বছর পনের সার্ভিস দেওয়ার পর অবশেষে ল্যান্ডফোনটা দেহ রাখলো। হাজার চেষ্টা করেও তাকে আর বাঁচান গেল না। বহুবার স্থানীয় অফিসে গেলাম। দরখাস্ত করলাম। একটা সিরিয়াল নাম্বারও পেলাম। দিন যায় মাস যায়। ওদিকে বিল আসছে সমানে। শেষে একটা দরখাস্ত দিয়ে ল্যান্ডফোনটাকে সারেন্ডার করে দিলাম। রিসিভার আর তারটুকু রয়ে গেল ঘরে।
সেই থেকে ও নীরবে শুয়ে আছে টিভি-টেবিলের এক পাশে।
আজ, প্রায় পাঁচ বছর পর, ল্যান্ডফোনটা আবার একবার আচমকা বেজে উঠলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে পড়ি, মৃত বলে ঘোষিত মানুষের শরীর নাকি আবার জেগে উঠেছে। ফোনটাও কি সেইভাবে বেঁচে উঠল আবার!
রিসিভার তুললাম। টানা ঘসঘস আওয়াজ। কারও গলার শব্দ নেই। প্রথমে ভাবলাম সারানোর চেষ্টা হচ্ছে বোধহয়। কিন্তু আমি তো সারেন্ডার করবার দরখাস্ত অনেকদিন হল জমা দিয়ে এসেছি। ক্রেডেলে রিসিভার নামিয়ে আবার তুললাম। ডায়াল টোন নেই। একদম মর্গের মতো নীরবতা। হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম ফোনের সামনে। মনের মধ্যে কেবল ভেসে আসতে লাগল পুরোন দিনের নানা কথা। অনেক স্মৃতিবিজড়িত এই ল্যান্ডফোন। নিয়েছিলাম ঘরে বসেই দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার জন্য। তার ভেতর একটা প্রধান কারণ ছিল, হৃদয়বানদার সঙ্গে সম্পর্কটা নিবিড় রাখা। জীবনে যার সঙ্গে হৃদয়বান মিত্রের একবার দেখা হবে তাঁর হৃদয়ে ওনার জন্য পাকা আসন পাতা হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। এমন বিচিত্র মানুষ খুব বিরল।
***
প্রথম সাক্ষাতটাই বেশি মনে পড়ছে এখন।
আগের দিন বাড়িতে এসেছে এই ল্যান্ডফোন। পরদিন কানেকশন দিল। অফিসের ফোন থেকে বাড়ির ফোনে পরিবারের সঙ্গে কথা বললাম। অফিস থেকে ফিরেই শুনতে পেলাম দোতলার ঘরে ল্যান্ডফোনটা বাজছে। ভীষণ মিষ্টি লেগেছিল ক্রিং ক্রিং আওয়াজটা। আহ্বান শুনেই চিত্ত পুলকিত হল। অফিসের ফোন থেকে ফোনে ফোনে সবে দু একজন চেনা পরিচিত বন্ধুবান্ধবকে দিয়েছি নম্বরটা। বলেছি, সন্ধ্যেবেলা করিস। তাদেরই কেউ হবে। কার ফোন হতে পারে ভাবতে ভাবতে দৌড়লাম দোতলার দিকে।
তুলতেই সাগর বলেছিল,
- আপনি বিকেলের চা কটা নাগাদ খান?
সাগর আমার কলিগ। বছর তিনেকের জুনিয়ার। বাড়ি বেহালায়। পোস্টিং কাকদ্বীপে। ওদের বাড়িতে ল্যান্ডফোন অনেকদিন ধরেই আছে। প্রথম দিনই যাদের নম্বর দিয়েছি তাদের ভেতর সাগরও একজন। বলেছিল ফোন করবে। আমাদের এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে যাওয়ার কথা। নিশ্চয়ই সেই নিয়ে আলোচনা করবে। তা না করে, বিকেলের চা কটায় খাই?
উত্তরে আমি বললাম,
- কটায় আবার? অতো ঘড়ি ধরে তো খাইনে। বাড়ি থাকলে সন্ধের মুখে খাই। অফিস থাকলে যখন ফিরি তখন খাই। তবে রাত ন'টার পর আর খাইনে।
- বিকেলে খেলে পাঁচটার পর, না ছ'টায়?
- ওই ধরো সাড়ে পাঁচটা ছ'টা নাগাদ।
- সঙ্গে বিস্কুট?
- ঠিক নেই। যদি দুপুরের খাওয়া দেরিতে হয়, বিকেলে পেট ভার লাগে, তাহলে বিস্কুটটা আর খাই না। শুধু চা।
- লিকার না দুধ?
- তখন লিকার হলেই বেটার।
- যদি বিস্কুট খান তাহলে থিন না ক্রিম ক্র্যাকার?
- কী ব্যাপার বলোতো? চা খাওয়া নিয়ে এতো জেরা কিসের?
- জেরা নয়। ঐ যে, বলেছিলাম না, শনিবার একজনের বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যাব। ওনার বাড়ি থেকেই তো আমরা রোববার ঝাড়গ্রাম রওনা দেব। উনি আমাদের রিসার্চ সেন্টারের মেম্বার। আরে, ঐ যে...
- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। কী যেন নাম ওনার?
- খবরদার, নাম মনে নেই, এ যেন ওনার সামনে বলে ফেলবেন না। চিরকুটে লিখে পকেটে রাখবেন। আপনার যা ভুলো মন। ভাল করে শুনুন আবার, ওনার নাম হৃদয়বান মিত্র।
- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে থাকবে। কিন্তু এতো জেরা কেন চা খাওয়া নিয়ে?
- প্রশ্নগুলো আমাকে লিস্ট করে পাঠানো হয়েছে। আরও আছে। শনিবার রাতে আপনার পছন্দের মেনুটা জানান। তারপর তো এক সপ্তাহের জন্য ব্যাপারটা অন্যের হাতে চলে যাবে।
- আমরা ফিরছি কবে যেন?
- পরের শনিবার। সেটা সমস্যা নয়। সমস্যা হল এই শনিবার রাত অবধি আপনার মেনু চার্ট।
- বাপরে। এত এডভান্স এতো কিছু জানাতে হবে?
- অবশ্যই। আরও আছে।
- আরও?
- হ্যাঁ, আছে। আপনি বাড়ি থেকে শনিবার দুপুরের মিল কটায় খেয়ে বেরোবেন। সেই মেনুতে কী কী খেয়েছেন। আপনি একটা সাড়ে তিন ঘন্টার জার্নি করে আসবেন। সঙ্গে ব্যাগ। তাতে সাতদিনের জামাকাপড়। কাজেই জার্নি শেষে আপনার দুপুরের মিল কতটা হজম হবে তার ওপর নির্ভর করবে বিকেলের টিফিনের ওজন। যদি মেনু হালকা থাকে তাহলে খিদেটা বিকেলে বেশি পাবে। তখন আর শুধু বিস্কুটে হবে না। হয় চিঁড়ে বাদাম ভাজা বা সুজি। সুজি চাইলে নোনতা না মিষ্টি। আবার, এসেই চা বিস্কুট খেয়ে নিয়ে তারপর সুজি বা চিঁড়ে। এছাড়াও অপশন আছে।
মাথা ঝিমঝিম করে উঠল আমার। একজন অপরিচিতের বাড়ি যাচ্ছি। তাকে চিনি না, সে-ও আমাকে চেনে না। অথচ আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে এতদূর ভাবছে?
বললাম,
- আর কী কী অপশন?
- স্যাঁকা পাঁউরুটি, সঙ্গে হোমমেড ঘুগনি। ঘুগনিতে নারকোল কুচো ভাজা থাকবে কি না জানাবেন। ওপরে ধনেপাতা কুচিয়ে, না বিটনুন, না গোলমরিচ অর বোথ? সিকি পরিমাণ পাতিলেবু পাশে থাকবে কি না।
- সেরেছে। মাথা তো বনবন করে ঘুরছে। শোন সাগর, আমি জীবনে কোনদিন এতো আগে থেকে কখন কী খাব ভাবিনি। ওনাকে বলে দাও, অত টেনশনের কিছু নেই। আর তুমিও এই নিয়ে বিল আর বাড়িও না। যা দেবেন তাইই খাব। তুমি তো জান, আমি মোটামুটি সর্বভুক।
- আমি তো বলেইছিলাম হৃদয়বানদাকে, যে আপনাকে নিয়ে এতো টেনশনের কিছু নেই। আমরা এক মেসে কোচবিহারে তিন বছর কাটিয়েছি। কত অখাদ্য খেয়ে কেটেছে সে সব দিন। শুনে কী বলল জানেন?
- কী বলল?
- বলল, টেনশন করাটাই তো ওর কাজ।
- ওনার ফোন নেই? আমি একটু কথা বলে নিতাম।
- না, ফোন নেই, নেবেও না কোনদিন।
- কেন?
- ফোন নাকি মানুষের কাছ থেকে মানুষকে কেবল বিচ্ছিন্ন করে, দূরে ঠেলে দেয়।
- সেকি? কেন?
- ফোন এসে গেলে মানুষ আর মানুষের বাড়ি গিয়ে গল্প করে না।
- বাপরে!
- ওর আরও অনেক কিছু নেই।
- যেমন?
- টিভি নেই, গ্যাস নেই, ফ্রিজ নেই।
- এরা আবার কী দোষ করল?
- দেখা হলে আপনি জেনে নেবেন। আমি যতটুকু জানি, টিভি বোকাদের বাক্সো, তাই নেই। গ্যাসে খেলে পেটে গ্যাস হয় আর ফ্রিজ হল মর্গ। সংরক্ষিত মৃতদেহ গ্যাসে মিশিয়ে ও খাবে না কোনদিন। তাই ওসব ঢুকবে না ওর বাড়িতে । আবিষ্কার করুন ওনাকে, ধীরে ধীরে, সব বলে দিলে হবে?
ফোন রেখে দিল সাগর।
***
শনিবার খাওয়া দাওয়া সেরে রওনা দিয়েছিলাম। রানাঘাট থেকে শেয়ালদা বাই ট্রেন, তারপর সাউথ সেকশন। বজবজ লোকাল বাদে যে কোন লোকালে ওঠার নির্দেশ ছিল। বারুইপুর লোকালে চেপে যাদবপুর স্টেশন। সেখান থেকে রিকশা নিলাম একটা। সুপুরিবাগান শনিমন্দির বলতেই একদম বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল।
মন্দিরের উলটো দিকে একটাই কাঁচা বেড়ায় ঘেরা বাড়ি। পূবমুখো টিনের গেট। সব মিলে গেল। আলকাতরা দিয়ে লেখা নম্বরটা মিলিয়ে নিয়েছিলাম কেবল - বেশ দীর্ঘ নম্বর - ২/৪৩/১২, বিজয়গড়। কলি–৩২।
ঝুলন্ত শেকলে হাত ছোঁয়াবার আগেই দরজা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলে গিয়েছিল। ফ্রেমে দাঁড়িয়ে একজন গোলগাল দোহারা মানুষ। বয়স চল্লিশের একটু ওপারে। গায়ের রং আরেকটু খুললেই ফর্সার দলে পরে যেতেন। পাজামা পাঞ্জাবি ঘামে ভেজা। পাজামার ঘের পায়ের বুড়ো আঙুল অবধি। পাঞ্জাবি তুলনায় ছোট ঝুলের এবং টাইট। বুকপকেটে মানিব্যাগ ও কলম।
মুখমণ্ডল গোলাকার। চন্দ্রের জাতক। চোখদুটি খুবই ছোট। মঙ্গোলয়েড। চশমার ফ্রেম এক দিকে একটু ঝুলে পড়ায় একটা চোখ পুরো, অন্যটি হাফ, দৃশ্যমান। সরু করে কামানো গোঁফ। শরীরে লোমের গ্রোথ কম।
নিঃশব্দে হাসলেন। সেই হাসি শুধু মুখে নয়,সারা শরীরেও যেন ছড়িয়ে পড়ল।
- রিকশা ভাড়া কত নিল?
এইটাই প্রথম প্রশ্ন। থতমত খেয়ে বললাম,
- চার টাকা।
পেছন ফিরে বললেন,
- রানওয়ে ধরে চলে আসুন। মাটিতে পা দেবেন না। পেছল খুব। বেশি না, একটাকা বেশি নিয়েছে। লোভ কম ওর। কী রকম বয়েস ছিল?
রানওয়েই বটে। দরজার ভেতর পা দিলেই উঠোনটা চারকোণা। তার পরিধি বরাবর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধান ফুট দুয়েকের চওড়া পথ। বাকিটা কাঁচা। সেখানে মাটি ভিজে, শ্যাওলা জমেছে হাল্কা করে। গেট থেকে সেই চতুর্ভুজের কর্ণ বরাবর যাওয়া বিপদজনক। খুব শুকনো সময় রানওয়ে পরিহার করে যাওয়া চলে কিন্তু এখন একদমই না।
চারিদিকে সেই রানওয়ের বাইরে, কিছু ফুলের টব, কিছু ফলের চারা, কিছু জড়ো করা পুরনো ইঁট। এক কোণে একটা সিমেন্টের ভাঙা বাথটব। ভেতরে জলে থেকে থেকে ছোট ছোট বুড়বুড়ি উঠছে। মনে হল, ভেতরে মাছ আছে।
সাবধানে রওনা দিলাম উত্তরদিক ঘেঁষে ঘরের দিকে। সামনে খোলা বারান্দার মুখ দক্ষিণে। সেখানে পা রেখে বলেছিলাম,
- অতটা খেয়াল করিনি। তবে ইয়াং ছেলে বলেই মনে হল।
- বয়েস?
- চব্বিশ পঁচিশ হবে।
- কেমন ভাবে চালাচ্ছিল? ফুর্তিতে না ক্লান্ত চালে?
- না না, দারুন এনার্জি। শিস দিচ্ছিল আপনমনে, সিটে পেছন ঠেকাচ্ছিলই না। ঝড়ের বেগেই নিয়ে এল প্রায়। সামনে লোক পরে গেলে হইহই করে উঠছিল।
- দু একটা রসিকতাও করছিল?
- হ্যাঁ, ঠিক, আপনি জানলেন কী করে?
- সুনীল। চম্পাহাটির ছেলে। এখন গড়ফার এক বস্তিতে ভাড়া থাকে। বুড়ী মাকে নিয়ে থাকে। আমি ওর বাড়ি গেছি। বকুনি খাবে আমার কাছে।
- কেন?
