো বুজে আসে স্বপনের। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে এসে স্বপনের জামাটা ভিজিয়ে দেয়। 

হঠাৎ ওর পিঠে একটা হাত এসে পড়ে। চমকে গিয়ে চোখ খোলে স্বপন, ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে থ মেরে যায় ও। এ কাকে দেখছে স্বপন! নিজের দুটো চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না স্বপন। সেই মুখ, সেই চেহারা বদলায়নি একটুও। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ঠিক যেরকম দেখেছিল, আজও ঠিক সেরকমটাই আছে। এ যে ওর অভিন্ন আত্মা বন্ধু, দুই শরীর এক প্রাণ মদন, - মদনা। নিজের দুটো চোখ কচলে নিয়ে জামায় মোছে স্বপন। অস্ফুটে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “আরে মদনা তুই?” হাঁড়িচাঁপা গলায় মদন বলে ওঠে, “কিরে ট্যাবলা তুই একেনে? রসুলপুর রাজবাড়িতে কাজ নিয়েছিস বুঝি?” আকাশ থেকে পড়ে স্বপন। এ নিশ্চইয়ই ওই ব্যাটা নায়েবের কীর্তি! আগে থেকে ওপারের সব কথা এপারে ফাঁস করে দিয়েছে। ব্যাটা ফোঁপর দালাল! মদন আবার বলে ওঠে, “কিরে ধামসী দেবীর মন্দিরে যাবার পথ খুঁজছিস? চ আমি নিয়ে যাচ্ছি” স্বপনের তখন বিশ্বাস হচ্ছেনা নিজের চোখকে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে সেই মদনা, আজ পঁয়ত্রিশটা বছর যার কোন খবর নেই। ওকে তো বাড়ির লোক নিরুদ্দেশ ঘোষণা করেছিল, পুলিশ ও কোনো কিনারা করতে পারেনি। আর পারবেই বা কি করে? মদনা তো বাইরে কাজে গিয়েছিল, ঠিক কোথায় কাজে গিয়েছিল কেউ জানতো না। ওর পরিবারে তো মা আর দুই বোন ছাড়া তেমন কেউ ছিল না। ওদেরকেও মদনা ঠিক করে কিছু বলে যায়নি। কেমন যেন একটা চাপা অভিমান ছিল ওর ভিতর সৰ কিছু নিয়ে। ও গরীব, পড়াশুনাতে মাথা থাকলেও পরিস্থিতির চাপে বেশীদূর পড়তে পারলো না। দুটো বোনের বিয়ে দিতে হবে, অসুস্থ মা এইসব কিছু নিয়ে একটা ঘোলাটে ধরণের বিষাদে ডুবে থাকত ছেলেটা! এক একসময় মুখে কিছু বলতো না, বা হয়তো সবার কাছে অভিযোগ করতো না - কিন্তু স্বপনের কাছে ওর মনের কথা খুলে বলতো কখনো কখনো। 

স্বপন আর মদন ছিল প্রাণের বন্ধু। স্কুলে দুষ্টুমি করা থেকে এর ওর বাগানে সরস্বতীর পুজোর সময় কুল চুরি করতে যাওয়া, মল্লিকদের বাগানে সবেদা পাড়তে যাওয়া, রাজহাঁসের খাঁচা থেকে ডিম চুরি করে বার করে আনা সবেতেই ওরা দুজন একসাথে থাকতো। বাগানে ঢুকে মদন সবেদা গাছ বেয়ে তরতরিয়ে উঠে পাকা টুসটুসে সবেদাগুলো পেরে, উপর থেকে ছুঁড়ে স্বপনকে দিত। তারপর দুজনে মিলে আয়েস করে সেই সবেদা খেয়ে বিচিগুলো রাস্তায় এর ওর গায়ে ছুঁড়ে মারত। দুজনের নামে নালিশ হত স্বপনের বাড়িতে। স্বপনের মা কখনো আদর বা শাসন কোনোটাতেই ওদের দুজনের মধ্যে ভেদ করেননি। মদনকে তিনি ভালোবাসতেন নিজের পেটের ছেলের চাইতেও বেশী। মদনাটা যেদিন হারিয়ে গেল, সেদিন থেকে স্বপন ওর মা কে দেখেছে দুপুর বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে। হয়তো ওর মায়ের আরও কষ্ট ছিল, কিন্তু মদনার কথা ওর মা মারা যাবার আগের দিন অবধি বলতো। বলতো নাকি স্বপ্নে মদনকে দেখতে পেত ওর মা। একটা নাম না জানা গ্রামে রয়েছে মদনা। স্বপনের মা কে দেখলে খালি হাসে। স্বপনের বিশ্বাস হত না, কিন্তু আজ সেইরকম একটা গ্রামেই মদনের সাথে দেখা হল স্বপনের। এটা কি শুধুই কাকতালীয়? 

