ভোর চারটে নাগাদ গঙ্গারানির ঘুম ভাঙল। রোজই ভাঙে। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। বিছানা থেকে নামার আগে একটু অপেক্ষা করলেন। স্নায়ু গুলো সচল হওয়ার সময় দিলেন। তর্পণ পাশের ঘরে ঘুমচ্ছে। হার্ডওয়্যারের কোম্পানি অনেক রাত করে ছেলেটাকে ছাড়ে। আবার বেলা দশটার ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। ওর বাবা একবার পাশ ফিরল। গঙ্গারানি সন্তর্পণে নেমে পড়লেন খাট থেকে। সোজা চলে গেলেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের দেওয়ালে। বাঁ কান চেপে ধরলেন দেওয়ালের সঙ্গে। অভিজ্ঞ ডাক্তারের মত চোখ বুঁজে সমস্ত মনযোগ জড়ো করে রাখলেন কানের ফুটোর ভেতর। হুঁ, হাল্কা কুলকুল শব্দ। খুব মনোযোগ না দিলে ধরাই যায় না। কোথাও কমোড লিক করছে। তার মানে নিয়ম কেউ না কেউ মানেনি। কে মানেনি? দক্ষিণের তিনতলায় নতুন ভাড়াটে? মানালিরা আগে নিজেরাই থাকত। দুবছর আগে বর বদলি হল আমেরিকায়। তালা বন্ধ ছিল তারপর থেকেই। ভালই হয়েছিল। তিনতলায় এক জোড়া ফ্ল্যাট। মানালিরাই মালিক। ডবল টয়লেট, কিন্তু সিঙ্গেল কিচেন। জল খরচের প্রধান আখড়া হল টয়লেট আর কিচেন। পুরো ফ্লোর ফাঁকা থাকায় বাস্তবিক দুটো ফ্ল্যাটের জল বেঁচে যেত রোজ। সমস্যা অনেক হাল্কা ছিল। কিন্তু তিন তলায় ভাড়াটে বসিয়ে দিল মানালির মা। বলল, ফ্ল্যাট একদম বন্ধ থাকলে বিশেষ করে গণ্ডগোল হয় পাখা আর পাইপলাইনে। কমোড, সিস্টার্ন, শাওয়ারের দফারফা।
ঠিক আছে তাই হোক। কিন্তু নতুন ভাড়াটেকে আগে থেকে জলের ঝামেলার কথা নিশ্চয় বলেনি মানালির মা। ভুল গঙ্গারানিরও হয়েছে। নতুন ভাড়াটে প্রথম এসেছিল একা, তখনও মানালির মা এসে পৌছয়নি, উনি অপেক্ষা করছিলেন। তখনই গঙ্গারানি আলাপ সেরে নিয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই জমিটা তাঁদের। দোতলার দক্ষিণ পূবের ফ্ল্যাট, নিচের একটা গোটা ফ্ল্যাট আর একতলায় শাটার দেওয়া দোকানদুটো ওঁদেরই। একতলার সবটাই ভাড়া দেওয়া। আরও অনেক কথাই বলেছিলেন। কিন্তু জলের কথাটা বলতে দ্বিধা হল। ভাবলেন নিশ্চয়ই মানালির মা একটু আভাস দিয়েছে। কিন্তু প্রথম দিনই বুঝলেন যে জলের ব্যাপারটা চেপে গেছে মানালির মা।
নতুন ভাড়াটে পুরনো অভ্যাসে চলা শুরু করেছিল। গঙ্গারানি কিছু বলেননি। শিশু প্রথম হাঁটতে শিখে একটু বেপরোয়া ভাব দেখায়। দু একাটা আছাড় খাবার পর পরোয়া করতে শুরু করে। গঙ্গারানি জানতেন আছাড় এরাও খাবে।
শনিবার বিকেলে ভাড়াটের স্ত্রী ঢুকল এই প্রথম। বাপের বাড়ি বেশ দূরে। সেইখানে কোন এক ইস্কুলে পড়ায়। ডেলি প্যাসেঞ্জারি হয় না। ঢুকল স্টিম ইঞ্জিনের মত হাঁসফাঁস করতে করতে। দোতালার বারান্দা থেকে লুকিয়ে দেখে নিলেন গঙ্গারানি। পাক্কা দু-মনি গতরখানা। তার মানে শরীরে গরম বোধ প্রবল। ফলে প্রচুর জল খরচ করে স্নান। এক এক বারে এক এক খানা গায়ে মাখা সাবান শেষ করে তবে এই সব শরীর জুড়োয়।
পরদিন সক্কাল বেলায় ভাড়াটিনির তীক্ষ্ণ গলা ভেসে এল,
- যাও। ওঠো। এক ফোঁটা জল নেই কলে আর উনি শুয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। যাও, হয় ওনাকে গিয়ে বল পাম্প চালাতে না হয় নিজেই চালিয়ে দিয়ে এস। একী? সাত সকালে জল নেই। বাথরুম পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
সুইচটা দেড় তলায়। একতলার ল্যান্ডিং থেকে তিন ধাপ উঠে অথবা দোতলা থেকে তিন ধাপ নেমে দেওয়ালের গায়ে সুইচ বোর্ড। সাতটায় জল আসা শুরু হবে। ভোররাতে জলের শেষ ফোঁটাটুকু নিঃশেষ করে দোতলার উত্তর-পূবের ফ্ল্যাটের ‘গরুর ডাক্তার’ আর ‘র্যাশন কার্ডের অফিসার’ কত্তা-গিন্নি মিলে বিদায় নিয়েছেন। এই খবর ভাড়াটে জানেনা। বেচারা তিনতলার দরজা খুলতেই গঙ্গারানি দোতালার ল্যান্ডিংয়ে এসে দাঁড়ালেন।
- দিদি জল কি...?
