জন্মকথা

লিখেছেন:রেদওয়ান খান

সময় পাল্টে গেলে একদা মায়াবী-বিষণ্নতায় ঢাকা, তথাপি জীবনের নানা রকম চঞ্চলতায় কম্পমান গ্রামগুলোর হারিয়ে যাওয়া সবুজের মতোই এখানকার মানুষগুলোও আজকাল শুকনো, বিবর্ণ, রুক্ষতায় নিঃসঙ্গ। তাদের স্বপ্ন-সাফল্য-গাঁথা এখন আর দূর অচিন কোনও যুবক অথবা লাজুক বালিকার হঠাৎ ঝলকানি-বাৎসরিক ‘শিক্ষা বৃত্তি’ লাভের কীর্তিতে উল্লসিত হয় না। তারা শহরমুখী, গ্রামগুলো এখন সম্ভবত তাদের সন্তানদের নামও মনে রাখে না আর। শহর তাদেরকে চুম্বকের মতো টানার পর, তারা সহসা ঘরে বাইরে আগন্তুক হয়ে ওঠে এবং সকাল-সন্ধ্যা নবতর এক মানব মিছিলের বোবা অংশীদার হয়ে নিজ নিজ নিঃসঙ্গতাকে বুকের ভেতর খোদাই করে রাখে। মেঘনা পাড়ের মেয়ে, পরীবানুর বুক আজকাল বসতিশূন্য এক চর। সম্প্রতি সে তার বালিকাবেলা সমাপনান্তে যৌবনবতী, স্নিগ্ধ; পৃথিবীর পথে উঁকিঝুঁকি দিতে উৎসুক, নিজের কারণে নয়, পরিবারের একমাত্র সক্ষম সম্ভাবনা - জেগে ওঠার মতো সামান্য বীজ কেবলমাত্র তারই ভেতর দেখা দিয়েছিলো। বৃক্ষের সব ডালে ফুল আসে না।

গ্রামের অবাধ দিগন্তে বেড়ে ওঠা অন্যান্য দুরন্ত বালক, স্বপ্ন-বালিকা কিংবা বয়স্ক মানুষদের মতো পরীবানুর অন্তরেও কলাপাতা, বাঁশঝাড়, পুকুরের পাড়ে শুকিয়ে যাওয়া কচুরির ফুল অথবা হলদে পাখিটির দুঃখের কারণে অশ্রুনদীর চিরকালীন ধারার একটা ক্ষীয়মাণ প্রবাহ বহমান। তবে, সম্প্রতি সে, পরীবানু, নদী-কোপানো লঞ্চে করে বিশাল মেঘনা নদীটি পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলো। তারপর, মানব-মানবীর নৈমিত্তিক স্রোতের ভেতর নিজের স্বপ্ন ও নিঃসঙ্গতাকে পুঁতে দিয়ে, সে এক চলমান জীবন।

মা সূর্যবানু নাকের নিম্নদেশে প্রাচীন স্বপ্নের মতো ঝুলে থাকা পুরনো রূপার বালীটি নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন, ‘যাইচ না। তুই ঢাহায় গেলে আমি তো লুলা হইয়া যামু। বড়ো মাইয়াডা আঁন্ধা, তোর বাপের এই অবস্থা। একলা সামলামু কেমনে!’

‘মা, চিন্তা কইরেন না ত। আমি ত ভালার জন্যই যাইতাছি। আয় উন্নতি না করলে বুবুর জন্য কিছু করা, ফায়েজের মাদ্রাসায় হাফেজি পড়া – এসব ত অইবো না, মা। আমাগো কি বড়ো ভাই আছ? বা’জানের শরীল দিন দিন কি অইতেছে বুঝতেছেন না, মা ?’

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসার পর, সূর্যবানু কন্যার মুখের দিকে – যে মুখ সহসা অচেনা – অপলক চেয়ে রয়, ‘কি জানি রে মা, জীবনে ঢাহা শহর কি – জানি না, দুই নয়নে দেখিও নাই। মনে বড়ো ডর করে। কার কাছে গিয়া থাকবি, খাবি কি !’

‘এ্যাতো ডরাইয়্যেন না ত। আইজকাইল কত মাইয়্যারাই ত ঢাকায় গার্মেনে কাম করে। ঘরের চালডাও ত খুইল্যা পড়তেছে। টিনের চাল করমু, মা।’ এভাবে জন্মদাত্রীকে একধরনের নড়বড়ে স্বপ্নে দুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছে পরীবানু। নিজেও দুলে উঠেছে। মনে মনে। পরিবর্তনের আহ্বানে তার অন্তঃকরণ সাহসী হয়ে উঠেছিলো।

জননী সূর্যবানু কয়েক রাকাত নফল নামাজ পড়ে পরীর বুকে ফুঁ দিয়ে, আশঙ্কিত অন্তঃকরণে দু’একটি নফল রোজাও মানত করেছিলেন তাঁর সর্বমঙ্গলময় প্রভুর কাছে। অন্ধ-কানা বড়ো বোনটি, তারামনবানু বলে – তার কথায় পরীবানু হেসেছিলো, ‘আমার লেইগাও একটা কাম দেহিস ত, পরী !’ 

মা, তারামনের কথা কেড়ে নিয়ে রাগতস্বরে বলেন, ‘হ অইছে ! আপনের আর কাম করন লাগবো না। পোন্দের নাই ছড়, লক্ষ্মীপুজা কর!’ তার অন্ধত্বকে খোঁটা দিয়ে প্রায়ই, কথায় কথায় সূর্যবানু এধরনের ‘শোলক’ বলেন, তাই মায়ের প্রতি অভিমানাহত জন্মান্ধ তারামন পা টেনে টেনে নিজের অভ্যস্ত আন্দাজ-অভ্যাসে পুকুরপাড়ের বাঁশমুড়াটির উঁচু ঢিবিতে বসে দু’ফোটা অশ্রুপাতের পর, মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, পরী ঢাকার তন বাড়ি এলে সে তার সঙ্গেই চলে যাবে। আর কোনও দিনও বাড়ি ফিরবে না।

বুবু’র এ ধরণের বালিকা-স্বভাবে হাসে পরীবানু। তারপর হাত ধরে অনুনয় করে তারামনের কষ্ট লাঘব করে। দুই বোনের সখ্যতায় ছেদ পড়ার বেদনায় মুষড়ে পড়তে চায় তারামনবানু, ‘পরীটা যে কী আউলা-ঝাউলা, ক্যামনে কি করবো কে জানে ! চিন্তা করলে হাত-পাও বরফ অইয়া যায় আমার।’

তার বাপ ইব্রাহিম মিয়ার হাঁপানির সমস্যা। পান জর্দ্দা খাওয়ার নেশায় শ্বাসের ব্যারাম আর কমে না  তবু ডিগিড্ডিগির কইরা চন্দ্রাবাজার গিয়া পরীর পছন্দের লেজবাঁকা হাঁস কিন্যা আনেন। লেজের কাছে চিকন হয়ে একগোছা পালক বাঁকা হয়ে এলে সেই হাঁস খাওনের উপযুক্ত, তেলতেল ভাব, শিলপাটায় পেষা মসলা দিয়ে ভুনা খেতে ভালোবাসে পরী। সঙ্গে চালগুঁড়ার সিদ্ধ নরম রুটি অথবা লক্ষ্মীবিলাসের ভাত।

পোড়া ইঁটের রুক্ষতা, গাড়ির হর্ণ, রিকশা-জটের স্তব্ধতা সত্ত্বেও, কখনও-বা, এই রাজধানীতে মনুষ্যসম্ভব হৃদ্যতা স্থাপিত হয়ে থাকে। তাই মানুষেরা, কর্মসূত্রে পরিচয় এবং নিজ নিজ প্রয়োজনে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট যোগস্থাপনের একটা সেতু খুঁজে পায়। সে কারণে, পরীবানু, মনে মনে নীলুফাকে সহোদর বোনের মতোই জানে। তার নিজের জগতের ছোটো ছোটো জমে থাকা কথামালার কিছু কিছু নীলুফাকে বলতে পারলে অন্তরে বাহিরে সুখী হয়ে ওঠে। নীলুফাও, গভীর আগ্রহে পরীর গল্পকথা মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে, কখনওবা অন্যমনষ্কতার প্রয়োজনে, কাজের ফাঁক-ফোঁকরে হাঁ হুঁ করে শুনতে ভালোবাসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের সুখ-দুঃখের গল্পগুলো, নীলুফাও, সত্য-মিথ্যার চিরায়ত ভাব-বিলাসে পরীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। উভয়ে উভয়ের কিছু কথা মনে মনে অবিশ্বাস করে; কিছু কথায় আবার প্রকাশ্যে বাষ্পরুদ্ধতায় নুয়ে পড়ে বিশ্বাস স্থাপনের অনন্য সম্ভাবনাও নির্মাণ করে।

‘বুঝলা পরী, তোমার ইকবাল ভাই লোকটা ভালাই ছিলো। ছিলেটে তার দ্যাশেই নিয়া যাওনের কতা। আমি কইলাম কিছুদিন পর যামু, কয়দিন গার্মেনে কামটাম করি। দোষ আমারই বইন, অহন হাড়ে হাড়ে বুঝি একটা পুরুষ মানুষ কত দরকার।’

‘তয় চইলা গেলো ক্যান, এ্যাতো ভালা অইলে ?’ নীলুফার পুত্র টিংকুকে কোলে বসাইয়া আদর করতে করতে বলে পরীবানু। টিংকু পুটপাট কথা কইতে শিখেছে, ‘কিতা অইছে পরী, কিতা অইছে পরী’ – সিলেটি কথা সে কই পাইছে কে জানে-এ নিয়ে হাসাহাসি।

‘শুন, মাইয়্যাগো শত্তুর অইলাম আমরা নিজেরাই! আফরুজা মাগী কি জানতো না আমার একটা ছেলে আছে? ক্যামন ছলচাতুরি তাবিজ-তুমার কইরা ওই কালনাগিনী পোলাডার বাপরে পাগল কইরা বাইর কইরা লইয়া ভাগছে ?  আমার সোনার সংসার ভাঙছে.. অর কপালে ঠাডা পড়বো।’