মদনকে কত কিছু বলবার মত কথা স্বপনের পেটে আসছে, কিন্তু মুখে আসছে না। কিছুটা আগে আগে মদন হেঁটে চলেছে তার পিছু নিয়েছে স্বপন। কিন্তু স্বপন যে এপারে আসবে সেটা কি মদন জানতো আগে থেকেই? ধামসী দেবীর মন্দিরে কি ওও এর আগে গিয়েছে? ও কি পেয়েছে সেই গুপ্তধনের সন্ধান? ধনসম্পদ পেয়ে কি আর ওদিকে ফেরেনি? দিব্যি আছে এখানে! মনে মনে মদনের প্রতি হিংসা হয় স্বপনের। পথ চলতে চলতে স্বপন দেখতে পায় আশেপাশে যে যার কাজ করছে নিজের মত। কেউ রাস্তা থেকে পাতা কুড়োচ্ছে, কেউ মাথায় সবজি ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে হেঁটে চলেছে ক্ষেতের পাশের ঘাসের বলিরেখা বেয়ে, কেউবা আবার নেহাতই আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। সবাই যেন কেমন একটা অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ, ঠিক এই মদনাটারই মত। কেমন যেন আলগা সুতোর মত ওরা সবাই সবসময় কালনিদ্রায় ডুবে আছে। ঘুরতে ঘুরতে ওরা সেই মিটিংয়ের জায়গাটাতে এসে পরে। লোকগুলো এখনো সেখানে বসে আছে। স্বপন এবার প্রশ্ন করে, “ওরা কারা রে মদনা?” আবার হাঁড়িচাপা গলায় মদনা উত্তর দেয়, "ওরা সবাই খনি-মজুর। এই রসুলপুরের মাটির নীচে সোনার খনি আছে, তা জানিস?" কথাটা শুনে স্বপনের মুখ আবার হাঁ হয়ে যায়। মদন বলতে থাকে, “ওই যে কোশী নদী, ওর জল ছেঁচলে সোনা পাওয়া যায়। সেই সোনা ওই রাজার তোষাখানায় সাপ্লাই দিয়ে এদের পেট চলে। এখন রেট কমেছে, চাবুকের ঘা বেড়েছে তাই এরা সব ধর্মঘটে বসেছে। আদিবাসী সব। কি বলছে বোঝা তোর কম্ম নয়! মুহূর্তে স্বপনের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। রাজা যদি ইহজগতের না হয় তাহলে মদনাও কি? আর এরা? গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে স্বপনের। কিছুক্ষনের স্তব্ধতা যেন পরিবেশটাকে আরও থমথমে করে দেয়। মদনা বলে চলে, “বাবা মারা যাবার পর, পড়াশুনা তো খুব বেশী হল না। সবই তো জানিস আমাদের অবস্থা কেমন ছিল! তোদের বাড়ি থেকে রুটি চেয়ে খেতাম। পেটের দায়ে এটা সেটা করতে শুরু করলাম। তারপর লাগলাম বিনোদ কাকার গ্যারাজে। সেখানেও দু বেলা লাথি ঝ্যাঁটা। দূর! বিরক্ত হয়ে লাল্টুদার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজে ভিড়ে গেলাম। হঠাৎ একদিন দলবল নিয়ে আমরা কাজে লাগলাম ওই রসুলপুর রাজবাড়িতে। তারপর একদিন ওই রাজা আর নায়েব মোহরের লোভ দেখিয়ে এপারে পাঠিয়ে দিল। আর ফিরতে পারিনি ভাই। কালের খাঁচায় আটকা পরে গেছি।” 

মুখটা ছোট হয়ে যায় স্বপনের। সবটুকু বোঝা হয়ে গেছে ওর এতক্ষণে। কিন্তু ওকে যে ফিরতে হবেই। মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে ওর। আফসোসের সুরে মদন বলে ওঠে, “তোকেও ওরা লোভ দেখিয়ে এখানে পাঠিয়েছে রে ট্যাবলা। কিন্তু সে মোহর কি তুই পাবি? তুই কি আড়াই প্যাঁচের মন্ত্র জানিস? বোগো কাপালিক তোকে এখান থেকে আর ফিরতে দেবে না। তবে তোর কোন ক্ষতি ও করবেনা।” কথাগুলো শুনতে শুনতে স্বপনের মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ। যেন একশোটা লোক ঢ্যাড়রা পিটছে সেখানে। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসে ওর। ওর বেগুন ভাজার মত ঝুলে যাওয়া মুখটা দেখে দাঁত বার করে হাসতে থাকে মদন। বলে, “ইতিহাসে তো তুই সারা জীবনই গাড্ডু পেয়ে এলি। মনে আছে? ইস্কুলে ইতিহাস পিরিয়ডে পেছনের বেঞ্চ থেকে মিউ ডাকতিস! বর্গীদের নাম শুনেছিস তো। আরে হ্যাঁ রে ভাই, এটা সেই ছড়ার বর্গী, যা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছিস।” স্বপনের মাথায় তখন সাত পাঁচ চিন্তা ঘুরছে। এই বোগো কাপালিক কে? আড়াই প্যাঁচের মন্ত্রটাই বা কি? কিভাবে শিখতে হয় সেই মন্ত্র? ওদিকে মদন তখনও বলে চলেছে। নিরুত্তাপ আকাশে দয়াহীন নবমী চাঁদে তখন পুরোদস্তুর পোড়া লেগেছে। কাল চৌহুদ্দির যোগবিন্দুতে নষ্ট জাগতিক মায়াপাশে জড়িয়ে তার আপেক্ষিক গতি যেন কালের হিসেবে গুলিয়ে দিচ্ছে।

 