ভাড়াটের ইতস্তত কণ্ঠস্বর।
- হ্যাঁ। জল নেই একদম। পাম্প চালাব ঠিক আটটায়। রিজার্ভারে একটু জমুক। এখনই চালালে পাম্পে হাওয়া ঢুকে যাবে। দেখবেন ত’ আপনার কমোডের চাবি বন্ধ আছে কিনা। এই ফ্ল্যাটের সব কমোড, কলের চাবি খারাপ। জঘন্য মাল দিয়েছে প্রোমোটার। এক্কেবারে ডাহা ঠকিয়েছে।
- সেকি? কমোডের চাবি বন্ধ থাকলে ফ্ল্যাশ করব কি করে?
- কেন? বালতি নেই আপনার? দুই তিন বালতি জল সবসময় স্টকে রাখবেন দাদা। কখন যে চলে যায় কে জানে।
- কিন্তু জল ঢেলে কমোড কি ভাবে......
- আরে আমি তো তাই করি।
ভাড়াটের দমে যাওয়া মুখ দেখে প্রলেপ দিলেন একটু,
- বেশ, খুব যদি অসুবিধা মনে হয় তাহলে ফ্ল্যাশ করে ট্যাঙ্কি ভরে গেলেই চাবি ঘুরিয়ে আবার লক করে দেবেন। এই ত’ আপনার ঠিক নিচে ডাক্তার বাবু আর র্যাশন কার্ডের অফিসার, স্বামী স্ত্রী দুজন থাকেন।
গলাটা নামিয়ে,
- ওরা না ভীষণ বেহিসেবি ভাবে জল খরচ করে। আমার চিন্তা ওদের কমোড লিক করেছে কিনা। চাবি মারা ফ্ল্যাট, কিচ্ছু করার নেই।
- তাহলে আমি কি আটটা অব্দি অপেক্ষা করব?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ... আর মিনিট দশেক মাত্র। জল কি বালতিতে একদম নেই ভরা? আমি কি এক বালতি দিয়ে আসব?
- বালতি একটা ভরতি আছে। আপাতত চলে যাবে।
বিকট শব্দে ঠিক আটটায় পাম্প চালু করলেন গঙ্গারানি। পাম্পটার কি হয়েছে কে জানে? চালালেই মনে হয় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কাঁপছে। ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট পর বন্ধ করে দিলেন পাম্প। ল্যান্ডিংয়ে একটু দাঁড়ালেন। যদি নতুন ভাড়াটিয়া কিছু বলে। কেউ এল না।
সন্ধ্যেবেলা ফের জল নেই। ভাড়াটিয়া একটু মরিয়া হয়ে নামতেই দেখল গঙ্গারানি ল্যান্ডিং থেকে নেমে সুইচের দিকে প্রায় দৌড়চ্ছেন। সশব্দে পাম্প চালু করেই মুখ তুলে গলা চড়িয়ে বললেন,
- আসল গোলমাল হল রিজার্ভারে। জমিটার এমন বেখাপ্পা সাইজ যে বড় করে রিজার্ভার বানানো গেলই না। তর্পণের বাবার ত’ সবটাতেই তাড়াহুড়ো। বললাম ঝাপ্পা কে দিয়ে ফ্ল্যাট বানিও না। ও হল সরকারি কন্ট্রাক্টর। চুরি না করলে ওর গা চুলকোয়। তাও ওকেই দিল।
গজগজের ভঙ্গিতে ইতিহাস বলে যান গঙ্গা রানি।
- আমি এইসব ফ্ল্যাট ট্যাটে থাকা কোনদিনই পছন্দ করি না বাবা। আমার একতলা চালাঘর ছিল আমারই। ঝাপ্পা এসে কি যে বোঝাল। আহা – কি সুন্দর থনথনে শিউলি গাছ, তুলসির চারা ছিল আমার ...
বাজারের থলে হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটু হাসল নতুন ভাড়াটে। বলল,
- তাহলে দিলেন কেন ঝাপ্পা কে?
গলা নামিয়ে বললেন গঙ্গারানি,
- ওমনি কি আর দিলাম দাদা? তর্পণের বাবার তখন ওপেন হার্ট। ওই ঝাপ্পাই অপারেশনের সময় অতগুলো টাকা এক কথায় বার করে দিয়েছিল।
- ব্বাঃ। বেশ উপকারি লোক ত’।
- আরে টাকা কি আর খালি হাতে দিয়েছিল? জমি আর জমির ওপর যা কিছু সবই ত’ বন্ধক দিতে হল। আমি বললাম, বাবা, পায়ের নিচে মাটি বলে আর কিছু যে রইল না। তর্পণ তখন পড়ছে। প্রাইভেট কোম্পানির তো আর আপনাদের মত পেনশন নেই। তর্পণের বাবা আর রোজগার করবার মত অবস্থায় ফিরতে পারল না। এগ্রিমেন্টে সই করবার আগে বলল, গঙ্গা, পায়ের নিচের মাটির চেয়ে মাথার ওপর ছাদ এখন বেশি জরুরী।
- তা অবশ্য ঠিক। লাইফে এক একটা টাইম এমন আসে যে...
