ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, কূটনীতি ও অপারেশন সিঁদুর: একটি বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা

লিখেছেন:ভাস্কর সিন্‌হা

 

প্রাককথন:

ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি জ্বলন্ত অধ্যায়, যার জটিলতা ও গভীরতা বহু গবেষক, ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের যুগ যুগ ধরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এই দুই দেশের জন্ম দিলেও সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এক অদ্ভুত শত্রুতা ও সংবেদনশীল বন্ধুত্বের ভারসাম্য বিরাজ করছে। কেবল রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা সীমানাগত বিরোধ নয়, এর অন্তর্নিহিত কারণ নিহিত রয়েছে দুই দেশের জাতীয় চেতনা, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, এবং মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিতে।

ভারত-পাকিস্তানের এই সম্পর্কের জটিলতার মূল শিকড় হলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিকে নেওয়া হঠকারী ও তড়িঘড়ি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন তার শেষ কামড় দিয়ে যায় দ্বিজাতি তত্ত্বের পালে হাওয়া লাগিয়ে। তাদের সাথে হাত লাগায় কিছু ক্ষমতালিপ্সু দেশীয় রাজনীতিক। এবং চিরকালের এক কুরুক্ষেত্র ভূমির পটভূমিকা তৈরি হয়ে যায়, যার জন্য চার্চিল সেই কবে থেকে সলতে পাকানো শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের বিভাজন কেবল ভূমির বিভক্তিই ছিল না, ছিল একটি সংস্কৃতি ও সভ্যতার হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদ। কাশ্মীর ইস্যু সেই বিভাজনের সবচেয়ে স্পষ্ট ও সংবেদনশীল উদাহরণ, যা দুই দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ককে বারংবার গভীর সংকটে ফেলেছে। উভয় দেশই এই ভূখণ্ডটিকে নিজেদের জাতীয় পরিচয় ও মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করেছে। তাই কাশ্মীর বিতর্ক শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক বিরোধ হিসেবে সীমিত থাকেনি, বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গভীর সংকটে পরিণত হয়েছে।

এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে ভারত-পাকিস্তানের সামরিক সংঘাত ছিল অনিবার্য। ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধগুলো ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলেছে। বিশেষত, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের গতিপথই বদলে দেয়। পাকিস্তানের ভেতরে তৈরি হয় গভীর নিরাপত্তাহীনতা ও ভারতের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস। অন্যদিকে ভারতেও ক্রমাগত পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং গোপন ষড়যন্ত্রের শঙ্কা তৈরি হতে থাকে।

১৯৮৪ সালের ‘অপারেশন মেঘদূত’ ছিল এই অবিশ্বাস ও সংঘাতেরই আরও একটি জটিল উদাহরণ। পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেনে ভারতের সেনাবাহিনী এই অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানের পরিকল্পনাকে পরাস্ত করে ওই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সিয়াচেন হিমবাহের মতো চরম আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে এমন একটি অভিযান পরিচালনা করা সামরিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এই অভিযানের মাধ্যমে ভারত নিজেদের সামরিক কৌশলগত সক্ষমতা যেমন প্রমাণ করে, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ভারসাম্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। অপারেশন মেঘদূত ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের পরবর্তী প্রতিটি আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

এই অভিযান কেবলই একটি সামরিক উদ্যোগ নয়; এটির মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছানো। ভারতের জন্য সিয়াচেনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ছিল পাকিস্তানের প্রতি একটি কঠোর সংকেত, যা পরবর্তীতে দুই দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের গতিপথকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের জন্য সিয়াচেনে ভারতের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ছিল একটি সরাসরি বড় ধাক্কা, যা তাদের পরবর্তী সামরিক ও কূটনৈতিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে।