- আপনার কাছ থেকে একটাকা বেশি নিয়েছে বলে। আমার বাড়িতে নামাবার সময় ওর ভাবা উচিত ছিল। যাই হোক। গরিব মানুষের চেয়ে ধনীরা মানুষকে বেশি ঠকায়। সব সময়। সাধ্বী-ই — বারান্দায় চেয়ার দাও। ফোল্ডিং দুটো দিও। এলুমিনিয়ামের হাতল লাগান দুটো। আপনার ফোলডিং চেয়ারে বসবার অভ্যাস আছে তো? চাইলে বারান্দার ভেতরের ওই তক্তপোষেও বসতে পারেন। অথবা হাতল দেওয়া কাঠের চেয়ার দিতে পারি। মোড়ার কথা অনেকে বলে। তাই রেখেছি এক জোড়া। মোড়া আবার দু রকমের। দেখেছেন নিশ্চয়ই। এক ধরণের শক্ত উঁচু মতো। তলাটা কালো টায়ার দিয়ে বাঁধান। আরেক ধরণের আজকাল খুব চলছে। একটু ‘সফি’ দেখতে। বেঁটে। বিড়ে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে। নরম। একটু আরামদায়কও বটে। তবে দুর্বল। এছাড়া আছে, ইজিচেয়ার, পিঁড়ে আর জলচৌকি। যেটা চান দিতে পারব। এগুলোর সুবিধা হল, সবকটা পোর্টেবল। বাইরে বসবার জন্য একদম ফিট। রানওয়েতেও বসি রাতের দিকে লোডশেডিং হলে।
গলা নামিয়ে বলেছিলেন,
- শুকনো সিজিনে মাদুর বা শতরঞ্চি পেতে উঠোনে বসে সবচেয়ে সুখ। শুধু কোলের ওপর থাকবে একটা পাশবালিশ।
বারান্দায় এলেন মিসেস মিত্র। আয়তনের দিক থেকে দুজন একদম রাজযোটক। হৃদয়বানবাবুর ভেতর পিতৃভাবের চেয়ে সখ্যভাব বেশি আর মিসেসের ভেতর মাতৃভাবের প্রাবল্য। বড় বড় চোখদুটো বাৎসল্যে ভাসমান। স্নেহে অর্ধনিমীলিত। সাদামাটা ঘরোয়া ভাবে পড়া শাড়ি-ব্লাউজের ভেতর রুচির ছোঁয়া। আমি জোড়হাত তুলতেই নিখুঁত বাঙলা উচ্চারণে বলে উঠলেন,
- ও তুমিই তাহলে রজতশুভ্র?
গলাটি খুবই সুরেলা ।
- সাগরের কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি, তোমাদের সেই কুচবিহারের মেস লাইফের সব কাণ্ডকারখানা। এক হাঁড়িতে সব ফেলে রান্না। একবারে যা নামবে তাই। তাই তো? আচ্ছা তোমাদের মেসের সেই ম্যানেজার ছেলেটির নাম কী যেন?
- অনাদি।
- হ্যাঁ হ্যাঁ অনাদি। ও নাকি সর্ষের তেলের শিশিতে সাতদিনের দাগ লেবেল দিয়ে আটকে রাখতো? এই আগের দিনের ডাক্তারবাবুরা যেমন মিক্সচারের শিশিতে লেবেল দিতেন। সত্যি?
- ঠিকই শুনেছেন। আবার বেশি তেল যেন কেউ আলুভাতেতে মেখে না ফেলে সেজন্য লেবেলের ওপর সোম মঙ্গল এইভাবে সাতটা বারও লিখে রাখত।
- মিস্টার অনাদিকে আমার অভিনন্দন জানাবেন। বলবেন, একবার দেখা হলে ধন্য হব।
হৃদয়বানের গলা আচমকা ঢুকে পড়ল এই আলাপের ভেতর।
- তোমাকে তুমি বলছি বলে কিছু মনে কর না যেন। তুমি সাগরের বয়সী। সাগর আমার ভাই কাম বন্ধু। তুমিও তাই। আমাদের ইন্সটিটিউটের বন্ধুরাও ভীষণ ক্লোজ। প্রথম আলাপেই তুমি সবাই। তাদের যারা বন্ধু, খুব বুড়ো না হলে সব তুমি।
মিসেস মিত্রর গলার স্বর যেন হৃদয় থেকে উত্থিত হল।
- না না তুমিই তো ভাল। আপনি থেকে তুমি অনেক কাছের।
- ঠিক, কিন্তু তুই থেকে তুমিতে উত্তরণ শুনেছেন কখনও?
হৃদয়বানের প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। ঘাড় নেড়ে বললাম,
- নাঃ, শুনিনি। এও সম্ভব?
মিসেসের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
- খুব দুর্ভাগ্য হলে এরকম হয়। যেমন আমাদের ঘটেছে। আমরা তুমি থেকে তুইতে পৌঁছে আবার তুমিতে ব্যাক করেছি খানিকটা বাধ্য হয়ে। এটাকে সভ্যতার সঙ্কট বলতে পার। সেই সঙ্কটের নাম – বিবাহ। প্রকাশ্যে তুই আর বলতে পারি না।
- সঙ্কট, এটাকে তুমি সঙ্কট বলছ?
- সঙ্কট বললে কম বলা হয়। চরম সঙ্কট বলা উচিত।
সঙ্কট যাতে আর না বাড়ে সেজন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম,
- আমি একটু বাথরুমে যাব।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন আসুন।
হৃদয়বান এইবার পথপ্রদর্শক। রানওয়ে ধরে আমাকে একটু দক্ষিণে নিয়ে চললেন। ডানহাতে একটা বিচ্ছিন্ন ঘর। মূল বাড়ির সঙ্গে কোন সংস্পর্শ নেই। টিনের দরজা এরও। দরজায় একটি ছোট পাতলা টিনের হলুদ রঙের প্লেট স্ক্রু দিয়ে আঁটা। তারওপর কালো হরফে রং দিয়ে লেখা- ‘প্রাতঃস্মরণীয়’।
বাইরে আসতেই দেখি রানওয়ে জুড়ে সাদানীল ফিতেয় বোনা চকচকে এলুনিমিয়ামের দুটি ফোলডিং চেয়ার মুখোমুখি পাতা। মাঝখানে নিচু, কাঠের, মাঝারি মাপের একটা টেবিল। তার ওপর সাদা দুটি মাঝারি চিনামাটির প্লেটের ওপর শিউলি ফুলের মতো ধবধবে এবং ফুরফুরে চিঁড়ে ভাজা সাজান।
মিনি টিলার মতো উঁচু চিঁড়েগুলোর ওপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়ান ভাজা বাদাম। একপাশে একটি ভাজা শুকনো লঙ্কা, অন্যপাশে একটি কাঁচালঙ্কা সমান্তরাল ভাবে শায়িত। আলাদা একটি স্টিলের ট্রেতে দুটি চামচ।
চিঁড়েভাজাগুলো এত নরম যে মুখে দিতেই মিলিয়ে যাচ্ছে। তুলনায় বাদামগুলো ঈষৎ শক্ত। নরম-শক্তের একটা যুগলবন্দি চলছে মুখের ভেতর। মুখ ভরে উঠছে সহায়ক উৎসেচকের জারণরসে।
একফাঁকে হৃদয়বান বললেন,
- সাগরটা মিস করল।
- হ্যাঁ, হঠাত যে কী হল ওর। একদম রওনা দেওয়ার আগে ওর ফোন এল। বলল আসতে পারবে না। রাত হবে ওর। আমি যেন আগে ঢুকে যাই। আমি বললাম, সম্পূর্ণ অচেনা একজনের কাছে যাব। যোগসূত্র একমাত্র তুমি। সেই তুমিই যদি না থাক...
থামিয়ে দিয়ে বললেন,
- না, আমি চিঁড়ে ভাজাটার কথা বলছি। আর কী বলল?
- সাগর আরও বলল, ইন্সটিটিউট সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা নেই। তাই এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমি ভাবছি।
- ঠিক। আপনার কোন ধারণাই তো নেই। এই গল্পটা বললে একটু ধারণা হবে। সাধ্বীর একবার পেটে একটা টিউমার ধরা পড়ল। পড়ল একদম শেষ মুহূর্তে। ডাক্তার জানাল একঘণ্টা হাতে আছে। তারপর বার্স্ট করবে। আমি তখন ব্রাঞ্চে। ক্যাশ মেলাচ্ছি। খবরটা শুনেই আমার লুজ মোশন শুরু হয়ে গেল।
- সেকি?
- হ্যাঁ, কারও শরীর খারাপ শুনলেই আমার শরীর খারাপ হয়ে যায়। যাই হোক, আমি ওরই ফাঁকে ইন্সিটিউটের দুজনকে ফোন করতে পারলাম। তারপর ওষুধ বিসুধ গিলে মোশন থামিয়ে যেতে যেতে ঘণ্টা তিনেক লাগল। গিয়ে দেখি অপারেশন শেষ। মোট সাতাশজন মেম্বার নার্সিং হোমে উপস্থিত। আমিই শেষ ব্যক্তি।
- চা কি দেব এখন?
রান্নাঘর থেকে সাধ্বীদির উঁচু গলা শোনা গেল।
- পাঠাও।
রানওয়ে থেকে ক্লিয়ারেন্স গেল।
একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব রমণী, পরনে সাদা শাড়ি ব্লাউজ, মাথায় ঘোমটা, দুহাতে ট্রে নিয়ে রানওয়ে ধরে বারান্দা থেকে আসছেন। আবির্ভাবে মাতৃভাব প্রবল। যদিও চেহারায় তিনি পরিচারিকা বা সহায়িকা, তবু একটা বিশেষ অধিকারবোধ লেগে আছে তার মুখে।
- ছোট টেবিলটা আগে ফাঁকা করে নিলে পারতে রাজোর মা। এত বড় ট্রে রাখবে কোথায় এখন? মাসি আমাদের। ওর মেয়ের নাম রাজোবালা। শর্টে রাজো। আমি কতবার বলেছি আগে টেবিল ফাঁকা করে তারপর চায়ের ট্রে আনবে। ভুলে যাবে প্রত্যেকবারই। যাও, চা রেখে এসে আগে টেবিল ফাঁকা করো। তারপর চা আনবে।
সহসা এইরকম একটা থতমত খাওয়া দৃশ্যে সাধ্বীদিদির প্রবেশ।
- দাও দাও। আমাকে ট্রেটা দাও তো মাসি। তারপর টেবিল ফাঁকা করো। আমি ধরছি।
- তুমি আবার রান্না ছেড়ে এলে কেন? মালাইকারির পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়ে গেল তো।
- কেন হবে পঞ্চত্ব? আমি তো স্টোভ নিভিয়ে এসেছি।
- স্টোভ নেভালে তো আরও মাটি হল জিনিসটা।
- দ্যাখ হৃদয়বান, -‘তোমার জগত মাঝারে রয়েছে যতেক কাজের তাড়া, / আমার পানে উন্মুখ হয়ে আছে আকাশের তারা’। এ তো বলেইছেন, তুমিও তো পড়েছ।
- কোথায় বলা আছে?
- পঞ্চম খণ্ডে ‘নীলিমা’ কাব্যগ্রন্থে ‘সদাব্যস্ত’ কবিতায়।
বাপরে! এতো চলন্ত এনসাইক্লপিডিয়া? পুরো রচনাবলী মুখস্থ নাকি! রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নামটা শুনেছি এতদিন, এইবার নমুনা দেখলাম। বিমুগ্ধও হলাম।
- বাজে কথা।
হৃদয়বানের আচমকা আওয়াজে চমকে উঠলাম।
- বাজে কথা? আমি এখুনি এনে দেখাই?
- দেখাও।
মেদিনী কাঁপিয়ে সাধ্বীদির প্রস্থান।
হৃদয়বান বলে উঠলেন,
- ঢপ। পুরোটাই ঢপ। ওই নামে ওনার কোন কবিতাই নেই। সবটাই সাধ্বীর বানানো। ইনস্ট্যান্ট। দ্যাখো না কী হয়।
ভেতর থেকে উচ্চস্বরে একটা চিৎকার ছুটে এল।
- নেই, পঞ্চম খণ্ডটাই নেই। নিশ্চয়ই শানুকে দিয়েছ? আর ফেরত চাওনি। ওই বা কেমন? ফেরত তো দেবে।
- ফেরত দিলেও তাতে ওই কবিতা আর কোনদিন খুঁজে পাবে না।
অদ্ভুত হাসিতে উদ্ভাসিত হৃদয়বানের মুখমণ্ডল। তৃপ্তির হাসি, পরাজয় না-মানার হাসি। অনুমান নির্ভুল হওয়ার হাসি। দাম্পত্য কলহে জিতে গেলে বিজয়ীর মুখে যে ধরণের হাসি দেখা যায় ঠিক সেই রকম। ছোট ছোট চোখ দুটো প্রায় নিমীলিত। বললেন,
- খন্ডটা ও-ই সরিয়ে রাখল এইমাত্র। আমি লাইনটা ভুলে গেলে আবার বার করবে। ভাবছি এবার থেকে লিখে রাখব।
- কিন্তু দিদি তো কাব্যগ্রন্থের নামধাম সমেত বলে দিলেন।
- ওঃ। ওইরকম অজস্র নাম আমি বলতে পারি। যে কোন ওই সময়ে একটা মেয়ের নাম বসিয়ে দাও না, মানসী, সরলা, মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী। ওনার লেখা একটা না একটা কবিতার নাম পাবেই।
চা পর্ব শেষ হলে হৃদয়বান বললেন,
- এইবার জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। কী এনেছ? লুঙ্গি না পাজামা?
- আমি বাড়িতে লুঙ্গি পড়ি। বাইরে কোথাও গেলে পাজামা নিয়ে যাই।
- রাতে পাজামা না দিনে?