- ঝাপ্পা দুটো জায়গায় ঝামেলা রেখে গেছে। আপনি ভাল মানুষ আপনাকে লুকাবো না। মানালির মা হয়ত ভাড়া দেবার সময় এত কিছু আপনাকে জানায়নি। আপনি যদি একা একবার অন্য সময় আসতেন আমি আপানাকে এই ফ্ল্যাটের হিস্ট্রি সব খুলে বলে দিতাম।
- ঝামেলা কোথায় কোথায়?
- প্রথম ঝামেলা রিজার্ভারে। বড় করবার আর উপায় নেই। দ্বিতীয় ঝামেলা রাখল কলের ফিটিংসে। সমস্ত কল কমা কম্পানির। সবসময় ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। এখন সবাইয়ের ত’ পয়সা খরচ করে পুরো ফিটিংস পালটান সম্ভব নয়। এ ছাড়া এই ফ্ল্যাটের আর কোন সমস্যা নেই। থাকলে আপনি আমায় খালি একবার বলবেন। আমি ব্যবস্থা করে দেব।
- ধন্যবাদ। আমি আপনার কথা মনে রাখব, বিশেষ করে জলের ব্যাপারটা।
- আমি আপনার সুবিধের জন্য মোটামুটি জলের রুটিনটা জানিয়ে রাখি দাদা।
- বলুন। দেখি কতটা মনে রাখতে পারি।
ভাড়াটিয়ার গলায় সামান্য হতাশা।
- ধরেন, সকাল সাতটায় জল আসে। খাবার জলটা আমাদের সঙ্গে আপনি নিচের কর্পোরেশনের কল থেকে ভরে নিলেন। দেরি করবেননা, লাইন বেড়ে যাবে। আমি আটটায় পাম্প চালাই। ২০ মিনিট। নইলে ওভার ফ্লো হয়ে যাবে। সেই জল ১০টা নাগাদ শেষ। দুপুর বারোটায় আবার পাম্প চালাই। কিন্তু সেটাও রান্না চান করতেই প্রায় শেষ। জল খরচ সবচেয়ে বেশি তখন। বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটার জলটুকই ভরসা দাদা। ওই সময় বাড়িও ফাঁকা। ওপর তলায় কেবল মুন্নির মা আর দোতলায় আমরা স্বামী স্ত্রী। তর্পণের ত’ হার্ডওয়্যারের কোম্পানি। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা।
একটু দম নিয়ে শেষ করলেন বক্তব্য,
- আসলে ফ্ল্যাট বাড়িতে দাদা, আমি বলি কি, সবাই মিলে একটু এ্যাডজাস্ট না করে চললে মুস্কিল। আপনার বালতি কম পড়লে বলবেন। আমার বাড়তি বালতি সবসময় রেডি থাকে। দিয়ে দেব। জল ভরে রাখবেন।
রাতে মানালির মায়ের সঙ্গে ফোনে ভাড়াটিয়ার নিম্নরূপ কথাবার্তা হল।
- সিঁড়ির আলো আর পাম্পের মোট বিল কত আসে?
- ওটা ত’ আমার দেবার কথা।
- না না। আমি এমনি জানতে চাইছি। নিচ তলার দিদি দেখছি কখনই দশ পনের মিনিটের বেশি পাম্প চালান না।
- হ্যাঁ। জল খরচ নিয়ে ওনার একটু প্রবলেম আছে। তবে কখনই সমস্যা হবেনা। উনি থাকাতে দেখবেন, অনেক কিছু উপকার পাবেন। এই ধরেন ময়লা ফেলার গাড়ি এলে বাঁশি দিলে উনি খেয়াল রাখেন কে কে নামতে পারে নি। জমাদারকে দাঁড় করিয়ে রাখবেন ঠিক। লেটার বক্সে চিঠি এলে খবর দেওয়া, নিচের কোলাপ্সিবল, ছাদের তালা লাগানো-খোলা, সেলস্ম্যান আটকানো, চাঁদা পার্টি সামলানো, মোটর চালানো বন্ধ করা। কেয়ার টেকার নেই ত’ আমাদের। সবটাই নিজের বাড়ির মত করে সামলে রাখেন। আসলে জমিটা নিজের ছিল ত’, ফ্ল্যাট হয়ে গেলেও সেই কথাটা ভুলতে পারলেন না। তবে দেখবেন, বড্ড পরোপকারী মানুষটা।
অফিস যাবার মুখে আবার ধরলেন গঙ্গারানি,
- পূজোয় বাইরে যাবেন নাকি? না, দেশের বাড়ি পূজো আছে?
- না না। কোথাও যাব না। কলকাতাতেই থাকব।
- সপরিবারে?
- হ্যাঁ। মেয়ে কলকাতা ছেড়ে পূজোর সময় নড়বেই না। ওর কলকাতার পুজো দেখা চাইই ।
- তা, দশমীর পর গুরুজনদের প্রনাম করতে যেতে হয় নিশ্চয়ই?
- দেখি, মিসেস আসুক। ওদের ইস্কুলের এটাই ত’ বড় ছুটি।
- একমাস থাকবেন নাকি?