৭ 

রাজা রায়নারায়ণ হেমেন্দ্রর কুলদেবী ছিলেন মা চন্ডী। সেটা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়। দেশে বর্গী আক্রমণ হল। মহারাষ্ট্র থেকে উল্কাবেগে ছুটে এসে ভাস্কর পন্ডিতের বিশাল সেনাবাহিনী উড়িষ্যাকে তছনছ করে, দক্ষিণ পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশ করলো রাঢ় বঙ্গে। রাজা হেমেন্দ্র ছিলেন প্রবল অত্যাচারী। প্রজাদের উপর নানা কারণে অকারণে পাশবিক নির্যাতন, মেয়েদের উপর অত্যাচার ইত্যাদি নানান ধরণের ব্যাভিচার ছিল রাজার মজ্জাগত। সঙ্গে ছিল নায়েব ‘ধূলাকটি দাস’ এর কুপরামর্শ। ফলত রসুলপুর এর জমিদারীতে রাজার বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরী হয়েই ছিল। সেই সুযোগে ভাস্কর পন্ডিত তাঁর সবচেয়ে পারদর্শী, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সেনাপতি ‘মান্দার রাও’ কে পাঠালেন গড় রসুলপুর দখলের জন্য। তখন বাংলার মসনদে আসীন নবাব ‘আলিবর্দী খাঁ’। চল্লিশ মণ সোনা রসুলপুর থেকে ভেট পাঠিয়ে রাজা হেমেন্দ্র পেলেন ‘রায়চৌধুরী’ খেতাব। রাজার একটি দ্বাদশ বর্ষীয়া মেয়ে ছিল, নাম ‘হেমলতা’। সে তন্ত্রমতে দেবী চন্ডীর উপাসনা করত। কোনো এক মহালয়ার আগে মান্দার রাও রসুলপুর আক্রমণ করলে সেই মেয়ে দেবী চন্ডীর উপাসনা শুরু করে। সিদ্ধি লাভের জন্য নিজের এক সখীকে সে দেবী চন্ডির সামনে বলি দেয়। যদিও রাজ্যের এই দুর্দিনে সেই নরবলি উৎসর্গের স্বইচ্ছায় হয়েছিল। দেবী সেই নররক্তে তুষ্ট হয়ে তাঁর প্রধান সহচরী ‘ধামসী’ কে রণক্ষেত্রে পাঠান। এই ধামসী ছিলেন মায়াবিদ্যায় পারদর্শী এক অপদেবী। নিজের মায়ার জালে আবিষ্ট করে তিনি মান্দার রাও আর তাঁর সেনাবাহিনীকে পাশবদ্ধ করে ফেলেন। মান্দার রাও পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান। কিন্তু কানা ঘুষোয় শোনেন এই অপদেবীর কথা, রাজার মেয়ের কথা। সুচতুর মান্দার রাও চাললেন মোক্ষম চাল। কথায় আছে যুদ্ধেই সেনাপতির জয়। সেখানে নৈতিকতার স্থান নেই। সুপুরুষ মান্দার রাও তাঁর বিশ্বস্ত কিছু অনুচর নিয়ে ভৃত্যের কাজ নিলেন গড় রসুলপুরে। নিজে রইলেন মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায়। তাঁর অনুচরেরা রাজার মেয়ে হেমলতার মহলের দাসীদের প্রেমে অনুরক্ত করে ফেললো ধীরে ধীরে। বলিষ্ঠ চেহারার অধিকারী উজ্জ্বল বর্ণ সৌম্যকান্তি পুরুষের মোহজাল অস্বীকার করা এই বঙ্গনারীদের পক্ষে তখন প্রায় অসম্ভব। তারাই মান্দার রাও এর সাথে পরিচয় করালো রাজকুমারীর। মান্দার রাও-এর মোক্ষম মদনবাণে আসক্ত হয়ে নিজের হৃদয় মান্দার এর চরণে সঁপে দিলেন হেমলতা। কাকপক্ষীতেও টের পেল না সে কথা। এক তরফে তখন নিবিড় সে প্রেম - আর অন্য দিকে তা নিছক খেলা মাত্র, কপট ক্রূর এক যুদ্ধকৌশল। তারা দুজনে ঠিক করলেন কোশী নদীর পূর্ব তীরে পালিয়ে যাবেন, সঙ্গে নেবেন রাজ কোষাগার থেকে দশ ঘড়া সোনা-দানা, মোহর, দামী রত্ন। সেই মত তোষাখানার কর্মচারীদের উৎকোচ দেওয়া হল। অত বিশাল গড় জুড়ে তখন শুধুই বিশ্বাসঘাতকতা আর খল ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প খেলা করছে। আমোদ বিহারে মগ্ন রাজা হেমেন্দ্র নারায়ণ টেরও পেলেন না কিছুই। নিজেদের ঠিক করা দিনক্ষণ অনুযায়ী মান্দার আর হেমলতা পালিয়ে গেলেন নদীর পূর্ব পাড়ে। স্বামীর কল্যাণার্থে ধীরে ধীরে সেখানে দেবী চন্ডীর ঘট প্রতিষ্ঠা করে শুরু করে দিলেন পূজা। ছলে বলে কৌশলে মান্দার সেই পূজা ধীরে ধীরে শিখতে লাগলেন। 