এর যুগ-পরবর্তী প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী। সিয়াচেনকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বহুবার আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আজও এই সমস্যা সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবিশ্বাস ও কৌশলগত স্বার্থ। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের জটিলতা এবং সংবেদনশীলতার এই সূক্ষ্ম ও গভীর বিশ্লেষণ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অপারেশন সিঁদুরের আলোকে দুই দেশের সম্পর্কের এই গভীর, বিস্তৃত এবং বহুমাত্রিক বিশ্লেষণই এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্যকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের জন্ম ইতিহাসের পাতায় যতটা নাটকীয় ও তাৎপর্যময়, তার চেয়েও বেশি প্রভাবশালী ছিল সেই জন্মের পরবর্তী ঘটনাবলি। এই দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তিতে ধর্মীয় পরিচয়ের বিভাজনই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত, এই দ্বিজাতি তত্ত্বের ফসল হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তি তৈরি করেছিল এক অন্তহীন সংকট ও সংঘাতের পরিবেশ।

প্রথম বড় ধরনের সংকট হিসেবে আসে কাশ্মীর প্রশ্ন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং যখন ভারতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন, তখন থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাতের সূচনা ঘটে। সেই সময়ের কাশ্মীর যুদ্ধ (১৯৪৭-১৯৪৯) দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এমন গভীর ছাপ ফেলেছিল যা আজও এই অঞ্চলের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই যুদ্ধ শুধু সামরিক শক্তির প্রদর্শনই ছিল না, বরং দুই দেশের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল (Dixit, 2002)।

এরপর, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধেও দুই দেশের সামরিক দ্বন্দ্ব কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। পাকিস্তান পরিচালিত অপারেশন জিব্রাল্টার এবং ভারতের পাল্টা সামরিক জবাব এই যুদ্ধকে আরও জটিলতর করে তোলে। সেই সংঘাতের মধ্যেই উঠে আসে দুটি দেশের অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদী আবেগের তীব্রতা এবং পরস্পরের প্রতি গভীর অবিশ্বাস। যুদ্ধের পর, তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে কিছুটা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও, এই শান্তি ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর ও অস্থায়ী (Ganguly & Hagerty, 2005)।

তবে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এই যুদ্ধ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সরকার পোষিত দীর্ঘ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি, যেখানে ভারত সরাসরি সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করেছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে গভীর ও স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। পাকিস্তানের জন্য এই ঘটনা ছিল জাতীয় ও সামরিক মর্যাদায় এক অপূরণীয় ক্ষতি, যার প্রভাব পড়ে দুই দেশের পরবর্তী কয়েক দশকের সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত সম্পর্কে গভীর নিরাপত্তাহীনতা ও সন্দেহ তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে তাদের বিদেশনীতি ও সামরিক নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে (Sisson & Rose, 1990)।

এই তিনটি বড় ঐতিহাসিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটেই বোঝা যায় যে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক প্রশ্ন নয়; এটি সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বেরও এক গভীর প্রতিফলন। বিভক্তির এই ঐতিহাসিক পটভূমি থেকেই দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সন্দেহের জন্ম হয়। বিশেষ করে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সমাজের মধ্যে, ইতিহাস ও রাজনীতির ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিভেদের দেয়াল আরও দৃঢ় হয়, যা পরবর্তীকালে যেকোনো শান্তি প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলেছে (Cohen, 2004)।

এই দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের মধ্যে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো ছোট-বড় নানা অভিযান দুই দেশের সম্পর্ককে বারবার নাড়া দিয়েছে, নতুন করে প্রশ্ন তৈরি করেছে, এবং নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই দুই দেশের সম্পর্কের মূল সংকটগুলো আজও একই রয়ে গেছে— পারস্পরিক নিরাপত্তাহীনতা ও দ্বিপাক্ষিক বিশ্বাসের অভাব। এই বিষয়গুলো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কোনো স্থায়ী সমাধান আশা করা যায় না। তাই এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই দুই দেশের কূটনৈতিক ভবিষ্যতের পথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

কাশ্মীর বিরোধের গভীর বিশ্লেষণ:

কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক সংকট ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শুধু ইতিহাসের পাতাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমাধান আজও অধরা। এই অঞ্চলের দ্বন্দ্বের চরিত্রে রয়েছে ঐতিহাসিক অধিকার দাবি, জাতীয়তাবাদী আবেগ এবং ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জটিল সমীকরণ।

কাশ্মীর ভূখণ্ডের বিশেষ মর্যাদা ছিল ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী, যা ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ভারত সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীর সংকটকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে। তবে এই সংকটের মূল সূত্রপাত সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই, যখন জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পাকিস্তান সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম বড় কারণ (Lamb, 1991)।

বিশেষ করে আশির দশকের শুরুতে সিয়াচেন হিমবাহ অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পায়। ১৯৮৪ সালের 'অপারেশন মেঘদূত' নামে ভারতীয় সেনাবাহিনী সিয়াচেন হিমবাহের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলি দখল করে নেয়। এই অপারেশন সিয়াচেনের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ সিয়াচেনের নিয়ন্ত্রণ মানে কৌশলগত উচ্চতা ও সামরিক সুবিধা অর্জন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত সিয়াচেনের যুদ্ধ দুটি দেশের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। এই অঞ্চলে সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা দুপক্ষের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কঠিন প্রমাণিত হয়েছে, তবুও দুই দেশই নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে (Verma, 2002; Wirsing, 1994)।

কাশ্মীর সংকটের এই জটিলতার পিছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জলসম্পদের নিয়ন্ত্রণ। সিন্ধু নদীর জল ভাগাভাগি দুই দেশের মধ্যে ১৯৬০ সালের সিন্ধু জলচুক্তি অনুযায়ী হলেও, দুই দেশের মধ্যকার সামরিক সংঘাতের সময় বারবার এই জলসম্পদ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষত কাশ্মীর অঞ্চলের নদীগুলো দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি, অর্থনীতি ও জনসংখ্যার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে দুই দেশই এই অঞ্চলের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া (Briscoe, 2010)।

কাশ্মীরের সামরিকীকরণ এবং সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ঘটনাগুলিও এই সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। আশির দশকের শেষ দিক থেকে কাশ্মীরে পাকিস্তান সমর্থিত সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির তৎপরতা বৃদ্ধি পায়, যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে স্থায়ী উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০১ সালের ভারতীয় সংসদে হামলা, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা এবং ২০১৬ সালের উরি হামলার মতো ঘটনা দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা ও অবিশ্বাসকে আরও গভীর করেছে। এই ধরনের হামলাগুলির ফলে দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়াগুলো বারবার ব্যাহত হয়েছে (Fair, 2014)।

কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের জন্য দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হলেও সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চাপ এবং আন্তর্জাতিক সমীকরণ এই আলোচনাগুলোর সাফল্যের পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করেছে।

অপারেশন সিঁদুর:

২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহের এক গভীর মধ্যরাতে, যখন ঘড়ির কাঁটা অতিক্রম করল রাত ১:০৫, তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী শুরু করল তাদের এক নজিরবিহীন সামরিক অভিযান—'অপারেশন সিঁদুর'। প্রায় আধঘণ্টারও কম সময়ে, ঠিক ১:৩০ মিনিটে শেষ হওয়া এই ত্রিবাহিনীর সমন্বিত অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে সক্রিয় ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করা। এই অভিযান ছিল মূলত একটি প্রতিরোধমূলক ও পূর্ব-প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ, যা ২২ এপ্রিল, ২০২৫ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকার পহেলগামে ঘটে যাওয়া নৃশংস হামলার প্রত্যুত্তর হিসেবে নেওয়া হয়। ওই হামলায় ২৫ জন ভারতীয় এবং ১ জন নেপালি নাগরিক প্রাণ হারান, যা পুরো দেশকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা হামলার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন 'দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)'-কে। যদিও হামলার পরপরই এই সংগঠনটি দায় স্বীকার করে, কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যময় ভাবে তাদের বক্তব্য থেকে পিছু হটে সাইবার হামলার অজুহাত দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে কেবল প্রতিরোধ নয়, বরং সমূলে নির্মূল করতে একটি বিস্তৃত ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন আছে।