- না না। বাড়ি ফেলে সবাই মিলে কি আর অতদিন থাকতে পারবে? বড়জোর লক্ষ্মী পুজো অবধি ।
- মেয়ে মায়ের সঙ্গে দেশের বাড়ি যেতে চায়না? ছুটি ছাটা ত’ থাকেই।
- মোটেও যেতে চায়না বাড়ি। কলকাতা ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকতে চায় না। একমাত্র মাসি থাকে বিলাসপুর। কত ডাকাডাকি করে। নড়ে না।
- হুঁ হুঁ বাবা। কলকাতার জল একবার পেটে পড়লে আর নড়তে চায় না কেউ। এই আমার কথাই ধরুন না কেন, আমারই বাপের বাড়ি বাঁকুড়ায়। সে যে কি জলকষ্ট দাদা !!! সেখানে লোকজন আসবে শুনলেই আমাদের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। খাবার জন্য নয়, থাকার জন্যেও নয়, স্রেফ জলের জন্যে। আমি ওই জন্যে বাপের বাড়ি গেলেও একদম থাকতে চাই না। ভাই বোন গলা ছেড়ে কাঁদে। আমি চলে আসি।
- আচ্ছা, এখন অফিস...
- হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি আসেন।
ইশারায় ওনার পাশের ফ্ল্যাটের তালাবন্ধ দরজা দেখিয়ে গলা নামিয়ে বললেন,
- আসলে বউটা বদ। নিজেদের জলের কাজ হয়ে গেলেও কল বন্ধ করেনা। ইচ্ছে করে খুলে রেখে দেয়।
- কেন? এইরকম করে কেন?
- বদমাইশি, স্রেফ বদমাইশি দাদা। সারা সপ্তাহ থাকে না। জল খরচ করে না। অথচ পাম্পের বিল, কাজের লোকের মাইনের ভাগ দিতে হচ্ছে। তাই শনি রবি এসে পয়সা উসুল করে। বুঝলেন?
- হুমমম...
- আচ্ছা দাদা, আপনি আসেন। আর একটা কথা। প্রতি রোববার সিঁড়ি ধোয়া হয়। মালতি, কাজের মেয়েটা, আপনার দরজায় বেল দেবে। আপনি ছোট বালতির এক বালতি জল আপনার ল্যান্ডিংয়ে ঢেলে দেবেন। সবাই এক বালতি করেই দেয়। না হলে সিঁড়ি ধুতে গিয়ে মালতির হাতে ট্যাঙ্কির চাবি ছেড়ে দিলে ও ফুল ট্যাঙ্কই খতম করে দেবে এক সিঁড়ি ধুতে গিয়ে।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে...
ভাড়াটিয়া পালিয়ে বাঁচে।
সন্ধ্যেবেলা গঙ্গারানি ললিত কে ডাকলেন। ললিত এই ফ্ল্যাটের কাজের সময় এ্যাসিস্টেন্ট প্লাম্বার হিসেবে ছিল। গঙ্গারানি তাকে আলাদা করে খাতির করেন। বললেন,
- কি ব্যাপার? নতুন ভাড়াটে তোকে ডেকেছিল কেন রে? তোকে পেলই বা কোথায়?
- উনি দোকানে গিইছিলেন। আমি তখন বসে। মালিক আমাকেই পাঠাল।
- হয়েছিলটা কি?
- শাওয়ারের চাবি পুরো খুলে বেরিয়ে এসছিল। গবগবিয়ে জল পড়ছিল।
- সেকি! কতক্ষণ ধরে পড়েছে?
- তা বলতে পারব না। আমি গিয়ে ন্যাকড়া গুঁজে বন্ধ করলাম।
- কি গোলমাল দেখলি?
কয়েকটা তালের বড়া ফ্রিজ থেকে বার করে কাগজের প্লেটে করে এনে রাখলেন ললিতের সামনে ।
একটা মুখে দিয়ে ললিত রিপোর্ট করে চলল,
- যা হয়। ওয়াসার টোয়াসার সব ক্ষয়ে শেষ।
- পাল্টে দিলি ত’?
- নাঃ। বলল, আপাতত কাজ চালানোর মত করে দাও। আগে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলি। তারপর তোমাকে ডাকব।
- বাড়িওয়ালা আবার কি বলবে? ছোটোখাটো রিপেয়ারের দায়িত্ব ভাড়াটের। তবে আমি হলে নিজে কাজটা করে নিয়ে ভাড়া থেকে কেটে নিতাম। তুই কি করলি তাহলে?
ললিত বিষম খেল।
- আহারে। দাঁড়া দাঁড়া, একটু জল দিই দাঁড়া।
আধ গ্লাস জল দিলেন গঙ্গারানি। ললিত সবটুকু চোঁ করে মেরে দিতেই গঙ্গারানি বললেন,
- চা দিই?
- না না, আর একটু জল খাব।
গঙ্গারানি আবার আধ গেলাস জল আর চা একসঙ্গে এনে রাখলেন। ললিত সবটুকু জল খেল না। গঙ্গারানি জানতেন অতটা লাগবেনা। এরা যে কবে বুঝবে জলের দাম? তবে উঁচু করে খেল এই যা রক্ষে।
- প্যাঁচটা একটু লুজ আছে। তাই বার বার খুলে আসছিল। ফেঁসো দিয়ে টাইট করে দিলাম। আর, বলে এলাম, এটা কিন্তু থাকবে না যে কোন সময় উড়ে বেরিয়ে যাবে। আপনি পুরো ওয়াশার আর ভাল্ভ পাল্টে নেবেন তাড়াতাড়ি।
- আর পাল্টিয়েছে। তুইও যেমন। একটু ভয় দেখাতে পারলি না? গিন্নি ছিল?