এদিকে রাজবাড়ী থেকে হেমলতার পালানোর খবর চাউর হয়ে গেলো। রাজাও জানতে পারলেন ওদের এই পাড়ে পালিয়ে আসার কথা। নিজে এই পাড়ের গ্রামে এসে বেশ কিছু নিরীহ আদিবাসী প্রজার গর্দান ও নিলেন। কিন্তু মান্দার আর হেম কোথায় আছেন সে বিষয়ে কারো মুখ খোলাতে পারলেন না। তখন এই সাহসী প্রেমিক যুগল রাজার বিরুদ্ধে গ্রামবাসীর সকল প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে। এমনকি হেম অবধি নিজের বাবার এইসব অত্যাচার, দমন পীড়নের স্বরূপ জানতে পেরে গ্রামবাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তখনও তিনি মান্দার এর আসল পরিচয় জানতেন না। ক্রমশঃ মান্দার মায়াবিদ্যা চর্চ্চায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠলেন। এরপর কোন এক মহালয়ার কোটায় কৃষ্ণানবমী তিথিতে মান্দার বন্দী করলেন নিজের স্ত্রীকে। বলি দিলেন মা চন্ডীর ঘটের সামনে। জীবনের অন্তিম সময়ে এসেও হেমলতার চোখে কী নিদারুণ কষ্ট তখন! হাড়িকাঠে মান্দার এর কপট রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে হেমলতার দুই চোখ বেয়ে বেরিয়ে এলো অশ্রুধারা। সে চোখ তখনও মানতে পারছেনা তার সাথে ঘটে যাওয়া এই ভয়ানক চাতুরীর কথা। মান্দারের উদ্ধত তরোয়াল নেমে এলো হেমলতার মস্তকে। লুটিয়ে পড়লো তাঁর মাথা, নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত তার একদা আরাধ্যা দেবী চন্ডীর ঘটের ঠিক সামনেতে। কণ্ঠনালীর সমস্ত শিরা ধমনী বেয়ে নিষ্প্রাণ দেহের সব রক্ত নির্গত হয়ে সেই স্থানে নির্মাণ করলো এক নিকষ শোণিত জাল। দেবী চন্ডী প্রকট হলেন মান্দার রাও এর সামনে। তার নর নিধনের প্রসাদ স্বরূপ মান্দার ধামসী দেবীর প্রভুত্ব প্রাপ্ত হলেন। সেই দেবীর সাহায্যে মান্দার সে বছর দুর্গা পুজোর মধ্যেই দখল করলেন গড় রসুলপুর। প্রকাশ্য দিবালোকে মুন্ডচ্ছেদ করলেন রাজা আর তার তোষামোদী নায়েবের। পরে অবশ্য নবাব সেনা পাঠিয়ে রসুলপুর পুনরুদ্ধার করেন। আসলে হেমলতা বিশ্বাসহীনতার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। সে বলি তো তাঁর স্বেচ্ছায় ছিল না। তাই সম্পূর্ণ সিদ্ধি পাননি মান্দার। নবাবী সেনার তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসেন আবার কোশী নদীর পূর্ব পাড়ে। এখানটায় তার ক্ষেত্ৰবন্ধন করা ছিল তাই নবাবের সেনা এদিকে প্রবেশ করতে পারেনি। নবাবের সেনা মান্দার রাওকে ধরার জন্য কোশী নদী পেরোনোর সময় হঠাৎ করেই নদীতে প্রচন্ড জোরে বান আসে। সেই জলের তোড়ে নবাবের চতুরঙ্গ সেনা সহ সমরপালেরা ভেসে যায় অকূলে। এতদিনের মায়াবিদ্যার অভ্যাসে রচিত মান্দারের ক্ষেত্ৰবন্ধন অটুট থাকে। সেই থেকে তিনি আবার শুরু করেন দেবী ধামসীর সাধনা। এর পর থেকে প্রায় প্রতি অমাবস্যার রাতে নরবলির প্রয়োজন হত তাঁর। অবুঝ আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর মায়া বিস্তার করে তিনি বলি জোগাড় করতেন। কালের নিয়মে উগ্র তন্ত্র সাধনার ফলে তাঁর পার্থিব শরীর এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। মান্দার রাও এখন এ গাঁয়ের ‘বোগো কাপালিক’। কালের চাকা এখন তাঁর বশীভূত। আর হেমের অতৃপ্ত আত্মা আজও যক্ষিনী হয়ে তাঁর বাবার সম্পদ পাহারা দিচ্ছে। সেই সম্পদ তাই মান্দার রাও আজও হস্তগত করতে পারেননি। যদিও তাঁর লক্ষ্য এখন আরও অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করা। এদিকে নবাবের সেনার তাড়া খেয়ে মান্দার রাও এর সৈন্যবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো চতুর্দিকে। তারা কেউ কেউ মিশে গেলো এই রাঢ় বঙ্গের গ্রামে-গ্রামান্তরে। অনেকে আবার এই বঙ্গদেশের রমণীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে বসতি গড়লো জীবিকার জন্য। এঁরা তখন মূলত নদীপথে ভোজ্য তেল আর তৈজস দ্রব্যাদির বাণিজ্যে যুক্ত হয়ে পড়লো। কুন্দন এর অলংকারের ব্যবহার ভীষণ প্রচলিত ছিল এঁদের ভেতর। সেই কুন্দন শব্দের অপভ্ৰংশ থেকে সৃষ্টি হলো নতুন পদবী ‘কুণ্ডু’। পরবর্তীতে জাতি বিন্যাসে এঁরা মূলতঃ তিলি বা তেলজাত দ্রব্যের বানিয়া গোষ্ঠীর শ্রেণীভুক্ত হল।

 

