লুপ্তপ্রায় লোকসঙ্গীত: ঘেটু গান

লিখেছেন:সুতপা সোহহং

 

"কয়ে থাকো যদি ব্যথার কথা
খুলে যাক যদি প্রাণ
নয়নের জলে ভিজায়ে হৃদয়
করে থাকোই যদি দান
এমনি মধুর চাঁদের আলোকে
কম্পিত হৃদি পলকে পলকে
অধরে অধরে পরশ মাখা
সুধা করে থাকো প্রাণ
তবে বধূ এসো হে
ধীরে এসে কাছে বসো হে –
এমন মধুর চাঁদিমা যামিনী
না হতে অবসান।"

 

ঘেটুগান, ছবিসূত্র - ইন্টারনেট (https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/numondal114/30238519) 

অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি নদ-নদী, হাওর-বাওড় বেষ্টিত ভাটি অঞ্চলে এক ধরনের প্রেম-বিরহের লোকগানের প্রচলন হয়েছিল, যা নৃত্য সহকারে পরিবেশন করা হত। এরই নাম ঘেটুগান। কেউ বলেন চারশো বছর, আবার কেউ বলেন দেড়শ বছর আগে এই গানের উৎপত্তি। বর্ষার মরসুমে হাওর অঞ্চল যখন জলে টইটম্বুর, তখন এই গানের দল নদীর বুকে নৌকো নিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘাটে ঘাটে নেমে কিংবা বড়ো নৌকা ঘাটে ভিড়িয়ে পাটাতনে বায়না নিয়ে নাচ দেখাত আর গান শোনাত, আর সেজন্যই এর নাম ‘ঘেটুগান’। ‘ঘাট’ থেকে ‘ঘেটু’ বা 'ঘাটু' শব্দটা এসেছে। মূলত ‘ঘেটুগান’ কৃষ্ণের বিরহে রাধার গান অর্থাৎ বিরহগীত হিসেবে গাওয়া হত, লোকসঙ্গীতের সুরে। এই গানগুলি 'মধুর', 'বিরহ' ও আদিরসে ছিল সমৃদ্ধ।

রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা ও দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র ঘটনা ছিল ঘাটু গানের বিষয়বস্তু। নেচে নেচে রাধা সেজে এই গান পরিবেশন করত সুদর্শন কিশোরেরা।  নাচে-গানে পারদর্শী কিশোর বালকেরাই 'ঘেটু’ নামে পরিচিতি পেত। তাদের পরনে থাকত রাধার পোশাক, অলঙ্কার, এমনকি পায়ে আলতা, ও চোখে কাজল। তাদের অঙ্গ ভঙ্গি সব‌ই হত মেয়েদের মতো। অভাবী ঘরের দেখতে-সুন্দর কিশোরদেরই এ-সব দলে নেওয়া হত, তালিম দেওয়া হত নাচগানের। তাদেরকে সবসময়ই মেয়েদের সাজে সাজিয়ে রাখা হত। এদের যুবতীসুলভ রূপ-লাবণ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, সুমধুর কণ্ঠ, অঙ্গভঙ্গি, নৃত্য প্রভৃতির মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখাটাই ছিল কাজ। 

ঘাটু গানের উৎপত্তি নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে প্রামাণ্য যে তথ্য জানা যায়, তা হল ষোল শতকের প্রথম দিকে শ্রীহট্টের আজমিরিগঞ্জ নিবাসী জনৈক বৈষ্ণবাচার্য শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে বিবাগী হন। পুরুষ দেহ ধারণ করলেও নিজেকে তিনি রাধার সাথে অভিন্ন সত্ত্বা বলে মনে করতেন। তাই বিরহিনী রাধাবেশে কৃষ্ণের আগমনের প্রতীক্ষায় দিন কাটাতেন। কৃষ্ণের প্রতি তাঁর এই সুগভীর প্রেম ও ভাবাবেশ সেসময়ের অনেককে আন্দোলিত করে। তার খ্যাতি ও পরিচিতি ধীরে ধীরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। নানা জায়গা থেকে লোক ভক্তির সন্ধানে তাঁর কাছে আসত এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করত। এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁর বহু শিষ্যদল গড়ে ওঠে। এই শিষ্যদের মধ্যে বালক-শিষ্যদের, বিশেষত সুদর্শন বালকদের রাধার সখী সাজিয়ে তাদের নিয়ে নেচে নেচে বিরহ সঙ্গীত গাওয়া হতো। ক্রমে ক্রমে নারীবেশী এই বালক-শিষ্যরা ঘাটু নামে পরিচিত হয় এবং এদের নিয়েই গড়ে ওঠে ঘাটুর দল।