- না, মেয়ে ছিল।
- মেয়ের কানে জলটা দেওয়া উচিত ছিল রে বোকা।
- ও ত’ সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল।
- দেখি কি দাঁড়ায়। দুশ্চিন্তা থেকেই গেল বুঝলি ললিত।
- কেন?
- ধর সবাই মিলে বাইরে গেল বা কোথাও বেড়াতে যেতেও পারে ত’?
- পারে ।
- ঠিক সেই সময় গেল শাওয়ারের গ্যাটিস খানা খুলে। তখন?
- মুশকিল হল বিল্ডিংয়ের কোন বাথরুমেই একটা করে মেন সুইচ রাখেনি ঝাপ্পাদা যে সেটা ঘোরালেই বেসিন, শাওয়ার, কমোড সব একবারে বন্ধ করা যাবে। ওইরকম হলে আপানাকে সেই ছাদে গিয়ে মেন বন্ধ করে দিয়ে ওনাদের খবর দিতে হবে।
- ব্বাঃ। আর যদি ওরা সাতদিন পর এসে তালা খোলে ত’ আমাদের সারা ফ্ল্যাটের সব মেম্বারদের এক সপ্তাহ জল ছাড়া কাটাতে হবে। বেশ বুদ্ধি তোর।
ললিত বিষাদে ডুবে যায়।
- টের পাব যখন ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে জল নামতে শুরু করবে। কোন ফ্ল্যাটের বাথরুম ছাড়া আর তো কোথাও নালি রাখিস নি তোরা। যতবার ঘর ধুই ওই কোলাপ্সিবলের রেল তুলে ঝাঁটিয়ে জল বার করতে হয়। তারপর সেই জল নামে সিঁড়ি বেয়ে। ফলে আবার সিঁড়ি ধোও। উফফ বাবা বাবা। ভাবতেই পাগল পাগল লাগছেরে ললিত।
- অত ভেবেন না। কিসসু হবে নাকো।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন হঠাৎ,
- আচ্ছা তুই ভাল করে ভেবে বল ত’ এই যে আজকালকার ফ্ল্যাট বাবুরা, যারা দুদিন আগেও কলোনির কাঁচা বাড়িতে থাকত, তারা ছোট বাইরে করবার পর ক' বালতি জল ঢেলেছে?
- তাতো বটেই।
ললিত নিঃশর্ত সায় দেয়,
- এই যে হুড়মুড় করে দিনে সতের বার ফ্ল্যাশ টানে সব্বাই, বলত’ এক একবারে কত লিটার জল খরচা হয়?
- আজ্ঞে তা ধরেন সাত লিটার ত’ বটেই।
- তাহলে, এই যে ধর মানালির মায়ের কথাটাই ধর। থাকত বারুইপুর। আমি গেছি বেশ কয়েকবার। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি।
চার ধারে পানা পুকুর, ঝোপ ঝাড়। সন্ধ্যে হলেই শেয়াল ডাকে। আহা, বাথরুমের কি ছিরি! ছাদ খোলা চাদ্দিকে পাঁচিল ঘেরা একখানা খুপরি। প্লেন সিমেন্টের মেঝেতে দুখান ইঁট পোতা। আর ছিটকিনি লাগান টিনের দরজা। ব্যাস। পাশে একবালতি জল আর একখানা পেলাস্টিকের মগ। ছোট বাইরে সেরে দু মগ জল কেউ ঢালে কিনা সন্দেহ। কি দুর্গন্ধ!! বাপরে বাপ। আর এখানে? মেয়ে, জামাই, কোলের শিশুটার দুখের দাঁত ওঠেনি, সেখাচ্ছে সব্বাই মিলে - সোনা যাও, ফ্ল্যাশ করে এসো। যা-আ-আ-ও- ।
ললিত হেসে ফেলে। সেই হাসিতে গঙ্গারানির প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ পায়।
- সেদিন টিভিতে দেখলাম বলছে। বুঝলি ললিত, একটা প্যান্ট পরা মেয়ে, লেখাপড়া জানে। ছেলেদের মত চুল কাটা আর জামা গায়ে। বলছিল, গ্রামের চেয়ে শহরের লোক অনেক বেশি জল খরচ করে। ধর, গ্রামের একজন পুকুরে গেল চান করতে। ডুব দিল, উঠে এল। পুকুরের জলের কিন্তু কোন কমা বাড়া হল না। যা ছিল তাই থাকল । কিন্তু শহরের মানুষ? আমি পরিষ্কার বুঝতে পাই ললিত, আমার ওই ওপরের ভাড়াটিয়ার বউটা শাওয়ার আর কল দুটোই ছেড়ে দিয়ে চান করছে। পাইপ বেয়ে জল নামার সেকিই আওয়াজ! দেওয়ালে কান দিলে তুইও বুঝতে পারবি। দেখিস, মনে হবে, হলস্টাইন গরু বুঝি চান করছে বাথরুমের ভেতর।
খিঁক খিঁক করে হেসে ওঠে ললিত।
- তোকে এই কথাও বলছি শুনে রাখ। ওই যে প্যান্ট পরা মেয়ে, টিভিতে যতই জ্ঞান দিক, ওর শ্যাম্পু করতেই লাগে হাফ ট্যাঙ্কি জল।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা। বললেন,
- তর্পণ এসব বোঝে না। পেছনে লাগে। বেসিনের কল খুলে রেখেই দাড়ি কামায়। কেন রে? হাত বাড়ালেই যখন জল বন্ধ করা যায় তখন তোর এত কুঁড়েমি কিসের রে? আমার এখন ত’ একটাই দুশ্চিন্তা। বিয়ে দেব, নতুন বউমা এইসব কি ভাবে নেবে কে জানে? ভাববে, বাতিক আছে আমার, জল বাতিক। হ্যাঁরে, জল হল গিয়ে জীবন। জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করা কি ঠিক?