অপারেশন সিঁদুরের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর সূক্ষ্মতা ও সুপরিকল্পিত আঘাতের প্রকৃতি। অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে পাকিস্তানের সরাসরি সামরিক স্থাপনাগুলোকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা ন্যূনতম হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এই অভিযানকে "কেন্দ্রিক, মেপে নেওয়া এবং অ-উত্তেজক" বলে অভিহিত করেন, এবং ভবিষ্যতে এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথাও ঘোষণা করেন। এই অভিযানের ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—১০০ জনেরও বেশি সন্ত্রাসবাদী নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জৈশ-ই-মোহাম্মদের অন্যতম প্রধান নেতা আব্দুল রউফ আজহার। তার বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় বিমান আইসি-৮১৪ ছিনতাই এবং আমেরিকান সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। পাশাপাশি নিহত হন মাসুদ আজহারের পরিবারের আরও ১০ সদস্য।

১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এটাই ছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে বড় ও সাহসী অভিযান। পূর্বের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক (২০১৬) এবং বালাকোট বিমান হামলা (২০১৯) যেখানে নির্দিষ্ট হামলার প্রতিক্রিয়া ছিল, সেখানে অপারেশন সিঁদুর ছিল পূর্বপরিকল্পিত, বিস্তৃত পরিসরের এক সুসংগঠিত সামরিক অভিযান। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি কৌশলগত স্থান এই অভিযানের আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ছিল মুরিদকে—লস্কর-ই-তৈয়বার সদর দপ্তর, এবং বাহাওয়ালপুর—জৈশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান ঘাঁটি। এছাড়াও হিজবুল মুজাহিদিনসহ অন্যান্য ভারতবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ শিবির ও পরিকাঠামো ধ্বংস করা হয়।

এই অভিযানটি ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করেছে, যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে সক্রিয় ও বহুমাত্রিক আক্রমণাত্মক মনোভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অপারেশন সিঁদুরের সফল বাস্তবায়ন তাই শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, বরং কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

কূটনৈতিক সম্পর্ক:

সিয়াচেনের দখল এবং অপারেশন সিঁদুরের পরবর্তী সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক গভীরভাবে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। পাকিস্তান অবিলম্বে এই অভিযানকে ভারতের ‘আগ্রাসী সামরিক কৌশল’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরে, এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানায়। অন্যদিকে, ভারত তার অবস্থান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে এই অভিযান ছিল সম্পূর্ণরূপে সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। এই প্রেক্ষিতে, উভয় দেশের কূটনৈতিক যোগাযোগ প্রাথমিকভাবে বেশ উত্তপ্ত ও জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে থাকে।

অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র ও দ্রুত। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ভারতকে অভিযুক্ত করেন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের জন্য এবং বলেন যে এই ধরনের পদক্ষেপ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদপত্র পেশ করে। এই প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা লঙ্ঘন করেছে এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।

ভারতও পাল্টা জবাবে পাকিস্তানের কাছে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না হলে এই ধরনের সামরিক পদক্ষেপ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে উল্লেখ করা হয় যে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষার্থে এই অভিযান প্রয়োজন ছিল। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভারতের ধৈর্য্য সীমাহীন নয় এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে তারা পিছপা হবে না। এই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক পরিবেশকে আরও জটিল করে তোলে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ঘটনাকে গভীর উদ্বেগের সাথে গ্রহণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয় পক্ষকেই সংযম বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে আহ্বান জানায়। চীন পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন বজায় রেখে ভারতকে সংযত হতে অনুরোধ জানায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় উভয় পক্ষের সংলাপের ওপর জোর দেয়। রাশিয়া, ভারতের ঐতিহাসিক সহযোগী হিসেবে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানালেও সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকির প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানায়।

