গুচ্ছ কবিতা

লিখেছেন:রঞ্জন চৌধুরী

রুটিন চেক 

১.

নদীর পাড়ে এলে কেন জানিনা নৌকোর কথা মনে পড়ে। নৌকোর কথা মনে পড়লে তার মাঝি, হাল, জলের কালোয়াতি, আর মনে পড়ে চিকিমিকি বালিয়াড়ি। আপনবিন্দুতে স্থির হয়ে নয়নে নয়নে ফিরে এসে বালির ঢিপি জড়ো করে, ঘর বাঁধে, তারপর ভেঙে দিয়ে চলে যায় প্রথম ইস্কুল যাওয়া দামাল ছেলেবেলা।

২.

চুনো চুনো ঝিনুক লজ্জা হারিয়েছে। যৌবন ছুঁতে চলে যায় ডুবজলে এদিক-ওদিক। ছাপানো রোদ আড়াল করে টঁইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়া প্রেম, গাছের ছায়ায়। সাঁতারের অছিলায় ভেসে যায় কলসের মত মুখবন্ধ খাম। তাতে কি প্রণয় ছিল! চিন্তাস্রোতে কিছুতেই মনে করতে পারেনা হুঁ হুঁ দূরের হাওয়া ও লাবণ্য কফিকাপ ।

৩.

ধুলোপড়া আয়না। ভাঙাচোরা মুখ। চিনতে পারছো ! অদিতি গো অদিতি — সপাটে বলা দুটো-তিনটে শব্দ আলতো পায়ে হেঁটে ওঠে একতলা-দোতলা, রাত্রির মায়ার বিকার মাখা ঘর থেকে দূর, ভাবলেশহীন, নিভৃত, নিঃসঙ্গ। 'সম্পর্ক কি কোন ক্লিষ্ট ইতিহাসের মিথ্যে আয়না' — কে যেন এই সুরে শব্দকরতলে গান ধরে মাতাল হাওয়ায়।

৪.

ছিল বটে সেইসব দিন। তামাটে মেঘের পাশে ছিল ছল ছল জল, অযতিচিহ্ন... । মানচিত্র ধৃত নয় যেথায়, বরং ছিল বহু কিছু চাই, জ্যামিতিপ্রবাহ, হা-ভাতের কংশাল ঠুকে অর্থের বহুবিধ বিকল্প। আচমকাই উড়ে গেছে বয়সের ভারে। কোথায় থামাবো তাকে সপার্ষদ ! স্মৃতি যে চলমান, জীবন যে গরীব খুব, কথা শোনেনা। ছুটে যেতে চায় শুধু বাঁকের পর বাঁক।

৫.

যদি বলো তবে কথা শেষ করি। শবযাত্রায় সামিল হই স্বয়ং। আত্মীয়-স্বজন সুরভিত, ভরাট তো হয়ে আছে আরো কত ! কারাগারে যেতে চাইনা, মুক্ত হতে চাই। হেঁটে ফেলেছি অনেক হে আমার প্রিয় জনপদ, ভ্রমণের অভিসারে স্পৃহা ও শ্রুতি। ঐ দেখো দেখা যায় মেঘে ঢাকা তারা, আকাশ ছাড়া। মনে রেখো, কেউ না হোক, তুমি অন্তত দিনের রকম, বেলুনগাড়ির পিছু ছুটে ছিল কেউ একদিন, বৃষ্টির পর মাটিতে লেগে ছিল তার অচ্যূত পায়ের দাগ । 

 

নিরুদ্দেশের প্রতি 

মাটি ওপড়াতে ওপড়াতে আবহাওয়া সঙ্গীত বেজে উঠলো। ঘোষক বললো নাচ শুরু হবে। নাচার লোক অনেক। কে আগে নাচবে !

#

ইতিমধ্যেই রাজা মত একটা লোক, ছোট্ট মত কিছু একটা বললো, অমনি নীল আলো আরো ঘন হলো। নাচ শুরু হলো। উদ্ভট সব যে যার মত নেচে উঠলো।

থামার লক্ষণটি নেই।

#

রাজা খুশ। এরই মধ্যে মুখ পাতলা কে যেন বলে উঠলো - দলীয় নিধন চলছে। আছড়ে পড়লো একটি পাথর, তারপর রেনেসাঁস রেনেসাঁস বলতে বলতে সেই যে একটা পাগল উধাও হলো, আজো খুঁজে চলেছে তাকে ঢাউস ঢাউস এক একটি পোষ্টার ।

      

প্রসঙ্গ ক্রমে 

নিচু মেঘে বৃষ্টিপাত
নিচু মেঘে তোমাকে পাওয়া
মনে পড়ে
সেদিন ছিল তোমার ছাতা হারানোর দিন
মাথা বাঁচাতে জড়ো হয়ে ছিলাম নিচু টিনের এক
                                            ছাউনির তলে
#

আজও তেমনি একটি দিন
চলো চুপিসারে জানালাটা খুলে দিই
আর বলি —
ওহে মেঘ ওহে বজ্র ওহে বৃষ্টি
সেই থেকে আমরা আজও পালাতে পারিনি
রয়ে গেছি হৃদি চলাচল বন্ধনবৃত্তে একসাথে
সংসারে, সংসারের মায়াঘোরে
     

স্বপ্নের ফানুসে চড়ে 

গ্রহ নক্ষত্র তাবিজ কবচ কুন্ডলী খুইয়ে শুয়ে আছি
                      এখন পৃথিবীর আরোগ্যনিকেতনে
আমার চারপাশে জোনাকি আলো
পুটুস করে একবার জ্বলছে আর একবার নিভছে
সারাদিন লেগে আছে নানা রঙের পাখিদের বসন্তবিহার 
দেখছি আর একটু ক্লান্ত বোধ করতেই
মেঘ এসে জল খাইয়ে দিয়ে যায়
ভারী সুন্দর সে, তবুও খেলাঘর থেকে দূরে রাখে নিজেকে 
আমি আদর করে তার নাম রেখেছি মেঘছন্দা
 

#
এমন একটি নিকেতন এখানে যে
কোথাও কোন ইতিকথা নেই, বাক্য পঙ্গু হয়না
নেই কোন চিরবুভুক্ষার অন্তরদহন গান
ভারী শান্তি এখানে সর্বদা বিরাজিত 
কে আগুন জ্বালাতে বললো কে কার পাপকথা ধুইয়ে দিলো
কোথাও সেইসব কথার গুঞ্জন নেই এখানে
এখানে সুবাসিত ফুল ফোটে নিজের খেয়ালে
ভ্রমর আসে আপন রচিত গান নিয়ে 
 

#
আর এইসব আছে বলেই হয়তো
সুস্থ হয়ে উঠছি ক্রমশ অসমাপ্ত মৃত্যূকে পাশ ফিরিয়ে
                                             শুয়ে রেখে
 

#
ফিরে আসবো খুব শিগগিরই 
এমনটাই কথা দিয়েছি আমার জন্মদাগ লেগে থাকা
                                       প্রিয় বসুন্ধরাকে
 

#
চিনবে কী করে !
দেখবে, খোলা জানালায় কালোমেঘের ক্ষণ গর্জন থেকে 
ঝরে পড়ছি কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে
কিংবা বনসন্ধ্যার তুষারে তুষারে 
তোমারি অপেক্ষার আশেপাশে ফুল হয়ে ।
        

 

 

0 Comments
Leave a reply