- মোটেই না।
ললিত সঙ্গত করে সম আর ফাঁক দেখে।
- আমাদের দেশে, বুঝলি, বাঁকুড়ায়, সমস্ত টিউবওয়েলের মুখে পাম্প করবার আগে একটা ন্যাকড়া বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়। কেন বলত?
- কেন?
- তাহলে জল ছড়াবে না চাদ্দিকে। এখানে জল হাঁড়ি, কলসি, গেলাস, বালতি ভেতরে যা পড়ে বাইরে পড়ে তার থেকে অনেক বেশি। ওই যে বাইশ পাইপ লাগাল গলির মুখটায়, দেখিস অর্ধেক জল লোকে ফেলে পাত্রের বাইরে।
ললিতের মোবাইল বেজে ওঠে। তাকিয়েই বলে,
- যাই গো। মালিক ডাকে।
- আয়। তবে মাঝে মাঝে নতুন ভাড়াটেকে দেখা হলে মনে করিয়ে দিস যেন শাওয়ারের চাবিটা পাল্টে নেয়। কোনদিন সব্বনাশ হয়ে যাবে নইলে।
ঘাড় নেড়ে নেমে যায় ললিত।
সাত সকালে বেল বাজল।
- কে?
ভাড়াটের মেয়েটার মিহি গলার আওয়াজ,
- আমি আন্টিইই...
- এস এস, কি হয়েছে মা ?
বড় মিষ্টি দেখতে মেয়েটা, আর কি শান্ত। আজকালকার মেয়েদের মত গেঞ্জি আর টাইট প্যান্ট পড়ে ঘোরে না। হয় সালোয়ার কামিজ নয় শাড়ি।
- বস মা বস। দেখ টিভিতে কি সুন্দর একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে, জল নিয়ে। জল যে কি জিনিষ এই সব না শুনলে বুঝবেই না। আমি ভাবতাম এইসব আমার নিজের ভাবনা এবং এগুলো বোধহয় এক ধরনের বাতিক। আজ এই সব জ্ঞানী মানুষদের কথা শুনে মনে যে কি জোর পাচ্ছি ভাবতেও পারবে না মা।
রাশভারী চেহারার একজন বক্তা বলে চলেছেন,
- পৃথিবীতে তিন ভাগ জল আর একভাগ স্থল। কিন্তু সমস্যা হল এই জলের যেটুকু দুই মেরুতে জমে বরফ হয়ে থিতু থাকে সেই বরফ গলে যাচ্ছে সমানে। আর কিছুদিনের ভেতরই ডাঙা এলাকার অনেকটাই চলে যাবে জলের নিচে।
অথচ একটু আগেই আগের বক্তা বলেছেন,
- মাটির নিচে জল কিন্তু আর বেশিদিন নেই।
একদিকে মাটির নিচে জল থাকবে না আর এক দিকে বরফ গলা জলে ডাঙা জমি চলে যাবে জলের তলায়, এই দুই উলটো নিয়ম ঠিক বুঝতে পারলেন না গঙ্গারানি। ঠিক করলেন ললিতের কাছে পরিষ্কার হয়ে নেবেন। জলের খবর, তা সে মাটির নিচেরই হোক আর ওপরের, ললিত সবচেয়ে ভাল রাখে।
আহা, যদি গঙ্গারানিকে একবার ওরা ডাকত আর প্রশ্ন করত কি ভাবে রোজকার জল খরচ সাশ্রয় করেন, তখন মন খুলে জানিয়ে দিতেন প্রত্যেকটা হিসেব। এই সব তত্ত্ব কথার চেয়ে বাস্তবে জল খরচ কিভাবে কমাতে হয় তাই নিয়ে কিন্তু কোন আলোচনা হচ্ছেই না। জানিয়ে দিতেন তরকারি ধোয়া জলটুকু না ফেলে বালতিতে ধরে রেখে কিভাবে বাথরুম ধোয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে ব্যবহার করেন, পরে ভাল জল দিয়ে ধুয়ে ফেলেন। কিভাবে চাল ধোয়া জল দিয়ে বালতি মাজেন, কিভাবে বৃষ্টির জল বালতিতে ধরে রেখে সাদা জামা কাপড় ধুয়ে নীল খরচ আর জল খরচ দুটোই বাঁচান, কেন সবসময় সব্বাইকে বলেন জল আলগোছে খেতে, সব সব।
নানা গল্পে কোথা দিয়ে কেটে গেল অতখানি পথ। একটু অবাকও হলেন গঙ্গারানি। যে মেয়ে প্যান্ট পরে, কিসব জারনালিজম্ না কি নিয়ে পড়াশোনা, নর্থ-ইষ্টের মেয়েদের মত চুলের ছাঁট, ঝড়ের বেগে ইংরাজি বলে, বাবাকে ডাকে ‘ড্যাড’, আর টাকাকে বলে ‘বাকস্’, সেই মেয়ের নাক ভীষণ উঁচু হওয়ার কথা। কিন্তু এই মেয়ে একদম ঘরোয়া। সবচেয়ে বড় কথা মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে।
আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করবার মত। সারাক্ষণ মেয়েটা জল খেল না। হয় কফি নয় কোল্ড ড্রিংক্স। বাহরে মেয়ে, ব্বাঃ। জল নিয়ে যারা ভাবে তারা এই রকম একটু হবেই।