অন্যমতে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ সন্নিকট কুশিয়ারার তীরে জলসুখা গ্রামে বিশেষ রীতির এই সঙ্গীতধারার প্রবর্তন হয় এক বৈষ্ণব আখড়াকে কেন্দ্র করে। আখড়াটির স্থাপনা আনুমানিক চারশো বছর আগে। স্থানীয়ভাবে পরিচিত গোপীনাথ জিউর আখড়া নামে। এটা জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের আখড়া। আর এই সম্প্রদায়ের মাঝে মূর্তিপূজার প্রচলন নেই। তাই বিগ্রহও নেই। সেই কারণেই এই স্থাপনা মন্দির নয়, আখড়া নামে পরিচিত। অনেকে এই আখড়াতেই প্রথম ঘেটু গানের উৎপত্তি বলে মনে করেন। 

ঘাটু গানের উৎপত্তির বিষয়ে আর এক রকম অনুমানও করা হয়। গুজরাটের নিম্নশ্রেণির লোকেরা সুন্দর দেখতে বালকদের নাচ-গান শিখিয়ে, তাদের মেয়েদের পোশাক ও অলঙ্কার পরিয়ে আমোদ করত। স্থানীয় ভাষায় এই ছেলেদের দলকে বলা হত 'গান্টু'। সেখান থেকে বৃন্দাবন হয়ে গঙ্গার তীর ধরে রাজমহল পর্যন্ত নিম্নশ্রেণির চাষা ও কুলিমজুরদের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন হয়। এছাড়া ঘাটুগানের বেশ কিছু রূপমূল বা শব্দমূলের সাথে গান্টু গানের রূপমূলতাত্তিক (morphological) সাদৃশ্য ও সম্পর্কের কারণেও অনেকে গুজরাট কিংবা উল্লিখিত অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যেই ঘাটুগানের উদ্ভবের ইতিহাস খোঁজ করেছেন। 

প্রসঙ্গত, পশ্চিমা কুলিদের মধ্যে উচ্চারিত হয় ‘গান্টু’। এটি একটি আঞ্চলিক শব্দ। এই শব্দের মূল অনুসন্ধান করলে আমরা দুটি শব্দ পাই, 'গান' আর ‘ঘাট’। গান+টু—গান্টু>গাঁটু; আর ঘাট+উ—ঘাটু।” অঞ্চলভেদে ‘ঘাটু’ শব্দটির উচ্চারণগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এরকমই কিছু উচ্চারণ হল - "ঘাঁটু", "ঘেটু", "ঘেঁটু", "গেন্টু", "ঘাডু", "গাড়ু", "গাঁটু", "গাডু" ইত্যাদি। যেমন: সুনামগঞ্জ অঞ্চলে ‍একে ‘ঘাডু’ বলে। নেত্রকোণা অঞ্চলে ‍এটি ‘গাডু’ নামে পরিচিত। শিক্ষিতজনরা ‘ঘাটু’ বলেন। তবে 'ঘাট' থেকে শব্দটি যে এসেছে, এই মতামতই বেশি জনপ্রিয়।

ঘাটু বা ঘেটু গানে রাধাকৃষ্ণের কাহিনী বর্ণিত হ‌য়। এই গানে লৌকিক ও আদিরসের প্রাধান্য থাকলেও ভক্তিরস ও মধুর রসের‌ও উপস্থিতি ছিল। পরবর্তী সময়ে শুধু হিন্দুদের মধ্যেই এই গান সীমাবদ্ধ থাকেনি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝি মাল্লারাও এতে অংশগ্রহণ করাতে এই গান প্রেমিকের বিরহে প্রেমিকার বিরহগীতিতে পরিণত হয়েছিল, যা ছিল মূলত আদিরসে পরিপূর্ণ । 

