ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ-বর্বরতা কী আজকের বিশ্ব ভূ-রাজনীতির পরিণতি?

লিখেছেন:স্বপন পাড়িয়া

গাজায় ‘সভ্য’ দুই দেশের আদিম হিংস্রতার বিরূদ্ধে এই মুহূর্তে তামাম দুনিয়ার শতাধিক দেশের সংবেদী প্রতিবাদী মানুষের উত্তাল আওয়াজ “আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই / স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের / চিতা আমি তুলবই”। ‘হামাসবিরোধী যুদ্ধ’র নামে স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টানীয়দের নাছোড় একরোখা জেদী আওয়াজকে চিরতরে স্তব্ধ করতে যেন আদিমতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে জায়নবাদী ইজরায়েলি সেনা সঙ্গতে মার্কিনশক্তি। অবারিত বোমাবর্ষন থেকে নবজাত শিশু কি বৃদ্ধ নর-নারী কারোর কোনো রেহাই নেই। আক্রমণের জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে সর্বাধিক জনবহুল এলাকাগুলিকে। এখনই মোট মৃত্যু ছাড়িয়েছে তেইশ হাজার। প্যালেস্টাইন আজ মনুষ্যত্বের কবরখানা। এ এক নয়া ‘নাকবা’। অন্যরূপে হলোকস্ট, কেবল পক্ষবদল মাত্র। সারা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে দেখছে সভ্যতার বলাৎকার। যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘকে অকার্যকারী করেছে মার্কিন ভেটো। যুক্তরাজ্যের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। বাইডেন ঊবাচ “যদি ইজরায়েলের অস্তিত্ব না থাকে তাহলে আমাদের একে আবিষ্কার করতে হবে”। তাহলে কি পশ্চিম এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষার্থে ইজরায়েল শতরঞ্জের বোড়ে? ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ এক প্রক্সিওয়ার? এ যুদ্ধ থেকে ইজরায়েলের পশ্চাদপসরণ একমেরু বিশ্বের অবসানের ইঙ্গিতবাহী?

এসব প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তরের পশ্চাদভূমিতে অস্তিত্বমান এক বাস্তবতা। বর্তমান পুঁজিবাদের জীবনপ্রবাহের চলাচল বাণিজ্যপথে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যম কোন মুদ্রায় হবে? ডলারে, ইউয়ানে, ইউরোতে নাকি আরো অনেকগুলি মুদ্রায় - অধুনা বিশ্বায়িত পৃথিবীতে এ নিয়ে বহু বিবাদ। বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে জারি আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রারূপী ডলারের রমরমা আর নেই। এতদিন যুক্তরাজ্য ডলারের জোরে তাদের দেশের সমস্ত সঙ্কট দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে চালান করেছে, আর বিভিন্ন সংঘর্ষের অঞ্চলে একতরফা বৈদেশিক নীতি নিয়েছে। জাতীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক বিবাদ স্বাভাবিক। পুঁজি কিন্তু স্বনিযুক্ত ভৌগলিক বাধার মাঝেই আঞ্চলিক বাণিজ্যগোষ্ঠী গড়ে তুলবে। চীন, রাশিয়া এবং আমেরিকার নেতৃত্বে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি অনেকগুলি। সেখানে বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় চলে। বহুমেরু বিশ্বের পথ উন্মুক্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন একতরফা সিদ্ধান্ত শরনার্থী সমস্যায় জেরবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মানেনি। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধেও তাই। বরং ইউরোপ এখন রাশিয়ার সাথে যৌথতায় আবদ্ধ। রাশিয়া, চীন ও জার্মানির পশ্চিমী কর্পোরেট শক্তির জন্য ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে এখন আমেরিকার প্রতিযোগী। এছাড়া চীন রাশিয়ার সহযোগিতায় পুঁজিবাদী কৌশলেই বিবদমান ইরান আর সৌদি আরবকে (মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের মার্কিন সঙ্গী) একস্থানে করে ফেলেছে। আবার অন্যদিকে শিয়া-সুন্নী বিবাদকে অতিক্রম করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকে প্যালেস্টাইনের পক্ষে একজোট করে ফেলেছে। পৃথিবীর উদীয়মান বাজার অর্থনীতির অনেক দেশকেই ব্রিক্স এ যুক্ত করে পুঁজিবাদী সহযোগিতার আবহ তৈরিতে অগ্রসর।  ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে অধুনা যুক্ত সৌদি আরব, ইরান, ইউনাইটেড আরব ইমিরেটস, ইথিওপিয়া এবং মিশর। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে পশ্চিম এশিয়ার ঊনিশটি দেশকে যুক্ত করে ফেলেছে। মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের সামনে তা চ্যালেঞ্জ বৈকি। আপাতত আজকের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিমেরুর চেহারাটাই আমাদের সামনে অনেকখানি স্পষ্ট। হামাস, হুটী বা হিজবুল্লাহ কোন শক্তির সাহায্যপুষ্ট সেটাও অনেকখানি স্পষ্ট। আগামী পৃথিবী দ্বিমেরু, বহুমেরু নাকি অন্যকিছু তা ভবিষ্যত বলবে। অন্তত এটুকু বলা যায় পৃথিবী পুঁজিবাদের সমস্ত হিংস্রতা ও অসামাজিকতা নিয়ে বিরাজমান থাকবে অন্তত বেশ কিছুকাল, যুগের বিচারে যা অনেক সময়।   