অপারেশন সিঁদুরের পরবর্তী সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ: 

অপারেশন সিঁদুর দুই দেশের সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অভিযানটি ভারতের কৌশলগত মনোভাবের স্পষ্ট পরিবর্তন এবং পাকিস্তানের প্রতি কঠোর অবস্থানের বার্তা দেয়। এটি ভারতের প্রতিরক্ষা নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত, যেখানে ভারত স্পষ্ট করেছে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তারা কঠোর এবং সক্রিয় ভূমিকা নেবে।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও, ভারতের সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা সীমিত প্রভাব ফেলে। তবে দুই দেশের মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও গভীর হয় এবং এর ফলে সামরিক উত্তেজনা হ্রাসের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। মূল বিষয়গুলোর সমাধানে উভয় পক্ষের মধ্যে গভীর মতানৈক্যের কারণে সমাধান অধরাই থেকে গেছে। কূটনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন দুই দেশের পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতার নতুন পথ সন্ধান করা, যা আগামী দিনে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

বর্তমান বিশ্বে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক শুধু উপমহাদেশ নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার উত্তেজনার রেশ বহু বছর ধরেই চলছে। বিশেষত ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার সংলাপের আহ্বান জানিয়ে এসেছে, তবুও কূটনৈতিক সমাধানের পথে বাস্তবিক অর্থে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি। পাকিস্তান তার জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মদত দেওয়া বন্ধ করুক। কে না জানে যে ওসামা বিন লাদেনকে তারাই রক্ষা করছিল।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে তা সীমিতই রয়ে গেছে। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্তমানে প্রায় স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। অথচ অতীতে দেখা গেছে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় পক্ষের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা তৈরি হয়, যা কূটনৈতিক আলোচনার জন্য ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে (Bose & Jalal, 2011)।

সাংস্কৃতিক দিক থেকেও দুই দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক মিল রয়েছে। উর্দু ও হিন্দি ভাষা, সংগীত, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যকার সংযোগ অত্যন্ত গভীর। বহু ভারতীয় শিল্পী যেমন নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি পাকিস্তানের দর্শকদের কাছে প্রিয়; তেমনই পাকিস্তানের শিল্পী নুসরত ফতেহ আলি খান, মেহেদি হাসান, আবিদা পারভিন ভারতীয় দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। ক্রিকেট, দুই দেশের মানুষের হৃদয়ের গভীর আবেগ ও ভালোবাসার বিষয়, যা রাজনৈতিক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যায়। সুতরাং, দুই দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলে তা পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তি তৈরি করতে পারে (Ganguly & Kapur, 2010)।

কূটনৈতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসি বা অপ্রাতিষ্ঠানিক সংলাপের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে দুই দেশের সাবেক কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীরা আলোচনায় বসে পরস্পরের মতামত বুঝে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। এমন সংলাপ থেকে উঠে আসা প্রস্তাবনা সরকারি পর্যায়ে আলোচনার পথ খুলে দিতে পারে।

সর্বোপরি, দুই দেশের নেতৃত্বকে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তরিক হতে হবে। দুই দেশের জনগণের স্বার্থেই শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংঘাতের বদলে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে।

উপসংহার:

ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সংঘাত, বৈরিতা ও কূটনৈতিক অস্থিরতার এক দীর্ঘ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু হয়ে কাশ্মীর বিরোধ, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, কার্গিল সংঘর্ষ, এবং সর্বশেষ অপারেশন সিঁদুর পর্যন্ত এই সম্পর্কের জটিলতা ক্রমশ বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে। এই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সিয়াচেনের নিয়ন্ত্রণ ও 'অপারেশন সিঁদুর' নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়, যা দুই দেশের সামরিক-কৌশলগত চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজকের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী, আন্তরিক ও গভীর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