- অত তো ভাবিনি। এই পাজামা তো দিনেও পড়ি। রাতেও পড়ি।
- ভাবনার অভাবেই জাতটা সর্বনাশের পথে চলে যাচ্ছে। যাই হোক, তোমার ব্যাপার। রাত পাজামা একটা কিনে নিতে পার, বা বানিয়ে নিলে। ওগুলো একটু পাতলা হয়। গরমে আরাম। চলো, এইবার ভেতরে যাওয়া যাক।
আমরা উঠে রানওয়ে বেয়ে বারান্দার চাতালে পা রাখলাম। একপাশে একটা তক্তপোশ। বেতের মাদুর বিছানো। তারপাশে মাটিতে লোহার সরু শিক দিয়ে তৈরি একটা জুতো রাখার র্যাক। র্যাকে চামড়ার চটি দু জোড়া, হাওয়াই তিন জোড়া, আর লেডিজ স্যান্ডেল দু জোড়া। কোন বুটজুতো নেই। র্যাকের ডান সাইডে একটা সরু স্টিলের চেন। তার সঙ্গে ঝোলান একটা টিনের প্লেট। গায়ে লেখা - জুতোর বাড়ি।
দরজার সামনে ছোট্ট পাপোশ। কুচো কাপড়ের নানা রঙের টুকরোর ওপর সুতোর দিয়ে সেলাই করে বানানো বেশ গোছান একটা চাকা। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সুতো দিয়ে লেখা আছে - পদদলিত।
- থমকালে হবে না। চমকালেও হবে না। আরও আছে। আগে বাড়ো। পদদলিতকে আরেকবার দলন করা না করা তোমার ইচ্ছে। এইবার পা রাখ ভেতর ঘরে। তার আগে একবার ওপরটা দেখে নিয়ো।
ইশারা লক্ষ্য করে চোখ তুললাম। চৌকাঠের মাথায় সেই রকম প্লেট, লেখা - অন্দরমহল।
ঘরের মাথায় এসবেটাস, এবং ফাঁকে ফাঁকে টালি আর পিচচটের আস্তরণ। কিন্তু ভেতরে পা দিলে সেসব কিছুই বোঝা যাবে না। সুন্দর ধবধবে সাদা রং করা সিলিং। সেটাও তৈরি দরমা ধরণের কোন বেড়া দিয়ে। দেওয়ালের সঙ্গে ভাল করে আটকান। কোথাও ঝুলে নেই, টানটান। একজোড়া টিউবলাইট মুখোমুখি দুই দেওয়াল বসে সারা ঘর ধুইয়ে দিচ্ছে আলোয়। দেওয়ালে যামিনী রায় আর রামকিঙ্করের রেপ্লিকা।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট মুঘল মিনিয়েচার, রাজস্থানী আর কাংড়াও টাঙানো। এবং কী আশ্চর্য, ঘরের কোণে নিচু টেবিলের ওপর একটা টিভি। একদম নতুন। ঝকঝক করছে। আমি একদম ঘাঁটালাম না।
চোখের সমান্তরালে ঝুলছেন সাদা কালো রঙের বিশ্বকবি। পাশে একটি মাত্র ক্যালেন্ডার। তার সারা গায়েই এক বছরের সব মাস বার আর তারিখ।
ক্যালেন্ডারটির দিকে নজর না পরে কোন উপায় নেই।
বেশ কিছু তারিখ নানা রঙের স্কেচ পেন দিয়ে রাঙান। সাঙ্কেতিক কিছু শব্দ পাশের মার্জিনে লেখা। কিছু ক্লিপ, মেটাল এবং প্লাস্টিকের, ক্যালেন্ডারের গায়ে চারপাশে বাদুড়ের মতো ঝুলছে। সেইসব ক্লিপের ভেতর আটকান কিছু রশিদ বা ক্যাশমেমো।
আমি ক্যালেন্ডারটার কাছে এগিয়ে গেলাম। কোথাও মার্জিনে লেখা ‘এল, আই, সি’। তারপর সেই লেখার গা থেকে একটা স্কেচ পেনের তির চিহ্ন বার হয়ে বাঁক নিয়ে চলে গেছে ১৭ই মে তারিখ অবধি। আবার অন্য জায়গায় মার্জিনে লেখা – কাবেরির জন্মদিন - তির চলে গেছে ২৩শে জুন। এইভাবে ‘খবরের কাগজ’, ‘দুধ’, ‘লাইট বিল’, ‘রেকারিং’ ‘প্রেশার মাপা’, ‘জুতোয় কালি’, ‘নারকেল পাড়া’ এইরকম অজস্র খুঁটিনাটি বিবর্ণ। সবচেয়ে দুর্বোধটি হল, ‘মাসিকে বকতে হবে’। সেটিও ১২ই জুলাইতে গিয়ে তিরবিদ্ধ।
আমি বিস্ময় খচিত মুখে পেছন ফেরবার আগেই চোখে পড়ল কালকের তারিখটার ওপর। রবিবার, একটা নিটোল ছুটির দিন, সেখানে বিচিত্র একটি সঙ্কেত - জারালআটা।
লাল আটা, সাদা আটা, ভুসি মেশান আটা, এইসবই শুনেছি এতদিন। কিন্তু জারালআটা? নাহ, অসম্ভব। ফ্যালফ্যালে চোখে ফিরলাম হৃদয়বানের দিকে।
মুখমণ্ডল জুড়ে খেলা করছে এক অপার আনন্দ। ছোট ছোট চোখ দুটো হাসির উল্লাসে প্রায় বুঁজে এসেছে। ঠোঁটের দুপাশে ঝুলছে রহস্যময় ইঙ্গিত।
আবার বললাম,
- জারালআটা? ব্যাপারটা কী?
- একটা গ্রামের নাম।
সহাস্য জবাব। আমার দুরাবস্থা উপভোগ চলছে প্রসন্ন চিত্তে।
- কারণ, ওটাই আগামীকাল আমাদের গন্তব্যস্থল।
- সাগর যে বলেছিল, ঝাড়গ্রাম।
- ঠিকই বলেছে। ঝাড়গ্রামে নেমে ওই গ্রামে যেতে হয়। চিন্তা নেই, গাড়ি থাকবে। আমরা থাকব একটা এগ্রিকালচারাল ফার্ম হাউসে। এক সপ্তাহের মতো বডিফেলা কর্মসূচি ওখানেই। তবে এই ভাদ্রের গরমে কেউ ঝাড়গ্রাম বেড়াতে যায় না। আমাদের রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচার কর্মসূচিও আছে একটা।
- সাগর এত ডিটেলে বলেনি। বলল, আপনার কাছেই সব জেনে নিতে। তা কে কে যাচ্ছি আমরা? মোট কজন?
- আমি, সাধ্বী, তুলসী দা, অভিক, জয়, সাগর আর তুমি। তুমিই একমাত্র ইন্সটিটিউটের লোক নও। বহিরাগত। বাকিরা আমরা সকলেই প্রায় দুই দশকের বন্ধু।
কথার মাঝখানে একটি রোগা, কোঁকড়া চুলের কিশোর ঢুকে পড়ল ঘরে। মুখখানি বড় মিষ্টি। সবে গোঁফদাড়ি গজিয়েছে। দু একবার লুকিয়ে কামিয়েওছে মনে হয়। কিন্তু এখন সেই মুখে উদ্বেগের ছায়া প্রবল। সোজা হৃদয়বানের দিকে তাকিয়ে বলল,
- কাগা, তুমি গোপালকে বলনি যে আজ রাতে এখানে থাকতে হবে?
- না, ও বাড়ি ছিল না। ওর টেবিলের ওপর একটা চিরকুটেতে সব লিখে দিয়ে এলাম তো।
- কিন্তু ওর মা যে বলল, তুমি মাসিমাকে কিছুই বলে আসনি।
- ওর মাকে কেন বলব? মা কী রাতে এসে এখানে থাকবেন নাকি? গোপাল ছিলনা দেখে বাইরে থেকে জানলা দিয়ে চিরকুটটা গলিয়ে ওর পড়ার টেবিলে নামিয়ে রেখে এসেছি। খোলা চিঠি। টেবিলে এলেই দেখতে পাবে।
- দেখেছে তো। দেখে যখন মাকে জানাতে গেছে ততক্ষণ ওর মা রাতের খাবার রেডি করে ফেলেছে।
- তাহলে গোপালকে বল, রাতের সেই খাবারটা নিয়ে যেন এইখানে চলে আসে, রজত খাক সেটা। আমি তোদের জন্য গলদা চিংড়ি অলরেডি করে ফেলেছি। গোপাল সেখান থেকে একপিস খাবে।
- আর রজতকাগা কি গোপালের রুটি চচ্চড়ি খাবে নাকি?
আলাপ নেই তবু ছেলেটি আমাকে 'কাগা' বলে ফেলছে। তার মানে ও জানে যে আমি ‘কাগা’র বন্ধু।
- না না, রজত গলদাও খাবে আবার ভাল লাগলে গোপালের মায়ের হাতের রান্না করা রুটি চচ্চড়িও খাবে। আচ্ছা, কেউ যদি নাই খায় তো আমিই খেয়ে নেব। তোমার কি গলদায় এলার্জি আছে?
পরিস্থিতি ঘোরাল হয়ে গেছে। রান্নাঘরের দরজার ফ্রেমে সাধ্বীদিদি স্থির। ঘরের মেঝেয় হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়েছে ভাইপোটি। দম বন্ধ করে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই সহসা পাল্টে যাওয়া মেনু তালিকায় আমি যদি রাজি না হই তাহলে আজ রাতের এতগুলো মানুষের খাওয়া দাওয়ার ভাগ্যে যে কী আছে কে জানে, এই রকম একটা থমথমে ভাব। আমি একটু সময় নিয়ে স্পষ্ট ভাবে বললাম,
- হৃদয়বানদা, অত টেনশনের কিছু নেই। প্রথমেই বলে রাখি, আমার খাদ্য ব্যক্তিত্ব অত প্রবল নয়। তার ওপর মেসে মেসে লাইফ কাটিয়েছি দীর্ঘ দিন। আমি মোটামুটি সর্বভুক। কাজেই...
- এটা একটা কথা হল? তুমি কী খাবে সেটা তো তুমিই বলবে, আমি সেইমত এরেঞ্জ করব। আপরুচি খানা। এখনও প্রচুর সময় আছে। ভেবেচিন্তে বলে ফেল। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিকেন খেলে বলতে পার। মাছ আছে। রাতে দুটো মাছের ঝোল ভাতও দেওয়া যাবে।
একটুও না ভেবে বললাম,
- রুটি আর আলুভাজা।
আমি জানি, এর চেয়ে সহজ মেনু আর হয়না।
- গোপালের মা কী রান্না করেছে জানিস তুই?
হৃদয়বান বললেন ভাইপোকে।
- না, জানিনা। কী করে জানব? তবে গোপাল রাতে রুটি সবজি বা দুধ রুটি খায় এটুকু জানি।
- ঠিক আছে। গোপালকে বলে আয় মেনু যাই হোক, সেটা যেন প্যাক করে নিয়ে চলে আসে। দাঁড়া -- সাধ্বী- আমাদের ছোট দোতলা টিফিন ক্যারিটা দাও তো। বাকিরা?
- ওরা খেয়ে আসবে।
ভাইপোর ছোট উত্তর।
কথা বার্তার ভেতরেই টিভি চালু হয়ে গেল। খেলা চলছে। গতকালের খেলাটা এখন দেখাচ্ছে। আর্জেন্টিনা বনাম বুলগেরিয়া । মারাদোনা অবিশ্বাস্য গতিতে পর্দায় ঝড় তুলছে। গ্যালারি ফেটে পড়ছে উল্লাসে। হাজার হাজার মানুষ কাঁপছে উত্তেজনায়।
- আজ কাদের খেলা রে?
- নাইজিরিয়া আর গ্রিস।
- বোরিং হবে। কটা থেকে?
- রাত সাড়ে বারোটা থেকে।
ভাইপোর খেলার টাইমটেবিল মুখস্থ।
- তাতাইরা কখন আসবে?
- এগারটার মধ্যে ঢুকে যাবে সবাই।
- তাহলে আমি সাড়ে আটটা নাগাদ খেয়ে নেব। বারোটা অবধি একঘুম দিয়ে নেব ভাবছি। তারপর উঠে খেলা দেখব। রজত তুমি কি আমার সঙ্গেই খাবে না গোগোলদের সঙ্গে? এক কাজ কর, তুমি আমার সঙ্গেই খেয়ে নাও।
- এত সকাল সকাল খাব?
- সকাল সকাল খাওয়াই তো স্বাস্থ্যকর। দেখনা, সাহেবরা সব সাতটার ভেতর ডিনার সেরে নেয়। তারপর তাস খেলে, টিভি দেখে। একটু হাঁটতেও যায় কেউ কেউ। আফটার লাঞ্চ, রেস্ট আ হোয়াইল বাট আফটার ডিনার মাস্ট ওয়াক আ মাইল। এই টিভি আসবার পর থেকে আমারও হাঁটাচলা কমে গেছে। এত ডেঞ্জারাস জিনিষ আর দুনিয়ায় দুটো নেই।
বললাম,
- কিনলেন কেন?