শুরুতে এই লোকগীতি ছিলো মন্দির কেন্দ্রিক, অর্থাৎ মন্দিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়া হত। কিন্তু ক্রমে ঘেটুগানের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের তরুণদের মধ্যে। ফলে গ্রামে গ্রামে গঠন হয় সৌখিন ও পেশাদার ঘেটু দল। কালক্রমে ঘেটু দল গঠন করতে শুরু করে সৌখিন মুসলিমরাও। দুই সম্প্রদায়ের ঘেটু দল প্রতিযোগিতার সময় বাছ বিচার, বিধি নিষেধ কিছুই থাকত না। ফলে ঘেটুগানকে কেন্দ্র করে এক নিরপেক্ষ সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল। ভাটি অঞ্চলে এই ঘেটুপ্রীতি রূপ পায় উন্মাদনায়। 

সুশ্রী চেহারার গরীব ঘরের কিশোরদের কিনে নিয়ে আসা হতো পিতামাতার কাছ থেকে। অভিজাত শ্রেণির মধ্যে এ নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা হত যে কোন জমিদার কত সংখ্যক ঘেটু বালক কিনতে পারে এবং তার সাথে সেই ঘেটু বালকদের রূপের সৌন্দর্য, নাচ গানের দক্ষতা নিয়েও প্রতিযোগিতা হত। এক্ষেত্রে সুন্দর ঘেটু বালক নিয়ে দ্বন্দ ও রেষারেষির‌ কথাও শোনা যায়। ফলে কেনার সময় দলিল দস্তাবেজ করা হতো রীতিমতো। ঘেটু গানের আসরের খরচ যোগাতে যুবকরা গোপনে বিক্রি করতো গোলার ধান আর গোয়ালের গরু। মায়ের অলঙ্কার, জমিজমাও বেঁচে দেওয়ার মতো দৃষ্টান্ত রয়েছে। ঘেটু গান নিয়ে অবিবাহিত কিশোর, তরুণ এবং কিছু বিত্তবানদের মধ্যে সর্বক্ষণের মাতামাতি ছিলো । এখানকার সিনেমার তারকার মতো সুশ্রী চেহারার কিশোর তরুণেরা জনপ্রিয় হয়ে মর্যাদা পেত ঘেটু তারকার। তারকা ঘেটুবালকের বাঁশি নিলামে পর্যন্ত বিক্রি হতো। ঘেটুগানের খবর পেলে মা বাবা মুরুব্বীরা তাই ঠ্যাঙ্গাতে আসতো লাঠি নিয়ে। ধরা পড়লে শাস্তি দেয়া হতো পঞ্চায়েতে নাকে খত দিয়ে। এই গানের আসরের আয়োজন হতো তাই গোপনে গভীর রাতে।