এইসব অসার কথার ছলনা নারী জীবনের এক চলমান আত্মসান্ত্বনা। ফলে তারা পুনরায় ঘুপচি ঘরে টুংটাং করে বেজে ওঠার সাহস সঞ্চয় করে। তারপর নিজের কাজের ভেতরে চুপ হয়ে বিষণ্ন মগ্নতায় ডুব দেয়। তার বদমাশ স্বামীটি নীলুফাকে ছেড়ে চলে যাবার পর, সে পুনরায় সংসারের ফাঁদে পা দেয়নি। পুরুষ মানুষের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। বছর চারেকের পুত্রটিকে সঙ্গে নিয়ে জগতে সামান্য ঠাঁইয়ের ছাইচাপা প্রত্যাশায় লড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় একদা পরীবানুকে পেয়ে, অন্ততঃ ঘুপচি ঘরের শুষ্ক বাঁশের আড়া-কালি-ঝুলি-মাকড়সার সঙ্গে – টিকটিকি তবু কথা বলে –বোবা হয়ে থাকার নির্মমতা থেকে রেহাই পাওয়ার একটা মনষ্কামনা নীলুফারকে নাড়া দিয়েছিলো। এরকমই কথা চলে তাদের মধ্যে। এখানে কথাই জীবন।

কারওয়ান বাজার রেললাইনের পাশে, হিজড়াপট্টিতে মাসিক দু’হাজার টাকায় ঘুপচি আঁন্ধার ঘর ভাড়া নিয়েছিলো নীলুফা। ‘গার্মেনে’ কাজ করে একলার পক্ষে মাস মাস দু’হাজার টাকা – হিসাব মেলানো কঠিন, তাই, পরীর সঙ্গে নব্য সখ্যতাহেতু ঘুপচি ঘরের অর্ধেক ভাগাভাগি করার অনিচ্ছুক মানসিকতা সত্ত্বেও, মাসিক হিসাব মেলানোর স্বার্থে নীলুফাকে শেষমেষ একটি পথই বেছে নিতে হয়। এছাড়া উপায় নাই। বরিশালে, বাপ-মা’র বাড়ি ফিরে যাওয়ারও উপায় নাই। তারা নিজেরাই ভালোমতোন তিনবেলা খেতে পায় না। বিশেষত, স্বামী পরিত্যক্তারা একূল-ওকূল সবই বিসর্জন করে মূলত, গৃহহীন।

হিজড়াপট্টি ব্যতিক্রম নয়, এখানকারও সব ঘরই মুরগির খোঁয়াড়ের মতোই। এক চিলতে চকি ফেলবার পর, হান্ডিপাতিল রাখার জায়গা নাই। পা ফেলতেই অবিন্যস্ত গৃহস্থালী ঠন্নর করে বেজে ওঠে। বহু যুগের পঁচা-মজা ডোবা আর থমকে থাকা ড্রেন থেকে উড়ে এসে মশারা তাদের দৈনন্দিন রক্ত বস্তিতে খুঁজে পায়। দূষিত রক্তের সহসলভ্যতায় তাদের শারীরিক আকৃতি নাদুস-নুদুস। হিজড়াদের বেতাল অঙ্গ-ভঙ্গির সমতালে, তাদের হাতে তালি বাজানোর বিচিত্র দর্শন ওঠা-নামার মতোই, জয় বাংলা, শহীদ জিয়া জাতীয়তাবাদ, জাতীয় পল্লী পার্টি ইত্যাদি বিচিত্র নাম নিয়ে বল্লম উঁচিয়ে মারামারির নরক যন্ত্রণাও, এখানে নৈমিত্তিক ডালভাত। জয়বাংলা যায়, জাতীয়তাবাদ আসে। জাতীয়তাবাদী ডলানি খেয়ে পালায় তো জয় বাংলা নামের মাতাল রক্তজবা – সাত বছরের কোনও উকুন ভরা আউলাচুল বালিকার পেট ভার করে দিয়ে দাবিয়ে বেড়ানো, লিকলিকে কোমর ও কানসা ভেসে-ওঠা যুবকেরা কিলবিল করে হিজড়াপট্টির নড়বড়ে কোল ঘেঁষা রেল লাইনটিতে। ক্ষমতার পালাবদলে, অস্তিত্ব রক্ষার অমোঘ বিধানে বস্তিটিরও দল বদল হতে বাধ্য। জয়বাংলা হিজড়াপট্টি অথবা শহীদ জিয়া জাতীয়তাবাদী হিজড়াপট্টি নামটির অস্তিত্ব ললাটে লিখে নিয়ে বস্তিটি স্বমহিমা অর্জন করে বেঁচে থাকে। সামনে ভোট। একারণেও, নীলুফারের রাত্রিকালীন ভয় জমাট। পরীকে পেয়ে সে কিছুটা হালকা বোধ করে থাকবে।

সম্প্রতি গ্রামের খোলা উঠান থেকে, ঝরা কচি সুপারির গোটা দিয়ে সাতগুটি খেলার ছক – মাটিতে খোদিত খোপ খোপ ‘সাতঘর’– পুকুরের পাড়ে ফেলে রেখে উদাসীন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, যমে-পাওয়া কাউয়ার মতো মাথা ঘুরতে ঘুরতে, প্রায় ডানা ভেঙ্গে ঘুপচি ঘরের জীবনে বন্দী হয়েছে পরীবানু। একারণে তার, দূর্বাঘাস অথবা উন্মুক্ত আকাশ-বাতাসের পাশাপাশি লেজনাড়া কালো গাইটির জন্য শোক এখনও কিছুটা কাঁচা। নীলুফার বৃত্তান্তও প্রায় অনুরূপই, তবে শহরে তার অতিক্রান্ত কালের পরিধি পরীর চেয়ে লম্বা। একই গার্মেন্টস-এ কাজ করার সুবাদে পরস্পর হৃদয়-বৃত্তান্ত বিনিময়ে অন্তরের সারল্যে অশ্রুমতি হয়ে ওঠার পর, বস্তির বন্দীখানায় নিজেদের গন্তব্যহীন শূণ্যতাকে রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা করে। ঘরে কথা বলার জন্যও একটা লোক দরকার – এই আকুলতা সবারই।

পরীটা আসলেই পরীর মতোই সোন্দর। যদিও গাঁয়ে থাকতে, ফাল্গুনের শুকনো হলদে পাতা কুড়ানোর কালে, সুবাসিনী মাসির বাঁশঝাড় অথবা শৈলবালাদের রক্তশিমূলের ডালে বসে থাকা সাদা-নীল শাড়ীর কালো ঢেউতোলা-চুল ‘পরী’– সে কখনও দেখে নাই। যেহেতু বহুকাল আগেই সুবাসিনী মাসি-শৈলবালারা বনগাঁ-বসন্তপুর দিয়ে ইণ্ডিয়া চলে গেছে, সেহেতু বাঁশঝাড়ে আশ্রিত পরীদের পক্ষে তো উড়াল দিয়ে ইণ্ডিয়া চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। অবশ্য, বনগাঁ-বসন্তপুর জগতের কোনখানে – এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নাই পরীবানুর। ইণ্ডিয়া নামটাও তার কাছে বিশাল এক ধোঁয়াশা।

সুতরাং বাস্তব জগতে এমন সোন্দর মাইয়্যা মানুষ নীলুফা সহসা দেখেনি। এর কপাল তো বিনা আগুনেই পুড়বে। আবার কাম জুটাইছে এক্কেবারে জ্যান্ত আগুনের পাতিল - গার্মেন্টে। তার নিজেরই জীবনের ঠিক-ঠিকানা নাই, গাঙে-ভাসা সোঁদা কাঠ, জোয়ারে ভাটায় উজান-ভাটি কইরা কইরা এখন গার্মেন-হিজড়াপট্টি করে বেড়াচ্ছে। এইসব চিন্তায় নীলুফা কখনও বা অন্যমনষ্ক।

এমতাবস্থায় পরীর জন্য নীলুফার যৎসামান্য দুঃখু-কষ্ট অনুভূত হয়। কল্পনার পরী বাস্তবিক মনুষ্যকুলে এসে গাঙে-ভাসা নীলুফার সঙ্গে থাকে। এতে গাঙের পাড়-ভাঙা শব্দ যেন নীলুফার পাঁজর চাপা দেয়। সে তার অল্প বয়স্ক শিশু পুত্রকে নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রি এক অনিশ্চিতের মৌন স্রোতে ভাসমান। পরের জন্য সে কতটাই বা করার সাধ্য রাখে।

কারো কারো বেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনা সমূহ সমাজে ‘সমতা’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইঙ্গিতবহ। সুতরাং আমরা সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘেঁটে জানতে পারি, তার গার্মেন্টস-এর বড়ো সাব নীলুফারের দিকেও নজর দিয়েছিলো। বাজপাখি যেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয় মুরগি ছানার দিকে। তবে বাসায় ডেকে নিয়ে, সারারাত রাখার পর কয়, ‘তোর আর আসবার দরকার নাই। অন্য জায়গায় কাজ দেখ। তোর শরীরে বোঁটকা গন্ধ।’ তারপর পাঁচ’শ টাকার চারটা চকচকে নোট তার হিম নীল হাতে গুঁজে দিয়েছিলো।

চাতুর্যের কাছে ধরা খেতে চিরকালই মানুষের উৎসাহ-লোভ সুবিদিত। ইকবালের ফিরে আসার চূড়ান্ত– ‘গুড়েবালি’ নিশ্চয়তার পর, এটা ছিলো নীলুফার দ্বিতীয়পর্বের সূচনা।