৮ 

স্বপন হাঁটছে মদনের পিছু পিছু। আশপাশটা কিরকম অবিশ্বাস্য রকমের থম মেরে আছে! দূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। অদূরে চিতার আলোয় লাল হয়ে গেছে আকাশটা। সামনেই শ্মশান বোঝা যায়। মরা পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ ভেসে আসছে স্বপনের নাকে। মদন কিন্তু নির্বিকার, সে যেন কালকে জয় করেছে। জাগতিক ভয়-ঘৃণা-ক্রোধ আর তাকে বিচলিত করতে পারে না। সামনের একটা উলু খাগড়ার ঝোপের আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে একটি চিতা। তার উপরে যোগাসনে আবিষ্ট এক ভীষণদর্শন তান্ত্রিক। কেশরাজিতে তাঁর অবিন্যস্ত জটাভার, চক্ষুযুগল রক্তবর্ণ, আজানুবিস্তৃত অভেদ্য গোঁফ দাড়ির জঙ্গল, প্রায় উলঙ্গ শরীরটার নাভীমূলের পর আর কিছু দেখা যায় না। প্রচন্ড লেলিহান শিখা তাঁকে স্পর্শ করছে মাত্র। চিতায় জ্বলন্ত শবের উপর বসে তিনি ক্রমশঃ আহুতি দিয়ে যাচ্ছেন, আর মন্ত্র পড়ছেন বিড়বিড় করে, “ওম্ হ্রীম্ সিম্ চামুন্ডায়ৈ তর্পময়ৈঃ স্বাহা / ওম্ হ্রীম্ সিম্ চামুন্ডায়ৈ তর্পময়ৈঃ স্বাহা / ওম্ হ্রীম্ সিম্ চামুন্ডায়ৈ তর্পময়ৈঃ স্বাহাঃ।” মৃত্যুর জটিল অববাহিকা জুড়ে তখন কেবল ঋজু কন্ঠের মন্ত্র নিনাদ আর মৃতদেহের অসাড় আর্তনাদ। লক্ষ লক্ষ সংলাপহীন প্রেতযোনি যেন জেগে উঠছে পঞ্চভূতে। নিদারুণ পৈশাচিক উল্লাস যেন তখন নৃত্য করছে লৌকিক আর অলৌকিকের মাঝে স্থিত সেই মায়া লোক জুড়ে। মদনের দৃষ্টি সেই অতিমানবের দিকে, স্থির আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে সে স্বপনকে বললো, ‘বোগো কাপালিক’। কাপালিকের পাংশুটে মুখে মাংস প্রায় নেই বললেই চলে, দেহ কেবলই অস্থিচর্মসার। স্বপন মায়া বশীভূতের মত চেয়ে থাকে সেই দিকে। ক্রমাগত দানবীয় মন্ত্রোচ্চারণ যেন ক্রমশঃ আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে ওকে। “এতে গন্ধপুস্পে, ওম্ সিম্ ক্লিম্ হ্রীম্ ঔম্ হউম্ বজ্রবৈড়চন্ডী হুং হুং ফট্ স্বাহাঃ।” মন্ত্র পড়তে পড়তে সেই কাপালিক নিজের ডান হাতের মদের বোতল থেকে একটি ছোট মড়ার খুলিতে মদ ঢালতে ঢালতে বাম হাতে, চিমটে দিয়ে জ্বলন্ত শবের মাথার খুলিটা ফাটিয়ে ঘিলুটা বার করে, সেই মড়ার খুলির ভেতর রেখে মদের সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেললো। সেই দৃশ্য দেখে স্বপনের নাভি গুলিয়ে বমি পেলো। পচা মাংসের একটা গন্ধ ভেসে এলো ওর নাকে। কাপালিক তখনও মন্ত্রোচ্চারণ চালিয়ে যাচ্ছে, “পাদ্যং প্রচন্ড চন্ডিকা দেবতায়ৈ নমঃ / ইদং অর্ঘ্যং প্রচন্ড চন্ডিকা দেবতায়ৈ তর্পময়ৈঃ নমঃ / ওম্ ধুপ দীপ্যং প্রচন্ডচন্ডিকায়ৈঃ দেবতায়ৈঃ নমঃ।” মদের বোতলটা আবার হাতে নিয়ে সেই করোটির উপর মদ ঢালতে লাগলো কাপালিক, “কারণ্যং পঞ্চদআসনেভ্যঃ তর্পময়ৈঃ স্বাহাঃ / মহাপাত্রেভ্য স্বাহাঃ / কৃতকারা হং ফট স্বাহাঃ।” কাপালিকের চতুর্দিকে অন্ধকার আরো ঘন হচ্ছে যেন। যেন সেই অন্ধকার জমে জমে আবির্ভাব হবে কোন অশরীরীর। “ওম্ সিঁদুর বর্ণানি চ, এতে গন্ধপুস্পে যাং যোগিনীভ্য নমঃ / ওম্ কারণ্যং ডাং ডাকিনীভ্য তর্পময়ৈঃ স্বাহাঃ / মহাপাত্রেভ্য নমঃ / মহাসর্পায় নমঃ / মহাকালেভ্য নমঃ” কাপালিক হাতের মদের বোতলটা উঁচু করে উপর থেকে সামনে মদ ঢালতে লাগলো আর সেই দুরূহ যজ্ঞভূমির কালান্তক অমানিশা চিরে প্রকট হয়ে এক জোড়া লোলুপ জিহ্বা আকণ্ঠ পান করতে থাকলো সেই তৃষ্ণীভূত বাতাস ঘেঁষে চুঁয়ে পড়া নির্ভার কারণবারিধারা। চিতার আগুনটা প্রবল তেজ লাভ করে নিভে আসে আস্তে আস্তে। কাপালিক এবার চিতা থেকে নেমে এসে পাশের গাছে বাঁধা একটা কুঁচকুঁচে কালো পাঁঠা কে হাতের কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে স্নান করাতে থাকে। কাপালিকের কোমরে শত সহস্র নরহস্ত বপন করেছে অভেদ্য লজ্জাবস্ত্র। পাঁঠাটার কপালের শিঙে সিঁদুর মাখিয়ে কাপালিক মন্ত্র পড়তে থাকে, “ওম্ সিদুরবর্ণানী চ, ছাগ পশবে নমঃ / এতে গন্ধপুস্পে ছাগ পশবে নমঃ / ওম্ শুভকর্ণঙ্গ অমান্যং ভাগ্যং মিষ্ঠান্যং নৈবেদ্যং শর্করা নৈবেদ্যং ফলতাম্বুলাম্ নমঃ / ছাগ পশবে নমঃ।” মন্ত্র পড়তে পড়তে পশুটির দিকে ফুল বেলপাতা মিষ্টি ছিটিয়ে দিল কাপালিক। অবোধ পশুটি সেগুলো তখন চিবোতে ব্যস্ত। এবার কাপালিক তীব্র হুংকার ছেড়ে পাঁঠাটার দুটো শিং দুহাতে বজ্ররোষে ধরে জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে লাগলো, “ওম্ সিদুরবর্ণানী চ, করামাংস মহামাংস ছাগাদি কচ্চস পঞ্চমকারাঞ্চ মহাপতি বিশ্ববিশস্য স্বাহাঃ।” চারপাশের অদৃশ্য ক্ষেত্র থেকে বেজে উঠলো ঢাক-ঢোল-কাঁড়া-নাকাড়া-শিঙে মিশ্রিত একটা বাজনা। এই বাজনা স্বপন আগে শুনেছে স্বপ্নের ভেতর। বঙ্গদেশের সাধারণ বলির বাজনার সাথে এর যেন কোন মিলই নেই। দুহাতে চ্যাংদোলা করে নিয়ে পাঁঠা টাকে সামনে রাখা একটা বিশাল খড়গের মাঝে ফেললো কাপালিক। তারপর দুহাতে চাপ দিয়ে ঘষে ঘষে কাটতে লাগলো। সেই অসহায় পশুর নির্মম মৃত্যুযন্ত্রণায় পরিত্রাহি চিৎকার, একনাগাড়ে চলতে থাকা বলির বাজনাটাকে ছাপিয়ে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে লাগলো বাঁচার আকুল প্রার্থনায়। যেন সমস্ত জীব জগৎ পরিত্রাণ চাইছে এই বিমর্ষ পাশবিকতার হাত থেকে। পরমাত্মার কাছে তাদের সেই ব্যাকুল নিবেদন অক্লেশে গ্রাস করে নিচ্ছে সেই ভীমসম কাপালিকের হরসীমন্তিনী অট্টহাসি।

