“In nature nothing exists alone.”
Rachel Carson, Silent Spring
ধানের হলুদ মাজরা পোকা (ছবি - https://www.nucleomeinfo.com/)
সকালবেলায় ধানক্ষেতে গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল অতুলদার। পোকাগুলো আবার হামলা করেছে সদ্য বেড়ে উঠতে থাকা ধান গাছে। সাথে কয়েকটা গাছের গোড়া চিবিয়ে গেছে মেঠো কাঁকড়া গুলো। শান্তি নেই আর। এই দিন পাঁচেক আগেই পোকা মারা বিষ ছড়িয়েছিল মাঠে। সেই বিষে কয়েকদিনের নিশ্চিন্তি থাকলেও দেখা যাচ্ছে খুব বেশী দিন এদের আর এড়ানো যাচ্ছেনা। এখন তাও ভরা বর্ষা। ধানের আরেক শত্রু মেঠো ইঁদুর এখনও এসে পৌঁছায়নি। ধান পাকলেই তারা পিলপিল করে এসে জুটবে আলের গায়ে গায়ে। তখন তাদের মারার জন্যেও আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে। একদিকে যেমন এইভাবে পোকা, কাঁকড়া, ইঁদুরের আক্রমণে ফসলের বার্ষিক ফলনের পরিমাণ ব্যপকভাবে কমে চলেছে তেমনই তাদের খতম করার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে কীটনাশকের পেছনে। আর দিনকে দিন সেই খরচ বেড়েই চলেছে যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে লভ্যাংশের ওপর। ফলত পূর্ণ সময়ের চাষিদের জন্যে দিন গুজরান করা আর সহজ থাকছে না। অতুলদার মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। আর তাঁর এবং তাঁর মত দেশের হাজারো চাষির অবস্থা আলাদা কিছু নয়।
ভারতবর্ষ কৃষি প্রধান দেশ। এখনও দেশের জিডিপির একটা বড় অংশ কৃষির উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। আর সেই বার্ষিক ফলনে আঘাত হানছে নানা ধরণের ক্ষতিকারক জীবসমূহ। যারা ফসলের পেস্ট নামে অধিক জনপ্রিয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, মরসুমের খামখেয়ালিপনা বা জলসঙ্কট সহ নানা কারণে শস্যের স্বাভাবিক ফলন কমলেও তার এই হ্রাসপ্রাপ্তির অন্যতম প্রধান হেতু রকমারি পেস্টের উত্তরোত্তর বাড়বাড়ন্ত। বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণী (আগাছা, ছত্রাক, পোকা থেকে শুরু করে স্তন্যপ্রায়ী অবধি) প্রতিনিয়ত দেশের মূল শস্য যেমন ধান কিংবা বিভিন্ন সবজির ওপর আক্রমণ শানাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশের অর্থ ব্যবস্থায়। সেই পেস্ট তাড়াতে দেশের চাষি ভাইবোনেরা ব্যবহার করছে নানা ধরণের কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশকের। আর ধীরে ধীরে পোকামাকড় থেকে শুরু করে আগাছারা নিজেদেরকে কীটনাশকের সাথে হয় মানিয়ে নিচ্ছে অথবা হয়ত পরের বছর সেই কীটনাশকের সাথে লড়তে প্রস্তুত এমন পোকার আবির্ভাব ঘটছে ফলে মরসুমপ্রতি সেই কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলেছে।
তবে এখানে মনে রাখা জরুরি চাষের জমিতে বিভিন্ন ছোটখাট পোকামাকড় থেকে শুরু করে বড় আকারের পশুপাখি যারা আস্তানা গাড়ে তাদের সবাই কিন্তু ক্ষতিকারক নয়। মাত্র গুটিকয়েকই হয়তো তাদের মধ্যে পেস্ট। বাকিরা কোনভাবেই শস্যের কোন ক্ষতি করেনা। যেমন ধানের অন্যতম প্রধান পেস্ট হল মাজরা পোকা। কিন্তু ধানক্ষেতে মাজরা পোকা ছাড়াও, বিভিন্ন ফড়িং, প্রজাপতি, মাকড়শা এরাও বাসা বাঁধে বা খাবার সংগ্রহ করতে আসে যারা আদপে ফলনের কোন ক্ষতি করেনা। কিন্তু