সাহেবের কথা শুইন্যা নীলুফারের রাগ হয় নাই, কার সঙ্গে কেনই বা রাগ করবে। গাঙে গাঙে ঘাটে ঘাটে ভাসা যৌবন। শরীর কখনও শুকায় না। বোঁটকা গন্ধ তো অইবই। আর গার্মেন-এর বড়ো স্যাররা বেতন চাইলে চোখ রাঙালেও মেয়েদের বুকের দিকে সমানভাবে, পক্ষপাতিত্বহীন, ‘সমতা’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইঙ্গিতবাহী-নরমভাবেই তাকায় – সহ্য শক্তির দক্ষতা একান্ত নিজের, নীলুফার রাগ থাকে না। নাইট শিপ্টে ডিউটি বাড়াইয়া দেয়, নাইটে কাজ করলে মূল বেতনের সঙ্গে বাড়তি অর্থযোগ হয়। এইসব অভিজ্ঞতা অবশ্য একদিনে হয় নাই। শহরের অলি-গলি চিনতে নেড়ি কুত্তারও কিছুদিন সময় লাগে। অর্থাৎ নীলুফা এখন অভিজ্ঞতায় কিছুটা ঋদ্ধ।

পূর্বেকার ফ্যাক্টরী ছেড়ে দেয়ার পর, বর্তমান ঝুমঝুমপুর ফ্যাশন লিমিটেড-এ মাইয়্যা-পোলা- সব কর্মীরাই নীলুফা কিংবা পরীর মতো অথবা শরীরিক লাঞ্চনা শেষে নিঃস্ব হাতে গোপনে অন্যত্র চলে যাওয়া সরলাদের বৃত্তান্ত জানে। ফিসফাস করে। মিটমিট হাসে। তাদের কী-ই বা করার থাকে! মাস শেষে কিছু টাকা না এলে কারোরই গ্রামের বাড়িতে চুলা জ্বলবে না। অতএব কোন বড়ো সাব কোন মাইয়্যারে নিয়া রাইতের শিপ্ট করে-এসব দেখলে তাদের চলে না। তারা সেলাই কারখানা সচল রাখে। এক মাসের বেতন মালিকের কাছে বাঁন্ধা, মুখ খুলবে কে? যৌন-জ্বালায় তারাও তো গার্মেন্টের স্তূপীকৃত ভারী কাপড়ের চিপা খোঁজে, কারো বা গায়ে হাত দিয়ে সুড়িসুড়ি অনুভব করে। ওড়নার নিচে মাংসের স্তূপ দেখেও চক্ষু জুড়ায়। কারো কারো চক্ষু অবশ্য হতাশায় রক্তজবা, সকলের আশা তো আর পূর্ণ হয় না।

প্রথম প্রথম, শহুরে বাজপাখির ছোবল প্রচেষ্টায়-অনভিজ্ঞতা হেতু পরী, ডানা ঝাপটিয়ে গাঁয়ে ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। নিজেকে ভেবেছিলো গোয়ালে বাঁধা গাই। কখনও বা ঘুপচি ঘরের আড়ায় লটকানোর সাধ জাগে অথবা গভীর রাতে ঘুমন্ত ঝুপড়িটি বিধ্বস্ত করা শব্দে ট্রেন আসার প্রতীক্ষায় থেকেছে পরীবানু। নীলুফা সাধ্যমতো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ-উপমায়, বিভ্রান্ত পরীবানুকে বোঝায়, ‘বইন শহরে আইছো - এই শরীল অখন আর তোমার না - এইটা মনে রাইখ্যো। এই শইল্যে সাপ-খোপ কুত্তা-বিলাই কামড় দিবোই। আমারেও কি কম কামড়াইছে? নিজের স্বামীও কামড় দিয়া মাংসের দলা আর লৌ নিয়া ভাইগ্যা গ্যাছে কুত্তার লাহান।’ নিরিবিলি ধরনের ঠান্ডা সুনসান মেয়েটিকে মনে ধরেছিলো নীলুফারের। অতি বকবকির তো অভাব নাই, শেষতক পরীবানুর উপর একটা মায়াও পড়ে গিয়ে থাকবে তার। ঘর ভাড়ার অংশীদারিত্বের প্রয়োজন তো ছিলোই – কথা ছাড়া জীবনের মানে কি? আঁন্ধা-বোবার জীবন সে চায় নাই।

পরীবানু, ভ্যাবাচ্যাকা-ফ্যালফ্যাল চোখে নীলুফার মুখের বর্ণনার দিকে তাকিয়ে এইসব অবলীলা – অথচ আচনক – কথাবার্তা শোনে। ‘বইন গো, বাড়ি চইল্যা গ্যালে বাপ-মা-ভাই-বইনেরে টাকা দিবা ক্যামনে! কোত্থেকে দিবা? মুখ বন্ধ কইরা অহন চুপচাপ কাম কর ত।’

ময়লা শাড়ির আঁচলে পরীর টলমল করা চোখের পানি মোছার দৃশ্য নীলুফারকে সহসা বিজ্ঞ করে তোলে। ‘বইন, মাইয়্যা মাইনষ্যের জীবন বড়োই কষ্টের। চোক বুঁইজ্যা কষ্ট সইয্য করতে না পারলে কাউয়ার বাজারে বাঁচতে পারবা না– ছোঁ মাইরা লইয়্যা যাইবো।’ এ-কথার বিজ্ঞতাপূর্ণ উচ্চারণ শেষে নীলুফারের কন্ঠে আষাঢ়ের মেঘ গুম গুম করতে দেখে পরীবানু আপন অন্তরে নিরর্থক সান্ত্বনাস্রোত উথলে উঠছে - টের পাওয়ার পর, চাপা দিতে না পেরে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। অবুঝ বালিকার মতো ফোঁপায়। নারী ও শিশু সমাজে কান্না মূলত, সংক্রামক। ফলে নীলুফারের চোখ ভিজে উঠলে তার ছোটো পুত্রটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভ্যাঁক করে কাইন্দা ফালায়। নিজের ঢুলঢুল-টলটলায়মানতা সামলে নিয়ে, নীলুফা একই সঙ্গে পরীবানু এবং নিজের পুত্রকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

রাতের খাবার শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে বারোটা-একটা। সকালে আবার খাবার গরম করে নাকেমুখে একদলা খেয়ে দৌড়। আটটার এক সেকেন্ড দেরী হলে গার্মেন্ট-এ হাজিরা কাটা। ভোরবেলা এরকম নারী-পুরুষের মিছিল – এই জীবনে আগে কখনও দেখেনি পরীবানু। সে তার মায়ের কাছে শুনেছিলো, যুদ্ধের বছর এরকম ‘কাঠাকাঠ’ লোক আর লোক ভিনদেশে – হিন্দুস্তান না কই যেন চলে যেতো পাকিস্তানিদের ভয়ে, কখনও বা স্বদেশী চেনাজানা রাজাকারের ভয়ে। জনারণ্যের সেই রূপকথার মিছিল এখন নিজের চোখের সামনে যেন জীবন্ত, বাস্তব। পরীবানু-নীলুফা সেই কাঠাকাঠ লোকেরই ভিড়ে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা স্রোতের মতো ভেসে যায় – যুদ্ধই করে একরকম। মাঝে মধ্যে গাঁয়ের কথা, রাত্রিকালে জুনিপোকার সেইসব আলোর কথা কিছু মনে পড়ে। তারপর ক্লান্তিতে কখনও বা ঘুম আসে।

রাইতে যে পরীর নিদ্রা হয় না বা কম হয় - এটা টের পায় নীলুফা। তার নিজেরও ঘুম হয় কম। হিজড়াপট্টিতে রাইতের বেলায়ও চা-রুটির দোকান খোলা। দোকানে উচ্চস্বরে গান-বাজনার শব্দ। কোনও কোনও চতুর দোকানদার হিন্দি সিনেমা চালু করে দিয়ে কাস্টমার টানে। টুপি মাথায় বৃদ্ধ মৌলভি অথবা লিকলিকে, চ্যাংড়া গাঁঞ্জট্টির অভাব হয় না। হাত-তালি দিয়ে হিজড়ারাও, নিশি-খদ্দের না পেলে, দোকানে চড়াও হয়, টাকা না দিলে কাস্টমারদেরকেও অশ্লীল কোমর দোলানি দিয়ে ভ্যাংচায়। রেলের লোহার পাত ভয়ঙ্কর কাঁপিয়ে, ঝুপড়ি ঘরে ভূমিকম্প তুলে রাতের দূরগামী ট্রেন যায়, আসে। এর মধ্যে ঘুম আসে কেমনে – ঘুমের আর দোষ কি। পুত্রকে জড়িয়ে ধরে তার বাপের বেঈমানী-বদমায়েশির কথা ভাবতে থাকে নীলুফা। আল্লাহর কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানারকম বিচারও পাঠায় সে, তবে পরল পরল ত্যানা পোঁচানো ঝুপড়ি ঘরের চালা অতিক্রম করে, সাত আসমান পেরিয়ে সে-সব বিচার-অনুযোগ-অভিশাপ পৌঁছে কিনা কে জানে। তবে সম্ভবত, এই পর্যন্ত আরশের মালিক নীলুফার কোনও কথা শোনেননি, বিচার-টিচারও কিছুই করেননি।

নির্ঘুম বিছানায় কতো কথা মাথার ভেতরে কিলবিল করে ওঠে। কখনও বা ঠন্নর ঠন্নর একটা আওয়াজ জীবনের সব প্রশ্ন-আশালতা ধোঁয়াশা করে দেয়। তখন বাঁচতে ইচ্ছে করে না। ছেলেটা এতিম হইবো - নইলে কবেই যেদিকে মন চাইতো, একেকবার ভাবে, চলে যেতে পারতো সে, এখন তার সবই এলোমেলো, বাঁশের ভাঙা সাঁকো।

ইকবাল রড-মিস্ত্রির কাজ করতো। সিলেটি মানুষ। প্রথম প্রথম নিরীহ মুখচোরা ইকবালের আচার-ব্যবহারে মনে হয়েছিলো একমাত্র নীলুফাকে বিবাহ করবার জন্যই তাকে অশরীরী-কায়াহীন ফেরেশতারা প্রেরণ করেছেন।