যদিও গায়ে কড়া বডি স্প্রে মাখে মেয়েটা, তবু থেকে থেকে একটা চাপা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে লাগছিল বারবার। কিসের গন্ধ? চেনা চেনা, অথচ মনে করতে পারছিলেন না গঙ্গারানি। নামার সময় মনে পড়ল। চান করেনি মেয়েটা।
চান রোজ গঙ্গারানিরও করা হয়না। কতদিন গেছে গায়ে জল ঢালার পর মাঝপথে জল শেষ। গা মাথা মুছে বাইরে এসে দশ মিনিট মোটর চালিয়ে জল ভরে আবার চান করবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। কাক চানও করেছেন বহুদিন। মাঝে মাঝে এমন হতেই পারে। তাই বলে গায়ে কোনদিন গন্ধ জন্মায়নি। এই মেয়েও তার মানে মাঝে মাঝেই চান করে না।
- তোমার কি খুবই কাজের চাপ থাকে?
- আমি ফ্রি-ল্যান্সার। বুঝেছ? যখন কাজ থাকে তখন নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না, চান ফান দূরের কথা। ঘুম টুম উবে যায়। আবার যখন কাজ নেই তখন চুটিয়ে রিল্যাক্স করি। স্পা যাই। রিজুভিনেট করে নিই নিজেকে।
- শরীরের দিকে খেয়াল রেখ মা। এখন অল্প বয়েস। বুঝতে পারবে না। বয়েস হলে অসুবিধেয় পড়বে কিন্তু।
- সেইজন্যেই ত’ ব্যাগে সবসময় ড্রাই ফুড রাখি। ডোন্ট ওরি আনটি ।
- আর খাবার জল?
- বেসিক্যালি বাইরের জল টাচ করি না। তেস্টা পেলে কোল্ড ড্রিঙ্কস। বড়জোর মিনারেল। জলের যা আকাল আসছে সামনে।
নামার আগে ব্যাগ থেকে একটা চেক বার করে বাড়িয়ে ধরে বলল,
- এটা রাখ, পাঁচশ টাকার চেক। চেকটা সাবধানে রেখ আন্টি। ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে তোমার নামে?
- নাতো বাবা।
- তাহলে একটা খুলতে হবে চেকটা ডিপোজিট করবার জন্য। ভাল করে শোনো, একটা ডকুমেন্টারির কথা ভাবছি আমরা। সেভ ওয়াটার। ওটা বাইরে যাবে। এখানেও একটু কথা বলতে হবে তোমাকে। ওই ক্যামেরার সামনে। তফাৎ হল এটা টিভি আর ওটা শর্ট ফিল্ম। বুঝেছ? এখানে পেমেন্ট আরও ভাল। তুমি রেডি থেকো। আমি ডেকে নেব তোমাকে।
তর্পণ তোর জন্যে আমাকে আর গরু খোঁজা করতে হল না রে। ভগবান সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। শুধু মেয়েটা রাজি কিনা একটু বুঝে নিতে হবে এবার। খুব তাড়াতাড়ি।
ভোররাতে রোজকার মত ঘুম ভাঙার একটু আগেই যেন জল পড়বার আওয়াজ পেলেন গঙ্গারানি। বেশ তোড়ে জল পড়বার শব্দ। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। হুঁ, সিঁড়ি দিয়ে জল নামছে হুড়হুড় করে। মালতি ওপর থেকে বালতি করে সিঁড়িতে জল ঢাললে যেরকম ছড়ছড় করে জল পড়ে সেই আওয়াজ। কেবল সঙ্গে ঝাঁটা চালাবার খস্খস্ শব্দটা নেই।
দরজা খুলতেই চাপা আর্তনাদ বার হল মুখ দিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে অবিরল ধারায় জল নামছে। বাঁক নিয়ে জলের ধারা নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে একতলার দিকে। কোন রকমে পা টিপে টিপে তিনতলায় উঠলেন গঙ্গা রানি। যা ভয় পেয়েছিলেন তাই। ভাড়াটিয়ার কোলাপ্সিবল তালা মারা। দরজার নিচ দিয়ে কুলকুল করে জল বার হয়ে আসছে। ওরা সপরিবারে দেশের বাড়ি। এক সপ্তাহ পর আসবার কথা। নিশ্চয়ই শাওয়ারের সেই খারাপ ভালভ্টা খুলে গেছে। তখনি ললিতকে বার বার বলা হল, ওরে, ভালভ্টা ওই ভাবে গ্যাটিস মেরে রাখতে দিস না। পালটে দিয়ে আয়। শুনল না হতচ্ছাড়া। আর ভাড়াটিয়াও দেখল যে কাজ যখন চলে যাচ্ছে তখন কে আর খরচা করে।