পারস্পরিক অবিশ্বাস দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। এই অবিশ্বাসের উৎস হলো ঐতিহাসিক সংঘাতের স্মৃতি, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত। এই অবিশ্বাস দূরীকরণের জন্য প্রথমেই উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আলোচনার নতুন পথ খুঁজতে হবে। দ্বিপাক্ষিক সংলাপের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পারস্পরিক সহানুভূতি ও আস্থা তৈরি করা জরুরি। এই লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে বিনিময় কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা যেতে পারে। দুই দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা নীতি সহজ করা হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

এছাড়া শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়ায় নতুন ধারার সূচনা করতে হবে, যেখানে কেবল সরকারি পর্যায় নয়, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে উভয় দেশের সাবেক কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে ঐকমত্যের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত জাতিসংঘ, সার্ক এবং অন্যান্য প্রভাবশালী দেশসমূহের সহযোগিতা দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই সহযোগিতার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অচলাবস্থা নিরসনে নতুন আলো দেখা যেতে পারে।

ভারত-পাকিস্তানের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। রাজনৈতিক নেতাদের সংকীর্ণতা ও জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেবলমাত্র আন্তরিক প্রচেষ্টা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং বাস্তবসম্মত সমঝোতার মাধ্যমেই দুই দেশের সম্পর্ক নতুন দিগন্তে পৌঁছতে পারে। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দুই দেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তারা সংঘাতের অতীতকে বহন করে চলবে নাকি শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবে।

সুতরাং, দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই কেবল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের স্থায়ী ও ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে অপারেশন সিঁদুরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সচেতন ও দূরদর্শী পদক্ষেপই হবে উপযুক্ত কৌশল।

তথ্যসূত্র:

  • Ganguly, Sumit (1994). The Origins of War in South Asia: Indo-Pakistani Conflicts since 1947. Westview Press.
  • Verma, Ashok K. (2002). Siachen Glacier: The Battle of Roses. Manas Publications.
  • Joshi, Manoj (1987). Operation Meghdoot: A Strategic Analysis. Journal of Strategic Studies, Vol. 10, Issue 3, pp. 35-55.
  • Dixit, J.N. (2002). India-Pakistan in War and Peace. Routledge.
  • Cohen, Stephen P. (2013). Shooting for a Century: The India-Pakistan Conundrum. Brookings Institution Press.
  • Mohan, C. Raja (2015). Modi's World: Expanding India's Sphere of Influence. HarperCollins Publishers India. 
  • Ganguly, Sumit, and Devin T. Hagerty. Fearful Symmetry: India-Pakistan Crises in the Shadow of Nuclear Weapons. University of Washington Press, 2005.
  • Sisson, Richard, and Leo E. Rose. War and Secession: Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh. University of California Press, 1990.
  • Cohen, Stephen P. The Idea of Pakistan. Brookings Institution Press, 2004.
  • Lamb, Alastair. Kashmir: A Disputed Legacy, 1846-1990. Oxford University Press, 1991.
  • Verma, Bharat. Indian Defence Review, Volume 17, Issue 1. Lancer Publishers, 2002.
  • Wirsing, Robert G. India, Pakistan, and the Kashmir Dispute. St. Martin's Press, 1994.
  • Briscoe, John. Water and Security in South Asia. Harvard University Press, 2010.
  • Fair, Christine. Fighting to the End: The Pakistan Army's Way of War. Oxford University Press, 2014.
  • Bose, S., & Jalal, A. (2011). Modern South Asia: History, Culture, Political Economy. Routledge.
  • Ganguly, S., & Kapur, S. P. (2010). India, Pakistan, and the Bomb: Debating Nuclear Stability in South Asia. Columbia University Press.
  • Mohan, C. R. (2015). Crossing the Rubicon: The Shaping of India's New Foreign Policy. Penguin Books India.

 

ছবি - https://ddindia.co.in/

 

0 Comments
Leave a reply