কীটনাশকের বেলাগাম প্রয়োগ (যার মধ্যে পারদ বা ক্যাডমিয়ামের মত ভারী ধাতু উপস্থিত) ভালো খারাপ নির্বিশেষে যেকোনো আগাছা বা প্রাণীদের শেষ করে দেয়। এদের মধ্যে বহু প্রাণী রয়েছে যারা পরিবেশের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। যেমন চাষের জমিতে অনেক প্রজাপতি, বোলতা বা পাখি থাকে যারা পরাগ মিলনে সাহায্য করে। কোন কোন ছত্রাক তৈরি হয় যারা ভোজ্য। বহু মানুষ সেখান থেকে খাবার ছত্রাক বা মাশরুম তুলে বাড়ি নিয়ে রান্না করে খায়। এছাড়া নানা ধরণের মাছেরা বর্ষাকালে যখন পুকুর ডোবা খাল বিল উপচে পড়ে তখন ডিম পাড়ার জন্যে ধানের জমিতে চলে আসে। বেশ কিছু মাছ আছে যারা গভীর জলে ডিম পারতে পারেনা। তাদের ডিম পাড়ার জন্যে অল্প ডুবে থাকা অগভীর চাষের জমিই প্রয়োজন। বর্ষা শেষে জল নেমে গেলে তারা আবার পুকুর ডোবা জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় গ্রামের মানুষ, চাষি, জেলেরা ঘুনি-আঁটল দিয়ে সেই মাছ ধরে নিজেদের প্রোটিনের চাহিদা মেটায় এবং প্রয়োজনমত বিক্রিও করে। আবার এমনও কোন কোন প্রাণী থাকে যারা চাষের সরাসরি অপকার বা উপকার কোনটাই করেনা। কীটনাশক এবং আগাছানাশকের অযাচিত ব্যবহার এই মাছের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন এবং তাদের বংশ বৃদ্ধিতেও আঘাত হানে।
ভারতবর্ষ পৃথিবীর এমন এক দেশ যেখানকার কৃষি এবং জৈববৈচিত্র্য দুই-ই দেশের বিচিত্রতায় আলাদা এক মাত্রা যোগ করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে দেশের এই দুই উপাদান পারস্পরিকভাবে পৃথক। আসলে তা কিন্তু নয়। বরং চাষাবাদ এবং বন্যপ্রাণ বাস্তুতন্ত্রে একে-অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরিবেশের ভারসাম্য সঠিকভাবে রক্ষা করে চলেছে। মানুষের প্রচলিত ধারণা বন্যপ্রাণের স্বাভাবিক আবাসভূমি হল ঘন অরণ্য বা সামুদ্রিক পরিবেশ যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত। যাতে সেখানকার বন্যপ্রাণ অবাধে কোন রকম বিশৃঙ্খলা ছাড়া নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আর অন্যদিকে গ্রাম বা শহরাঞ্চল হল মানুষের থাকার জায়গা। আর পশুপাখি বলতে সেখানে থাকবে গবাদি পশু বা অন্যান্য গৃহপালিতরা। কিন্তু আদপে ব্যাপারটা কি তাই? এই দেশের মোট এলাকার মাত্র পাঁচ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে জাতীয় উদ্যান এবং অভয়ারণ্যের মত সংরক্ষিত এলাকা আর এটা বলে দিতে হবে না এই নগণ্য অংশের বাইরেও রয়েছে প্রচুর বন্যপ্রাণ (ছত্রাক, গাছপালা এবং জীবজন্তু) যারা প্রায় অবাধেই মানুষের বাসস্থানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাদের মধ্যে বেশ কিছু এই চাষের জন্যে বিশেষভাবে উপকারী। তাই একটু বুঝে শুনে চাষ করলে এত কীটনাশক প্রয়োগের কোন দরকারই পড়েনা। কারণ চাষের জমিতেই এমন অনেক প্রাণী বসবাস করে যারা আসলে জমির জৈব কীটনাশক। যেমন পেঁচা এবং ফিঙে পাখি চাষের জমির বিভিন্ন পেস্ট (যেমন মাজরা পোকা ইত্যাদি) খেয়ে নেয়। কাঁকড়া ধানের গোড়া চিবিয়ে নষ্ট করে দেয়, সেই কাঁকড়া খায় হচ্ছে খ্যাঁক শিয়াল। রাতের অন্ধকারে খ্যাঁকশিয়াল কাঁকড়ার গর্তে লেজ ঢুকিয়ে বসে থাকে। আর সেই লেজকে কাঁকড়ারা খাবার