এখন মরণ গঙ্গারানির। প্রথমেই চারতলার ছাদের ট্যাঙ্কির নিচের জল বেরনোর মেন কলটা বন্ধ করতে হবে। তারপর ভাড়াটিয়াকে ফোন করে আনান। দুশ কিলোমিটার রাস্তা আসবেন উনি। সেও প্রায় পাঁচ-ছ ঘণ্টার পথ। ততক্ষণ ফ্ল্যাটের সব্বার জল বন্ধ। ওদিকে সকাল নটার আগে ক্যানিং থেকে ললিত আসবে না। ও এলে একটা রাস্তা ঠিক বার করে ফেলবে।
একবার ভাবলেন তর্পণকে ডাকবেন। নাঃ থাক। কাল অনেক রাত করে ফিরেছে ছেলেটা। ঘুমোক।
চারতলার সিঁড়িতে পা রাখতেই হড়কালেন গঙ্গারানি । প্রথমে পড়লেন উবুড় হয়ে। হাঁটুতে এসে লাগল রেলিঙের কোনাটা। মনে হল মালাইচাকি চুরমার হয়ে গেল। ঘুরপাক খেয়ে পড়লেন তিনতলার ল্যান্ডিংয়ে। জ্ঞান যেন হারাবে এখুনি যন্ত্রণায়। প্রবল তেষ্টায় গলা কাঠ। একটু জল পেলে গলাটা ভিজত, প্রাণটা জুড়ত। চারপাশ দিয়ে হু হু করে জল নামছে। অথচ এক ফোঁটা জল মুখে তুলে দেবার মত কেউ নেই !
তর্পণ, বাবা তর্পণ? কোথায় তুই? একি কালঘুমে তোকে ধরল বাপ। মা যে যায়। মরে গেলে একবুক গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে অনেকবার জল দিবি বাবা। কিন্তু জীবদ্দশায় তোর হাতের দু ফোঁটা জল কি আমার কপালে লেখা নেইরে?
প্রবল ঝাঁকুনিতে ঘোর কাটল গঙ্গারানির। মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে অনেক মুখ। তর্পণ, মিডিয়ার মেয়ে, ভাড়াটিয়া সপরিবারে, পাশের ফ্ল্যাটের গরুর ডাক্তার আর তার র্যাশনকার্ডের অফিসার বউ। একতলার নর্থ ইষ্টের ছেলে গুলো নিরীহ মুখ, আরও কাঁচুমাঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তর্পণের বাবা হতভম্ব হয়ে বসে। একজন চশমা পরা গম্ভীর চেহারার লোক সিরিঞ্জ রেডি করছেন এক মনে।
তাকাতেই বললেন,
- এ্যাম্বুলেন্স কতদূর?
- আর মিনিট পাঁচেক লাগবে। প্রিন্স আনোয়ার শা ছেড়ে এইমাত্র লর্ডসের মোড় ক্রস করল।
তর্পণের গলা। আঃ, কোথায় বাবা তুই?
- মা, এখন ঠিক আছ ত’?
- ঠিক আছি বাবা। হ্যাঁরে, জল বন্ধ হয়েছে?
- কোন জল? কোথায় জল?
- ওপরের ট্যাঙ্কির? দাদার ঘরে শাওয়ারের ভালভ্ খুলে সারা সিঁড়ি বেয়ে জল নামছিল যে? তোকে কত ডাকলাম। উঠলি না। উঠলে কি আজ আমার এই দশা হয়?
সকলেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল এক দফা।
ভারি গলায় ডাক্তার বললেন,
- কোথাও জল টল কিসসু পড়েনি। আপনি ঘুমের ভেতর ছিলেন। সেই অবস্থাতেই একটা মাইল্ড স্ট্রোক পার হলেন। সাবধানে থাকবেন এর পর থেকে। জলটল নিয়ে বেশী ভাববেন না। ওসব প্রাকৃতিক ব্যাপার, প্রকৃতির ওপরেই ছেড়ে দিন।
দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন গঙ্গা রানি। মিডিয়ার মেয়েটা দুষ্টু দুষ্টু হাসছে। মনে মনে ঠিক করলেন, একটু ভাল হলেই চারহাত এক করে দিতে হবে। কি যেন নাম মেয়েটার? বড় সরল। কিছুতেই নামটা মনে করতে পারলেন না ।
থাকগে। নামে কি এসে যায়। সবচেয়ে বড় কথা হল, পৃথিবীতে তিন ভাগ জল থাকলেও কোন লাভ নেই যদি না শেষ সময়ে তার থেকে দু ফোঁটা তুলে মুখে দেবার কেউ না থাকে।
এ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে পাড়া কাঁপিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে। তার দু হাত ধরে নামাচ্ছে দুজন, তর্পণ আর মিডিয়ার মেয়ে। নিশ্চিন্তে ওদের ওপর শরীরের ভার ছেড়ে দিলেন গঙ্গারানি।