যেহেতু ভরা বর্ষায় চারিদিকে জল থৈ থৈ করত, বাড়ি থেকে বের হওয়া ও আনন্দ ফূর্তি সম্ভব হত না সেসময়। ফলে সেকালের অভিজাতশ্রেণির মানুষেরা অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য বাড়িতে ঘেটুগানের আসর বসাতেন। রাধারূপী ঘেটুপুত্রকে মনে ধরলে, তাকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে রেখে দিতেন। এই সময়টায় ঘেটুপুত্রদের সেই অভিজাত মানুষটির নিয়মিত শয্যাসঙ্গী‌ও হতে হতো। পরবর্তীতে এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান যুগে সমকামীতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও তখন এই প্রথার বিপক্ষে সমাজ কোন প্রশ্ন তোলেনি কিংবা তুলবার সাহস করেনি। বাড়ির স্ত্রীরাও এটা মেনে নেন বা মেনে নিতে বাধ্য হন। তারা ঘেটুপুত্রদের সতীনের চোখেই দেখতেন এবং ‘সতীন’ বলে ডাকতেও শুরু করেন। ষাট-সত্তর বছর আগেও এই প্রথার বেশ চল ছিল। ফলে অভিজাত শ্রেণির স্ত্রীরা তাদেরকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন এবং কখনো কখনো এর ফল ভালো হত না। বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক ও চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের শেষ ছবি "ঘেটুপুত্র কমলা" তে এমন‌ই এক ঘেটুপুত্রের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে যেখানে শেষ পর্যন্ত জমিদারের স্ত্রীর ঈর্ষায় ও পরিকল্পনায় ঘেটুপুত্রের মৃত্যু হয়েছে। ঘেটু বালকদের জীবন মোটেও সহজ ছিল না। খুব অল্প বয়স থেকে নাচ গানের তালিম শুধু নয় মেয়েদের মত গলার স্বর, ভাব ভঙ্গী করতে ও পোষাক পরতে তাদের বাধ্য করা হত। তারা ছিল অনেকটা অভিজাত শ্রেণীর রক্ষিতাদের মতো। রাতে জমিদারদের শয্যা সঙ্গিনী হ‌ওয়া ছাড়াও তাদের নিজেদের জীবনে নিজের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। গরীব বাবা মায়ের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার পর তাদের আর বাবা মায়ের কাছে ফেরত যেতে দেওয়া হত না। বেশিরভাগ সময় পরিবারের সাথে দেখা সাক্ষাৎ‌ও করতে দেওয়া হত না। তবে এতেই ওরা অভ্যস্ত ছিল কারণ এরা বংশপরম্পরায় ঘাটু গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। তবে বংশ পরম্পরায় হলেও বিশেষ সেই সঙ্গীত ধারাতে সুন্দর পোশাক পরে কিছু সুদর্শন মুখের ছাত্রদের নাচগান করার জন্য নির্বাচন করা হত। এই ছাত্রদের আঞ্চলিক ভাষাতে বলা হত ঘেটুপাখ। ঘেটু বালকদের এই বিশেষ লোকসঙ্গীত ধারার সুরে কীর্তন করা শিখতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে হত।   

 

ঘেটুপুত্র কমলা সিনেমার পোস্টার (ছবি - উইকিপিডিয়া) 

ঘাটু দলের প্রধান অর্থাৎ মূল গায়েনকে বলে ‘সরকার’। এ গানে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হয় ঢোল, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়াম, বেহালা, সারিন্দা, মন্দিরা, করতাল প্রভৃতি। ঘাটু গানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক গ্রামের জোতদাররা এবং এর প্রধান কর্মী সমকামী যুবকরা। সাধারণত এক একটি ঘাটু দলে একজন সর্দার, একজন সুগায়ক (সে একাধারে নৃত্য ও সংগীত প্রশিক্ষক), একজন ঘাটুছেলে (যে বাচ্চা ছেলেটি মেয়ে সেজে নৃত্য পরিবেশন করতো), আর পাঁচ থেকে সাত জন বাজনদার থাকতো।

ভাদ্রমাসের প্রথম দিন মনসার ভাসান উপলক্ষ্যে বড়ো হাওরের পূর্ব-প্রান্তবর্তী 'নিকলি' নামক জায়গায় শত শত ঘাটুর নৌকা এসে সমবেত হত। বিজয়া-উৎসবের দিনও আগে কোন কোন অঞ্চলে ঘাটুগানের বিশেষ সমারোহ হত, কিন্তু পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিজয়া-উৎসব চেয়ে মনসার ভাসান উৎসবই বেশি জনপ্রিয় বলে এই উপলক্ষ্যে এখন‌ও ঘেটু গানের আসর বসে। ঘাটু দলের যে গান গাওয়া হয় তার দুটি ধারা। একটি ঘাটু সম্প্রদায়ের সমবেত সঙ্গীত। অন্যটি ঘাটুর একটি বৈঠকী সঙ্গীত। তাই, ঘাটু গানকে অঞ্চল বিশেষে বৈঠকী গানও বলা হয়। যখন দুই ঘেটু বা ঘাটু দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় তখন একদল প্রশ্ন করে আরেকদল উত্তর দেয়। প্রতিযোগিতামূলক গানকে সাধারণত দুইটি প্রধান অংশে ভাগ করা হয় (১) প্রকাশ্য (২) ছাপা। প্রকাশ্য ঘাটু গান আসরের সকলেই বুঝতে পারে। আর ছাপা ঘাটু গান গায়ক এবং বয়াতি ব্যতীত আর কেউই বুঝতে পারে না। প্রকাশ্য ঘাটু গানের প্রতিযোগিতায় জয়-পরাজয় থাকে। যে দলের ঘাটুর বালক বেশি প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে তারই জয় হয়। আর অপর দলটি পরাজয় মেনে নেন। সেক্ষেত্রে পরাজিত দল সে জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে বাধ্য হয়। 