স্বপন আর নিতে পারলো না দৃশ্যটা। মদন ওর হাত ধরে ওকে সরিয়ে নিয়ে এলো সেখান থেকে। ওরা এবার এসে দাঁড়ালো একটা পোড়ো ভাঙা মন্দিরের সামনে। অন্ধকারে মন্দিরের গগনচুম্বী চূড়া দেখা যায় না ভালোভাবে। মন্দিরের সামনে একটা হাঁড়িকাঠ। মন্দিরের দরজা হাট করে খোলা, সেই দরজা দিয়ে ভেতরে চোখ চলে যায় স্বপনের। গর্ভগৃহের ভেতরের ছাত থেকে বিশাল বিশাল তেলের প্রদীপ ঝুলছে। সেই আলোতে মূর্তির ওপর চোখ যেতেই শিউরে ওঠে স্বপন। এ যেন মাটির বা পাথরের মূর্তি নয়, এ মূর্তি যেন জীবন্ত। এই দেবীকেই সেদিন ওপারের রাজবাড়িতে রাতে স্বপ্নে দেখেছিল স্বপন। বীভৎস বসনা করালী রূপ দেবীর। কোটোরগ্রস্ত দুটো বিশাল রক্তবর্ণ চোখ, দেবীর বিদ্যুজিহ্বা যেন মাটি ছুঁতে চাইছে। অর্বুদ সংখ্যারও বেশী ধারালো দন্তরাজি দেবীর আর তাতে ভয়ানক সব পোকা কিলবিল করছে। যেন শত সহস্র বৎসর হতে পচতে থাকা নরমাংস ভক্ষণ করেছেন দেবী। পোকারা এসেছে তারই উচ্ছিষ্টের আশায়। ঠোঁটের দু কোণে ধারালো তরোয়ালের মত দুটি দাঁত যেন লেলিহান উদগ্রতা শানাচ্ছে। সদ্য ভক্ষিত গলিত শবের পচতে থাকা রক্ত যেন গড়িয়ে পড়ছে দেবীর লোলজিহ্বা বেয়ে। দেবীর কেশরাশি যেন আকাশ চুম্বন করতে চাইছে। স্বপন পেছন থেকে শুনতে পায় মদনের গলা, “ট্যাবলা এই হল দেবী ধামসী, কাঁচাখেগো দেবতা একেবারে। বোগো কাপালিক একে এত্ত বছর ধরে জাগিয়ে রেখেছে। তুই কি ভেবেছিলি ওই নায়েব তোর ভালোর কথা ভেবে তোকে এখানে পাঠিয়েছে? ছেলেবেলায় পাড়ার নাড়ুদা কি বলত মনে আছে রে ট্যাবলা? অন্ধকারে সাদা আর কালোর ফারাক করা অত সহজ না!” 