- আরে ওই ওদের চাপে।
ইশারায় পেছন দিক থেকে ভাইপো এবং রান্নাঘরের সাধ্বীদিকে দেখালেন।
ভাইপো গোগোল, টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
- কাগা, ভুল হল। বাট আর মাস্ট এই দুটো মূল প্রবাদে নেই। তুমি এইমাত্র জুড়লে।
বিজ্ঞাপন শুরু হল। হৃদয়বান বলল,
- জুড়লাম একটু জোরাল করবার জন্য। এ্যাড শেষ হলে একটু নিউজটা দিস।
গোগোল মেঝেয় পেছন ঘষটে টিভির একদম কাছে এগিয়ে গিয়ে বসল। একটু কোনাকুনি রইল যাতে আমরা পেছন থেকে দেখতে পাই। আমরা বসে আছি দেওয়ালে হেলান দিয়ে একটা তক্তপোশের ওপর। মোটা মোটা, বালিশ, তাকিয়া সব সাজান। ঠেসান দিয়ে আরাম করে বসেছি আমরা। আমি পাজামা আর গেঞ্জি পরে নিয়েছি। হৃদয়বান পাজামা পড়েছেন কিন্তু খালি গায়ে বসে। নোয়াপাতিটা একটু ঝুলে আছে কোলের ওপর।
গোগোল টিভির সাইডে একটা স্টিলের চৌকো সুইচে চাপ দিল। দশটা মোট এইরকম সুইচ। ওপর নিচে সাজান। অনেকটা বহুতলের কার্নিশের মত দেখতে। যে চ্যানেল চলছে সেই ধাপের কার্নিশে একটা ছোট্ট সবুজ আলো জ্বলছে। আমাদের বাড়ির টিভির যেমন তখন ছিল কোনারকের রথের চাকার সুইচ, ঘোরালে কটকট করে আওয়াজ হয়, এরা তেমন না। অনেক উন্নত এবং ছিমছাম কালার সেট এইটা। গোগোল একটায় চাপ দিল।
খবরে এসে দেখা গেল রাষ্ট্রপতি দারিদ্র্য দূর করবার জন্য জাতিকে কোন একটা সভায় আহ্বান জানাচ্ছেন। দু সেকেন্ড পরেই হৃদয়বানের আদেশ হল,
- তিনে দে।
লাস্যময়ী এক তরুণী ঝরনার জলের ভেতর বিশেষ একটা সবান মেখে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে তুমুল স্নান করছে। পা পিছলে পড়ে যাওয়া নিয়ে তার বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই।
- সাত।
গোগোল অন্য কার্নিশ টিপল। বয়স্ক শিক্ষার ওপর অনুষ্ঠান। একজন শিক্ষক কিছু বয়স্ক মানুষ যোগাড় করে তাদের বানান শেখাচ্ছেন।
- চার।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হারের সঙ্গে শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগের সম্পর্ক নিয়ে চারজন ভীষণ গম্ভীর প্রকৃতির লোক দর্শকদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজেদের ভেতর আলোচনায় মগ্ন। সঞ্চালক হতাশ ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছেন। এই বিষণ্ণ অনুষ্ঠানটি তাঁকে সম্প্রচার করতে হবে বলেই বোধহয় আজ দাড়ি কামাননি।
- নয়।
পান মশলার বিজ্ঞাপনে একদা হিন্দি সিনেমার এক নায়ক, পরে বিপুলকায়, পার্শ্ব চরিত্রেও সমান জনপ্রিয়, প্রচুর দাড়িগোঁফ নাচিয়ে বোঝাচ্ছেন কী ভাবে বরযাত্রীদের এই বিশেষ পানমশলা দিয়ে স্বাগত জানালে তারা চরম প্রীত হবেন।
- এবার দেখ, খেলাটা বোধহয় আরম্ভ হয়ে গেল।
গোগোল খেলার চ্যানেলে ফিরল। না, এখনও বিজ্ঞাপন।
- খবরটা দে আবার।
ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটল ঘরের ভেতর। গোগোল লাফিয়ে উঠে বলল,
- পা-আ-র-বো-না। তুমি নেমে এসে পালটাও।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। পাল্টাতে হবে না তোকে। তুই কালই কঞ্চি আর ফোম-এর পিসটা এনে রাখিস তাহলে। তোকে কতবার বলেছি ওগুলো এনে রাখিস।
- কঞ্চি কলকাতা শহরে পাওয়া যায় না তুমি জান। আমি সামনের সপ্তাহে ক্যানিং যাব। তখন নিয়ে আসব।
গোগোলের গলায় এখন মাখন।
- তুমি বিছনায় বসে বসেই সব চ্যানেল পাবে। কিন্তু প্লিজ এরপর একটা রিমোট দেওয়া সেট কিনো কাগা। এসব আর চলে না।
- হবে হবে, তোর চাকরিটা হয়ে গেলেই সব হবে রে।
হৃদয়বানের গলায় মধু আর ঘি। কে বলবে একটু আগে এরা দুজন সিরাজ আর ক্লাইভের ভূমিকায় ছিল।
রাত সাড়ে নটা নাগাদ মোট চারজন ঢুকল। সবাই গোগোলের কাছাকাছি বয়েসের। সবচেয়ে শান্ত দেখতে ছেলেটির হাতে দোতলা স্টেনলেস স্টিলের টিফিন বাক্সো। তার মানে বুঝলাম, ওই হল গোপাল। সবাই মেঝেতে গোগোলকে কেন্দ্রে রেখে মেঝেতে গোল হয়ে বসে পড়ল।
টিফিন বাক্সোটা চালান হয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।
রাত সাড়ে বারোটার দশমিনিট আগে হৃদয়বানের নাসিকার বজ্র নির্ঘোষ শোনা গেল। খাওয়া ভালই হয়েছে। গোপালের মায়ের হাতের তৈরি রুটি আর ইলিশ মাছ দিয়ে তৈরি একটা অনবদ্য ছ্যাঁচড়া সমেত রুটি খেলাম। হৃদয়বানের চাপে সামান্য ভাতও নিতে হল মালাইকারির জন্য। হৃদয়বান জিগ্যেস করেছিল, কেমন হয়েছে মালাইকারিটা। স্বাভাবিক ভাবেই জানিয়েছিলাম, দারুণ হয়েছে।
- উঁহু, ও ভাবে না, আর ক্রিটিকালি বলতে হবে। মানে, আর কী কী হলে আরও বেটার হতো বা এই এই কারণে একটু কমা হয়েছে। এইভাবে।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়েছি সাধ্বীর দিকে। সাধ্বী বলেছিল,
- কী জিনিষ নিয়ে ঘর করছি দেখছ তো ভাই? বলতেই হবে তোমাকে, বার করতেই হবে খুঁত।
- আরে খুঁত কেন? সমালোচনা। একটা সিনেমা দেখে এসে দেখ না একটা আলোচনা হয়। এই সিনটা আরেকটু এই রকম হলে বেটার হতো, সেই রকম।
পাশের ঘরে ঘুমচ্ছে সাগর। এগারটা নাগাদ এসেছে। সঙ্গে হাল্কা একটা সাইড ব্যাগ। ও খেয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। শোবার আগে জানতে চেয়েছিল,
- কাল কিসে যাওয়া হচ্ছে হাওড়া অবধি?
হৃদয়বান জানিয়েছে
- পাঁচটার ফার্স্ট বাসে। যেটা এইট বি থেকে ছাড়ে একদম হাওড়া। সরকারি, লে ল্যান্ড। গাঁক গাঁক করে নিয়ে যাবে। সকালে নো ট্রাফিক। তায় রোববার। বড় জোর চল্লিশ মিনিটে হাওড়া স্টেশন।
- আর জয় তুলসীদা অভিক? ওরা কী ভাবে আসছে হাওড়ায়?
- অভিক এইট বিতেই থাকবে। তুলসীদা আর জয় সোজা হাওড়া চলে যাবে। ঘড়ির নিচে মিট হবে সবার।
***
মাঝঘুমে গায়ে ঠ্যালা দিল কে যেন। ঘুম চোখে উঠে ঘড়িতে দেখি রাত সাড়ে তিনটে। গোপাল, গোগোলের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত। সে-ই ডেকেছে আমাকে। ডেকে যেন ভীষণ অপরাধ করেছে এমন একটা ভঙ্গি করে ফিসফিস করে বলল,
- রজতকাকা ওঠ। কাকিমা চা বসিয়ে দিয়েছে। মুখ ধুয়ে এসে চা খাও।
- উম্মম্- হৃদয়দা কোথায়?
- বাথরুমে। চা খেয়ে হাল্কা হতে গেছে।
আধো আলো, আধো অন্ধকারে, তীর্থ যাত্রীদের মতো আমরা, গোগোলের বন্ধুরা সমেত, মোট আট জন রাস্তায় পা দিতেই, কালীমন্দিরের চাতালে ঘুমন্ত কুকুরগুলো প্রবল বেগে গর্জে উঠল।
নবযাত্রী ক্লাবের পেছনে মাঠের ভেতর সারবাঁধা রিকশা। সেখান থেকে তিনটে রিকশা টেনে এনে আমাদের যাবতীয় লাগেজ চাপিয়ে রিকশা চালিয়ে চলে গেল গোগোলের বন্ধুরা।
আমাদের ভেতর কেবল একজন রিকশা চাপার অনুমতি পেল, সাধ্বীদি।
বাকিরা- ফল ইন্,কুইক মার্চ।
আমি না বলে পারলাম না,
- রিকশাওয়ালারা কোথায়?
- ওরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাল ওদের দুটো দিশি বোতল দেওয়া হয়েছে ভাড়ার বদলে। না চালিয়ে ওরা সরাসরি ভাড়া নিতে চাইল না। তাঁর বদলে চেয়ে নিল ক্লান্তিহারি গাঢ় ঘুম । চাবি দিয়েই রেখেছিল গতকাল। গোগোলের বন্ধুরা আমাদের মাল তুলে দিয়ে এসে ক্লাবের মাঠে রিকশাগুলো রেখে চেন দিয়ে তালা মেরে যার যার মাথার নিচে চাবি ঢুকিয়ে রেখে দেবে।
আমি কোনমতে বলতে পারলাম,
- এত কিছু আপনার মাথায় আসে কী করে?
আবছা আলো ভেদ করে স্পষ্ট হচ্ছে এইট বি বাসস্ট্যান্ড। লাল রং চটা বৃদ্ধ সরকারি বাসগুলো দাঁড়িয়ে। চারপাশে জনমনিষ্যি নেই। প্রথম বাসটার ড্রাইভার কেবিনের জানলার ভেতরে একটা রংচটা সাদা টিনের পাত হেলান। তাতে কালো কালিতে লেখা 'হাওড়া'।
গোগোল এবং তার বন্ধুরা আমাদের লাগেজ বাসের ভেতর সিটের তলায় ভাল করে রেখে দিয়ে নেমে গেল। গোগোল একবার ইশারায় আমাকে ডাকল। ফিসফিস করে বলল,
- কাগাকে একটু সামলে রেখ। ফিরে এসে আমাকে সব বলবে। যা যা কাগা করবে সব। যা কাণ্ডজ্ঞান কাগার, বুঝতেই তো পারলে।
হাত নেড়ে টা টা করে ফিরে গেল গোগোলের দলটা।
হৃদয়বানের এত বন্ধু থাকতে আমাকেই বা কেন এই দায়িত্ব দিল গোগোল বুঝলাম না। তবে বুঝলাম, ফিরে এসে ও আমাকে ছাড়বে না। সব শুনবে।
টিকিট ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছিপছিপে চেহারার একজন যুবক এগিয়ে এল। আমাদের দেখেই বলল-
- গুড মর্নিং।
- অভিক বসু। ফটোগ্রাফার। ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। আমাদের সহযাত্রী। ওরই মামাবাবুর কাছে আমরা যাব।
বলেই হৃদয়বান লাফ দিয়ে উঠে পড়ল বাসটায়।
পেছনে পেছনে উঠলাম আমরা। সাধ্বী উঠতেই হৃদয়বান হাত বাড়িয়ে ডান হাতের লম্বা লেডিজ টানা সিট দেখিয়ে বললেন,
- বস বস, এইখানে গেট চেপে বস। নামতে সুবিধা হবে।
আমরা যে যার মত বসতে যেতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন। বললেন,
- দাঁড়াও দাঁড়াও। হুটহাট করে বোকার মতো আগেই যেখানে সেখানে বসে পড় না যেন। সরকারি বাসের অনেক ফ্যাকড়া আছে। চেক করে নাও, কোন সিটের গদি বসা, বা উঁচু। ছেঁড়া ছত্রকার কোনগুলো। সেগুলোর ভেতর ছারপোকার কলোনি আছে। উঁচু নিচু সিটে বসলে দুম্বায় ব্যাথা হবে। বেড়ানো হবে মাটি।
নিজেই সবকটা সিট চেক করে করে কে কোথায় বসবে ঠিক করতে লাগলেন হৃদয়বান মিত্র। বাসে আর কোন জনপ্রাণী নেই। কাজেই আমাদেরই একছত্র রাজত্ব।
- চেক কর, চেক কর। জানলাগুলো ভাল করে চেক কর। ভাদ্র মাসের বৃষ্টিতে ভিজলে চিকুনগুনিয়া নির্ঘাত।
আমাদের তিনজনের কপালে তিনটে জানলার একটারও কপাট নামল না। বাকি জানলাগুলো সচল। কিন্তু আমরা তিনজন যদি ঐ তিনটে জানলা ছেড়ে দিয়ে অন্য সিটে চলে যাই তাহলে আবার ছেঁড়া বা তোবড়ান গদি ভাগে পড়ে।
তবু আমরা তিনজন জানলার ধারই বেছে নিলাম। হৃদয়বান সবচেয়ে নিখুঁত গদি এবং জানলা একটা পেল বটে কিন্তু বসবার পর আবিষ্কার করলেন জানলার ফ্রেমের নিচের অংশে সামান্য ডালভাতের কুচো হাল্কা করে লেগে আছে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন হৃদয়বান।
চল চল, নাম সবাই। সাধ্বী, তুমি নাম সবার আগে। কুইক। আমরা নেমে যেতেই কালো ধোঁয়া ছেড়ে রওনা দিল বাসটা।
- ট্যাক্সি, এই ট্যাক্সি।
হাঁক পারলেন হৃদয়বান মিত্র।
***
হাওড়া স্টেশনে দেখি ইতিমধ্যে তুলসীদা আর জয় এসে পড়েছেন। অভিক আর সাগর পাতলা ছিপছিপে, মেদহীন। তুলসীদা সেই তুলনায় লম্বা এবং বেশ রোগা। তুলসীপাতার মতোই হাল্কা পাতলা চেহারা। রেলে আছেন। আমাদের টিমের সবচেয়ে বয়স্ক অভিযাত্রী। জয় একটা স্কুলে পড়ায়। এইসব তথ্যের আদানপ্রদান হৃদয়বান প্রথমেই সেরে ফেললেন।
সঙ্গে যোগ করলেন,
- জয় অসম্ভব ভাল গান গাইতে পারে। ওর গলায়, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ শুনলে তোমার মনে হবে ভর দুপুরে বাইরে কাঠফাটা রোদ থাকলেও আসলে মেঘ করে এসেছে নিশ্চিত।
জয়ে চেহারার ভেতর সত্যি একটা শিল্পী ভাব প্রবল। সুঠাম চেহারায় পাজামা পাঞ্জাবি আর চাপ দাড়ি, ঘাড়ের কাছে লুটিয়ে পড়া চুল, ওকে সব মিলিয়ে একজন অভিনেতার মতো লাগছিল।
খুব লাজুক ভঙ্গিতে জয় বলল,
- এই সব হৃদয়-দৌর্বল্যের বাহুল্য মাত্র।