‘বুঝলায়নি লিলু, বিয়ানীবাজার যাইবায় নি? টিলার উপরে তোমারে একখান সোন্দর ঘর বানাইয়া দিমু! আমরার বিয়ানীবাজার, আমরার লাউতা গেরাম বড়ই সোন্দর্য। নদীত বারোমাস তাজা মাছ আর মাছ।’ একবেলা মাছ ছাড়া ভাত, তারও ভালো লাগে না। ‘মাছ ছাড়া মানুষ ভাত খায় ক্যামনে !’ ইকবালের মুলাম কথাবার্তা শুনতে শুনতে চকিতে ভেবেছিলো নীলুফা।

ইকবালের মুখে সিলেটের উচ্চারণ ভালোই লেগেছিলো নীলুফার। তাকে যে ‘লিলু’ ডেকেছিলো - তাও। লিলু ডাকের ভেতর কোনওরূপ শয়তানির কল্পনা ছিলো না।

বিবাহের পর, রড-মিস্ত্রির কর্ম ইকবালের ভালো লাগে না। খুবই কষ্টের মনে হয়। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কোমরে চোট লাগার মতো চিনচিন ব্যথা আর কিছুতেই কমতে চায় না। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে খুকখুক কাশে। ও-য়া-ক্ করে বুকের ভেতর থেকে কফের দলা বের করে আনে। একলা আসন্ন দিশেহারা অবস্থা অনুধাবন করে, শেষ পর্যন্ত নীলুফা ইকবালকেও গার্মেন্টস-এ ঢুকিয়ে দেয়। তার, তৎকালে মনে হয়েছিলো, হোক গার্মেন্ট-তা ও তো একটা অফিস।

তারপর ইকবালের অসুখ সেরে যায়। সে লিলুর সঙ্গে গার্মেন্টে-এ হনহনিয়ে যায় আবার ফিরেও আসে। মাঝে মধ্যে, পুরুষমানুষ ত - ঘরে থাকে না। আগাড়ে বাগাড়ে টো টো করা এদের অভ্যাস। নীলুর ছেলে তখন পেটে। শরীর ধানভরা মটকার মতো ভারী। গার্মেন্টে যেতে আসতে কষ্ট। সময় হয়ে এলে ছুটি নেবে। ছুটি নিতেও ভয়। ফিরে এসে কাজটা আদৌ ফিরে পাবে কিনা - নিশ্চয়তা নাই। মালিকরা পেটভারী মহিলা কর্মী ফ্যাক্টরীর জন্য বাড়তি বোঝা বলে মনে করে। তাছাড়া একজন চলে গেলে কাজের জন্য লাইন ধরা সরলাবালাদের অভাব নাই। গ্রাম খালি করে তারা এখন ঢাকায়।

এই সময়, এই জীবন-মরণ কালের সন্ধিক্ষণে, ইকবালের নজর পড়লো পিরোজপুরের আফরুজার উপর। আফরুজাও সোন্দর। গোলগাল। দাঁত একটু উঁচা কিন্তু হাসলে গালে টেপ-পড়া কলসীর মতো শক্ত টোল পড়ে। ফ্যাক্টরীতে কানাঘুষা সহনীয় হয়ে ওঠার কিছুকাল পর, নীলুফার পুত্র জন্মের পাঁচ মাসের মাথায় ইকবাল মিস্ত্রি আফরুজারে নিয়া নিরুদ্দেশ। বুড়িগঙ্গা না তুরাগ কোন নদী পেরিয়ে কোনও ফ্যাক্টরী না সিলেটের জাফলং-এ পাথর কেয়ারীতে কাম নিচে, অনেক খোঁজ নেয়ার পরও কূলকিনারা হয় না। শেষে ‘জোর জবরদস্তি করে সংসার হয় না’ – এমনটাই ভেবে নিয়েছিলো নীলুফার।

এভাবেই বিয়ানীবাজারের টিলার উপর একখানি ঘর আর নদীতে তাজা চিকমিক চিতল মাছের আকাঙ্খা চাপা পড়ে যায়। সেখানে কোনও দিনই যাওয়া হয় না, সিলেট দেখতে কেমন কল্পনায় আনতে পারে না নীলুফা। তবে শাহজালালের মাজারের কথা সে জেনেছিলো। সিলেট ওলি-আল্লার দ্যাশ-মানুষ নাকি মাজারে সিন্নি দেয়, মানতি করে।

নীলু পুত্র বুকে নিয়ে ঘাটে পড়ে থাকে। পুত্রমায়া বড়ো কঠিন মায়া। গ্রামের উদ্দেশ্যে যেতে, প্রায় আধমরা বুড়িগঙ্গাটি – পার হওয়ার নানা খেয়া নৌকা থাকলেও, নদী পার হতে পুত্রবতীর রাজ্যের দ্বিধা। ফলে সে নদী পার হতে পারে না। কিন্তু এখন তার অন্যজীবন – এখন পুলসিরাত পার হয়েও ইকবালের মুখ দেখতে চায় না নীলুফা। সে এতদিনে কিছুটা মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছে। কিন্তু কর্মশ্রান্ত তথাপি রাত্রিজাগরণে পরীবানু দ্বিধার দ্বৈরথে কম্পমান। সে নীলুফার মতো তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। তার গ্রাম্য প্রাকৃতিক ভাষাহীন বোবা সারল্য তাকে আঁন্ধার-কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রির মতো অধরা করে রাখে। কথাবিমূখতার কারণে সে তার আসল ঘটনা যথা সময়ে নীলুফাকে কয় নাই। চার মাসের বেশি হওয়নের পর অচল মুখ সচল হলে নীলুফাকে সত্য ঘটনা খুইল্যা কয় পরীবানু। তার আগে, টুকটাক– গোপনে বমি করেছিলো, মাথা ঘুরে ওঠায় ঝিম মেরে ছিলো। এতে, পরীবানুর অযথা বোকামিতে নীলুফা নিজের অতীতকাল ও অশ্রুপাত পুনরপি দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখে বিস্মিত বেকুপ, বিরক্ত – সে বলে, ‘আগে কইতে পারলি না বেডি ? কিলিনিকে নিয়া সারাইয়া আনতাম। অহন মর গিয়া যা ! তলে তলে তুইও দেহি কম না।’

ঘটনা ঘটাইছে গার্মেন্টে, পরীর স্যুইং সেকশনের ফ্লোর ইনচার্জ ভুট্টো ফরাজি। নাইট শিপ্ট-এ মেয়েদের টয়লেটে বিনা নোটিশে প্রথমবার মুখচেপে কাজটা করেছিলো ভুট্টো স্যার। সাবধান করেছিলো কাউকে কিছু না বলার জন্য, বললে চাকরি– নট। অবশ্য সেই মাসেই পরীবানুর বেতন তিন’শ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিলো ভুট্টো। ফাঁকতালে এই সুযোগ আরো নিয়েছিলো কালো মতো, লম্বা, গলায় সোনার চেইন, জিন্স, টাই, সু-পরা ভুট্টো স্যার। অনভিজ্ঞ-অনভ্যস্ততার কারণে, ভয়াবহ বিভীষিকা - খুব কষ্ট হয়েছিলো পরীর, অন্য মেয়েদের গল্পকথা নিজের জীবনে সত্য হয়ে ওঠায়, মর্মবিদারী মানব মিছিলে নিজেকে আর খুঁজে পায়না সে। তবে বাড়িতে, পুকুরের পাড় ঘেঁষে, মায়ের হাতের স্পর্শে মাটির ভিটায় একটা টিনের চাল উঠছে – এই রকম ভাবনার ভেতর সে কিছুটা শহুরে হয়ে উঠেছিলো সাম্প্রতিক কালে।

বুকের পাড় ভেঙে চৈতন্য ফেরার শব্দ হওয়ার পরই কেবল, সহসা ধড়ফড়িয়ে নীলুফাকে গলায় জড়িয়ে পরীবানুর আত্মহত্যার অর্গলটি খুলে যায়। সে বলে, ‘বইন,আমারে বিষ আইন্যা দেও। এই জীবন আমি আর রাখমু না। মা বাপেরে এই মুখ দেখামু ক্যামনে !’

নীলুফা খুবই ব্যথিত। ঘুপচি ঘরে রেখে যাওয়া অবুঝ পুত্র, গার্মেন্টের সেলাই মেশিনের অবিরাম শব্দ, বেতনের অনিশ্চয়তা, নতুন করে পরীর এই সমস্যা, তারই অবসরে ‘হারামজাদা ইকবালইল্যার কপালে ঠাটা পড়ুক’ – এই বদদোয়া দেয়ার প্রয়োজনে – একলা একলা কতো আর সামলানো যায়। তারও, নিজের ভেতর থেকে মুচড়ে আসা কথা সে বলে যেতে পারে শুধু , ‘বইন রে, মাইয়্যা লোকের জীবন বড়োই কঠিন - নিটুর। আমরা অইলাম কই মাছের লাহান। ছাঁৎ করা তামার লাহান আগুন-গরম কড়াইতে ভাজলেও আমাগো ন্যাজ নাড়াইতে অইবো। অহন তোর মরণের কাম নাই লো। শামসুন্নাহার ডাক্তরের কিলিনিকে চল। এইডা বস্তি, দেহস না সাপের আখড়া ? লেলানো বাদ দিয়া চুপচাপ থাক মাগি।’

তথাপি, গাঁয়ের দুর্বা ঘাসে পা ভিজিয়ে বেড়ে ওঠা সবুজ পরী, দু’বেলা পেটের ভাত জোগাড়ের সন্ধানে অনেক পথ পাড়ি দেয়ার পর, এখন অন্তঃসত্ত্বাজনিত অনিচ্ছুক পাপাচারের দায় - ক্ষমার অযোগ্য এই দায় – আবেগে, নিজেকেই দিয়ে বলে ওঠে, ‘আমার বাজানরে আমি কি জবাব দিমু। আমার জনমদুখী মা’রে আমি এই মুখ ক্যামনে দেখামু। আমার পরানের ভাই বোনডিরে।’ বুকচাপা কষ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিলাপ করে পরীবানু।