ভেবে ভুল করে ধরতে গেলেই তারা খ্যাঁকশিয়ালের খাবারে পরিণত হয়। ধানের অন্যতম প্রধান শত্রু হচ্ছে মেঠো ইঁদুর। এরা ধান পাকলে প্রচণ্ড দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে আর পাকা ধান কেটে জড়ো করে নিজেদের ভুলভুলাইয়ার মত গর্তে। সেই ইঁদুরের বংশ নিয়ন্ত্রনে রাখে হল দাঁড়াশ সাপ। নির্বিষ এই সাপ চাষজমির অন্যতম বাসিন্দা। দাঁড়াশ সাপের প্রিয় খাবার হল ইঁদুর, এই সাপের ইংরাজি নাম ‘র্যাট স্নেক’ দেওয়াও হয়েছে এদের ইঁদুর খাওয়ার প্রবণতা থেকেই।
কৃষি যে ভারতবর্ষের মূল ভিত্তি তা আগেই আলোচিত। সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে উচ্চফলনশীল শস্যের আধিক্য বাড়লেও ভারতের এক বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে আজও খাবারের যোগান পর্যাপ্ত নয়। ২০২৪ সালের বিশ্ব খাদ্য সূচক অনুযায়ী ১২৭ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৫। সেখানে বাংলাদেশ বা নেপালের মত রাষ্ট্রও তার অনেক আগে রয়েছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ফলন বাড়ানোর চেষ্টা চলতে থাকলেও যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে সঠিক খাবার সবার কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না। আর পৌঁছালে তার মধ্যে মিশে আছে বিষ। যা ধীরে ধীরে সঞ্চিত হচ্ছে মানুষের দেহে এবং কারণ হয়ে উঠছে নানা মারণ ব্যাধির। অর্থাৎ এই মুহূর্তে প্রয়োজন কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ওপর হ্রাস টানা এবং ধীরে ধীরে জৈব উপায়ে পেস্টের জনসংখ্যা কমানোর দিকে মনোনিবেশ করা।
শোষক পোকার আক্রমণে শুকিয়ে গেছে ধানক্ষেত - লোবা পঞ্চায়েত এলাকা (ছবি - আনন্দবাজার)
আর অন্যদিকে রয়েছে স্থানীয় ছোটখাট বন্যপ্রাণী যারা আজকের তথাকথিত সংরক্ষণের সাপেক্ষে অচ্ছুৎ হলেও বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপক এবং অপরিকল্পিত কীটনাশক প্রয়োগের যারা অকারণ শিকার। তাই সামান্য পরিকল্পনার মাধ্যমে যদি এই দুই দৃষ্টিকোণকে এক বিন্দুতে মেলানো যায় তাহলেই হয়ত এই সমস্যার সমাধানে কিছুটা দিনের আলো দেখা গেলেও যেতে পারে। আর এই ধারণা যে নতুন কিছু তা কিন্তু নয়, কীটনাশকের ব্যাপক প্রসারের আগে গ্রামের চাষি ভাইবোনেরা পেস্ট দমনে এই প্রাকৃতিক পদ্ধতির ওপরই মূলত নির্ভরশীল ছিল। তবে ব্যাপারটা এতটাও সোজা নয় যে ভারতবর্ষের মত জনবহুল দেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ খাদ্যের বিশুদ্ধতা এবং স্থানীয় জৈববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের ভোল রাতারাতি বদলে দেবে। তবে বিন্দু বিন্দুতে যেমন সিন্ধু হয়, তেমনই এই পথে এগোলে কিছুটা হয়ত হদিশ মিলবে পাখির কলরবে মুখরিত নতুন এক বসন্তের। তাই এখন সময় চাষের জমিতে বন্যপ্রাণের অবস্থান কতটা নিবিড় এবং গুরুত্বপূর্ণ তা সাধারণের কাছে স্থাপন করা এবং তা পরিবেশের বাস্তুতান্ত্রিক (কীটনাশকের ব্যবহার কমানো) এবং দেশের অর্থনৈতিক (চাষের জমির ফলন রক্ষা করা) দিক থেকেও যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা জনসমক্ষে তুলে ধরা। তাহলেই হয়ত বিশ্বকে আগামী দিনে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হবে।