ট্রেনে ওঠার পর মালপত্র সাজানোর সময় একবার হাত ফস্কে হৃদয়বানের সুটকেসখানা মেঝেতে পড়ো পড়ো হয়ে গেল। সাধ্বীদি চেঁচিয়ে উঠলেন,
- সাবধান হৃদয়বান, সাবধান। আমি তক্ষুনি বলেছিলাম এই সুটকেস নিও না। সেই জেদ করে নিলে।
হৃদয়বান দার্শনিকের হাসি হেসে বললেন,
- আমার কাজের ভুল ধরবার মতো ক্ষমতা ইউনিটে কারও নেই বৎসে। তুমি নিশ্চিন্তে খেয়ে নিয়ে একটু টিফিন-ঘুম দিয়ে নাও।
***
ঝাড়গ্রাম স্টেশনে তেল চুকচুকে ভুঁড়ি ফতুয়ার একটু বাইরে বার করে একজন বছর পঞ্চাশের ধূর্ত চেহারার লোক আমাদের পথ আটকাল। হাত দুটো তার বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গিতে তোলা।
- নমোস্কার, আমি বংশী। বংশী প্রতিহারী। মামাবাবু আমাকে পাঠালেন। আপনারা গাড়িতে উঠে পড়েন জলদি জলদি।
ঝাড়গ্রাম স্টেশনটি ভারি মায়াময়। হাওড়া বা শেয়ালদার মতো কুৎসিত ভিড় নেই। নেই চিৎকার, চেঁচামেচি। নেই মাইকের দুর্বোধ্য ঘোষণা। নেই গায়ে গা লেগে যাওয়ার অস্বস্তি। বরং চারিদিকে দীর্ঘ শাল সেগুনের সমান্তরাল কাণ্ড। প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বেশ একটা প্রাতঃভ্রমণ ভাব মনে এল।
আমরা উঠে পড়লাম বাইরের অপেক্ষমান একটা জোংগা জিপের পেটের ভেতর। বসলাম সবাই মিলে বেশ চাপাচাপি করে। মাল তুলল বংশী প্রতিহারী। ছাদ ভরে গেল ব্যাগে ব্যাগে। তারপর মোটা নাইলন দড়ি দিয়ে সবকটা ব্যাগকে বাঁধা হল। গোটা লাগেজ পর্ব সুপারভাইজ করল হৃদয়বান মিত্র।
ঘড়ি মেলাইনি তবে মনে হল আধঘণ্টার পথ। ঝাড়গ্রামের যেটুকু শহুরে অংশ সেটুকু ফুরিয়ে গেল নিমেষে। রইল দুপাশে উঁচুনিচু টাঁড়। শালের সারির ফাঁক দিয়ে হঠাত ঢালু হয়ে পিছলে নেমে যাওয়া সোনালি সবুজ ধানক্ষেত। চালাঘরের টোপর পরা সাদা দেওয়ালের বাড়িগুলোর সর্বাঙ্গে চিত্র বিচিত্র আলপনা আঁকা।
দরজায়, উঠোনে, সারল্যমাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে বসে কাজে অকাজে ব্যস্ত রয়েছে মিশকালো বর্ণের এক জনজাতি। যাদের পোশাকে, চেহারায়, বচনে এখনও লেগে থাকা মাটির গন্ধ। মাঝে মাঝে দু একটা হাফপ্যান্ট, দু একটা রঙিন গেঞ্জি, দু একটা মাথায় ক্যাপ পড়া যুবক। বাকিরা এখনও ট্র্যাডিশনাল।
সহসা বাঁক নিল জোঙ্গা জিপ। থামল একটা নির্মীয়মান বাড়ির সামনে। কিছুটা প্লাস্টার হয়েছে। দোতলা বাড়িটা ঢুকলেই বোঝা যায় স্কুলবাড়ি হবে। সামনে দক্ষিণমুখো টানা বারান্দা। পাশাপাশি তিন চারটে ঘর। সব ঘর থেকে ওই বারান্দায় যাওয়া যায়। আবার ঘরগুলোর ভেতর দিয়ে এমন ভাবে দরজা বসান, যে সব ঘর থেকে বারান্দায় পা না দিয়েও সব ঘরে চলে যাওয়া যায়।
সব ঘরের ভেতরেই হাই এবং লো বেঞ্চ। এখন একদিকে জড়ো করে রাখা।
ঘরের একটা করে দেওয়াল, মূলত দক্ষিণেরগুলো ব্ল্যাকবোর্ড হবে বলে আয়তাকার একটা ফ্রেম করে রাখা আছে। উলটো দিকের উত্তরের দেওয়ালে দুটি করে জানলা।
একটা হবু ক্লাসরুমের ভেতরে আমাদের সব লাগেজ এনে তুলে দিল প্রতিহারী। বারান্দার পশ্চিম মাথায় টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে গিয়ে এক এক করে ফ্রেশ হলাম আমরা।
তুলসীদা তার শীর্ণ শরীর নিয়ে দুটো লো বেঞ্চ জুড়ে নিয়ে একটু স্ট্রেট হলেন। টানটান করে পা ছড়িয়ে বললেন,
- অরে তরাও একটু বিশ্রাম কইরা ল।
বলেই শবাসনে একদম নিশ্চল হয়ে গেলেন। একে একে স্নান পর্বে ঢুকে পড়লাম আমরা।
প্রতিহারী এসে জানাল খাবার রেডি।
একতলার বারান্দায় টেবিল পাতা হয়ে গেছে। ডেকরেটরের ভাঁজ করা স্ট্যান্ডের ওপর কাঠের তক্তা পাতা টেবিল। কাগজের রোলের বদলে সানমাইকায় বাঁধান। পেছনে নড়বড়ে কাঠের চেয়ার। শালপাতার থালায় লেবু, নুন আর লঙ্কা সাজান। পাশে জলের ভাঁড়। থালায় ফুটো আছে বলে ডবল করে পাতা দেওয়া। তবুও হৃদয়বান আর দুটি পাতা চেয়ে নিয়ে মোট চারপাতার একটা গদিমতো বানিয়ে নিলেন।
যে কর্মঠ মানুষটি ভাত দিতে শুরু করেছিল সে হৃদয়বানের থালার কাছে আসতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন একটা,
- ওহে ভায়া, আজকের মেনু কী?
- শুক্তো, আলুভাজা, ডাল, ছ্যাঁচড়া, রুই মাছের ঝোল, মুরগি কষা, টকদই, দরবেশ। এই হল গে আজকের, কী যেন বলে, মানু।
- শুনেছ সবাই? এইবার কে কত পারসেন্ট কী দিয়ে বোঝাই করবে তার তার ব্যাপার। আর হ্যাঁ ভাই, শোন। মানু নয় ওটা মেন্যু।
দেরি না করে হৃদয়বান ঝাঁপিয়ে পড়ল শালপাতার ওপর।
দীর্ঘ গ্রীষ্মের গোটা দুপুরটা কাটল হ্রস্ব ও দীর্ঘ নানা রকম নাসিকা গর্জনের সিম্ফনি শুনে। ঘুম এল না। একটা চাপা কৌতুহল এবং উত্তেজনা কাজ করছিল ভেতর ভেতর। বিকেলের চায়ের আসরে আমাদের সঙ্গে প্রথমবার মিলিত হবেন অভিকের ইজ্রায়েলি 'মামাবাবু'।
সাড়ে পাঁচটা নাগাদ প্রতিহারীর ডাক এল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ছাদে উঠলাম। প্লাস্টিকের টেবিল চেয়ার সেখানে সুবিন্যস্ত। চেয়ার দেখে হৃদয়বানের মনে সন্দেহ হল, তার ও সাধ্বীর শরীরের ভার এই সব ফঙ্গবেনে চেয়ার আদৌ বহন করতে পারবে কি না।
সে ভাল করে তুলে, চাপ দিয়ে, হাল্কা করে বসে, তারপর পুরো শরীরের ভার পুরো ধীরে ধীরে ছেড়ে অবশেষে গা এলিয়ে বসল। পরম যত্নে একটি বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিল মৃদুমন্দ পুবালি বাতাসের অনুকূলে।
ঠিক পৌনে ছ'টায় মামাবাবু প্রবেশ করলেন। পরনে সাদা কলার দেওয়া কালো স্পোর্টস টি-শার্ট। সাদা হাফপ্যান্ট, একটু বেশি ঝুলের। পায়ে সাদা মোজা আর কালো কেডস। মাথায় ধবধবে সাদা, ছোট করে ছাঁটা চুল। গায়ের রঙটি মিশকালো। মামাবাবুকে একটা চলমান সাদা কালো ছবি বললেও কোন ভুল হবে না। সাদা ভুরু আর কালো রং করা গোঁফ যেন সেই ছবির ওপর করা শিল্পীর সই।
স্বাস্থ্যের দিক থেকে বিচার করলে এই ধরণের চেহারাকে বলা যায়, 'বুলেটের মতো শরীর'। হাত পা নাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে টি শার্ট ভেদ করে হাতের কাঁধের গুলির নড়াচড়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মাঝারি হাইটের টাইট শরীরের ধারে কাছে কোনদিন কোন অসুখ বিসুখ আসতে পেরেছে বলে মনে হল না।
- অভিক, এরা তাহলে তোমার বন্ধু? গুড।
- হ্যাঁ মামাবাবু।
- আচ্ছা আচ্ছা, হৃদয়বানবাবু কোন জন? তিনি এসেছেন তো?
- এইযে আমি।
বলার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়বান অনেকটা স্কুল লাইফের ' উপস্থিত' বলার মতো করে হাত তুললে।
- আচ্ছা আচ্ছা। নমস্কার সবাইকে। তোমরা সবাই যখন অভিকের বন্ধু তখন তোমাদের তুমি করেই বলছি।
বলেই একবার তুলসীদার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালেন। তুলসীদা সঙ্গে সঙ্গে কেসটা বুঝে নিয়ে বলে উঠলেন,
- না না চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনি আমাকেও তুমি করে বলতে পারেন। আমি আপনার চেয়ে খুব বেশি হলে বছর দশেকের বড়।
তুলসীদা চুলে রং করেন না। খুব সাদাসিধা পোশাকে বিশ্বাসী। রেলের বড় অফিসার কিন্তু নিরহঙ্কারী মানুষ। কিছুদিন পর রিটায়ার করবেন। মামাবাবুকে স্বচ্ছন্দ করে দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন না।
- অভিক, তুই কিছু বলেছিস নাকি এনাদের?
- না মামা। আমি কিছুই বলিনি। সবাই তোমার মুখ থেকেই শুনুক।
- বেশ তাহলে শোন হৃদয়বান এবং তার বন্ধুরা । আমি চিরকালই চাষবাস নিয়ে পড়ে থাকা মানুষ। লোকে আমাকে কৃষি বিজ্ঞানী বলেই জানে। কারণ আমার নামের পাশে একটা বিদেশের ইউনিভার্সিটির ছাপ আছে। আসলে কিন্তু আমি একজন চাষি।
ছোট থেকেই চাষ করতে ভাল লাগত আমার। বেশ মনে আছে, আমার বয়স তখন বছর দশেক হবে জোর । উত্তর কলকাতার বারো ভাড়াটের এক ঘুপচি ঘরে থাকি।
দক্ষিণের একমাত্র জানলা দিয়ে কয়েকঘণ্টার জন্য রোদ আসে। তারপর ওপাশের বাড়ির আড়ালে চলে যায়। সেই জানলার ধাপে কুড়িয়ে আনা চায়ের ভাঁড়ে কিছু মাটি ফেলে একটা ধানের দানা গুঁজে দিয়ে একটু করে জল ঢালতাম। একদিন অবাক হয়ে দেখলাম মাটি ফুঁড়ে ধানগাছ গজিয়েছে।
আমাকে এবং বাড়ির সবাইকে অবাক করে সেই গাছ তরতর করে বড় হল এবং একদিন তাতে এক গোছা ধানের শীষ বার হল। সেই প্রথম আমি চাষবাসের ক্ষমতা টের পাই। আমার মনে হল, একটি মাত্র ধানের দানা, লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে লুকিয়ে তুলে এনে, একটি মাত্র ভাঁড়ে বসিয়ে যদি একগাছ ধান পাওয়া যায়, তাহলে একটা গোটা মাঠ পেলে না জানি কী করে ফেলব আমি।
বলা ভাল, সময়টা ছিল, খাদ্য আন্দোলনের। ভুট্টা মাইলো এইসব খেয়ে দিন কাটছিল আমাদের। একমুঠো চালের দাবিতে মানুষ রাস্তায় গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে।
- বাপরে, আপনি তখনই এইসব ভাবছেন?
- আরও আছে। ইউনিভারসিটিতে এসে অনেক কিছু শিখলাম, জানলাম। নানা রকম কেমিকেল ফার্টিলাইজার, পেস্টিসাইডের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। একবার একটা পাকা কলার গাছ লাগালাম ক্যাম্পাসের মাঝখানে। নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা কায়দা কানুন চালালাম তার ওপরে। আলটিমেটলি দেখা গেল গাছটার সর্বাঙ্গ দিয়ে কলা গজিয়েছে। সেই শুরু হল হাইব্রিড কলার চাষ। সে কী উত্তেজনা, সে কী উন্মাদনা। বাইরে থেকে কিছু কৃষিবিজ্ঞানী এসেছিলেন ক্যাম্পাসে। তারা আমার নাম ধাম লিখে নিয়ে গেলেন। কোর্স শেষ হতেই ইজরায়েল থেকে ডাক এল। সেই প্রথম আমার বিদেশ ভ্রমণ।
চা এল, সঙ্গে এল ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কিট। চুমুক দিয়ে মামাবাবু শুরু করলেন,
- নানা দেশ ঘুরে আবার এলাম ইজরায়েলে। তাজ্জব বনে গেলেম এবার এসে। গাছের গায়ে ওরা তরমুজ ফলিয়েছে, ঝুলন্ত সব তরমুজ। একটাও মাটিতে ঠেকে নেই। সবাই আকাশে ঝুলছে। কী তার টেস্ট ! কী তার সাইজ!
- বলেন কী? ঝুলন্ত তরমুজ?
হৃদয়বানের চায়ে বিষম লাগল না বিস্কুটে বোঝা গেল না।
- হ্যাঁরে ভাই। তবে আর বলছি কী? আর বেগুন? সেও কী সাইজ। একটা কিনলে বাড়ি সুদ্ধ খেয়ে শেষ করতে পারবে না। গাঢ় হলুদ রঙের বেগুন। সে-ও ঝুলছে। কিন্তু শেপ অনেকটা ঢোলকের মতো। ভাইরে কী বলব। এইসব দেখে আমার চোখ তো ছানাবড়া। দশ হাজার একরের মরুভূমিতে দেড় লাখ টন সবজি ফলিয়ে ফেলছে ওরা। রপ্তানি করছে আমেরিকা, রাশিয়া আরও ইউরোপের নানা দেশে।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের বিরতি। তারপর বললেন,
- দেশে ফিরে আমি কোথাও দশ বিঘে জমি পেলাম না। মানতেই চায় না গভর্মেন্ট আমার কথা। বোরোধান ছাড়া আরও কোন চাষের ঝুঁকি নেবেই না কেউ। যাই হোক, অনেক কষ্টে এই প্রতিহারীর মাধ্যমে এইখানে, জারালআটায় পনের একরের জমিটা লিজ পেলাম। একেবারেই অনাবাদী, ল্যাটেরাইট মাটি বোঝাই, চাষিরা অর্ধাহারে, অনাহারে। বৃষ্টি হলে তবে একফালি ধান হত। না হলে মাঝপথে শুকিয়ে জ্বলে যেত। ওরাও বাঁচল ধার কর্জের হাত ঠেকে। আমিও বাঁচলাম আমার এতদিনের স্বপ্ন সফল করতে পেরে। কিন্তু...