এ যুদ্ধ যতদিন চলবে বিশ্বের জনমানসে আমেরিকা এবং ইজরায়েল একাকী হয়ে পড়বে। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন ইজরায়েল পক্ষ নিঃশেষিত হবে অনেকখানি। অন্য মেরুর স্বার্থ সেখানে। সকলেই নিজের ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত। প্যালেস্টানীয় জনতার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার ভবিষ্যত তাহলে কী? বিশ্ব জুড়ে জনতার প্রতিবাদ। অন্তত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বা রোয়ান্ডায় হুটু, টুটসি গনহত্যায় পৃথিবীর রাষ্ট্রশক্তিগুলির মুখ ঘুরিয়ে থাকার সাথে বিশ্ব জনতার নীরবতা এক্ষেত্রে ঘটেনি। শতাধিক দেশের প্রতিবাদী মানুষের ধারাবাহিক প্রায় আট হাজারের অধিক প্রতিবাদ সভা জানান দেয় অন্য পরিবর্তনের। ইজরায়েল সহ আমেরিকা ইউরোপের দেশগুলিতে “আমাদের নামে নয় এ গণহত্যা” ব্যানারে খোদ ইহুদিদের প্রতিবাদ বা আরব দেশগুলিতে জনতার এই যুদ্ধের বিরোধে রাস্তায় নামা, যে দেশগুলির সরকারকে প্যালেস্টাইনের পক্ষে দাড়াঁতে যথেষ্ট চাপে রেখেছে বলা বাহুল্য। সর্বোপরি এই যুদ্ধ প্রায় ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেওয়া প্যালেস্টাইন প্রশ্নকে সারা দুনিয়ার সামনে এনে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক ভাবে ‘গ্লোবাল সলিডারিটি স্ট্রীট’ (এখানে একজোট হয়েছে সত্যানুসন্ধানী বিশ্লেষক, র‍্যাডিকেল বুদ্ধিজীবি, বিকল্প মিডিয়ার মানুষ এবং সামাজিক মাধ্যমের সৃষ্টিশীল ব্যবহারিকেরা) নামে সংহতিমঞ্চ পশ্চিমী মিডিয়ার একাধিপত্যে ফাটল ধরিয়ে সত্যপ্রচারে যুদ্ধের ন্যারেটিভ বদলে ফেলতে পেরেছে। সাতই অক্টোবরের হামাস হামলার খবরের ঘেরাটোপ ভেঙে সতের বছরের প্যালেস্টাইন দখলদারী সামনে এনেছে, প্যালেস্টানীয়দের ডেমনাইজেসনের স্থলে তাদের মানবিক সঙ্কট তুলে এনেছে বিকল্প ছবি খবর ভিডিওর মাধ্যমে। ‘শিশুদের কবরখানা’ গাজাভূমিতে ‘গণহত্যার কেতাবি ধরন’ পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করেছে। সংঘটিত করেছে প্রায় সারা পৃথিবীজুড়ে প্রতিবাদ। অবস্থা দেখে মনে হয় দুই রাষ্ট্র বা এক রাষ্ট্র যেভাবেই হোক না কেন, প্যালেস্টাইন সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা অনেকখানি।         

* মতামত লেখকের নিজস্ব 

 

1 Comments
  • avatar
    আবু সিদ্দিক

    20 January, 2024

    গাজায় গনহত্যা, এথনিক ক্লিনসিং চলছে। এর পিছনে মার্কিন পুঁজিবাদ। দেখে মনে হচ্ছে জোর যার মুলুক তার। ইউএনও, আন্তরজাতিক আইন, নানা সামরিক অসামরিক চুক্তি সব লোক দেখানো। লেখক অল্প কথায় পুঁজিবাদের হিংসার স্বরূপ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আর এই পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে প্রতিবাদও হচ্ছে। এটিই আশার কথা। ধন্যবাদ।

Leave a reply