‘আগে মনে ছিলো না ? তলে তলে পেট বাজাইয়া অহন কাঁনলে কে আইবো তোরে দেখতে ? কাঁন্দন থামা। আয় ভাত খা।’ অকস্মাৎ নীলুফার এই ধমকের ভেতর একটা মায়াবী স্নেহ-সাহস-আশ্রয়ের অনুকূল আবহ বস্তির নড়বড়ে ঘরটিতে স্থিরতা নামিয়ে আনতে সচেষ্ট।

বস্তিতে অশ্লীলতা দুর্গন্ধের সমতুল্য দ্রুত ছড়ায়। চিৎকার করে অশ্রুপাতের সুযোগ কম। এইরকম এক আঁন্ধার রাত্রিকালীন হু হু করে দূরে চলে যাওয়া ট্রেনের শব্দের মতো বিপন্ন বিলাপের ভেতর পরীবানু তার অন্তর্চক্ষুতে দেখতে পায় – উঠান পেরিয়ে কাকচক্ষু পুকুরে ভাসমান কচুরি ও তাদের জন্ম-উদাস ফুল। ঘনত্বে ঠাঁসা কচুরির ভেতর ঠ্যাং আটকে থাকা বালিহাঁসটির ছটফটানি, হাঁসটিকে কোনও এক নিঠুর শিকারী গুলতি মেরে সম্ভবত ডানা ভেঙ্গে দিয়েছিলো - তার সখাটি পুকুরপাড়ের ডুমুর গাছে বসে কাঁদছে। কিন্তু পরীবানু এখন আর গাঁয়ে, পুকুরের পাড়ে থাকে না। সে এখন, কুমারী গর্ভধারিণী বিধায় হিজড়াপট্টির লোলুপ জয়বাংলা অথবা জাতীয়তাবাদী গার্মেন্টস-এর এজমালী সম্পদ হয়ে ওঠার ধারাবাহিক নিয়মে শৃঙ্খলিত। পরীর গমনাগমন অবলোকন করে গাঁঞ্জট্টিরাও মনে মনে কিছু আশা করেছিলো।

গ্রামে ফিরে যাওয়ার সব পথ বন্ধ। আজরাইল এখন ভুট্টো স্যারের মুখাবয়বে যখন তখন তার চিন্তাবৃক্ষে হানা দেয়। নতুন গার্মেন্টস-এ কাজ কাম এলোমেলো তার। বর্তমান সহকর্মীরা জানে, তার স্বামী মোবাইলের হেডফোন কানে লাগাইয়া রাস্তা পার হইতে গিয়া, কমলাপুরে, ট্রেন চাপায় মরছে।’ বেকুব পুরুষ ছিলো একটা। মোবাইল কানে দিয়া রেললাইন পার হয় ! জীবনের প্রয়োজনে মিথ্যা বলা জায়েজ আছে – এ কথা কে না স্বীকার করবে। এভাবে, জীবনই জীবনবৃক্ষের অশ্রুমালা শুকনো হলদে পাতার মতো ঝরায়।

নিবেদিতা নার্সিং হোমে, শামসুন্নাহার ডাক্তার সব রকম পরীক্ষা কইরা, কষ্টের টাকার একরকম নিষ্ফল দণ্ডি - বললেন, ‘সম্ভব না, লেট করেছেন আপনি। রেগুলার চেক করিয়ে যাবেন।’ ক্রমশঃ নড়ে ওঠা ভারী পেট, আজরাইলের বীর্য নিয়ে নীলুফারের সঙ্গে ঘুপচি ঘরে ফিরে আসে পরীবানু। নতুন গার্মেন্ট-এ, শরীর টেনে টেনে ‍দু’বেলা মিছিলের অংশ হয়ে সকালে যায়-রাতে আসে। মাথা ঘুরায় তার।

পরীর জীবনের ডানা তখন আরেকবার কচুরির ভেতর অসহায় আটকে থাকা বালিহাঁসটির মতোই নিয়তিসম্ভব এক দুরুদুরু কম্পমান বিভীষিকা। তার ক্ষুদ্র আকাশটি আষাঢ় মেঘের গুমগুমানীতে থর থর করতে থাকে। নিরেট ঢাকা শহরে, তার অন্য কোনও আকাশ নাই।

বস্তিতে ময়লা সমাজ। এখানকার মানুষের মুখের কোনও লাগাম নাই - সবকিছুই কেমন যেন ন্যাংটা উদাম। পুরুষগুলো নিজেদের নোংরা, আধোয়া প্রশ্রাবের দাগ-লাগা প্যান্টের জিপারে অনাবশ্যক একটা হস্তাঙ্গুলি-চাপ দিয়ে লকলক কইরা পরীবানু অথবা নীলুফা, রেল লাইনের পাশে, ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে চিঁকুতকুত খেলায় মগ্ন অবুঝ বালিকা অর্থাৎ চলমান উদ্ভ্রান্ত রমণীমাত্রকেই চোখের অশ্লীল তীরে জর্জরিত করে দেয়। ঢেকুর তুলে আপাদমস্তক গিলেও খায়। মাইয়্যা লোকেরাও, কখনও বা হিজড়াদের মতো ভয়ানক আত্ম-অসহায়ত্ব অনুভব করে বলে ওঠে ‘ও পরী মাগী, কি লা! কুন ভাতারের গুতায় পেট বানাইলি ? তোর রাঙা ভাতারের মুকখান ত একবার দেখাইলি না। যাঃ ! খানকি। হা হা হা। ইস ! দ্যাখ লা - আবার মাথায় কাপড় টানে ! হা হা হা ! মাথার কাপড়ে কি পেট ঢাকতে পারবি রে মাগী…।’

তাহাদের কথা মিথ্যা হয় না। অবশ্য সকলে তো আর জানে না, অবশ্যম্ভাবীভাবে, পরীবানুর জামাইটা তো ছিলো একটা বেকুব। এই তো কিছুদিন অইলো রেললাইনে কাটা পইড়া মরছে, দিন দুপুরে।

দিন দিন পরীবানুর পেট ঢোলের মতো ফুলে ওঠে। তয় সব মাইয়্যা মাইনষেরই এমুন অয়। নীলুফারও অইছিলো। এর আগের গার্মেন্টের বড়ো সাব যেবার তারে বাজাইছিলো, নীলু, বাস্তবতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরথমেই অষুদ খাইয়া শ্যাষ কইরা দিছিলো। ভাসমান জীবন। নিজের জীবনেই চলে না… সাহেবরা তো আর বিয়া কইরা ঘরে তুইল্যা ফুলটুঙ্গিতে রাখবো না। সে ধরা খাইছে ইকবাইল্যার কাছে। হারামজাদাটা নিগুরমুয়া শয়তান ছিলো একটা।

‘পরীটা বোকা। তার মতো বোকা সরল সিধা মাইয়্যা মানুষ আল্লার দুনিয়ায় নাই।’ ভাবে নীলুফা। সে পরীকে নিয়া পরীর থেকেও ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত। নিদ্রাহীন।

হান্ডি-পাতিল এক সঙ্গে থাকলে টুঙটাঙ বাজবেই। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলো টুঙটাঙ বাজনার একেকটা আখড়া আজকাল। গ্রাম থেকে স্রোতে ভেসে আসা হান্ডি-পাতিলের মতো কালো মাথার পুরুষ-নারীরা, পারস্পরিক গল্পকথায় বেজে ওঠার পর, শেষমেষ কামিনী-কাঞ্চনের উত্থিত আবেগে ফ্যাক্টরীর টয়লেটগুলো স্খলিত বীর্য-রক্ত-পুঁজের ছিটায় নরক বানিয়ে রাখে। এটা সকলেই জানে।

অবশ্য,পরীর হৃদয় সামান্য বেজে উঠেছিলো গার্মেন্ট-এ মনোয়ারের লগে। সদ্য গাঁয়ের মাঠ থেকে উঠে আসা লাঙল-টানা শক্ত হাত, চওড়া বুক, শ্যামাঙ্গ মানোয়ারের চোখ চিতল মাছের মতো ঝিলিক মেরেছিলো পরীকে দেখে। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা কইরা মনোয়ার আদম বেপারীর পাল্লায় জমি বিক্রির টাকা জমা দিয়া বিরাট ধরা খাইয়া গার্মেন্টে কাম নিছে। অতঃপর, সে, মনোয়ার, ছুটির দিনে পরীকে চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখাইয়া আনছে। পয়লা ফাল্গুনে ঢাকা শহর সবে মাত্র বুক উঠেছে - এমন কিশোরী গার্মেন্টসকর্মী আর তাদের ভালোবাসার ছোকরা-বুড়ায় অলি গলি-পার্ক-সিনেমা ভরে যায়। এমন দিনে পরীও জোড় বেনীতে হলুদ রঙা ফিতা দিয়ে ফুল বেঁন্ধে, পায়ে মানোয়ারের কিনে দেয়া রূপার মল, ঠোঁটে কমদামী চকবাজারের ঠোঁটপালিশ লাগিয়ে পক্ষীদের মতোই নিশ্চিন্তে ফুরফুর করে উড়ে বেড়ায়। বড়ো লোকেরাও বেরোয়। তারা আবার শাহবাগের ফুলবাজারের ফুলমুকুট পরে আজকাল - এটা মূলত বড়ো লোকেদের ভালোবাসা দিবস। অবশ্য, মনোয়ারও, তার পরীবানুকে হলুদ রঙের টাঙ্গাইল শাড়ী কিনে দিতে ভুল করে নাই। দুইজনে কই কই ঘুইরা বেড়াইছে - কলাবাগানে মামা হালিম-চটপটি খেয়ে হিজড়াপট্টির ঘুপচিতে ফিরেছে বেশ রাইত কইরা। ফেরার সময়, নীলুফার জন্য ‘নিখুদি’ মিষ্টি আর তার পুত্রের জন্য ক্যাডবেরি না কি যেন কিনে এনেছিলো-এসব শক্ত নাম পরীবানু উচ্চারণ করতে পারে না। আর পরীর দেখাদেখি, মনোয়ারও, নীলুফাকে ডেকেছিলো ‘বড়ো আপা।’

মনোয়ার কয়, অতি দুঃখেও আজ  মনে পড়ে যায় পরীবানুর, ‘তুমি এ্যাতো সোন্দর ক্যান পরী !’