নাড়ুদা ওদের পাড়ায় থাকত। ভালোবাসা করে পাড়ারই মেয়ে মঙ্গলাদিকে বিয়ে করেছিল। মঙ্গলাদির ভাইয়ের সাথে মিলে মাছের কারবার করত। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে নাড়ুদার সেই সম্বন্ধী নাড়ুদাকে পথে বসিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে চম্পট দিল। কয়েকদিন পর মঙ্গলাদিও যেন কার সাথে একটা পালাল। তার পর থেকে নাড়ুদা কেমন যেন একটা হয়ে গেল! জষ্ঠির দুপুরে রাস্তার ধরে গাছতলায় বসে বিড়বিড় করে আবোল তাবোল বকত কিসব! কেউ কাছে যাবার সাহস করতো না। কাছে গেলে নাড়ুদা নাকি কামড়ে দিত। কিন্তু মদন আর স্বপন অনেকবার সাহস করে ওর কাছে গেছে ওদের কখনো কিছু করেনি নাড়ুদা। স্বপন শুনেছিল নাড়ুদা যা বলে তার সবই নাকি আবোল তাবোল নয়। জীবন থেকে কঠিন শিক্ষা পেয়ে নাড়ুদার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতো কথাগুলো। আজ মদনার কথায় স্বপনের সেই দিনগুলোর কথা মনে পরে যায় হঠাৎ। মদন বলে চলে, “আমাদের চোখে, আমাদের মনে সব সময় লোভের অন্ধকার লেগে থাকে রে ট্যাবলা! মায়ায় সেই অন্ধকার আরও গাঢ় হয়। মায়া সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নিজের ওপর মায়া, নিজের পরিবারের ওপর মায়া, নিজের ভালোবাসার লোকের ওপর মায়া। মায়ার জাল ছেড়ে বেরোনো অত সহজ না রে ট্যাবলা! ওই মোহর আমিও পাইনি রে ট্যাবলা, শুধু কালের জালে আটকা পরে গেছি, আর বেরোতে পারিনি। এই পুরো জায়গা জুড়ে কালক্ষেত্র রচনা করে রেখেছে ওই বোগো, ওর পোষা পিশাচ আর দেবী ধামসীর সাহায্যে। ওই যে দেবীর জিভ দেখছিস লকলক করছে সাপের মত, ওটা হলো লোভ আর মোহের চিহ্ন। দেবী নিজের দাঁত দিয়ে সেই জিভকে দমন করে রেখেছেন ঠিক যেমন সাদা আর কালো। কালোকে চেপে রাখতে পারলেই সব সাদা।” একটু থেমে মদন আবার বলে, “শোন রে ট্যাবলা, মায়ের কাছে গিয়ে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা বল। মায়ের দয়া হলে যেটুকু প্রয়োজন, তোর নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য সেটুকু নিয়ে তুই এই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারবি। কিন্তু খবরদার! লোভ করবি না। মনে রাখিস তোর মামা বাড়ি কুণ্ডু। বর্গীর রক্ত তোর শরীরেও আছে।” কথাগুলো বলে মদন কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আর তাকে দেখতে পেলো না স্বপন। 

পায়ে পায়ে মন্দিরের ভেতর ঢুকে পড়লো সে। দেবী মূর্তির চোখে যেন বাঁধা আছে কুহকিনী মায়া। সেই চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে ক্রমশঃ বিভোর হয়ে পড়ে স্বপন, ওর হাত পা অসাড় হয়ে আসে। ও বেশ টের পায় দেবীর তরোয়ালের ফলার মত ছুঁচালো দাঁত ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে ওর দিকে। আস্তে আস্তে সেই দাঁত ঢুকে যাচ্ছে ওর বুকের ভিতর। ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে ওর গায়ের পাতলা চামড়া মাংসের আস্তরণ। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। ঝর্ণার মত নির্গত সেই রুধির ধারায় ভেসে যাচ্ছে দেবীর পাদদেশে রাখা নর করোটিগুলো। ক্রমশ তাদের বিবরদেশ বর্ণ পরিবর্তন করে আরক্তিম বর্ণ ধারণ করে। বিস্ফারিত চক্ষে স্বপন দেখে দেবীর জিহ্বা বিস্তৃত হয়ে ওর রক্তের স্বাদ নিচ্ছে সেই করোটিগুলোর বিবর থেকে। ওই অবস্থাতেই বিবশ দেহে মাটিতে বসে পড়ে স্বপন। হঠাৎ তার চোখ যায় দেবীর পাদদেশে বিশাল আকারের উঁচু ঢিবিটার দিকে। দুটো অসহায় হাত সেদিকে বাড়াবার চেষ্টা করে স্বপন কিন্তু হঠাৎ দেবীর পায়ের পাতা থেকে একটা বিশাল কৃষ্ণকায় বিষধর সাপ বেরিয়ে এসে বিশাল ফণা তুলে দাঁড়ায় স্বপনের বুকের উপর। জ্ঞান হারায় স্বপন। অবচেতনে সে যেন দেখতে পায় উগ্র দেবী ধামসীর চিন্ময়ী রূপ। মমতার কিঞ্চিৎ বারি সিঞ্চিত হয়েছে সেই মুখে, চোখে নেই আর কোন সর্বনাশী মায়া! সে চোখ তখন মায়ের মতোই স্নিগ্ধ। দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনার সুরে স্বপন বলে ওঠে, “মা, মাগো, আমি নিজের জন্য এখানে আসিনি মা। আমি লোভী নই। আমি শুধু ভালোভাবে বাঁচতে চাই। এই দুনিয়ায় একদল কেবল ভালো থাকবে, আরেক দল ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যাবে অন্ধকারের নীচে, এই নিয়ম কেন মা? কে বানাল মা এই নিয়ম? এতো তোমার নিয়ম নয়। বাড়িতে আমার পরিবার আছে মা, দুটো ছোট ছেলে মেয়ে। মেয়েটাকে আমি অনেক দূর লেখাপড়া শেখাব মা। তারপর ওর বিয়ে দেব একদম রানীর মত করে। ছেলেটাকেও পড়াশোনা শিখিয়ে একটা ভালো কাজে লাগাবো, ভালো কাজ মা। যাতে দেশ দশের লোক ওকে সম্মান করে। আমাদের মত মজুরের কাজ নয় মা। আমার তো অত সামর্থ্য নেই মা। তুমি না দয়া করলে কোথায় যাব মা? কোথায় আশ্রয় পাব? মা করুণা করো, মা দয়া করো!” অবচেতনেই দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে স্বপন।