- কেন ? কিন্তু কেন আবার?
হৃদয়বান অধৈর্য।
- মানুষ এতো শয়তান !
- সে তো সবাই জানে। এখানে কী ধরণের শয়তানি করল?
- চুরি করতে শুরু করল। সমানে চুরি। বিঘেকে বিঘে তরমুজ কিছুদিনের মধ্যে হাওয়া। একদম ম্যাচিওরড অবস্থায় লোপাট। ভেবে রেখেছি কাল পরশু হয়ত একটা এলাকায় তরমুজ তুলব, সকালে এসে দেখি হাওয়া।
- তার মানে রাতেই মাল সরাচ্ছে।
যেন বিশাল একটা ক্লু পেল হৃদয়বান।
- হ্যাঁ রাতেই। এক রাতে অত মাল সরাতে হলে রীতিমত একটা বাহিনী দরকার। দু একজনের কাজ না। কারা আসছে, কোথা থেকে আসছে, কে জানে?
- জমির পুরোন মালিকরা কিছু করছে না তো?
ভুরু কুঁচকে হৃদয়বানের প্রশ্ন।
- না না। তাদের প্রায় সকলেই এই ফার্মের কর্মচারী। নিয়মিত মাইনে পায়। পুজোয় বোনাস দি। ওরা তো চোর ধরবে বলে রাতে পাহারা দিল খুব কদিন। যদিও প্রতিহারীর ধারণা, ওরা পাহারা দেওয়ার নাম করে চুরি করে এবং তারপর সারারাত মহুয়া খেয়ে ঘুমোয়। পরদিন পাহারা দেওয়ার মজুরিটাও নিয়ে নেয়। আমার আবার এই বয়সে রাতজাগা বারণ। নইলে একবার নিজেই নেমে পড়তাম।
- আশ্চর্য!
- আশ্চর্য তো বটেই , আর সেই কারণেই তো আপনাকে ডাকা।
ডাকা? হৃদয়বানকে? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। সাগরের দিকে তাকালাম। সাগর ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল।
হৃদয়বানের মুখে সলজ্জ গৌরবের ছায়া। মুখে বিনয়ের হাসি। বলল,
- না না, এখনি কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সরেজমিনে দেখা দরকার সব কিছু।
- নিশ্চয়ই। কাল ভোরে সব দেখাব। আমি রোজ সূর্য উঠবার সঙ্গে সঙ্গে ফার্মে ঢুকি। তুমি, মানে, তোমরা সকলেই আমার সঙ্গে তখন যাবে। কার চোখে কী পড়ে বলা যায় না তো।
একটু থেমে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন,
- কারও কোন কষ্ট বা অসুবিধা হচ্ছে না তো এইখানে থাকতে? কলকাতার মানুষ তোমরা, আলো নেই পাখা নেই, জলের কষ্ট। তবে সারাদিন হুহু হাওয়া, এই যা।
- না না মামাবাবু, আমরা ভীষণ এনজয় করছি।
সাধ্বীদি প্রায় হাউমাউ করে জানাল।
- সন্ধের টিফিন কী আছে রে?
ফিসফিস করে কানে কানে অভিককে প্রশ্ন করল হৃদয়বান। অভিক ইশারায় ডাকল প্রতিহারীকে। দুজনের ভেতর কানে মুখে কিছু কথা হল। মিলিয়ে গেল প্রতিহারী সিঁড়ির বাঁকে।
সবাই এখন সম্মিলিত হয়েছি ছাদের ওপর। টেবিল চেয়ার মুছে গেছে রঙ্গমঞ্চ থেকে। মাদুর পেতে গোল হয়ে বসে সবাই। মাঝখানে ধামায় মুড়ি। জল ছিটিয়ে আলুর চপ ভেঙে আচ্ছা করে চটকান হয়েছে মুড়ির সঙ্গে। হৃদয়বান জল দিতে আপত্তি করেছিল। বলেছিল, মুড়িতে জল দিলে মুড়ি আত্মহত্যা করে। কেউ শোনেনি। বাকিরা বলেছিল, রোমে এসেছ, রোমান হও।
কাঁচা লঙ্কাগুলো বল্লমের মতো বিঁধে আছে ভিজে মুড়ির স্তুপে। ভাজা বাদাম ছিটান হল, ছিটান হল ধনে পাতার কুচো। আচারের তেলের গন্ধে ভুরভুর করে উঠল এলাকা। আমাদের হাত কেবল উঠতে লাগল আর নামতে লাগল। চারিদিকে ঘসঘস করে মুড়ি চিবানোর শব্দ। হৃদয়বানের দু চোখ বন্ধ। গরুর চোয়ালের মতো জাবর কাটার ভঙ্গিতে চিবুচ্ছে। সর্বাঙ্গে ব্রহ্মানন্দের ছাপ।
সাধ্বীদি মুড়ি ছুঁড়ে দিচ্ছে মুখে। কিছু মুড়ি চলকে পড়ে যাচ্ছে। হাতের চেটোয় সেগুলো লুফে নিয়ে আবার চালান করে দিচ্ছে মুখ-গহ্বরে। অভিক আমি সাগর তুলসীদা আর জয় নীরবে খেয়ে চলেছি আর মাঝে মাঝে মুড়ি চেবানোর শব্দ কী ভাবে নীরবতাকে খান খান করে ফেলছে তাই শুনছি।
হঠাৎ হৃদয়বান গালের একপাশে মুড়িগুলোকে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
- সন্দেহর তালিকায় প্রথম যে নাম উঠে আসে সেটা কার বলত?
- কার?
আমি বললাম।
- প্রতিহারী।
- বলুন বাবু, আপনাদের আর মুড়ি লাগবে?
আমরা সবাই চমকে উঠলাম। আঁতকে উঠলাম বলাই ভাল। কেউ টেরই পাইনি কখন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতিহারী।
হৃদয়বান এতটুকু ঘাবড়াল না। সস্নেহে ডাকল প্রতিহারীকে।
- আরে প্রতিহারী, এস এস, সামনে এস।
- হাঁ বলেন।
- বোসো। এইখানটায় একটু বস দেখি।
- হাঁ বলেন।
- একটু আগে আমি কী বললাম বল দেখি?
- আজ্ঞা বললেন, সন্দের তালিকায় প্রথম নাকি আমি।
- হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। সন্দেহ মানে জান?
- জানি বাবু।
- আর তালিকা মানে?
- জানি।
- তালিকা মানে কী বল দেখি।
- লিস্টি।
- গুড, ভেরি গুড ।
প্রতিহারীর পিঠে একখানা চাপড় মেরে বলল হৃদয়বান,
- শাবাশ, কী ব্রেইন দেখেছিস? এ যে বিদ্যাসাগর।
প্রতিহারীর মুখের রেখা স্থির। কেবল লন্ঠনের আলো পাথুরে মুখের রেখায় রেখায় নেচে বেড়াচ্ছে। হঠাত কেমন শীত শীত করে উঠল আমার ভেতরটা।
- তা বাবা, প্রতিহারী, তোমার নামটা কী যেন বলেছিলে তখন?
- বংশী।
- হ্যাঁ হ্যাঁ বংশী। তা বাবা বংশী, এই তরমুজ চুরি কাদের কাজ বলে তোমার মনে হয়?
- কার আবার, সাঁওতালদের।
- সাঁওতালদের? কোন সাঁওতাল? কোথায় থাকে তারা?
- ঐ যে, ডুলুং নদীর পার ঘেঁসে ওদের গেরাম। সবকটা মদ্দ সারাদিন নেশা করে পড়ে থাকে আর রাতে চুরি করতে বার হয়।
- কেন চুরি করে ওরা? অভাবে?
- না না, দিকুদের ওপর ওদের চিরকালের রাগ।
- দিকুটা আবার কী?
- যারা সাঁওতাল নয় তারা সবাই দিকু। আমরা যারা মেদিনীপুর থেকে এইখানে এইচি তারা সবাই দিকু।
- আমরা যারা কলকাতার লোক তারাও দিকু?
- সব সব। সাঁওতাল না হলেই আপনি দিকু।
- তা ওদের এই চুরি চামারি বন্ধ করা যায় না?
- কেমন করে ঠেকাবেন?
- কেন? রাতে পাহারা দিয়ে।
- খেপিচেন? রাতে কোথা থেকে বিষতির মারবে তার ঠিক আছে নাকি?
- বিষতির?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, লাগার দশ মিনিটের ভেতর জান শেষ। হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার টাইম দেবেনি।
- বলো কী হে?
পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে রুমাল বার করে মুখ মুছল হৃদয়বান। থুপে নিল গাল গলা।
- কাউকে মেরেছে নাকি এখানে এর আগে?
- কত-অ মেরেছে। কেউ হিসেব রেখেছে নাকি।
- কেন মেরেছে? কেন?
- ওদের রাগ সাঙ্ঘাতিক। চাঁড়ালের রাগ। এমনিতে খুব সাদাসিধে। কিন্তু রেগে গেলে হাঁসুয়ার কোপ দিতে এক সেকেন লাগবেনি।
বিন বিন করে ঘাম ফুটে উঠল আমাদের সবারই কপালে।
একটু চুপ করে থেকে প্রতিহারী বলল,
- আসি গে। রাতের খাবার এডি করতে হবেনি? আমি ছাড়া তো আর কেউ এই কাজ পারবেনি।
প্রতিহারী মিলিয়ে গেলে সাধ্বীদি চাপা গলায় ধমকে উঠল,
- কাল ফার্স্ট ট্রেনে সবাই ফিরে চল কলকাতায়। প্যাক আপ। অনেক হয়েছে হৃদয়বান। তুমি আর যাই হও, ব্যোমকেশ তো নও। একটা ভোঁতা ছুরিও নেই তোমার কোমরে।
***
রাতে কচি পাঁঠার মাংসটা তেমন উপভোগ করতে পারল না হৃদয়বান। খাবার নাড়াচাড়া দেখেই বোঝা গেল ওর খিদে মরে গেছে। বাকিরা কেউই তত নিশ্চিত নয় কাল আদৌ ফেরা হবে কি না। সাধ্বীদি কিন্তু একটু চেপেই খেল।
ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রতিহারী এসে দরজায় ঘা দিল। ঘুম চোখে দরজা খুলে দিল জয়। প্রতিহারী জানাল, সাহেব এডি হয়ে চা নিয়ে বসে আছেন।
চা আর ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট শেষ করে আমরা ফার্মে ঢুকলাম।
খুবই নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ফার্মটি সাজান। ব্লক ভাগ করে করে চাষআবাদ করা আছে। তরমুজ বেগুন আরও নানা ধরণের সব্জির আলাদা আলাদা আয়তক্ষেত্র। চারপাশে আল দিয়ে সযত্নে ঘেরা। আলের ওপর দিয়ে আরামসে হাঁটা যায়। আমাদের দেশের ধানক্ষেতের মতো আল থেকে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার কোন চান্স নেই।
প্রধান আল ছাড়া আরও অনেক উপ-আলপথ তৈরি আছে। সেগুলো অপেক্ষাকৃত সরু।
সবার আগে চলেছে প্রতিহারী, তারপর মামাবাবু, তারপর হৃদয়বান, জয়, আমি, অভিক, তুলসীদা। সাধ্বীদি আসেনি। বলেছে, এইসব বিষতিরের খাদ্য হওয়ার ভেতরে সে নেই আর।
মামাবাবু একটা তরমুজের জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেখানে মাটিতে মাচায়, নানা ভঙ্গিতে তরমুজ ঝুলছে বা শুয়ে বসে আছে। গলা ঝেড়ে নিয়ে মামাবাবু বললেন,
- এই যে তরমুজ তোমরা দেখছ, এগুলোর আদি বাড়ি সাদার্ন আফ্রিকার কালাহারি ডেজার্ট। এরা খুব অল্প জল খেয়ে এবং ভীষণ গরমে আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কারণ হল এরা অক্সিজেনের ব্যবহারটাকে কন্ট্রোল করতে পারে। স্টোমাটা বন্ধ করে দিয়ে পাতার ভেতর জল ধরে রাখতে পারে। ফলে বাস্পীভবন খুব কম রেটে হয়। সাইটরুলাইন নামে একটা এমাইনো এসিড এদের পাতায় থাকে যেটা এই জল ধরে রাখার কাজকে সাহায্য করে। জানতো, জল বেশি বার হয়ে গেলে মানুষের চামড়া খসখসে হয়ে যায়? বয়েস বেশী দেখায়?
বুশম্যান উপজাতির মানুষেরা চামড়া ভাল রাখার জন্য এই তরমুজের রস গায়ে মাখে। জাপানি বিজ্ঞানীরাও এই তরমুজের রসকে হেলথ ড্রিঙ্ক বানিয়ে আর কসমেটীক্সে ভরে ব্যবহার করবার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
সস্নেহে হাত বাড়িয়ে একটা পৌনে দু কিলো ওজনের তরমুজের গায়ে পরম মমতায় হাত বোলাতে লাগলেন মামাবাবু।
হৃদয়বান দু বার তরমুজের ক্ষেত থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ফার্ম হাউসের দুরত্ব বুঝবার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
- আচ্ছা, মামাবাবু। আপনার খামারবাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে এই ক্ষেতের শেষ প্রান্তের দুরত্ব কতটা হবে? বড়জোর দেড়শ মিটার?
- তা, প্রায় দুশ মিটার হবে। তাতে কী?
- আপনার বাইনোকুলার আছে?