‘আপনেরে কইছে ! যান ! মুক লাগবো ! আপনে বেশি সোন্দর !’ লাজুক লাজুক হাসিতে সেদিন ঠিকই বলতে পেরেছিলো সে। টনক টনক কথা শিখেছিলো কিছু্, গার্মেনে দু’একজন সখি হয়েছিলো বিধায়।

‘তোমারে আগে পাইলে আদমবেপারী ধইরা বিদ্যাশ যাইতে চাইতো কোন শালায় ! এ্যাতাদিনে বিয়া কইরা পোলাপানের বাপ অইতাম !’

‘যান! খালি বেশী বেশী কথা কন !’ শুনে খুব সোন্দর করে হেসেছিলো মনোয়ার। শ্যামল-কালোয় মিলে মুকখানিতে ছোটো শসার বিচির মতো দাঁতগুলো, তার পাতলা চোখা চোখা গোঁফের তলে সরলতা বিছিয়ে রেখেছিলো।

পরীবানুর চাওয়া-পাওয়াগুলো ছিলো সামান্যই। বাড়িতে প্রায় বৃদ্ধ কোমর বেঁকে আসা বাপ, মা, জন্মান্ধ বড়ো বোন - এদের পাশে দাড়ানো, আর মাদ্রাসা পড়ুয়া ছোটো ভাইটিকে পিতা-মাতার লালিত পারলৌকিক বাসনা পূরণার্থ কোরআন-এ-হাফেজ হতে সহায়তা করা। দিন যতো গিয়েছে, পরীবানু একটু একটু করে টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়িতে এটা সেটা করার চেষ্টা চালিয়েছে। ফজরের সময় বিছানা ছেড়ে বস্তির লোলুপ পুরষদের যথাসম্ভব এড়িয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মিছিলে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করেছে। তার খুব আকাঙ্খা ছিলো গ্রামে একটা টিনের চৌচালা ঘর করবে। নিজেকে নিয়ে বিশেষ ভাবনা তাকে গ্রাস করেনি, সংসারের দুঃখ মোচন জরুরী।

গার্মেন্ট-এর নানা কথা-উপকথা-রূপকথা সে কিছু কিছু আগেই শুনেছিলো পুরান বাড়ির সানাসের কাছ থেকে। পান-খাওনি-চুন-খাওনি, আজদাহা-নিলাজ সানাসের মাধ্যমেই সে একদিন কাজের সন্ধানে ঢাকা এসেছিলো। বাড়িতে বাপ-মায়ের কষ্ট দেখে অনেকেই, ঢাকায়, আজকাল গার্মেনে কাম করে। ঈদের সময় বাড়িতে এসে, লাল কাপড় পইরা সদরঘাট-নিউমার্কেট-বলাকা সিনেমার গল্প করে চোখ গোল গোল করে। সে এক স্বপ্নজারণ বিস্ম য়– পরীবানু কখনও লঞ্চে চড়ে ঢাকা যায় নাই। এমনকী পরীবানুর চাচাতো বোন, শরীরে ধড়কুড় ব্যারামের সাদা খোপ খোপ সুরাইয়া নাকি লঞ্চের পুরানো টিকিট দলা কইরা ভিড়ের মধ্যে চেকারকে ধরাইয়া দেয়, লঞ্চ থেকে নেমেও যায় –কোনও সমস্যাই না ! একথার ধাঁন্ধা বুঝতে গিয়ে গালে হাত দিয়ে অত্যাশ্চার্য বোধ করে পরীবানু। সুরাইয়ার সাহস আছে ! 

শেষ পর্যন্ত সানাসের গার্মেন্টস-এ স্যুইং এর কাজ কিছুটা শেখার পর, বেতন আটকে থাকে, মালিক পালিয়ে থাকে - এইসবের কারণে নীলুফার হাত ধরে পরীবানু। এ্যাতো কষ্টের কাম, রাত-দিন কিভাবে যায় টের পাওয়া যায় না, বেতন না পাইলে ত চলে না। নীলুফার ফ্যাক্টরীর মালিক নাকি ভালো– কথায় কথায় ছুতানাতায় বেতন আটকায় না। তবে নীলুফা তাকে বড়ো সাব সম্পর্কে সাবধান যে করে নাই – এমন নয়। তিনি নাকি এমনকী সোন্দর অল্প বয়সী পোলাও, সোন্দর মাইয়্যাদের তো কথাই নাই - যাকে তার নজরে ধরে, কাম বাদ দিয়া রাত্রিকালে নিজের রুমে নিয়া কাটান। বেতন কাটেন না। এসব শুনে সতর্ক পরীবানুর বুক কতোবার কেঁপে উঠলেও, এক সময় ভুট্টো বা অপয়া নিয়তি তাকে নজর লাগায় ঠিকই।

দেরিতে হলেও ঘটনা শোনার পর, মনোয়ার মন-মরা হয়ে থাকে কয়েকদিন। সহকর্মীরা তারে আর পরীবানুকে নিয়া ঠাট্টা-তামাশা করে, ‘ভুট্টো স্যাররে নাকি পরী ধরছে - তোরা জানস ? হা হা হা।’ মনোয়ার-পরীকে শুনিয়ে শুনিয়ে এইসব মুখরোচক আখ্যান এ ফ্লোর সে ফ্লোর ঘুরে বেড়ায়। সেলাই মেশিনে জোড়া-তালি দিয়ে দিয়ে তৈরি হতে থাকে নানা রূপকথা।

মনোয়ারের তপ্ত মাথায় খুন চাপে। কিন্তু সে তো ফ্লোর ইনচার্জ ভুট্টোকে খুন করতে পারে না। সে বড়োই একা। তার ক্ষমতাও নাই। পরীর জন্য বুক ফেটে যায়। কিন্তু পরীর শরীরে তো সে কখনো স্পর্শও করে নাই ! খোঁচা খেলে সাপের দাঁতে বিষ পিলপিল করে, অন্তত একটা কামড়ের জন্য নিশ্ছিদ্র লোহার ঘরেও সে ঢোকে। কিন্তু আদম বেপারীর কাছে বিরাট ধরা খাইয়া মনোয়ার এখন শক্তিরহিত বিষহীন নপুংসকতা অনুভব করে এক ঝিমানো শামুক।

মনোয়ার কাউকে কিছু না বলে একদিন আর গার্মেন্ট-এ আসে না। কোথায় উধাও হয়ে যায়, কাউক বলেও যায় না - এতো বড়ো জনপদে, মানুষের মুখ ও মাথা গুণে তাকে বের করা সম্ভব নয়। মোবাইল ফোন বন্ধ। নীলুফারের ইকবাল আর পরীবানুর মনোয়ারের হারিয়ে যাওয়ার গল্পও মুখে মুখে রূপকথার জন্ম দেয়। তারা তো প্রকৃতই অদৃশ্য। এইভাবেই, মানবস্রোতে একটা সমতা সৃষ্টির উপলক্ষ ও উদাহরণ নির্মিত হতে থাকে শহরের অলিতে গলিতে।

পরীবানুর সমস্যা তার পেটেই বেড়ে উঠতে থাকে। দিন দিন শরীরটা পাথরের মতো অচল হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে, তার বিহ্বল অন্তরের সীমাবদ্ধ, জিজ্ঞাসু ভাবনাগুলো জীবনের মানে কী – এর গন্তব্যই বা কী-উত্তর খুঁজে পায় না। এই দ্বৈত বাহন বেশীদূর নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তার নাই, পিতৃপরিচয়হীন পাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর জন্য তো সে গ্রাম ছাড়ে নাই। রোদে ঝলসানো টিনের চালের বাসনায় সে এখন অন্ধ। গন্তব্যহীন।

নীলুফা মাইয়্যা মানুষ হইয়া আরেকটা মাইয়্যা মানুষের দুঃখ বোঝে। কিন্তু তার নিজেরই ধড়ফড় জীবন, সাধ্যও সীমিত। হিজড়াপট্টিতে কেউ কেউ তাকেও ‘খানকি মাগি’ কয়। তবে এসব শুনে তার গা সওয়া হয়ে গেছে। আগে মন খারাপ হলেও এখন আর হয় না। বরং পরীর জন্যই খুব চিন্তা-ভাবনা হয় তার। বাচ্চা হওয়নের সময় এই মাইয়্যা ত কামে যাইতে পারব না, হাতে টাকা পয়সাও নাই। কারণ, ছুটি নিলে গার্মেনে কামও নাই টাকাও নাই। পরীর পেডের অজাগর সাপ সব্বনাশের মতো- তারও ঘুম হারাম কইরা দিছে।

এমনি করেই, জীবনের প্রয়োজনে, পরীবানু, হিজড়াপট্টির দিনরাত্রিকালে, ট্রেনের শব্দের তলে নুয়ে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে। রেললাইনের এপার-ওপার শেখ মুজিবের আউলা-ঝাউলা-ছেঁড়া ধুলিময়-কর্দমাক্ত ছবির নিচে গাঁঞ্জট্টি গুন্ডার বড়ো ছবিওয়ালা ব্যানারে ঢেকে থাকার কারণে বুকচাপা দুঃখবতীরা ’জয়বাংলা’ ব্যানারের নিচ দিয়ে নিজেদের আড়াল করে, আলগোছে চলবার একটা সুযোগ পেয়ে থাকবে। পরীবানুও তার ব্যতিক্রম নয়।