কখন জ্ঞান ফিরেছে স্বপন, নিজেও জানে না। চোখ খুলে সে দেখলো, মন্দিরের অন্তঃপুরে মাটিতে সে শুয়ে আছে। আশপাশ এখন অনেকটাই শান্ত, সেই সাপটিও সরে গেছে সেখান থেকে। ওর বুকের ওপর কয়েকটা মোহর আর একটা সোনার হার পরে আছে। হারটা ওজনে বেশ ভারী, প্রায় বিশ ভরি তো হবেই। সেগুলিকে সাথে নিয়ে স্বপন দেবী ধামসী কে একটা প্রণাম করে। তার শরীরে কোন ঘা, কোন কষ্ট নেই আর। বাইরে তখন ব্রহ্মমুহূর্ত, আর কিছু পরেই ভোরের আলো ফুটবে হয়তো। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো কাল রাতের সেই দানবীয় গর্জন! বোগো কাপালিক মন্দিরে ফিরছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে ছুট লাগায় স্বপন যেদিকে ঠিক মনে হয় সেদিকে। কাল রাতে তো মদন ওকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল, এসময় যদি আরেকবার মদনকে ও দেখতে পেত। এই কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ স্বপন দূরে ওর ছোট্টবেলার বন্ধু মদনাকে দেখতে পায়। মদনা ওর আগে আগে একদম পাখির মত উড়ে চলেছে। আর ওকে বলছে, “আয় ট্যাবলা, চলে আয়। আমার পিছু পিছু আয়। মা তোকে দয়া করেছেন। তুই পারবি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। জলদি আয়।” খুব কাছেই নদী। নদীর জলের স্রোতের কুলুকুলু শব্দ শুনতে পায় স্বপন। হঠাৎই যেন ওর ঠিক পেছনে একটা হিংস্র মুখের উপস্থিতি টের পায় স্বপন। বীভৎস ক্ষিপ্রতায় সেই দানবীয় পিশাচ তাড়া করে স্বপনকে। ক্ষুরধার একটা জিভ বার করে সে বাড়িয়ে দেয় স্বপনের দিকে। ছুরির ফলার মত জিভটা স্বপনের পিঠে খোঁচা মেরে বেশ কিছুটা মাংস তুলে ফেলে প্রায়। বাঁচার একটা মরিয়া চেষ্টা করে চলেছে স্বপন। আর কয়েক হাত যেতে পারলেই নদী। যে করেই হোক ওকে নদী অবধি পৌঁছতেই হবে। একটা প্রাণপণ লাফ দেয় স্বপন। অবাক হয়ে দেখে ও নিজেও পাখির মত শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে কিছুক্ষণ হাওয়ায় শরীরটা ভাসিয়ে রাখতে পারছে। হঠাৎ উড়তে পাড়ার ফলে ওর দৌড়োবার গতি যেন আরো বেড়ে গেছে। মরিয়া একটা লাফ দেয় স্বপন, সোজা এসে ডুব দেয় কালের প্রবাহে বয়ে চলা কোশী নদীতে। নদীতে এখন প্রায় তিনগুণ জল, হঠাৎ করেই বান ডেকেছে যেন। স্বপন সমানে সেই স্রোতে তলিয়ে যেতে থাকে। 

 

৯ 

কোনরকমে সাঁতরে এপারে যখন স্বপন উঠলো, তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর। কিন্তু নদীর পাশে যে ঘাটটা থেকে কাল ও যাত্রা শুরু করেছিল সেটা আর ও খুঁজে পেল না। নদীটা এখন আরো মজে ছোট্ট একটা মাঠ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে যায় স্বপন, এই তো কিছুক্ষন আগে অবধি এই নদীতে তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ও সাঁতার দিচ্ছিল। এপারটা কেমন যেন পাল্টে গেছে অনেকটা। সেই ফাঁকা মাঠটা আর নেই। সেই জায়গায় একটা বিশাল বাড়ি উঠেছে রাজবাড়িটাকে ঘিরে। রাজবাড়ীর যে অংশটায় ওরা কাজ করে গেছিল শুধু সেই অংশটা রেখে বাকি সব পোড়ো অংশগুলো ফেলে দিয়ে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে গেছে। রাজবাড়িটাকে ঘিরে কী ভীষণ ব্যস্ততা এখন! স্বপন দেখে একটা শ্যুটিং পার্টি ভীড় করে আছে বাড়িটার চারপাশে। নায়িকা বসে মেক আপ ঠিক করছে, পেছন পেছন ডিরেক্টর ঘুরঘুর করছে। সেই বিশাল পুরোনো নাটমন্দিরটার জায়গায় ছোট করে মার্বেল দিয়ে বাঁধানো একটা মন্দির আছে এখন। আমবাগানটাও আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই। কিছু গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে শুধু। পেল্লাই পেল্লাই গুঁড়ি সেগুলোর। স্বপন সেগুলো দেখে ভাবে এগুলোর গুঁড়ি কেটে বেশ ভালো জাতের জয়ঢাক বানানো যাবে। স্বপন খেয়াল করে ওপারে মদনা যেমন আকাশে উড়ছিল এপারে এসে ও নিজেও আকাশে উড়ে ভেসে বেড়াতে পারছে, ঠিক একটা পাখির মতন। গয়না যা দেবী ধামসীর আশীর্বাদে ও পেয়েছিল তার বেশীরভাগই নদীর জলে ভেসে গিয়েছে। তবে ওর স্থির বিশ্বাস ওকে ঠিক তেমনি দেখতে আছে, যেমনটা ছিল এপার ছেড়ে ওপারে যাবার সময়।

 

 

0 Comments
Leave a reply