কবিতা এক অনুপম সৃষ্টি

লিখেছেন:জয়ন্ত দত্ত


 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পান্ডুলিপি (ছবি - উইকিমিডিয়া) 

পৃথিবীর প্রথম কবিতাটি কোথায় কখন রচিত হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকদের মতে, প্রথম কবিতাটি রচিত হয়েছিল ভারতবর্ষে শতদ্রু নদীতীরে কোনো এক তপোবন প্রাঙ্গণে এবং তা প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। তা যদি হয় তাহলে, 

"মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।"  

সংবেদনশীল কবি হৃদয়ের বেদনার এই বাণীরূপই পৃথিবীর তাবৎ কবিতার পূর্বসূরী এবং বাল্মীকি যথার্থ অর্থেই পৃথিবীর আদিকবি।

প্রখ্যাত গ্রীক দার্শনিক প্লেটো তাঁর গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, তার মধ্যে কবিদের জায়গা রাখেন নি। তাঁর মত ছিল আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কোন প্রয়োজন নেই। আমরা অবশ্য প্লেটোকে সমর্থন করি না। কারণ যে পৃথিবীতে হোমার, কালিদাস, শেক্সপিয়ার কিংবা রবীন্দ্রনাথ নেই, তেমন একটা হত দরিদ্র পৃথিবীর কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না। এখন প্রশ্ন, কবিতা কেন পড়ব আমরা? আমরা সকালে যখন যে যার কাজে বের হই, তখন আমাদের শরীর ও মন থাকে তাজা ঝরঝরে। সন্ধ্যায় যখন কাজ থেকে ফিরি তখন শরীরের ধুলো ময়লা ধুয়ে ফেলে স্নিগ্ধ হতে প্রয়োজন একটি সুন্দর স্নানের। সারাদিনের কাজে মনের মধ্যেও ময়লা জমে। এই ময়লা ধুয়ে ফেলার জন্যও দরকার হয় একটি শুচি স্নিগ্ধ স্নানের। এই মানসিক স্নানের একাধিক উপকরণের একটি হল কবিতা পাঠ। কবিতা আমাদের দেয় একটি আকাঙ্খিত স্নিগ্ধ সাহচর্য। সুখের আতিশয্যে আমাদের সুখানুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। দুঃখের আবর্তে কবিতা জ্বালিয়ে রাখে একটি দীপ্ৰ আলোকবর্তিকা। কবিতা সঙ্কটে দেয় সাহস। শোকে দেয় সান্ত্বনা। ক্লান্ত যখন তখন ললাটে রাখে স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ। কবিতা হতে পারে আমাদের সখা, সঙ্গী, সচিব, স্বজন যার ওপর নিশিদিন ভরসা করা যায়।

কবিতা আমাদের শুধু দেয়ই না! আমাদের সঙ্গে করে নিয়েও যায়। কবিরা নিত্যনুতন ভুবনের স্রষ্টা। সেই সব ভুবনে পাঠকের প্রবেশাধিকার অবাধ। যাবেন নাকি সেখানে! যেখানে “মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে" অথবা যেখানে “... হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে / বাবলার গলির অন্ধকারে / অশথের জানালার ফাঁকে / কোথায় লুকায় আপনাকে!" কিম্বা চলুন না সেখানে যাই, যেখানে "... অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে / চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে / ভোরের দয়েল পাখি।" জীবনানন্দ আমাদের নিয়ে যান এইসব মায়াময় স্থানে। কীটসে্‌র সঙ্গে আমরা অনায়াসে চলে যেতে পারি সেই নাইটিঙ্গেল পাখিটির কাছে যে ব্যথা, বিষণ্নতা আর কান্নায় ভরা এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে শ্যামল অরণ্যভূমির এক ঘন পত্রনিবিড় অন্ধকার কোণে, যেখানে মৃদু বাতাসে আন্দোলিত পত্ররাজির মাঝখান দিয়ে ম্লান চন্দ্রালোক প্রবেশ করে গাঢ় সবুজ অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে চলা আঁকাবাঁকা, ঘাসে ঢাকা পায়ে চলা ক্ষীণ পথরেখাকে পরিদৃশ্যমান করে তোলে। "But here there is no light / Save what from heaven is with the breezes blown / Through verdurous glooms and winding mossy ways." এইভাবেই কবিদের হাত ধরে ঘটে চলে আমাদের ভুবন পরিক্রমা। এভাবে জয়দেব, কালিদাস নিয়ে যায় যেখানে, মালার্মে, রিলকে নিয়ে যান অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। আর রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট ভুবনের তো সীমারেখা নেই। তাঁর সব ভুবন পরিক্রমা করতে একটি মানুষের তিন জন্ম লেগে যাবে।