ডিসেম্বর মাস। শীতের বাতাসের পাশাপাশি সাতই মার্চের ভাষণের একটা রোদেলা উত্তাপ আছে। কিন্তু সেই উত্তাপে জাতীয়তাবাদীরা নির্লিপ্ততার ভঙ্গিতে রেল রাস্তাটি পার হয়। কারণ, তাদের নেতা শহীদ জিয়া এমন একটি উত্তাল ভাষণ কখনও দেননি – এই হীনমন্যতায় তারা শেখ মুজিবের তর্জনী – আঙ্গুলের নিচে ম্রিয়মান, ‍হতোদ্যম। তাদের দলও সম্প্রতি প্রতিজ্ঞা করেছে তারা জানুয়ারির নির্বাচনে যাবেও না, নির্বাচন করতেও দেবে না। আর হিন্দুয়ানী গন্ধ আছে বিধায় তাদের চিন্তা যুগভারে দ্বিধাবিভক্ত – ‘জয়বাংলা’  শব্দটি এখন ভাঙা নৌকার পাটাতন। কয়েকজন হিজড়া কোমর দুলিয়ে, ঠোঁটে চড়া লিপস্টিকের লেপা দিয়ে, কেউ কেউ বা আজকাল মাথায় হিজাব লাগিয়ে,  দলে ভিড়ে গিয়ে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিলে আশেপাশে একটা হুল্লোড় ওঠে। কারওয়ান বাজারের মোড়ে পেট্রল বোমার আওয়াজ হলে হিজড়াপট্টিও বুঝে যায়– কাল হরতাল। অবশ্য ট্রেনের বিকট হুইসেল বেজে উঠলে হঠাৎ, চিপা গলির ভেতর থেকে, ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি কেউ শুনতে পায় না। 

ভোর রাত থেকে পরীবানু প্রসব বেদনায় যেন মেঘলা দিনে কানে-হাঁটা কৈ মাছ। বস্তির থুত্থুড়ি বুড়ী জম্বি’র মাকে অনেক অনুনয় করে হাত ধরে টেনে এনেছিলো নীলুফা। বুড়ির দোষ নাই, চলতে পারেন না, চোখে কম দেখেন। তবু নতুন পোলার ‘ওঁয়াও’ কান্নার একটা ছলনাময় চুম্বকাকর্ষী টান আছে তাঁরও দীর্ঘজীবি অন্তরের গহীনে। জম্বি’র মা ঘরে ঢুকে কষ্টকর আঁন্ধারে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন, বলাকা ব্লেড, গরম পানি আছে কিনা।

পরীর ছটফটানিতে দুঃখকাতর ঝগড়াবতী কোনও এক নারী আরবের ‘ঝমঝম’ কূপের পানি আর ‘মরিয়ম’ ফুল দিয়ে গেছে। পানিতে মরিয়ম ফুল ভিজিয়ে, শুকনো পুরনো ফুলটি বিস্তার লাভ করার পর সেই পানি পরীবানুকে খেতে দেয়। এই পানির নাকি অলৌকিক ক্ষমতা– তরতর কইরা পেটের বাচ্চা বের করে আনে। পরীবানুর ক্ষেত্রে সেরকম কিছু হয় নাই। তার ‘খৈল্তা’ অথবা জরায়ুর পানি শেষ, বাচ্চা বের হয় না। সে ভয়ানক কষ্ট পাইতেছে। নীলুফা এখন কী করবে - বুঝে উঠতে না পেরে, ঘুম থেকে জেগে ওঠা ভয়ার্ত পুত্রটিকে প্রথমত একটা চড় মারে– ‘এ্যাতো রাইতে তোর জাগার কামডা কি ?’

মানুষের জন্মের ইতিহাস কিছুটা অশ্লীলতা-সংলগ্ন। ঢুলুঢুলু চোখে উঁকিমারা অতি উৎসাহী কেউ একজন বললো, ‘মা গো মা মাগী ম্যাতায় কি ! ছি ! এমন বাচ্চার মুখ দেখাও হারাম। আমরা অইলে অই পাপ কুত্তার মুকে তুইল্যা দিতাম। জারজ জন্মের সাধ কি – অহন বুঝ !’ তারা শুনেছিলো পরীর স্বামী নাই।

কিন্তু হিজড়াদের কাছে শিশুজন্ম উৎসবের সমতুল্য বিবেচিত হয়, এমন-কী জগৎ দয়াময়ী হয়ে ওঠার পর, ট্রেনের হুইসেল আর পরীবানুর কাতরানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা নৃত্যভঙ্গিমায় দুলে ওঠে। তাদের কেউ একজন প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করে না। দুই হাতে একটা ছন্দময় তালি বাজাতে বাজাতে সে বলে, ‘ওই বেডি, বাচ্চার দোষ কি লা হ্যাঁয় – তারা ফেরেশতা ! যা ভাগ এইখান থেইক্যা। সতী দুগ্গা-ইসসি রে !’ এই সত্যবাক্যের মাহাত্ম্য অভিজ্ঞ প্রাচীনা জম্বি’র মা’র কান অবধি পোঁছুলে তিনি হাঁ-সূচক মথা নাড়েন। এরা তো প্রায়ই নাকে কাপড় গুজে দিয়ে বিস্ময়ে দেখে, বিশেষত ভোরের দিকে কুকুরের মুখে ঝুলছে ময়লার স্তূপে ফেলে দেয়া নামগোত্রহীন মৃত নীল মানবশিশু।

রাত্রিকালে আর পরীবানুর মুশকিল আসানের সম্ভাবনা নাই। থরথরিয়ে শেষ ট্রেন চলে যাবার পর, ততক্ষণে ভোরের আযান পড়ে গেছে। আজ সকাল-সন্ধ্যা একটানা জাতীয়তাবাদীদের হরতাল। পেট্রল বোমা পড়েছে সকালেই। যাত্রাবাড়ি, গুলিস্তান, বিজয় সরণী। গাড়ী ঘোড়া সব বন্ধ। পিকেটাররা আচম্বিতে এসে চাকার হাওয়া বের করে দেয়, রিকশার জীর্ণ নারকেল ছোবড়ার সিটটি তুলে নিয়ে দিয়াশলাইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, কিন্তু রিকশাওয়ালাদের উপায় নাই, তাদের পেটের দায় বড়ো কঠিন। ঘর থেকে বের না হয়ে তাদের উপায় নাই। তারা বেরিয়ে পড়েও। হরতালের আগে, বোমার আতঙ্কে তারা, গত সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরেছিলো। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে পেট্রলবোমাও এক নবতর সংযোজন।

সুতরাং, হরতালের হিংসা আশঙ্কার ভেতর, সকালের ধুলি-কুয়াশা-মাখা আলোটা চক্ষুসহা হয়ে আসার পর, নীলুফা তার ছেলেকে কোনও এক মানবিক হিজড়ার জিম্মায় দিয়ে, পরীকে নিয়ে রিকশা-ভ্যানে ওঠে। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল ছাড়া আর উপায় নাই। যেতে হবে বেশ খানিকটা পথ। কিসের কি হরতাল। গার্মেন্টে তার নিজের হাজিরাটায় আজ  লাল কালি পড়বে - এই চিন্তা তাকে খানিক হতাশা – কষ্ট দেয়। টেনে টুনে চলা জীবন। একদিনের হাজিরা তার কাছে রক্ততুল্য দামী।

হরতালে রাস্তায় লোকজন কম। তবু জীবনের প্রয়োজনে হুটহাট করে দু’একটা গাড়ী চোরা দৌড় মেরে এসে, ঝটিতি থেমে, যাত্রী নিয়ে পেট্রল বোমার স্বপ্নাতঙ্কে ছুটে চলে। বেশির ভাগ লোক হেঁটে চলেছে। নীলক্ষেত মোড়ের কাছে,পেট্রলপাম্পের সামনেই, শীতের শেষের ন্যাড়া বয়স্ক দেবদারু গাছটির পাশ দিয়ে রিকশাভ্যানটি এগিয়ে এলে, পথের শেষ নাই - এরকম ভাবনায় এলোমেলো নীলুফা – ঠাস ঠাস ঠাস করে ৭-৮-৯-১০টা বিকট শব্দে কম্পিত হয়ে ওঠে এলাকাটি। ততক্ষণে কুয়াশার বিলম্বিত চাদরটা ঠেলা দিয়ে জবুথবু একটা সূর্য দুনিয়াকে আলো দেয়ার অমোঘ কর্তব্যপরায়ণতায় একটুখানি তাকায়। কিন্তু হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে ঢাকা ‘ইম্বাসিটির’ জয়বাংলা আর শহীদ জিয়া জাতীয়তাবাদী পোলারা গন্ডগোল লাগাইছে এই বিহান বেলা। ফলে, দেবদারু গাছের মরা ডালে হরতাল উপভোগরত কালা কাউয়ার দল, যদিও তারা ইদানিং পেট্রল বোমার শব্দের সঙ্গে পরিচিত, তথাপি ঘটনার আকস্মিকতার একটা ধাক্কায় জীব মাত্রই কম্পমান স্বভাবে উড়াল মারতে চায়। কাকেরা কা কা কা করে হরতালের শুভারম্ভ – বোমবাজিকে অভিনন্দিত করে নীলক্ষেত মোড়ের উপর দিয়ে লাজুক সূর্যের আলোতে বার ক’য়েক পাখা ঝাপটানি দিয়ে পুনরায় নিজ নিজ দখলীকৃত ডালে বসে পরবর্তী ঘটনা পর্যালোচনা করার পক্ষে চঞ্চুলগ্ন তীক্ষ্ণ চোখ একবার এদিক আরেকবার ওদিক ঘুরায়। তারা দেখতে পায়, দেবদারু তলায় উদাম রিকশাভ্যানের উপর স্থবির দুই রমণী ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়, জীর্ণ, গলায় লাল টুকটুক মাফলার পেঁচানো রিকশাওয়ালাকে।

সময়ের সঙ্গে দ্রুত পাল্লা দিতে ঢাকা শহরে মানুষগুলো হরতালেও কিভাবে যে বের হয়ে আসে– এমনকী এখন নীলক্ষেত মোড়ের সবগুলো চওড়া রাস্তায় রিকশার ঘন্টি বাজনে–শব্দের এক বাজার। কাঁচাবাজারের ব্যাগ হাতে অবশ্য, কেউ কেউ নিউমার্কেটের দিকেই যাচ্ছে।