- না তো।
- তাহলে একটা আনিয়ে নিন।
- কী হবে বাইনো দিয়ে? চুরি তো হচ্ছে রাত্তির বেলা।
- হ্যাঁ, কিন্তু চুরির রেটটা বুঝবার জন্য রোজ এইভাবে আসবার দরকার হবে না আর। বারন্দা থেকেই টের পাবেন, কটা চুরি হল। আই মিন রেট অফ থেপ্ট পার নাইট। সেখানে থেকে কজন আসছে চুরি করতে, একটা এ্যাসেস তো করা যাবে।
মামাবাবুর চোখে গভীর সন্দেহর দৃষ্টি ফুটে উঠল। আমারও মনে হল, হৃদয়বান কী লোক হাসাবে? মামাবাবু ঈষৎ গম্ভীর স্বরে বললেন,
- অভিক, লাঞ্চের পর তুই একবার আমার সঙ্গে দেখা করিস তো। একদম একা।
তারপরেই সুর পালটে বলে উঠলেন,
- হ্যাঁ, হৃদয়বান। তোমার ভাবনাটা ফেলে দেবার মতো নয়। ঠিক আছে, কাল বিকেলের ভেতর তুমি বাইনোকুলার পেয়ে যাবে। খুবই পাওয়ারফুল। ইজ্রায়েল আর্মির কাছে তো নাইট ভিশন চলে এসেছে। কিন্তু ওপেন মার্কেটে পাওয়া যায় না। পেলে খুব উপকার হত। দেখছি কদ্দুর কী করতে পারি।
লাঞ্চের পর অভিক গেল মামাবাবুর কাছে। সাদামাটা মাছের ঝোলভাত খেয়ে হৃদয়বানের মেজাজ চটকে গেছে। এ যেন জামাই বিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া হল।
আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম বিকেলে একটু জারালআটা গ্রামটার আশপাশ ঘুরে দেখা হবে।
কাছেই নাকি ডুলুং নদী। হাঁটা পথ। সাধ্বীদি, যে রিকশা ছাড়া কলকাতা শহরে বাড়ির বাইরে পা দেয় না, সে-ও হাঁটবে।
বেলা তিনটে নাগাদ আমরা রওনা দিলাম। অভিক জানাল মামাবাবু হৃদয়বানের দূরদৃষ্টির পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে বাইনোকুলার আনানোর জন্য লোক পাঠিয়েছেন কলকাতায়। তার ধারণা হৃদয়বানই পারবে এই তরমুজ চোরকে পাকড়াও করতে।
লালমাটির পথ পার হয়ে আমরা চলেছি। তেড়ে বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগেই। কাদার রং এখানে লাল। সার সার বাঁশ গাছ আর শালের জংগল আমাদের দু পাশ থেকে জল ঝরিয়ে যেন অভিবাদন জানাচ্ছে।
দুপাশে গ্রামীণ কুটির। কুঁড়েঘর যে এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। ঘরের দেওয়ালে নানা রকম ছবি। আলপনা। দরজার মাথায় ঝুলছে পাকা ধানের ছড়া। শান্ত, নয়নমনোহর এক একটা পাড়া। উঠোনে দড়িবোনা খাটিয়া পাতা। বয়স্করা বসে সেখানে। বাচ্চারা আশেপাশে খেলছে। খেলছে কুকুর ছানা, ছাগল ছানা, মুরগি ছানার সঙ্গে মানুষের ছানারা।
আমাদের দলটা দেখে দু একজন তাকাচ্ছে। এক যুবতি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিল করে হেসেই ফেলল,
- বাপরে বাপ। শহর ঠেকে কত্ত মুট্টা মুট্টা দিকুরা এসচে সব।
বাকিদের হাসির বাঁধ ভাঙল। হেসে গড়িয়ে পড়ল এ ওর গায়ে। আমরা দ্রুত পায়ে এই জায়গাটা পার হয়ে গেলাম।
সামনে উঁচু বাঁধের মতো একটা আড়াল। তার মাথায় উঠতেই যেন প্রকৃতি একটা পর্দা সরিয়ে নিল তার মুখের ওপর থেকে। সামনে একটা ঘোলা জলের খরস্রোতা নদী। হৃদয়বান বলল,
- ডুলুং।
বাঁধের ভেতরে থাকার ফলে ডুলুং এখানে ক্যানেলের আকার নিয়েছে। মাঝখানে একটা ব্রিজ। সেই ব্রিজের হাইট নদীর জল থেকে এক ইঞ্চি উঁচুতে মাত্র। ব্রিজের মাঝখান ঢালু। তলা দিয়ে শনশন করে ঘোলা জল ফেনা তুলে চলেছে।
- আমরা ব্রিজে এসে দাঁড়ালাম। একজন পথচারী পাশ দিয়ে যাবার সময় জানাল, ওই পারে না যাওয়াই ভাল, বৃষ্টি বেশি হলে বিরিজ ডুবে যাবে।
- ব্রিজ ডুবে যাবে? বলে কী?
হৃদয়বান জানাল, মালভূমি এলাকার নদীগুলোর বর্ষাকালের বৈশিষ্টই এইরকম। গরম কালে শুকনো। বর্ষায় আনপ্রেডিকটেবল।
তুলসীদা মনে হল একটু অ্যাডভেঞ্চারিস্ট। আসার পথে স্টেশন এলেই নেমে পড়ছিলেন। এদিক ওদিক দেখছিলেন। চা খাচ্ছিলেন এবং খাওয়াচ্ছিলেন। জল ভরছিলেন কল থেকে অকারণেই। এবং গাড়ি একটু রানিং হলে তবে দৌড়ে এসে উঠছিলেন। সাধ্বীদি দুবার বকতে বলেছিলেন,
- শরীরটারে সচল রাখতাছি। তবে বুঝলি, এক এক স্টেশনের চায়ের স্বাদ এক একরকম। ফালাকাটার চায়ে মাংসের গন্ধ আবার মহিষাদলের চায়ে পাইবা মোষের দুধের সোয়াদ।
এখানেও, হায়, কে জানত, ফেরার পথে, সেই চঞ্চল তুলসীদা, ব্রিজ থেকে নেমেই, ডূলুং-এর পারে এক সুন্দর বালি কাঁকর বেছান প্রাকৃতিক চাতাল দেখে, রাস্তা থেকে মারবেন এক লাফ?
ফস করে হাঁটু পর্যন্ত পা, প্যান্ট সমেত মুহূর্তে ডুবে গেল সেই বালি কাঁকরের চাতালে। তুলসীদা যেন বালির ওপর গেঁথে গেলেন। ওপর থেকে যে জায়গা দেখে তুলসীদা ভেবেছিলেন নদীর চর, আসলে সেটা একটা চোরাবালির আস্তরণ। সাধ্বীদি চিল চিৎকার দিল,
- সাগর শিগগির নাব। তুলসীদা ডুবে যাচ্ছে।
রেস্কিউ করতে প্রথম লাফ দিল দলের সব চেয়ে কম কথার শান্ত শিষ্ট মানুষটি, জয়। দিতেই তুলসীদার পাশে আরেকটা উইকেটের মতো সমান্তরাল ভাবে কাদায় গেঁথে গেল নিজেও।
সন্ধ্যা গাঢ়। চারিদিকে শুনশান। কোন মানুষ স্বেচ্ছায় না এলে ডাক দিয়ে কাউকে পাওয়া অসম্ভব। কী করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হবে কে জানে।
তুলসীদা জয়ের কাঁধে ভর দিয়ে আছে। চাপ দিলেই জয় আরও গেঁথে যাচ্ছে। আমরা নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। ওদের অন্তত ফুট তিনেক একটা দড়ি দরকার যাতে করে ব্রিজের সঙ্গে বেঁধে ওদের গায়ে ফেলে দিলে ওরা উঠে আসতে সক্ষম হবে।
হঠাত হৃদয়বানের মুখ হাসিতে ভরে উঠল। নিজের মাথায় একটা থাপ্পড় মেরে বলল,
- মূর্খ।
তারপর পাঞ্জাবি তুলে ফস করে খুলে ফেলল পাজামার গিঁট। ঢলঢলে পাজামা সড়াৎ করে নেমে গেল পায়ের দিয়ে। ভেতরের আন্ডারপ্যান্ট ঢাকা পড়ে গেল পাঞ্জাবির ঝুলের তলায়।
পাজামা তুলে একপা বাঁধল ব্রিজের রেলিঙএর গায়ে, আরেক পা ছুঁড়ে দিল ওদের দিকে। মোট সাড়ে তিন সাড়ে তিন - সাত ফুট লম্বা হল পা দুটো।
জয় খপ করে লুফে নিল পাজামার পা। তারপর, মারো টান, হেঁইও...
উঠে আসার পর ওরা দুজনে যখন জামা কাপড়ের কাদা ঝাড়তে ব্যস্ত, আর বাকিরা ওদের পরিষেবায় নিযুক্ত, তখনই পাজামা না পড়া অবস্থাতেই, হৃদয়বান আমার কাঁধে হাত রেখে ইশারা করলেন।
সবিস্ময়ে দেখলাম, যেখানে ওরা পড়ে গিয়েছিল সেখান থেকে অনেকটা বালি কাঁকর এখন নদীর জলে ধ্বসে স্রোতের টানে ভেসে চলে গেছে। সেই ধ্বসে যাওয়া জায়গার ভেতরে, পাড় ঘেঁষে দেখা যাচ্ছে একটা আধা গোলাকার সুড়ঙ্গ। তিন ফুট বাই চার ফুট হবে বড় জোর। সুড়ঙ্গের ভেতর, আবছা আলো অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে, তরমুজের সারি।
কাউকে কিছু না বলার কিরে খেয়ে আমরা ফিরছি। দলটা চুপ। হৃদয়বান পই পই করে বারণ করেছে রাস্তায় এসব নিয়ে আলোচনা না করতে। ওর ধারণা, এতক্ষণে নিশ্চয়ই কেউ অনুসরণ করছে ওদের। নজর রাখছে প্রত্যেক পদক্ষেপের ওপর।
সবাই যার যার মতো করে ভাবতে ভাবতে ফিরছি আমরা। কোন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবার উপায় নেই। অথচ প্রশ্নগুলো একই। কী করে তরমুজগুলো ওইখানে গেল? কে নিয়ে গেল? এইসব প্রশ্নের উত্তর কারও মাথাতেই সামান্য ক্লু সমেত এখনও আসেনি।
রাতের খাওয়া নিয়ে হৃদয়বান একটা কথাও বলল না। দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে এক পাহাড় লালচে চালের ভাত সপাসপ শব্দ তুলে খাওয়া শেষ করল। ছাদের ওপর চলে গিয়ে বিড়ি ধরাল একটা। তাকিয়ে রইল দেড়শ মিটার দূরের তরমুজের ক্ষেতের দিকে। সরু চোখ করে ভাবনার গোড়ায় ধোঁয়া দিতে লাগল একমনে।
সাধ্বীদিকে কেবল বলল,
- কালকেই চলে যাওয়া উচিত আমাদের। কোন বিশাল র্যাকেট কাজ করছে এর পেছনে। তারা এলাকার সব সুড়ঙ্গ, সব চোরাবালি, সব রাস্তাঘাট সব চেনে। আমরাই চিনি না কিচ্ছু। বিপদ এলে আমরা একদম সোজা উড়ে যাব ওদের চক্রান্তের সামনে।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর প্রতিহারী এসে একটা প্যাকেট দিয়ে গেল হৃদয়বানের হাতে। মামাবাবু পাঠিয়েছেন। খুলতেই দেখা গেল, হাতের মুঠোয় ধরে যায় এমন একটা বাইনোকুলার শুয়ে রয়েছে ভেতরে। ব্লু-ব্ল্যাক রঙের ঠাণ্ডা ধাতব শরীর নিয়ে শুয়ে রয়েছে যন্ত্রটা। মুঠো করে ধরবার জায়গায় একটা ছোট্ট খোদাই, লেখা আছে, ‘মেড ইন চেকস্লোভাকিয়া’।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হৃদয়বান নেই। নেই তো নেই। উৎকণ্ঠিত সাধ্বীদির চাপে আমরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুঁজতে গেলাম হৃদয়বানকে। দেখি বেলা সাতটা নাগাদ ক্যানেলের দিক থেকে হনহন করে ফিরছেন তিনি। সারা গা ঘামে ভেজা। বললেন,
- মর্নিং ওয়াকটা ভুলেই যাচ্ছিলাম প্রায়। একটু চালু করে দিলাম।
বেলা বাড়লে হৃদয়বান আমাদের নিয়ে ছাদে গেল। বাইনোকুলারে সবাই চোখ রাখলাম এক এক করে। চোখে লাগিয়ে হতবাক হলাম। সব কটা তরমুজ যেন নাকের সামনে ঝুলছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।
হৃদয়বান খুব গম্ভীর চোখে গোটা ক্ষেত পর্যবেক্ষণ করে বাইনোকুলার নামিয়ে বলল,
- ভেরি নাইস ভিসন। মামাবাবু কোথায়?
পাশ থেকে অভিক বলল,
- অস্ট্রেলিয়ায়।
চমকে উঠলাম।
অভিক বলল,
- হঠাৎ একটা সেমিনার থেকে ডাক পেয়ে চলে গেলেন। আমাকে বলে গেছে। দেখিস, তোর বন্ধুদের যেন কোন অসুবিধা না হয়। আমি ফিরে সব জেনে নেব।
হৃদয়বান চমকাল না। খালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
- বাঁচা গেছে। চল নিচে যাই। সকাল সকাল চান খাওয়া সেরে ঘুম দি। কাল আবার ফেরা।
আমি হতভম্ব হলাম। তার মানে তরমুজ রহস্য অনাবিষ্কৃত রেখেই আমরা চলে যাচ্ছি? এত কাণ্ডের পর ব্যর্থতার সঙ্গে পলায়ন?
দুপুরে খাসি খেয়ে আমরা মোষের মতো ঘুমালাম। বিকেলে একটু ঘুরে ফিরে এসে ঠিক হল কাল যাওয়া। আজ জয়ের গান শোনা হবে সন্ধ্যের পর। জয় বাকি শিল্পীদের মত না না করল না, এটাই আশ্চর্যের।
সন্ধ্যেবেলা ফুলুরি আর বেগুনি দিয়ে মুড়ি, সঙ্গে ভাঁড়ে চা। খাওয়া সেরে জয় চাঁদের আলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে গেয়ে উঠল, আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। বন মাঠ সব যেন গেয়ে উঠল ওর সঙ্গে।
রাতে প্যাকআপের সময় সাধ্বীদি আবার চেঁচামেচি জুড়ে দিল।
- আমি কিচ্ছু জানিনা। তুমি লাগেজ সব বার করে ওদের সবার ব্যাগে ভাগ করে দাও।
হৃদয়বানদা বললেন,
- না, তা হয় না। আমার বোঝা আমাকেই বইতে দাও।
- কোথায় বোঝা? এনেছ তো একটা বাড়তি পাজামা আর পাঞ্জাবি। গামছা তোয়ালে সাবান পেস্ট ওইসব আবার লাগেজ নাকি। তার জন্য এই ঢাউশ সুটকেস? এই হ্যান্ডেল কিন্তু এবার খুলে পড়বে হৃদয়। আমি বলে দিলাম।
হৃদয়বান উত্তর না দিয়ে হ্যান্ডেলখানা একবার ভাল করে টেনে দেখে নিল। বলল,
- ইম্পসিবল।
ফেরার পথে প্রতিহারীকে একটা পঞ্চাশ টাকার বকশিশ অফার করা হল। সে নিল না। শুধু বলল,
- তরমুজগুলো বাঁচাতে পারলেন না এত গুলো দিকু মিলে? বকশিশ দিয়ে কী হবে?