কবিতা অনেক রকমের হয়। বিভিন্ন কবির কবিতা পড়তে পড়তে তাঁদের কবিতার প্রতি একধরণের ভালবাসার জন্ম হয়। আবার এটাও ঠিক জীবনানন্দ যে কারণে ভাল লাগে, তার থেকে অন্য কারণে অরুণ মিত্রের কবিতা ভাল লাগে। কারো কবিতা ভাল অথচ ভাল লাগে না তারও বিশেষ কারণ থাকে। সমস্যাটা হল ইন্টারপ্রিটেশন, তার জন্য চাই মনঃসংযোগ। যে কারণে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভাল লাগে সে কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ভাল লাগে না। প্রত্যেক কবির আলাদা জোরের জায়গা আছে। সেটাই হয়তো কোনো পাঠকের ভালবাসার জায়গা হয়ে ওঠে। আসল কথা কবির কবিতার সাথে একাত্ম হতে না পারলে ভাল কবিও ভাল না-লাগা কবি হতে পারে। কবিতা শব্দ দিয়ে নির্মিত এমনই একটি সূক্ষ্ম শিল্প শাখা, যা প্রকৃত দীক্ষিত পাঠক পাঠিকার জন্য। সব কবিতা সবার জন্য নয়। যে কবিতা শেষ পর্যন্ত পড়তে ইচ্ছে হয়, তাই ভাল কবিতা। যে কোনো বিষয়েই তা হতে পারে। প্রেম, অপ্রেম, যুদ্ধ, মহামারী, সুখ-অসুখ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, মান-অভিমান, দেশপ্রেম এমনকি বিপ্লবও হতে পারে। যদি লেখাটি কবিতা হয়ে ওঠে তা হলেই সেটি পাঠককে টানে। যত ভাল বিষয়ই হোক যদি কবিতাটি একটি শিল্পমাত্রা না পায় তাহলে তাকে অকবিতা বলা যায়। সে পড়াও খুব কঠিন।

এখন প্রশ্ন কবিতা কি শুধু দীক্ষিত পাঠকের জন্য নাকি সে এক স্ববিরোধ! সিরিয়াস কবিতায়, মানে যে কবিতা উত্তীর্ণ, সে কবিতাকে দীক্ষিত পাঠকের দরকার আছে। এলাম, গেলাম আর জয় করলাম এমন ব্যাপার নয়। কবিতার কাছেও আসতে হবে। দীক্ষিত হয়ে আসতে হবে। তাহলে অন্তত বোঝা যাবে কী বলার চেষ্টা হচ্ছে। সুতরাং এটা একটা চর্চার ব্যাপার। এখন অনেকে বলে সহজ সরল ভাবে কবিতা লেখা দরকার। তারা কবিতা নিয়ে চর্চা করতে চায় না। তারা সহজে পেতে চায় কবিতার স্বাদ। কিন্তু কবিতা সাংবাদিকতা নয়। যেভাবে সংবাদপত্র পড়ি, সেরকম ভাবে কবিতা পড়া যায় না। তাহলে প্রশ্ন আসে সবাই কবিতা বুঝবে কী করে। সবার জন্য সব কিছু নয়। এটাও বুঝতে হবে। আমি যেমন ডাক্তারি পরিভাষা বুঝি না। তাতেও আমার জীবন চলে। কবিতা না বুঝেও জীবন চলে। তবে বুঝতে গেলে পড়তে হবে।