ঘাটু গানের প্রশ্নোত্তরে একজন থাকে রাধার ভূমিকায়। আর অপর জনের পালা থাকে কৃষ্ণের ভূমিকা। রাধার প্রশ্নমূলক একটি গান এরকম–

"শ্যাম বুঝাইয়া দে
শাতালী পর্বতের নীচে
কৃষ্ণ নামে গো
মালা কে জপে
ও কৃষ্ণের নামে মালা কে জপে।"

কৃষ্ণের পালা গাইতে গিয়ে রাধার প্রশ্নের গানের মাধ্যমে উত্তর দেয়–

"রাই বুঝাই তোরে শাতালী পর্বতের নীচে
মহাদেবে মালা জপতাছে।
চান্দের মরণ আসে গো মাসে।
সূর্য্যরে মরণ কাবার ঘরে
রবি শশী গো আকাশে আকাশে ঘুরে।"

প্রশ্নোত্তর ঘাটু গানে হালকা প্রেম রসের অনেক গানও গাওয়া হয়। গানের কথায় অনেক খোলামেলা অশ্লীলতা প্রকাশ পায় কারণ ঘেটুর শ্রোতারা সব নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত মানুষ জন। তাই তাদের আকর্ষণের জন্য আদিরসের প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়। প্রশ্নোত্তর জাতীয় গান ছাড়া ঘাটু গানের আসরে যে সব গান গাওয়া হয় সেগুলিকে সাধারণত ‘ছম’ গান বলা হয়। ছম গান আবার বিভিন্ন প্রকারের। যেমন: মুরলী, রঙবাউলা, বিচ্ছেদ, জলভরা, সন্ন্যাস ইত্যাদি। ঘাটুর ‘মুরলী’ গান নিম্নে উল্লেখ করা হল।

"শ্যামের হাতের মোহনও বাঁশি
রাধা বলে বেজো না।
হায় রে শ্যামের হাতের মোহন বাঁশি গো
ও রাধা বলে বেজো না।
যে না শ্যামের বাঁশি গো তুমি
সেই না শ্যামের দাসী গো আমি
চিন না তুমি।
শুকনা বাঁশের বাঁশি হইয়া গো
নারী বেদন জান না।
ঐ নারী বেদন জান না গো নারী বেদন জান না।"

ঘাটু গান গভীর প্রেম-বিরহের গান। বিরহের আগুনে রাধা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তার উপর তার প্রিয় বন্ধু শ্যামের বংশীধ্বনি তাকে ব্যাকুল করে ঘর ছাড়া করতে চায়। সামাজিক গৃহ সংসারে আবদ্ধ নারীর জন্য তা কতটা বেদনার ও কষ্টের তাই এখানে ঘেটু গানের উপজীব্য বিষয়। রাধা কী কী প্রকারে বিলাপ করছেন, কৃষ্ণের জন্য কেমন আকুল হচ্ছেন, বাঁশিকে দোষারোপ করছেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে গানগুলো।

ঘাটু গানের মধ্যে এক রকম ছম গান আছে যাতে সংসার ধর্মের প্রতি সুস্পষ্ট বৈরাগ্যের ভাব প্রকাশ পায়। যেমন,