তার চোখের কোণ, দেখা গেল চিকচিক করছে। সেখানে তরমুজের ওপর মায়া এবং আমাদের ওপর করুণা দুইই দুলছে একতালে।
***
ট্রেনের হকারের কাছ থেকে গরম কচুরি আর ছোলার ডাল নিলাম সবাই। এইবার দাবি উঠল, কেন আমরা চলে এলাম তার কারণ জানাতে হবে। আর কেনই বা আমাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে এখনও। অভিক ছাড়া আর কেউ তো কিছু জানিই না। সব বলতে হবে খুলে।
ভাঁড়ের চায়ে আয়েস করে চুমুক দিয়ে হৃদয়বান একটা বিড়ি ধরাল। ছোট ছোট চোখদুটো আধবোজা করে বলল,
- কারও খাবার সংগ্রহের অভিযানে বাধা দিতে বিবেকে বাঁধল আমার।
তার মানে চোর কে হৃদয়বান জেনে গেছে? কেবল নীতিগত ভাবে আটকে গেল সে? মেনে নিল পরাজয় মামাবাবুর কাছে?
আমি বলে উঠলাম,
- কে চুরি করছিল? গরিব সাঁওতালদের নিশ্চয়ই কেউ? তাই আপনার বিবেকে বাঁধল ধরিয়ে দিতে?
- গরিব? তা বটে ওরা। একদম সর্বহারা বললেও ভুল বলা হয় না। আমাদের মতো সভ্যজাতেরও নয়। আদিম এখনও। আমরা সভ্য মানুষ খাবার নিয়ে যা কান্ড করি ওরা তার সিকিও করে না। বরং আমরা আমাদের এই বিপুল খাদ্য ভান্ডারের সামান্য অংশ দিতেও অস্বীকার করি ওদের। এমনকি হত্যাও করি। আমরা সভ্যতার অভিশাপ।
গলা ভারি হয়ে এল হৃদয়বানের।
গুম হয়ে গেলাম সবাই। সাঁওতালরা গরিব। সবাই জানে। বার বার ওরা সভ্য সমাজের বিরুদ্ধ বিদ্রোহ করেছে ওদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার এই সভ্য মানুষরা চালিয়েছে বলেই। নিজে থেকে তো কোনদিন আগ্রাসী হয়ে আমাদের এলাকা বেদখল করতে আসেনি ওরা। বরং আমরা ওদের বারবার উৎখাত করেছি। অত্যাচার করেছি। মজুরি দিইনি ঠিকঠাক। চা বাগান, মোট বওয়ার কাজ, ক্ষেতে খামারের কাজে ওদের লেবার হিসেবে লাগিয়ে চালিয়েছি চরম অত্যাচার। ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার সাক্ষ্য।
তুলসী দার সরল প্রশ্ন,
- তুমি কি চিনতে পারলে ওদের? মামাবাবুর ফার্মেরই কেউ?
- নাহ, চিনতে পারিনি ব্যক্তিগত ভাবে তবে জাতিগত ভাবে তো চিনিই। আমি নয়, আমি আপনি সবাই চিনি ওদের।
- এত হেঁয়ালি আর নেওয়া যাচ্ছে না রে।
সাগর বলে উঠল,
- এইবার ঝেড়ে কাশ তো বাবা।
নাইলন দড়ি খুলে সুটকেসের ভেতর থেকে হৃদয়বান সযত্নে একটা বিদেশি ম্যাগাজিন বার করল। ম্যাগাজিনটা বেশ পুরনো। বলল,
- এইটা ধর্মতলার ফুটপাথ থেকে কিনেছিলাম। মামাবাবুর কাছে কেসটা নেওয়ার পর থেকেই পড়াশুনা তো করতেই হয়, এই ভেবে খুঁজছিলাম এইরকম কিছু। পেয়ে গেলাম সেদিন। একটা জায়গা তোদের পড়ে শোনাই। চিন্তা নেই, অনুবাদ করেই শোনাব। এই মহাপৃথিবীর একটা বিশেষ প্রজাতির খাদ্য সংগ্রহের বৃত্তান্ত শোনাই তোদের-
যুগ যুগ ধরে এরা খাবার সংগ্রহ করে সূর্যাস্তের পরে। এবং খেতেও বসে তখন। আমাদের মতো চব্বিশ ঘণ্টা ধরে খাই খাই করে না।
শান্ত নীরব লোকালয় পেলে এরা দিনের বেলাও খাবার জোগাড় করতে বার হয়।
পুরনো বাসা এরা দিনের বেলা সারায় আর নতুন বাসা রাতের বেলা তৈরি করে।
রাতের প্রথম এবং শেষ প্রহরে এদের নারী পুরুষরা মিলিত হয়।
এক এক জোড়া নারী পুরুষ মিলে এরা সর্বাধিক ছ'টি করে বাচ্চা প্রসব করে। বছরে করে মোট চার বার।
প্রথম মাসে যদি ছ'টা বাচ্ছা দেয় তাহলে পরের চতুর্থ মাসে দেয় বারোটা নারী আর বারোটা পুরুষ সন্তান, অর্থাৎ মোট চব্বিশটা। আগের দম্পতি ধরে সংখ্যা দাঁড়ায় তিরিশ।
সপ্তম মাসে দেয় আটচল্লিশ দুগুণে ছিয়ানব্বই আর আগের দম্পতিগুলো ধরে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় একশ ছাব্বিশ। দশম মাসে মোট পাঁচশ দশ জন। তের-তম মাসে গিয়ে দাঁড়ায় দু হাজার ছেচল্লিশ জন। এক বছরে এক জোড়া থেকে দু হাজার ছেচল্লিশ জন। বুঝলি?
সবচেয়ে স্বাস্থ্যবানটির ওজন পাঁচশ গ্রাম অবধি হতে পারে। ইতিমধ্যেই এরা ধ্বংস করেছে রেলপথ, সেতু, বড় বড় গম্বুজওয়ালা খিলানওয়ালা প্রাসাদ। সারা পৃথিবীতে এদের হাতে যত মানুষ খুন হয়েছে আর কেউ তা পারেনি আজও।
নদীর বাঁধ ধ্বংস করে এরা বন্যাকে ডেকে আনতে খুবই দড়। বছরে আটলক্ষ টন মানুষের খাবারদাবার এরা কেবল এই দেশেই খেয়ে এবং নষ্ট করে ফেলে। এ
দের খাদ্য তালিকা ভারি অদ্ভুত। সিমেন্টের মেঝে, কাঠ, ইলেকট্রিকের তার, সিসা, এলুমিনিয়াম, কাপড়চোপড়, বাড়ির জমির দলিল, এমনকি কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের আগের রাতে সব আয়োজন এরা স্রেফ খেয়ে তছনছ করে দিতে পারে।
সব রকম খাবার এরা খেলেও এদের প্রিয়তম খাদ্য হল তরমুজ।
- তুই কি ইঁদুরের কথা বলছিস?
তুলসীদা চোখ সরু করে জিগ্যেস করলেন।
হৃদয়বান তাকাল। চোখ ছলছল করছে তার। ঘাড় নেড়ে বলল,
- ঠিক তাই।
- তা, ওরা মাঠ থেকে অতদূরে নিয়ে যাচ্ছে রোজ, সুড়ঙ্গের ভেতর লুকোচ্ছে। ঠিক আছে, সুড়ঙ্গ না হয় মাটি দিয়ে মুখ চাপা। কিন্তু ক্ষেত থেকে বার হচ্ছে কী ভাবে? কেউ টের পেল না?
- পাবে কী করে? বাইনোকুলার ছাড়া টের পাওয়া যে অসম্ভব।
হৃদয়বানের নির্বিকার জবাব।
- তা, বাইনোকুলার দিয়ে তুই টের পেলি কী করে?
- কাল সকালে মর্নিং ওয়াকের নাম করে একবার একা বেরিয়ে গিয়েছিলাম মনে পড়ে?
- পড়ে।
- মাঠটার পশ্চিমে ডুলুং নদী?
- বেশ।
- ফার্মের এলাকা শেষ হলেই ডুলুংএর দিকে ঢাল?
- বেশ বেশ।
তুলসীদা মেলাচ্ছেন।
- ঢাল আর ক্ষেতের সীমানার মাঝে ঝোপ?
- হল।
- ঝোপের গা খুব একটা ঘন নয়। ওপাশের জমিও ফার্মের একটা পতিত অংশ।
- তারপর?
- ভোরের আবছা আধো অন্ধকারে ওরা এক এক করে ক্ষেতের ভেতর এসে এক একজন একটা করে তরমুজ আঁকড়ে ধরছিল। আরেকজন কুট করে কেটে দিচ্ছিল তরমুজের বোঁটা।
- তাতো হল, কিন্তু তরমুজ নিয়ে যাচ্ছিল কী করে? গড়িয়ে?
- না, যে আঁকড়ে ধরছিল নখ দিয়ে তার ল্যাজ ধরে আরও দু তিনজন টানছিল ওই পশ্চিমের ঢালের দিকে।
- বাপরে! বলিস কী?
- হ্যাঁ, বেড়া পার করেই গড়িয়ে যাচ্ছিল তরমুজ। গিয়ে পড়ছিল একদম একটা পিলের মতো গর্তে।
- কেউ দেখতে পায়নি গর্ত এতদিন ধরে?
- না, কারণ, গর্তের ওপর দিকে ঝোপঝাড়ের ঢাকনা। দেখতে পাওয়া খুবই কঠিন। তার আগে সবচেয়ে বড় কথা হল, সন্দেহ। ক্ষেত থেকে প্রায় পাঁচ ছ মিটার দূরে ওই গর্ত। ওখান দিয়ে তরমুজ গড়িয়ে দেওয়ার কথা খোদ কলম্বাসের মাথায়ও উঁকি দেবে না।
- বেশ। গর্ত তো হল, তার সঙ্গে ডুলুংয়ের সুড়ঙ্গ কী করে এলো?
- ওই গর্ত ওই সুড়ঙ্গ অবধি চলে গেছে?
প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
- বলেন কী?
- হ্যাঁ, গেছে। মাঠে কাজ করছে এমন একজন স্থানীয় মানুষকে জিগ্যেস করলাম। সে বলল, হ্যাঁ, এইখানে এমন অনেক সুড়ঙ্গ আছে নদী অবধি।
- কিন্তু এইসব সুড়ঙ্গ বানাল কে? কেন বানাল?
- এইবার একটু ঝাড়গ্রামের ইতিহাস তোমাদের জানতে হবে। এখানকার হিন্দু রাজা সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় থেকে দু তরফেই মানে ইংরেজ এবং সাঁওতাল দু দিকেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন। তার ভয় ছিল যে কোন সময় হয় ইংরেজ নয় সাঁওতাল তাঁকে আক্রমণ করবে। তাই প্রাসাদ থেকেই শুধু নয়, কাছাকাছি অনেক জায়গা থেকেই এই এলাকায় অনেক সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে জারাল আটা গ্রামে রাজার ছিল বিশাল শস্য ভাণ্ডার। আজ যেখানে মামাবাবুর ফার্ম হাউস সেটা ছিল রাজার গ্রানারি। খরার সময় এইখানে খাদ্য সংগ্রহ করে রাখতেন রাজার লোকজন। তাদেরও তো পালানোর কথা মাথায় রাখতে হয়েছিল।
একটু দম নিয়ে হৃদয়বান উদাস সুরে বলল,
- আরেকটা জিনিসও এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে তোমাকে। স্থানীয় কেন, সারা দেশে সাঁওতালরা যেখানে যেখানে রয়েছে, চোর হিসেবে তাদের সেইরকম কোন রেকর্ড নেই। প্রতিহারী যদিও সেটা মানে না এবং আমার মনকেও বিষিয়ে দিয়েছিল প্রায়। কিন্তু মনে রেখ, বংশীও ওদের চোখে একজন দিকুমাত্র। আর দিকু মানেই...
- সবই তো বুঝলাম, এর সঙ্গে বাইনোকুলারের সম্পর্কটা বুঝলাম না।
- বাইনোকুলার ছাড়া ওদের এই অপারেশন কাছে গিয়ে নিজের চোখে দেখা অসম্ভব ছিল। লোকজন ওই পথের পঞ্চাশ মিটারের ভেতর এলেই ওরা সুড়ুত। টিকিটি দেখতে পেত না কেউ।
- তা তুই কোথা দেখে দেখলি ওদের এই অপারেশন?
- কেন, ভোরবেলা, মর্নিং ওয়াকে যাওয়ার আগে মামাবাবুর ফার্ম হাউসের বারান্দা থেকে বাইনোকুলারে চোখ রাখতেই পরিষ্কার দেখতে পেলাম গোটা অপারেশনটা। তারপর পালানোর রাস্তাটা দেখবার জন্য নেমে সরেজমিনে গেলাম। দেখি মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলেই ওরা সব ভোঁভা। ঢালু জমিটার ভিজে মাটিতে পা হড়কে আমি পিছলে পড়ে না গেলে ওই ঝোপের ভেতর সুড়ঙ্গের এদিককার মুখটা খুঁজেই পেতাম না। আমি তো ভাবছি ওরা তরমুজ নিয়ে বেড়া পার হয়ে তারপর কি শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে?
- এইসব কথা তুই মামাবাবুকে জানাবি না?
- না।
- কেন?
- দেখ তুলসীদা। তুমি তো জান আমি খেতে কীরকম ভালবাসি। মানুষ বাঁচার জন্য খায়। আমি খাওয়ার জন্য বাঁচি। আমি জানি জীবনের সেরা বাসা রসনায়। জীবজগত সবচেয়ে ভাল এবং সুখী হয় খাওয়ার সময়। জেনে শুনে সমগোত্রীয় আরেকটা জাতের পেটে লাথি কেমন করে মারব বল?
আমরা নীরব হয়ে হৃদয়বানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও একমনে জানলা দিয়ে বাইরে ছুটন্ত পৃথিবীটা দেখছে।
ট্রেনটা সহসা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে টানা হুইসেল বাজিয়ে স্পিড তুলে হু হু করে ছুটতে লাগল কলকাতার দিকে।
*****