ইউনিভার্সিটিতে দুই দলের সক্রিয় কর্মীরা চকচকে ধারালো চাপাতি হাতে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার কসরতে সম্ভবত মশগুল। এরা ক’দিন আগেই উঠতি বয়সী বিশ্বজিৎ নামের এক স্বপ্নময় দরিদ্র টেইলার মাস্টারকে জনারণ্যে কুপিয়ে, তার তাজা রক্ত নিজেদের শরীরে মেখে নিয়ে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে নিজেদের পবিত্র বিদ্যা উপার্জনের মহামন্দিরটির অঙ্গন সার্থক করে তুলেছিলো। অবশ্য সেটি ছিলো তাদেরই অন্যতম নিরাপদ অভয়ারণ্য - জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সিপাহী বিপ্লব স্মরণে নির্মিত উঁচু তোরণটিও জগন্নাথের সন্নিকটে – চাপাতির মাঝখানে একটি ছেলের বাঁচার আকুতি, সেই রক্তস্নান প্রত্যক্ষ করেছিলো। ক্ষণিক পূর্বে নীলক্ষেতের ক্ষুদ্র আকাশখানি প্রদক্ষিণ করে আসা, বর্তমানে দেবদারু বৃক্ষে স্থির কাকেরাও বিশ্বজৎ হত্যার অন্যতম সাক্ষী। এ-কথা নাগরিক কাকেরাও জানে, চাপাতি মহড়া শেষে এরা, এই তরুণেরা, কিছুক্ষণ পরই, হাকিম চত্বরে চা-সিঙারা খেয়ে বিল না দিয়ে ঘুমাতে যাবে। বের হবে সন্ধ্যায়।

কিন্তু রিকশাভ্যানে পরীবানুর আর সময় নাই। বোমের শব্দে সহসা মানুষের চিল্লাচিল্লি আর কাউয়াদের ভয়ঙ্কর প্রতিবাদের ভেতর, মনে হয়, সারা ঢাকায় ট্রাফিক সিগন্যাল বন্ধ হয়ে আছে। গরিবের বিপদ আসে পাহাড়ী ঢলের লাহান। চারদিক চাপাইয়া, আসমান জমিন ভাসাইয়া। দিকভ্রান্ত নীলুফা, ‘লা ই লা হা ইল্লা আন্তা ছোবহনাকা..’ পড়তে শুরু করলো। সে কিছুটা বিমর্ষ, দিশেহারাও। সঙ্গে অন্য কেউ তো নাই। রিকশাওয়ালাও এই গুড়ুম গুড়ুম হরতালের মইধ্যে নিজের বেকুপিপনার জন্য মনে মনে বিপদগ্রস্ত, শঙ্কিত। ভ্যান রিকশাটিই তার একমাত্র স্থাবর সম্পদ আর গায়ের ঘামঝরা খাটুনি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবিক ভয়াবহ শরমের ঘটনার জন্য সে অপ্রস্তুত, ফলে ঘটনার আকস্মিকতায় তার শ্রমক্লান্ত কোটরাগত চক্ষুজোড়া ভেতর থেকে বার হয়ে আসছে। ‘কোন ‍কুক্ষণে কার মুক দেইখ্যা আইজ ঘরবার হইছিলাম’ – এভাবে নিজেকে অভিশপ্ত করে সে।

এ সময়, পরীবানু, ‘ও মা গো’ কইরা একটা ভয়াবহ চিক্কুর দিলো। এতে ক্ষণিকের শান্তি পুনরায় বিঘ্নিত হওয়ায় কাকেরা কা কা করে ওঠে। দেবদারু বৃক্ষটিও নড়েচড়ে ওঠে।

একলা দিশাহারা, উপায়ান্তর না দেখে ঘামতে শুরু করেছে নীলুফা। সে পলিথিনের ময়লা পুটলিটা বাঁ-হাতে রিকশাওয়ালার দিকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘ও ভাই, এইডার মইধ্যে কাপড় আছে। একটা শাড়িকাপড় বার কইরা রিকশাডা এট্টু আড়াল দেন ভাই। কি অইলো, অক কইরা আছেন ক্যান, ধরেন !’ প্রায় আদেশের মতো এই কন্ঠস্বরে ভ্যাবাচেকা খায় রিকশাওয়ালা। কাপড় হাতে প্রকৃতই বিভ্রান্ত, নির্বাক রিকশাওয়ালা। এমন ঘটনার মুখোমুখি, বিশেষত, হরতাল তাড়িত এই আতঙ্কিত রাজপথে – চিন্তাশক্তি রহিত হওয়ার উপক্রমে ভিরমি খেয়ে পড়তে যেয়ে নীলুফার ধমকে কেঁপে ওঠে, ‘কি ভাই আপনেগো ও তো মা বইন আছে নাকি নাই ? কাপড়ডা দিয়া আড়াল দেন বেডা !’ চিৎকার করে ওঠে নীলুফা।

ন্যাড়া দেবদারু গাছটির তলেই ওয়েল্ডিং মেশিন কারখানা। তার পরেই সারি সারি লেপ তোষক বালিশের দোকান। হরতাল হলেও, দৈনন্দিন অভ্যাসে এরা দোকান খুলতে শুরু করেছিলো কেউ কেউ। গোলাগুলির কর্ণভেদী বিকট শব্দ, মানুষের দৌড়ঝাপ, আটকে পড়া গাড়ি, ট্যাক্সি, সিএনজি-রিকশার কৌতুহলোদ্দীপক চক্ষু-ভিড়ের ভেতর সন্তান প্রসব করতে যাচ্ছে পরীবানু। মেডিকেল এখনো বেশ দূর। রাজপথ আতঙ্কে স্তব্ধ এবং পিকেটার ও পুলিশের যৌথ সক্রিয়তায় এলোমেলো। রিকশাওয়ালাও এতক্ষণে বিগড়েছে। ‘কী এক মুছিবতে পড়লাম !’ – এই চিন্তায় সে চাকায় হাওয়া আছে কিনা পরখ করে।

এই সময় পরীবানু-নীলুফাদের, অন্ধকার চির রহস্যময় আল্লাহতালা সম্ভবত সাত আসমানের পর্দার আড়ালে একটু নড়েচড়ে উঠলেন। ফলে সারি সারি বেডিং স্টোরের সার্টারের মাথায় ঝোলানো শিশুতোষ কোলবালিশগুলো যৌন ক্ষুধার্ত বানরের বিচির মতো বাতাসে ছটপট করতে থাকে।

গোলাগুলির শব্দ এখন কিছুটা স্তিমিত, ঝিম মেরে আছে মানুষের কানের ভেতর। কিন্তু শত শত কাকের ডানা ঝাপটানিতে নীলক্ষেতের আকাশ এখন মুখরিত।

মোটর সাইকেল মেরামতের কারখানার কেরোসিন তেল-গ্রিজ এ চিটটিটে হাত দু’একজন শ্রমিক বের হয়ে আসে। তারা ঘটনা পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ছিলো। এক্ষণে, নীলুফার ছুঁড়ে দেয়া শাড়ি হাতে রিকশাওয়ালার বিমূঢ়-বিস্মিত-বিভ্রান্তির সহযোগী হতে পা’য়ে পা’য়ে এগিয়ে আসে। এদের কেউ কেউ লজ্জার একটা বাতুল শিরশিরানি উপেক্ষা করার সাহস সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়, রিকশাটা ঘিরে শাড়ি-কাপড়টা উঁচু করে ধরার প্রক্রিয়ায় হাত লাগায়। এতে, নীলক্ষেত মোড়ে, কাকের চক্ষুর নিচে, দেবদারু গাছটার তলে এক অভিনব ছাদহীন আড়াল নির্মিত হয়।  ক্রমশঃ হরতাল উপেক্ষা করা পথচারীর সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসু জোড়-চোখের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। রিকশাওয়ালাসহ রিকশাটি ঘিরে যাঁরা আড়াল নির্মাণ করেছিলো, তাঁদের মনুষ্যত্ব কিছুটা বিনম্রতার প্রলেপে মিটিমিটি – তারা সকলেই কিছুক্ষণ পূর্বেকার দায়িত্ববান সূর্যটির দিকে, তাঁদের জোড়–চোখগুলো শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলো।

পরীবানুর ধড়ফড়ানো কাতরানো হৃদয় দেবদারু গাছে বসা কাকের সমাবেশে মিলিয়ে যাবার পর, তার মৃত্যুসম চিৎকারে ফিনকি দিয়ে রক্তস্রোত নেমে এসে কাষ্ঠনির্মিত রিকশার পাটাতনের ফাঁকে, নীলক্ষেতের কালো পিচঢালা রাজপথে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বক্ষণে, নীলুফার ব্যতিব্যস্ত হাতের উপর একটি মানব শিশু ‘ওঁয়াঁওঁ’ করে ওঠে। হরতালের বোম-তান্ডব অবজ্ঞা করার পর, সমাগত পুরুষদের চোখে-মুখে এক ধরনের ধুলিমলিন প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়লে, দেবদারু গাছের কাকগুলো আরেকবার কা কা র’বে আকাশ প্রদক্ষিণ করার ইচ্ছায় উড়তে শুরু করে।

 

সমাপ্ত

 

2 Comments
  • avatar
    গোলাম ফারুক

    15 April, 2024

    কথাসাহিত্যিক খান ভাই, তোমার লেখাটা একনিমিষে পড়ে শেষ করলাম। ভেতরটা ভারী হয়ে গেল। বাস্তবতাকে গল্পের মাধ্যমে সুন্দর ও সহজ সরলভাবে যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তা এককথায় অসাধারণ । জয়তু খানভাই।

  • avatar
    রেদওয়ান খান

    16 April, 2024

    নিজের লেখা নিজেই আগে পড়লাম । ২/১টা বানান ভুল রয়ে গেছে । কম্পিউটারের ফুল স্ক্রিন (পুরোগামী পেজ) জুড়ে থাকার কারণে পড়তে গিয়ে খেই হারানো যে-কারোরই হতে পারে । গল্পগুলোকে অন্ততঃ দুই কলামে সাজানো হলে বা রাখলে পড়ার সুবিধা হয় বলে আমার ধারণা । কলাম ও সামান্য অলংকরণ হলে মন্দ হয় না । গল্পটি নির্বাচিত ও প্রকাশ করার জন্য পুরোগামী টিমের জন্য ভালোবাসা ।

Leave a reply