"যাইগারে পরাণের বন্ধু
বন্ধু যাই তোমারে থুইয়া
যাই তোমারে ধুইয়া বন্ধুরে
যাই তোমারে থুইয়া।
এই বন্ধু গেল দূর দ্যাশে
পাখি গেল তার তালাশে
আর কতকাল থাকবো আমি
পাখির প্রাণে চাইয়ারে।
বন্ধু যাই তোমাদের থুইয়া
যাই তোমারে থুইয়ারে বন্ধু যাই তোমারে থুইয়া।"

এছাড়াও কয়েকটি বিখ্যাত ঘাটু বা ঘেটু গানের উদাহরণ:

ক) বাজে বংশী রাজহংসী নাচে
দুলিয়া দুলিয়া,
নাচে পেখমও মেলিয়া।।
ঝুমুর ঝুমুর ঝুমুর ঝুমুর
ঝুমুর ঝুমুর ঝুম।(২)
রাজহংসীর চোখ কালো
তারে দেখে লাগলো ভালো,
সেই বিহনে জগৎ কালো সবই অন্ধকার
তার নাচে ভূবণ নাচে আহা! কি বাহার......ঐ

 

খ) আমার মনের বেদনা
সে বিনে কেউ জানে না
কালা যখন বাঁজায় বাঁশি
তখন আমি রান্তে বসি
বাঁশির সুরে মন উদাসী
ঘরে থাকতে পারি না
আমার মনের বেদনা
সে বিনে কেউ জানে না।

 

গ) শুয়া উড়িল উড়িল জীবেরও জীবন
শুয়া উড়িল উড়িল রে,
আরলাম আকানে ছিলা আনন্দিত মন
ভবে আসি পিঞ্জরাতে হইলা বন্ধন।(ঐ)
নিদয়া নিষ্ঠুর পাখি দয়া নাই রে তোর
পাষাণ সমান হিয়া কঠিন অন্তর।

 

ঘ) রাই বুঝাই তোরে ঘাটুর জন্ম ভাওয়াইলের দ্যাশে
যখন ঘাটু দ্যাশে আইল, ছোট ভাই মোর পাগল হইল
হালের বলদ গোহাইলে রইল।
ঐ হালের বলদ গোহাইলে রইল গো
হালের বলদ গোহাইলে রইলো।।

 

ঙ) নারী তো বেইমানের জাত গো
তোর বাড়ি আর যাইমু না
রাই বলে-পুরুষ তো বেইমানের জাত গো
আসবার কইয়া আইল না।
পয়সার কথা কইয়ারে কইয়া
প্রেম করিল শুইয়ারে শুইয়া
পয়সা দিল না।

 

চ) তুই আমারে চিনলে নারে
আমি তো রসের কমলা।
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি
মধ্যে নলের বেড়া।

 

ছ) ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু
পান খাইলায়না
এক বালিশে দুইটি মাথা
সুন্দর কইরা কওরে কথা।

ঘেটু গান বা ঘাটু গান এখন কালের অতলে হারিয়ে গেলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। যেহেতু বিশেষ অঞ্চলসমূহের লোকজীবন, লোকভাব ও লোকভাষার প্রতিফলন ঘাটুগানের মধ্যে পাওয়া যায় সেহেতু সেইসব অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের অনুষঙ্গ এতে ধরা পড়ে। এখনো কোথাও কোথাও ঘেটু গানের আসর সখের বশে বসলেও এর জনপ্রিয়তা কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে। ফলে এই বিলুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারী পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টার আশু প্রয়োজন।

 

তথ্যসূত্র:

১) "ঘাটুগান ঘাটুসংস্কৃতি" : জফির সেতু

২) "ফোকলোর চর্চায় সিলেট" : নন্দলাল শর্মা

৩) "ঘাটুগান ঐতিহ্যে - ঐশ্বর্যে " : মোহাম্মদ হক নিয়োগী

৪) "বাংলার লোক সংস্কৃতি " : ওয়াকিল আহমদ

 

0 Comments
Leave a reply