আধুনিক, উত্তর আধুনিক কবিতা, অ্যান্টি পোয়েট্রি থেকে শুরু করে আজকের জিরো বাউন্ডারি কবিতায় নানা বিবর্তন ঘটে চলেছে। উত্তর আধুনিকতা আমার মতে শুধু সাহিত্যের একটা ব্যাপার নয়। সামাজিক বিষয় হিসেবেই এর জন্ম। তো সেটা কবিতার ক্ষেত্রে অনেকে ব্যবহার করেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, ভাবশৃঙ্খল যে কবিতা, একটা লাইনের সাথে আরেকটা লাইনের যে ভাবের বিশৃঙ্খলা - মানে মিল নেই, যাকে বলা যায় লজিক্যাল ক্র্যাক, সিন্থেসিস নেই এরকম যে কবিতা তাকে আমরা উত্তর-আধুনিক কবিতা বলে থাকি। এটা একটা আন্দোলন বা ঢেউ, সমুদ্রে যেমন থাকে, সে ঢেউ চিরকাল থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। দুর্গাপুরে যেমন নিম সাহিত্য সেও একটা আন্দোলন, হাংরি আন্দোলন...সাহিত্যে এরকম আন্দোলন হয়। সেটা কিছুদিন থাকে। একদিক থেকে খুব দরকারও। কারণ ট্র্যাডিশনাল রাস্তায় চলতে চলতে সেটাকে একসময় ভাঙার খুব দরকার হয়ে পড়ে। যদি না ভাঙা যায়। যদি বাঁক বদল না আসে, তবে একটা গতানুগতিকতার মধ্যে ঢুকে যায় সাহিত্য। সে জন্য কিছু সংখ্যক কবি সাহিত্যিক এক জায়গায় হয়ে তারা সাংগঠনিক ভাবে একটা আন্দোলন তৈরি করে। তবে দেখতে হবে যে এগুলি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় কিনা! সময়ই বলে দেবে এটা সার্থক না ব্যর্থ। তবে আজকাল অনেকেই আধুনিক কবিতার নাম করে এমন কিছু শব্দ প্রয়োগ করছেন যা পাঠকের ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। এবং অনেক পাঠক কবিতা বিমুখ হয়ে পড়ছেন। কবিরাই কবিতা লিখবেন, পড়বেন এবং সমালোচনা করবেন, এটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে যেন! তবু বলি সেই কবিতাই সার্থক কবিতা যার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। অবশ্য এর বিপক্ষেও অনেক যুক্তি আছে।

সব শেষে কিছু কথা বলা যাক। মহৎ কবি মাত্রই ঋষি। আজকের সন্ত্রাস কবলিত পৃথিবী বহু পূর্বে উচ্চারিত ঋষি বাক্যকে সত্য করে তুলেছে। কেন এত ঘৃণা, এত বিদ্বেষ, এত রক্তপাত? তাহলে কি কবিতা হেরে যাবে! আমরা কার কাছে যাব কবিতা ছাড়া! হৃদয় যখন বেদনায় বিদীর্ণ ,নয়নসম্মুখে সূচিভেদ‍্য অন্ধকার তখন কবি ছাড়া কে দেখাবে ক্ষীণ স্নিগ্ধ, শুচি শান্ত ও পবিত্র আলোকবর্তিকা? কবির কণ্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলব, "If winter comes can spring be far behind?" বলবো "রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন?" স্মরণ করবো শাহীর লুধিয়ানভির কবিতা - 

রাত যিতনি ভি সংগীন হোগি
সুবহ উতনি হি রংগীন হোগি
গম না কর যো হ্যায় বাদল ঘনেরা
কিসকে রোকে রুকা হ্যায় সবেরা।

 

0 Comments
Leave a reply